ফারুক মেহেদী
ছেলেবেলায় বড়দের কাছে শোনা একটি গল্প মনে পড়ছে। গল্পটি হলো এমন–একদিন রাস্তার দুদিক থেকে দুজন লোক হেঁটে এক জায়গায় এসে থামেন। এমন সময় আলাপে আলাপে একজন আরেকজনকে জিজ্ঞেস করেন, ‘ভাইসাব, আপনার বাড়ি কোথায়?’ উত্তরে লোকটি বলেন, তাঁর বাড়ি রসুলপুর। তখন প্রশ্নকর্তা তাঁকে বলেন, ‘তাহলে আপনাকে একটা কচুরফুল।’ এবার যে লোকটির বাড়ি জানতে চাওয়া হয়েছিল তিনি উল্টো প্রশ্নকর্তার বাড়ি জানতে চেয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘ভাইসাব, আপনার বাড়ি কোথায়?’ উত্তরে প্রথম প্রশ্নকর্তার জবাব, তাঁর বাড়ি বলেশ্বর। এবার দ্বিতীয় প্রশ্নকর্তা প্রথম প্রশ্নকর্তাকে বলেন, ‘তাহলে আপনাকে একটা ঢেঁকি।’ প্রথম প্রশ্নকর্তা চোখ বড় করে বিস্ময়ের সঙ্গে দ্বিতীয় প্রশ্নকর্তার দিকে তাকান। বলেন, ‘ভাইসাব, আপনার বাড়ি রসুলপুর, তার সঙ্গে আমি মিলিয়ে আপনাকে দিলাম কচুরফুল। আর আপনি আমার বাড়ি বলেশ্বরের সঙ্গে মিলিয়ে কিছু দিতে পারতেন! বলেশ্বরের সঙ্গে তো ঢেঁকি যায় না! যেটা দিলেন, এটা কোনোভাবেই মিলল না! কেমনে কী?’ দ্বিতীয় প্রশ্নকর্তা মুচকি হেসে মুখে বাহাদুরি ভাব নিয়ে বলেন, ‘মিললে মিলুক না মিললে নাই, দিতে তো পারলাম!’ এই বলেই তিনি সামনে হাঁটতে শুরু করলেন। গল্পটি এখানেই শেষ হলে ভালো হতো!
কিন্তু সরকার আবারও বিদ্যুতের দাম বাড়াবে–এ খবরটি পড়ার পর আমার মাথায় ওই গল্পটিই কিলবিল করতে লাগল। কেন? সে কথাই বলব আজ। তার আগে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো নিয়ে নতুন খবরটি একটু বলে নিই। গণমাধ্যমে এসেছে যে গত বৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে সরকারের এক শীর্ষ কর্মকর্তা আরেক দফা বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কথা জানিয়েছেন। দাম বাড়াতে বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রস্তুতি নিতে মৌখিক নির্দেশ দিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। মন্ত্রণালয়ের গত মাসের সমন্বয় সভায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব তৈরি করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলেও খবরে জানা যায়। যদি দাম বাড়ানো হয়, তবে চার বছরের মধ্যে এটি তিনবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ঘটনা হবে। আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পাওয়ার পর এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেবে বিইআরসি।
বিদ্যুতের দাম বাড়াবেন, ঠিক আছে। দেশের উন্নয়নের জন্য সরকারের টাকার প্রয়োজন আছে। এ খাতে আরও বিনিয়োগ করতে হবে। বিদ্যুৎ খাত উন্নত হলে দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা উন্নত হবে। দেশ এগিয়ে যাবে–এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। তবে দেশের পরিস্থিতি কি তা সমর্থন করে? দেশ কি এখন স্বাভাবিক অবস্থায় আছে? করোনা সংক্রমণের পর থেকে গত দেড় বছরে বলতে গেলে মানুষ বেঁচে থাকার লড়াই করছে। একদিকে জীবন বাঁচানোর লড়াই, অন্যদিকে জীবিকা বাঁচানোর সংগ্রাম। করোনার প্রভাবে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ২০-২২ শতাংশ থেকে বেড়ে প্রায় ৩৫ শতাংশের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। হকার, দিনমজুর, লাখো কর্মী চাকরি হারিয়ে পথে বসেছেন। অসংখ্য ছোট-বড় প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। এসএমই খাতে বিপর্যয় নেমে এসেছে। বড় শিল্পের মালিকেরা উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন, এখন ঋণখেলাপি হওয়ার পথে। হোটেল, রেস্টুরেন্ট, পর্যটন, রিসোর্ট, পরিবহন খাত রীতিমতো বিপর্যস্ত। করোনার আঘাত দেড় বছরের, কিন্তু ক্ষতির প্রভাব তৈরি করেছে কয়েক বছরের।
এখনো করোনা চলে যায়নি। সামনে পরিস্থিতি কি আরও ভালো হবে না মন্দ, তা কেউ জানে না। ধনী, শিল্পপতি, বিত্তশালী থেকে শুরু করে রাস্তার দিন আনে দিন খায়–এমন মানুষও করোনার কারণে কমবেশি আক্রান্ত, ক্ষতিগ্রস্ত। এখন লকডাউন তুলে দেওয়া হলেও পুরো স্বাভাবিক হয়নি ব্যবসা-বাণিজ্য। ধারদেনায় জর্জরিত একেকজন। মাসের পর মাস চাকরি হারিয়ে সঞ্চয় ভেঙে খেয়ে অনেক মধ্যবিত্তের নিত্য দিনযাপন এখন একেকটি ভয়াল গল্প। সবার কথা গণমাধ্যমে আসে না। প্রতিটি পরিবারে সংকট, অভাব আর টানাটানির হাহাকার। এসব কজন জানে?
কথায় বলে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা! যেখানে মানুষ প্রতিদিনের খাবার জোটাতে মরিয়া। লোকসান আর দেনার ভারে জর্জরিত। বন্ধ কারখানা কীভাবে খুলবেন এই চিন্তায় ঘুম হারাম। যাঁরা চাকরি হারিয়েছেন তাঁরা আবারও কাজে ফিরতে পারবেন কি না, জানেন না। হাতে টাকা নেই। কাজ নেই। আবার প্রতিদিনের অপরিহার্য খরচ মেটাতে হচ্ছে। এর মধ্যে প্রতিটি নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। চাল-ডাল-তেল-চিনি-পেঁয়াজ-মাছ-মাংস—কোনটির দাম সহনীয় আছে? এ রকম অবস্থায় আর কোনো বাড়তি খরচের বোঝা কি মানুষ সইতে পারবে? এই করোনাকালে মধ্যবিত্তের আয় তো বাড়েইনি; বরং কমেছে বা বন্ধ হয়েছে। বাচ্চার স্কুল বন্ধ, কিন্তু অনলাইন ক্লাসের ইন্টারনেট খরচ, স্কুলে ক্লাস হয়নি কিন্তু প্রতি মাসে বেতন দিতে হচ্ছে। এভাবে সবার খরচের পাল্লা ভারী হয়েছে।
এমন ত্রাহি অবস্থায় যদি আবারও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়, তখন কী হবে? মধ্যবিত্তের সংসারে খরচের আরও একটি পালক যুক্ত হবে! যাঁরা কারখানার মালিক তাঁদের খরচের খাতা লম্বা হবে। তাতে কী হবে? তাঁরা যেসব পণ্য উৎপাদন করেন, সেবা দেন–এই সবকিছুর দাম বাড়বে। ধরা যাক, বিদ্যুতের দাম বাড়ল। তখন রেস্টুরেন্ট তার খাবারের দাম বাড়াবে। যাঁরা চিপস, ব্রেড, চিনি, তেল উৎপাদন করেন, তাঁরা এসবের দাম বাড়াবেন। দোকানদার আবার দামের অজুহাতে আরেক দফা বাড়াবেন; অর্থাৎ যা কিছুই নিত্যপ্রয়োজন প্রায় সবকিছুতে বাড়তি টাকা দিতে হবে ভোক্তাকে। এভাবে ঘরে বিদ্যুতের বাড়তি বিল, দোকানে পণ্যের বাড়তি দাম, রেস্টুরেন্টে খাবারের বাড়তি বিল–এসব করতে করতে ভোক্তার খরচের সঙ্গে বাড়তি কত টাকা যোগ হবে, এটা এখন একটু আন্দাজ করা যেতে পারে।
আসলে সরকার কখন কী করবে, তার একটা পরিকল্পিত হোমওয়ার্ক থাকা দরকার। এখন অগ্রাধিকারে কী করা উচিত? সবার আগে দরকার দেশের অর্থনীতিতে করোনার নেতিবাচক প্রভাব কতটা পড়ল, তার একটা বাস্তবসম্মত হিসাব বা জরিপ। ক্ষতি যে হয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এখন দেখতে হবে কোন কোন খাতে কতটুকু ক্ষতি হলো? কোন খাতে কত মানুষের চাকরি গেল? কত প্রতিষ্ঠান বন্ধ হলো? তাদের জন্য কী করা যায়? আবারও প্রণোদনা দিতে হবে কি না? মানুষের কর্মসংস্থান দিয়ে, কাজে ফিরিয়ে তাঁদের নিত্যখরচ মেটানোর সুযোগ তৈরি করে একটা স্থিতিশীল স্বাভাবিক অবস্থা যখন ফিরবে, তখনই সরকার নতুন কোনো কর, মাশুল আরোপ করতে পারে।
ভোক্তা, বিশেষ করে দরিদ্র, অতিদরিদ্র ও মধ্যবিত্তের ওপর যাতে চাপ না পড়ে, তা দেখা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সুযোগ আছে বলেই একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া বা চাপিয়ে দেওয়া ভালো কথা নয়। আসলে সরকারের কাজের ভেতরে পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর গবেষণার অভাবেই এমনটি হতে দেখা যায়। কখন কী করতে হবে, কোনটা আগে করা উচিত, এটা যাচাই-বাছাই না করেই সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হয়। কোনোটার সঙ্গে কোনোটা মিলিয়ে করা হয় না। যার ফল হয় উল্টো। যে কারণে আমার ওই গল্পটার কথা মনে হলো। সরকারও বিষয়টি সময়ের সঙ্গে যায় কি না, এটা এ সময়ে উপযুক্ত কি না, তার বাছবিচার না করে কে কী মনে করল তা না ভেবে, শুরুতে যে গল্পটি বলেছিলাম, তার দ্বিতীয় প্রশ্নকর্তার মতো ‘মিললে মিলল না মিললে নাই’র মতো অবস্থায় আছে!
এখন সরকারের আয়ের সময় নয়, বিনিয়োগের সময়। এমনিতেই কল্যাণমূলক রাষ্ট্র মানুষের স্বার্থ দেখবে আগে। এমন সরকারের উদ্দেশ্য আয় করা নয়; বরং ধারদেনা করে হলেও অপরিহার্য সেবা দেওয়াই সরকারের মূল কাজ। আরেকটি বিষয় করতে পারে তা হলো, বিদ্যুৎ খাতে বিপুল পরিমাণে সিস্টেম লস রয়েছে, তা কমিয়ে আনা। টাকার অঙ্কে সিস্টেম লস কিন্তু কম নয়। নিশ্চয় সরকারের কাছে এ হিসাব রয়েছে। এদিকে জোর মনোযোগ দেওয়া দরকার। প্রাতিষ্ঠানিক অনিয়ম, দুর্নীতি আর অপচয় রোধ করে সরকার এ কাজে দক্ষতা আনতে পারে। এতে বিপুল পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় হবে। এ থেকেও সরকার চাইলে বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে বিনিয়োগ করতে পারে।
সত্যি কথা হলো, বাংলাদেশ এগিয়ে যাওয়ার একটি সুন্দর পথে রয়েছে। এখানে আরও সরকারি বিনিয়োগ দরকার। আর বিদ্যুৎ খাত হলো উন্নয়নের মূল শক্তি। এ খাতে আরও বিনিয়োগ হলে স্বাভাবিকভাবেই সার্বিক অর্থনীতিতে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। তবে এখন ভোক্তা বা দেশের সাধারণ নাগরিকদের ওপর বাড়তি বোঝা চাপানোর সময় নয়। সময় হলে শুধু বিদ্যুৎ কেন; গ্যাস, পানিসহ সব বিলই বাড়াতে পারবে সরকার। সুযোগ তো রয়েছে। ওই সময় আসেনি। আগে গাছ বাঁচাতে হবে, গাছ টিকে গেলে, ফল ধরলে এটা খাওয়া যাবে, আবার বিক্রিও করা যাবে। কিন্তু গাছই যদি না বাঁচে, তাহলে ফল আসবে কোথা থেকে?
লেখক: সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
ছেলেবেলায় বড়দের কাছে শোনা একটি গল্প মনে পড়ছে। গল্পটি হলো এমন–একদিন রাস্তার দুদিক থেকে দুজন লোক হেঁটে এক জায়গায় এসে থামেন। এমন সময় আলাপে আলাপে একজন আরেকজনকে জিজ্ঞেস করেন, ‘ভাইসাব, আপনার বাড়ি কোথায়?’ উত্তরে লোকটি বলেন, তাঁর বাড়ি রসুলপুর। তখন প্রশ্নকর্তা তাঁকে বলেন, ‘তাহলে আপনাকে একটা কচুরফুল।’ এবার যে লোকটির বাড়ি জানতে চাওয়া হয়েছিল তিনি উল্টো প্রশ্নকর্তার বাড়ি জানতে চেয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘ভাইসাব, আপনার বাড়ি কোথায়?’ উত্তরে প্রথম প্রশ্নকর্তার জবাব, তাঁর বাড়ি বলেশ্বর। এবার দ্বিতীয় প্রশ্নকর্তা প্রথম প্রশ্নকর্তাকে বলেন, ‘তাহলে আপনাকে একটা ঢেঁকি।’ প্রথম প্রশ্নকর্তা চোখ বড় করে বিস্ময়ের সঙ্গে দ্বিতীয় প্রশ্নকর্তার দিকে তাকান। বলেন, ‘ভাইসাব, আপনার বাড়ি রসুলপুর, তার সঙ্গে আমি মিলিয়ে আপনাকে দিলাম কচুরফুল। আর আপনি আমার বাড়ি বলেশ্বরের সঙ্গে মিলিয়ে কিছু দিতে পারতেন! বলেশ্বরের সঙ্গে তো ঢেঁকি যায় না! যেটা দিলেন, এটা কোনোভাবেই মিলল না! কেমনে কী?’ দ্বিতীয় প্রশ্নকর্তা মুচকি হেসে মুখে বাহাদুরি ভাব নিয়ে বলেন, ‘মিললে মিলুক না মিললে নাই, দিতে তো পারলাম!’ এই বলেই তিনি সামনে হাঁটতে শুরু করলেন। গল্পটি এখানেই শেষ হলে ভালো হতো!
কিন্তু সরকার আবারও বিদ্যুতের দাম বাড়াবে–এ খবরটি পড়ার পর আমার মাথায় ওই গল্পটিই কিলবিল করতে লাগল। কেন? সে কথাই বলব আজ। তার আগে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো নিয়ে নতুন খবরটি একটু বলে নিই। গণমাধ্যমে এসেছে যে গত বৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে সরকারের এক শীর্ষ কর্মকর্তা আরেক দফা বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কথা জানিয়েছেন। দাম বাড়াতে বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রস্তুতি নিতে মৌখিক নির্দেশ দিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। মন্ত্রণালয়ের গত মাসের সমন্বয় সভায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব তৈরি করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলেও খবরে জানা যায়। যদি দাম বাড়ানো হয়, তবে চার বছরের মধ্যে এটি তিনবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ঘটনা হবে। আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পাওয়ার পর এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেবে বিইআরসি।
বিদ্যুতের দাম বাড়াবেন, ঠিক আছে। দেশের উন্নয়নের জন্য সরকারের টাকার প্রয়োজন আছে। এ খাতে আরও বিনিয়োগ করতে হবে। বিদ্যুৎ খাত উন্নত হলে দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা উন্নত হবে। দেশ এগিয়ে যাবে–এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। তবে দেশের পরিস্থিতি কি তা সমর্থন করে? দেশ কি এখন স্বাভাবিক অবস্থায় আছে? করোনা সংক্রমণের পর থেকে গত দেড় বছরে বলতে গেলে মানুষ বেঁচে থাকার লড়াই করছে। একদিকে জীবন বাঁচানোর লড়াই, অন্যদিকে জীবিকা বাঁচানোর সংগ্রাম। করোনার প্রভাবে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ২০-২২ শতাংশ থেকে বেড়ে প্রায় ৩৫ শতাংশের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। হকার, দিনমজুর, লাখো কর্মী চাকরি হারিয়ে পথে বসেছেন। অসংখ্য ছোট-বড় প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। এসএমই খাতে বিপর্যয় নেমে এসেছে। বড় শিল্পের মালিকেরা উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন, এখন ঋণখেলাপি হওয়ার পথে। হোটেল, রেস্টুরেন্ট, পর্যটন, রিসোর্ট, পরিবহন খাত রীতিমতো বিপর্যস্ত। করোনার আঘাত দেড় বছরের, কিন্তু ক্ষতির প্রভাব তৈরি করেছে কয়েক বছরের।
এখনো করোনা চলে যায়নি। সামনে পরিস্থিতি কি আরও ভালো হবে না মন্দ, তা কেউ জানে না। ধনী, শিল্পপতি, বিত্তশালী থেকে শুরু করে রাস্তার দিন আনে দিন খায়–এমন মানুষও করোনার কারণে কমবেশি আক্রান্ত, ক্ষতিগ্রস্ত। এখন লকডাউন তুলে দেওয়া হলেও পুরো স্বাভাবিক হয়নি ব্যবসা-বাণিজ্য। ধারদেনায় জর্জরিত একেকজন। মাসের পর মাস চাকরি হারিয়ে সঞ্চয় ভেঙে খেয়ে অনেক মধ্যবিত্তের নিত্য দিনযাপন এখন একেকটি ভয়াল গল্প। সবার কথা গণমাধ্যমে আসে না। প্রতিটি পরিবারে সংকট, অভাব আর টানাটানির হাহাকার। এসব কজন জানে?
কথায় বলে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা! যেখানে মানুষ প্রতিদিনের খাবার জোটাতে মরিয়া। লোকসান আর দেনার ভারে জর্জরিত। বন্ধ কারখানা কীভাবে খুলবেন এই চিন্তায় ঘুম হারাম। যাঁরা চাকরি হারিয়েছেন তাঁরা আবারও কাজে ফিরতে পারবেন কি না, জানেন না। হাতে টাকা নেই। কাজ নেই। আবার প্রতিদিনের অপরিহার্য খরচ মেটাতে হচ্ছে। এর মধ্যে প্রতিটি নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। চাল-ডাল-তেল-চিনি-পেঁয়াজ-মাছ-মাংস—কোনটির দাম সহনীয় আছে? এ রকম অবস্থায় আর কোনো বাড়তি খরচের বোঝা কি মানুষ সইতে পারবে? এই করোনাকালে মধ্যবিত্তের আয় তো বাড়েইনি; বরং কমেছে বা বন্ধ হয়েছে। বাচ্চার স্কুল বন্ধ, কিন্তু অনলাইন ক্লাসের ইন্টারনেট খরচ, স্কুলে ক্লাস হয়নি কিন্তু প্রতি মাসে বেতন দিতে হচ্ছে। এভাবে সবার খরচের পাল্লা ভারী হয়েছে।
এমন ত্রাহি অবস্থায় যদি আবারও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়, তখন কী হবে? মধ্যবিত্তের সংসারে খরচের আরও একটি পালক যুক্ত হবে! যাঁরা কারখানার মালিক তাঁদের খরচের খাতা লম্বা হবে। তাতে কী হবে? তাঁরা যেসব পণ্য উৎপাদন করেন, সেবা দেন–এই সবকিছুর দাম বাড়বে। ধরা যাক, বিদ্যুতের দাম বাড়ল। তখন রেস্টুরেন্ট তার খাবারের দাম বাড়াবে। যাঁরা চিপস, ব্রেড, চিনি, তেল উৎপাদন করেন, তাঁরা এসবের দাম বাড়াবেন। দোকানদার আবার দামের অজুহাতে আরেক দফা বাড়াবেন; অর্থাৎ যা কিছুই নিত্যপ্রয়োজন প্রায় সবকিছুতে বাড়তি টাকা দিতে হবে ভোক্তাকে। এভাবে ঘরে বিদ্যুতের বাড়তি বিল, দোকানে পণ্যের বাড়তি দাম, রেস্টুরেন্টে খাবারের বাড়তি বিল–এসব করতে করতে ভোক্তার খরচের সঙ্গে বাড়তি কত টাকা যোগ হবে, এটা এখন একটু আন্দাজ করা যেতে পারে।
আসলে সরকার কখন কী করবে, তার একটা পরিকল্পিত হোমওয়ার্ক থাকা দরকার। এখন অগ্রাধিকারে কী করা উচিত? সবার আগে দরকার দেশের অর্থনীতিতে করোনার নেতিবাচক প্রভাব কতটা পড়ল, তার একটা বাস্তবসম্মত হিসাব বা জরিপ। ক্ষতি যে হয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এখন দেখতে হবে কোন কোন খাতে কতটুকু ক্ষতি হলো? কোন খাতে কত মানুষের চাকরি গেল? কত প্রতিষ্ঠান বন্ধ হলো? তাদের জন্য কী করা যায়? আবারও প্রণোদনা দিতে হবে কি না? মানুষের কর্মসংস্থান দিয়ে, কাজে ফিরিয়ে তাঁদের নিত্যখরচ মেটানোর সুযোগ তৈরি করে একটা স্থিতিশীল স্বাভাবিক অবস্থা যখন ফিরবে, তখনই সরকার নতুন কোনো কর, মাশুল আরোপ করতে পারে।
ভোক্তা, বিশেষ করে দরিদ্র, অতিদরিদ্র ও মধ্যবিত্তের ওপর যাতে চাপ না পড়ে, তা দেখা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সুযোগ আছে বলেই একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া বা চাপিয়ে দেওয়া ভালো কথা নয়। আসলে সরকারের কাজের ভেতরে পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর গবেষণার অভাবেই এমনটি হতে দেখা যায়। কখন কী করতে হবে, কোনটা আগে করা উচিত, এটা যাচাই-বাছাই না করেই সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হয়। কোনোটার সঙ্গে কোনোটা মিলিয়ে করা হয় না। যার ফল হয় উল্টো। যে কারণে আমার ওই গল্পটার কথা মনে হলো। সরকারও বিষয়টি সময়ের সঙ্গে যায় কি না, এটা এ সময়ে উপযুক্ত কি না, তার বাছবিচার না করে কে কী মনে করল তা না ভেবে, শুরুতে যে গল্পটি বলেছিলাম, তার দ্বিতীয় প্রশ্নকর্তার মতো ‘মিললে মিলল না মিললে নাই’র মতো অবস্থায় আছে!
এখন সরকারের আয়ের সময় নয়, বিনিয়োগের সময়। এমনিতেই কল্যাণমূলক রাষ্ট্র মানুষের স্বার্থ দেখবে আগে। এমন সরকারের উদ্দেশ্য আয় করা নয়; বরং ধারদেনা করে হলেও অপরিহার্য সেবা দেওয়াই সরকারের মূল কাজ। আরেকটি বিষয় করতে পারে তা হলো, বিদ্যুৎ খাতে বিপুল পরিমাণে সিস্টেম লস রয়েছে, তা কমিয়ে আনা। টাকার অঙ্কে সিস্টেম লস কিন্তু কম নয়। নিশ্চয় সরকারের কাছে এ হিসাব রয়েছে। এদিকে জোর মনোযোগ দেওয়া দরকার। প্রাতিষ্ঠানিক অনিয়ম, দুর্নীতি আর অপচয় রোধ করে সরকার এ কাজে দক্ষতা আনতে পারে। এতে বিপুল পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় হবে। এ থেকেও সরকার চাইলে বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে বিনিয়োগ করতে পারে।
সত্যি কথা হলো, বাংলাদেশ এগিয়ে যাওয়ার একটি সুন্দর পথে রয়েছে। এখানে আরও সরকারি বিনিয়োগ দরকার। আর বিদ্যুৎ খাত হলো উন্নয়নের মূল শক্তি। এ খাতে আরও বিনিয়োগ হলে স্বাভাবিকভাবেই সার্বিক অর্থনীতিতে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। তবে এখন ভোক্তা বা দেশের সাধারণ নাগরিকদের ওপর বাড়তি বোঝা চাপানোর সময় নয়। সময় হলে শুধু বিদ্যুৎ কেন; গ্যাস, পানিসহ সব বিলই বাড়াতে পারবে সরকার। সুযোগ তো রয়েছে। ওই সময় আসেনি। আগে গাছ বাঁচাতে হবে, গাছ টিকে গেলে, ফল ধরলে এটা খাওয়া যাবে, আবার বিক্রিও করা যাবে। কিন্তু গাছই যদি না বাঁচে, তাহলে ফল আসবে কোথা থেকে?
লেখক: সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
দলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
১০ ঘণ্টা আগেশেখ হাসিনা সরকারের পতনের ১০০ দিন পার হয়ে গেছে। ১০০ দিনে অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কিছু যে হয়নি, তা নয়। তবে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে অস্থিরতার লক্ষণ অস্পষ্ট নয়। এর মধ্যেই তিন দফায় উপদেষ্টার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।
১০ ঘণ্টা আগেবাংলা ভাষায় অতিপরিচিত একটি শব্দবন্ধ হলো ‘খোলনলচে’। যাপিত জীবনে কমবেশি আমরা সবাই শব্দবন্ধটি প্রয়োগ করেছি। বাংলা বাগধারায় আমরা পড়েছি ‘খোলনলচে পালটানো’। বাংলা অভিধানে খোল শব্দের একাধিক অর্থ রয়েছে।
১০ ঘণ্টা আগেঅফিসে যাতায়াতের সময় স্টাফ বাসে পরিচয়ের সূত্রে ফারজানা আক্তার আজিমপুরে নিজের বাসায় সাবলেট দিয়েছিলেন ফাতেমা আক্তার শাপলা নামের এক নারীকে। কিন্তু ফাতেমা যে একটি প্রতারক চক্রের সদস্য, সেটা তাঁর জানা ছিল না।
১০ ঘণ্টা আগে