সেলিম জাহান
মঞ্চে উঠে দৃষ্টিটা ছড়িয়ে দিয়েছিলাম সামনে। সবাই উন্মুখ হয়ে আছে ‘নাদিম গর্ডিমার স্মারক বক্তৃতা’ শোনার জন্য। বছর তিনেক আগে কেপটাউনে যাওয়া ওই লক্ষ্যেই। অবশ্য একই সঙ্গে ‘মানব সক্ষমতা ও উন্নয়ন পর্ষদ’-এর বার্ষিক সভায় আমন্ত্রিত হয়েছিলাম ‘মাহবুবুল হক স্মারক ভাষণ’ দেওয়ার জন্যও। সে বছর ওই পর্ষদের বার্ষিক সভারও স্থান ছিল কেপটাউন।
‘নাদিম গর্ডিমার স্মারক বক্তৃতা’র স্থান ছিল ১৫০ বছরের পুরোনো কেপটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরাট মিলনায়তন। ওপরে মাঝারি আকারের দুই সারি ঝাড়বাতি, মধ্যখানেরটি বিশালাকৃতি। নিচে ৭০০ আসন, ওপরে অর্ধচন্দ্রাকৃতি বেষ্টনীর মধ্যে আরও ৩০০ আসন। দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবিদ্বেষকালে ওই বেষ্টনীর মধ্যে বসত কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠী। নিচের মূল আসনে বসার অধিকার ছিল শুধু শ্বেতাঙ্গদের। কত বছর আগের কথা? বেশি দিনের নয়–বড়জোর বছর তিরিশেক আগের কথা।
মিলনায়তন উপচে পড়েছিল লোকে। উদ্যোক্তারা বলেছিলেন হাজারের বেশি লোক। কাছাকাছি তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্ররা এসেছিল। তার মধ্যে দুটো দরিদ্র ছাত্রছাত্রীদের, বিশেষত কৃষ্ণাঙ্গ শিক্ষার্থীদের জন্য। দলে দলে এসেছিল তারা। ‘একবিংশ শতাব্দীর দক্ষিণ আফ্রিকা’ কেমন হবে—তার রূপরেখা তারা জানতে চায়। এসেছিলেন রাজনীতিবিদ, উন্নয়নকর্মী, শিক্ষক, সরকারি কর্মকর্তা, বেসরকারি সংস্থার লোকজন ও প্রচারমাধ্যমের প্রতিনিধিরা। কে নেই সেখানে—সবাই উন্মুখ হয়ে ছিলেন ২০১৭ সালের নাদিম গর্ডিমার স্মারক বক্তৃতা শোনার জন্য।
‘মাতিয়ে দেবে, বুঝেছ,’ বলেছিলেন কেপটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ম্যাক্স প্রাইস। প্রায় চল্লিশ বছর আগে সতীর্থ ছিলাম আমরা কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে। বক্তৃতার আগের রাতে ওর বাড়িতে নৈশভোজের আমন্ত্রণ ছিল। সেখানেই তার ওই ‘মাতিয়ে দেওয়ার’ উসকানি। আমি হেসে ফেলেছিলাম। ‘মাতিয়ে দেব কী? আমি কি চটুল গানের গায়ক নাকি?’ ‘তাতিয়ে দেবে’, দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী সংগ্রামের অন্যতম নেতা ম্যাক্স প্রাইস আমাকে তাতানোর চেষ্টা করেছিল। ‘না পারলে ঠেঙিয়ে দেব’। তা আমাকে ঠ্যাঙানোর কথা ম্যাক্স বলতেই পারে।
বলার শুরুতেই তাই এই বিশাল দর্শক-শ্রোতার দিকে দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়েছিলাম। সামনের সারিগুলোয় বসেছিলেন ধনাঢ্য ক্ষমতাবান মানুষজন। যাঁদের পোশাকের চাকচিক্য আর চেহারার চেকনাই দেখলেই বোঝা যায়। তার মধ্যে শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গ দুই-ই ছিলেন। তারপরে অন্যরা। বেষ্টনীঘেরা সারিগুলোর সবাই প্রায় কৃষ্ণাঙ্গ। মনটা আমার কেমন করে উঠেছিল। তাহলে দক্ষিণ আফ্রিকায় বদলালটা কী?
বদলেছে অনেক কিছু। তবে ভালোর দিকে নয়, মন্দের দিকে। চূড়ান্ত অসমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষ্ণাঙ্গদের একটা অংশ রাষ্ট্রক্ষমতার অপব্যবহার করে ফুলেফেঁপে উঠেছে। সাধারণ কৃষ্ণাঙ্গদের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। দুর্নীতি, লুটপাট ও শোষণের রাজনৈতিক অর্থনীতিতে সমাজ ডুবে যাচ্ছে। কৃষ্ণাঙ্গদের মুখে কোনো হাসি নেই—জীবনের জাঁতাকলে তাঁরা নিপিষ্ট। সাদা-কালো মিশ খায়নি। শহরের প্রান্তে কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর বসবাস। কৃষ্ণাঙ্গ অধ্যুষিত জনপদে সাধারণ সেবাগুলোও নেই। অথচ ও জায়গা থেকে তিন মাইল এগোলেই মনে হবে, ইংল্যান্ডের এসেক্সের কোনো এলাকায় আছি।
কেপটাউনের অদূরে সেই লাঙ্গা-দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে পুরোনো কৃষ্ণাঙ্গ জনপদ। ওই লাঙ্গা থেকেই তো দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম সংগ্রামী মিছিল বেরিয়ে এসেছিল ১৯৮৯ সালে। শ্বেতাঙ্গ পুলিশের গুলিতে ২ ঘণ্টায় ১৩০০ লোক প্রাণ হারিয়েছিল। শুনেছি, সে লাঙ্গায় কোনো কৃষ্ণাঙ্গ ঢুকতে পারেন না। এমনকি আমার মতো বাদামি গাত্রবর্ণের লোকজনও। দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ পুলিশও সেখানে ঢুকতে ভয় পায়। একজন বলেছিলেন, ওখানের প্রধান খাদ্য সস্তা মদ–সকালে মদ, দুপুরে মদ, রাতে মদ। দাঙ্গা, বিবাদ ও সংঘর্ষ লাগার নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।
ততক্ষণে আমি আমার বক্তব্যের প্রথম লাইন পেয়ে গিয়েছিলাম। ‘কে বলেছে দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদ নিঃশেষিত হয়েছে? বর্ণবাদ এ সমাজে এখনো আছে।’ এ কথা উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ ১০০০ দর্শক-শ্রোতার সারা মিলনায়তন নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। একটা পিন পতনের শব্দও শোনা যাবে সেখানে। ‘আপনাদের গাত্র-বর্ণভিত্তিক বর্ণবাদ তো যানইনি; বরং অর্থসম্পদের রংভিত্তিক এক বর্ণবাদ আপনারা সৃষ্টি করেছেন। ফলে সমাজে নতুন এক বিভাজন তৈরি হয়েছে।’ সামনের সারিতে বসা গণ্যমান্যদের মাঝে একধরনের অস্বস্তি আমি টের পাই। তাঁরা নড়েচড়ে বসছেন। খুব সুখকর নয় ব্যাপারটি তাঁদের জন্য।
কিন্তু আমি থামি না। রাস্তাঘাটে দেখা আমার পর্যবেক্ষণ, বর্তমান দক্ষিণ আফ্রিকার পরিস্থিতি, তথ্য-উপাত্ত দিয়ে আমি আমার যুক্তিকে ধারালো করি, আমার বিশ্লেষণকে শাণিত করি এবং আমার উপসংহারকে দুর্ভেদ্য করি। ‘এটা ২০১৭ সাল। তাকিয়ে দেখুন, কারা বসে আছেন ওই বেষ্টনীঘেরা আসনগুলোয়।’ টের পাই, রুদ্ধশ্বাসে শুনছেন আমার কথাগুলো ওখানে বসা শ্রোতা-দর্শক।
মাদিবার স্বপ্নের কথা বলি। উল্লেখ করি অনতিদূরের রবেন দ্বীপের কথা, যেখানে ওই মানুষটি জীবনের ২৬ বছর বন্দিজীবন কাটিয়েছেন একটি খুপরিতে। কেন? কী স্বপ্ন ছিল তাঁর? শ্বেতাঙ্গ কর্তৃক নিপীড়নকে তিনি কি রূপান্তরিত করতে চেয়েছিলেন একটি কৃষ্ণাঙ্গচালিত নিপীড়নে? না, তা তিনি চাননি। তিনি চেয়েছিলেন, দক্ষিণ আফ্রিকার নিপীড়িত মানুষের মুক্তি। কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে অসমবিত্তের দুটো শ্রেণি আপনারা সৃষ্টি করছেন এবং এ বিভাজন আপনারা বিস্তৃত করছেন। এভাবে চললে আপনারা একবিংশ শতাব্দীতে নয়, আপনারা ঊনবিংশ শতাব্দীতে ফেরত যাবেন।’ এক অশনিসংকেতের কথা বলে বক্তব্য শেষ করি।
বক্তব্য শেষে সারা মিলনায়তন দুই সেকেন্ড নিশ্চুপ। বুঝতে পারি, আবেগ সামলাচ্ছেন দর্শক-শ্রোতা। তারপর সারা মিলনায়তন উদ্বেলিত হয়ে পড়ে। দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন সবাই। এটা আমি আশা করিনি। লাফ দিয়ে মঞ্চে চলে এসেছিল ম্যাক্স। উষ্ণ আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে বলেছিল, ‘ফাটিয়ে দিয়েছ হে।’ যাক বাবা, ঠ্যাঙানোর হাত থেকে সে যাত্রা বেঁচেছিলাম। কিন্তু আমি নিচুস্বরে ওকে বলেছিলাম: ‘আমি কিছুই ফাটাইনি। তোমরা একটা তাজা বোমার ওপর বসে আছ। এটাই এক দিন ফাটাবে তোমাদের।’
ওপরের বেষ্টনী থেকে দলে দলে নানা বয়সের মানুষ এগিয়ে এসেছিলেন। হাত ধরে, কথা বলে, জানতে চেয়েছিলেন বহু কিছু। একটু বয়স্ক যাঁরা, তাঁরা তাঁদের আশাভঙ্গের কথা বলেছিলেন।
সংগ্রামের দিনগুলো স্মরণ করেছিলেন। হারানো সাথিদের কথা বলেছিলেন। অনেকের চোখে জল। অনেকে আবেগ সামলাতে চেষ্টা করছিলেন। কোথায় যেন তাঁদের সঙ্গে মেলাতে পারছিলাম।
কোন জায়গায় যেন সুতোর গাঁটছড়া বাঁধা দেখতে পেয়েছিলাম। বুঝতে পেরেছিলাম, একই রকম পথ পেরিয়েই আমরা এসেছি।
তরুণেরা বলেছিলেন, পরের দিন নিয়ে যাবেন লাঙ্গায় কৃষ্ণাঙ্গ জনপদে। যাব, নিশ্চয়ই যাব। এত দূর এসে তীর্থস্থলে না গেলে কি চলে? লাঙ্গায় যাওয়া! সে এক অন্য গল্প।
লেখক: ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য বিমোচন বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
মঞ্চে উঠে দৃষ্টিটা ছড়িয়ে দিয়েছিলাম সামনে। সবাই উন্মুখ হয়ে আছে ‘নাদিম গর্ডিমার স্মারক বক্তৃতা’ শোনার জন্য। বছর তিনেক আগে কেপটাউনে যাওয়া ওই লক্ষ্যেই। অবশ্য একই সঙ্গে ‘মানব সক্ষমতা ও উন্নয়ন পর্ষদ’-এর বার্ষিক সভায় আমন্ত্রিত হয়েছিলাম ‘মাহবুবুল হক স্মারক ভাষণ’ দেওয়ার জন্যও। সে বছর ওই পর্ষদের বার্ষিক সভারও স্থান ছিল কেপটাউন।
‘নাদিম গর্ডিমার স্মারক বক্তৃতা’র স্থান ছিল ১৫০ বছরের পুরোনো কেপটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরাট মিলনায়তন। ওপরে মাঝারি আকারের দুই সারি ঝাড়বাতি, মধ্যখানেরটি বিশালাকৃতি। নিচে ৭০০ আসন, ওপরে অর্ধচন্দ্রাকৃতি বেষ্টনীর মধ্যে আরও ৩০০ আসন। দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবিদ্বেষকালে ওই বেষ্টনীর মধ্যে বসত কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠী। নিচের মূল আসনে বসার অধিকার ছিল শুধু শ্বেতাঙ্গদের। কত বছর আগের কথা? বেশি দিনের নয়–বড়জোর বছর তিরিশেক আগের কথা।
মিলনায়তন উপচে পড়েছিল লোকে। উদ্যোক্তারা বলেছিলেন হাজারের বেশি লোক। কাছাকাছি তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্ররা এসেছিল। তার মধ্যে দুটো দরিদ্র ছাত্রছাত্রীদের, বিশেষত কৃষ্ণাঙ্গ শিক্ষার্থীদের জন্য। দলে দলে এসেছিল তারা। ‘একবিংশ শতাব্দীর দক্ষিণ আফ্রিকা’ কেমন হবে—তার রূপরেখা তারা জানতে চায়। এসেছিলেন রাজনীতিবিদ, উন্নয়নকর্মী, শিক্ষক, সরকারি কর্মকর্তা, বেসরকারি সংস্থার লোকজন ও প্রচারমাধ্যমের প্রতিনিধিরা। কে নেই সেখানে—সবাই উন্মুখ হয়ে ছিলেন ২০১৭ সালের নাদিম গর্ডিমার স্মারক বক্তৃতা শোনার জন্য।
‘মাতিয়ে দেবে, বুঝেছ,’ বলেছিলেন কেপটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ম্যাক্স প্রাইস। প্রায় চল্লিশ বছর আগে সতীর্থ ছিলাম আমরা কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে। বক্তৃতার আগের রাতে ওর বাড়িতে নৈশভোজের আমন্ত্রণ ছিল। সেখানেই তার ওই ‘মাতিয়ে দেওয়ার’ উসকানি। আমি হেসে ফেলেছিলাম। ‘মাতিয়ে দেব কী? আমি কি চটুল গানের গায়ক নাকি?’ ‘তাতিয়ে দেবে’, দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী সংগ্রামের অন্যতম নেতা ম্যাক্স প্রাইস আমাকে তাতানোর চেষ্টা করেছিল। ‘না পারলে ঠেঙিয়ে দেব’। তা আমাকে ঠ্যাঙানোর কথা ম্যাক্স বলতেই পারে।
বলার শুরুতেই তাই এই বিশাল দর্শক-শ্রোতার দিকে দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়েছিলাম। সামনের সারিগুলোয় বসেছিলেন ধনাঢ্য ক্ষমতাবান মানুষজন। যাঁদের পোশাকের চাকচিক্য আর চেহারার চেকনাই দেখলেই বোঝা যায়। তার মধ্যে শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গ দুই-ই ছিলেন। তারপরে অন্যরা। বেষ্টনীঘেরা সারিগুলোর সবাই প্রায় কৃষ্ণাঙ্গ। মনটা আমার কেমন করে উঠেছিল। তাহলে দক্ষিণ আফ্রিকায় বদলালটা কী?
বদলেছে অনেক কিছু। তবে ভালোর দিকে নয়, মন্দের দিকে। চূড়ান্ত অসমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষ্ণাঙ্গদের একটা অংশ রাষ্ট্রক্ষমতার অপব্যবহার করে ফুলেফেঁপে উঠেছে। সাধারণ কৃষ্ণাঙ্গদের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। দুর্নীতি, লুটপাট ও শোষণের রাজনৈতিক অর্থনীতিতে সমাজ ডুবে যাচ্ছে। কৃষ্ণাঙ্গদের মুখে কোনো হাসি নেই—জীবনের জাঁতাকলে তাঁরা নিপিষ্ট। সাদা-কালো মিশ খায়নি। শহরের প্রান্তে কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর বসবাস। কৃষ্ণাঙ্গ অধ্যুষিত জনপদে সাধারণ সেবাগুলোও নেই। অথচ ও জায়গা থেকে তিন মাইল এগোলেই মনে হবে, ইংল্যান্ডের এসেক্সের কোনো এলাকায় আছি।
কেপটাউনের অদূরে সেই লাঙ্গা-দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে পুরোনো কৃষ্ণাঙ্গ জনপদ। ওই লাঙ্গা থেকেই তো দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম সংগ্রামী মিছিল বেরিয়ে এসেছিল ১৯৮৯ সালে। শ্বেতাঙ্গ পুলিশের গুলিতে ২ ঘণ্টায় ১৩০০ লোক প্রাণ হারিয়েছিল। শুনেছি, সে লাঙ্গায় কোনো কৃষ্ণাঙ্গ ঢুকতে পারেন না। এমনকি আমার মতো বাদামি গাত্রবর্ণের লোকজনও। দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ পুলিশও সেখানে ঢুকতে ভয় পায়। একজন বলেছিলেন, ওখানের প্রধান খাদ্য সস্তা মদ–সকালে মদ, দুপুরে মদ, রাতে মদ। দাঙ্গা, বিবাদ ও সংঘর্ষ লাগার নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।
ততক্ষণে আমি আমার বক্তব্যের প্রথম লাইন পেয়ে গিয়েছিলাম। ‘কে বলেছে দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদ নিঃশেষিত হয়েছে? বর্ণবাদ এ সমাজে এখনো আছে।’ এ কথা উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ ১০০০ দর্শক-শ্রোতার সারা মিলনায়তন নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। একটা পিন পতনের শব্দও শোনা যাবে সেখানে। ‘আপনাদের গাত্র-বর্ণভিত্তিক বর্ণবাদ তো যানইনি; বরং অর্থসম্পদের রংভিত্তিক এক বর্ণবাদ আপনারা সৃষ্টি করেছেন। ফলে সমাজে নতুন এক বিভাজন তৈরি হয়েছে।’ সামনের সারিতে বসা গণ্যমান্যদের মাঝে একধরনের অস্বস্তি আমি টের পাই। তাঁরা নড়েচড়ে বসছেন। খুব সুখকর নয় ব্যাপারটি তাঁদের জন্য।
কিন্তু আমি থামি না। রাস্তাঘাটে দেখা আমার পর্যবেক্ষণ, বর্তমান দক্ষিণ আফ্রিকার পরিস্থিতি, তথ্য-উপাত্ত দিয়ে আমি আমার যুক্তিকে ধারালো করি, আমার বিশ্লেষণকে শাণিত করি এবং আমার উপসংহারকে দুর্ভেদ্য করি। ‘এটা ২০১৭ সাল। তাকিয়ে দেখুন, কারা বসে আছেন ওই বেষ্টনীঘেরা আসনগুলোয়।’ টের পাই, রুদ্ধশ্বাসে শুনছেন আমার কথাগুলো ওখানে বসা শ্রোতা-দর্শক।
মাদিবার স্বপ্নের কথা বলি। উল্লেখ করি অনতিদূরের রবেন দ্বীপের কথা, যেখানে ওই মানুষটি জীবনের ২৬ বছর বন্দিজীবন কাটিয়েছেন একটি খুপরিতে। কেন? কী স্বপ্ন ছিল তাঁর? শ্বেতাঙ্গ কর্তৃক নিপীড়নকে তিনি কি রূপান্তরিত করতে চেয়েছিলেন একটি কৃষ্ণাঙ্গচালিত নিপীড়নে? না, তা তিনি চাননি। তিনি চেয়েছিলেন, দক্ষিণ আফ্রিকার নিপীড়িত মানুষের মুক্তি। কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে অসমবিত্তের দুটো শ্রেণি আপনারা সৃষ্টি করছেন এবং এ বিভাজন আপনারা বিস্তৃত করছেন। এভাবে চললে আপনারা একবিংশ শতাব্দীতে নয়, আপনারা ঊনবিংশ শতাব্দীতে ফেরত যাবেন।’ এক অশনিসংকেতের কথা বলে বক্তব্য শেষ করি।
বক্তব্য শেষে সারা মিলনায়তন দুই সেকেন্ড নিশ্চুপ। বুঝতে পারি, আবেগ সামলাচ্ছেন দর্শক-শ্রোতা। তারপর সারা মিলনায়তন উদ্বেলিত হয়ে পড়ে। দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন সবাই। এটা আমি আশা করিনি। লাফ দিয়ে মঞ্চে চলে এসেছিল ম্যাক্স। উষ্ণ আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে বলেছিল, ‘ফাটিয়ে দিয়েছ হে।’ যাক বাবা, ঠ্যাঙানোর হাত থেকে সে যাত্রা বেঁচেছিলাম। কিন্তু আমি নিচুস্বরে ওকে বলেছিলাম: ‘আমি কিছুই ফাটাইনি। তোমরা একটা তাজা বোমার ওপর বসে আছ। এটাই এক দিন ফাটাবে তোমাদের।’
ওপরের বেষ্টনী থেকে দলে দলে নানা বয়সের মানুষ এগিয়ে এসেছিলেন। হাত ধরে, কথা বলে, জানতে চেয়েছিলেন বহু কিছু। একটু বয়স্ক যাঁরা, তাঁরা তাঁদের আশাভঙ্গের কথা বলেছিলেন।
সংগ্রামের দিনগুলো স্মরণ করেছিলেন। হারানো সাথিদের কথা বলেছিলেন। অনেকের চোখে জল। অনেকে আবেগ সামলাতে চেষ্টা করছিলেন। কোথায় যেন তাঁদের সঙ্গে মেলাতে পারছিলাম।
কোন জায়গায় যেন সুতোর গাঁটছড়া বাঁধা দেখতে পেয়েছিলাম। বুঝতে পেরেছিলাম, একই রকম পথ পেরিয়েই আমরা এসেছি।
তরুণেরা বলেছিলেন, পরের দিন নিয়ে যাবেন লাঙ্গায় কৃষ্ণাঙ্গ জনপদে। যাব, নিশ্চয়ই যাব। এত দূর এসে তীর্থস্থলে না গেলে কি চলে? লাঙ্গায় যাওয়া! সে এক অন্য গল্প।
লেখক: ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য বিমোচন বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
দলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
২ ঘণ্টা আগেশেখ হাসিনা সরকারের পতনের ১০০ দিন পার হয়ে গেছে। ১০০ দিনে অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কিছু যে হয়নি, তা নয়। তবে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে অস্থিরতার লক্ষণ অস্পষ্ট নয়। এর মধ্যেই তিন দফায় উপদেষ্টার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।
২ ঘণ্টা আগেবাংলা ভাষায় অতিপরিচিত একটি শব্দবন্ধ হলো ‘খোলনলচে’। যাপিত জীবনে কমবেশি আমরা সবাই শব্দবন্ধটি প্রয়োগ করেছি। বাংলা বাগধারায় আমরা পড়েছি ‘খোলনলচে পালটানো’। বাংলা অভিধানে খোল শব্দের একাধিক অর্থ রয়েছে।
২ ঘণ্টা আগেঅফিসে যাতায়াতের সময় স্টাফ বাসে পরিচয়ের সূত্রে ফারজানা আক্তার আজিমপুরে নিজের বাসায় সাবলেট দিয়েছিলেন ফাতেমা আক্তার শাপলা নামের এক নারীকে। কিন্তু ফাতেমা যে একটি প্রতারক চক্রের সদস্য, সেটা তাঁর জানা ছিল না।
২ ঘণ্টা আগে