বিভুরঞ্জন সরকার
আগস্ট মাস এলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনসংগ্রাম, তাঁর ত্যাগ-তিতিক্ষা, বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র গঠনে তাঁর অসামান্য অবদান নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি তাঁর নির্মম হত্যাকাণ্ড নিয়েও কথা হয়। তাঁকে সরাসরি যে ঘাতক দল হত্যা করেছে, তাদের কথা সবাই জানলেও নেপথ্যে কার কী ভূমিকা ছিল; কে, কীভাবে ঘাতকদের নৈতিক সহযোগিতা দিয়েছিল এবং কীভাবে কারা স্বাধীনতার পর থেকে অব্যাহতভাবে নানা ষড়যন্ত্রমূলক অপতৎপরতার মাধ্যমে পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল, সে বিষয়গুলো এখনো পরিষ্কার হয়নি। এসব বিষয়ে হয়নি কোনো বিশ্বাসযোগ্য গবেষণা। বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতাসীনেরা তাদের সুবিধামতো তথ্য তৈরি করে প্রচার করেছে। এতে মানুষের মনে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে, ইতিহাস বিকৃত হয়েছে।
ইতিহাসের সত্য সন্ধানে আমাদের আগ্রহ কম। ইতিহাসের নামে কখনো কখনো কল্পগল্পও আমরা বানিয়ে থাকি। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হঠাৎ কোনো ঘটনায় হয়নি, কোনো ব্যক্তি হুইসেল বাজিয়েছেন আর মানুষ জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, বিষয়টি মোটেও তেমন নয়। এর পেছনে রয়েছে দীর্ঘ এবং ধারাবাহিক নানা ছোট-বড় রাজনৈতিক সংগ্রাম। বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডের রাজনৈতিক সংগ্রামের ধারাবাহিক এই সংগ্রামের প্রধান নেতা বা কান্ডারি অবশ্যই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর সঙ্গে তুলনীয় না হলেও আরও অনেক নেতা-কর্মীর শ্রম ও নিষ্ঠার কথাও অস্বীকার করা ঠিক হবে না। আওয়ামী লীগ দল হিসেবে নেতৃত্বের অবস্থানে থাকলেও আরও দু-চারটি দলও কম অবদান রাখেনি। বঙ্গবন্ধুসহ আওয়ামী লীগের অনেকে যেমন জেল-জুলুমের শিকার হয়েছেন, তেমনি অন্য বাম-প্রগতিশীল দলের নেতারাও জেল-নিগ্রহের বাইরে ছিলেন না। সবার অবদানের কথা একভাবে না হলেও যার যার অবস্থান অনুযায়ী উল্লেখ থাকা প্রয়োজন। ইতিহাস রচনায় সত্যনিষ্ঠ হয়ে ভারসাম্য রক্ষা করতে ব্যর্থ হলে একসময় ইতিহাসই আমাদের বিদ্রূপ করবে।
এ ভূমিকাটি করা হলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ২৬ আগস্টের বক্তৃতার পরিপ্রেক্ষিতে। জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের দুই অংশের আয়োজিত আলোচনা সভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি আওয়ামী লীগের নেতাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেছেন, ‘আমাদের বাসায় যখন গুলি শুরু হয়, বঙ্গবন্ধু কিন্তু সবাইকে ফোন করেছিলেন। আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে কথা হয়, তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে কথা হয়, সেনাপ্রধান সফিউল্লাহর সঙ্গে কথা হয়। এ রকম একটা ঘটনার পর আমাদের দল, সমর্থক, মুক্তিযোদ্ধাদের যে ভূমিকা ছিল, তা হয়তো তারা করতে পারেনি। সেনাবাহিনীরও যার যা ভূমিকা ছিল, তারাও সঠিকভাবে তা (পালন) করেনি। এর পেছনের রহস্যটা কী? সেটাই প্রশ্ন।’
সত্যি, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ৪৬ বছর হতে চলল অথচ এই দীর্ঘ সময় পরেও ‘পেছনের রহস্য’ উন্মোচিত হলো না। এটা দুঃখজনক এবং এই ব্যর্থতার দায় আমাদের সবার। বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ ঘাতকদের বিচার হয়েছে, কয়েকজন ফাঁসির দড়িতে ঝুলেছেন। কয়েকজন এখনো পলাতক কিংবা অজ্ঞাতবাসে আছেন। অন্তত দুজনের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু নেপথ্যে ভূমিকা পালনকারীদের খোঁজে কোনো বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। আওয়ামী লীগ টানা তিন মেয়াদে সরকারে থাকা সত্ত্বেও এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ না নেওয়ার বিষয়টিও প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়। তবে দলের ভূমিকা নিয়ে এত দিন পর দলীয়প্রধান, প্রধানমন্ত্রী এবং বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা প্রশ্ন তোলায় অনেকের কাছেই বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিয়েছিলেন খোন্দকার মোশতাক আহমেদ। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার কয়েকজন বাদে আর সবাই মোশতাকের মন্ত্রিসভায় শপথ নিয়েছিলেন। বিষয়টি মোটেও স্বাভাবিক এবং প্রত্যাশিত ছিল না। এখন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে মোশতাকের সহযোগী হিসেবে তৎকালীন সেনাবাহিনীর উপপ্রধান জিয়াউর রহমানকে অভিযুক্ত করা হলে বিএনপির পক্ষ থেকে উল্টো বলা হয়, শেখ মুজিবকে আওয়ামী লীগই হত্যা করেছে। এত দিন পর শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের তখনকার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলায় এ বিষয়ে নতুন আলোচনা এবং বিতর্ক তৈরির পথ সুগম হলো।
প্রশ্ন হলো, শেখ হাসিনা কেন দল, দলের কয়েকজন নেতার নাম উল্লেখ করে বক্তৃতা করলেন? এটা যে দলের মধ্যেও প্রতিক্রিয়া তৈরি করবে, সেটা দলীয়প্রধান অবশ্যই বোঝেন। তিনি বুঝেশুনে কেন বঙ্গবন্ধু হত্যায় দলের ভূমিকার বিষয়টি সামনে আনলেন? শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতির পদে আছেন চার দশক হয়ে গেল। এই দীর্ঘ সময় নিশ্চয়ই তাঁকে ক্ষতবিক্ষত করেছে এই সব প্রশ্ন। যে নেতাদের ভূমিকা নিয়ে তাঁর মনে প্রশ্ন আছে, তাঁদের নিয়েই তো তিনি চলেছেন। তাঁদের দলের গুরুত্বপূর্ণ পদ দিয়েছেন, একাধিকবার মন্ত্রীও বানিয়েছেন। তিনি কি নিরুপায় হয়ে এটা করেছেন, নাকি তাঁদের মনমানসিকতা পরিবর্তনের সুযোগ দিয়েছেন? কোনো কারণে কি এখন তাঁর মনে হয়েছে যে পঁচাত্তরে নীরব ভূমিকা পালনকারীরা এখনো দলের জন্য নির্ভরযোগ্য হয়ে ওঠেননি?
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বক্তৃতা করার দুদিন আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সচিবালয়ে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘আমি বঙ্গবন্ধুকে হত্যার আগের বাংলাদেশকে দেখেছি। ১৫ আগস্টের পরের ছবিও দেখেছি। আমার ভয় হয় যখন আমি সচিবালয়ের আশপাশে বিলবোর্ড, পোস্টার আর ব্যানারের ছড়াছড়িতে আকাশ পর্যন্ত ঢেকে গেছে—এমন পরিবেশ দেখি। চোখের পলকে ১৫ আগস্ট ঘটে গেল, যাদের দেখতাম নব্য আওয়ামী লীগার সেজে মুজিব কোট পরত, ১৫ আগস্টের পর মুজিব কোট লুকানোর দৃশ্যপটও ভুলিনি। আজ সারা বাংলাদেশের যত্রতত্র অনেকেই বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল তুলেছে। যদি হঠাৎ চোখের পলকে কোনো অঘটন ঘটে যায়, তখন কী এসব ম্যুরাল রাখবেন। যাঁরা ম্যুরাল স্থাপন করেছেন তাঁরাই ভেঙে ফেলবেন। এই দৃশ্যপট অনেক দেখেছি।’
ওবায়দুল কাদের আরও বলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগ করি, আপনারা যদি আমার চেয়েও বড় আওয়ামী লীগার হন, তাহলে দুঃখ লাগে। এখন অনেকেই নব্য আওয়ামী লীগার আমাদের চেয়েও যেন বড় আওয়ামী লীগার। কথায় কথায় বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনার প্রশংসা করেন। কিন্তু এটা কী মনের কথা? অনেককেই দেখেছি ১৫ আগস্টের আগে কী বক্তব্য দিয়েছেন। ১৫ আগস্ট ঘটার পর রাতারাতি ভোল পাল্টে ফেলেছে। এই ভোল পাল্টানো আওয়ামী লীগারদের আমার প্রয়োজন নেই।’
সরকার এবং দলের দুজন শীর্ষ ব্যক্তির এই দুই বক্তৃতা এক করলে মানুষের সামনে বিশেষ কোনো অবস্থা, ‘কোনো অঘটন ঘটার’ আশঙ্কা কি তৈরি হয়? বঙ্গবন্ধুর প্রতি কৃত্রিম এবং অকৃত্রিম দরদিদের আলাদা করার কাজটি কেন করা হয়নি বা হয় না?
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ রেকর্ড সময় ধরে ক্ষমতায় আছে। দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতিও হচ্ছে। বাংলাদেশের সমৃদ্ধি চোখে পড়ছে দেশের বাইরেও। তার মানে কিন্তু এটা নয় যে যেভাবে চলছে, তার থেকে ভালো চলার কিছু নেই। সরকার এবং সরকারি দলের ভেতরেও অবশ্যই সমস্যা আছে। নানাভাবে তার বিকৃত বহিঃপ্রকাশও ঘটে। দায় এড়ানোর একটি অসুস্থ প্রবণতা প্রায়ই দেখা যায়। আবর্জনা কার্পেটের নিচে লুকিয়ে রেখে বাইরে থেকে সবকিছু ফিটফাট দেখানোর আত্মঘাতী প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
ভেতরের সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠতে পারলে দেশ আরও ভালো চলবে। দেশে যে আয়বৈষম্য, ধনবৈষম্য বাড়ছে, তা অস্বীকার করা যাবে না। সরকারে থেকে, সরকারি দলের আশ্রয়ে থেকে আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার তথ্য গোপন করার মতো বিষয় নয়। শুধু কোটিপতির সংখ্যা বৃদ্ধি নয়, উচিত কথা বলার মতো লোকের সংখ্যা যেন দেশে বাড়ে এবং উচিত কথা শুনে গায়ে জ্বলুনি ধরা লোকের সংখ্যা যেন কমতে থাকে। উদারতা এবং সহনশীলতার মাত্রা না বাড়লে দেশের উন্নয়নযাত্রা কাঙ্ক্ষিত ফল দেবে না।
আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আদর্শে পরিচালিত রাজনৈতিক দল। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির মূল লক্ষ্য ছিল ‘বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো’। মুষ্টিমেয় মানুষের মুখে হাসি থাকলে, বেশি মানুষের জীবন যন্ত্রণাময় হলে, আওয়ামী লীগের রাজনীতি সঠিক পথে চলছে–বলা যাবে কি? একদিকে নারীর ক্ষমতায়ন বাড়ার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, অন্যদিকে প্রতিদিন ঘরে-বাইরে নারী নিগ্রহ-ধর্ষণ-নিপীড়ন-হত্যার খবর মোটেও সামাজিক সুস্থিতির পরিচয়বাহী নয়।
আওয়ামী লীগের মধ্যে কারা তাঁর প্রকৃত সুহৃদ, কারা আস্তিনের নিচে ছুরি লুকিয়ে রেখেছে, তা বঙ্গবন্ধুর অজানা ছিল না। তাঁর বিরুদ্ধে যে দলের ভেতরে এবং বাইরে কিছু সন্দেহজনক ভূমিকা চলছিল, সে তথ্যও বঙ্গবন্ধুর জানার বাইরে ছিল না। কিন্তু সবাইকে নিয়ে চলার উদারতার পরিণামে তাঁকে বুকের রক্ত দিতে হয়েছে। আওয়ামী লীগের ভেতরে একটি বড় শুদ্ধি অভিযানের সময় এখন আবার দুয়ারে কড়া নাড়ছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন। শেখ হাসিনাও কি সেটা ভেবেই বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর দলের ভূমিকার বিষয়টি সামনে আনলেন?
লেখক: সহকারী সম্পাদক
আজকের পত্রিকা
আগস্ট মাস এলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনসংগ্রাম, তাঁর ত্যাগ-তিতিক্ষা, বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র গঠনে তাঁর অসামান্য অবদান নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি তাঁর নির্মম হত্যাকাণ্ড নিয়েও কথা হয়। তাঁকে সরাসরি যে ঘাতক দল হত্যা করেছে, তাদের কথা সবাই জানলেও নেপথ্যে কার কী ভূমিকা ছিল; কে, কীভাবে ঘাতকদের নৈতিক সহযোগিতা দিয়েছিল এবং কীভাবে কারা স্বাধীনতার পর থেকে অব্যাহতভাবে নানা ষড়যন্ত্রমূলক অপতৎপরতার মাধ্যমে পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল, সে বিষয়গুলো এখনো পরিষ্কার হয়নি। এসব বিষয়ে হয়নি কোনো বিশ্বাসযোগ্য গবেষণা। বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতাসীনেরা তাদের সুবিধামতো তথ্য তৈরি করে প্রচার করেছে। এতে মানুষের মনে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে, ইতিহাস বিকৃত হয়েছে।
ইতিহাসের সত্য সন্ধানে আমাদের আগ্রহ কম। ইতিহাসের নামে কখনো কখনো কল্পগল্পও আমরা বানিয়ে থাকি। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হঠাৎ কোনো ঘটনায় হয়নি, কোনো ব্যক্তি হুইসেল বাজিয়েছেন আর মানুষ জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, বিষয়টি মোটেও তেমন নয়। এর পেছনে রয়েছে দীর্ঘ এবং ধারাবাহিক নানা ছোট-বড় রাজনৈতিক সংগ্রাম। বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডের রাজনৈতিক সংগ্রামের ধারাবাহিক এই সংগ্রামের প্রধান নেতা বা কান্ডারি অবশ্যই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর সঙ্গে তুলনীয় না হলেও আরও অনেক নেতা-কর্মীর শ্রম ও নিষ্ঠার কথাও অস্বীকার করা ঠিক হবে না। আওয়ামী লীগ দল হিসেবে নেতৃত্বের অবস্থানে থাকলেও আরও দু-চারটি দলও কম অবদান রাখেনি। বঙ্গবন্ধুসহ আওয়ামী লীগের অনেকে যেমন জেল-জুলুমের শিকার হয়েছেন, তেমনি অন্য বাম-প্রগতিশীল দলের নেতারাও জেল-নিগ্রহের বাইরে ছিলেন না। সবার অবদানের কথা একভাবে না হলেও যার যার অবস্থান অনুযায়ী উল্লেখ থাকা প্রয়োজন। ইতিহাস রচনায় সত্যনিষ্ঠ হয়ে ভারসাম্য রক্ষা করতে ব্যর্থ হলে একসময় ইতিহাসই আমাদের বিদ্রূপ করবে।
এ ভূমিকাটি করা হলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ২৬ আগস্টের বক্তৃতার পরিপ্রেক্ষিতে। জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের দুই অংশের আয়োজিত আলোচনা সভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি আওয়ামী লীগের নেতাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেছেন, ‘আমাদের বাসায় যখন গুলি শুরু হয়, বঙ্গবন্ধু কিন্তু সবাইকে ফোন করেছিলেন। আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে কথা হয়, তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে কথা হয়, সেনাপ্রধান সফিউল্লাহর সঙ্গে কথা হয়। এ রকম একটা ঘটনার পর আমাদের দল, সমর্থক, মুক্তিযোদ্ধাদের যে ভূমিকা ছিল, তা হয়তো তারা করতে পারেনি। সেনাবাহিনীরও যার যা ভূমিকা ছিল, তারাও সঠিকভাবে তা (পালন) করেনি। এর পেছনের রহস্যটা কী? সেটাই প্রশ্ন।’
সত্যি, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ৪৬ বছর হতে চলল অথচ এই দীর্ঘ সময় পরেও ‘পেছনের রহস্য’ উন্মোচিত হলো না। এটা দুঃখজনক এবং এই ব্যর্থতার দায় আমাদের সবার। বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ ঘাতকদের বিচার হয়েছে, কয়েকজন ফাঁসির দড়িতে ঝুলেছেন। কয়েকজন এখনো পলাতক কিংবা অজ্ঞাতবাসে আছেন। অন্তত দুজনের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু নেপথ্যে ভূমিকা পালনকারীদের খোঁজে কোনো বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। আওয়ামী লীগ টানা তিন মেয়াদে সরকারে থাকা সত্ত্বেও এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ না নেওয়ার বিষয়টিও প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়। তবে দলের ভূমিকা নিয়ে এত দিন পর দলীয়প্রধান, প্রধানমন্ত্রী এবং বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা প্রশ্ন তোলায় অনেকের কাছেই বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিয়েছিলেন খোন্দকার মোশতাক আহমেদ। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার কয়েকজন বাদে আর সবাই মোশতাকের মন্ত্রিসভায় শপথ নিয়েছিলেন। বিষয়টি মোটেও স্বাভাবিক এবং প্রত্যাশিত ছিল না। এখন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে মোশতাকের সহযোগী হিসেবে তৎকালীন সেনাবাহিনীর উপপ্রধান জিয়াউর রহমানকে অভিযুক্ত করা হলে বিএনপির পক্ষ থেকে উল্টো বলা হয়, শেখ মুজিবকে আওয়ামী লীগই হত্যা করেছে। এত দিন পর শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের তখনকার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলায় এ বিষয়ে নতুন আলোচনা এবং বিতর্ক তৈরির পথ সুগম হলো।
প্রশ্ন হলো, শেখ হাসিনা কেন দল, দলের কয়েকজন নেতার নাম উল্লেখ করে বক্তৃতা করলেন? এটা যে দলের মধ্যেও প্রতিক্রিয়া তৈরি করবে, সেটা দলীয়প্রধান অবশ্যই বোঝেন। তিনি বুঝেশুনে কেন বঙ্গবন্ধু হত্যায় দলের ভূমিকার বিষয়টি সামনে আনলেন? শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতির পদে আছেন চার দশক হয়ে গেল। এই দীর্ঘ সময় নিশ্চয়ই তাঁকে ক্ষতবিক্ষত করেছে এই সব প্রশ্ন। যে নেতাদের ভূমিকা নিয়ে তাঁর মনে প্রশ্ন আছে, তাঁদের নিয়েই তো তিনি চলেছেন। তাঁদের দলের গুরুত্বপূর্ণ পদ দিয়েছেন, একাধিকবার মন্ত্রীও বানিয়েছেন। তিনি কি নিরুপায় হয়ে এটা করেছেন, নাকি তাঁদের মনমানসিকতা পরিবর্তনের সুযোগ দিয়েছেন? কোনো কারণে কি এখন তাঁর মনে হয়েছে যে পঁচাত্তরে নীরব ভূমিকা পালনকারীরা এখনো দলের জন্য নির্ভরযোগ্য হয়ে ওঠেননি?
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বক্তৃতা করার দুদিন আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সচিবালয়ে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘আমি বঙ্গবন্ধুকে হত্যার আগের বাংলাদেশকে দেখেছি। ১৫ আগস্টের পরের ছবিও দেখেছি। আমার ভয় হয় যখন আমি সচিবালয়ের আশপাশে বিলবোর্ড, পোস্টার আর ব্যানারের ছড়াছড়িতে আকাশ পর্যন্ত ঢেকে গেছে—এমন পরিবেশ দেখি। চোখের পলকে ১৫ আগস্ট ঘটে গেল, যাদের দেখতাম নব্য আওয়ামী লীগার সেজে মুজিব কোট পরত, ১৫ আগস্টের পর মুজিব কোট লুকানোর দৃশ্যপটও ভুলিনি। আজ সারা বাংলাদেশের যত্রতত্র অনেকেই বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল তুলেছে। যদি হঠাৎ চোখের পলকে কোনো অঘটন ঘটে যায়, তখন কী এসব ম্যুরাল রাখবেন। যাঁরা ম্যুরাল স্থাপন করেছেন তাঁরাই ভেঙে ফেলবেন। এই দৃশ্যপট অনেক দেখেছি।’
ওবায়দুল কাদের আরও বলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগ করি, আপনারা যদি আমার চেয়েও বড় আওয়ামী লীগার হন, তাহলে দুঃখ লাগে। এখন অনেকেই নব্য আওয়ামী লীগার আমাদের চেয়েও যেন বড় আওয়ামী লীগার। কথায় কথায় বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনার প্রশংসা করেন। কিন্তু এটা কী মনের কথা? অনেককেই দেখেছি ১৫ আগস্টের আগে কী বক্তব্য দিয়েছেন। ১৫ আগস্ট ঘটার পর রাতারাতি ভোল পাল্টে ফেলেছে। এই ভোল পাল্টানো আওয়ামী লীগারদের আমার প্রয়োজন নেই।’
সরকার এবং দলের দুজন শীর্ষ ব্যক্তির এই দুই বক্তৃতা এক করলে মানুষের সামনে বিশেষ কোনো অবস্থা, ‘কোনো অঘটন ঘটার’ আশঙ্কা কি তৈরি হয়? বঙ্গবন্ধুর প্রতি কৃত্রিম এবং অকৃত্রিম দরদিদের আলাদা করার কাজটি কেন করা হয়নি বা হয় না?
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ রেকর্ড সময় ধরে ক্ষমতায় আছে। দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতিও হচ্ছে। বাংলাদেশের সমৃদ্ধি চোখে পড়ছে দেশের বাইরেও। তার মানে কিন্তু এটা নয় যে যেভাবে চলছে, তার থেকে ভালো চলার কিছু নেই। সরকার এবং সরকারি দলের ভেতরেও অবশ্যই সমস্যা আছে। নানাভাবে তার বিকৃত বহিঃপ্রকাশও ঘটে। দায় এড়ানোর একটি অসুস্থ প্রবণতা প্রায়ই দেখা যায়। আবর্জনা কার্পেটের নিচে লুকিয়ে রেখে বাইরে থেকে সবকিছু ফিটফাট দেখানোর আত্মঘাতী প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
ভেতরের সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠতে পারলে দেশ আরও ভালো চলবে। দেশে যে আয়বৈষম্য, ধনবৈষম্য বাড়ছে, তা অস্বীকার করা যাবে না। সরকারে থেকে, সরকারি দলের আশ্রয়ে থেকে আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার তথ্য গোপন করার মতো বিষয় নয়। শুধু কোটিপতির সংখ্যা বৃদ্ধি নয়, উচিত কথা বলার মতো লোকের সংখ্যা যেন দেশে বাড়ে এবং উচিত কথা শুনে গায়ে জ্বলুনি ধরা লোকের সংখ্যা যেন কমতে থাকে। উদারতা এবং সহনশীলতার মাত্রা না বাড়লে দেশের উন্নয়নযাত্রা কাঙ্ক্ষিত ফল দেবে না।
আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আদর্শে পরিচালিত রাজনৈতিক দল। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির মূল লক্ষ্য ছিল ‘বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো’। মুষ্টিমেয় মানুষের মুখে হাসি থাকলে, বেশি মানুষের জীবন যন্ত্রণাময় হলে, আওয়ামী লীগের রাজনীতি সঠিক পথে চলছে–বলা যাবে কি? একদিকে নারীর ক্ষমতায়ন বাড়ার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, অন্যদিকে প্রতিদিন ঘরে-বাইরে নারী নিগ্রহ-ধর্ষণ-নিপীড়ন-হত্যার খবর মোটেও সামাজিক সুস্থিতির পরিচয়বাহী নয়।
আওয়ামী লীগের মধ্যে কারা তাঁর প্রকৃত সুহৃদ, কারা আস্তিনের নিচে ছুরি লুকিয়ে রেখেছে, তা বঙ্গবন্ধুর অজানা ছিল না। তাঁর বিরুদ্ধে যে দলের ভেতরে এবং বাইরে কিছু সন্দেহজনক ভূমিকা চলছিল, সে তথ্যও বঙ্গবন্ধুর জানার বাইরে ছিল না। কিন্তু সবাইকে নিয়ে চলার উদারতার পরিণামে তাঁকে বুকের রক্ত দিতে হয়েছে। আওয়ামী লীগের ভেতরে একটি বড় শুদ্ধি অভিযানের সময় এখন আবার দুয়ারে কড়া নাড়ছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন। শেখ হাসিনাও কি সেটা ভেবেই বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর দলের ভূমিকার বিষয়টি সামনে আনলেন?
লেখক: সহকারী সম্পাদক
আজকের পত্রিকা
দলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
১১ ঘণ্টা আগেশেখ হাসিনা সরকারের পতনের ১০০ দিন পার হয়ে গেছে। ১০০ দিনে অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কিছু যে হয়নি, তা নয়। তবে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে অস্থিরতার লক্ষণ অস্পষ্ট নয়। এর মধ্যেই তিন দফায় উপদেষ্টার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।
১১ ঘণ্টা আগেবাংলা ভাষায় অতিপরিচিত একটি শব্দবন্ধ হলো ‘খোলনলচে’। যাপিত জীবনে কমবেশি আমরা সবাই শব্দবন্ধটি প্রয়োগ করেছি। বাংলা বাগধারায় আমরা পড়েছি ‘খোলনলচে পালটানো’। বাংলা অভিধানে খোল শব্দের একাধিক অর্থ রয়েছে।
১২ ঘণ্টা আগেঅফিসে যাতায়াতের সময় স্টাফ বাসে পরিচয়ের সূত্রে ফারজানা আক্তার আজিমপুরে নিজের বাসায় সাবলেট দিয়েছিলেন ফাতেমা আক্তার শাপলা নামের এক নারীকে। কিন্তু ফাতেমা যে একটি প্রতারক চক্রের সদস্য, সেটা তাঁর জানা ছিল না।
১২ ঘণ্টা আগে