বিভুরঞ্জন সরকার
এক ভয়াবহ জাতীয় দুর্যোগের মধ্য দিয়ে এবার বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন পয়লা বৈশাখ উদ্যাপিত হলো। না, কোনো আনন্দ আয়োজন ছিল না এবারের বর্ষবরণে। রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণের অনুষ্ঠান হয়নি। ছিল না চারুকলার পক্ষ থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন। নতুন পোশাক পরে কেউ বের হয়ে আসেননি ঘর থেকে। সড়কে আঁকা হয়নি আলপনা। দেশের কোথাও হয়নি কোনো বৈশালী মেলা। নাগরদোলায় চড়ে কেউ করেননি আনন্দ উল্লাস। ছোটদের হাতে দেখা যায়নি হাওয়াই মিঠাই কিংবা রঙিন পুতুল।
করোনাভাইরাসের নতুন আক্রমণে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে সবাই ব্যস্ত আছেন কীভাবে সংক্রমণ রোধ করা যায়, তার উপায় খুঁজতে। গত বছরও বৈশাখ উদ্যাপন হয়নি, করোনার প্রাথমিক আঘাতের কারণে। আশা করা হয়েছিল, ১৪২৭ হলো না তো কি হয়েছে, ১৪২৮ বরণ করা হবে নতুন উচ্ছ্বাস ও উদ্দীপনার সঙ্গে। ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’ সঙ্গীত ধ্বনিত হবে লাখো মানুষের কণ্ঠে। কিন্তু করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ এবারও বাধ সাধল বর্ষবরণের আনন্দ আয়োজনে।
গত বৈশাখের আগে বাংলাদেশে করোনায় মৃত্যু হয়েছিল ৩৯ জনের। এবার সেই সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার ছুঁইছ্ুঁই। প্রতিদিনই এই সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। সংক্রমণ হার বেড়ে যাওয়ায় হাসপাতালগুলোতে দেখা দিয়েছে আসন সমস্যা। চিকিৎসকেরাও মৃত্যুবরণ করছেন। কোথায় গিয়ে শেষ হবে এই মৃত্যুমিছিল তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না।
গত একবছরে আমরা এমন অনেককে হারিয়েছি, যাঁরা ছিলেন আমাদের সামনে আলোর দিশারী কিংবা প্রগতিপথের সামনের সারির যোদ্ধা। যাঁদের জ্ঞান-মেধা-অভিজ্ঞতা ছিল দেশ ও দেশের মানুষের জন্য অনুপ্রেরণাদায়ক। বিপদে ভয় না পাওয়ার সাহস তাঁরা আমাদের জুগিয়েছেন। কিন্তু করোনা-গ্রাসে তাঁদের হারিয়ে আমরা জাতি হিসেবেই কিছুটা নিঃস্ব হয়েছি। খ্যাতি ও জ্যোতির অধিকারী ব্যক্তিদের অকালমৃত্যুর তালিকা কেবলই দীর্ঘ হচ্ছে।
এবার পয়লা বৈশাখে আমরা যেমন ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৯৬ জনের মৃত্যুর খবর জেনেছি, তেমনি একই দিন হারিয়েছি বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র শামসুজ্জামান খান এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক আদর্শের অবিচল সৈনিক অ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরুকে।
শামসুজ্জামান খান তাঁর ৮১ বছরের জীবনে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করার কাজে বড় অবদান রেখেছেন। অধ্যাপনা করেছেন। দেশের ভেতরে থেকেও আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা নানাভাবে সহায়তা করেছেন শামসুজ্জামান খান তাঁদের একজন। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক প্রগতিচিন্তার একজন বলিষ্ঠ সাধক। গবেষণা করেছেন বাংলার লোক ঐতিহ্য নিয়ে। তাঁর অসংখ্য গ্রন্থ বাঙালির চিন্তাজগতের আড়ষ্ঠতা দূর করতে ভূমিকা রেখেছে। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীসহ অন্য দুটি গ্রন্থ সম্পাদনায় তিনি বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অতুলনীয় সহায়তা করেছেন। মৃত্যুকালে তিনি ছিলেন বাঙালির মননশীলতা চর্চার প্রাণপ্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমির সভাপতি। তাঁর আগে টানা কয়েক বছর তিনি বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন।
আবদুল মতিন খসরু ছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য। মাত্র কিছুদিন আগেই তিনি সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে নির্বাচিত হয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠনের পর তিনি আইনমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছিলেন। কুখ্যাত ইনডেমনটি আইন প্রত্যাহার এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করতে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশ্বস্ত সহযোগী ছিলেন। স্বৈরাচারবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনেও আবদুল মতিন খসরুর সাহসী ভূমিকা অন্যদের প্রেরণা জুগিয়েছিল। শামসুজ্জামান খান এবং আবদুল মতিন খসরুর মৃত্যু এবার পয়লা বৈশাখকে আরও বেশি বিষণ ও বিষাদময় করেছে।
করোনা সংক্রমণ রোধের সর্বাত্মক চেষ্টার অংশ হিসেবে ১৪ এপ্রিল অর্থাৎ পয়লা বৈশাখ থেকেই কঠোর লকডাউন শুরু হয়েছে দেশে। জনসমাগম কমানোর লক্ষ্য থেকেই এই লকডাউনের ব্যবস্থা। তবে আমাদের গত বছরের অভিজ্ঞতা খুব ভালো নয়। দেশের মানুষের একাংশের মধ্যে লকডাউন না মানার প্রবণতা আছে। অতিরিক্ত জনঘনত্বের কারণে এবং জনগণের বিপুল অংশের মধ্যে একধরনের উদাসীনতা ও খামখেয়ালিপনার জন্য লকডাউন পুরোপুরি অর্থবহ করা বাস্তবে সম্ভবপর নয় বলেও মনে করা হয়। লকডাউনে বিপুলসংখ্যক মানুষের আয়-রোজগারের পথ বন্ধ হয়।
গত একবছরে অনেক মানুষ কর্মহীন হয়েছেন। অনেকের সামান্য সঞ্চয়ও শেষ হয়েছে। মানুষের অভাব-অনটন বেড়েছে। জিনিসপত্রের দামও এই সময় না কমে বরং বেড়েছে। আয় কম, ব্যয় বেশি– দুঃসহ এক অবস্থা কয়েক কোটি মানুষের। দরিদ্র ও হতদরিদ্র মানুষের সংখ্যা গত একবছরে বেড়েছে। এবারের লকডাউন দীর্ঘ হলে সেটা আরও বাড়বে। একদিকে জীবন, অন্যদিকে জীবিকা। কী করবেন, মানুষ তা বুঝে উঠতে না পেরে অসহায় অবস্থায় অস্থির ছোটাছুটি করছেন। শহর থেকে গ্রামে ছুটছেন হাজার হাজার মানুষ। একদিকে খাওয়াপরার সংকট, অন্যদিকে করোনাভাইরাসের তাড়া। মানুষ সত্যি এখন দিশেহারা। শহর যে চাপ কুলাতে পারে না, গ্রাম কি তা পারবে?
নববর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে বলেছেন মানুষের জীবন সবার আগে। বেঁচে থাকলে আবার সবকিছু গুছিয়ে নেওয়া যাবে। তাই জীবন-জীবিকার অসুবিধা হলেও কঠোর কিছু ব্যবস্থা সরকারকে নিতে হচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দিয়েছেন। করোনা পরিস্থিতিতে অর্থনীতি ও মানুষের জীবন-জীবিকা যাতে সম্পূণরূপে ভেঙে না পড়ে, সেদিকে সরকার দৃষ্টি রাখছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ইতিমধ্যে প্রায় ১ লাখ ২৪ হাজার ৫৩ কোটি টাকার ২৩টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে।
কলকারখানায় যাতে উৎপাদন ব্যাহত না হয়, সে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। নেওয়া হয়েছে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্যোগ। দিনমজুর, পরিবহন শ্রমিক, হকার, রিকশাচালক, দোকান কর্মচারী, স্কুলশিক্ষক ও মাদ্রাসাশিক্ষক-শিক্ষার্থী, মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিন, অন্য ধর্মের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সেবাদানকারী, সাংবাদিকসহ নিম্ন আয়ের নানা পেশার মানুষকে সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এ সময় প্রায় আড়াই কোটি মানুষকে বিভিন্ন সরকারি সহায়তার আওতায় আনা হয়েছে।
দেশবাসীকে শঙ্কিত না হওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যে পল্লি অঞ্চলে কর্মসৃজনের জন্য ৮০৭ কোটি ৬৫ লাখ টাকা এবং পবিত্র রমজান ও আসন্ন ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ৬৭২ কোটির বেশি টাকার বরাদ্দ দিয়েছি। এর মাধ্যমে দেশের প্রায় ১ কোটি ২৪ লাখ ৪২ হাজার নিম্নবিত্ত পরিবার উপকৃত হবে। গত বছর করোনাভাইরাসের প্রার্দুভাবের পর থেকে ভিজিএফ, টেস্ট রিলিফসহ বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বৃদ্ধি করা হয়েছে।’
টিকাদান কর্মসূচির কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমাদের সৌভাগ্য যে টিকা উৎপাদনের শুরুতেই উল্লেখযোগ্য পরিমাণ টিকার ডোজ আমরা নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছি। ইতিমধ্যে ৫৬ লাখের বেশি মানুষকে প্রথম ডোজ টিকা দেওয়া সম্পন্ন হয়েছে। পর্যায়ক্রমে দেশের সবাইকে টিকার আওতায় আনার কথা জানিয়ে টিকা নেওয়ার পরও সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মানার ওপর জোর দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, জরুরি প্রয়োজনে বাইরে বের হলে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। ঘরে ফিরে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে গরম পানির ভাপ নিতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যুগে যুগে মহামারি আসে। আসে নানা ঝড়ঝঞ্ঝা, দুর্যোগ-দুর্বিপাক। এসব মোকাবিলা করেই মানবজাতিকে টিকে থাকতে হয়। জীবনের চলার পথ মসৃণ নয়। তবে পথ যত কঠিনই হোক, আমাদের তা জয় করে এগিয়ে যেতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা মানুষকে নিশ্চয়ই আশাবাদী হয়ে উঠতে ভরসা জোগাবে। সরকার অসহায় মানুষের পাশে আছে – এটা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে মানুষ দেখতে চায়, কথা ও কাজে সঙ্গতি। কেনো মানুষ যেন অনাহারে না থাকে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। গরিব মানুষের সুরক্ষার জন্য সরকারি যে সহায়তার কথা বলা হয়েছে তা বিলিবণ্টনে যেন কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি না হয় সে দিকে কড়া নজরদারি বজায় রাখতে হবে।
দেশের মানুষকেও নিজ নিজ সুরক্ষার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গেই নিতে হবে। সংক্রমণ রোধে সবাইকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। করোনা দুর্যোগের মধ্যেই শুরু হয়েছে রোজা। পবিত্র রমজান মাসকে বলা হয় সংযমের মাস। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী। রোজার মাসে সবাই জীবনাচারে সংযমী হলে অনেক সমস্যার সমাধান সহজ হয়ে যায়। ব্যক্তির অমিতাচার সমষ্টির ক্ষতির কারণ হয়। রোজা এলেই একশ্রেণির মুনাফালোভী ব্যবসায়ী নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত অসংযমের পরিচয় দিয়ে অনেকের জীবন অতিষ্ঠ করে তোলেন। এবারও তার ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে না। আমরা সবকিছুর জন্য সরকারের ওপর দায় চাপিয়ে নিজেদের দায়িত্ব পালনের ব্যর্থতা আড়াল করে তৃপ্তি বোধ করি। ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকার সম্প্রসারণ এখন জরুরি হয়ে পড়েছে।
মানুষ বেঁচে থাকে নতুন আশা ও স্বপ্ন নিয়ে। আমরা নতুন বছরকে এবার উৎসবমুখর অনুষ্ঠানমালার মধ্য দিয়ে বরণ করতে না পারলেও এই প্রত্যয় নিয়ে অগ্রসর হতে চাই যে, আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় যেন আগামী বছর আমরা বলতে পারি: মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা। বাঙালি লড়তে জানে, মরতে জানে, জিততেও জানে। নিশ্চয়ই করোনাকালের পরে এক নতুন জীবনদায়ী অবস্থায় আমরা পৌঁছতে সক্ষম হব।
এক ভয়াবহ জাতীয় দুর্যোগের মধ্য দিয়ে এবার বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন পয়লা বৈশাখ উদ্যাপিত হলো। না, কোনো আনন্দ আয়োজন ছিল না এবারের বর্ষবরণে। রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণের অনুষ্ঠান হয়নি। ছিল না চারুকলার পক্ষ থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন। নতুন পোশাক পরে কেউ বের হয়ে আসেননি ঘর থেকে। সড়কে আঁকা হয়নি আলপনা। দেশের কোথাও হয়নি কোনো বৈশালী মেলা। নাগরদোলায় চড়ে কেউ করেননি আনন্দ উল্লাস। ছোটদের হাতে দেখা যায়নি হাওয়াই মিঠাই কিংবা রঙিন পুতুল।
করোনাভাইরাসের নতুন আক্রমণে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে সবাই ব্যস্ত আছেন কীভাবে সংক্রমণ রোধ করা যায়, তার উপায় খুঁজতে। গত বছরও বৈশাখ উদ্যাপন হয়নি, করোনার প্রাথমিক আঘাতের কারণে। আশা করা হয়েছিল, ১৪২৭ হলো না তো কি হয়েছে, ১৪২৮ বরণ করা হবে নতুন উচ্ছ্বাস ও উদ্দীপনার সঙ্গে। ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’ সঙ্গীত ধ্বনিত হবে লাখো মানুষের কণ্ঠে। কিন্তু করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ এবারও বাধ সাধল বর্ষবরণের আনন্দ আয়োজনে।
গত বৈশাখের আগে বাংলাদেশে করোনায় মৃত্যু হয়েছিল ৩৯ জনের। এবার সেই সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার ছুঁইছ্ুঁই। প্রতিদিনই এই সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। সংক্রমণ হার বেড়ে যাওয়ায় হাসপাতালগুলোতে দেখা দিয়েছে আসন সমস্যা। চিকিৎসকেরাও মৃত্যুবরণ করছেন। কোথায় গিয়ে শেষ হবে এই মৃত্যুমিছিল তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না।
গত একবছরে আমরা এমন অনেককে হারিয়েছি, যাঁরা ছিলেন আমাদের সামনে আলোর দিশারী কিংবা প্রগতিপথের সামনের সারির যোদ্ধা। যাঁদের জ্ঞান-মেধা-অভিজ্ঞতা ছিল দেশ ও দেশের মানুষের জন্য অনুপ্রেরণাদায়ক। বিপদে ভয় না পাওয়ার সাহস তাঁরা আমাদের জুগিয়েছেন। কিন্তু করোনা-গ্রাসে তাঁদের হারিয়ে আমরা জাতি হিসেবেই কিছুটা নিঃস্ব হয়েছি। খ্যাতি ও জ্যোতির অধিকারী ব্যক্তিদের অকালমৃত্যুর তালিকা কেবলই দীর্ঘ হচ্ছে।
এবার পয়লা বৈশাখে আমরা যেমন ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৯৬ জনের মৃত্যুর খবর জেনেছি, তেমনি একই দিন হারিয়েছি বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র শামসুজ্জামান খান এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক আদর্শের অবিচল সৈনিক অ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরুকে।
শামসুজ্জামান খান তাঁর ৮১ বছরের জীবনে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করার কাজে বড় অবদান রেখেছেন। অধ্যাপনা করেছেন। দেশের ভেতরে থেকেও আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা নানাভাবে সহায়তা করেছেন শামসুজ্জামান খান তাঁদের একজন। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক প্রগতিচিন্তার একজন বলিষ্ঠ সাধক। গবেষণা করেছেন বাংলার লোক ঐতিহ্য নিয়ে। তাঁর অসংখ্য গ্রন্থ বাঙালির চিন্তাজগতের আড়ষ্ঠতা দূর করতে ভূমিকা রেখেছে। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীসহ অন্য দুটি গ্রন্থ সম্পাদনায় তিনি বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অতুলনীয় সহায়তা করেছেন। মৃত্যুকালে তিনি ছিলেন বাঙালির মননশীলতা চর্চার প্রাণপ্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমির সভাপতি। তাঁর আগে টানা কয়েক বছর তিনি বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন।
আবদুল মতিন খসরু ছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য। মাত্র কিছুদিন আগেই তিনি সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে নির্বাচিত হয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠনের পর তিনি আইনমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছিলেন। কুখ্যাত ইনডেমনটি আইন প্রত্যাহার এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করতে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশ্বস্ত সহযোগী ছিলেন। স্বৈরাচারবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনেও আবদুল মতিন খসরুর সাহসী ভূমিকা অন্যদের প্রেরণা জুগিয়েছিল। শামসুজ্জামান খান এবং আবদুল মতিন খসরুর মৃত্যু এবার পয়লা বৈশাখকে আরও বেশি বিষণ ও বিষাদময় করেছে।
করোনা সংক্রমণ রোধের সর্বাত্মক চেষ্টার অংশ হিসেবে ১৪ এপ্রিল অর্থাৎ পয়লা বৈশাখ থেকেই কঠোর লকডাউন শুরু হয়েছে দেশে। জনসমাগম কমানোর লক্ষ্য থেকেই এই লকডাউনের ব্যবস্থা। তবে আমাদের গত বছরের অভিজ্ঞতা খুব ভালো নয়। দেশের মানুষের একাংশের মধ্যে লকডাউন না মানার প্রবণতা আছে। অতিরিক্ত জনঘনত্বের কারণে এবং জনগণের বিপুল অংশের মধ্যে একধরনের উদাসীনতা ও খামখেয়ালিপনার জন্য লকডাউন পুরোপুরি অর্থবহ করা বাস্তবে সম্ভবপর নয় বলেও মনে করা হয়। লকডাউনে বিপুলসংখ্যক মানুষের আয়-রোজগারের পথ বন্ধ হয়।
গত একবছরে অনেক মানুষ কর্মহীন হয়েছেন। অনেকের সামান্য সঞ্চয়ও শেষ হয়েছে। মানুষের অভাব-অনটন বেড়েছে। জিনিসপত্রের দামও এই সময় না কমে বরং বেড়েছে। আয় কম, ব্যয় বেশি– দুঃসহ এক অবস্থা কয়েক কোটি মানুষের। দরিদ্র ও হতদরিদ্র মানুষের সংখ্যা গত একবছরে বেড়েছে। এবারের লকডাউন দীর্ঘ হলে সেটা আরও বাড়বে। একদিকে জীবন, অন্যদিকে জীবিকা। কী করবেন, মানুষ তা বুঝে উঠতে না পেরে অসহায় অবস্থায় অস্থির ছোটাছুটি করছেন। শহর থেকে গ্রামে ছুটছেন হাজার হাজার মানুষ। একদিকে খাওয়াপরার সংকট, অন্যদিকে করোনাভাইরাসের তাড়া। মানুষ সত্যি এখন দিশেহারা। শহর যে চাপ কুলাতে পারে না, গ্রাম কি তা পারবে?
নববর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে বলেছেন মানুষের জীবন সবার আগে। বেঁচে থাকলে আবার সবকিছু গুছিয়ে নেওয়া যাবে। তাই জীবন-জীবিকার অসুবিধা হলেও কঠোর কিছু ব্যবস্থা সরকারকে নিতে হচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দিয়েছেন। করোনা পরিস্থিতিতে অর্থনীতি ও মানুষের জীবন-জীবিকা যাতে সম্পূণরূপে ভেঙে না পড়ে, সেদিকে সরকার দৃষ্টি রাখছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ইতিমধ্যে প্রায় ১ লাখ ২৪ হাজার ৫৩ কোটি টাকার ২৩টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে।
কলকারখানায় যাতে উৎপাদন ব্যাহত না হয়, সে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। নেওয়া হয়েছে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্যোগ। দিনমজুর, পরিবহন শ্রমিক, হকার, রিকশাচালক, দোকান কর্মচারী, স্কুলশিক্ষক ও মাদ্রাসাশিক্ষক-শিক্ষার্থী, মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিন, অন্য ধর্মের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সেবাদানকারী, সাংবাদিকসহ নিম্ন আয়ের নানা পেশার মানুষকে সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এ সময় প্রায় আড়াই কোটি মানুষকে বিভিন্ন সরকারি সহায়তার আওতায় আনা হয়েছে।
দেশবাসীকে শঙ্কিত না হওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যে পল্লি অঞ্চলে কর্মসৃজনের জন্য ৮০৭ কোটি ৬৫ লাখ টাকা এবং পবিত্র রমজান ও আসন্ন ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ৬৭২ কোটির বেশি টাকার বরাদ্দ দিয়েছি। এর মাধ্যমে দেশের প্রায় ১ কোটি ২৪ লাখ ৪২ হাজার নিম্নবিত্ত পরিবার উপকৃত হবে। গত বছর করোনাভাইরাসের প্রার্দুভাবের পর থেকে ভিজিএফ, টেস্ট রিলিফসহ বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বৃদ্ধি করা হয়েছে।’
টিকাদান কর্মসূচির কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমাদের সৌভাগ্য যে টিকা উৎপাদনের শুরুতেই উল্লেখযোগ্য পরিমাণ টিকার ডোজ আমরা নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছি। ইতিমধ্যে ৫৬ লাখের বেশি মানুষকে প্রথম ডোজ টিকা দেওয়া সম্পন্ন হয়েছে। পর্যায়ক্রমে দেশের সবাইকে টিকার আওতায় আনার কথা জানিয়ে টিকা নেওয়ার পরও সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মানার ওপর জোর দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, জরুরি প্রয়োজনে বাইরে বের হলে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। ঘরে ফিরে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে গরম পানির ভাপ নিতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যুগে যুগে মহামারি আসে। আসে নানা ঝড়ঝঞ্ঝা, দুর্যোগ-দুর্বিপাক। এসব মোকাবিলা করেই মানবজাতিকে টিকে থাকতে হয়। জীবনের চলার পথ মসৃণ নয়। তবে পথ যত কঠিনই হোক, আমাদের তা জয় করে এগিয়ে যেতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা মানুষকে নিশ্চয়ই আশাবাদী হয়ে উঠতে ভরসা জোগাবে। সরকার অসহায় মানুষের পাশে আছে – এটা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে মানুষ দেখতে চায়, কথা ও কাজে সঙ্গতি। কেনো মানুষ যেন অনাহারে না থাকে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। গরিব মানুষের সুরক্ষার জন্য সরকারি যে সহায়তার কথা বলা হয়েছে তা বিলিবণ্টনে যেন কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি না হয় সে দিকে কড়া নজরদারি বজায় রাখতে হবে।
দেশের মানুষকেও নিজ নিজ সুরক্ষার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গেই নিতে হবে। সংক্রমণ রোধে সবাইকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। করোনা দুর্যোগের মধ্যেই শুরু হয়েছে রোজা। পবিত্র রমজান মাসকে বলা হয় সংযমের মাস। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী। রোজার মাসে সবাই জীবনাচারে সংযমী হলে অনেক সমস্যার সমাধান সহজ হয়ে যায়। ব্যক্তির অমিতাচার সমষ্টির ক্ষতির কারণ হয়। রোজা এলেই একশ্রেণির মুনাফালোভী ব্যবসায়ী নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত অসংযমের পরিচয় দিয়ে অনেকের জীবন অতিষ্ঠ করে তোলেন। এবারও তার ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে না। আমরা সবকিছুর জন্য সরকারের ওপর দায় চাপিয়ে নিজেদের দায়িত্ব পালনের ব্যর্থতা আড়াল করে তৃপ্তি বোধ করি। ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকার সম্প্রসারণ এখন জরুরি হয়ে পড়েছে।
মানুষ বেঁচে থাকে নতুন আশা ও স্বপ্ন নিয়ে। আমরা নতুন বছরকে এবার উৎসবমুখর অনুষ্ঠানমালার মধ্য দিয়ে বরণ করতে না পারলেও এই প্রত্যয় নিয়ে অগ্রসর হতে চাই যে, আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় যেন আগামী বছর আমরা বলতে পারি: মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা। বাঙালি লড়তে জানে, মরতে জানে, জিততেও জানে। নিশ্চয়ই করোনাকালের পরে এক নতুন জীবনদায়ী অবস্থায় আমরা পৌঁছতে সক্ষম হব।
যেকোনো সামাজিক বিষয় বা সামাজিক সমস্যা নিয়ে আমরা যখন আলোচনা করি, তখন কখনো কখনো তত্ত্ব দিয়ে তার ব্যাখ্যা করি, আবার কখনো কখনো বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সে বিষয় বা সমস্যার বিশ্লেষণ করি। তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা...
৬ ঘণ্টা আগেগাজার সবচেয়ে সুপরিচিত ফুটবল স্টেডিয়ামটি এখন বিশৃঙ্খলায় ভরা। মাঠ ও বসার জায়গায় বাস্তুচ্যুত লোকের বন্যা। সবার পিঠে ব্যাগ আর কিছু কাপড়। কেউ অসুস্থ ব্যক্তিদের সাহায্য করছেন বা আহত আত্মীয়দের নিয়ে চলেছেন। আবার কেউ কেউ একা হাঁটছেন, খালি পায়েই হেঁটে চলেছেন।
৬ ঘণ্টা আগেসিসা একটি নরম ধাতু। এটি ঈষৎ নীলাভ ধূসর বর্ণের। এর পারমাণবিক সংখ্যা ৮২। ধাতুটি এতটাই নরম যে একটি ছুরির সাহায্যে একে কাটা যায়। সিসা কিন্তু মারাত্মক ক্ষতিকর বিষ। এই বিষের ভেতরেই বাস করছে বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ। বাংলাদেশের বাতাসে যেমন সিসার উপস্থিতি দেখা গেছে, তেমনি মাটিতে-পানিতেও পাওয়া গেছে...
৬ ঘণ্টা আগেঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রী পরিচয়ে দ্রুত অস্ত্রোপচারে সহায়তা করার কথা বলে পাপিয়া আক্তার রোগীর কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন। তিনি যে ‘ভুয়া’ ছাত্রী, সেটি বুঝতে পেরে চিকিৎসকেরা তাঁকে আটক করেন। তিনি গ্রেপ্তার হয়েছেন। হয়তো তাঁর শাস্তিও হবে। পাপিয়া শুধু অচেনা রোগী ও তাদের স্বজনদের নয়, তাঁর স্বামীকেও ধোঁকা...
৬ ঘণ্টা আগে