আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
লিখতে বসে আজ কেন যেন কোনো বিষয়ে মনস্থির করতে পারছি না। বয়স হয়েছে। শরীরটাও মাঝে মাঝেই বিগড়ে যায়। তারপরও মনে জোর রাখি। কখনো কখনো মন সায় না দিলেও কলম নিয়ে বসি। ভাবি, অনেক মানুষ না হলেও কিছু মানুষ তো আমার লেখার জন্য অপেক্ষা করেন। সবাই আমার লেখার বক্তব্যের সঙ্গে হয়তো একমত হন না, তারপরও পড়েন। একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে আমার মতামতটা বোঝার চেষ্টা করেন। আবার এমনও মানুষ আছেন, যিনি হয়তো আমাকে গাল দেওয়ার একটি উপলক্ষ খুঁজতেও আমার লেখা পড়েন।
আমার একটি পরম সৌভাগ্য যে, আমি অনেক কিছু দেখেছি—ব্রিটিশ শাসন, পাকিস্তানি শাসন এবং তারপর বাংলাদেশ পর্ব। দীর্ঘ সময়। অনেক উত্থান-পতন। নেতা-উপনেতা। ত্যাগী নেতা-ভোগী নেতা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, তাজউদ্দীন, মওলানা ভাসানী, মণি সিংহ, অধ্যাপক মোজাফ্ফর। আবার খন্দকার মোশতাক, শাহ্ মোয়াজ্জেমকেও দেখেছি।
আজ পেছন ফিরে তাকালে কত স্মৃতি ভিড় করে মনের পর্দায়। লেখার বিষয় নিয়ে যখন সাত-পাঁচ ভাবছি, তখনই লেখার টেবিলে রাখা ফোনটি বেজে উঠল। অচেনা নম্বর, কিন্তু বুঝতে কষ্ট হলো না যে বাংলাদেশ থেকেই কেউ। আমি প্রতিদিন বেশ কয়েকটি ফোনকল পাই দেশ থেকে। শুধু ঢাকা নয়, ঢাকার বাইরে থেকেও অনেকে ফোন করেন। কেউ শুধু আমার কুশল জানার জন্য, কেউ কোনো লেখা পড়ে ভালো লাগলে সেই ভালোলাগা অনুভূতিটুকু প্রকাশের জন্য আবার কেউ কোনো বিষয়ে লেখার অনুরোধ জানান, প্রয়োজনীয় তথ্য দেন।
বহু বছর থেকে দেশের বাইরে আছি। কিন্তু নানা উপায়ে নানা জনের সঙ্গে প্রতিদিন নিয়মিত কথা হওয়ায় আমি আসলে বিচ্ছিন্নবোধ করি না। দেশের সঙ্গে আমার একটি নিবিড় যোগাযোগ আছে। ফোনটি কানের কাছে নিতেই একটি অচেনা কণ্ঠ উচ্ছ্বসিতভাবে বলল, গাফ্ফার ভাই, অনেক চেষ্টা করে আপনার ফোন নম্বর জোগাড় করে আজ কথা বলছি। তিনি নিজের নাম-পরিচয় বললেন। ঢাকায় থাকেন। চাকরি করেন একটি বেসরকারি ব্যাংকে। দেশ-দুনিয়ার খোঁজখবর রাখেন। টানা কিছুক্ষণ কথা বলে তিনি বললেন, ‘আপনাকে একটি তথ্য জানানোর জন্য এবং এ নিয়ে কিছু লেখার অনুরোধ করতেই আজকের এই ফোনকল।’
আমি জানতে চাই: বলুন কী তথ্য আপনার কাছে আছে? তিনি বললেন, গোপন কোনো তথ্য নয়। বিএনপির বিশেষ সভা চলছে। লন্ডন থেকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হয়ে সভায় সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। খালেদা জিয়ার অবর্তমানে এই প্রথম দলের একটি গুরুত্বপূর্ণ সভায় তারেক রহমান সভাপতিত্ব করছেন। সভা আরও এক দিন চলবে। এখন বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা নিজ নিজ মত তুলে ধরছেন। এরপর শনিবার হবে স্থায়ী কমিটির সভা। সেখান থেকেই হয়তো বিএনপি কিছু কর্মসূচি ঘোষণা করবে।
আমি বললাম, হ্যাঁ, ঢাকা থেকে আমি সাংবাদিক-বন্ধুদের মাধ্যমে বিএনপির এই সভার আপডেট জানার চেষ্টা করছি। তারা কী সিদ্ধান্ত নেয়, সেটা জেনে এ নিয়ে বিস্তারিত লেখার চেষ্টা করব।
তিনি বললেন, দুই দিনের বৈঠকের পর কিছুটা স্পষ্ট হয়েছে যে, বিএনপির ভেতরে শেখ হাসিনার সরকারের অধীন নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার পক্ষেই মত প্রবল। তারা সরকার পতনের আন্দোলনের ওপরই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বলে মনে হয়। বিএনপি সরকার পতনের আন্দোলনের ডাক দিলে পরিস্থিতি কেমন হতে পারে, সে বিষয়ে আপনার একটি লেখা চাই।
তরুণ বন্ধুটিকে আশ্বস্ত করলাম, আমি এ নিয়ে লেখার চেষ্টা করব। তিনি খুশি হলেন। আমার সুস্থতা কামনা করে ফোন রাখলেন।
আমি ফোন রেখে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে ভাবলাম, বিএনপি যে সরকার পতনের আন্দোলনের কথাই বলবে, এটা তো নতুন কিছু নয়। সরকার পতনের কথা না বললে বিএনপি জোশ পায় না। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে বিএনপি স্বস্তি পায় না। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা প্রথম প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই সরকার পতনের ডাক দিয়ে আসছে বিএনপি। সঙ্গে থাকে জামায়াতসহ ধর্ম নিয়ে রাজনীতির আসর জমানো আরও কিছু সংগঠন। ২০১২-১৫ সময়ে বিএনপি-জামায়াত সারা দেশে আন্দোলনের নামে কী ভয়াবহ তাণ্ডব চালিয়েছে, তা দেশের মানুষের এত তাড়াতাড়ি ভুলে যাওয়ার কথা নয়। বিএনপি কি আবার সেই ধারায় ফিরে যাবে? আবারও কি জামায়াতকে সঙ্গে রাখবে বিএনপি? বিএনপির মধ্যেও নাকি জামায়াত নিয়ে সন্দেহ-অবিশ্বাস আছে। একবার শুনি তাদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। আবার শুনি, এহ্ বাহ্য। বিএনপি-জামায়াতের গাঁটছড়া সহজে ছিন্ন হবে না।
অপেক্ষায় আছি, বিএনপির সিদ্ধান্ত জানার। তবে এই মুহূর্তে একটি পুরোনো ঘটনা মনে পড়ছে।
সাবেক অখণ্ড ভারতে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যখন অবাস্তব এবং মধ্যযুগীয় ধর্মীয় দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতভাগ এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছেন, তখন তাঁর বন্ধু বিখ্যাত সমাজতন্ত্রী নেতা ইউসুফ মেহের আলী তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন: জিন্নাহ, আপনি একজন পাশ্চাত্য-শিক্ষিত আধুনিক জীবনধারার মানুষ। আপনি কি সত্যিই ধর্মীয় দ্বিজাতিতত্ত্বে বিশ্বাস করেন এবং ভারত ভাগ করে একটা অবাস্তব ধর্মীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চান?
জিন্নাহ জবাব দিয়েছিলেন: আমি ধর্মীয় জাতিতত্ত্বে বিশ্বাস করি কি না, সে প্রশ্ন এখন থাক। তবে ধর্মীয় রাষ্ট্রে আমি বিশ্বাস করি না এবং ধর্মরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতেও চাই না। আমি ভারতে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাই, যেখানে অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুর সমান নাগরিক অধিকার থাকবে।
ইউসুফ মেহের আলী বলেছিলেন, কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়ের গরিষ্ঠতার ভিত্তিতে কোনো রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলে সেখানে গণতন্ত্র প্রাধান্য পেতে পারে না। আধুনিক গণতন্ত্রের অনুপস্থিতিতে সে রাষ্ট্র কার্যত হবে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। আপনি কার্যত পাকিস্তান নামে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চলেছেন। পরিণামে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র মধ্যযুগীয় ধর্মরাষ্ট্রে পরিণত হয়। পাকিস্তানও কালক্রমে তা-ই হবে।
ইউসুফ মেহেরের সঙ্গে জিন্নাহ একমত হননি। কিন্তু জিন্নাহ আজ বেঁচে থাকলে হয়তো পাকিস্তানের পরিণতি দেখে নিজেই আত্মহত্যা করতে চাইতেন। পাকিস্তান কালক্রমে শুধু ধর্মীয় রাষ্ট্রে পরিণত হয়নি, ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। সেই ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের থাবা আজ বাংলাদেশ পর্যন্ত প্রসারিত। পাকিস্তান
নামক ফ্যাসিবাদী দেশে তেমন উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ধর্মীয় সংখ্যালঘু না থাকায় নিজেদের ধর্মমতের মধ্যেই সংখ্যালঘু তৈরি করে এবং অমুসলিম ঘোষণা করে তাদের ওপর চালানো হচ্ছে অমানুষিক নির্যাতন। পাকিস্তানে আহমদিয়া এমনকি বাহাই ও শিয়া সম্প্রদায়কে (লিখিত ও অলিখিতভাবে) ‘অমুসলিম সংখ্যালঘু’ সম্প্রদায় ঘোষণা করে তাদের ওপর চালানো হচ্ছে অত্যাচার।
সেই পঞ্চাশের দশকেই জামায়াত নেতা মাওলানা মওদুদীর এক ফতোয়াকে ভিত্তি করে লাহোরসহ পাঞ্জাবে কাদিয়ানিবিরোধী যে দাঙ্গা শুরু হয়, তাতে ৫০ হাজার নর-নারী নিহত হয়েছিলেন এবং পাকিস্তানের উচ্চ আদালত ওই হত্যাকাণ্ডের জন্য মওদুদীকে অপরাধী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন। সৌদি আরবের বাদশাহর হস্তক্ষেপে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান মওদুদীর প্রাণদণ্ডাদেশ মওকুফ করেছিলেন।
বাংলাদেশেও এরশাদ এবং বিএনপির শাসনামলে পাকিস্তানের অনুকরণে আহমদিয়াদের ওপর নির্যাতন হয়েছে। তাদের মসজিদে অগ্নিসংযোগ হয়েছে। আহমদিয়াদের অমুসলিম ঘোষণার দাবি বাংলাদেশেও সরব হয়ে উঠেছিল। আওয়ামী লীগের শাসনামলে সরকারের সতর্ক নীতির কারণে আহমদিয়াবিরোধী আন্দোলন ও তাদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা বাড়তে পারেনি। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘু নির্যাতনের সঙ্গে সঙ্গে কাদিয়ানি, বাহাই, শিয়া প্রভৃতি একেবারেই সংখ্যাল্প সম্প্রদায়গুলোর ওপর যদি নির্যাতন শুরু হয়, তাহলে বিস্মিত হব না।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতার উচ্ছেদ এবং রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে সংবিধানে যুক্ত করার পরই জিয়া থেকে এরশাদ পর্যন্ত সামরিক শাসকেরা দেশের সিভিল ও মিলিটারি প্রশাসনকে সাম্প্রদায়িকীকরণ শুরু করেন। ধর্মনিরপেক্ষতা বা অসাম্প্রদায়িকতাকে তাঁরা ইসলামের স্বার্থবিরোধী অ্যাজেন্ডা হিসেবে দাঁড় করান।
ধর্মনিরপেক্ষতা দুর্বল হলে স্বাভাবিকভাবেই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শক্তিশালী হতে পারে না। বর্তমান বাংলাদেশে আমরা তা-ই দেখছি।
তারপরও কিছু কিছু ত্রুটি-দুর্বলতা-আপসকামিতা সত্ত্বেও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের গতিমুখ অসাম্প্রদায়িক এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ধারামুখী। তাই এই সরকারের পতন চায় বিএনপি, জামায়াত এবং অন্য সব সাম্প্রদায়িক শক্তি। ক্ষমতার বাইরে থাকা সব অপশক্তির লক্ষ্য একটাই—বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির সহায়ক কোনো শক্তি, সেটা আওয়ামী লীগ বা আর কেউ যেন মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে হটাতে পারলেই তাদের নীলনকশা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। আওয়ামী লীগ শত্রুর পাতা ফাঁদগুলো সম্পর্কে কতটুকু সতর্ক থেকে তাদের চলার পথ ঠিক করছে, আমি তা জানি না। তবে ব্যক্তিগতভাবে শেখ হাসিনার ওপর ভরসা হারাইনি বলে আশা করি, পথ বন্ধুর হলেও শেষ হাসি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তিই হাসবে।
লেখক: বর্ষীয়ান সাংবাদিক ও কলামিস্ট
লিখতে বসে আজ কেন যেন কোনো বিষয়ে মনস্থির করতে পারছি না। বয়স হয়েছে। শরীরটাও মাঝে মাঝেই বিগড়ে যায়। তারপরও মনে জোর রাখি। কখনো কখনো মন সায় না দিলেও কলম নিয়ে বসি। ভাবি, অনেক মানুষ না হলেও কিছু মানুষ তো আমার লেখার জন্য অপেক্ষা করেন। সবাই আমার লেখার বক্তব্যের সঙ্গে হয়তো একমত হন না, তারপরও পড়েন। একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে আমার মতামতটা বোঝার চেষ্টা করেন। আবার এমনও মানুষ আছেন, যিনি হয়তো আমাকে গাল দেওয়ার একটি উপলক্ষ খুঁজতেও আমার লেখা পড়েন।
আমার একটি পরম সৌভাগ্য যে, আমি অনেক কিছু দেখেছি—ব্রিটিশ শাসন, পাকিস্তানি শাসন এবং তারপর বাংলাদেশ পর্ব। দীর্ঘ সময়। অনেক উত্থান-পতন। নেতা-উপনেতা। ত্যাগী নেতা-ভোগী নেতা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, তাজউদ্দীন, মওলানা ভাসানী, মণি সিংহ, অধ্যাপক মোজাফ্ফর। আবার খন্দকার মোশতাক, শাহ্ মোয়াজ্জেমকেও দেখেছি।
আজ পেছন ফিরে তাকালে কত স্মৃতি ভিড় করে মনের পর্দায়। লেখার বিষয় নিয়ে যখন সাত-পাঁচ ভাবছি, তখনই লেখার টেবিলে রাখা ফোনটি বেজে উঠল। অচেনা নম্বর, কিন্তু বুঝতে কষ্ট হলো না যে বাংলাদেশ থেকেই কেউ। আমি প্রতিদিন বেশ কয়েকটি ফোনকল পাই দেশ থেকে। শুধু ঢাকা নয়, ঢাকার বাইরে থেকেও অনেকে ফোন করেন। কেউ শুধু আমার কুশল জানার জন্য, কেউ কোনো লেখা পড়ে ভালো লাগলে সেই ভালোলাগা অনুভূতিটুকু প্রকাশের জন্য আবার কেউ কোনো বিষয়ে লেখার অনুরোধ জানান, প্রয়োজনীয় তথ্য দেন।
বহু বছর থেকে দেশের বাইরে আছি। কিন্তু নানা উপায়ে নানা জনের সঙ্গে প্রতিদিন নিয়মিত কথা হওয়ায় আমি আসলে বিচ্ছিন্নবোধ করি না। দেশের সঙ্গে আমার একটি নিবিড় যোগাযোগ আছে। ফোনটি কানের কাছে নিতেই একটি অচেনা কণ্ঠ উচ্ছ্বসিতভাবে বলল, গাফ্ফার ভাই, অনেক চেষ্টা করে আপনার ফোন নম্বর জোগাড় করে আজ কথা বলছি। তিনি নিজের নাম-পরিচয় বললেন। ঢাকায় থাকেন। চাকরি করেন একটি বেসরকারি ব্যাংকে। দেশ-দুনিয়ার খোঁজখবর রাখেন। টানা কিছুক্ষণ কথা বলে তিনি বললেন, ‘আপনাকে একটি তথ্য জানানোর জন্য এবং এ নিয়ে কিছু লেখার অনুরোধ করতেই আজকের এই ফোনকল।’
আমি জানতে চাই: বলুন কী তথ্য আপনার কাছে আছে? তিনি বললেন, গোপন কোনো তথ্য নয়। বিএনপির বিশেষ সভা চলছে। লন্ডন থেকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হয়ে সভায় সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। খালেদা জিয়ার অবর্তমানে এই প্রথম দলের একটি গুরুত্বপূর্ণ সভায় তারেক রহমান সভাপতিত্ব করছেন। সভা আরও এক দিন চলবে। এখন বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা নিজ নিজ মত তুলে ধরছেন। এরপর শনিবার হবে স্থায়ী কমিটির সভা। সেখান থেকেই হয়তো বিএনপি কিছু কর্মসূচি ঘোষণা করবে।
আমি বললাম, হ্যাঁ, ঢাকা থেকে আমি সাংবাদিক-বন্ধুদের মাধ্যমে বিএনপির এই সভার আপডেট জানার চেষ্টা করছি। তারা কী সিদ্ধান্ত নেয়, সেটা জেনে এ নিয়ে বিস্তারিত লেখার চেষ্টা করব।
তিনি বললেন, দুই দিনের বৈঠকের পর কিছুটা স্পষ্ট হয়েছে যে, বিএনপির ভেতরে শেখ হাসিনার সরকারের অধীন নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার পক্ষেই মত প্রবল। তারা সরকার পতনের আন্দোলনের ওপরই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বলে মনে হয়। বিএনপি সরকার পতনের আন্দোলনের ডাক দিলে পরিস্থিতি কেমন হতে পারে, সে বিষয়ে আপনার একটি লেখা চাই।
তরুণ বন্ধুটিকে আশ্বস্ত করলাম, আমি এ নিয়ে লেখার চেষ্টা করব। তিনি খুশি হলেন। আমার সুস্থতা কামনা করে ফোন রাখলেন।
আমি ফোন রেখে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে ভাবলাম, বিএনপি যে সরকার পতনের আন্দোলনের কথাই বলবে, এটা তো নতুন কিছু নয়। সরকার পতনের কথা না বললে বিএনপি জোশ পায় না। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে বিএনপি স্বস্তি পায় না। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা প্রথম প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই সরকার পতনের ডাক দিয়ে আসছে বিএনপি। সঙ্গে থাকে জামায়াতসহ ধর্ম নিয়ে রাজনীতির আসর জমানো আরও কিছু সংগঠন। ২০১২-১৫ সময়ে বিএনপি-জামায়াত সারা দেশে আন্দোলনের নামে কী ভয়াবহ তাণ্ডব চালিয়েছে, তা দেশের মানুষের এত তাড়াতাড়ি ভুলে যাওয়ার কথা নয়। বিএনপি কি আবার সেই ধারায় ফিরে যাবে? আবারও কি জামায়াতকে সঙ্গে রাখবে বিএনপি? বিএনপির মধ্যেও নাকি জামায়াত নিয়ে সন্দেহ-অবিশ্বাস আছে। একবার শুনি তাদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। আবার শুনি, এহ্ বাহ্য। বিএনপি-জামায়াতের গাঁটছড়া সহজে ছিন্ন হবে না।
অপেক্ষায় আছি, বিএনপির সিদ্ধান্ত জানার। তবে এই মুহূর্তে একটি পুরোনো ঘটনা মনে পড়ছে।
সাবেক অখণ্ড ভারতে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যখন অবাস্তব এবং মধ্যযুগীয় ধর্মীয় দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতভাগ এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছেন, তখন তাঁর বন্ধু বিখ্যাত সমাজতন্ত্রী নেতা ইউসুফ মেহের আলী তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন: জিন্নাহ, আপনি একজন পাশ্চাত্য-শিক্ষিত আধুনিক জীবনধারার মানুষ। আপনি কি সত্যিই ধর্মীয় দ্বিজাতিতত্ত্বে বিশ্বাস করেন এবং ভারত ভাগ করে একটা অবাস্তব ধর্মীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চান?
জিন্নাহ জবাব দিয়েছিলেন: আমি ধর্মীয় জাতিতত্ত্বে বিশ্বাস করি কি না, সে প্রশ্ন এখন থাক। তবে ধর্মীয় রাষ্ট্রে আমি বিশ্বাস করি না এবং ধর্মরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতেও চাই না। আমি ভারতে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাই, যেখানে অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুর সমান নাগরিক অধিকার থাকবে।
ইউসুফ মেহের আলী বলেছিলেন, কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়ের গরিষ্ঠতার ভিত্তিতে কোনো রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলে সেখানে গণতন্ত্র প্রাধান্য পেতে পারে না। আধুনিক গণতন্ত্রের অনুপস্থিতিতে সে রাষ্ট্র কার্যত হবে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। আপনি কার্যত পাকিস্তান নামে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চলেছেন। পরিণামে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র মধ্যযুগীয় ধর্মরাষ্ট্রে পরিণত হয়। পাকিস্তানও কালক্রমে তা-ই হবে।
ইউসুফ মেহেরের সঙ্গে জিন্নাহ একমত হননি। কিন্তু জিন্নাহ আজ বেঁচে থাকলে হয়তো পাকিস্তানের পরিণতি দেখে নিজেই আত্মহত্যা করতে চাইতেন। পাকিস্তান কালক্রমে শুধু ধর্মীয় রাষ্ট্রে পরিণত হয়নি, ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। সেই ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের থাবা আজ বাংলাদেশ পর্যন্ত প্রসারিত। পাকিস্তান
নামক ফ্যাসিবাদী দেশে তেমন উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ধর্মীয় সংখ্যালঘু না থাকায় নিজেদের ধর্মমতের মধ্যেই সংখ্যালঘু তৈরি করে এবং অমুসলিম ঘোষণা করে তাদের ওপর চালানো হচ্ছে অমানুষিক নির্যাতন। পাকিস্তানে আহমদিয়া এমনকি বাহাই ও শিয়া সম্প্রদায়কে (লিখিত ও অলিখিতভাবে) ‘অমুসলিম সংখ্যালঘু’ সম্প্রদায় ঘোষণা করে তাদের ওপর চালানো হচ্ছে অত্যাচার।
সেই পঞ্চাশের দশকেই জামায়াত নেতা মাওলানা মওদুদীর এক ফতোয়াকে ভিত্তি করে লাহোরসহ পাঞ্জাবে কাদিয়ানিবিরোধী যে দাঙ্গা শুরু হয়, তাতে ৫০ হাজার নর-নারী নিহত হয়েছিলেন এবং পাকিস্তানের উচ্চ আদালত ওই হত্যাকাণ্ডের জন্য মওদুদীকে অপরাধী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন। সৌদি আরবের বাদশাহর হস্তক্ষেপে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান মওদুদীর প্রাণদণ্ডাদেশ মওকুফ করেছিলেন।
বাংলাদেশেও এরশাদ এবং বিএনপির শাসনামলে পাকিস্তানের অনুকরণে আহমদিয়াদের ওপর নির্যাতন হয়েছে। তাদের মসজিদে অগ্নিসংযোগ হয়েছে। আহমদিয়াদের অমুসলিম ঘোষণার দাবি বাংলাদেশেও সরব হয়ে উঠেছিল। আওয়ামী লীগের শাসনামলে সরকারের সতর্ক নীতির কারণে আহমদিয়াবিরোধী আন্দোলন ও তাদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা বাড়তে পারেনি। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘু নির্যাতনের সঙ্গে সঙ্গে কাদিয়ানি, বাহাই, শিয়া প্রভৃতি একেবারেই সংখ্যাল্প সম্প্রদায়গুলোর ওপর যদি নির্যাতন শুরু হয়, তাহলে বিস্মিত হব না।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতার উচ্ছেদ এবং রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে সংবিধানে যুক্ত করার পরই জিয়া থেকে এরশাদ পর্যন্ত সামরিক শাসকেরা দেশের সিভিল ও মিলিটারি প্রশাসনকে সাম্প্রদায়িকীকরণ শুরু করেন। ধর্মনিরপেক্ষতা বা অসাম্প্রদায়িকতাকে তাঁরা ইসলামের স্বার্থবিরোধী অ্যাজেন্ডা হিসেবে দাঁড় করান।
ধর্মনিরপেক্ষতা দুর্বল হলে স্বাভাবিকভাবেই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শক্তিশালী হতে পারে না। বর্তমান বাংলাদেশে আমরা তা-ই দেখছি।
তারপরও কিছু কিছু ত্রুটি-দুর্বলতা-আপসকামিতা সত্ত্বেও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের গতিমুখ অসাম্প্রদায়িক এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ধারামুখী। তাই এই সরকারের পতন চায় বিএনপি, জামায়াত এবং অন্য সব সাম্প্রদায়িক শক্তি। ক্ষমতার বাইরে থাকা সব অপশক্তির লক্ষ্য একটাই—বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির সহায়ক কোনো শক্তি, সেটা আওয়ামী লীগ বা আর কেউ যেন মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে হটাতে পারলেই তাদের নীলনকশা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। আওয়ামী লীগ শত্রুর পাতা ফাঁদগুলো সম্পর্কে কতটুকু সতর্ক থেকে তাদের চলার পথ ঠিক করছে, আমি তা জানি না। তবে ব্যক্তিগতভাবে শেখ হাসিনার ওপর ভরসা হারাইনি বলে আশা করি, পথ বন্ধুর হলেও শেষ হাসি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তিই হাসবে।
লেখক: বর্ষীয়ান সাংবাদিক ও কলামিস্ট
দলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
৪ ঘণ্টা আগেশেখ হাসিনা সরকারের পতনের ১০০ দিন পার হয়ে গেছে। ১০০ দিনে অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কিছু যে হয়নি, তা নয়। তবে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে অস্থিরতার লক্ষণ অস্পষ্ট নয়। এর মধ্যেই তিন দফায় উপদেষ্টার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।
৪ ঘণ্টা আগেবাংলা ভাষায় অতিপরিচিত একটি শব্দবন্ধ হলো ‘খোলনলচে’। যাপিত জীবনে কমবেশি আমরা সবাই শব্দবন্ধটি প্রয়োগ করেছি। বাংলা বাগধারায় আমরা পড়েছি ‘খোলনলচে পালটানো’। বাংলা অভিধানে খোল শব্দের একাধিক অর্থ রয়েছে।
৪ ঘণ্টা আগেঅফিসে যাতায়াতের সময় স্টাফ বাসে পরিচয়ের সূত্রে ফারজানা আক্তার আজিমপুরে নিজের বাসায় সাবলেট দিয়েছিলেন ফাতেমা আক্তার শাপলা নামের এক নারীকে। কিন্তু ফাতেমা যে একটি প্রতারক চক্রের সদস্য, সেটা তাঁর জানা ছিল না।
৪ ঘণ্টা আগে