সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
আট দফাপন্থীরা চাইছে সরকার বনিয়াদি গণতন্ত্র হটিয়ে দিয়ে সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচন দিক এবং সে নির্বাচনে বিরোধী দলগুলো যাতে অবাধে অংশগ্রহণ করতে পারে, তার বন্দোবস্ত করুক। তাদের লক্ষ্য রাষ্ট্রব্যবস্থার বদল নয়, বিদ্যমান ব্যবস্থা টিকিয়ে রেখে ক্ষমতার অংশপ্রাপ্তি। দাবিগুলো আদায়ের জন্য যে গণ-আন্দোলন প্রয়োজন, সেটা গড়ে তোলার শক্তি ডাক-এর ছিল না। এবং জোটের অন্তর্ভুক্ত দলগুলোর ভেতর যে মতাদর্শিক ও অভীষ্ট লক্ষ্যের ব্যাপারে ঐক্য ছিল, তা-ও নয়। তবু তারা জোট বেঁধেছে যাতে সাধারণ মানুষের কাছে যাওয়ার একটা পথ পায় এবং নিজেদের নেতৃত্ব ধরে রাখতে পারে।
তাদের জন্য যেটা খুবই জরুরি ছিল সেটা হলো, আন্দোলন যাতে ‘চরমপন্থী’দের হাতে চলে না যায়, তার বন্দোবস্ত করা। ডাক-এর মধ্য দিয়ে সে চেষ্টাই করা হয়েছে। জোটবদ্ধ দলগুলো শুধু যে আইয়ুববিরোধী ছিল তা নয়, ছিল ভাসানীপন্থী, ন্যাপ তথা সমাজতন্ত্রবিরোধীও। ৬ ডিসেম্বর ১৯৬৮-তে ভাসানী ন্যাপ, শ্রমিক ফেডারেশন ও কৃষক সমিতিকে নিয়ে মওলানা ভাসানীর লাটভবন ঘেরাও এবং অটোরিকশাশ্রমিকদের অনুরোধে পরের দিন হরতাল ডাকা, ঢাকায় হরতালে অপ্রত্যাশিত সাফল্য এবং পাশাপাশি ছাত্রসমাজের আন্দোলন গড়ে ওঠা, ঐক্যবদ্ধ হয়ে ১১ দফা প্রণয়ন–এসব ঘটনা ডাক নেতাদের নড়েচড়ে ওঠার জন্য নিশ্চয়ই উদ্বুদ্ধ করেছিল।
ডাকের অন্তর্ভুক্ত দলগুলোর নামের তালিকাটা দেখলেই বোঝা যাবে কেন তারা আট দফার অধিক অগ্রসর হতে পারেনি। দলগুলো ছিল: ১. জামায়াতে ইসলামী; ২. নেজামে ইসলাম পার্টি; ৩. মুসলিম লীগ; ৪. জামিয়াতুল উলেমা-ই-ইসলাম; ৫. জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট (এনডিএফ); ৬. পিডিএমপন্থী আওয়ামী লীগ; ৭. ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ওয়ালীপন্থী); ৮. পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। দলগুলোর নাম অন্যভাবেও সাজানো যায়, সাজানো হয়েছেও। যেমন, আওয়ামী লীগের অনুরাগী সাহিত্যিক আবদুল হক সাজিয়েছেন। তিনি তাঁর রোজনামচা’য়। তাঁর লেখা তালিকায় ছয় দফাপন্থী আওয়ামী লীগ রয়েছে শীর্ষে। দল হিসেবে আওয়ামী লীগই অবশ্য তত দিনে শীর্ষস্থানে উঠে এসেছে। কিন্তু ডাক-এর ভেতর আওয়ামী লীগ শীর্ষে ছিল না। ডাক-এর মূল চরিত্র ছিল দক্ষিণপন্থী।
পূর্ব পাকিস্তানের ৯ নেতা ১৯৬২ সালে যে যৌথ বিবৃতি দেওয়ার ব্যাপারে একত্র হয়েছিলেন, যে বিবৃতিতে আইয়ুব খান প্রদত্ত সংবিধানকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল এবং দাবি করা হয়েছিল সংসদীয় ধরনের সরকার ও ফেডারেল রাষ্ট্রকাঠামোর; ডাক ছিল অনেকটা সেই যৌথতারই পরবর্তী ও সর্বপাকিস্তানি সম্প্রসারিত রূপ। জোটের প্রধান হিসেবে কাজ করতেন নবাবজাদা নসরুল্লাহ, যিনি দৃষ্টিভঙ্গিতে ছিলেন আপসপন্থী, জাতিগত পরিচয়ে পাঞ্জাবি এবং যিনি সহজেই চোখে পড়তেন মাথার টুপি ও সঙ্গের তামাক সেবনের গড়গড়াটির জন্য। ডাক-এ আওয়ামী লীগ যোগ দিয়েছিল অনেকটা নিরুপায় হয়েই। নেতা শেখ মুজিবুর রহমান তখন কারাগারে।
আইয়ুব সরকার তাঁকে অভিযুক্ত করেছে আগরতলা মামলায়, পারলে ফাঁসি দেবে। তাঁর মুক্তিই ছিল আওয়ামী লীগের প্রধান বিবেচনা। ডাক-এর অন্য দলগুলোর কোনোটাই ছয় দফাকে সমর্থন করেনি, অধিকাংশ দলই বিরোধিতা করেছে। তবে ডাক-এর কর্মসূচির তালিকায় ৫ নম্বরে যে উল্লেখ ছিল শেখ মুজিবসহ সব রাজনৈতিক বন্দীর মুক্তি এবং কোর্ট ও ট্রাইব্যুনালে মামলা প্রত্যাহারের দাবির–সেটা ছিল আওয়ামী লীগের দিক থেকে প্রধান প্রাপ্তি। আওয়ামী লীগের উদ্বেগ ছিল মামলা প্রত্যাহার ও নেতাকে মুক্ত করার ব্যাপারেই। ডাক গঠনে সর্বাধিক আগ্রহ ছিল দক্ষিণপন্থী দলগুলোরই। আন্দোলনের আড়ালে তারা সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেতে চাইছিল।
ডাক গঠনে সর্বাধিক মুনাফা পেয়েছে জামায়াতে ইসলামীই। অন্য দলগুলোর কাছ থেকে তারা স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছে এবং আইয়ুববিরোধী ‘গণতান্ত্রিক’ শক্তি হিসেবেও নিজেদের জাহির করার একটা মওকা পেয়ে গেছে। সত্তরের নির্বাচনে ভাসানী ন্যাপ অংশ নেয়নি; সেই সুযোগে তুলনায় অনেক কম ভোট পেলেও জামায়াত পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের পরেই নিজেকে জাহির করে ফেলেছে। পরবর্তী সময়ে জামায়াত সমাজতান্ত্রিক শক্তির প্রতিপক্ষের ভূমিকা নিয়ে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলোর বড় শরিকে পরিণত হয়েছে এবং একাত্তরের গণহত্যার সময়ে আইয়ুবের চেয়েও গর্হিত যে ইয়াহিয়া খান, তাঁর সহযোগী হিসেবে বেছে বেছে প্রগতিশীল বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের খুন করার কাজে লিপ্ত হয়েছে। ডাক জামায়াতকে আড়াল দিয়েছে ছুরি শাণানোর প্রস্তুতিতে।
আন্দোলনের শক্তি ডাক-এর ছিল না। ভাসানী ন্যাপ-এর সঙ্গে যুক্ত হয়নি। জামায়াত তো অবশ্যই, ওয়ালী ন্যাপও তাতে খুশি হয়েছে। আন্দোলনের সময়ে পূর্ববঙ্গ ডাক ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের প্রতিপক্ষই হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তবে আইয়ুবের কাছে আওয়ামী লীগ, দুই ন্যাপ ও ভুট্টোর পিপলস পার্টির তুলনায় ডাক যে অধিক গ্রহণযোগ্য ছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। উনসত্তরের অভ্যুত্থানের চূড়ান্ত পর্যায়ে আলোচনার জন্য ডাককেই তিনি ডেকেছিলেন এবং ডাক-এর মূল যে দুটি দাবি: পার্লামেন্টারি সরকার ও সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ নির্বাচন–সে দুটি মেনে নিয়েছিলেন। এবং প্রস্থান করেছিলেন, মানে মানে। তাই বলে ক্ষমতা তিনি ডাক-এর নেতাদের কাছে হস্তান্তর করেননি; সেটা তুলে দিয়েছিলেন সেনাবাহিনীর হাতেই। ডাক কিন্তু কেন্দ্রীয় পরিষদে জনসংখ্যার ভিত্তিতে পূর্ব ও পশ্চিমে আসন বণ্টন চায়নি; আইয়ুব খানও সেটির কথা উল্লেখ করেননি। জনসংখ্যার ভিত্তিতে আসন বণ্টনের দাবি ছিল পূর্ববঙ্গের; উনসত্তরের অভ্যুত্থানের মুখে পড়ে ইয়াহিয়া খান সেটা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। না মেনে কোনো উপায় ছিল না।
ভাসানীর ১৪ দফা নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। বিশেষভাবে আপত্তি এসেছিল ন্যাপেরই যে অংশ স্বতন্ত্র হয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল (রুশপন্থী বলে পরিচিত), তাদের কাছ থেকে। তারা বলছিল, ‘ছয় দফা আন্দোলনের বিরোধিতা করিয়া ন্যাপ প্রকারান্তরে স্বায়ত্তশাসন দাবিরই বিরোধিতা করেছে।’ জবাবে ন্যাপের এক বিশেষ অধিবেশনে (৩০ নভেম্বর ১৯৬৭) সভাপতির ভাষণে ভাসানী বলেছেন, তাঁদের (রুশপন্থীদের) ওই দাবি নিতান্ত হাস্যকর। তাঁর ভাষায়, ‘পাকিস্তানের বিভিন্ন ভাষাভাষী জনগণের স্বাধিকারসহ পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধী পররাষ্ট্রনীতির দাবিতে যে ন্যাপের জন্ম, সেই ন্যাপ স্বায়ত্তশাসনের দাবির বিরোধিতা করিতেছে, ইহার চাইতে হাস্যকর কথা আর কী হইতে পারে?’ তবে হ্যাঁ, তিনি স্বীকার করেন, ন্যাপের বক্তব্যের সঙ্গে অন্যদের বক্তব্যের পার্থক্য একটা আছে। সেটা আসলে মৌলিক। সেটি হলো পুঁজিবাদীদের সঙ্গে সমাজতন্ত্রীদের পার্থক্য।
ছয় দফার এই সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে শেখ মুজিব নিজেও কিন্তু সচেতন ছিলেন। তাঁর আমাদের বাঁচার দাবি ছয় দফা কর্মসূচি প্রচার-পুস্তকে বিষয়টি এসেছে এভাবে: ‘আমি যখন বলি, পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার ও স্তূপীকৃত হইতেছে, তখন আমি আঞ্চলিক বৈষম্যের কথাই বলি, ব্যক্তিগত বৈষম্যের কথা বলি না। আমি জানি, এ বৈষম্য সৃষ্টির জন্য পশ্চিম পাকিস্তানিরা দায়ী নয়। যত দিন ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার অবসান না হইবে, তত দিন ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে এই অসাম্য দূর হইবে না। কিন্তু তার আগে আঞ্চলিক শোষণও বন্ধ করিতে হইবে।’
এই বক্তব্যে যাকে ‘ব্যক্তিগত বৈষম্য’ বলা হচ্ছে, সেটিকেই আর্থ-রাজনৈতিক পরিভাষায় বলা হয় শ্রেণিগত বৈষম্য। ছয় দফার অঙ্গীকার হলো, আগে আঞ্চলিক শোষণ বন্ধ করা চাই। পরে শ্রেণিশোষণের অবসানের ব্যাপারটা দেখা যাবে।
১৪ দফায় জাতীয় জীবনের মূল সমস্যাগুলোর অধিকাংশেরই সমাধানের পথ নির্দেশ করা আছে; কিন্তু ‘জাতীয় মুক্তি’র ওই কর্মসূচি যে জনগ্রাহ্য ও আন্দোলনের জন্য গৃহীত হলো না, তার আসল কারণ হয়তো এই স্থূল বাস্তবতা যে অত্যন্ত সংগতভাবেই মধ্যবিত্ত তখন পাঞ্জাবি শাসন থেকে মুক্তির জন্য এমনভাবে ছটফট করছে যে, ছয় দফা যে পরিমাণ স্বাধীনতা এনে দেবে বলে মনে হচ্ছে, সেটাই আপাতত দরকার বলে ভেবেছে। তারা বড়জোর ছাত্রদের ১১ দফা পর্যন্ত যেতে প্রস্তুত; কিন্তু ওই মুহূর্তে ভাসানীর ১৪ দফা তাদের জন্য বেশ দূরের ব্যাপার।
পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃত্ব ছিল যে উঠতি মধ্যবিত্তের হাতে; তারা ১৪ দফায় কৃষক, শ্রমিক ও নিম্নমধ্যবিত্তের মুক্তির জন্য যেসব সুপারিশ উপস্থাপন করা হয়েছিল, তাতে উৎসাহী ছিল না, রাষ্ট্রের জন্য স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি তাদের অনেকের কাছেই প্রতীকী কথার মতো; তাদের আকাঙ্ক্ষা ছয় দফায় সংরক্ষিত ছিল, যে ছয় দফার ভেতর সম্ভাবনা উপ্ত ছিল এক দফায় পরিণত হওয়ার। তাদের কাছে পূর্ব ও পশ্চিমে দুই অর্থনীতি প্রত্যক্ষ সত্য। পূর্ববঙ্গের জন্য তারা একক অর্থনীতি চায়, যে অর্থনীতিতে তাদের কর্তৃত্ব থাকবে। মেহনতিদের স্বার্থ? সেটা দেখবে না কেন, অবশ্যই দেখবে, মেহনতিরা কি তাদের আপনজন নয়, বাঙালি নয়? সেই স্বাধীনতাই তাদের জন্য ছিল যথেষ্ট স্বাধীনতা, একসময় পাকিস্তান রাষ্ট্র যেটা দেবে বলেছিল; কিন্তু দেয়নি। ওই বেইমানদের সঙ্গে আর আমাদের কায়কারবার চলবে না, ওদের হাত থেকে অব্যাহতি চাই–এটাই ছিল মনোভাব। (চলবে)
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আট দফাপন্থীরা চাইছে সরকার বনিয়াদি গণতন্ত্র হটিয়ে দিয়ে সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচন দিক এবং সে নির্বাচনে বিরোধী দলগুলো যাতে অবাধে অংশগ্রহণ করতে পারে, তার বন্দোবস্ত করুক। তাদের লক্ষ্য রাষ্ট্রব্যবস্থার বদল নয়, বিদ্যমান ব্যবস্থা টিকিয়ে রেখে ক্ষমতার অংশপ্রাপ্তি। দাবিগুলো আদায়ের জন্য যে গণ-আন্দোলন প্রয়োজন, সেটা গড়ে তোলার শক্তি ডাক-এর ছিল না। এবং জোটের অন্তর্ভুক্ত দলগুলোর ভেতর যে মতাদর্শিক ও অভীষ্ট লক্ষ্যের ব্যাপারে ঐক্য ছিল, তা-ও নয়। তবু তারা জোট বেঁধেছে যাতে সাধারণ মানুষের কাছে যাওয়ার একটা পথ পায় এবং নিজেদের নেতৃত্ব ধরে রাখতে পারে।
তাদের জন্য যেটা খুবই জরুরি ছিল সেটা হলো, আন্দোলন যাতে ‘চরমপন্থী’দের হাতে চলে না যায়, তার বন্দোবস্ত করা। ডাক-এর মধ্য দিয়ে সে চেষ্টাই করা হয়েছে। জোটবদ্ধ দলগুলো শুধু যে আইয়ুববিরোধী ছিল তা নয়, ছিল ভাসানীপন্থী, ন্যাপ তথা সমাজতন্ত্রবিরোধীও। ৬ ডিসেম্বর ১৯৬৮-তে ভাসানী ন্যাপ, শ্রমিক ফেডারেশন ও কৃষক সমিতিকে নিয়ে মওলানা ভাসানীর লাটভবন ঘেরাও এবং অটোরিকশাশ্রমিকদের অনুরোধে পরের দিন হরতাল ডাকা, ঢাকায় হরতালে অপ্রত্যাশিত সাফল্য এবং পাশাপাশি ছাত্রসমাজের আন্দোলন গড়ে ওঠা, ঐক্যবদ্ধ হয়ে ১১ দফা প্রণয়ন–এসব ঘটনা ডাক নেতাদের নড়েচড়ে ওঠার জন্য নিশ্চয়ই উদ্বুদ্ধ করেছিল।
ডাকের অন্তর্ভুক্ত দলগুলোর নামের তালিকাটা দেখলেই বোঝা যাবে কেন তারা আট দফার অধিক অগ্রসর হতে পারেনি। দলগুলো ছিল: ১. জামায়াতে ইসলামী; ২. নেজামে ইসলাম পার্টি; ৩. মুসলিম লীগ; ৪. জামিয়াতুল উলেমা-ই-ইসলাম; ৫. জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট (এনডিএফ); ৬. পিডিএমপন্থী আওয়ামী লীগ; ৭. ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ওয়ালীপন্থী); ৮. পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। দলগুলোর নাম অন্যভাবেও সাজানো যায়, সাজানো হয়েছেও। যেমন, আওয়ামী লীগের অনুরাগী সাহিত্যিক আবদুল হক সাজিয়েছেন। তিনি তাঁর রোজনামচা’য়। তাঁর লেখা তালিকায় ছয় দফাপন্থী আওয়ামী লীগ রয়েছে শীর্ষে। দল হিসেবে আওয়ামী লীগই অবশ্য তত দিনে শীর্ষস্থানে উঠে এসেছে। কিন্তু ডাক-এর ভেতর আওয়ামী লীগ শীর্ষে ছিল না। ডাক-এর মূল চরিত্র ছিল দক্ষিণপন্থী।
পূর্ব পাকিস্তানের ৯ নেতা ১৯৬২ সালে যে যৌথ বিবৃতি দেওয়ার ব্যাপারে একত্র হয়েছিলেন, যে বিবৃতিতে আইয়ুব খান প্রদত্ত সংবিধানকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল এবং দাবি করা হয়েছিল সংসদীয় ধরনের সরকার ও ফেডারেল রাষ্ট্রকাঠামোর; ডাক ছিল অনেকটা সেই যৌথতারই পরবর্তী ও সর্বপাকিস্তানি সম্প্রসারিত রূপ। জোটের প্রধান হিসেবে কাজ করতেন নবাবজাদা নসরুল্লাহ, যিনি দৃষ্টিভঙ্গিতে ছিলেন আপসপন্থী, জাতিগত পরিচয়ে পাঞ্জাবি এবং যিনি সহজেই চোখে পড়তেন মাথার টুপি ও সঙ্গের তামাক সেবনের গড়গড়াটির জন্য। ডাক-এ আওয়ামী লীগ যোগ দিয়েছিল অনেকটা নিরুপায় হয়েই। নেতা শেখ মুজিবুর রহমান তখন কারাগারে।
আইয়ুব সরকার তাঁকে অভিযুক্ত করেছে আগরতলা মামলায়, পারলে ফাঁসি দেবে। তাঁর মুক্তিই ছিল আওয়ামী লীগের প্রধান বিবেচনা। ডাক-এর অন্য দলগুলোর কোনোটাই ছয় দফাকে সমর্থন করেনি, অধিকাংশ দলই বিরোধিতা করেছে। তবে ডাক-এর কর্মসূচির তালিকায় ৫ নম্বরে যে উল্লেখ ছিল শেখ মুজিবসহ সব রাজনৈতিক বন্দীর মুক্তি এবং কোর্ট ও ট্রাইব্যুনালে মামলা প্রত্যাহারের দাবির–সেটা ছিল আওয়ামী লীগের দিক থেকে প্রধান প্রাপ্তি। আওয়ামী লীগের উদ্বেগ ছিল মামলা প্রত্যাহার ও নেতাকে মুক্ত করার ব্যাপারেই। ডাক গঠনে সর্বাধিক আগ্রহ ছিল দক্ষিণপন্থী দলগুলোরই। আন্দোলনের আড়ালে তারা সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেতে চাইছিল।
ডাক গঠনে সর্বাধিক মুনাফা পেয়েছে জামায়াতে ইসলামীই। অন্য দলগুলোর কাছ থেকে তারা স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছে এবং আইয়ুববিরোধী ‘গণতান্ত্রিক’ শক্তি হিসেবেও নিজেদের জাহির করার একটা মওকা পেয়ে গেছে। সত্তরের নির্বাচনে ভাসানী ন্যাপ অংশ নেয়নি; সেই সুযোগে তুলনায় অনেক কম ভোট পেলেও জামায়াত পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের পরেই নিজেকে জাহির করে ফেলেছে। পরবর্তী সময়ে জামায়াত সমাজতান্ত্রিক শক্তির প্রতিপক্ষের ভূমিকা নিয়ে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলোর বড় শরিকে পরিণত হয়েছে এবং একাত্তরের গণহত্যার সময়ে আইয়ুবের চেয়েও গর্হিত যে ইয়াহিয়া খান, তাঁর সহযোগী হিসেবে বেছে বেছে প্রগতিশীল বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের খুন করার কাজে লিপ্ত হয়েছে। ডাক জামায়াতকে আড়াল দিয়েছে ছুরি শাণানোর প্রস্তুতিতে।
আন্দোলনের শক্তি ডাক-এর ছিল না। ভাসানী ন্যাপ-এর সঙ্গে যুক্ত হয়নি। জামায়াত তো অবশ্যই, ওয়ালী ন্যাপও তাতে খুশি হয়েছে। আন্দোলনের সময়ে পূর্ববঙ্গ ডাক ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের প্রতিপক্ষই হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তবে আইয়ুবের কাছে আওয়ামী লীগ, দুই ন্যাপ ও ভুট্টোর পিপলস পার্টির তুলনায় ডাক যে অধিক গ্রহণযোগ্য ছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। উনসত্তরের অভ্যুত্থানের চূড়ান্ত পর্যায়ে আলোচনার জন্য ডাককেই তিনি ডেকেছিলেন এবং ডাক-এর মূল যে দুটি দাবি: পার্লামেন্টারি সরকার ও সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ নির্বাচন–সে দুটি মেনে নিয়েছিলেন। এবং প্রস্থান করেছিলেন, মানে মানে। তাই বলে ক্ষমতা তিনি ডাক-এর নেতাদের কাছে হস্তান্তর করেননি; সেটা তুলে দিয়েছিলেন সেনাবাহিনীর হাতেই। ডাক কিন্তু কেন্দ্রীয় পরিষদে জনসংখ্যার ভিত্তিতে পূর্ব ও পশ্চিমে আসন বণ্টন চায়নি; আইয়ুব খানও সেটির কথা উল্লেখ করেননি। জনসংখ্যার ভিত্তিতে আসন বণ্টনের দাবি ছিল পূর্ববঙ্গের; উনসত্তরের অভ্যুত্থানের মুখে পড়ে ইয়াহিয়া খান সেটা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। না মেনে কোনো উপায় ছিল না।
ভাসানীর ১৪ দফা নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। বিশেষভাবে আপত্তি এসেছিল ন্যাপেরই যে অংশ স্বতন্ত্র হয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল (রুশপন্থী বলে পরিচিত), তাদের কাছ থেকে। তারা বলছিল, ‘ছয় দফা আন্দোলনের বিরোধিতা করিয়া ন্যাপ প্রকারান্তরে স্বায়ত্তশাসন দাবিরই বিরোধিতা করেছে।’ জবাবে ন্যাপের এক বিশেষ অধিবেশনে (৩০ নভেম্বর ১৯৬৭) সভাপতির ভাষণে ভাসানী বলেছেন, তাঁদের (রুশপন্থীদের) ওই দাবি নিতান্ত হাস্যকর। তাঁর ভাষায়, ‘পাকিস্তানের বিভিন্ন ভাষাভাষী জনগণের স্বাধিকারসহ পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধী পররাষ্ট্রনীতির দাবিতে যে ন্যাপের জন্ম, সেই ন্যাপ স্বায়ত্তশাসনের দাবির বিরোধিতা করিতেছে, ইহার চাইতে হাস্যকর কথা আর কী হইতে পারে?’ তবে হ্যাঁ, তিনি স্বীকার করেন, ন্যাপের বক্তব্যের সঙ্গে অন্যদের বক্তব্যের পার্থক্য একটা আছে। সেটা আসলে মৌলিক। সেটি হলো পুঁজিবাদীদের সঙ্গে সমাজতন্ত্রীদের পার্থক্য।
ছয় দফার এই সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে শেখ মুজিব নিজেও কিন্তু সচেতন ছিলেন। তাঁর আমাদের বাঁচার দাবি ছয় দফা কর্মসূচি প্রচার-পুস্তকে বিষয়টি এসেছে এভাবে: ‘আমি যখন বলি, পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার ও স্তূপীকৃত হইতেছে, তখন আমি আঞ্চলিক বৈষম্যের কথাই বলি, ব্যক্তিগত বৈষম্যের কথা বলি না। আমি জানি, এ বৈষম্য সৃষ্টির জন্য পশ্চিম পাকিস্তানিরা দায়ী নয়। যত দিন ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার অবসান না হইবে, তত দিন ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে এই অসাম্য দূর হইবে না। কিন্তু তার আগে আঞ্চলিক শোষণও বন্ধ করিতে হইবে।’
এই বক্তব্যে যাকে ‘ব্যক্তিগত বৈষম্য’ বলা হচ্ছে, সেটিকেই আর্থ-রাজনৈতিক পরিভাষায় বলা হয় শ্রেণিগত বৈষম্য। ছয় দফার অঙ্গীকার হলো, আগে আঞ্চলিক শোষণ বন্ধ করা চাই। পরে শ্রেণিশোষণের অবসানের ব্যাপারটা দেখা যাবে।
১৪ দফায় জাতীয় জীবনের মূল সমস্যাগুলোর অধিকাংশেরই সমাধানের পথ নির্দেশ করা আছে; কিন্তু ‘জাতীয় মুক্তি’র ওই কর্মসূচি যে জনগ্রাহ্য ও আন্দোলনের জন্য গৃহীত হলো না, তার আসল কারণ হয়তো এই স্থূল বাস্তবতা যে অত্যন্ত সংগতভাবেই মধ্যবিত্ত তখন পাঞ্জাবি শাসন থেকে মুক্তির জন্য এমনভাবে ছটফট করছে যে, ছয় দফা যে পরিমাণ স্বাধীনতা এনে দেবে বলে মনে হচ্ছে, সেটাই আপাতত দরকার বলে ভেবেছে। তারা বড়জোর ছাত্রদের ১১ দফা পর্যন্ত যেতে প্রস্তুত; কিন্তু ওই মুহূর্তে ভাসানীর ১৪ দফা তাদের জন্য বেশ দূরের ব্যাপার।
পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃত্ব ছিল যে উঠতি মধ্যবিত্তের হাতে; তারা ১৪ দফায় কৃষক, শ্রমিক ও নিম্নমধ্যবিত্তের মুক্তির জন্য যেসব সুপারিশ উপস্থাপন করা হয়েছিল, তাতে উৎসাহী ছিল না, রাষ্ট্রের জন্য স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি তাদের অনেকের কাছেই প্রতীকী কথার মতো; তাদের আকাঙ্ক্ষা ছয় দফায় সংরক্ষিত ছিল, যে ছয় দফার ভেতর সম্ভাবনা উপ্ত ছিল এক দফায় পরিণত হওয়ার। তাদের কাছে পূর্ব ও পশ্চিমে দুই অর্থনীতি প্রত্যক্ষ সত্য। পূর্ববঙ্গের জন্য তারা একক অর্থনীতি চায়, যে অর্থনীতিতে তাদের কর্তৃত্ব থাকবে। মেহনতিদের স্বার্থ? সেটা দেখবে না কেন, অবশ্যই দেখবে, মেহনতিরা কি তাদের আপনজন নয়, বাঙালি নয়? সেই স্বাধীনতাই তাদের জন্য ছিল যথেষ্ট স্বাধীনতা, একসময় পাকিস্তান রাষ্ট্র যেটা দেবে বলেছিল; কিন্তু দেয়নি। ওই বেইমানদের সঙ্গে আর আমাদের কায়কারবার চলবে না, ওদের হাত থেকে অব্যাহতি চাই–এটাই ছিল মনোভাব। (চলবে)
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
দলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
১ দিন আগেশেখ হাসিনা সরকারের পতনের ১০০ দিন পার হয়ে গেছে। ১০০ দিনে অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কিছু যে হয়নি, তা নয়। তবে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে অস্থিরতার লক্ষণ অস্পষ্ট নয়। এর মধ্যেই তিন দফায় উপদেষ্টার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।
১ দিন আগেবাংলা ভাষায় অতিপরিচিত একটি শব্দবন্ধ হলো ‘খোলনলচে’। যাপিত জীবনে কমবেশি আমরা সবাই শব্দবন্ধটি প্রয়োগ করেছি। বাংলা বাগধারায় আমরা পড়েছি ‘খোলনলচে পালটানো’। বাংলা অভিধানে খোল শব্দের একাধিক অর্থ রয়েছে।
১ দিন আগেঅফিসে যাতায়াতের সময় স্টাফ বাসে পরিচয়ের সূত্রে ফারজানা আক্তার আজিমপুরে নিজের বাসায় সাবলেট দিয়েছিলেন ফাতেমা আক্তার শাপলা নামের এক নারীকে। কিন্তু ফাতেমা যে একটি প্রতারক চক্রের সদস্য, সেটা তাঁর জানা ছিল না।
১ দিন আগে