মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সম্প্রতি উপদেষ্টা পরিষদ, কেন্দ্রীয় এবং অঙ্গসংগঠনের নেতাদের নিয়ে তিন দিনের একটি ধারাবাহিক সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডন থেকে অনলাইনে সংযুক্তির মাধ্যমে তিনটি সভাতেই সভাপতিত্ব করেন। দলের নেতারা বর্তমান সরকারের অধীন কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া সম্ভব নয় মর্মে মত প্রকাশ করেন।
এ জন্য তাঁরা দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে সরকার পতনের আন্দোলন করার কথাও ব্যক্ত করেন। এ ছাড়া নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যতীত নির্বাচনে কোনো অবস্থায়ই বিএনপির অংশগ্রহণ করা উচিত নয় বলে মত দেন। একইভাবে আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হতে যাচ্ছে। এ অবস্থায় একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের দাবি আদায় করার পক্ষেও দলটির নেতারা মত দেন। আগামী নির্বাচনে বৃহত্তর ঐক্য গঠনের পক্ষেও নেতারা মতামত প্রদান করেন। এসব মতামত বিবেচনায় নিয়ে বিএনপি এ সপ্তাহে আরও কিছু সাংগঠনিক সভা এবং বিভিন্ন পেশাজীবীর মতামত গ্রহণ করতে যাচ্ছে। এরপর সরকারের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী একটি বৃহত্তর আন্দোলন শুরু করার জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার ধারণা দেওয়া হয়েছে।
আগামী নির্বাচন দলটি যেকোনো মূল্যে নিরপেক্ষ নির্দলীয় সরকারের অধীন অনুষ্ঠানের জন্য একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের দাবি আদায় করে দেশে তাদের ভাষায় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। আওয়ামী লীগকে একটি ফ্যাসিবাদী গণতন্ত্র হরণকারী, দেশ ধ্বংসকারী এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য বিপজ্জনক বলে অভিহিত করে আসছে বিএনপি। সরকার উৎখাতে বৃহত্তর আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করে দলটি। আগামী নির্বাচনের এখনো ২ বছর ৩ মাস বাকি। তার আগেই বিএনপি সরকার উৎখাত কিংবা তাদের প্রস্তাবিত নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন এবং নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম শুরু করতে চায়। দলটি এ লক্ষ্যেই অন্য দলগুলোকে নিয়ে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে একটি গণ-অভ্যুত্থান সৃষ্টির কথা ভাবছে। বিএনপির এসব বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রচারিত হওয়ায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকসহ অন্য নেতারা তাদের সক্ষমতা নিয়ে কিছু বিদ্রূপাত্মক প্রতিক্রিয়াও ব্যক্ত করেছেন।
বিএনপি নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে দাবি উত্থাপন করছে, সেটি অনেকের কাছে শুনতে বেশ ভালো লাগলেও কিছু বিষয়ে অনেকের কাছেই নানা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারবিষয়ক কোনো বিধান বা অনুচ্ছেদ বর্তমান সংবিধানে নেই। সুতরাং প্রথমেই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংবিধানে ফিরিয়ে আনতে হবে। কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব?
সব রাজনৈতিক দলের আন্দোলনের মুখে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত একতরফা ভোটারবিহীন নির্বাচনে গঠিত জাতীয় সংসদে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয় [অনুচ্ছেদ ৫৮(ক-ঙ)]।
ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় ১৯৯৬-এর জুন, ২০০১ ও ২০০৮ সালে ৩টি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তবে ২০০৬ সালে নির্ধারিত নির্বাচনের আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে বিএনপি এবং জোট সরকারের নানা কূটকৌশলের কারণে দেশে চরম রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। এক ভয়াবহ সংকট দেখা দেয়। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানের দায়িত্ব নিয়ে গোটা সরকারব্যবস্থাকেই অচল করে দিয়েছিলেন। নেপথ্যে কলকাঠি নাড়ছিলেন বিএনপি ও চারদলীয় জোটের নেতারা। দেশজুড়ে রাজনৈতিক সংঘাত ছড়িয়ে পড়া সত্ত্বেও রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন নির্বাচন কমিশন ঘোষিত একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানে অনড় থাকেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার থেকে চারজন সদস্য পদত্যাগ করেন। ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ কারও সঙ্গে আলোচনা ব্যতীত বিএনপির পরামর্শেই নতুন চারজন সদস্য নিয়োগ দেন। নির্বাচন কমিশনেও নতুন কমিশনার নিয়োগ করা হয়। এতসব করেও অচলাবস্থা নিরসন হয় না বরং দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক সব মহল ২২ জানুয়ারির ঘোষিত নির্বাচন নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকে।
এই অবস্থায় ১/১১ সংঘটিত হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অকার্যকারিতা, অসহায়ত্ব, ব্যর্থতা এবং দেশকে ভয়াবহ রক্তাক্ত বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে নেওয়ার দৃশ্য দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক সব মহলের কাছেই দৃশ্যমান হয়েছিল। ফলে এই ব্যবস্থাটি যে মোটেও দেশকে কোনো সুষ্ঠু, অবাধ নির্বাচন দেওয়ার একমাত্র গ্যারান্টি নয়, সেটি প্রমাণিত হয়। বিএনপি ও চারদলীয় জোট নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা জনগণের কাছে সম্পূর্ণরূপে নষ্ট করেছে। তারাই যে সেটি ব্যর্থ করে দিয়েছে, তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। সে কারণে এখন বিএনপির নতুন করে তোলা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি জনগণের কাছে ১৯৯৫-৯৬ সালের মতো গ্রহণযোগ্যতা পাবে কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে। অনেকেই মনে করেন বিএনপি নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার কবর রচনা করেছে।
অথচ ২০১৪ সালের নির্বাচন সামনে রেখে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থার একটি রূপরেখা প্রদানের জন্য তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে একটি সমাধানে পৌঁছানোর যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, সেটি সব মহলের কাছে প্রশংসিত হলেও খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সেই ডাকে সাড়া দেননি। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বসতেও রাজি হননি। শেখ হাসিনা বিরোধী দলকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ ৫টি মন্ত্রণালয়ের পদ নিয়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারব্যবস্থার অধীন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে প্রস্তাব দিয়েছিলেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রীর নীতিনির্ধারণী কোনো কাজ না করার প্রতিশ্রুতি ছিল, অন্তর্বর্তী সরকারে বিরোধী দলের ৫ জন এবং সরকারি দলের ৫ জন মন্ত্রী থাকার প্রস্তাব ছিল। বিষয়টি নিয়ে খালেদা জিয়া যদি আলোচনা করতেন এবং ভবিষ্যৎ নির্বাচনকালীন সরকারের এমন কাঠামো গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিতেন, তাহলে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে বারবার এ রকম জটিলতা ও অনাস্থার পরিবেশ হয়তো আর তৈরি হতো না। শেখ হাসিনার সেই উদ্যোগ বিএনপি নাকচ করে দেওয়ার পরিণতি এখন সবাইকেই ভোগ করতে হচ্ছে।
তা ছাড়া, সুপ্রিম কোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্পর্কে যে আইনগত ও সাংবিধানিক ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন, তা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী হিসেবে সংসদে গৃহীত হওয়ার পর বাংলাদেশে আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি নেই। এমন পরিস্থিতিতে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি বিএনপির জন্য বুমেরাং হতে পারে।
নির্বাচন অবশ্যই সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হওয়া দরকার। সেই ট্রেনটি বিএনপি আগেই মিস করেছে। এখন কীভাবে নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থার একটি স্থায়ী রূপরেখা নির্ণয় করা যায়, তা নিয়ে বর্তমান সরকারের সঙ্গে আলোচনা করা যেতে পারে। কিন্তু সেই আলোচনা কতটা সফল হবে, সেটি বলা মুশকিল। কারণ, ২০০৬ সালের অভিজ্ঞতা শুধু আওয়ামী লীগের একার জন্যই নয়, সব রাজনৈতিক দলের জন্যই ভয়ানক তিক্ততার ছিল। বিএনপি বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। ভবিষ্যতে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে দেশে প্রতিশোধ, নিগ্রহ এবং রাষ্ট্রের উদারবাদিতাকে হরণ করার কোনো দৃষ্টান্ত স্থাপিত হবে না—এমন প্রশ্ন শুধু আওয়ামী লীগই নয়, রাজনীতিসচেতন সব মহলেই রয়েছে। বিএনপির প্রতিহিংসাপরায়ণতা রাজনীতির নজির হিসেবে ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের শাসনকাল সবার সামনে উজ্জ্বল হয়ে আছে। তাই বিএনপিকে আগে নিজের গায়ের ময়লা সাফসুতরো করে মাঠে নামতে হবে।
এ ছাড়া সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার জন্য বিএনপির সাংগঠনিক প্রস্তুতি খুব একটা নেই। ২০০৭ সালের পর থেকে বিএনপি একের পর এক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাতে গিয়ে সচেতন দেশি এবং আন্তর্জাতিক মহলের কাছে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের পরিচয় হারায়, ২০১৩-১৫ সালের অগ্নিসংযোগ, দেশব্যাপী তাণ্ডব ইত্যাদি উগ্র ও হঠকারিতায় দলটি আরও বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। ২০১৮ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে দলটি নেতৃত্বশূন্যতায় কতটা অসহায় হয়ে পড়েছিল, সেটিও দেখা গেছে। বিএনপির একদিকে ড. কামাল হোসেন, অন্যদিকে জামায়াতের হাতে ধানের শীষ তুলে দেওয়ার দুর্বলতাও স্পষ্ট হয়েছে। এখন দলের চেয়ারপারসন কারাদণ্ডে দণ্ডিত, তিনি শারীরিকভাবেও অসুস্থ, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসনও দণ্ড নিয়ে বিদেশে অবস্থান করছেন। তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা কতটা উদ্দীপনা নিয়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়বেন, তা নিয়ে সংশয় আছে। অনেক জায়গায় দলটির কমিটি নেই, যেখানে কমিটি আছে সেখানেও দ্বন্দ্ব-বিরোধে জর্জরিত।
নতুন করে কমিটি গঠন করতে যাওয়ার মধ্যেও বিপদ আছে। বহুমাত্রিক সংকট নিয়ে বিএনপি আগামী দিনে কীভাবে সরকার পতনের আন্দোলন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন আদায়ের আন্দোলন সংগঠিত করবে, ভবিষ্যতের ঘটনাপ্রবাহ কীভাবে সংঘটিত বা পরিবর্তিত হবে, সে সম্পর্কে এত আগে থেকে ভবিষ্যদ্বাণী করা যাবে না। তবে সংক্ষেপে এটুকু বলা যায়, দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা বিএনপির অনুকূল বলে অনেকেই মনে করেন না।
লেখক: অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট
গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সম্প্রতি উপদেষ্টা পরিষদ, কেন্দ্রীয় এবং অঙ্গসংগঠনের নেতাদের নিয়ে তিন দিনের একটি ধারাবাহিক সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডন থেকে অনলাইনে সংযুক্তির মাধ্যমে তিনটি সভাতেই সভাপতিত্ব করেন। দলের নেতারা বর্তমান সরকারের অধীন কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া সম্ভব নয় মর্মে মত প্রকাশ করেন।
এ জন্য তাঁরা দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে সরকার পতনের আন্দোলন করার কথাও ব্যক্ত করেন। এ ছাড়া নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যতীত নির্বাচনে কোনো অবস্থায়ই বিএনপির অংশগ্রহণ করা উচিত নয় বলে মত দেন। একইভাবে আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হতে যাচ্ছে। এ অবস্থায় একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের দাবি আদায় করার পক্ষেও দলটির নেতারা মত দেন। আগামী নির্বাচনে বৃহত্তর ঐক্য গঠনের পক্ষেও নেতারা মতামত প্রদান করেন। এসব মতামত বিবেচনায় নিয়ে বিএনপি এ সপ্তাহে আরও কিছু সাংগঠনিক সভা এবং বিভিন্ন পেশাজীবীর মতামত গ্রহণ করতে যাচ্ছে। এরপর সরকারের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী একটি বৃহত্তর আন্দোলন শুরু করার জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার ধারণা দেওয়া হয়েছে।
আগামী নির্বাচন দলটি যেকোনো মূল্যে নিরপেক্ষ নির্দলীয় সরকারের অধীন অনুষ্ঠানের জন্য একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের দাবি আদায় করে দেশে তাদের ভাষায় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। আওয়ামী লীগকে একটি ফ্যাসিবাদী গণতন্ত্র হরণকারী, দেশ ধ্বংসকারী এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য বিপজ্জনক বলে অভিহিত করে আসছে বিএনপি। সরকার উৎখাতে বৃহত্তর আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করে দলটি। আগামী নির্বাচনের এখনো ২ বছর ৩ মাস বাকি। তার আগেই বিএনপি সরকার উৎখাত কিংবা তাদের প্রস্তাবিত নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন এবং নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম শুরু করতে চায়। দলটি এ লক্ষ্যেই অন্য দলগুলোকে নিয়ে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে একটি গণ-অভ্যুত্থান সৃষ্টির কথা ভাবছে। বিএনপির এসব বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রচারিত হওয়ায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকসহ অন্য নেতারা তাদের সক্ষমতা নিয়ে কিছু বিদ্রূপাত্মক প্রতিক্রিয়াও ব্যক্ত করেছেন।
বিএনপি নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে দাবি উত্থাপন করছে, সেটি অনেকের কাছে শুনতে বেশ ভালো লাগলেও কিছু বিষয়ে অনেকের কাছেই নানা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারবিষয়ক কোনো বিধান বা অনুচ্ছেদ বর্তমান সংবিধানে নেই। সুতরাং প্রথমেই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংবিধানে ফিরিয়ে আনতে হবে। কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব?
সব রাজনৈতিক দলের আন্দোলনের মুখে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত একতরফা ভোটারবিহীন নির্বাচনে গঠিত জাতীয় সংসদে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয় [অনুচ্ছেদ ৫৮(ক-ঙ)]।
ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় ১৯৯৬-এর জুন, ২০০১ ও ২০০৮ সালে ৩টি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তবে ২০০৬ সালে নির্ধারিত নির্বাচনের আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে বিএনপি এবং জোট সরকারের নানা কূটকৌশলের কারণে দেশে চরম রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। এক ভয়াবহ সংকট দেখা দেয়। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানের দায়িত্ব নিয়ে গোটা সরকারব্যবস্থাকেই অচল করে দিয়েছিলেন। নেপথ্যে কলকাঠি নাড়ছিলেন বিএনপি ও চারদলীয় জোটের নেতারা। দেশজুড়ে রাজনৈতিক সংঘাত ছড়িয়ে পড়া সত্ত্বেও রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন নির্বাচন কমিশন ঘোষিত একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানে অনড় থাকেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার থেকে চারজন সদস্য পদত্যাগ করেন। ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ কারও সঙ্গে আলোচনা ব্যতীত বিএনপির পরামর্শেই নতুন চারজন সদস্য নিয়োগ দেন। নির্বাচন কমিশনেও নতুন কমিশনার নিয়োগ করা হয়। এতসব করেও অচলাবস্থা নিরসন হয় না বরং দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক সব মহল ২২ জানুয়ারির ঘোষিত নির্বাচন নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকে।
এই অবস্থায় ১/১১ সংঘটিত হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অকার্যকারিতা, অসহায়ত্ব, ব্যর্থতা এবং দেশকে ভয়াবহ রক্তাক্ত বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে নেওয়ার দৃশ্য দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক সব মহলের কাছেই দৃশ্যমান হয়েছিল। ফলে এই ব্যবস্থাটি যে মোটেও দেশকে কোনো সুষ্ঠু, অবাধ নির্বাচন দেওয়ার একমাত্র গ্যারান্টি নয়, সেটি প্রমাণিত হয়। বিএনপি ও চারদলীয় জোট নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা জনগণের কাছে সম্পূর্ণরূপে নষ্ট করেছে। তারাই যে সেটি ব্যর্থ করে দিয়েছে, তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। সে কারণে এখন বিএনপির নতুন করে তোলা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি জনগণের কাছে ১৯৯৫-৯৬ সালের মতো গ্রহণযোগ্যতা পাবে কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে। অনেকেই মনে করেন বিএনপি নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার কবর রচনা করেছে।
অথচ ২০১৪ সালের নির্বাচন সামনে রেখে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থার একটি রূপরেখা প্রদানের জন্য তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে একটি সমাধানে পৌঁছানোর যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, সেটি সব মহলের কাছে প্রশংসিত হলেও খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সেই ডাকে সাড়া দেননি। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বসতেও রাজি হননি। শেখ হাসিনা বিরোধী দলকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ ৫টি মন্ত্রণালয়ের পদ নিয়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারব্যবস্থার অধীন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে প্রস্তাব দিয়েছিলেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রীর নীতিনির্ধারণী কোনো কাজ না করার প্রতিশ্রুতি ছিল, অন্তর্বর্তী সরকারে বিরোধী দলের ৫ জন এবং সরকারি দলের ৫ জন মন্ত্রী থাকার প্রস্তাব ছিল। বিষয়টি নিয়ে খালেদা জিয়া যদি আলোচনা করতেন এবং ভবিষ্যৎ নির্বাচনকালীন সরকারের এমন কাঠামো গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিতেন, তাহলে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে বারবার এ রকম জটিলতা ও অনাস্থার পরিবেশ হয়তো আর তৈরি হতো না। শেখ হাসিনার সেই উদ্যোগ বিএনপি নাকচ করে দেওয়ার পরিণতি এখন সবাইকেই ভোগ করতে হচ্ছে।
তা ছাড়া, সুপ্রিম কোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্পর্কে যে আইনগত ও সাংবিধানিক ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন, তা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী হিসেবে সংসদে গৃহীত হওয়ার পর বাংলাদেশে আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি নেই। এমন পরিস্থিতিতে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি বিএনপির জন্য বুমেরাং হতে পারে।
নির্বাচন অবশ্যই সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হওয়া দরকার। সেই ট্রেনটি বিএনপি আগেই মিস করেছে। এখন কীভাবে নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থার একটি স্থায়ী রূপরেখা নির্ণয় করা যায়, তা নিয়ে বর্তমান সরকারের সঙ্গে আলোচনা করা যেতে পারে। কিন্তু সেই আলোচনা কতটা সফল হবে, সেটি বলা মুশকিল। কারণ, ২০০৬ সালের অভিজ্ঞতা শুধু আওয়ামী লীগের একার জন্যই নয়, সব রাজনৈতিক দলের জন্যই ভয়ানক তিক্ততার ছিল। বিএনপি বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। ভবিষ্যতে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে দেশে প্রতিশোধ, নিগ্রহ এবং রাষ্ট্রের উদারবাদিতাকে হরণ করার কোনো দৃষ্টান্ত স্থাপিত হবে না—এমন প্রশ্ন শুধু আওয়ামী লীগই নয়, রাজনীতিসচেতন সব মহলেই রয়েছে। বিএনপির প্রতিহিংসাপরায়ণতা রাজনীতির নজির হিসেবে ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের শাসনকাল সবার সামনে উজ্জ্বল হয়ে আছে। তাই বিএনপিকে আগে নিজের গায়ের ময়লা সাফসুতরো করে মাঠে নামতে হবে।
এ ছাড়া সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার জন্য বিএনপির সাংগঠনিক প্রস্তুতি খুব একটা নেই। ২০০৭ সালের পর থেকে বিএনপি একের পর এক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাতে গিয়ে সচেতন দেশি এবং আন্তর্জাতিক মহলের কাছে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের পরিচয় হারায়, ২০১৩-১৫ সালের অগ্নিসংযোগ, দেশব্যাপী তাণ্ডব ইত্যাদি উগ্র ও হঠকারিতায় দলটি আরও বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। ২০১৮ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে দলটি নেতৃত্বশূন্যতায় কতটা অসহায় হয়ে পড়েছিল, সেটিও দেখা গেছে। বিএনপির একদিকে ড. কামাল হোসেন, অন্যদিকে জামায়াতের হাতে ধানের শীষ তুলে দেওয়ার দুর্বলতাও স্পষ্ট হয়েছে। এখন দলের চেয়ারপারসন কারাদণ্ডে দণ্ডিত, তিনি শারীরিকভাবেও অসুস্থ, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসনও দণ্ড নিয়ে বিদেশে অবস্থান করছেন। তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা কতটা উদ্দীপনা নিয়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়বেন, তা নিয়ে সংশয় আছে। অনেক জায়গায় দলটির কমিটি নেই, যেখানে কমিটি আছে সেখানেও দ্বন্দ্ব-বিরোধে জর্জরিত।
নতুন করে কমিটি গঠন করতে যাওয়ার মধ্যেও বিপদ আছে। বহুমাত্রিক সংকট নিয়ে বিএনপি আগামী দিনে কীভাবে সরকার পতনের আন্দোলন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন আদায়ের আন্দোলন সংগঠিত করবে, ভবিষ্যতের ঘটনাপ্রবাহ কীভাবে সংঘটিত বা পরিবর্তিত হবে, সে সম্পর্কে এত আগে থেকে ভবিষ্যদ্বাণী করা যাবে না। তবে সংক্ষেপে এটুকু বলা যায়, দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা বিএনপির অনুকূল বলে অনেকেই মনে করেন না।
লেখক: অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট
দলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
১ ঘণ্টা আগেশেখ হাসিনা সরকারের পতনের ১০০ দিন পার হয়ে গেছে। ১০০ দিনে অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কিছু যে হয়নি, তা নয়। তবে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে অস্থিরতার লক্ষণ অস্পষ্ট নয়। এর মধ্যেই তিন দফায় উপদেষ্টার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।
১ ঘণ্টা আগেবাংলা ভাষায় অতিপরিচিত একটি শব্দবন্ধ হলো ‘খোলনলচে’। যাপিত জীবনে কমবেশি আমরা সবাই শব্দবন্ধটি প্রয়োগ করেছি। বাংলা বাগধারায় আমরা পড়েছি ‘খোলনলচে পালটানো’। বাংলা অভিধানে খোল শব্দের একাধিক অর্থ রয়েছে।
১ ঘণ্টা আগেঅফিসে যাতায়াতের সময় স্টাফ বাসে পরিচয়ের সূত্রে ফারজানা আক্তার আজিমপুরে নিজের বাসায় সাবলেট দিয়েছিলেন ফাতেমা আক্তার শাপলা নামের এক নারীকে। কিন্তু ফাতেমা যে একটি প্রতারক চক্রের সদস্য, সেটা তাঁর জানা ছিল না।
২ ঘণ্টা আগে