সেলিম জাহান
চমকে উঠলাম। ভেতরটা নাড়িয়ে দিল দৃশ্যটা। চোখ আটকে গেল দূরের সবুজ মাঠটায়। কোনো এক শিশু লাল রঙের একটি গোল চাকতি ফেলে গেছে মাঠের কোণে সবুজ ঘাসের ওপর। আর ওই চাকতিতে একটি তারা থাকা সত্ত্বেও মাঠের ওই কোণটি কেমন করে যেন হয়ে গেছে বাংলাদেশের পতাকার মতো। কয়েকবার চোখ ঘষে আবার তাকালাম। না, কোনো ভুল নেই। ‘এ ঘরে এলায়ে পড়েছে ছবির’ মতো মাঠের কোণে বিছিয়ে আছে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকার মতো একটা ছবি। মন ও চোখ কেমন করে উঠল।
অবশ্য এ তো নতুন নয় আমার জন্য। পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় এক টুকরো বাংলাদেশ দেখলেই কেমন যেন হয়ে যাই। তা সে টুকরোটা যেভাবেই আসুক না–কখনো রাবাতে আমাদের দূতাবাসের ছোট্ট সাদা ভবনের ওপরে বাতাসে আন্দোলিত দ্বিবর্ণের পতাকার হোক, কিংবা রোমে যে বাঙালি তরুণটি রেস্তোরাঁয় ঘুরে ঘুরে লাল গোলাপ বিক্রি করছে, সে; কিংবা মস্কোর সরু গলির মধ্যে বাংলাদেশি পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছে যে দোকানটি, সেটি। বড় করে বাংলায় লেখা ‘রকমারি’, তার নিচে ছোট করে রাশানে তার অনুবাদ সম্ভবত। ওই বর্ণমালাগুলোর দিকে তাকালেই মনে হয়, ওখানে উঠে ওগুলো জড়িয়ে ধরি।
দেশের নানা শহরে কখনো কখনো বাংলাদেশ আমার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কার্যোপলক্ষে যেখানেই যাই, সুযোগ করে নিই সেখানকার বাঙালিদের সঙ্গে কথা বলার। আর কিছু নয়, তাঁদের মাঝে যখনই থাকি, তখনই মনে হয়, আমার হাত ধরে আছে আমার দেশ। বাংলাদেশের নানা অঞ্চল থেকে এসেছেন তাঁরা।
তাঁদের দেখে মনে হয়, এটাই তো বাংলাদেশ। দেশ মানে তো শুধু একটি ভূখণ্ড নয়, শুধু একটি মানচিত্র নয়, শুধু একটি পতাকা নয়; দেশ মানে মানুষ, লোক, জনগণ।
বার্লিনে বেশ কয়েক বছর আগে কার্যোপলক্ষে গেলে পরে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ ছাত্র সমিতি আমন্ত্রণ জানিয়েছিল একটি বক্তব্য দিতে। সব মিলিয়ে মোটে জনাপঞ্চাশেক ছাত্র আছে সেখানে। আমি যাতে হৃতোদ্যম না হয়ে পড়ি, সেটা ভেবেই হয়তো উদ্যোক্তারা আশ্বস্ত করতে চেয়েছিলেন আমাকে: ‘রবীন্দ্রনাথ ১৯২৯ সালে যে ঘরে বলেছিলেন, সেখানেই আয়োজন করার চেষ্টা করছি আমাদের অনুষ্ঠানের।’ আমার অবশ্য বিকার ছিল না।
কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছে দেখি, কোথায় ৫০! মিলনায়তনের ২০০ আসন ভর্তি বাঙালি ছাত্রছাত্রীতে, দাঁড়িয়ে আছে আরও শখানেক, বাইরে অপেক্ষমাণ আরও জনাচল্লিশেক। কোথা থেকে এল এত সব ছেলেপেলে? কোথা থেকে নয়? হামবুর্গ, হাইডেলবার্গ, মিউনিখ, কোলন, বন ঝেঁটিয়ে এসেছে সবাই। উদ্যোক্তাদের মুখ শুকনো। জনস্রোত যদি বাড়ে, কী করবে তারা?
ঘরে ঢুকে দেখি অতশত তরুণ মুখের কলকাকলিতে কান পাতা দায়। মঞ্চের দিকে তাকিয়ে মনটা কেমন যেন হয়ে গেল। সবুজের ওপর সুন্দর করে লাল দিয়ে লেখা, ‘বাংলাদেশ: অন্তর মম বিকশিত করো’। ওটাই আমার বক্তব্যের বিষয়বস্তু। চারদিকে চোখ বুলিয়ে মনে হলো, আচ্ছা এই যে তিন শ ছেলেমেয়ে, তারা কেন এসেছে? তাদের বেশির ভাগ চেনে না আমাকে, নামও শোনেনি সম্ভবত। তবু এসেছে। শুধু এসেছে–কেউ একজন বাংলাদেশ সম্পর্কে বলবেন। কেউ একজন যিনি মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন, সাক্ষী ছিলেন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের। ওই নাড়ির টানেই তারা এসেছে এখানে।
এক ডজন ছেলেমেয়ে মঞ্চে উঠল। কী সুন্দর সেজে এসেছে তারা! মেয়েরা সবুজ শাড়ি, লাল পাড়, কপালে লাল টিপ। ছেলেরা সবুজ পাঞ্জাবি। সাদা পায়জামা। গলায় লাল ওড়নি। খালি গলায় যখন ‘আমার সোনার বাংলা’ গেয়ে উঠল, তখন সারা ঘর দাঁড়িয়ে গেল, গলা মেলাল। দেখলাম, চোখ মুছছে কেউ কেউ। তখন কোথায় বার্লিন, কোথায় কী? মনে হচ্ছিল, এক টুকরো বাংলাদেশ সেখানে জ্বলজ্বল করছে। চোখের সামনে ভেসে উঠল আমাদের লাল-সবুজ পতাকা।
এবার আমার পালা। মঞ্চে উঠতে উঠতে ঠিক করলাম, আজকের দিনে রবীন্দ্রনাথ থাকবেন পেছনের সারিতে, আজ সামনে থাকবে শুধুই বাংলাদেশ। অন্তরের ভেতর থেকে বলেছিলাম কিছু কথা–একজন সাধারণ মানুষের কথন, যে বঙ্গবন্ধুকে দেখেছে, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম প্রত্যক্ষ করেছে এবং বাংলাদেশের অভ্যুদয়েরও সাক্ষী। না, আর কোনো যোগ্যতা নেই তার। সে শুধু বাংলাদেশকে ভালোবাসে, এক টুকরো বাংলাদেশ যার হৃদয়ে স্থিত।
শেষের দিকে বলেছিলাম, চিরকাল তরুণদের জাতির ভবিষ্যৎ করে রাখা হয়েছে। আজ সময় হয়েছে তাদের জাতির বর্তমান করে দেওয়ার জন্য। আবেদন করেছিলাম বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি, তাঁরা যেন একটু পেছনে সরে দাঁড়ান। পাদপ্রদীপের নিচটা ছেড়ে দেন তরুণদের জন্য। তাহলে আমাদের বর্তমানও সুনিশ্চিত হবে, তেমনি অর্থবহ হবে আমাদের ভবিষ্যৎ।
পঁয়তাল্লিশ মিনিটের সে বক্তব্যের সময়ে মিলনায়তনে ছিল পিনপতন নিস্তব্ধতা–একটি সুচ পড়লেও তা শোনা যেত। আমার বলার শেষে করতালি-ফালির কথা মনে নেই। শুধু মনে আছে, পুত্র-কন্যাসম ওই তিন শ ছেলেমেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আমার ওপরে–তাদের প্রশ্নের বুভুক্ষা নিয়ে, তাদের জানার তৃষ্ণা নিয়ে। দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় প্রজন্মের বাঙালি তারা। অনেকে বাংলা ভালো বলতেও পারে না, তেমন যায়নিও তারা দেশে। কিন্তু কী যে তাদের ভালোবাসা ওই দেশটির প্রতি। ‘কোথায় সে দেশ–অতীতে না ভবিষ্যতে?’ বাংলাদেশ তাদের কাছে শুধু একটা দেশ নয়, একটা স্বপ্ন। আমি তাদের স্বপ্নের একটি কণামাত্র–এক সূত্রধর।
কিন্তু এ কথা তো শুধু আমার নয়, আমাদের প্রজন্মের সবার কথা। সেদিন আমার স্ত্রী শামীম (কবি শামীম আজাদ) বলছিল তার কথা। বহুদিন ধরে শামীম দেশের বাইরে। কিন্তু বাংলাদেশকে সে হৃদয়ে ধারণ করে রেখেছে নিরন্তর। এ দেশের শিকড় সে নিয়ে গেছে সঙ্গে। তাই তার সব কর্মকাণ্ড আবর্তিত হয়েছে বাংলাদেশকে ঘিরে। আজ থেকে তিন দশক আগে বাইরে বাংলাদেশ সম্পর্কে জ্ঞান ছিল কম, ধারণা ছিল নেতিবাচক। শামীম হৃদয়ে তাগিদ অনুভব করেছে বাইরের বিশ্বে বাংলাদেশকে চেনানোর।
‘জানো’, বলেছে সে, ‘যেকোনো অনুষ্ঠানে গেছি, সব সময় চেষ্টা করেছি কিছু একটা বলার, সুযোগ খুঁজেছি কোনো একটি প্রশ্ন করার। শুধু এই কারণে, যাতে আমি পরিচয় দেওয়ার শুরুতেই বলতে পারি, আমি বাংলাদেশের।’ তার এ কথার পর কেমন যেন লেগেছিল আমার কাছে, কেমন একটা নৈকট্য অনুভব করেছিলাম তার কথার সঙ্গে।
আমিও তো যেখানে যাই, নিজের অন্য পরিচয়ের সঙ্গে সঙ্গে বলি, আমি বাংলাদেশের–মমতার সঙ্গে বলি, গর্বের সঙ্গে জানাই, প্রত্যয়ের সঙ্গে উচ্চারণ করি। তবে করেছিলাম বটে বাংলাদেশের জন্য একটা কাজ। বছর দশেক আগে নিউইয়র্কে দক্ষিণ এশিয়ার ওপর এক আলোচনা সভায় বক্তাদের মধ্যে আরও দুজনের সঙ্গে ছিলাম আমি এবং সেই বিখ্যাত ব্যক্তিটি যিনি সত্তরের দশকের প্রথমার্ধে নিতান্ত তাচ্ছিল্য ও অনুকম্পার সঙ্গে বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন।
আমার বক্তব্যে আমি তার সূত্র টেনেছিলাম এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতে বলেছিলাম যে সেদিনের সেসব দম্ভমান মানব আজ আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন; কিন্তু বাংলাদেশ অহংকারের সঙ্গে বিরাজ করছে এবং প্রত্যয়ের সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে। সভায় গুঞ্জন উঠেছিল, উপর্যুক্ত ব্যক্তিটি সভা শেষে কথা বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সভা শেষে আমি অপেক্ষা করিনি, দাঁড়াইনি, দৃপ্তপদে মাথা উঁচু করে সভাকক্ষ থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম।
লেখক: ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য বিমোচন বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
চমকে উঠলাম। ভেতরটা নাড়িয়ে দিল দৃশ্যটা। চোখ আটকে গেল দূরের সবুজ মাঠটায়। কোনো এক শিশু লাল রঙের একটি গোল চাকতি ফেলে গেছে মাঠের কোণে সবুজ ঘাসের ওপর। আর ওই চাকতিতে একটি তারা থাকা সত্ত্বেও মাঠের ওই কোণটি কেমন করে যেন হয়ে গেছে বাংলাদেশের পতাকার মতো। কয়েকবার চোখ ঘষে আবার তাকালাম। না, কোনো ভুল নেই। ‘এ ঘরে এলায়ে পড়েছে ছবির’ মতো মাঠের কোণে বিছিয়ে আছে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকার মতো একটা ছবি। মন ও চোখ কেমন করে উঠল।
অবশ্য এ তো নতুন নয় আমার জন্য। পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় এক টুকরো বাংলাদেশ দেখলেই কেমন যেন হয়ে যাই। তা সে টুকরোটা যেভাবেই আসুক না–কখনো রাবাতে আমাদের দূতাবাসের ছোট্ট সাদা ভবনের ওপরে বাতাসে আন্দোলিত দ্বিবর্ণের পতাকার হোক, কিংবা রোমে যে বাঙালি তরুণটি রেস্তোরাঁয় ঘুরে ঘুরে লাল গোলাপ বিক্রি করছে, সে; কিংবা মস্কোর সরু গলির মধ্যে বাংলাদেশি পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছে যে দোকানটি, সেটি। বড় করে বাংলায় লেখা ‘রকমারি’, তার নিচে ছোট করে রাশানে তার অনুবাদ সম্ভবত। ওই বর্ণমালাগুলোর দিকে তাকালেই মনে হয়, ওখানে উঠে ওগুলো জড়িয়ে ধরি।
দেশের নানা শহরে কখনো কখনো বাংলাদেশ আমার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কার্যোপলক্ষে যেখানেই যাই, সুযোগ করে নিই সেখানকার বাঙালিদের সঙ্গে কথা বলার। আর কিছু নয়, তাঁদের মাঝে যখনই থাকি, তখনই মনে হয়, আমার হাত ধরে আছে আমার দেশ। বাংলাদেশের নানা অঞ্চল থেকে এসেছেন তাঁরা।
তাঁদের দেখে মনে হয়, এটাই তো বাংলাদেশ। দেশ মানে তো শুধু একটি ভূখণ্ড নয়, শুধু একটি মানচিত্র নয়, শুধু একটি পতাকা নয়; দেশ মানে মানুষ, লোক, জনগণ।
বার্লিনে বেশ কয়েক বছর আগে কার্যোপলক্ষে গেলে পরে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ ছাত্র সমিতি আমন্ত্রণ জানিয়েছিল একটি বক্তব্য দিতে। সব মিলিয়ে মোটে জনাপঞ্চাশেক ছাত্র আছে সেখানে। আমি যাতে হৃতোদ্যম না হয়ে পড়ি, সেটা ভেবেই হয়তো উদ্যোক্তারা আশ্বস্ত করতে চেয়েছিলেন আমাকে: ‘রবীন্দ্রনাথ ১৯২৯ সালে যে ঘরে বলেছিলেন, সেখানেই আয়োজন করার চেষ্টা করছি আমাদের অনুষ্ঠানের।’ আমার অবশ্য বিকার ছিল না।
কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছে দেখি, কোথায় ৫০! মিলনায়তনের ২০০ আসন ভর্তি বাঙালি ছাত্রছাত্রীতে, দাঁড়িয়ে আছে আরও শখানেক, বাইরে অপেক্ষমাণ আরও জনাচল্লিশেক। কোথা থেকে এল এত সব ছেলেপেলে? কোথা থেকে নয়? হামবুর্গ, হাইডেলবার্গ, মিউনিখ, কোলন, বন ঝেঁটিয়ে এসেছে সবাই। উদ্যোক্তাদের মুখ শুকনো। জনস্রোত যদি বাড়ে, কী করবে তারা?
ঘরে ঢুকে দেখি অতশত তরুণ মুখের কলকাকলিতে কান পাতা দায়। মঞ্চের দিকে তাকিয়ে মনটা কেমন যেন হয়ে গেল। সবুজের ওপর সুন্দর করে লাল দিয়ে লেখা, ‘বাংলাদেশ: অন্তর মম বিকশিত করো’। ওটাই আমার বক্তব্যের বিষয়বস্তু। চারদিকে চোখ বুলিয়ে মনে হলো, আচ্ছা এই যে তিন শ ছেলেমেয়ে, তারা কেন এসেছে? তাদের বেশির ভাগ চেনে না আমাকে, নামও শোনেনি সম্ভবত। তবু এসেছে। শুধু এসেছে–কেউ একজন বাংলাদেশ সম্পর্কে বলবেন। কেউ একজন যিনি মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন, সাক্ষী ছিলেন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের। ওই নাড়ির টানেই তারা এসেছে এখানে।
এক ডজন ছেলেমেয়ে মঞ্চে উঠল। কী সুন্দর সেজে এসেছে তারা! মেয়েরা সবুজ শাড়ি, লাল পাড়, কপালে লাল টিপ। ছেলেরা সবুজ পাঞ্জাবি। সাদা পায়জামা। গলায় লাল ওড়নি। খালি গলায় যখন ‘আমার সোনার বাংলা’ গেয়ে উঠল, তখন সারা ঘর দাঁড়িয়ে গেল, গলা মেলাল। দেখলাম, চোখ মুছছে কেউ কেউ। তখন কোথায় বার্লিন, কোথায় কী? মনে হচ্ছিল, এক টুকরো বাংলাদেশ সেখানে জ্বলজ্বল করছে। চোখের সামনে ভেসে উঠল আমাদের লাল-সবুজ পতাকা।
এবার আমার পালা। মঞ্চে উঠতে উঠতে ঠিক করলাম, আজকের দিনে রবীন্দ্রনাথ থাকবেন পেছনের সারিতে, আজ সামনে থাকবে শুধুই বাংলাদেশ। অন্তরের ভেতর থেকে বলেছিলাম কিছু কথা–একজন সাধারণ মানুষের কথন, যে বঙ্গবন্ধুকে দেখেছে, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম প্রত্যক্ষ করেছে এবং বাংলাদেশের অভ্যুদয়েরও সাক্ষী। না, আর কোনো যোগ্যতা নেই তার। সে শুধু বাংলাদেশকে ভালোবাসে, এক টুকরো বাংলাদেশ যার হৃদয়ে স্থিত।
শেষের দিকে বলেছিলাম, চিরকাল তরুণদের জাতির ভবিষ্যৎ করে রাখা হয়েছে। আজ সময় হয়েছে তাদের জাতির বর্তমান করে দেওয়ার জন্য। আবেদন করেছিলাম বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি, তাঁরা যেন একটু পেছনে সরে দাঁড়ান। পাদপ্রদীপের নিচটা ছেড়ে দেন তরুণদের জন্য। তাহলে আমাদের বর্তমানও সুনিশ্চিত হবে, তেমনি অর্থবহ হবে আমাদের ভবিষ্যৎ।
পঁয়তাল্লিশ মিনিটের সে বক্তব্যের সময়ে মিলনায়তনে ছিল পিনপতন নিস্তব্ধতা–একটি সুচ পড়লেও তা শোনা যেত। আমার বলার শেষে করতালি-ফালির কথা মনে নেই। শুধু মনে আছে, পুত্র-কন্যাসম ওই তিন শ ছেলেমেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আমার ওপরে–তাদের প্রশ্নের বুভুক্ষা নিয়ে, তাদের জানার তৃষ্ণা নিয়ে। দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় প্রজন্মের বাঙালি তারা। অনেকে বাংলা ভালো বলতেও পারে না, তেমন যায়নিও তারা দেশে। কিন্তু কী যে তাদের ভালোবাসা ওই দেশটির প্রতি। ‘কোথায় সে দেশ–অতীতে না ভবিষ্যতে?’ বাংলাদেশ তাদের কাছে শুধু একটা দেশ নয়, একটা স্বপ্ন। আমি তাদের স্বপ্নের একটি কণামাত্র–এক সূত্রধর।
কিন্তু এ কথা তো শুধু আমার নয়, আমাদের প্রজন্মের সবার কথা। সেদিন আমার স্ত্রী শামীম (কবি শামীম আজাদ) বলছিল তার কথা। বহুদিন ধরে শামীম দেশের বাইরে। কিন্তু বাংলাদেশকে সে হৃদয়ে ধারণ করে রেখেছে নিরন্তর। এ দেশের শিকড় সে নিয়ে গেছে সঙ্গে। তাই তার সব কর্মকাণ্ড আবর্তিত হয়েছে বাংলাদেশকে ঘিরে। আজ থেকে তিন দশক আগে বাইরে বাংলাদেশ সম্পর্কে জ্ঞান ছিল কম, ধারণা ছিল নেতিবাচক। শামীম হৃদয়ে তাগিদ অনুভব করেছে বাইরের বিশ্বে বাংলাদেশকে চেনানোর।
‘জানো’, বলেছে সে, ‘যেকোনো অনুষ্ঠানে গেছি, সব সময় চেষ্টা করেছি কিছু একটা বলার, সুযোগ খুঁজেছি কোনো একটি প্রশ্ন করার। শুধু এই কারণে, যাতে আমি পরিচয় দেওয়ার শুরুতেই বলতে পারি, আমি বাংলাদেশের।’ তার এ কথার পর কেমন যেন লেগেছিল আমার কাছে, কেমন একটা নৈকট্য অনুভব করেছিলাম তার কথার সঙ্গে।
আমিও তো যেখানে যাই, নিজের অন্য পরিচয়ের সঙ্গে সঙ্গে বলি, আমি বাংলাদেশের–মমতার সঙ্গে বলি, গর্বের সঙ্গে জানাই, প্রত্যয়ের সঙ্গে উচ্চারণ করি। তবে করেছিলাম বটে বাংলাদেশের জন্য একটা কাজ। বছর দশেক আগে নিউইয়র্কে দক্ষিণ এশিয়ার ওপর এক আলোচনা সভায় বক্তাদের মধ্যে আরও দুজনের সঙ্গে ছিলাম আমি এবং সেই বিখ্যাত ব্যক্তিটি যিনি সত্তরের দশকের প্রথমার্ধে নিতান্ত তাচ্ছিল্য ও অনুকম্পার সঙ্গে বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন।
আমার বক্তব্যে আমি তার সূত্র টেনেছিলাম এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতে বলেছিলাম যে সেদিনের সেসব দম্ভমান মানব আজ আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন; কিন্তু বাংলাদেশ অহংকারের সঙ্গে বিরাজ করছে এবং প্রত্যয়ের সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে। সভায় গুঞ্জন উঠেছিল, উপর্যুক্ত ব্যক্তিটি সভা শেষে কথা বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সভা শেষে আমি অপেক্ষা করিনি, দাঁড়াইনি, দৃপ্তপদে মাথা উঁচু করে সভাকক্ষ থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম।
লেখক: ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য বিমোচন বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
দলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
১০ ঘণ্টা আগেশেখ হাসিনা সরকারের পতনের ১০০ দিন পার হয়ে গেছে। ১০০ দিনে অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কিছু যে হয়নি, তা নয়। তবে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে অস্থিরতার লক্ষণ অস্পষ্ট নয়। এর মধ্যেই তিন দফায় উপদেষ্টার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।
১০ ঘণ্টা আগেবাংলা ভাষায় অতিপরিচিত একটি শব্দবন্ধ হলো ‘খোলনলচে’। যাপিত জীবনে কমবেশি আমরা সবাই শব্দবন্ধটি প্রয়োগ করেছি। বাংলা বাগধারায় আমরা পড়েছি ‘খোলনলচে পালটানো’। বাংলা অভিধানে খোল শব্দের একাধিক অর্থ রয়েছে।
১০ ঘণ্টা আগেঅফিসে যাতায়াতের সময় স্টাফ বাসে পরিচয়ের সূত্রে ফারজানা আক্তার আজিমপুরে নিজের বাসায় সাবলেট দিয়েছিলেন ফাতেমা আক্তার শাপলা নামের এক নারীকে। কিন্তু ফাতেমা যে একটি প্রতারক চক্রের সদস্য, সেটা তাঁর জানা ছিল না।
১০ ঘণ্টা আগে