বিভুরঞ্জন সরকার
১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ৪৩ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করা হয়েছে। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমান বিএনপি নামের রাজনৈতিক দলের আনুষ্ঠানিক জন্মবার্তা ঘোষণা করেছিলেন। এর আগে একই বছর ফেব্রুয়ারি মাসে জিয়া আরও একটি রাজনৈতিক দল জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) প্রতিষ্ঠা করলেও কয়েক মাসের মাথায় তা বিলুপ্ত করে নতুন দলের জন্ম দেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর খুনিদের তত্ত্বাবধানে খোন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে সরকার গঠনের পর থেকে জিয়াউর রহমান সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা হয়েও রাজনৈতিক মঞ্চের একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হয়ে উঠেছিলেন। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানের পর খোন্দকার মোশতাককে সরিয়ে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব দেওয়া হয় তৎকালীন প্রধান বিচারপতি আবু মোহাম্মদ সায়েমকে। তিনি ৬ নভেম্বর থেকে ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করলেও ৭ নভেম্বর খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থান ব্যর্থ হলে কিছু নাটকীয় ঘটনার পর দেশের শাসনভার চলে যায় কার্যত জেনারেল জিয়ার হাতে। জিয়া প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব নিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা তাঁর কবজায় নিতে সক্ষম হন। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল বিচারপতি সায়েমের কাছ থেকে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিজে গ্রহণ করেন।
দ্রুত নির্বাচন করে নির্বাচিতদের হাতে ক্ষমতা দিয়ে নিজে ব্যারাকে ফিরে যাওয়ার কথা শুরুর দিকে বললেও তিনি আসলে উর্দি পরেই রাজনীতি শুরু করেছিলেন। রাজনীতিবিদদের জন্য দেশের রাজনীতি ‘ডিফিকাল্ড’ বা কঠিন করে দেওয়ার কথা বলে তিনি রাষ্ট্রপতির পদে বসে ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট ছড়িয়ে বাম, ডান, মধ্যপন্থী, সুবিধাবাদী, সুযোগসন্ধানী সবাইকে নিয়ে গঠন করেছিলেন নিজের পছন্দের রাজনৈতিক দল বিএনপি। জিয়া ক্ষমতার দণ্ড ঘুরিয়েছেন সব মিলিয়ে বছর ছয়েকের মতো। কিন্তু বিএনপি গঠনের পর তিন বছরের মাথায় ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে তাঁকে হত্যা করা হয়। সামরিক বাহিনীতে তাঁর বিরুদ্ধপক্ষই তাঁকে হত্যা করে। জিয়া সামরিক শক্তির বলেই রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেও তাঁকে সেনাবাহিনীর ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় বেগ পেতে হয়েছে। বেশ কয়েকবার বিদ্রোহ দমনের জন্য অসংখ্য সেনাসদস্য, এমনকি উচ্চপদের কর্মকর্তাদেরও হত্যা করতে হয়েছে।
রাজনৈতিক দল গঠন করার পরও জিয়া খুব স্বস্তিতে ছিলেন, সেটা বলা যাবে না। জিয়া রাজনীতির মানুষ ছিলেন না, পরিস্থিতি এবং সুযোগ তাঁকে রাজনীতির সদর দুয়ারে পৌঁছাতে সহায়তা করেছে। তিনি ক্ষমতার শিখরে উঠেছেন, কিন্তু ক্ষমতাকে নিষ্কণ্টক করতে বেগ পেতে হয়েছে পুরো সময়জুড়েই। সমমনা বা এক চিন্তার মানুষদের নিয়ে দল গঠন না করায় বিএনপিতে গোড়া থেকেই ছিল রেষারেষি-দ্বন্দ্ব-কলহ-গ্রুপিং। বিএনপির অভ্যন্তরীণ বিরোধ মেটানোর জন্যই তিনি চট্টগ্রামে গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি আর জীবিত ফিরতে পারেননি। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে বিয়োগান্ত ঘটনার শুরু, জিয়া হত্যাকাণ্ড তার দ্বিতীয় ধাপ।
একসময় রাজনীতি বিশ্লেষকদের কেউ কেউ এমন মন্তব্য করতেন যে জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বিএনপির পরিণতি হবে মুসলিম লীগের মতো। বিএনপি নামের একটি দল থাকবে, কিন্তু তার জনসমর্থন কমে যাবে এবং ক্ষমতায় ফিরে আসা আর সম্ভব হবে না। বাস্তবে ঘটনা হয়েছে ভিন্ন। আসলে আমাদের দেশের জনমনস্তত্ত্ব এবং রাজনৈতিক গতি-প্রকৃতি নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা খুব সহজ নয়। মানুষ কখন, কী কারণে, কোন রাজনৈতিক দলের দিকে ঝুঁকে পড়ে তা আগে থেকে অনুমান করা কিছুটা কঠিন। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বিএনপিতে অস্থিরতা দেখা দেয়নি, তা নয়। তবে জিয়াউর রহমানের স্ত্রী খালেদা জিয়া বিএনপির হাল ধরার পর দলটির সামনে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়। উপমহাদেশের রাজনীতিতে পারিবারিক নেতৃত্বের ধারা নতুন নয়। কোনো পরিবারের একজন রাজনীতিতে যশ ও খ্যাতি অর্জন করলে সেই পরিবারের রাজনীতি অনাগ্রহী সদস্যেরও রাজনীতিতে নেমে যশ-খ্যাতির অধিকারী হতে কষ্ট হয় না।
খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি দুই দফায় ১০ বছর ক্ষমতায় থাকার সুযোগ পেয়েছে। এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করবে বলে সাধারণভাবে অনেকের মধ্যেই ধারণা তৈরি হয়েছিল। সাংগঠনিকভাবে এবং জনপ্রিয়তার দিক থেকে বিএনপির তুলনায় আওয়ামী লীগ এগিয়ে থাকার কথা অনেকেই বিশ্বাস করতেন। কিন্তু ভোটের ফলাফল যায় বিএনপির অনুকূলে। তবে সরকার গঠনের জন্য জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন নিতে হয়। অবশ্য বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াতের পুনঃপ্রবেশ সম্ভব হয়েছিল বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের কল্যাণেই। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী এবং পাকিস্তানিদের সহযোগী ভূমিকা পালনের জন্য স্বাধীনতার পর জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জিয়া ক্ষমতা দখল করে স্বাধীনতাবিরোধীদের জন্য রাজনীতি করার পথ সুগম করে দেন।
রাজনীতির জটিল হিসাব-নিকাশ এবং নতুন শক্তি বিন্যাসের ধারা তৈরি হয় এরশাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলন এবং এরশাদের পতনের পর প্রথম সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে। খালেদা জিয়া বাংলাদেশে প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন। এটাও রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নারী নেতৃত্বের বিরোধিতাকারীদের পক্ষ থেকেই সহযোগিতা দিয়ে খালেদা জিয়াকে প্রধানমন্ত্রী করেন।
আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিএনপির যে কিছুটা নৈকট্য সৃষ্টি হয়েছিল যুগপৎ আন্দোলনের সময়, বিএনপি ক্ষমতায় যাওয়ার পর তাতে ফাটল ধরে এবং পরবর্তী সময়ে নানা ঘটনার জেরে তা ক্রমে শত্রুতার পর্যায়ে পৌঁছে। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি এখন দেশের রাজনীতির দুটি ধারার নেতৃত্ব দিচ্ছে। এই দুই দলের মধ্যে সমঝোতার সুযোগ এখন কম।
আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির জনপ্রিয়তা, সাংগঠনিক সামর্থ্য কাছিকাছি বলে কারও কারও কাছে মনে হলেও গত তিনটি নির্বাচনে ধারাবাহিকভাবে আওয়ামী লীগ প্রাধান্য অর্জন করেছে। দুটি নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলেও মধ্যের নির্বাচনটি বর্জন করেছে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়নি, সুষ্ঠু হয়নি, ভোটাররা তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেননি—এসব অভিযোগ থাকলেও আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকতে কোনো অসুবিধা হয়নি, হচ্ছে না। আওয়ামী লীগের সঙ্গে রাজনৈতিক কৌশল, সাংগঠনিক শক্তি এবং জনপ্রিয়তায় বিএনপি পিছিয়ে আছে।
বিএনপি ১৫ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে আছে। আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে একাধিকবার আন্দোলনে নেমে বিএনপি ব্যর্থ হয়েছে। সরকার পতনের ডাক দিয়েও তারা মানুষকে রাস্তায় নামাতে ব্যর্থ হয়েছে। এর মধ্যে বিএনপিতে দেখা দিয়েছে নানা ধরনের অভ্যন্তরীণ সংকট। দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দুটি দুর্নীতি মামলায় দণ্ডিত হয়ে জেল খাটছেন। শারীরিকভাবেও তিনি অসুস্থ। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডনপ্রবাসী, সরকারের খাতায় তিনি পলাতক আসামি। দলের গুরুত্বপূর্ণ দুই নেতার এই অবস্থানের কারণে বিএনপিতে দেখা দিয়েছে নেতৃত্বের সংকট। দলটি আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কি না, সে প্রশ্ন দলের মধ্যেও উঠছে। দলের রাজনৈতিক বা আন্দোলনের কর্মসূচি ও কৌশল মানুষকে আকৃষ্ট বা প্রভাবিত করতে পারছে না। আন্দোলন করবে, না নির্বাচনে অংশ নেবে, সে প্রশ্নেও দলের মধ্যে ঐকমত্যের অভাব আছে।
দলের ৪৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর প্রাক্কালে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘এত কিছুর মধ্যেও বিএনপির সাফল্য হচ্ছে, বিএনপি ভাঙেনি। ১৯৮১ সালের পর বিএনপি ভাঙার চেষ্টা হয়েছে। ২০০৭ সালে এক-এগারোর পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিএনপিকে ভাঙার জন্য দুটি কমিটি করে দিয়েছিল, কিন্তু পারেনি, বিএনপি ঐক্যবদ্ধ আছে।’
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, বিএনপি না ভাঙলেও মচকেছে এবং দলটির শক্তিও সংহত হয়নি। দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব, নেতৃত্বের মধ্যে গ্রুপিংয়ের কারণে একধরনের স্থবিরতা চলছে। দলের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন পুনর্গঠন করতে গিয়ে যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হচ্ছে, তাতে ক্ষোভ-অসন্তোষ বাড়ছে। ত্যাগীদের মূল্যায়ন না করার অভিযোগ আছে। দলের মধ্যে রাজনৈতিক কৌশল নিয়ে বিরোধের কারণে কিছু অস্থিরতার খবরও শোনা যায়। বিভিন্ন উগ্রবাদী গ্রুপের সঙ্গে মিলে কারও কারও ‘কিছু একটা করার’ মনোভাব বিএনপিকে বড় ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিতে পারে। দুনিয়াব্যাপী রাজনীতির যে হাওয়া, তা বুঝতে পারার সক্ষমতা বিএনপিকে অর্জন করে শত্রু-মিত্র বাছাই করতে হবে। দলের অভ্যন্তরীণ ঐক্য সুসংহত করতে না পারলে আন্দোলন কিংবা নির্বাচন–কোনোটাতেই বিএনপির ভালো ফল পাওয়ার আশা কম।
লেখক: সহকারী সম্পাদক
আজকের পত্রিকা
১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ৪৩ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করা হয়েছে। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমান বিএনপি নামের রাজনৈতিক দলের আনুষ্ঠানিক জন্মবার্তা ঘোষণা করেছিলেন। এর আগে একই বছর ফেব্রুয়ারি মাসে জিয়া আরও একটি রাজনৈতিক দল জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) প্রতিষ্ঠা করলেও কয়েক মাসের মাথায় তা বিলুপ্ত করে নতুন দলের জন্ম দেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর খুনিদের তত্ত্বাবধানে খোন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে সরকার গঠনের পর থেকে জিয়াউর রহমান সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা হয়েও রাজনৈতিক মঞ্চের একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হয়ে উঠেছিলেন। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানের পর খোন্দকার মোশতাককে সরিয়ে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব দেওয়া হয় তৎকালীন প্রধান বিচারপতি আবু মোহাম্মদ সায়েমকে। তিনি ৬ নভেম্বর থেকে ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করলেও ৭ নভেম্বর খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থান ব্যর্থ হলে কিছু নাটকীয় ঘটনার পর দেশের শাসনভার চলে যায় কার্যত জেনারেল জিয়ার হাতে। জিয়া প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব নিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা তাঁর কবজায় নিতে সক্ষম হন। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল বিচারপতি সায়েমের কাছ থেকে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিজে গ্রহণ করেন।
দ্রুত নির্বাচন করে নির্বাচিতদের হাতে ক্ষমতা দিয়ে নিজে ব্যারাকে ফিরে যাওয়ার কথা শুরুর দিকে বললেও তিনি আসলে উর্দি পরেই রাজনীতি শুরু করেছিলেন। রাজনীতিবিদদের জন্য দেশের রাজনীতি ‘ডিফিকাল্ড’ বা কঠিন করে দেওয়ার কথা বলে তিনি রাষ্ট্রপতির পদে বসে ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট ছড়িয়ে বাম, ডান, মধ্যপন্থী, সুবিধাবাদী, সুযোগসন্ধানী সবাইকে নিয়ে গঠন করেছিলেন নিজের পছন্দের রাজনৈতিক দল বিএনপি। জিয়া ক্ষমতার দণ্ড ঘুরিয়েছেন সব মিলিয়ে বছর ছয়েকের মতো। কিন্তু বিএনপি গঠনের পর তিন বছরের মাথায় ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে তাঁকে হত্যা করা হয়। সামরিক বাহিনীতে তাঁর বিরুদ্ধপক্ষই তাঁকে হত্যা করে। জিয়া সামরিক শক্তির বলেই রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেও তাঁকে সেনাবাহিনীর ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় বেগ পেতে হয়েছে। বেশ কয়েকবার বিদ্রোহ দমনের জন্য অসংখ্য সেনাসদস্য, এমনকি উচ্চপদের কর্মকর্তাদেরও হত্যা করতে হয়েছে।
রাজনৈতিক দল গঠন করার পরও জিয়া খুব স্বস্তিতে ছিলেন, সেটা বলা যাবে না। জিয়া রাজনীতির মানুষ ছিলেন না, পরিস্থিতি এবং সুযোগ তাঁকে রাজনীতির সদর দুয়ারে পৌঁছাতে সহায়তা করেছে। তিনি ক্ষমতার শিখরে উঠেছেন, কিন্তু ক্ষমতাকে নিষ্কণ্টক করতে বেগ পেতে হয়েছে পুরো সময়জুড়েই। সমমনা বা এক চিন্তার মানুষদের নিয়ে দল গঠন না করায় বিএনপিতে গোড়া থেকেই ছিল রেষারেষি-দ্বন্দ্ব-কলহ-গ্রুপিং। বিএনপির অভ্যন্তরীণ বিরোধ মেটানোর জন্যই তিনি চট্টগ্রামে গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি আর জীবিত ফিরতে পারেননি। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে বিয়োগান্ত ঘটনার শুরু, জিয়া হত্যাকাণ্ড তার দ্বিতীয় ধাপ।
একসময় রাজনীতি বিশ্লেষকদের কেউ কেউ এমন মন্তব্য করতেন যে জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বিএনপির পরিণতি হবে মুসলিম লীগের মতো। বিএনপি নামের একটি দল থাকবে, কিন্তু তার জনসমর্থন কমে যাবে এবং ক্ষমতায় ফিরে আসা আর সম্ভব হবে না। বাস্তবে ঘটনা হয়েছে ভিন্ন। আসলে আমাদের দেশের জনমনস্তত্ত্ব এবং রাজনৈতিক গতি-প্রকৃতি নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা খুব সহজ নয়। মানুষ কখন, কী কারণে, কোন রাজনৈতিক দলের দিকে ঝুঁকে পড়ে তা আগে থেকে অনুমান করা কিছুটা কঠিন। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বিএনপিতে অস্থিরতা দেখা দেয়নি, তা নয়। তবে জিয়াউর রহমানের স্ত্রী খালেদা জিয়া বিএনপির হাল ধরার পর দলটির সামনে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়। উপমহাদেশের রাজনীতিতে পারিবারিক নেতৃত্বের ধারা নতুন নয়। কোনো পরিবারের একজন রাজনীতিতে যশ ও খ্যাতি অর্জন করলে সেই পরিবারের রাজনীতি অনাগ্রহী সদস্যেরও রাজনীতিতে নেমে যশ-খ্যাতির অধিকারী হতে কষ্ট হয় না।
খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি দুই দফায় ১০ বছর ক্ষমতায় থাকার সুযোগ পেয়েছে। এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করবে বলে সাধারণভাবে অনেকের মধ্যেই ধারণা তৈরি হয়েছিল। সাংগঠনিকভাবে এবং জনপ্রিয়তার দিক থেকে বিএনপির তুলনায় আওয়ামী লীগ এগিয়ে থাকার কথা অনেকেই বিশ্বাস করতেন। কিন্তু ভোটের ফলাফল যায় বিএনপির অনুকূলে। তবে সরকার গঠনের জন্য জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন নিতে হয়। অবশ্য বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াতের পুনঃপ্রবেশ সম্ভব হয়েছিল বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের কল্যাণেই। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী এবং পাকিস্তানিদের সহযোগী ভূমিকা পালনের জন্য স্বাধীনতার পর জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জিয়া ক্ষমতা দখল করে স্বাধীনতাবিরোধীদের জন্য রাজনীতি করার পথ সুগম করে দেন।
রাজনীতির জটিল হিসাব-নিকাশ এবং নতুন শক্তি বিন্যাসের ধারা তৈরি হয় এরশাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলন এবং এরশাদের পতনের পর প্রথম সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে। খালেদা জিয়া বাংলাদেশে প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন। এটাও রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নারী নেতৃত্বের বিরোধিতাকারীদের পক্ষ থেকেই সহযোগিতা দিয়ে খালেদা জিয়াকে প্রধানমন্ত্রী করেন।
আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিএনপির যে কিছুটা নৈকট্য সৃষ্টি হয়েছিল যুগপৎ আন্দোলনের সময়, বিএনপি ক্ষমতায় যাওয়ার পর তাতে ফাটল ধরে এবং পরবর্তী সময়ে নানা ঘটনার জেরে তা ক্রমে শত্রুতার পর্যায়ে পৌঁছে। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি এখন দেশের রাজনীতির দুটি ধারার নেতৃত্ব দিচ্ছে। এই দুই দলের মধ্যে সমঝোতার সুযোগ এখন কম।
আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির জনপ্রিয়তা, সাংগঠনিক সামর্থ্য কাছিকাছি বলে কারও কারও কাছে মনে হলেও গত তিনটি নির্বাচনে ধারাবাহিকভাবে আওয়ামী লীগ প্রাধান্য অর্জন করেছে। দুটি নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলেও মধ্যের নির্বাচনটি বর্জন করেছে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়নি, সুষ্ঠু হয়নি, ভোটাররা তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেননি—এসব অভিযোগ থাকলেও আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকতে কোনো অসুবিধা হয়নি, হচ্ছে না। আওয়ামী লীগের সঙ্গে রাজনৈতিক কৌশল, সাংগঠনিক শক্তি এবং জনপ্রিয়তায় বিএনপি পিছিয়ে আছে।
বিএনপি ১৫ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে আছে। আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে একাধিকবার আন্দোলনে নেমে বিএনপি ব্যর্থ হয়েছে। সরকার পতনের ডাক দিয়েও তারা মানুষকে রাস্তায় নামাতে ব্যর্থ হয়েছে। এর মধ্যে বিএনপিতে দেখা দিয়েছে নানা ধরনের অভ্যন্তরীণ সংকট। দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দুটি দুর্নীতি মামলায় দণ্ডিত হয়ে জেল খাটছেন। শারীরিকভাবেও তিনি অসুস্থ। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডনপ্রবাসী, সরকারের খাতায় তিনি পলাতক আসামি। দলের গুরুত্বপূর্ণ দুই নেতার এই অবস্থানের কারণে বিএনপিতে দেখা দিয়েছে নেতৃত্বের সংকট। দলটি আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কি না, সে প্রশ্ন দলের মধ্যেও উঠছে। দলের রাজনৈতিক বা আন্দোলনের কর্মসূচি ও কৌশল মানুষকে আকৃষ্ট বা প্রভাবিত করতে পারছে না। আন্দোলন করবে, না নির্বাচনে অংশ নেবে, সে প্রশ্নেও দলের মধ্যে ঐকমত্যের অভাব আছে।
দলের ৪৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর প্রাক্কালে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘এত কিছুর মধ্যেও বিএনপির সাফল্য হচ্ছে, বিএনপি ভাঙেনি। ১৯৮১ সালের পর বিএনপি ভাঙার চেষ্টা হয়েছে। ২০০৭ সালে এক-এগারোর পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিএনপিকে ভাঙার জন্য দুটি কমিটি করে দিয়েছিল, কিন্তু পারেনি, বিএনপি ঐক্যবদ্ধ আছে।’
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, বিএনপি না ভাঙলেও মচকেছে এবং দলটির শক্তিও সংহত হয়নি। দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব, নেতৃত্বের মধ্যে গ্রুপিংয়ের কারণে একধরনের স্থবিরতা চলছে। দলের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন পুনর্গঠন করতে গিয়ে যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হচ্ছে, তাতে ক্ষোভ-অসন্তোষ বাড়ছে। ত্যাগীদের মূল্যায়ন না করার অভিযোগ আছে। দলের মধ্যে রাজনৈতিক কৌশল নিয়ে বিরোধের কারণে কিছু অস্থিরতার খবরও শোনা যায়। বিভিন্ন উগ্রবাদী গ্রুপের সঙ্গে মিলে কারও কারও ‘কিছু একটা করার’ মনোভাব বিএনপিকে বড় ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিতে পারে। দুনিয়াব্যাপী রাজনীতির যে হাওয়া, তা বুঝতে পারার সক্ষমতা বিএনপিকে অর্জন করে শত্রু-মিত্র বাছাই করতে হবে। দলের অভ্যন্তরীণ ঐক্য সুসংহত করতে না পারলে আন্দোলন কিংবা নির্বাচন–কোনোটাতেই বিএনপির ভালো ফল পাওয়ার আশা কম।
লেখক: সহকারী সম্পাদক
আজকের পত্রিকা
দলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
১০ ঘণ্টা আগেশেখ হাসিনা সরকারের পতনের ১০০ দিন পার হয়ে গেছে। ১০০ দিনে অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কিছু যে হয়নি, তা নয়। তবে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে অস্থিরতার লক্ষণ অস্পষ্ট নয়। এর মধ্যেই তিন দফায় উপদেষ্টার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।
১০ ঘণ্টা আগেবাংলা ভাষায় অতিপরিচিত একটি শব্দবন্ধ হলো ‘খোলনলচে’। যাপিত জীবনে কমবেশি আমরা সবাই শব্দবন্ধটি প্রয়োগ করেছি। বাংলা বাগধারায় আমরা পড়েছি ‘খোলনলচে পালটানো’। বাংলা অভিধানে খোল শব্দের একাধিক অর্থ রয়েছে।
১০ ঘণ্টা আগেঅফিসে যাতায়াতের সময় স্টাফ বাসে পরিচয়ের সূত্রে ফারজানা আক্তার আজিমপুরে নিজের বাসায় সাবলেট দিয়েছিলেন ফাতেমা আক্তার শাপলা নামের এক নারীকে। কিন্তু ফাতেমা যে একটি প্রতারক চক্রের সদস্য, সেটা তাঁর জানা ছিল না।
১০ ঘণ্টা আগে