জাহীদ রেজা নূর
ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। বিমানবন্দরের একটি উড়োজাহাজের দিকে জনস্রোত। যে যেভাবে পারছেন, উঠতে চাইছেন উড়োজাহাজে। যেকোনো মূল্যে দেশ থেকে সরে পড়তে হবে! আফগানিস্তানের কাবুল এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে থাকা উড়োজাহাজটিকে মনে হচ্ছিল সেই আদিকালে ঢাকার রামপুরা-সদরঘাট চলাচলকারী মুড়ির টিন বাস।
এ কথা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না, আফগানিস্তানে তালেবান শাসন শুরু হয়ে গেছে।
মার্কিনরা ২০ বছর আফগানিস্তানে অবস্থান করে দুই ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি যুদ্ধে ব্যয় করে এখন ফিরে যাচ্ছে। এরই মধ্যে বহু মার্কিন সৈন্য ও আফগান নাগরিক নিহত ও আহত হয়েছে আফগানিস্তানে। ভিনদেশে এ রকম যুদ্ধ চালানো উচিত কি না, সেটা নিয়ে মার্কিন প্রশাসনে কোনো প্রশ্ন দেখা দেয়নি। যদিও ষাটের দশকের শেষে বা সত্তরের দশকের শুরুতে ভিয়েতনামে যুদ্ধ বাধিয়ে নাকানি-চুবানি খেয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। উদাহরণটি থাকার পরও কেন মার্কিনরা আফগানিস্তানকে যুদ্ধের জন্য বেছে নিল, সেই প্রশ্ন এড়ানো যাবে না। সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানে তাদের মতো সরকার গড়তে চেয়েও জড়িয়ে পড়েছিল এক ভয়ংকর ট্র্যাজেডিতে। সেই পথ ধরে মার্কিনরাও আফগানিস্তানে ঢুকেছিল।
দুই. বলা যায়, মার্কিনরা আফগানিস্তানকে অরক্ষিত রেখেই পালিয়ে গেল। এবার তালেবানের হাতে পরাজিত হওয়ার জন্য যেন মরিয়া হয়ে উঠেছিল আফগানিস্তান সরকার। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর টুইন টাওয়ারে হামলার সেই নির্মম দিনটির পর তালেবানকে শাস্তি দিতে চেয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু ফল যা হলো তাতে দেখা যাচ্ছে, ২০২১ সালের আগস্টের ১৬ তারিখের মধ্যে তালেবান আফগানিস্তানের ৮৫ শতাংশ অঞ্চলের দখল নিয়ে নিয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী ৩১ আগস্টের মধ্যে আন্তর্জাতিক যে মিত্র সৈন্যরা আছে আফগানিস্তানে, তারা ফিরে যাবে যে যার দেশে। কিন্তু আসলে তারা পেছনে কী রেখে যাবে? দেড় লাখ লাশ আর দুই ট্রিলিয়ন ডলার অর্থ ব্যয় ছাড়া আর কিছু কি অর্জন হলো? শান্তি কি ফিরে আসবে আফগানিস্তানে?
উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো, যারা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী বা শত্রুদেশ, তারাও কিন্তু মার্কিন অসহায়ত্বে আনন্দিত হয়নি। বরং তারাও সতর্ক দৃষ্টি রাখছে ঘটনাবলির দিকে। ইরান, রাশিয়া বা চীন—প্রতিটি দেশের কপালেই পড়েছে চিন্তার ভাঁজ। তেহরান তো বহু আগে থেকেই আফগান উদ্বাস্তুদের চাপে রয়েছে। ৩৫ লাখ আফগান উদ্বাস্তু বাস করছে দেশটিতে। এখন সীমান্ত পার হওয়া মানুষের সংখ্যা আরও অনেক বাড়বে বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। শুধু ইরানেই নয়, আশপাশের সীমান্তবর্তী প্রতিটি দেশই এখন আফগান উদ্বাস্তুর চাপে পড়তে পারে।
তিন. নানা সংবাদমাধ্যমে গতকাল কাবুল এয়ারপোর্টের যে ছবিগুলো দেখা গেছে তাতে বোঝা যায়, তালেবানের আগমনে ভীতসন্ত্রস্ত মানুষ দেশ ছাড়ার জন্য মরিয়া হয়ে রয়েছে। রাশিয়ার সংবাদমাধ্যম রিয়া নোভাস্তির একটি ভিডিওচিত্রে দেখা গেল, উড়ন্ত বিমান থেকে হঠাৎ পড়ে গেছেন দুজন মানুষ। রানওয়েতে দাঁড়িয়ে সবাই সেই মর্মান্তিক দৃশ্য দেখছেন।
২১ বছর পর আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করার যে ঘোষণা দিয়েছিল হোয়াইট হাউস, তাতে অনেকেই ভেবেছিলেন আফগান সরকার ও তাদের সৈন্যদল নিজেরাই অবস্থা সামলে নিতে পারবে। নিজ দেশের হাল নিজেরা ধরতে পারলে দেশটা এগিয়ে যাবে সামনের দিকে। কিন্তু তাদের সেই ভাবনা যে ছিল একেবারেই হাওয়ায় ভাসা, যার বাস্তব কোনো ভিত্তি ছিল না, সেটা বোঝা গেল খুব দ্রুত। তালেবানরা দখল করে নিল দেশ। মার্কিন সমর্থিত সরকারের টিকে থাকার মুরোদ ছিল না। এর একটাই অর্থ হতে পারে, সরকার চলছিল মূলত মার্কিন সহায়তায়। নিজ থেকে সরকারের কোনো ক্ষমতা বা শক্তিই ছিল না।
চার. ইন্টারনেটে কিছুক্ষণ থাকলেই বোঝা যায় কী পরিমাণ সংকটে পড়েছে কাবুল। বিমানবন্দরের পথে যানজট লেগেছে কয়েক কিলোমিটারজুড়ে। পাকিস্তান সীমান্তে তৈরি হয়েছে অদ্ভুত অবস্থা। কেউ সীমান্তপথে দেশ ছাড়তে চাইছেন, কেউ সীমান্তপথে ফিরতে চাইছেন আফগানিস্তানে। মার্কিনরা এ দেশে আসার পর সরকারবিরোধী অনেক আফগান নাগরিক পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাঁরাই এখন ফেরার কথা ভাবছেন। তালেবান মানেই সহিংসতা—এমন একটা ধারণা থাকলেও এখন পর্যন্ত তালেবান নেতারা কোনো ধরনের শান্তি ভঙ্গ করার কথা বলছেন না। তাঁরা সম্ভবত চাইছেন, বিশ্বরাজনীতিতে এই মুহূর্তে তাঁদের নিয়ে যেন কোনো সংকট তৈরি না হয়। এ কারণেই হয়তো রাশিয়ান কূটনীতিবিদেরা রয়ে গেছেন কাবুলেই। তালেবান তাঁদের নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়েছে।
পাঁচ. কাবুল এখন অচেনা। বিশাল বিশৃঙ্খলার সময় যা যা হওয়ার কথা, তার সবই হচ্ছে। কাবুল থেকে বাণিজ্যিক ফ্লাইট বন্ধ হয়ে গেছে। এ লেখার সময় পর্যন্ত চালু হয়নি। এয়ারপোর্টের কর্মচারীরা নিরাপত্তার অভাবে পালিয়ে গেছেন। গতকাল সোমবার কাবুলে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, তার সঙ্গে অদ্ভুত মিল আছে ১৯৭৫ সালের ভিয়েতনামের সাইগনের সঙ্গে। ভিয়েতনামেও এ রকম একটা অবস্থা সৃষ্টির পর যখন মার্কিনরা সাইগন থেকে মার্কিন নাগরিক ও ভিয়েতনামে উদ্বাস্তুদের নিয়ে চলে যেতে চাচ্ছিলেন, তখনো একই রকম অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল।
১৫ আগস্ট সকালেই তালেবান ঘোষণা করেছিল, তারা আফগানিস্তানের কাবুলে প্রবেশ করছে এবং কাবুলের নিয়ন্ত্রণভার নিচ্ছে। এরই মধ্যে তারা কান্দাহার, হেরাত ও কুন্দুজ অধিকার করেছে। সরকারি বাহিনী কোনো ধরনের প্রতিরোধই গড়ে তুলতে পারেনি। এরই মধ্যে খবর প্রকাশিত হলো, আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি পালিয়ে গেছেন তাজিকিস্তানে। এরপর তাজিকিস্তান ছেড়ে তিনি অজানার উদ্দেশে বেরিয়ে পড়েছেন। কোনো ধরনের যুদ্ধাবস্থা যেন সৃষ্টি না হয়, সে কারণে নিজ ইচ্ছায় তিনি দেশ ছেড়েছেন, এমনটাই বলেছেন তিনি। কিন্তু মার্কিনদের সহযোগিতা করেছেন যাঁরা, যাঁরা দেশ ছাড়েননি, তাঁদের কী অবস্থা হবে,, সেটা বোধ হয় প্রেসিডেন্ট ভাবতে চাননি।
ছয়. সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের কী হবে, সেই প্রশ্নটা জেগেছিল অনেকের মনে। তালেবান নেতা সুহেল শাহিন বলেছেন, বৌদ্ধ ভাস্কর্য আফগানিস্তানে ঝুঁকির মুখে পড়বে না। অনেকেরই নিশ্চয়ই মনে পড়ে যাবে, ২০০১ সালে আফগানিস্তানের বামিয়ান প্রদেশে বুদ্ধের ভাস্কর্য ধ্বংস করা হয়েছিল। বামিয়ানের এই ভাস্কর্যগুলো ছিল সারা বিশ্বে গৌতম বুদ্ধের সবচেয়ে বড় ভাস্কর্য এবং সে দেশে ইসলামের আগমনের আগে সবচেয়ে প্রাচীন ভাস্কর্য। এখন যদিও এ ধরনের শান্তির বাণী শোনা যাচ্ছে; কিন্তু ভবিষ্যতে তালেবান দৃষ্টিভঙ্গি এ রকমই থাকবে কি না, সেই গ্যারান্টি এখনই কেউ দিতে পারবে না।
সাত. আমরা যখন গত শতাব্দীর আশির দশকের শেষে সোভিয়েত ইউনিয়নে পড়াশোনা করছিলাম, তখন সোভিয়েত সৈন্যরা গিয়েছিল কাবুল সরকারকে রক্ষা করতে। সেনাবাহিনীর যারা আফগানিস্তানে যাচ্ছিল, তাদের অনেকেই আহতাবস্থায় ফিরে আসছিল। কেউ কেউ আর ফিরে আসছিল না। আফগানিস্তানের গিরিখাত আর উপত্যকার ঘোরপ্যাঁচে দিশেহারা হয়ে পড়ছিল রুশ বাহিনী। সে সময় নানাভাবে সোভিয়েত সৈন্যদের আফগানিস্তানে যাওয়ার বিষয়টি জায়েজ করার চেষ্টা করছিল সোভিয়েত সরকার। কিন্তু যারা স্বজন হারিয়েছিল, তারা সরকারের কথা বিশ্বাস করছিল না আর। এবং একসময় পরাজিত হয়েই ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। সে সময় সোভিয়েত ইউনিয়নকে সমর্থন করা অনেক আফগানের সঙ্গেই পরিচয় হয়েছিল, যাঁরা টিকতে না পেরে সোভিয়েত ইউনিয়নে এসেছিলেন। এখানে তাঁদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছিল। এই দলে ছিলেন কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক মোহাম্মদ তুফান। তিনি তখন কুবান বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনে পিএইচডি করছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আফগানিস্তান অজেয়; কিন্তু কার জন্য, জানা নেই।’ কথাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাইরের কোনো দেশ কখনোই আফগানিস্তানকে কবজা করতে পারেনি। এর শেষ দুটি উদাহরণ হলো সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র।
আট. বাংলাদেশের মতো অনেক দেশই এখন আফগানিস্তানের দিকে নজর রাখবে। চীন আর রাশিয়া খুবই সতর্ক হয়ে কাবুলের দিকে তাকাবে। ভারতের জন্য অবশ্যই তালেবান-আফগানিস্তান হবে মাথাব্যথার কারণ। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র? কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে বিশাল এক অশ্বডিম্বের জন্ম দিয়ে তারা আসলেই কী অর্জন করল, তা কোটি টাকার প্রশ্ন। মূলত আরও কয়েকটা দিন না গেলে, তালেবান শাসনের আদল বোঝা না গেলে এ নিয়ে মন্তব্য করা ঠিক হবে না। তবে একটা কথা বলা দরকার, যেকোনো যুদ্ধ একটি দেশকে সত্যিই বিধ্বস্ত করে দেয়, সেটা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিকভাবে যেমন, তেমনি মানসিকভাবেও। আফগানিস্তান সেই ক্ষতগুলো কাটিয়ে উঠতে পারবে কত দিনে, কিংবা আদৌ পারবে কি না, সেটা বলে দেওয়ার সময় এখনো হয়নি।
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। বিমানবন্দরের একটি উড়োজাহাজের দিকে জনস্রোত। যে যেভাবে পারছেন, উঠতে চাইছেন উড়োজাহাজে। যেকোনো মূল্যে দেশ থেকে সরে পড়তে হবে! আফগানিস্তানের কাবুল এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে থাকা উড়োজাহাজটিকে মনে হচ্ছিল সেই আদিকালে ঢাকার রামপুরা-সদরঘাট চলাচলকারী মুড়ির টিন বাস।
এ কথা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না, আফগানিস্তানে তালেবান শাসন শুরু হয়ে গেছে।
মার্কিনরা ২০ বছর আফগানিস্তানে অবস্থান করে দুই ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি যুদ্ধে ব্যয় করে এখন ফিরে যাচ্ছে। এরই মধ্যে বহু মার্কিন সৈন্য ও আফগান নাগরিক নিহত ও আহত হয়েছে আফগানিস্তানে। ভিনদেশে এ রকম যুদ্ধ চালানো উচিত কি না, সেটা নিয়ে মার্কিন প্রশাসনে কোনো প্রশ্ন দেখা দেয়নি। যদিও ষাটের দশকের শেষে বা সত্তরের দশকের শুরুতে ভিয়েতনামে যুদ্ধ বাধিয়ে নাকানি-চুবানি খেয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। উদাহরণটি থাকার পরও কেন মার্কিনরা আফগানিস্তানকে যুদ্ধের জন্য বেছে নিল, সেই প্রশ্ন এড়ানো যাবে না। সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানে তাদের মতো সরকার গড়তে চেয়েও জড়িয়ে পড়েছিল এক ভয়ংকর ট্র্যাজেডিতে। সেই পথ ধরে মার্কিনরাও আফগানিস্তানে ঢুকেছিল।
দুই. বলা যায়, মার্কিনরা আফগানিস্তানকে অরক্ষিত রেখেই পালিয়ে গেল। এবার তালেবানের হাতে পরাজিত হওয়ার জন্য যেন মরিয়া হয়ে উঠেছিল আফগানিস্তান সরকার। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর টুইন টাওয়ারে হামলার সেই নির্মম দিনটির পর তালেবানকে শাস্তি দিতে চেয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু ফল যা হলো তাতে দেখা যাচ্ছে, ২০২১ সালের আগস্টের ১৬ তারিখের মধ্যে তালেবান আফগানিস্তানের ৮৫ শতাংশ অঞ্চলের দখল নিয়ে নিয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী ৩১ আগস্টের মধ্যে আন্তর্জাতিক যে মিত্র সৈন্যরা আছে আফগানিস্তানে, তারা ফিরে যাবে যে যার দেশে। কিন্তু আসলে তারা পেছনে কী রেখে যাবে? দেড় লাখ লাশ আর দুই ট্রিলিয়ন ডলার অর্থ ব্যয় ছাড়া আর কিছু কি অর্জন হলো? শান্তি কি ফিরে আসবে আফগানিস্তানে?
উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো, যারা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী বা শত্রুদেশ, তারাও কিন্তু মার্কিন অসহায়ত্বে আনন্দিত হয়নি। বরং তারাও সতর্ক দৃষ্টি রাখছে ঘটনাবলির দিকে। ইরান, রাশিয়া বা চীন—প্রতিটি দেশের কপালেই পড়েছে চিন্তার ভাঁজ। তেহরান তো বহু আগে থেকেই আফগান উদ্বাস্তুদের চাপে রয়েছে। ৩৫ লাখ আফগান উদ্বাস্তু বাস করছে দেশটিতে। এখন সীমান্ত পার হওয়া মানুষের সংখ্যা আরও অনেক বাড়বে বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। শুধু ইরানেই নয়, আশপাশের সীমান্তবর্তী প্রতিটি দেশই এখন আফগান উদ্বাস্তুর চাপে পড়তে পারে।
তিন. নানা সংবাদমাধ্যমে গতকাল কাবুল এয়ারপোর্টের যে ছবিগুলো দেখা গেছে তাতে বোঝা যায়, তালেবানের আগমনে ভীতসন্ত্রস্ত মানুষ দেশ ছাড়ার জন্য মরিয়া হয়ে রয়েছে। রাশিয়ার সংবাদমাধ্যম রিয়া নোভাস্তির একটি ভিডিওচিত্রে দেখা গেল, উড়ন্ত বিমান থেকে হঠাৎ পড়ে গেছেন দুজন মানুষ। রানওয়েতে দাঁড়িয়ে সবাই সেই মর্মান্তিক দৃশ্য দেখছেন।
২১ বছর পর আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করার যে ঘোষণা দিয়েছিল হোয়াইট হাউস, তাতে অনেকেই ভেবেছিলেন আফগান সরকার ও তাদের সৈন্যদল নিজেরাই অবস্থা সামলে নিতে পারবে। নিজ দেশের হাল নিজেরা ধরতে পারলে দেশটা এগিয়ে যাবে সামনের দিকে। কিন্তু তাদের সেই ভাবনা যে ছিল একেবারেই হাওয়ায় ভাসা, যার বাস্তব কোনো ভিত্তি ছিল না, সেটা বোঝা গেল খুব দ্রুত। তালেবানরা দখল করে নিল দেশ। মার্কিন সমর্থিত সরকারের টিকে থাকার মুরোদ ছিল না। এর একটাই অর্থ হতে পারে, সরকার চলছিল মূলত মার্কিন সহায়তায়। নিজ থেকে সরকারের কোনো ক্ষমতা বা শক্তিই ছিল না।
চার. ইন্টারনেটে কিছুক্ষণ থাকলেই বোঝা যায় কী পরিমাণ সংকটে পড়েছে কাবুল। বিমানবন্দরের পথে যানজট লেগেছে কয়েক কিলোমিটারজুড়ে। পাকিস্তান সীমান্তে তৈরি হয়েছে অদ্ভুত অবস্থা। কেউ সীমান্তপথে দেশ ছাড়তে চাইছেন, কেউ সীমান্তপথে ফিরতে চাইছেন আফগানিস্তানে। মার্কিনরা এ দেশে আসার পর সরকারবিরোধী অনেক আফগান নাগরিক পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাঁরাই এখন ফেরার কথা ভাবছেন। তালেবান মানেই সহিংসতা—এমন একটা ধারণা থাকলেও এখন পর্যন্ত তালেবান নেতারা কোনো ধরনের শান্তি ভঙ্গ করার কথা বলছেন না। তাঁরা সম্ভবত চাইছেন, বিশ্বরাজনীতিতে এই মুহূর্তে তাঁদের নিয়ে যেন কোনো সংকট তৈরি না হয়। এ কারণেই হয়তো রাশিয়ান কূটনীতিবিদেরা রয়ে গেছেন কাবুলেই। তালেবান তাঁদের নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়েছে।
পাঁচ. কাবুল এখন অচেনা। বিশাল বিশৃঙ্খলার সময় যা যা হওয়ার কথা, তার সবই হচ্ছে। কাবুল থেকে বাণিজ্যিক ফ্লাইট বন্ধ হয়ে গেছে। এ লেখার সময় পর্যন্ত চালু হয়নি। এয়ারপোর্টের কর্মচারীরা নিরাপত্তার অভাবে পালিয়ে গেছেন। গতকাল সোমবার কাবুলে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, তার সঙ্গে অদ্ভুত মিল আছে ১৯৭৫ সালের ভিয়েতনামের সাইগনের সঙ্গে। ভিয়েতনামেও এ রকম একটা অবস্থা সৃষ্টির পর যখন মার্কিনরা সাইগন থেকে মার্কিন নাগরিক ও ভিয়েতনামে উদ্বাস্তুদের নিয়ে চলে যেতে চাচ্ছিলেন, তখনো একই রকম অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল।
১৫ আগস্ট সকালেই তালেবান ঘোষণা করেছিল, তারা আফগানিস্তানের কাবুলে প্রবেশ করছে এবং কাবুলের নিয়ন্ত্রণভার নিচ্ছে। এরই মধ্যে তারা কান্দাহার, হেরাত ও কুন্দুজ অধিকার করেছে। সরকারি বাহিনী কোনো ধরনের প্রতিরোধই গড়ে তুলতে পারেনি। এরই মধ্যে খবর প্রকাশিত হলো, আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি পালিয়ে গেছেন তাজিকিস্তানে। এরপর তাজিকিস্তান ছেড়ে তিনি অজানার উদ্দেশে বেরিয়ে পড়েছেন। কোনো ধরনের যুদ্ধাবস্থা যেন সৃষ্টি না হয়, সে কারণে নিজ ইচ্ছায় তিনি দেশ ছেড়েছেন, এমনটাই বলেছেন তিনি। কিন্তু মার্কিনদের সহযোগিতা করেছেন যাঁরা, যাঁরা দেশ ছাড়েননি, তাঁদের কী অবস্থা হবে,, সেটা বোধ হয় প্রেসিডেন্ট ভাবতে চাননি।
ছয়. সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের কী হবে, সেই প্রশ্নটা জেগেছিল অনেকের মনে। তালেবান নেতা সুহেল শাহিন বলেছেন, বৌদ্ধ ভাস্কর্য আফগানিস্তানে ঝুঁকির মুখে পড়বে না। অনেকেরই নিশ্চয়ই মনে পড়ে যাবে, ২০০১ সালে আফগানিস্তানের বামিয়ান প্রদেশে বুদ্ধের ভাস্কর্য ধ্বংস করা হয়েছিল। বামিয়ানের এই ভাস্কর্যগুলো ছিল সারা বিশ্বে গৌতম বুদ্ধের সবচেয়ে বড় ভাস্কর্য এবং সে দেশে ইসলামের আগমনের আগে সবচেয়ে প্রাচীন ভাস্কর্য। এখন যদিও এ ধরনের শান্তির বাণী শোনা যাচ্ছে; কিন্তু ভবিষ্যতে তালেবান দৃষ্টিভঙ্গি এ রকমই থাকবে কি না, সেই গ্যারান্টি এখনই কেউ দিতে পারবে না।
সাত. আমরা যখন গত শতাব্দীর আশির দশকের শেষে সোভিয়েত ইউনিয়নে পড়াশোনা করছিলাম, তখন সোভিয়েত সৈন্যরা গিয়েছিল কাবুল সরকারকে রক্ষা করতে। সেনাবাহিনীর যারা আফগানিস্তানে যাচ্ছিল, তাদের অনেকেই আহতাবস্থায় ফিরে আসছিল। কেউ কেউ আর ফিরে আসছিল না। আফগানিস্তানের গিরিখাত আর উপত্যকার ঘোরপ্যাঁচে দিশেহারা হয়ে পড়ছিল রুশ বাহিনী। সে সময় নানাভাবে সোভিয়েত সৈন্যদের আফগানিস্তানে যাওয়ার বিষয়টি জায়েজ করার চেষ্টা করছিল সোভিয়েত সরকার। কিন্তু যারা স্বজন হারিয়েছিল, তারা সরকারের কথা বিশ্বাস করছিল না আর। এবং একসময় পরাজিত হয়েই ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। সে সময় সোভিয়েত ইউনিয়নকে সমর্থন করা অনেক আফগানের সঙ্গেই পরিচয় হয়েছিল, যাঁরা টিকতে না পেরে সোভিয়েত ইউনিয়নে এসেছিলেন। এখানে তাঁদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছিল। এই দলে ছিলেন কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক মোহাম্মদ তুফান। তিনি তখন কুবান বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনে পিএইচডি করছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আফগানিস্তান অজেয়; কিন্তু কার জন্য, জানা নেই।’ কথাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাইরের কোনো দেশ কখনোই আফগানিস্তানকে কবজা করতে পারেনি। এর শেষ দুটি উদাহরণ হলো সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র।
আট. বাংলাদেশের মতো অনেক দেশই এখন আফগানিস্তানের দিকে নজর রাখবে। চীন আর রাশিয়া খুবই সতর্ক হয়ে কাবুলের দিকে তাকাবে। ভারতের জন্য অবশ্যই তালেবান-আফগানিস্তান হবে মাথাব্যথার কারণ। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র? কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে বিশাল এক অশ্বডিম্বের জন্ম দিয়ে তারা আসলেই কী অর্জন করল, তা কোটি টাকার প্রশ্ন। মূলত আরও কয়েকটা দিন না গেলে, তালেবান শাসনের আদল বোঝা না গেলে এ নিয়ে মন্তব্য করা ঠিক হবে না। তবে একটা কথা বলা দরকার, যেকোনো যুদ্ধ একটি দেশকে সত্যিই বিধ্বস্ত করে দেয়, সেটা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিকভাবে যেমন, তেমনি মানসিকভাবেও। আফগানিস্তান সেই ক্ষতগুলো কাটিয়ে উঠতে পারবে কত দিনে, কিংবা আদৌ পারবে কি না, সেটা বলে দেওয়ার সময় এখনো হয়নি।
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
দলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
১৫ ঘণ্টা আগেশেখ হাসিনা সরকারের পতনের ১০০ দিন পার হয়ে গেছে। ১০০ দিনে অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কিছু যে হয়নি, তা নয়। তবে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে অস্থিরতার লক্ষণ অস্পষ্ট নয়। এর মধ্যেই তিন দফায় উপদেষ্টার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।
১৫ ঘণ্টা আগেবাংলা ভাষায় অতিপরিচিত একটি শব্দবন্ধ হলো ‘খোলনলচে’। যাপিত জীবনে কমবেশি আমরা সবাই শব্দবন্ধটি প্রয়োগ করেছি। বাংলা বাগধারায় আমরা পড়েছি ‘খোলনলচে পালটানো’। বাংলা অভিধানে খোল শব্দের একাধিক অর্থ রয়েছে।
১৫ ঘণ্টা আগেঅফিসে যাতায়াতের সময় স্টাফ বাসে পরিচয়ের সূত্রে ফারজানা আক্তার আজিমপুরে নিজের বাসায় সাবলেট দিয়েছিলেন ফাতেমা আক্তার শাপলা নামের এক নারীকে। কিন্তু ফাতেমা যে একটি প্রতারক চক্রের সদস্য, সেটা তাঁর জানা ছিল না।
১৬ ঘণ্টা আগে