সেলিম জাহান
শ্রদ্ধাঞ্জলি: চলে গেলেন কবি শঙ্খ ঘোষ—অতিমারির আরেক শিকার। সামনে টেবিলের ওপরে খোলা বই। শঙ্খ ঘোষের ‘লেখা যখন হয় না’। শঙ্খ ঘোষ আমার খুব প্রিয় কবি ও লেখক। তাঁর কবিতার কিছু কিছু লাইন সেই কবে থেকে মনে গেঁথে আছে। সেই যে ‘পাগল’ কবিতার শেষ চার লাইন—
‘হাওড়া ব্রিজের চূড়োয় উঠুন,
ঊর্ধে চান, নীচে তাকান।
দু’টোই কেবল সম্প্রদায়,
নির্বোধ আর বুদ্ধিমান।’
৪০ বছর আগে রবীন্দ্রসংগীতের একটি দীর্ঘ-বাদন ঘনশ্রুতি রেকর্ড কিনেছিলাম মন্ট্রিয়লে—‘একটি রক্তিম মরীচিকা’। প্রচ্ছদে ঊর্ধŸবাহু এক নারীর ছবি ছিল—রবীন্দ্রনাথেরই আঁকা। সেখানেই শঙ্খ ঘোষের পাঠ আর আবৃত্তি শুনেছিলাম প্রথম। পড়ার লালিত্য ছাড়িয়ে তাঁর কণ্ঠের বিশেষত্বই আমাকে মুগ্ধ করেছিল বেশি, অনেকটা অর্ঘ্য সেনের গায়কি কণ্ঠের স্বাতন্ত্র্যের মতোই।
তারপর এই দীর্ঘসময়ে শঙ্খ ঘোষের কত বই যে পড়েছি। ‘ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ’ পড়ার পরে দৈনিক সংবাদ-এ এক দীর্ঘ লেখা লিখেছিলাম ‘ওকাম্পোর উত্তরাধিকার’ নামে। ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর ওপরে (যাঁকে রবীন্দ্রনাথ নাম দিয়েছিলেন ‘বিজয়া’ বলে)। কিন্তু শঙ্খ ঘোষের ‘জার্নাল’ পড়ার পর থেকে তাঁর ছোট ছোট বইগুলোই আমাকে টানত বেশি—‘এ আমার আমির আবরণ’, ‘আয়ওয়ার ডায়েরী’ ‘বেরিয়ে পড়ার পথ’। ভালো কথা—শঙ্খ ঘোষের আসল নাম ‘চিত্তপ্রিয় ঘোষ’।
‘লেখা যখন হয় না’ বইটির শুরুতেই শঙ্খ ঘোষ লিখেছেন, ‘লেখকের লেখা যখন আসে না, তখনও প্রকাশক লেখকের লেখা ও পাওয়া চিঠিপত্র কুড়িয়ে-বাড়িয়ে একটা বই বের করে ফেলেন।’ ‘লেখা যখন হয় না’ও তাই পত্রভিত্তিক স্মৃতিচারণার বই। অন্যদের মধ্যে সে স্মৃতিচারণার কেন্দ্রে আছেন অমিয় চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু, সমর সেন, জয় গোস্বামী, সত্যজিৎ চৌধুরী, জয়দেব এবং বিশাল অংশজুড়ে সুভাষ মুখোপাধ্যায়।
অমিয় চক্রবর্তীর কটা লাইন মনে ছিল । এই যেমন, ‘মেলাবেন, তিনি মেলাবেন ঝোড়ো হাওয়া আর পোড়ো দরজাটা’ কিংবা ‘কেঁদেও পাবে না তাকে বর্ষার অজস্র জলধারে’। শঙ্খ ঘোষ মনে করিয়ে দিলেন, ‘তাঁতে এনে বসালেম বুক থেকে রোদ্দুরের সুতো’ কিংবা ‘কিছুই হয় না এই জল স্হিতির আকাশে।’ মনে করিয়ে দিলেন ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে বুদ্ধদেব বসুর উক্তি থেকে বিতর্কের ঝড়। বুদ্ধদেব বলেছিলেন, ‘ঞযব ধমব ঃযধঃ ঢ়ৎড়ফঁপবফ জধনরহফৎধহধঃয রং ড়াবৎ’। সংবাদপত্রের মাধ্যমে তা হয়ে গেল, ‘ঞযব ধমব ড়ভ জধনরহফৎধহধঃয রং ড়াবৎ’।
সমর সেনের ওপরে শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন, তিনি কবিতার জগৎ থেকে নিঃশব্দে সরে এসেছিলেন। এ কথা পড়তে গিয়ে মনে পড়ল অকালপ্রয়াত অসামান্য উর্দু কবি সারওয়াত হুসেনের দুটি লাইন—‘কবিতা যে কোন জায়গা থেকেই ছেড়ে যেতে পারে তোমাকে, বাবার হাতের মতো’। অবাক লাগে জেনে যে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছ থেকে ৫০ বছরের ব্যবধানে দুটো চিঠি পেয়েছিলেন শঙ্খ ঘোষ—একটি ১৯৬৫ সালে, অন্যটি ২০০৫ সালে। চিঠি দুটোর প্রতিলিপি আছে ‘লেখা যখন হয় না’তে। শঙ্খ ঘোষের কল্যাণে জানা গেল, জয় গোস্বামী সকালে খবরের কাগজ পড়েন না, কবিতা পড়েন। কারণ, গায়ককে যেমন প্রভাতে রেওয়াজ করতে হয়, কবিরও তেমন করা দরকার।
অসামান্য একগুচ্ছ লেখা আছে সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে, কিছু ব্যক্তিগত, কিছু তাঁর কবিতা নিয়ে। ‘পদাতিক’ নিয়ে আলোচনা আছে, ‘আজ আছি, কাল নেই’-এর বিশ্লেষণ আছে, পারিবারিক বন্ধুত্বের ওপরে মায়াভরা স্মৃতিচারণা আছে। কিন্তু আপ্লুত হয়েছি স্ত্রী গীতা বন্দোপাধ্যায়ের প্রয়াণের পরে শেষবয়সে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতায়,
‘লাঠি হাতে উঠে
এ ঘর ও ঘর করি খোঁড়াতে খোঁড়াতে।
কখনও সাক্ষাতে
বলিনি লজ্জার মাথা খেয়ে মুখ ফুটে
তবু খুব জানতে ইচ্ছে করে—
কখনও না কেঁদে
সমস্ত বর্ষার জল কেন তুমি হাসিমুখে
তুলে নাও দু-চোখের কোলে—
একদিন বাঁধ ভেঙে দিয়ে
আমাকে ভাসিয়ে দেবে বলে?’
কেমন যেন করে ওঠে মনটা। বইটা শেষ করে আস্তে আস্তে মুড়ে রাখি। মনে পড়ে যায় শঙ্খ ঘোষের ‘ছুটি’ কবিতার কয়েকটা লাইন—
‘সব তো ঠিক করাই আছে। এখন কেবল বিদায় নেয়া,
সবার দিকে চোখ,
যাবার বেলায় প্রণাম, প্রণাম!
কী নাম?
আমার কোনো নাম তো নেই,
নৌকো বাঁধা আছে দু’টি,
দূরে সবাই জাল ফেলছে সমুদ্রে—
ছুটি, প্রভু, ছুটি!
আজ আমার প্রিয় কবি ও লেখক শঙ্খ ঘোষের ছুটি হয়ে গেল।
শ্রদ্ধাঞ্জলি: চলে গেলেন কবি শঙ্খ ঘোষ—অতিমারির আরেক শিকার। সামনে টেবিলের ওপরে খোলা বই। শঙ্খ ঘোষের ‘লেখা যখন হয় না’। শঙ্খ ঘোষ আমার খুব প্রিয় কবি ও লেখক। তাঁর কবিতার কিছু কিছু লাইন সেই কবে থেকে মনে গেঁথে আছে। সেই যে ‘পাগল’ কবিতার শেষ চার লাইন—
‘হাওড়া ব্রিজের চূড়োয় উঠুন,
ঊর্ধে চান, নীচে তাকান।
দু’টোই কেবল সম্প্রদায়,
নির্বোধ আর বুদ্ধিমান।’
৪০ বছর আগে রবীন্দ্রসংগীতের একটি দীর্ঘ-বাদন ঘনশ্রুতি রেকর্ড কিনেছিলাম মন্ট্রিয়লে—‘একটি রক্তিম মরীচিকা’। প্রচ্ছদে ঊর্ধŸবাহু এক নারীর ছবি ছিল—রবীন্দ্রনাথেরই আঁকা। সেখানেই শঙ্খ ঘোষের পাঠ আর আবৃত্তি শুনেছিলাম প্রথম। পড়ার লালিত্য ছাড়িয়ে তাঁর কণ্ঠের বিশেষত্বই আমাকে মুগ্ধ করেছিল বেশি, অনেকটা অর্ঘ্য সেনের গায়কি কণ্ঠের স্বাতন্ত্র্যের মতোই।
তারপর এই দীর্ঘসময়ে শঙ্খ ঘোষের কত বই যে পড়েছি। ‘ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ’ পড়ার পরে দৈনিক সংবাদ-এ এক দীর্ঘ লেখা লিখেছিলাম ‘ওকাম্পোর উত্তরাধিকার’ নামে। ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর ওপরে (যাঁকে রবীন্দ্রনাথ নাম দিয়েছিলেন ‘বিজয়া’ বলে)। কিন্তু শঙ্খ ঘোষের ‘জার্নাল’ পড়ার পর থেকে তাঁর ছোট ছোট বইগুলোই আমাকে টানত বেশি—‘এ আমার আমির আবরণ’, ‘আয়ওয়ার ডায়েরী’ ‘বেরিয়ে পড়ার পথ’। ভালো কথা—শঙ্খ ঘোষের আসল নাম ‘চিত্তপ্রিয় ঘোষ’।
‘লেখা যখন হয় না’ বইটির শুরুতেই শঙ্খ ঘোষ লিখেছেন, ‘লেখকের লেখা যখন আসে না, তখনও প্রকাশক লেখকের লেখা ও পাওয়া চিঠিপত্র কুড়িয়ে-বাড়িয়ে একটা বই বের করে ফেলেন।’ ‘লেখা যখন হয় না’ও তাই পত্রভিত্তিক স্মৃতিচারণার বই। অন্যদের মধ্যে সে স্মৃতিচারণার কেন্দ্রে আছেন অমিয় চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু, সমর সেন, জয় গোস্বামী, সত্যজিৎ চৌধুরী, জয়দেব এবং বিশাল অংশজুড়ে সুভাষ মুখোপাধ্যায়।
অমিয় চক্রবর্তীর কটা লাইন মনে ছিল । এই যেমন, ‘মেলাবেন, তিনি মেলাবেন ঝোড়ো হাওয়া আর পোড়ো দরজাটা’ কিংবা ‘কেঁদেও পাবে না তাকে বর্ষার অজস্র জলধারে’। শঙ্খ ঘোষ মনে করিয়ে দিলেন, ‘তাঁতে এনে বসালেম বুক থেকে রোদ্দুরের সুতো’ কিংবা ‘কিছুই হয় না এই জল স্হিতির আকাশে।’ মনে করিয়ে দিলেন ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে বুদ্ধদেব বসুর উক্তি থেকে বিতর্কের ঝড়। বুদ্ধদেব বলেছিলেন, ‘ঞযব ধমব ঃযধঃ ঢ়ৎড়ফঁপবফ জধনরহফৎধহধঃয রং ড়াবৎ’। সংবাদপত্রের মাধ্যমে তা হয়ে গেল, ‘ঞযব ধমব ড়ভ জধনরহফৎধহধঃয রং ড়াবৎ’।
সমর সেনের ওপরে শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন, তিনি কবিতার জগৎ থেকে নিঃশব্দে সরে এসেছিলেন। এ কথা পড়তে গিয়ে মনে পড়ল অকালপ্রয়াত অসামান্য উর্দু কবি সারওয়াত হুসেনের দুটি লাইন—‘কবিতা যে কোন জায়গা থেকেই ছেড়ে যেতে পারে তোমাকে, বাবার হাতের মতো’। অবাক লাগে জেনে যে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছ থেকে ৫০ বছরের ব্যবধানে দুটো চিঠি পেয়েছিলেন শঙ্খ ঘোষ—একটি ১৯৬৫ সালে, অন্যটি ২০০৫ সালে। চিঠি দুটোর প্রতিলিপি আছে ‘লেখা যখন হয় না’তে। শঙ্খ ঘোষের কল্যাণে জানা গেল, জয় গোস্বামী সকালে খবরের কাগজ পড়েন না, কবিতা পড়েন। কারণ, গায়ককে যেমন প্রভাতে রেওয়াজ করতে হয়, কবিরও তেমন করা দরকার।
অসামান্য একগুচ্ছ লেখা আছে সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে, কিছু ব্যক্তিগত, কিছু তাঁর কবিতা নিয়ে। ‘পদাতিক’ নিয়ে আলোচনা আছে, ‘আজ আছি, কাল নেই’-এর বিশ্লেষণ আছে, পারিবারিক বন্ধুত্বের ওপরে মায়াভরা স্মৃতিচারণা আছে। কিন্তু আপ্লুত হয়েছি স্ত্রী গীতা বন্দোপাধ্যায়ের প্রয়াণের পরে শেষবয়সে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতায়,
‘লাঠি হাতে উঠে
এ ঘর ও ঘর করি খোঁড়াতে খোঁড়াতে।
কখনও সাক্ষাতে
বলিনি লজ্জার মাথা খেয়ে মুখ ফুটে
তবু খুব জানতে ইচ্ছে করে—
কখনও না কেঁদে
সমস্ত বর্ষার জল কেন তুমি হাসিমুখে
তুলে নাও দু-চোখের কোলে—
একদিন বাঁধ ভেঙে দিয়ে
আমাকে ভাসিয়ে দেবে বলে?’
কেমন যেন করে ওঠে মনটা। বইটা শেষ করে আস্তে আস্তে মুড়ে রাখি। মনে পড়ে যায় শঙ্খ ঘোষের ‘ছুটি’ কবিতার কয়েকটা লাইন—
‘সব তো ঠিক করাই আছে। এখন কেবল বিদায় নেয়া,
সবার দিকে চোখ,
যাবার বেলায় প্রণাম, প্রণাম!
কী নাম?
আমার কোনো নাম তো নেই,
নৌকো বাঁধা আছে দু’টি,
দূরে সবাই জাল ফেলছে সমুদ্রে—
ছুটি, প্রভু, ছুটি!
আজ আমার প্রিয় কবি ও লেখক শঙ্খ ঘোষের ছুটি হয়ে গেল।
যেকোনো সামাজিক বিষয় বা সামাজিক সমস্যা নিয়ে আমরা যখন আলোচনা করি, তখন কখনো কখনো তত্ত্ব দিয়ে তার ব্যাখ্যা করি, আবার কখনো কখনো বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সে বিষয় বা সমস্যার বিশ্লেষণ করি। তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা...
৪ ঘণ্টা আগেগাজার সবচেয়ে সুপরিচিত ফুটবল স্টেডিয়ামটি এখন বিশৃঙ্খলায় ভরা। মাঠ ও বসার জায়গায় বাস্তুচ্যুত লোকের বন্যা। সবার পিঠে ব্যাগ আর কিছু কাপড়। কেউ অসুস্থ ব্যক্তিদের সাহায্য করছেন বা আহত আত্মীয়দের নিয়ে চলেছেন। আবার কেউ কেউ একা হাঁটছেন, খালি পায়েই হেঁটে চলেছেন।
৪ ঘণ্টা আগেসিসা একটি নরম ধাতু। এটি ঈষৎ নীলাভ ধূসর বর্ণের। এর পারমাণবিক সংখ্যা ৮২। ধাতুটি এতটাই নরম যে একটি ছুরির সাহায্যে একে কাটা যায়। সিসা কিন্তু মারাত্মক ক্ষতিকর বিষ। এই বিষের ভেতরেই বাস করছে বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ। বাংলাদেশের বাতাসে যেমন সিসার উপস্থিতি দেখা গেছে, তেমনি মাটিতে-পানিতেও পাওয়া গেছে...
৪ ঘণ্টা আগেঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রী পরিচয়ে দ্রুত অস্ত্রোপচারে সহায়তা করার কথা বলে পাপিয়া আক্তার রোগীর কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন। তিনি যে ‘ভুয়া’ ছাত্রী, সেটি বুঝতে পেরে চিকিৎসকেরা তাঁকে আটক করেন। তিনি গ্রেপ্তার হয়েছেন। হয়তো তাঁর শাস্তিও হবে। পাপিয়া শুধু অচেনা রোগী ও তাদের স্বজনদের নয়, তাঁর স্বামীকেও ধোঁকা...
৪ ঘণ্টা আগে