জাহীদ রেজা নূর
কদিন ধরেই পরীমণিতে মিডিয়া গরম। প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক, অনলাইন মিডিয়ার পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও সবচেয়ে গরম খবর পরীমণি। পরীমণির আবির্ভাবের পর তাঁর প্রথম ছবি মুক্তি পাওয়ার আগেই প্রযোজক-পরিচালকেরা তাঁকে নতুন সিনেমায় চুক্তি সই করাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।
এভাবেই পরীমণি খবরের শিরোনাম হয়েছিলেন। সুশ্রী, চটপটে তিনি; অভিনয়ক্ষমতাও আছে তাঁর। অথচ তিনি কীভাবে, কোন পর্যায় থেকে উঠে এসেছিলেন, সেটা হয়েছিল মুখরোচক আলোচনার বিষয়। তাঁর অতীত ঘেঁটেছেন কেউ কেউ। কিন্তু পরীমণি সেসব গায়ে মাখেননি। তিনি তাঁর মতো করেই জীবন কাটিয়ে গেছেন। সেই জীবনযাত্রা নিয়ে নানা ধরনের কথা ভেসে বেড়িয়েছে বাতাসে। কিন্তু খুব বড় তোলপাড় হয়নি। কাদের ছায়ায় বেড়ে উঠছেন তিনি, তা নিয়েও কানাঘুষা চলেছে, কিন্তু গোমর ফাঁক করতে চাননি কেউ।
পরীমণি গ্রেপ্তার হওয়ার পর বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে তাঁকে নিয়ে যে আলোচনা হয়েছে, তার অনেকখানিই সাংবাদিকতার নীতি–নৈতিকতাবিরোধী। মিডিয়া ট্রায়াল থেকে রক্ষা পাননি তিনি।
দুই. সংবাদমাধ্যমে একটা অস্থিরতা চলছে। এমন অনেকেই এই পেশার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন, যাঁরা পেশাটির নীতি-নৈতিকতা সম্পর্কে কম জানেন। সাংবাদিকদের ‘সাংঘাতিক’ বলে কোথাও কোথাও কেন ডাকা হয়, সেটাও নিশ্চয় নতুন করে বলে দিতে হবে না। সংবাদপত্রের একটা পরিচয়পত্র হাতে পেলে ধরাকে সরাজ্ঞান করা যায়। আমরা তো এই কিছুদিন আগে হেলেনা জাহাঙ্গীর-কাণ্ডে দেখেছি, যাঁরা সংবাদকর্মী হিসেবে কাজ করতে আগ্রহী, তাঁরাই নিয়োগদানকারী কর্তৃপক্ষকে টাকা দিচ্ছেন। অর্থাৎ ঘটছে উল্টো ঘটনা। এর একটাই অর্থ হতে পারে, কর্তৃপক্ষ বলে দিচ্ছে, ‘আমি তোমার হাতে পরিচয়পত্র তুলে দিলাম, এবার তুমি তা ব্যবহার করে নিজের আখের গুছিয়ে নাও।’ আর সাংবাদিক মহাশয় তাঁর আখের গুছিয়ে নিতে শুরু করেছেন।
তিন. একটা ঘটনার উল্লেখ না করে পারছি না। বছর দুয়েক আগের ঘটনা।
ঢাকার বাইরের একটি শহর থেকে আমার এক আত্মীয়ের ফোন পেলাম। তিনি একটি প্যাকেজিং কোম্পানির সিইও। ফোন করে বললেন, ‘স্থানীয় কয়েকজন সাংবাদিক এসেছেন, আমাদের এখানে নাকি এমন কিছু পেয়েছেন, যা নিয়ে নিউজ করলে আমাদের বারোটা বেজে যাবে। এখানে কারখানা করার সরকারি অনুমতি নাকি আমরা নিইনি। তুমি কি একটু কথা বলবে?’
তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনাদের কি কাগজপত্র নেই?’
‘কাগজপত্র তো আমার হাতেই!’
‘ওদের পালের গোদাকে ফোনটি দিন।’
আমি খুব ঠান্ডা মাথায় আমার পরিচয় দিলাম। সাংবাদিকের কাজ সত্য উদ্ঘাটন, সেটা বলে ওদের বাহ্বা দিলাম। তারপর জানতে চাইলাম, এখানে আসলে কী অনৈতিক কাজ হচ্ছে? আরও জানতে চাইলাম, আমি যে পত্রিকায় কাজ করি, সেই পত্রিকার সাংবাদিক তাঁদের সঙ্গে নেই কেন?
পালের গোদা নিজের যে পরিচয় দিয়েছিলেন, তাতে বোঝা যায় স্থানীয় কোনো পত্রিকার সাংবাদিক তিনি। আমি তাঁর ফোন নম্বর রাখতে চাইলাম। তিনি সেটা না দিয়ে বললেন, আসলে বাইরে থেকে তথ্য পেয়ে এসেছিলেন। রিপোর্ট করতে নয়।এরপর চা খেয়ে তাঁরা চলে গিয়েছিলেন। আর ফেরেননি সেখানে।
ঘটনাটির উল্লেখ করলাম শুধু এ কারণে যে সাংবাদিকতার নাম করে এ ধরনের অনাচার অনেকেই করে বেড়ায়। বস্তুনিষ্ঠতার ধার না ধেরে যেকোনো ভুয়া খবরও যখন ছাপিয়ে দেওয়া যায়, তখন সাধারণ মানুষ খুবই অসহায় বোধ করে। সাংবাদিকতায় এই অন্যায়ের বীজটা ঢুকে পড়েছে অনেক আগেই।
চার. অনেকের মনে পড়ে যাবে মামুনুল হকের কথা। হেফাজত নেতা মামুনুল হক একটি রিসোর্টে গিয়ে ফেঁসে গিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন এক নারী। মূলত এই নারীর সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক আছে—এ নিয়েই আসর জমেছিল। ধর্মীয় নেতার এহেন কর্মকাণ্ডে অন্যদের সঙ্গে জ্বলে উঠেছিল সংবাদমাধ্যমগুলোও। ফোনালাপের সূত্র ধরে একেবারে ধসে গেছে মামুনুল হকের ভাবমূর্তি, এ কথা সত্যি, কিন্তু মুখরোচক আলোচনা দিয়ে কি সত্যিকার সাংবাদিকতা হয়? তা ছাড়া, একের পর এক ফোনালাপ কারা ফাঁস করছে, সেটা নাগরিক জীবনকে নজরদারির মধ্যে রাখার ফন্দি কি না, সে প্রশ্নেরও তো জবাব থাকতে হবে।
কে কার সঙ্গে রিসোর্টে গেল কিংবা কে কার সঙ্গে টেলিফোনে কী কথা বলল, তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো কে আসলে কোন অপরাধটা করেছেন, সেটা খুঁজে বের করা। মামুনুলের মূল অপরাধ হলো, তিনি ধর্মের লেবাসে এমন সব তথ্য হাজির করে জনগণকে উত্তেজিত করেছেন, যা ধর্ম ও সংবিধানবিরোধী। তাঁর বক্তব্যগুলো রেকর্ড করে তাঁর কাছ থেকে জবাবদিহি চাইলেই সত্যিকার কাজটা করা হতে পারত। নারীদের বিষয়ে মামুনুলরা যা যা বলে থাকেন, তার সঙ্গে তাঁদের আচরণের বৈপরীত্য নিয়েও কথা হতে পারত। কথা ও কাজে তাঁদের দ্বিচারিতা প্রমাণ করাই ছিল অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার আরাধ্য। কিন্তু সংবাদমাধ্যম নারী ও টেলিফোনের মুখরোচক আলোচনাকে যতটা সামনে আনতে পেরেছে, মামুনুলের সত্যিকার অপরাধকে ততটা সামনে আনেনি।
রাষ্ট্র ও বিদ্যমান সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে কিছু ধর্মব্যবসায়ীর অবাধ কুৎসা রটনার ঘটনা এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে একসময় মনে হয়েছিল, ধর্মান্ধতা আমাদের পুরো ব্যবস্থাকে গিলে খাবে। এদেরই পরামর্শে পাঠ্যপুস্তক থেকে অনেক কিছু বাদ দিয়েছে সরকার, যার কোনো প্রয়োজন ছিল না। আমরা কিন্তু খুবই সচেতনভাবে খেয়াল করছি, আমাদের লোকসংস্কৃতির অঙ্গযাত্রা, আলকাপ গান, মেলা ইত্যাদি গ্রামীণ জীবন থেকে উঠে যাচ্ছে। এগুলোর মধ্যে অশ্লীলতা প্রযুক্ত করে একসময় কলুষ ছড়ানো হয়, প্রিন্সেসদের আমদানি করা হয়। কিন্তু কারা কী উদ্দেশ্যে এটা করেছিল, সেই সন্ধানও তো করতে হবে। প্রিন্সেস লাকি খানরা কীভাবে যাত্রাপালার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ল, কীভাবে অমলেন্দু বিশ্বাসদের মতো যাত্রাজগতের মহিরুহদের জায়গা দখল করে নিল একশ্রেণির বদমাশ, সেই আলোচনাও তো আসতে হবে। দেশীয় সংস্কৃতিকে উধাও করে দিয়ে টিকে থাকার যে প্রবণতা, সে তো আত্মঘাতী হতে বাধ্য। সেটাই হয়েছে।
পাঁচ. নারী ও মদ—আলোচনার বেশ মুখরোচক দুটো বিষয়। আমাদের মধ্যে পুরুষতন্ত্র এতটাই জেঁকে বসেছে, নারীবিষয়ক কথাবার্তা বলার সময় অনেকেই খেয়াল করেন না যে তিনি যা বলছেন, তা নারীর জন্য অবমাননাকর। এমনকি নারীরাও নারীর অবমাননা করতে পিছপা হয় না। কে অপরাধের শিকার আর কে অপরাধকারী কিংবা কী কারণে একজন অপরাধজগতে পা বাড়ায়, কার থাকে পৃষ্ঠপোষণা—এসব বিবেচনা না করেই নারীকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়ে যায়। বিচার হওয়ার আগেই অপরাধী হিসেবে ঘোষণা হয়ে যায়। অপরাধী আর অভিযুক্ত যে এক বিষয় নয়, সেই ভাবনা মাথায় ঢোকে না। অর্থাৎ পুরুষবাদী মনোভাব নারী-পুরুষনির্বিশেষে সবাইকেই গ্রাস করে ফেলতে চাইছে। কেউ কেউ পুরুষবাদের সেই খিদে থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখতে পারছেন অনেক কষ্টে।
বলা হচ্ছে, পরীমণির সঙ্গে যাঁদের সম্পর্ক ছিল, তাঁদের সবার নাম প্রকাশ করা হবে। তাঁরাই নাকি পরীমণিকে প্রশ্রয় দিয়েছিলেন। প্রশ্ন হলো, তাঁদের নাম প্রকাশ হওয়াটাই কি সব? সত্যিই কি তাঁদের কোনো শাস্তি হবে? ক্যাসিনো-কাণ্ডের পর অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলাগুলোর কী অবস্থা, সেটা কি আমরা জানি? অনেকেই যে জামিনে বেরিয়ে এসেছেন, সেটাও কি কারও অজানা? কেন তাঁদের কেউ কেউ জামাই-আদরে হাসপাতালে থাকতে পারছেন, কারাগার থেকে বারবার তাঁদের ফেরত চাইলেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নির্বিকার থাকছে, সেটা দিয়েই বা কী প্রমাণিত হয়?
আর মদ? যে দেশে প্রকাশ্যে মদ খাওয়া নিষিদ্ধ, সে দেশের ক্লাবগুলোয় কাদের জন্য মদ থাকে? কেন থাকে? কারা মদ খাওয়ার অধিকার রাখেন? এ প্রশ্নগুলো নিয়েও তো কথা শুরু হওয়া দরকার।
ছয়. ইচ্ছে করেই এ লেখায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কথা আনিনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গরম-গরম মুখরোচক খবরগুলো যেভাবে ভাইরাল হয় এবং তাতে যে মন্তব্যগুলো অনায়াসে জায়গা করে নেয়, তা নিয়ে গবেষণা হলে নিশ্চিত বোঝা যাবে, নারীর প্রতি অসহনশীল একটা সমাজে আমাদের বসবাস। গভীরতাহীন জীবনধারা আমাদের যুক্তিবাদী মনকে গ্রাস করে নিচ্ছে। সে জায়গায় রক্ষণশীল, অন্যকে ছোট করার মানসিকতাসম্পন্ন এক অদ্ভুত সমাজের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
ভেতরে-ভেতরে এই কীটের দংশন অনেকটাই ছড়িয়ে গেছে। আমরা এখনো তা টের পাচ্ছি না।
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
কদিন ধরেই পরীমণিতে মিডিয়া গরম। প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক, অনলাইন মিডিয়ার পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও সবচেয়ে গরম খবর পরীমণি। পরীমণির আবির্ভাবের পর তাঁর প্রথম ছবি মুক্তি পাওয়ার আগেই প্রযোজক-পরিচালকেরা তাঁকে নতুন সিনেমায় চুক্তি সই করাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।
এভাবেই পরীমণি খবরের শিরোনাম হয়েছিলেন। সুশ্রী, চটপটে তিনি; অভিনয়ক্ষমতাও আছে তাঁর। অথচ তিনি কীভাবে, কোন পর্যায় থেকে উঠে এসেছিলেন, সেটা হয়েছিল মুখরোচক আলোচনার বিষয়। তাঁর অতীত ঘেঁটেছেন কেউ কেউ। কিন্তু পরীমণি সেসব গায়ে মাখেননি। তিনি তাঁর মতো করেই জীবন কাটিয়ে গেছেন। সেই জীবনযাত্রা নিয়ে নানা ধরনের কথা ভেসে বেড়িয়েছে বাতাসে। কিন্তু খুব বড় তোলপাড় হয়নি। কাদের ছায়ায় বেড়ে উঠছেন তিনি, তা নিয়েও কানাঘুষা চলেছে, কিন্তু গোমর ফাঁক করতে চাননি কেউ।
পরীমণি গ্রেপ্তার হওয়ার পর বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে তাঁকে নিয়ে যে আলোচনা হয়েছে, তার অনেকখানিই সাংবাদিকতার নীতি–নৈতিকতাবিরোধী। মিডিয়া ট্রায়াল থেকে রক্ষা পাননি তিনি।
দুই. সংবাদমাধ্যমে একটা অস্থিরতা চলছে। এমন অনেকেই এই পেশার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন, যাঁরা পেশাটির নীতি-নৈতিকতা সম্পর্কে কম জানেন। সাংবাদিকদের ‘সাংঘাতিক’ বলে কোথাও কোথাও কেন ডাকা হয়, সেটাও নিশ্চয় নতুন করে বলে দিতে হবে না। সংবাদপত্রের একটা পরিচয়পত্র হাতে পেলে ধরাকে সরাজ্ঞান করা যায়। আমরা তো এই কিছুদিন আগে হেলেনা জাহাঙ্গীর-কাণ্ডে দেখেছি, যাঁরা সংবাদকর্মী হিসেবে কাজ করতে আগ্রহী, তাঁরাই নিয়োগদানকারী কর্তৃপক্ষকে টাকা দিচ্ছেন। অর্থাৎ ঘটছে উল্টো ঘটনা। এর একটাই অর্থ হতে পারে, কর্তৃপক্ষ বলে দিচ্ছে, ‘আমি তোমার হাতে পরিচয়পত্র তুলে দিলাম, এবার তুমি তা ব্যবহার করে নিজের আখের গুছিয়ে নাও।’ আর সাংবাদিক মহাশয় তাঁর আখের গুছিয়ে নিতে শুরু করেছেন।
তিন. একটা ঘটনার উল্লেখ না করে পারছি না। বছর দুয়েক আগের ঘটনা।
ঢাকার বাইরের একটি শহর থেকে আমার এক আত্মীয়ের ফোন পেলাম। তিনি একটি প্যাকেজিং কোম্পানির সিইও। ফোন করে বললেন, ‘স্থানীয় কয়েকজন সাংবাদিক এসেছেন, আমাদের এখানে নাকি এমন কিছু পেয়েছেন, যা নিয়ে নিউজ করলে আমাদের বারোটা বেজে যাবে। এখানে কারখানা করার সরকারি অনুমতি নাকি আমরা নিইনি। তুমি কি একটু কথা বলবে?’
তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনাদের কি কাগজপত্র নেই?’
‘কাগজপত্র তো আমার হাতেই!’
‘ওদের পালের গোদাকে ফোনটি দিন।’
আমি খুব ঠান্ডা মাথায় আমার পরিচয় দিলাম। সাংবাদিকের কাজ সত্য উদ্ঘাটন, সেটা বলে ওদের বাহ্বা দিলাম। তারপর জানতে চাইলাম, এখানে আসলে কী অনৈতিক কাজ হচ্ছে? আরও জানতে চাইলাম, আমি যে পত্রিকায় কাজ করি, সেই পত্রিকার সাংবাদিক তাঁদের সঙ্গে নেই কেন?
পালের গোদা নিজের যে পরিচয় দিয়েছিলেন, তাতে বোঝা যায় স্থানীয় কোনো পত্রিকার সাংবাদিক তিনি। আমি তাঁর ফোন নম্বর রাখতে চাইলাম। তিনি সেটা না দিয়ে বললেন, আসলে বাইরে থেকে তথ্য পেয়ে এসেছিলেন। রিপোর্ট করতে নয়।এরপর চা খেয়ে তাঁরা চলে গিয়েছিলেন। আর ফেরেননি সেখানে।
ঘটনাটির উল্লেখ করলাম শুধু এ কারণে যে সাংবাদিকতার নাম করে এ ধরনের অনাচার অনেকেই করে বেড়ায়। বস্তুনিষ্ঠতার ধার না ধেরে যেকোনো ভুয়া খবরও যখন ছাপিয়ে দেওয়া যায়, তখন সাধারণ মানুষ খুবই অসহায় বোধ করে। সাংবাদিকতায় এই অন্যায়ের বীজটা ঢুকে পড়েছে অনেক আগেই।
চার. অনেকের মনে পড়ে যাবে মামুনুল হকের কথা। হেফাজত নেতা মামুনুল হক একটি রিসোর্টে গিয়ে ফেঁসে গিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন এক নারী। মূলত এই নারীর সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক আছে—এ নিয়েই আসর জমেছিল। ধর্মীয় নেতার এহেন কর্মকাণ্ডে অন্যদের সঙ্গে জ্বলে উঠেছিল সংবাদমাধ্যমগুলোও। ফোনালাপের সূত্র ধরে একেবারে ধসে গেছে মামুনুল হকের ভাবমূর্তি, এ কথা সত্যি, কিন্তু মুখরোচক আলোচনা দিয়ে কি সত্যিকার সাংবাদিকতা হয়? তা ছাড়া, একের পর এক ফোনালাপ কারা ফাঁস করছে, সেটা নাগরিক জীবনকে নজরদারির মধ্যে রাখার ফন্দি কি না, সে প্রশ্নেরও তো জবাব থাকতে হবে।
কে কার সঙ্গে রিসোর্টে গেল কিংবা কে কার সঙ্গে টেলিফোনে কী কথা বলল, তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো কে আসলে কোন অপরাধটা করেছেন, সেটা খুঁজে বের করা। মামুনুলের মূল অপরাধ হলো, তিনি ধর্মের লেবাসে এমন সব তথ্য হাজির করে জনগণকে উত্তেজিত করেছেন, যা ধর্ম ও সংবিধানবিরোধী। তাঁর বক্তব্যগুলো রেকর্ড করে তাঁর কাছ থেকে জবাবদিহি চাইলেই সত্যিকার কাজটা করা হতে পারত। নারীদের বিষয়ে মামুনুলরা যা যা বলে থাকেন, তার সঙ্গে তাঁদের আচরণের বৈপরীত্য নিয়েও কথা হতে পারত। কথা ও কাজে তাঁদের দ্বিচারিতা প্রমাণ করাই ছিল অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার আরাধ্য। কিন্তু সংবাদমাধ্যম নারী ও টেলিফোনের মুখরোচক আলোচনাকে যতটা সামনে আনতে পেরেছে, মামুনুলের সত্যিকার অপরাধকে ততটা সামনে আনেনি।
রাষ্ট্র ও বিদ্যমান সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে কিছু ধর্মব্যবসায়ীর অবাধ কুৎসা রটনার ঘটনা এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে একসময় মনে হয়েছিল, ধর্মান্ধতা আমাদের পুরো ব্যবস্থাকে গিলে খাবে। এদেরই পরামর্শে পাঠ্যপুস্তক থেকে অনেক কিছু বাদ দিয়েছে সরকার, যার কোনো প্রয়োজন ছিল না। আমরা কিন্তু খুবই সচেতনভাবে খেয়াল করছি, আমাদের লোকসংস্কৃতির অঙ্গযাত্রা, আলকাপ গান, মেলা ইত্যাদি গ্রামীণ জীবন থেকে উঠে যাচ্ছে। এগুলোর মধ্যে অশ্লীলতা প্রযুক্ত করে একসময় কলুষ ছড়ানো হয়, প্রিন্সেসদের আমদানি করা হয়। কিন্তু কারা কী উদ্দেশ্যে এটা করেছিল, সেই সন্ধানও তো করতে হবে। প্রিন্সেস লাকি খানরা কীভাবে যাত্রাপালার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ল, কীভাবে অমলেন্দু বিশ্বাসদের মতো যাত্রাজগতের মহিরুহদের জায়গা দখল করে নিল একশ্রেণির বদমাশ, সেই আলোচনাও তো আসতে হবে। দেশীয় সংস্কৃতিকে উধাও করে দিয়ে টিকে থাকার যে প্রবণতা, সে তো আত্মঘাতী হতে বাধ্য। সেটাই হয়েছে।
পাঁচ. নারী ও মদ—আলোচনার বেশ মুখরোচক দুটো বিষয়। আমাদের মধ্যে পুরুষতন্ত্র এতটাই জেঁকে বসেছে, নারীবিষয়ক কথাবার্তা বলার সময় অনেকেই খেয়াল করেন না যে তিনি যা বলছেন, তা নারীর জন্য অবমাননাকর। এমনকি নারীরাও নারীর অবমাননা করতে পিছপা হয় না। কে অপরাধের শিকার আর কে অপরাধকারী কিংবা কী কারণে একজন অপরাধজগতে পা বাড়ায়, কার থাকে পৃষ্ঠপোষণা—এসব বিবেচনা না করেই নারীকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়ে যায়। বিচার হওয়ার আগেই অপরাধী হিসেবে ঘোষণা হয়ে যায়। অপরাধী আর অভিযুক্ত যে এক বিষয় নয়, সেই ভাবনা মাথায় ঢোকে না। অর্থাৎ পুরুষবাদী মনোভাব নারী-পুরুষনির্বিশেষে সবাইকেই গ্রাস করে ফেলতে চাইছে। কেউ কেউ পুরুষবাদের সেই খিদে থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখতে পারছেন অনেক কষ্টে।
বলা হচ্ছে, পরীমণির সঙ্গে যাঁদের সম্পর্ক ছিল, তাঁদের সবার নাম প্রকাশ করা হবে। তাঁরাই নাকি পরীমণিকে প্রশ্রয় দিয়েছিলেন। প্রশ্ন হলো, তাঁদের নাম প্রকাশ হওয়াটাই কি সব? সত্যিই কি তাঁদের কোনো শাস্তি হবে? ক্যাসিনো-কাণ্ডের পর অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলাগুলোর কী অবস্থা, সেটা কি আমরা জানি? অনেকেই যে জামিনে বেরিয়ে এসেছেন, সেটাও কি কারও অজানা? কেন তাঁদের কেউ কেউ জামাই-আদরে হাসপাতালে থাকতে পারছেন, কারাগার থেকে বারবার তাঁদের ফেরত চাইলেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নির্বিকার থাকছে, সেটা দিয়েই বা কী প্রমাণিত হয়?
আর মদ? যে দেশে প্রকাশ্যে মদ খাওয়া নিষিদ্ধ, সে দেশের ক্লাবগুলোয় কাদের জন্য মদ থাকে? কেন থাকে? কারা মদ খাওয়ার অধিকার রাখেন? এ প্রশ্নগুলো নিয়েও তো কথা শুরু হওয়া দরকার।
ছয়. ইচ্ছে করেই এ লেখায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কথা আনিনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গরম-গরম মুখরোচক খবরগুলো যেভাবে ভাইরাল হয় এবং তাতে যে মন্তব্যগুলো অনায়াসে জায়গা করে নেয়, তা নিয়ে গবেষণা হলে নিশ্চিত বোঝা যাবে, নারীর প্রতি অসহনশীল একটা সমাজে আমাদের বসবাস। গভীরতাহীন জীবনধারা আমাদের যুক্তিবাদী মনকে গ্রাস করে নিচ্ছে। সে জায়গায় রক্ষণশীল, অন্যকে ছোট করার মানসিকতাসম্পন্ন এক অদ্ভুত সমাজের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
ভেতরে-ভেতরে এই কীটের দংশন অনেকটাই ছড়িয়ে গেছে। আমরা এখনো তা টের পাচ্ছি না।
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
দলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
২০ ঘণ্টা আগেশেখ হাসিনা সরকারের পতনের ১০০ দিন পার হয়ে গেছে। ১০০ দিনে অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কিছু যে হয়নি, তা নয়। তবে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে অস্থিরতার লক্ষণ অস্পষ্ট নয়। এর মধ্যেই তিন দফায় উপদেষ্টার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।
২০ ঘণ্টা আগেবাংলা ভাষায় অতিপরিচিত একটি শব্দবন্ধ হলো ‘খোলনলচে’। যাপিত জীবনে কমবেশি আমরা সবাই শব্দবন্ধটি প্রয়োগ করেছি। বাংলা বাগধারায় আমরা পড়েছি ‘খোলনলচে পালটানো’। বাংলা অভিধানে খোল শব্দের একাধিক অর্থ রয়েছে।
২০ ঘণ্টা আগেঅফিসে যাতায়াতের সময় স্টাফ বাসে পরিচয়ের সূত্রে ফারজানা আক্তার আজিমপুরে নিজের বাসায় সাবলেট দিয়েছিলেন ফাতেমা আক্তার শাপলা নামের এক নারীকে। কিন্তু ফাতেমা যে একটি প্রতারক চক্রের সদস্য, সেটা তাঁর জানা ছিল না।
২০ ঘণ্টা আগে