ড. নাদির জুনাইদ
১৯৭৪ সালের ১৫ মে বাংলাদেশে নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিস ইউজিন বোস্টার মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে পাঠানো একটি গোপন বার্তায় উল্লেখ করেছিলেন, দুই দিন আগে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেজর ফারুক রহমান আগে থেকে না জানিয়েই মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তা উইলিয়াম এফ গ্রেশামের সঙ্গে দেখা করেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তার নির্দেশে এসেছেন জানিয়ে বাংলাদেশে সরকার উৎখাতের কোনো ঘটনা ঘটলে সে ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব কেমন হবে এবং এমন পরিস্থিতিতে কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ যেন না ঘটে, সে ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র ব্যবস্থা নেবে কি না, গ্রেশামের কাছে ফারুক তা জানতে চান। কর্নেল শাফায়াত জামিলের লেখা থেকে জানা যায়, ফারুক ১৯৭৩ সালেও একবার সেনাবাহিনীতে সেই সময় থাকা মাত্র তিনটি ট্যাংক নিয়ে অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করেছিলেন এবং এ তথ্য সেনাবাহিনীতে ফাঁস হয়ে গিয়েছিল। ঊর্ধ্বতন অফিসাররা নাকি ফারুকের এই চেষ্টার কথা জানতেন। সেই সময় ট্যাংক রেজিমেন্টে কর্মরত মেজর নাসির উদ্দিনের লেখা থেকে জানা যায়, ১৯৭৫ সালের মার্চ মাসেও একবার ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে মহড়ার জন্য ট্যাংক পাঠানোর সময় ফারুক সেই ট্যাংকগুলো নিয়ে অভ্যুত্থান করতে চেয়েছিলেন। তখন সেনাবাহিনীর তৎকালীন চিফ অব জেনারেল স্টাফ (সিজিএস) ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে জানালে তিনি নাকি ফারুককে নিবৃত্ত করেছিলেন।
জানা যায়, বাংলাদেশে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানোর ষড়যন্ত্র হচ্ছে, সে কথা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে জানিয়েছিলেন ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান। ১৯৭৫ সালের মার্চে বঙ্গবন্ধুকে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা অভ্যুত্থানের ব্যাপারে আরও স্পষ্ট তথ্য দিয়েছিল এবং এ সময় মার্কিন প্রশাসনের পক্ষ থেকেও বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করা হয়েছিল– এমন কথা বলেছিলেন মার্কিন কূটনীতিক আলফ্রেড আথারটন। ভারতীয় ও মার্কিনদের কথা থেকে জানা যায়, এমন সতর্কবার্তায় বঙ্গবন্ধু গুরুত্ব দেননি। তিনি বিশ্বাস করতেন, দেশের কেউ তাঁর ক্ষতি করবে না। কিন্তু এ ক্ষেত্রে যে প্রশ্নটি তৈরি হয় তা হলো, সেই সময় সেনাবাহিনী এবং সরকারের অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থা সেনা অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে পেরে তা বন্ধ করার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেয়নি কেন? মেজর ফারুক সরকার উৎখাত করার জন্য অভ্যুত্থান করতে চেয়েছিলেন–এমন কথা যদি সেনাবাহিনীর বিভিন্ন পর্যায়ের অফিসাররা জেনেই থাকেন, তাহলে তাঁকে কী করে ঢাকা সেনানিবাসেই ট্যাংক রেজিমেন্ট প্রথম বেঙ্গল ল্যান্সারসের উপ-অধিনায়ক পদে রাখা হয়েছিল?
১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডসমূহের প্রধান দুই পরিকল্পনাকারী মেজর ফারুক রহমান আর মেজর আবদুর রশীদ সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাসকে একটি ভিডিও সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। মেজর ফারুক সেখানে বলেছেন, ১৯৭৫ সালের মার্চ মাসেই তিনি সেনাবাহিনীর তৎকালীন উপপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে তাঁদের সরকার উৎখাতের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৯ আগস্ট সেনাসদরে ঢাকার সব ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তার উপস্থিতিতে একটি বৈঠকে মেজর রশীদ বলেছিলেন, সেনাবাহিনীর সব সিনিয়র অফিসার ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের কথা আগে থেকেই জানতেন। প্রত্যেকের সঙ্গে আগেই তাঁদের আলাদাভাবে সমঝোতা হয়েছিল। কিন্তু সেই সভায় কর্নেল শাফায়াত জামিল ছাড়া অন্য কোনো সিনিয়র অফিসার রশীদের এমন কথার প্রতিবাদ করেননি। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন তাঁর বইয়ে লিখেছেন, ১৮ আগস্ট মেজর ডালিম তাঁকে বলেছিলেন, অভ্যুত্থানের ব্যাপারে সব সিনিয়র অফিসারের সমর্থন অভ্যুত্থানকারীরা আদায় করেছিলেন। রশীদ ও ডালিমের এমন বক্তব্য সত্যি কি না, তা নিশ্চিতভাবে জানা কঠিন হলেও ১৫ আগস্ট আক্রমণের খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থতা এবং হত্যাকাণ্ড ঘটে যাওয়ার পর খুনি অফিসারদের মুখোমুখি হয়ে তাঁদের গ্রেপ্তার করার ব্যাপারে সেনাবাহিনীর তৎকালীন ঊর্ধ্বতন অফিসারদের উদ্যোগহীনতা অবশ্যই প্রশ্ন তৈরি করে।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর ১৫ আগস্ট রাষ্ট্রপতির পদে আসীন হয়ে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে খন্দকার মোশতাক আহমদ বলেছিলেন, ‘দেশের শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন সর্বমহলের কাম্য হওয়া সত্ত্বেও বিধান অনুযায়ী তা সম্ভব না হওয়ায় সরকার পরিবর্তনের জন্য সামরিক বাহিনীকে এগিয়ে আসতে হয়েছে। সশস্ত্র বাহিনী পরমতম নিষ্ঠার সঙ্গে তাদের দায়িত্ব সম্পন্ন করে দেশবাসীর সামনে সম্ভাবনার এক স্বর্ণদ্বার উন্মোচন করেছে।’ মোশতাক তাঁর ভাষণে অভ্যুত্থান ও হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের ব্যাপারে কেবল কতিপয় সেনা কর্মকর্তার জড়িত থাকার কথা নয়, সমগ্র সামরিক বাহিনীর ভূমিকার কথা উল্লেখ করলেও সশস্ত্র বাহিনী থেকে মোশতাকের এমন কথার কোনো প্রতিবাদ তখন করা হয়নি। বরং তিন বাহিনীর প্রধানেরাই ১৫ আগস্টের নৃশংস ও অমানবিক হত্যাকাণ্ডসমূহের পর সম্পূর্ণ অবৈধভাবে রাষ্ট্রপতি পদে আসা মোশতাকের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন। বলা হয়, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পেছনে দেশের ও দেশের বাইরের বিভিন্ন চক্রের ষড়যন্ত্র ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর দেশের সশস্ত্র বাহিনী কেন হত্যাকাণ্ডে যুক্ত মাত্র দুটি ইউনিটকে প্রতিরোধ না করে নিষ্ক্রিয় থাকল?
১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডে যুক্ত অফিসারদের প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রে ব্যর্থতার ব্যাপারে তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহ আর ঢাকার ৪৬ ব্রিগেডের তৎকালীন কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিল পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়েছেন। সফিউল্লাহ বলেছেন, ১৫ আগস্ট ভোরে তিনি শাফায়াত জামিলকে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে হামলাকারীদের প্রতিরোধের জন্য তিনটি পদাতিক ব্যাটালিয়ন (১, ২ আর ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট) দ্রুত পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। আর শাফায়াত জামিল বলেছেন, সেই ভোরে সেনাপ্রধানের কাছ থেকে হামলাকারীদের প্রতিরোধ করার ব্যাপারে তিনি কোনো পরামর্শ বা নির্দেশ পাননি। হত্যাকাণ্ড ঘটে যাওয়ার পর জানা যায়, অভ্যুত্থানে ব্যবহার করা ট্যাংকগুলোতে কোনো গোলা নেই। এ তথ্য জানার পর তো বিদ্রোহী দুটি ইউনিটকে দমন করতে আরও দ্রুত উদ্যোগ নেওয়ার কথা। অথচ তাদের দমনের চেষ্টা করার পরিবর্তে ট্যাংকগুলোর জন্য জয়দেবপুরের অর্ডন্যান্স ডিপো থেকে গোলা প্রদানের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। সফিউল্লাহ বলেছেন, তাঁর অনুমতি ছাড়াই সিজিএস ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ট্যাংকগুলোতে গোলা প্রদানের নির্দেশ দিয়েছিলেন। আর শাফায়াত জামিল জানিয়েছেন, ট্যাংকগুলোতে গোলা প্রদানের অনুমতিপত্র দেওয়ার জন্য সিজিএসকে নির্দেশ দিয়েছিলেন সেনাপ্রধান নিজেই।
ট্যাংক ধ্বংস করার ক্ষেত্রে জঙ্গিবিমান অত্যন্ত কার্যকর। কিন্তু ১৫ আগস্ট বিদ্রোহী ইউনিট দুটিকে দমন করার জন্য জঙ্গিবিমান ব্যবহারের কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। বরং মেজর জেনারেল আমীন আহম্মেদ চৌধুরীর বই থেকে জানা যায়, সেদিন রক্ষীবাহিনীর সাভার প্রশিক্ষণকেন্দ্রের ওপর ঝাঁপ দেওয়ার জন্য তাঁর অনুরোধে সেখানে জঙ্গিবিমান পাঠানো হয়েছিল এবং জঙ্গিবিমান রক্ষীবাহিনীর দপ্তর লক্ষ্য করে কয়েকবার ঝাঁপও দিয়েছিল। সেদিন রক্ষীবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সেনা কর্মকর্তারা চিন্তা করছিলেন, অথচ সেনাবাহিনীতে যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, সেই চেইন অব কমান্ড ভেঙে দেশের রাষ্ট্রপতিকে নির্মমভাবে হত্যা করার সঙ্গে জড়িত দুটি সেনা ইউনিটের সদস্যদের দমন করার কোনো চেষ্টা সেদিন সশস্ত্র বাহিনী করেনি। চেইন অব কমান্ড ভেঙে ফেলার পর তাৎক্ষণিকভাবে বিদ্রোহীদের প্রতিরোধ না করার কারণে সেদিন সশস্ত্র বাহিনীতে যে পরিবেশ তৈরি হয়েছিল, তার ধারাবাহিকতা এবং প্রভাবেই কি ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে, ১৯৭৭ সালে এবং ১৯৮১ সালে সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনীতে বিভিন্ন অভ্যুত্থান ঘটেনি? এসব অভ্যুত্থানে বিভিন্ন অফিসারকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল, পরে প্রশ্নবিদ্ধ বিচারে ফাঁসি হয়েছিল অনেক অফিসার ও সৈনিকের, অনেকে হারিয়েছিলেন তাঁদের চাকরি।
১৫ আগস্ট নিজের পেশাগত ও নৈতিক দায়িত্ব পালনে অবিচল ছিলেন সামরিক বাহিনীর একজন কর্মকর্তা, কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদ। বঙ্গবন্ধুর সামরিক সচিব ও প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষে কদিন আগে তিনি যোগ দিয়েছিলেন অন্য পদে। ১৫ আগস্ট ভোরে বঙ্গবন্ধুর ফোন পেয়ে তিনি একাই ছুটে গিয়েছিলেন ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের দিকে। আক্রমণকারী সৈনিকদের দেখে এবং গুলির শব্দ শুনেও তিনি ভীত হননি। বঙ্গবন্ধুকে বিপদমুক্ত করার জন্য তিনি এগিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। তখন ঘাতকেরা গুলি করে হত্যা করেছিল এই কর্তব্যপরায়ণ ও সাহসী সেনা কর্মকর্তাকে। তাঁর বেদনাদায়ক মৃত্যু ঘটেছিল, কিন্তু নৈতিক ও পেশাগত কর্তব্য পালনের অসাধারণ দৃষ্টান্ত তৈরি করে তিনি প্রাণ দিয়েছিলেন। ১৫ আগস্ট অনেকেই কর্তব্য পালন করেননি। অকল্পনীয় নির্মমতা ঘটে যাওয়ার পর তাৎক্ষণিকভাবে ঘাতকদের দমন করার দায়িত্ব যাঁদের ছিল, তাঁরা সেদিন ছিলেন নিষ্ক্রিয়। এমন নিষ্ক্রিয়তার মাধ্যমে সেদিন তাঁরা নৈতিকতাবোধ অগ্রাহ্য করেছিলেন। আর অবমাননা করেছিলেন নিজেদের পেশাগত ও মানবিক অবস্থান।
লেখক: অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
১৯৭৪ সালের ১৫ মে বাংলাদেশে নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিস ইউজিন বোস্টার মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে পাঠানো একটি গোপন বার্তায় উল্লেখ করেছিলেন, দুই দিন আগে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেজর ফারুক রহমান আগে থেকে না জানিয়েই মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তা উইলিয়াম এফ গ্রেশামের সঙ্গে দেখা করেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তার নির্দেশে এসেছেন জানিয়ে বাংলাদেশে সরকার উৎখাতের কোনো ঘটনা ঘটলে সে ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব কেমন হবে এবং এমন পরিস্থিতিতে কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ যেন না ঘটে, সে ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র ব্যবস্থা নেবে কি না, গ্রেশামের কাছে ফারুক তা জানতে চান। কর্নেল শাফায়াত জামিলের লেখা থেকে জানা যায়, ফারুক ১৯৭৩ সালেও একবার সেনাবাহিনীতে সেই সময় থাকা মাত্র তিনটি ট্যাংক নিয়ে অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করেছিলেন এবং এ তথ্য সেনাবাহিনীতে ফাঁস হয়ে গিয়েছিল। ঊর্ধ্বতন অফিসাররা নাকি ফারুকের এই চেষ্টার কথা জানতেন। সেই সময় ট্যাংক রেজিমেন্টে কর্মরত মেজর নাসির উদ্দিনের লেখা থেকে জানা যায়, ১৯৭৫ সালের মার্চ মাসেও একবার ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে মহড়ার জন্য ট্যাংক পাঠানোর সময় ফারুক সেই ট্যাংকগুলো নিয়ে অভ্যুত্থান করতে চেয়েছিলেন। তখন সেনাবাহিনীর তৎকালীন চিফ অব জেনারেল স্টাফ (সিজিএস) ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে জানালে তিনি নাকি ফারুককে নিবৃত্ত করেছিলেন।
জানা যায়, বাংলাদেশে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানোর ষড়যন্ত্র হচ্ছে, সে কথা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে জানিয়েছিলেন ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান। ১৯৭৫ সালের মার্চে বঙ্গবন্ধুকে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা অভ্যুত্থানের ব্যাপারে আরও স্পষ্ট তথ্য দিয়েছিল এবং এ সময় মার্কিন প্রশাসনের পক্ষ থেকেও বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করা হয়েছিল– এমন কথা বলেছিলেন মার্কিন কূটনীতিক আলফ্রেড আথারটন। ভারতীয় ও মার্কিনদের কথা থেকে জানা যায়, এমন সতর্কবার্তায় বঙ্গবন্ধু গুরুত্ব দেননি। তিনি বিশ্বাস করতেন, দেশের কেউ তাঁর ক্ষতি করবে না। কিন্তু এ ক্ষেত্রে যে প্রশ্নটি তৈরি হয় তা হলো, সেই সময় সেনাবাহিনী এবং সরকারের অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থা সেনা অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে পেরে তা বন্ধ করার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেয়নি কেন? মেজর ফারুক সরকার উৎখাত করার জন্য অভ্যুত্থান করতে চেয়েছিলেন–এমন কথা যদি সেনাবাহিনীর বিভিন্ন পর্যায়ের অফিসাররা জেনেই থাকেন, তাহলে তাঁকে কী করে ঢাকা সেনানিবাসেই ট্যাংক রেজিমেন্ট প্রথম বেঙ্গল ল্যান্সারসের উপ-অধিনায়ক পদে রাখা হয়েছিল?
১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডসমূহের প্রধান দুই পরিকল্পনাকারী মেজর ফারুক রহমান আর মেজর আবদুর রশীদ সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাসকে একটি ভিডিও সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। মেজর ফারুক সেখানে বলেছেন, ১৯৭৫ সালের মার্চ মাসেই তিনি সেনাবাহিনীর তৎকালীন উপপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে তাঁদের সরকার উৎখাতের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৯ আগস্ট সেনাসদরে ঢাকার সব ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তার উপস্থিতিতে একটি বৈঠকে মেজর রশীদ বলেছিলেন, সেনাবাহিনীর সব সিনিয়র অফিসার ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের কথা আগে থেকেই জানতেন। প্রত্যেকের সঙ্গে আগেই তাঁদের আলাদাভাবে সমঝোতা হয়েছিল। কিন্তু সেই সভায় কর্নেল শাফায়াত জামিল ছাড়া অন্য কোনো সিনিয়র অফিসার রশীদের এমন কথার প্রতিবাদ করেননি। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন তাঁর বইয়ে লিখেছেন, ১৮ আগস্ট মেজর ডালিম তাঁকে বলেছিলেন, অভ্যুত্থানের ব্যাপারে সব সিনিয়র অফিসারের সমর্থন অভ্যুত্থানকারীরা আদায় করেছিলেন। রশীদ ও ডালিমের এমন বক্তব্য সত্যি কি না, তা নিশ্চিতভাবে জানা কঠিন হলেও ১৫ আগস্ট আক্রমণের খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থতা এবং হত্যাকাণ্ড ঘটে যাওয়ার পর খুনি অফিসারদের মুখোমুখি হয়ে তাঁদের গ্রেপ্তার করার ব্যাপারে সেনাবাহিনীর তৎকালীন ঊর্ধ্বতন অফিসারদের উদ্যোগহীনতা অবশ্যই প্রশ্ন তৈরি করে।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর ১৫ আগস্ট রাষ্ট্রপতির পদে আসীন হয়ে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে খন্দকার মোশতাক আহমদ বলেছিলেন, ‘দেশের শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন সর্বমহলের কাম্য হওয়া সত্ত্বেও বিধান অনুযায়ী তা সম্ভব না হওয়ায় সরকার পরিবর্তনের জন্য সামরিক বাহিনীকে এগিয়ে আসতে হয়েছে। সশস্ত্র বাহিনী পরমতম নিষ্ঠার সঙ্গে তাদের দায়িত্ব সম্পন্ন করে দেশবাসীর সামনে সম্ভাবনার এক স্বর্ণদ্বার উন্মোচন করেছে।’ মোশতাক তাঁর ভাষণে অভ্যুত্থান ও হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের ব্যাপারে কেবল কতিপয় সেনা কর্মকর্তার জড়িত থাকার কথা নয়, সমগ্র সামরিক বাহিনীর ভূমিকার কথা উল্লেখ করলেও সশস্ত্র বাহিনী থেকে মোশতাকের এমন কথার কোনো প্রতিবাদ তখন করা হয়নি। বরং তিন বাহিনীর প্রধানেরাই ১৫ আগস্টের নৃশংস ও অমানবিক হত্যাকাণ্ডসমূহের পর সম্পূর্ণ অবৈধভাবে রাষ্ট্রপতি পদে আসা মোশতাকের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন। বলা হয়, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পেছনে দেশের ও দেশের বাইরের বিভিন্ন চক্রের ষড়যন্ত্র ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর দেশের সশস্ত্র বাহিনী কেন হত্যাকাণ্ডে যুক্ত মাত্র দুটি ইউনিটকে প্রতিরোধ না করে নিষ্ক্রিয় থাকল?
১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডে যুক্ত অফিসারদের প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রে ব্যর্থতার ব্যাপারে তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহ আর ঢাকার ৪৬ ব্রিগেডের তৎকালীন কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিল পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়েছেন। সফিউল্লাহ বলেছেন, ১৫ আগস্ট ভোরে তিনি শাফায়াত জামিলকে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে হামলাকারীদের প্রতিরোধের জন্য তিনটি পদাতিক ব্যাটালিয়ন (১, ২ আর ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট) দ্রুত পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। আর শাফায়াত জামিল বলেছেন, সেই ভোরে সেনাপ্রধানের কাছ থেকে হামলাকারীদের প্রতিরোধ করার ব্যাপারে তিনি কোনো পরামর্শ বা নির্দেশ পাননি। হত্যাকাণ্ড ঘটে যাওয়ার পর জানা যায়, অভ্যুত্থানে ব্যবহার করা ট্যাংকগুলোতে কোনো গোলা নেই। এ তথ্য জানার পর তো বিদ্রোহী দুটি ইউনিটকে দমন করতে আরও দ্রুত উদ্যোগ নেওয়ার কথা। অথচ তাদের দমনের চেষ্টা করার পরিবর্তে ট্যাংকগুলোর জন্য জয়দেবপুরের অর্ডন্যান্স ডিপো থেকে গোলা প্রদানের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। সফিউল্লাহ বলেছেন, তাঁর অনুমতি ছাড়াই সিজিএস ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ট্যাংকগুলোতে গোলা প্রদানের নির্দেশ দিয়েছিলেন। আর শাফায়াত জামিল জানিয়েছেন, ট্যাংকগুলোতে গোলা প্রদানের অনুমতিপত্র দেওয়ার জন্য সিজিএসকে নির্দেশ দিয়েছিলেন সেনাপ্রধান নিজেই।
ট্যাংক ধ্বংস করার ক্ষেত্রে জঙ্গিবিমান অত্যন্ত কার্যকর। কিন্তু ১৫ আগস্ট বিদ্রোহী ইউনিট দুটিকে দমন করার জন্য জঙ্গিবিমান ব্যবহারের কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। বরং মেজর জেনারেল আমীন আহম্মেদ চৌধুরীর বই থেকে জানা যায়, সেদিন রক্ষীবাহিনীর সাভার প্রশিক্ষণকেন্দ্রের ওপর ঝাঁপ দেওয়ার জন্য তাঁর অনুরোধে সেখানে জঙ্গিবিমান পাঠানো হয়েছিল এবং জঙ্গিবিমান রক্ষীবাহিনীর দপ্তর লক্ষ্য করে কয়েকবার ঝাঁপও দিয়েছিল। সেদিন রক্ষীবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সেনা কর্মকর্তারা চিন্তা করছিলেন, অথচ সেনাবাহিনীতে যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, সেই চেইন অব কমান্ড ভেঙে দেশের রাষ্ট্রপতিকে নির্মমভাবে হত্যা করার সঙ্গে জড়িত দুটি সেনা ইউনিটের সদস্যদের দমন করার কোনো চেষ্টা সেদিন সশস্ত্র বাহিনী করেনি। চেইন অব কমান্ড ভেঙে ফেলার পর তাৎক্ষণিকভাবে বিদ্রোহীদের প্রতিরোধ না করার কারণে সেদিন সশস্ত্র বাহিনীতে যে পরিবেশ তৈরি হয়েছিল, তার ধারাবাহিকতা এবং প্রভাবেই কি ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে, ১৯৭৭ সালে এবং ১৯৮১ সালে সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনীতে বিভিন্ন অভ্যুত্থান ঘটেনি? এসব অভ্যুত্থানে বিভিন্ন অফিসারকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল, পরে প্রশ্নবিদ্ধ বিচারে ফাঁসি হয়েছিল অনেক অফিসার ও সৈনিকের, অনেকে হারিয়েছিলেন তাঁদের চাকরি।
১৫ আগস্ট নিজের পেশাগত ও নৈতিক দায়িত্ব পালনে অবিচল ছিলেন সামরিক বাহিনীর একজন কর্মকর্তা, কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদ। বঙ্গবন্ধুর সামরিক সচিব ও প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষে কদিন আগে তিনি যোগ দিয়েছিলেন অন্য পদে। ১৫ আগস্ট ভোরে বঙ্গবন্ধুর ফোন পেয়ে তিনি একাই ছুটে গিয়েছিলেন ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের দিকে। আক্রমণকারী সৈনিকদের দেখে এবং গুলির শব্দ শুনেও তিনি ভীত হননি। বঙ্গবন্ধুকে বিপদমুক্ত করার জন্য তিনি এগিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। তখন ঘাতকেরা গুলি করে হত্যা করেছিল এই কর্তব্যপরায়ণ ও সাহসী সেনা কর্মকর্তাকে। তাঁর বেদনাদায়ক মৃত্যু ঘটেছিল, কিন্তু নৈতিক ও পেশাগত কর্তব্য পালনের অসাধারণ দৃষ্টান্ত তৈরি করে তিনি প্রাণ দিয়েছিলেন। ১৫ আগস্ট অনেকেই কর্তব্য পালন করেননি। অকল্পনীয় নির্মমতা ঘটে যাওয়ার পর তাৎক্ষণিকভাবে ঘাতকদের দমন করার দায়িত্ব যাঁদের ছিল, তাঁরা সেদিন ছিলেন নিষ্ক্রিয়। এমন নিষ্ক্রিয়তার মাধ্যমে সেদিন তাঁরা নৈতিকতাবোধ অগ্রাহ্য করেছিলেন। আর অবমাননা করেছিলেন নিজেদের পেশাগত ও মানবিক অবস্থান।
লেখক: অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
দলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
১৩ ঘণ্টা আগেশেখ হাসিনা সরকারের পতনের ১০০ দিন পার হয়ে গেছে। ১০০ দিনে অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কিছু যে হয়নি, তা নয়। তবে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে অস্থিরতার লক্ষণ অস্পষ্ট নয়। এর মধ্যেই তিন দফায় উপদেষ্টার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।
১৩ ঘণ্টা আগেবাংলা ভাষায় অতিপরিচিত একটি শব্দবন্ধ হলো ‘খোলনলচে’। যাপিত জীবনে কমবেশি আমরা সবাই শব্দবন্ধটি প্রয়োগ করেছি। বাংলা বাগধারায় আমরা পড়েছি ‘খোলনলচে পালটানো’। বাংলা অভিধানে খোল শব্দের একাধিক অর্থ রয়েছে।
১৪ ঘণ্টা আগেঅফিসে যাতায়াতের সময় স্টাফ বাসে পরিচয়ের সূত্রে ফারজানা আক্তার আজিমপুরে নিজের বাসায় সাবলেট দিয়েছিলেন ফাতেমা আক্তার শাপলা নামের এক নারীকে। কিন্তু ফাতেমা যে একটি প্রতারক চক্রের সদস্য, সেটা তাঁর জানা ছিল না।
১৪ ঘণ্টা আগে