সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
আমরা নিশ্চয়ই গণতন্ত্র চাই, কিন্তু আসবে কি? তেমন লক্ষণ কিন্তু দেখা যাচ্ছে না। ওই প্রসঙ্গ ওঠাতে গেলে গভীর দুঃখ উথলে ওঠে, নিজেদের বেলায় যেমন, অন্য দেশের কথাটাও ভাবতে হয়। ভারতে নির্বাচনে যে গেরুয়াধারী রামভক্তরা ক্ষমতায় এসেছেন, তাঁদের ভাবসাব কিন্তু মোটেই গণতন্ত্রীদের মতো নয়। সেখানে আবারও নির্বাচন হবে, তাতে বুর্জোয়া দলগুলো যে রামভক্তদের হটিয়ে সর্বভারতীয় রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে নিতে পারবে—এমন ভরসা আপাতত দেখা যাচ্ছে না। বামপন্থীরা মোটামুটি ছত্রভঙ্গ দশাতে রয়েছেন। বড় রকমের পরিবর্তন প্রত্যাশা করা মোটেই ন্যায়সংগত নয়।
নির্বাচন হয়েছে বেলারুশেও। ২৪ বছর ধরে যিনি ক্ষমতায় রয়েছেন, আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো, তিনি এবারও জিতেছেন বলে দাবি করছেন। বিরোধীদের দাবি নির্বাচন হয়নি, একটা প্রহসন হয়েছে মাত্র, ব্যাপক প্রতারণা ও কারচুপি ঘটেছে। মুখের কথা নয়, শুধু প্রবল বিক্ষোভ হয়েছে। বিরোধীদলীয় প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী, যিনি দাবি করেছেন তিনিই জিতেছেন, তিনি যে দেশের ভেতর থেকে আন্দোলনের যে নেতৃত্ব দেবেন, তা পারেননি, গোপনে দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। আন্দোলন ছয় মাস পার করেছে, কিন্তু লুকাশেঙ্কো অনড় রয়েছেন। বোঝাই যাচ্ছে সেনাবাহিনী তাঁর সঙ্গে আছে।
থাইল্যান্ডে যে নির্বাচন হয় না তা নয়, মাঝেমধ্যেই হয়ে থাকে, কিন্তু দেখা যায় যারাই জিতুক, ঘুরেফিরে সেনাবাহিনীর কর্তারাই ক্ষমতায় আসা-যাওয়া করছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ঘটেছে ভিন্ন রকমের ঘটনা। ছাত্ররা নেমে পড়েছে রাস্তায়। ছাত্ররা আগেও একবার প্রবলভাবে নেমেছিল। সেই বিক্ষোভ দমন করেই সেনাবাহিনী ক্ষমতায় আসে।
থাইল্যান্ডে যে বিক্ষোভ কার্যকর হচ্ছে না, সেটা অন্যত্রও সত্য, বিশ্বব্যাপী এখন যে লড়াইটা দেখা দিয়েছে সেটা আর বুর্জোয়াদের গৃহ-বিবাদ মাত্র নয়; বুর্জোয়া রাজত্বের চরম প্রকাশের সময়ে যা অনিবার্য তারই আভাস ফুটে উঠছে সর্বত্র। সেটা গৃহযুদ্ধ। আমেরিকায় কট্টরপন্থী রিপাবলিকানরা গৃহযুদ্ধেরই উসকানি দিয়ে চলেছে।
মিয়ানমারও গৃহযুদ্ধের দিকেই এগোচ্ছে। সেখানেও নির্বাচন হয়েছিল। নির্বাচনে অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি আগের চেয়েও ভালো ফল করেছিল এবং তাতেই ঘটেছে তাদের ও ভোটদাতা জনগণের বিপদ। আসল ক্ষমতা সেখানে সেনাবাহিনীর হাতে, ক্ষমতা তারাই দখল করে রেখেছে এবং জবাবদিহির দায়বিহীন ক্ষমতায় থাকলে যা যা করা সম্ভব, সেসব তারা করেছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ, রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি—সবকিছুতেই অবাধ লুণ্ঠনের রাজত্ব বসিয়েছে। রোহিঙ্গাদের ওপর গণনির্যাতন, তাদের গৃহে অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, হত্যাসহ যত রকমের জুলুম কল্পনা করা সম্ভব, সব চালিয়েও শান্ত থাকেনি, ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে অস্ত্রের মুখে দেশছাড়া করেছে, দুর্ভাগা মানুষদের জায়গা-জমি, ব্যবসা-বাণিজ্য, দোকানপাট যা ছিল সব দখল করে নিয়েছে।
একদা বিশ্ববরেণ্য নেত্রী সু চি; তিনি প্রতিবাদ করবেন কি, উল্টো সহযোগিতাই করেছেন। অথচ ওই সেনাবাহিনী তাঁকে বছরের পর বছর আটক করে রেখেছিল, পারলে মেরেই ফেলত। আপসের ফর্মুলায় ক্ষমতা ভাগাভাগি করে নেবেন এবং নির্বাচনের পথে সেনাবাহিনীকে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে দেবেন—এই ছিল তাঁর আশা। তা সেনাবাহিনী সেটা হতে দেবে কেন? তাদের হাতে বন্দুক আছে, সেটা ব্যবহার করে পুনরায় তারা ক্ষমতা দখল করে নিয়েছে। সু চিকে আবারও আটক করা হয়েছে। সু চির দল কিন্তু প্রতিবাদ করতে পারেনি। তারা না পারুক, সাধারণ মানুষ ঠিকই পেরেছে। ওই একই ঘটনা।
বুর্জোয়াদের গৃহবিবাদ মীমাংসার কাল শেষ হয়ে এসেছে। সামরিক দুঃশাসনের নিদারুণ শিকার যে সাধারণ মানুষ, লড়াইটা তাদেরই করতে হবে। তারা ভোট দিয়েছে সামরিক বাহিনীর বিপক্ষে; দেখেছে তাতে কাজ হলো না, ভোটে কুলাল না, এবার তাই নেমে এসেছে রাজপথে। কেবল রাজধানীতে নয়, দেশের সব শহরে। এসেছে ছাত্ররা। তারাই অধিক সংগঠিত। মিয়ানমারে ছাত্রবিদ্রোহ আগেও একবার হয়েছিল; সেবার সেনাবাহিনী ভয়াবহ রকমের রক্তপাত ঘটিয়ে তাদের দমন করেছিল। কিন্তু এবার আর সুবিধা করতে পারছে না।
কারণ, ছাত্রদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পেশাজীবীরাও। সে দেশের মানুষ আর সেনাশাসন সহ্য করতে সম্মত নয়। এমনটা যে ঘটতে পারে, তা ছিল জেনারেলদের একেবারেই ধারণার বাইরে। কিন্তু অভ্যুত্থান না ঘটিয়ে তাদের পক্ষে কোনো উপায়ও ছিল না; নির্বাচনে বিজয়ী বুর্জোয়ারা তাদের ক্ষমতা থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার আয়োজন করছিল। জেনারেলরা তাই একেবারে মরণকামড়ই বসিয়েছেন। কিন্তু এটা তাঁরা টের পাচ্ছেন যে তাঁদের প্রতিপক্ষ এখন আর ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি নামের একটি বুর্জোয়া রাজনৈতিক দল নয়, প্রতিপক্ষ মিয়ানমারের জনসাধারণ। অস্ত্র হাতে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে বিপদের শঙ্কা আছে। কে জানে শেষ পর্যন্ত পুলিশ হয়তো হুকুম শুনবে না, সেনাসদস্যরাও হয়তো আপনজনদের ওপর ট্যাংক, কামান, বন্দুক ইত্যাদি নিয়ে চালিয়ে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিতে রাজি হবে না।
রোহিঙ্গা দমনের সময় যে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা লাখ লাখ অসহায় মানুষের মরণকান্নায় সাড়া তো দেয়ইনি, উল্টো সেনাবাহিনী ঠিক কাজ করছে বলে রাস্তায় বের হয়ে জেনারেলদের প্রতি সহমর্মিতা জানিয়েছিল—তারাও দেখা গেল এবার জেনারেলদের প্রতি সমর্থন জানাতে নারাজ। সু চি এবং তাঁর বুর্জোয়া সাথিরা না বুঝুক বিক্ষোভরতরা নিশ্চয়ই টের পাচ্ছে যে সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের হত্যা ও উচ্ছেদ কাণ্ড সমাপ্ত করে এখন কতটা যে হাত তারা পাকিয়েছে, তারই একটা পরীক্ষা নিজের দেশের মানুষের ওপর চালানোর পাঁয়তারায় আছে।
রাজপথে সেনাবাহিনীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মিয়ানমারের সাধারণ মানুষ হয়তো নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের বেদনাটাও এখন অনুমান করতে পারছে। অভিজ্ঞতার চেয়ে বড় শিক্ষক তো আর হয় না। ছবিতে তো দেখাও গেছে হাতে ধরা প্ল্যাকার্ডগুলোর একটিতে লেখা রয়েছে, ‘রোহিঙ্গা সংকটের জন্য আমরা সত্যি দুঃখিত।’ রোহিঙ্গারা যে অপরাধী নয়, তারা যে মিয়ানমারের নিপীড়িত মানুষেরই একাংশ এবং দুর্বল বলেই যে জেনারেলদের লেলিয়ে দেওয়া সেনাদের হাতে তারা মার খেয়েছে, এসব সত্য রণসজ্জায় সজ্জিত হন্তারকদের একেবারে সামনাসামনি দেখার পরে সাধারণ মানুষদের স্মৃতিতে ভেসে ওঠাটা অসম্ভব নয়। উগ্র জাতীয়তাবাদীদের মৌতাত ভেঙে মানবিকতার এই নাড়াচাড়া দেওয়াটা দৃশ্য হিসেবে সুখকর, ঘটনা হিসেবে আশাপ্রদ। নব্য পুঁজিবাদী চীনের এবং পাকাপোক্ত পুঁজিবাদী রাশিয়ার যে কতটা অধঃপতন ঘটে গেছে, সেটাও সামরিক জান্তার প্রতি ওই দুই দেশের শাসকদের নীরব সমর্থন দেখে মিয়ানমারবাসীকে বিলক্ষণ টের পাওয়ার কথা।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট, কেজেবির সাবেক কর্মচারী ভ্লাদিমির পুতিনও বেশ ‘গণতন্ত্রমনা’ দেখা যাচ্ছে। তিনি নির্বাচন দিয়ে থাকেন; তবে নির্বাচন ব্যবস্থাটাকে এতটাই নিখুঁত করে ফেলেছেন যে তাঁর আমৃত্যু নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট থাকতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। কমিউনিস্টদের উপস্থিতি যাতে শক্তিশালী না হয়, তার ব্যবস্থা অবশ্য আগেই করে রাখা হয়েছে। বুর্জোয়ারা যে দল গঠন করবে, এমন সম্ভাবনাও তাঁর গোয়েন্দা বাহিনী প্রায় নির্মূল করে ফেলেছে।
তবু প্রতিবাদ কিন্তু হচ্ছে। এক ব্যক্তি, তাঁর কোনো গোছানো দল নেই, সাহস করে তিনি যেই বলেছেন যে আগামী নির্বাচনে তিনি পুতিন সাহেবের বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন, অমনি রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দারা তৎপর হয়ে উঠেছে; বলা তো যায় না লোকেরা না আবার ওই প্রায় অচেনা ব্যক্তিটির পেছনেই দাঁড়িয়ে যায় কি না। গোয়েন্দারা কোনো ঝুঁকি নেয়নি, লোকটিকে তারা ইহজগৎ থেকেই সরিয়ে দিতে চেয়েছিল। খাবারে নয়, তার অন্তর্বাসের ভেতরে বিষ মাখিয়ে দেওয়ার বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। লোকটির টিকবার কথা ছিল না। হাসপাতালে মুমূর্ষু অবস্থায় পড়েছিল; জার্মানির দূতাবাসের লোকেরা বললেন চিকিৎসার জন্য তাঁকে আমরা আমাদের দেশের হাসপাতালে নিয়ে যেতে চাই। রাশিয়ার বড় বড় চিকিৎসকেরা সঙ্গে সঙ্গে আতঙ্কিত স্বরে বলে উঠলেন, সর্বনাশ, এই রোগীকে তো তার রোগশয্যার বাইরে নেওয়া যাবে না, নাড়াচাড়া করলেই তাঁর প্রাণবায়ু পলাতক হবে। জার্মানরা তবু পীড়াপীড়ি করতে থাকলেন, সংজ্ঞাহীন মৃতপ্রায় ব্যক্তিটির আপনজনেরাও বললেন আমরা ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত। লোকটি জার্মানির হাসপাতালে গেলেন এবং কী কঠিন তাঁর প্রাণশক্তি ও অবিচল দক্ষতা জার্মানির চিকিৎসকদের যে চিকিৎসায় তিনি সেরে উঠলেন। তবে ফেরত আসার সঙ্গে সঙ্গে, বিমানবন্দরেই তাঁকে আটক করা হলো।
যথারীতি মামলা দেওয়া হলো এবং যথাপ্রত্যাশিত স্বাধীন আদালতের সুবিবেচিত রায়ে তিনি দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে গেলেন। অনেক লোক প্রতিবাদ করল। শত শত নয়, হাজারে হাজার। এক দিন নয়, অনেক দিন ধরে। কিন্তু তাতে কী হবে? অদম্য ব্যক্তিটি জেলেই আছেন, কারণ তিনি তাঁর এই ঘোষণায় অনড় রয়েছেন যে প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে নির্বাচনে লড়বেনই। কাজেই তাঁর জন্য আরও অনেক দুর্ভোগ যে অপেক্ষা করছে—এটা নিশ্চিতরূপেই বলা যায়। শেষ পর্যন্ত অবশ্য এটাই দাঁড়াবে যে পুতিনই জিতবেন।
তবে এটা লোকে বুঝবে যেমনটা অন্য দেশের মানুষেরাও বুঝতে পারছে যে স্বৈরশাসকদের হটাতে গেলে নির্বাচনে আর কুলাবে না, অনিবার্য হচ্ছে অভ্যুত্থান। যার অপর নাম গৃহযুদ্ধ। সেই যুদ্ধেও কিন্তু কাজ হবে না, যুদ্ধটা যদি কেবল ব্যক্তিকে সরানোর জন্যই হয়। প্রয়োজন হবে সামাজিক বিপ্লবের, যে বিপ্লব লেনিন ঘটিয়েছিলেন রাশিয়াতে, মাও সে-তুং চীনে। কিন্তু সে বিপ্লবের অর্জনও স্থায়ী হবে না যদি না বিপ্লব বিশ্বময় ঘটে। এর বাইরে যা, সেসব কেবলই সংঘর্ষ, অরাজকতা ও মেরুকরণ বৃদ্ধি।
বিদেশের অভিজ্ঞতার ভেতর নিজেদের অবস্থা নিহিত আছে। আমাদেরও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় নির্বাচন দিয়ে নয়, আন্দোলন দিয়েই গড়ে তুলতে হবে। এই সত্য বাস্তবতাটা জনগণ নিশ্চয়ই উপলব্ধি করবে বলে ভরসা রাখছি।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আমরা নিশ্চয়ই গণতন্ত্র চাই, কিন্তু আসবে কি? তেমন লক্ষণ কিন্তু দেখা যাচ্ছে না। ওই প্রসঙ্গ ওঠাতে গেলে গভীর দুঃখ উথলে ওঠে, নিজেদের বেলায় যেমন, অন্য দেশের কথাটাও ভাবতে হয়। ভারতে নির্বাচনে যে গেরুয়াধারী রামভক্তরা ক্ষমতায় এসেছেন, তাঁদের ভাবসাব কিন্তু মোটেই গণতন্ত্রীদের মতো নয়। সেখানে আবারও নির্বাচন হবে, তাতে বুর্জোয়া দলগুলো যে রামভক্তদের হটিয়ে সর্বভারতীয় রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে নিতে পারবে—এমন ভরসা আপাতত দেখা যাচ্ছে না। বামপন্থীরা মোটামুটি ছত্রভঙ্গ দশাতে রয়েছেন। বড় রকমের পরিবর্তন প্রত্যাশা করা মোটেই ন্যায়সংগত নয়।
নির্বাচন হয়েছে বেলারুশেও। ২৪ বছর ধরে যিনি ক্ষমতায় রয়েছেন, আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো, তিনি এবারও জিতেছেন বলে দাবি করছেন। বিরোধীদের দাবি নির্বাচন হয়নি, একটা প্রহসন হয়েছে মাত্র, ব্যাপক প্রতারণা ও কারচুপি ঘটেছে। মুখের কথা নয়, শুধু প্রবল বিক্ষোভ হয়েছে। বিরোধীদলীয় প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী, যিনি দাবি করেছেন তিনিই জিতেছেন, তিনি যে দেশের ভেতর থেকে আন্দোলনের যে নেতৃত্ব দেবেন, তা পারেননি, গোপনে দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। আন্দোলন ছয় মাস পার করেছে, কিন্তু লুকাশেঙ্কো অনড় রয়েছেন। বোঝাই যাচ্ছে সেনাবাহিনী তাঁর সঙ্গে আছে।
থাইল্যান্ডে যে নির্বাচন হয় না তা নয়, মাঝেমধ্যেই হয়ে থাকে, কিন্তু দেখা যায় যারাই জিতুক, ঘুরেফিরে সেনাবাহিনীর কর্তারাই ক্ষমতায় আসা-যাওয়া করছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ঘটেছে ভিন্ন রকমের ঘটনা। ছাত্ররা নেমে পড়েছে রাস্তায়। ছাত্ররা আগেও একবার প্রবলভাবে নেমেছিল। সেই বিক্ষোভ দমন করেই সেনাবাহিনী ক্ষমতায় আসে।
থাইল্যান্ডে যে বিক্ষোভ কার্যকর হচ্ছে না, সেটা অন্যত্রও সত্য, বিশ্বব্যাপী এখন যে লড়াইটা দেখা দিয়েছে সেটা আর বুর্জোয়াদের গৃহ-বিবাদ মাত্র নয়; বুর্জোয়া রাজত্বের চরম প্রকাশের সময়ে যা অনিবার্য তারই আভাস ফুটে উঠছে সর্বত্র। সেটা গৃহযুদ্ধ। আমেরিকায় কট্টরপন্থী রিপাবলিকানরা গৃহযুদ্ধেরই উসকানি দিয়ে চলেছে।
মিয়ানমারও গৃহযুদ্ধের দিকেই এগোচ্ছে। সেখানেও নির্বাচন হয়েছিল। নির্বাচনে অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি আগের চেয়েও ভালো ফল করেছিল এবং তাতেই ঘটেছে তাদের ও ভোটদাতা জনগণের বিপদ। আসল ক্ষমতা সেখানে সেনাবাহিনীর হাতে, ক্ষমতা তারাই দখল করে রেখেছে এবং জবাবদিহির দায়বিহীন ক্ষমতায় থাকলে যা যা করা সম্ভব, সেসব তারা করেছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ, রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি—সবকিছুতেই অবাধ লুণ্ঠনের রাজত্ব বসিয়েছে। রোহিঙ্গাদের ওপর গণনির্যাতন, তাদের গৃহে অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, হত্যাসহ যত রকমের জুলুম কল্পনা করা সম্ভব, সব চালিয়েও শান্ত থাকেনি, ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে অস্ত্রের মুখে দেশছাড়া করেছে, দুর্ভাগা মানুষদের জায়গা-জমি, ব্যবসা-বাণিজ্য, দোকানপাট যা ছিল সব দখল করে নিয়েছে।
একদা বিশ্ববরেণ্য নেত্রী সু চি; তিনি প্রতিবাদ করবেন কি, উল্টো সহযোগিতাই করেছেন। অথচ ওই সেনাবাহিনী তাঁকে বছরের পর বছর আটক করে রেখেছিল, পারলে মেরেই ফেলত। আপসের ফর্মুলায় ক্ষমতা ভাগাভাগি করে নেবেন এবং নির্বাচনের পথে সেনাবাহিনীকে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে দেবেন—এই ছিল তাঁর আশা। তা সেনাবাহিনী সেটা হতে দেবে কেন? তাদের হাতে বন্দুক আছে, সেটা ব্যবহার করে পুনরায় তারা ক্ষমতা দখল করে নিয়েছে। সু চিকে আবারও আটক করা হয়েছে। সু চির দল কিন্তু প্রতিবাদ করতে পারেনি। তারা না পারুক, সাধারণ মানুষ ঠিকই পেরেছে। ওই একই ঘটনা।
বুর্জোয়াদের গৃহবিবাদ মীমাংসার কাল শেষ হয়ে এসেছে। সামরিক দুঃশাসনের নিদারুণ শিকার যে সাধারণ মানুষ, লড়াইটা তাদেরই করতে হবে। তারা ভোট দিয়েছে সামরিক বাহিনীর বিপক্ষে; দেখেছে তাতে কাজ হলো না, ভোটে কুলাল না, এবার তাই নেমে এসেছে রাজপথে। কেবল রাজধানীতে নয়, দেশের সব শহরে। এসেছে ছাত্ররা। তারাই অধিক সংগঠিত। মিয়ানমারে ছাত্রবিদ্রোহ আগেও একবার হয়েছিল; সেবার সেনাবাহিনী ভয়াবহ রকমের রক্তপাত ঘটিয়ে তাদের দমন করেছিল। কিন্তু এবার আর সুবিধা করতে পারছে না।
কারণ, ছাত্রদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পেশাজীবীরাও। সে দেশের মানুষ আর সেনাশাসন সহ্য করতে সম্মত নয়। এমনটা যে ঘটতে পারে, তা ছিল জেনারেলদের একেবারেই ধারণার বাইরে। কিন্তু অভ্যুত্থান না ঘটিয়ে তাদের পক্ষে কোনো উপায়ও ছিল না; নির্বাচনে বিজয়ী বুর্জোয়ারা তাদের ক্ষমতা থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার আয়োজন করছিল। জেনারেলরা তাই একেবারে মরণকামড়ই বসিয়েছেন। কিন্তু এটা তাঁরা টের পাচ্ছেন যে তাঁদের প্রতিপক্ষ এখন আর ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি নামের একটি বুর্জোয়া রাজনৈতিক দল নয়, প্রতিপক্ষ মিয়ানমারের জনসাধারণ। অস্ত্র হাতে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে বিপদের শঙ্কা আছে। কে জানে শেষ পর্যন্ত পুলিশ হয়তো হুকুম শুনবে না, সেনাসদস্যরাও হয়তো আপনজনদের ওপর ট্যাংক, কামান, বন্দুক ইত্যাদি নিয়ে চালিয়ে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিতে রাজি হবে না।
রোহিঙ্গা দমনের সময় যে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা লাখ লাখ অসহায় মানুষের মরণকান্নায় সাড়া তো দেয়ইনি, উল্টো সেনাবাহিনী ঠিক কাজ করছে বলে রাস্তায় বের হয়ে জেনারেলদের প্রতি সহমর্মিতা জানিয়েছিল—তারাও দেখা গেল এবার জেনারেলদের প্রতি সমর্থন জানাতে নারাজ। সু চি এবং তাঁর বুর্জোয়া সাথিরা না বুঝুক বিক্ষোভরতরা নিশ্চয়ই টের পাচ্ছে যে সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের হত্যা ও উচ্ছেদ কাণ্ড সমাপ্ত করে এখন কতটা যে হাত তারা পাকিয়েছে, তারই একটা পরীক্ষা নিজের দেশের মানুষের ওপর চালানোর পাঁয়তারায় আছে।
রাজপথে সেনাবাহিনীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মিয়ানমারের সাধারণ মানুষ হয়তো নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের বেদনাটাও এখন অনুমান করতে পারছে। অভিজ্ঞতার চেয়ে বড় শিক্ষক তো আর হয় না। ছবিতে তো দেখাও গেছে হাতে ধরা প্ল্যাকার্ডগুলোর একটিতে লেখা রয়েছে, ‘রোহিঙ্গা সংকটের জন্য আমরা সত্যি দুঃখিত।’ রোহিঙ্গারা যে অপরাধী নয়, তারা যে মিয়ানমারের নিপীড়িত মানুষেরই একাংশ এবং দুর্বল বলেই যে জেনারেলদের লেলিয়ে দেওয়া সেনাদের হাতে তারা মার খেয়েছে, এসব সত্য রণসজ্জায় সজ্জিত হন্তারকদের একেবারে সামনাসামনি দেখার পরে সাধারণ মানুষদের স্মৃতিতে ভেসে ওঠাটা অসম্ভব নয়। উগ্র জাতীয়তাবাদীদের মৌতাত ভেঙে মানবিকতার এই নাড়াচাড়া দেওয়াটা দৃশ্য হিসেবে সুখকর, ঘটনা হিসেবে আশাপ্রদ। নব্য পুঁজিবাদী চীনের এবং পাকাপোক্ত পুঁজিবাদী রাশিয়ার যে কতটা অধঃপতন ঘটে গেছে, সেটাও সামরিক জান্তার প্রতি ওই দুই দেশের শাসকদের নীরব সমর্থন দেখে মিয়ানমারবাসীকে বিলক্ষণ টের পাওয়ার কথা।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট, কেজেবির সাবেক কর্মচারী ভ্লাদিমির পুতিনও বেশ ‘গণতন্ত্রমনা’ দেখা যাচ্ছে। তিনি নির্বাচন দিয়ে থাকেন; তবে নির্বাচন ব্যবস্থাটাকে এতটাই নিখুঁত করে ফেলেছেন যে তাঁর আমৃত্যু নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট থাকতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। কমিউনিস্টদের উপস্থিতি যাতে শক্তিশালী না হয়, তার ব্যবস্থা অবশ্য আগেই করে রাখা হয়েছে। বুর্জোয়ারা যে দল গঠন করবে, এমন সম্ভাবনাও তাঁর গোয়েন্দা বাহিনী প্রায় নির্মূল করে ফেলেছে।
তবু প্রতিবাদ কিন্তু হচ্ছে। এক ব্যক্তি, তাঁর কোনো গোছানো দল নেই, সাহস করে তিনি যেই বলেছেন যে আগামী নির্বাচনে তিনি পুতিন সাহেবের বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন, অমনি রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দারা তৎপর হয়ে উঠেছে; বলা তো যায় না লোকেরা না আবার ওই প্রায় অচেনা ব্যক্তিটির পেছনেই দাঁড়িয়ে যায় কি না। গোয়েন্দারা কোনো ঝুঁকি নেয়নি, লোকটিকে তারা ইহজগৎ থেকেই সরিয়ে দিতে চেয়েছিল। খাবারে নয়, তার অন্তর্বাসের ভেতরে বিষ মাখিয়ে দেওয়ার বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। লোকটির টিকবার কথা ছিল না। হাসপাতালে মুমূর্ষু অবস্থায় পড়েছিল; জার্মানির দূতাবাসের লোকেরা বললেন চিকিৎসার জন্য তাঁকে আমরা আমাদের দেশের হাসপাতালে নিয়ে যেতে চাই। রাশিয়ার বড় বড় চিকিৎসকেরা সঙ্গে সঙ্গে আতঙ্কিত স্বরে বলে উঠলেন, সর্বনাশ, এই রোগীকে তো তার রোগশয্যার বাইরে নেওয়া যাবে না, নাড়াচাড়া করলেই তাঁর প্রাণবায়ু পলাতক হবে। জার্মানরা তবু পীড়াপীড়ি করতে থাকলেন, সংজ্ঞাহীন মৃতপ্রায় ব্যক্তিটির আপনজনেরাও বললেন আমরা ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত। লোকটি জার্মানির হাসপাতালে গেলেন এবং কী কঠিন তাঁর প্রাণশক্তি ও অবিচল দক্ষতা জার্মানির চিকিৎসকদের যে চিকিৎসায় তিনি সেরে উঠলেন। তবে ফেরত আসার সঙ্গে সঙ্গে, বিমানবন্দরেই তাঁকে আটক করা হলো।
যথারীতি মামলা দেওয়া হলো এবং যথাপ্রত্যাশিত স্বাধীন আদালতের সুবিবেচিত রায়ে তিনি দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে গেলেন। অনেক লোক প্রতিবাদ করল। শত শত নয়, হাজারে হাজার। এক দিন নয়, অনেক দিন ধরে। কিন্তু তাতে কী হবে? অদম্য ব্যক্তিটি জেলেই আছেন, কারণ তিনি তাঁর এই ঘোষণায় অনড় রয়েছেন যে প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে নির্বাচনে লড়বেনই। কাজেই তাঁর জন্য আরও অনেক দুর্ভোগ যে অপেক্ষা করছে—এটা নিশ্চিতরূপেই বলা যায়। শেষ পর্যন্ত অবশ্য এটাই দাঁড়াবে যে পুতিনই জিতবেন।
তবে এটা লোকে বুঝবে যেমনটা অন্য দেশের মানুষেরাও বুঝতে পারছে যে স্বৈরশাসকদের হটাতে গেলে নির্বাচনে আর কুলাবে না, অনিবার্য হচ্ছে অভ্যুত্থান। যার অপর নাম গৃহযুদ্ধ। সেই যুদ্ধেও কিন্তু কাজ হবে না, যুদ্ধটা যদি কেবল ব্যক্তিকে সরানোর জন্যই হয়। প্রয়োজন হবে সামাজিক বিপ্লবের, যে বিপ্লব লেনিন ঘটিয়েছিলেন রাশিয়াতে, মাও সে-তুং চীনে। কিন্তু সে বিপ্লবের অর্জনও স্থায়ী হবে না যদি না বিপ্লব বিশ্বময় ঘটে। এর বাইরে যা, সেসব কেবলই সংঘর্ষ, অরাজকতা ও মেরুকরণ বৃদ্ধি।
বিদেশের অভিজ্ঞতার ভেতর নিজেদের অবস্থা নিহিত আছে। আমাদেরও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় নির্বাচন দিয়ে নয়, আন্দোলন দিয়েই গড়ে তুলতে হবে। এই সত্য বাস্তবতাটা জনগণ নিশ্চয়ই উপলব্ধি করবে বলে ভরসা রাখছি।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
দলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
১ ঘণ্টা আগেশেখ হাসিনা সরকারের পতনের ১০০ দিন পার হয়ে গেছে। ১০০ দিনে অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কিছু যে হয়নি, তা নয়। তবে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে অস্থিরতার লক্ষণ অস্পষ্ট নয়। এর মধ্যেই তিন দফায় উপদেষ্টার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।
১ ঘণ্টা আগেবাংলা ভাষায় অতিপরিচিত একটি শব্দবন্ধ হলো ‘খোলনলচে’। যাপিত জীবনে কমবেশি আমরা সবাই শব্দবন্ধটি প্রয়োগ করেছি। বাংলা বাগধারায় আমরা পড়েছি ‘খোলনলচে পালটানো’। বাংলা অভিধানে খোল শব্দের একাধিক অর্থ রয়েছে।
২ ঘণ্টা আগেঅফিসে যাতায়াতের সময় স্টাফ বাসে পরিচয়ের সূত্রে ফারজানা আক্তার আজিমপুরে নিজের বাসায় সাবলেট দিয়েছিলেন ফাতেমা আক্তার শাপলা নামের এক নারীকে। কিন্তু ফাতেমা যে একটি প্রতারক চক্রের সদস্য, সেটা তাঁর জানা ছিল না।
২ ঘণ্টা আগে