সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি আদায়ে আন্দোলন যখন শুরু হয়, কমিউনিস্ট পার্টি তখন আওয়াজ তুলেছিল—সকল ভাষার সমান মর্যাদা চাই; অর্থাৎ কেবল বাংলা বা উর্দু নয়; পাঞ্জাবি, সিন্ধি, পশতু, বেলুচসহ পাকিস্তানের সব ভাষাকেই সমান মর্যাদা দিতে হবে। তখনকার বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সেই দাবি থেকে পার্টি সরে এসেছিল। কিন্তু সব ভাষার সমান মর্যাদার দাবি তো মোটেই অসংগত ছিল না এবং ওই দাবিই প্রমাণ করে দিচ্ছিল ‘পাকিস্তানি জাতি’ নামের একটি জাতি গঠনের চেষ্টা কতটা অন্যায়; ধরিয়ে দিচ্ছিল এই সত্যও যে পাকিস্তানে শাসন চলবে সেই অভিজাত শ্রেণির, নিজেদের মাতৃভাষা না-হওয়া সত্ত্বেও উর্দু ভাষাকে যারা সংস্কৃতির চর্চা ও যোগাযোগের ভাষা হিসেবে গণ্য ও ব্যবহার করে থাকে। সেদিন, সেই ১৯৫২ সালে, কমিউনিস্ট পার্টি যে দাবি থেকে সরে এসেছিল, পাঁচ বছর পরে ১৯৫৭ সালে উভয় পাকিস্তানের গণতন্ত্রকামী মানুষ সেই দাবির কাছে ফিরে গিয়েই পাকিস্তানের সব জাতির জন্য স্বাধীনতার দাবি তুলে ধরেছিল, গঠন করেছিল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)।
১৯৫৭ সালে ন্যাপ যখন গঠিত হচ্ছে, তখন এক ইউনিট প্রশ্নটি ছিল খুবই জীবন্ত। দীর্ঘ ৯ বছরের অপেক্ষা শেষে ১৯৫৬ সালের সংবিধান তখন সবে গৃহীত হয়েছে এবং সেই সংবিধানে এক ইউনিট গঠনকে সাংবিধানিক বৈধতা ও স্থায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ন্যাপের গঠন উপলক্ষে যে গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, তাতে সভাপতির ভাষণে মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, ‘পশ্চিম পাকিস্তানের এক ইউনিট সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলা প্রয়োজন। আওয়ামী লীগ কাউন্সিলের ১৯৫৫ সনের অক্টোবরের অধিবেশনে এক প্রস্তাবে পশ্চিম পাকিস্তানে জবরদস্তিমূলকভাবে এক ইউনিট গঠনের প্রতিবাদ জানানো হয় এবং ঘোষণা করা হয়, “যদি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যায় এবং যখনই যাইবে তখনই ইহা সমগ্র পাকিস্তানের জনমত সংগ্রহ করিয়া এবং জনসাধারণের মতামতের পূর্ণ স্বীকৃতি দিয়া এক ইউনিট আইনটি পুনর্বিবেচনা করিবেন”।’
মওলানা ভাসানী যোগ করেছিলেন, ‘এই প্রস্তাব এখনো বলবৎ আছে এবং আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় বসিয়াছে আজ দশ মাস। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের জনমত সংগ্রহের কোনো প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয় নাই। হওয়ার লক্ষণও নাই।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের স্বায়ত্তশাসন দাবির প্রতি মুসলিম লীগ, কৃষক প্রজা পার্টি ও নেজামে ইসলাম চূড়ান্ত উপেক্ষা প্রদর্শন করিয়াছে। সে জন্য দেশবাসী তাহাদিগকে ক্ষমা করে নাই। আমাদের সেই স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন সরকারও আজ উপেক্ষা প্রদর্শন করিতেছে। দেশবাসী উহা বরদাশত করিবেন কি?’
স্বায়ত্তশাসনের মর্মবাণীটিও তিনি উল্লেখ করেছেন: ‘পূর্ব পাকিস্তানের জন্য স্বায়ত্তশাসন দাবির অর্থ হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানের জন্যও স্বায়ত্তশাসন চাই’ এবং পরিষ্কারভাবে বলেছেন, ‘কয়েকজন অবাঙালি আদমজী দাউদের স্থলে কয়েকজন বাঙালি আদমজী দাউদ সৃষ্টিই যদি ৬ দফার লক্ষ্য হইয়া থাকে, তবে স্বায়ত্তশাসনের নামে বাংলার কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষ কোনো দিনই তার জন্য বুকের রক্ত ঢালিতে যাইবে না।’
বুকের রক্ত ঢালতে তারা অবশ্যই এগিয়ে গিয়েছিল। মেহনতি মানুষ উনসত্তরের অভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছে, প্রাণও দিয়েছে। এবং প্রাণ দিয়েছে তারা একাত্তরের যুদ্ধে, অতি অবিশ্বাস্য সংখ্যায়। নতুন ধনীদের সৃষ্টি করবে বলে নয়, নিজেদের মুক্ত করতে পারবে–এই আশাতেই। তাদের সেই আশা পূরণ হয়নি। সংখ্যা বেড়েছে একদিকে ধনীদের, অপরদিকে গরিবদের।
ভাসানীর আশঙ্কা ছিল যে এমনটাই ঘটবে, যদি না স্বাধীনতার জন্য আন্দোলনের নেতৃত্ব থাকে মেহনতি মানুষের স্বার্থের পাহারাদার রাজনৈতিক দলের হাতে। তাঁর ওই বক্তৃতাতেই মওলানা ভাসানী কিন্তু নেতৃত্বের প্রশ্নটিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল এই রকমের: ‘আজ প্রশ্ন ওঠে, কোন নেতৃত্বে স্বায়ত্তশাসন তথা জনগণের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক অধিকার অর্জিত হইবে।’ তিনি সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে, নেতৃত্ব যদি ‘উদীয়মান বাঙালি পুঁজিপতি গোষ্ঠীর’ করতলগত হয়, তাহলে স্বায়ত্তশাসন পর্যবসিত হবে বাঙালি ধনীদের পক্ষে ‘বাংলার কৃষক-শ্রমিক তথা সমস্ত মেহনতি মানুষের ওপর শোষণ-পীড়ন চালাবার’ অধিকারে সেদিন এটি ছিল শঙ্কা। পরে সেটাই সত্য হয়েছে। পূর্ববঙ্গের মানুষ স্বাধীনতা পেয়েছে, কিন্তু শোষণের হাত থেকে মুক্তি পায়নি। দোষ পুঁজিবাদীদের নয়, পুঁজিবাদীদের যা করার কথা সেটাই করেছে; দোষ সমাজতন্ত্রীদেরই, যারা ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি এবং নেতৃত্ব দিতে পারেনি মুক্তির যুদ্ধে।
ন্যাপ যে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা এবং এক ইউনিট ও তৎসংলগ্ন সংখ্যাসাম্য নীতির বিলুপ্তি চাইছিল, সেই দাবির বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমি স্বার্থবাদীরা শক্ত অবস্থান নিয়েছে। এবং সোহরাওয়ার্দী তখন তাঁদের পক্ষেই ছিলেন। সংবিধান প্রণয়ন না করতে পারলে দেশে সামরিক শাসন জারি হবে এই বলে তিনি ভয়ও দেখাতেন; পরে সত্যি সত্যি যখন সামরিক শাসন চলে এল, ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র বাতিল হয়ে গেল, তখনো কিন্তু স্বায়ত্তশাসনের অস্বীকৃতি এবং এক ইউনিট, সংখ্যাসাম্য ইত্যাদির অত্যাচার সেই আগের মতোই রয়ে গেল; আইয়ুব খান বরং আরও কঠিন স্বরে স্বায়ত্তশাসনের দাবিদারদের বিচ্ছিন্নতাবাদী, কমিউনিস্ট-প্ররোচিত ইত্যাদি বলে গাল পাড়া শুরু করলেন। সেই সময়ে ন্যাপের পক্ষ থেকে জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত সদস্য গাউস বক্স বেজেঞ্জা স্বায়ত্তশাসন ও এক ইউনিট প্রশ্নে ন্যাপের অবস্থানের তাৎপর্য অত্যন্ত সুন্দরভাবে তুলে ধরেছিলেন।
তাঁর বক্তব্য ছিল এরকম: ‘একমাত্র আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনই সর্বক্ষেত্রে বিরাজমান বৈষম্য দূর করিয়া পাকিস্তানের জাতীয় সমস্যার সমাধান করিতে পারে। [...] শাসকগোষ্ঠী স্বীয় স্বার্থে যে সংখ্যাসাম্যনীতি আমদানি করিয়াছে, তাহা বাস্তবে পাকিস্তানের বিভিন্ন ভাষাভাষী জনগণের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও বিদ্বেষভাবের সৃষ্টি করিয়াছে। এহেন পরিস্থিতিতে পূর্ব পাকিস্তানিরা মনে করিতেছেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানিরা তাহাদের শোষণ করিতেছেন এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ‘সংখ্যালঘু’ প্রদেশের জনগণ মনে করিতেছেন যে পাঞ্জাবিরা তাহাদের শোষণ করিতেছেন।’
দেখা যাচ্ছে যে, পূর্ববঙ্গ থেকে যখন স্বায়ত্তশাসনের দাবি তোলা হয়, তখন যুক্তি হিসেবে পাকিস্তানে দুই অংশের ভেতরকার আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতা ও দূরত্বের যুক্তি তো থাকেই, ১৯৪০ সালে গৃহীত যে লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে ১৯৪৭-এ পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা, সেই প্রস্তাবের কথাও স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়। লাহোর প্রস্তাবে পরিষ্কারভাবেই বলা হয়েছে যে, প্রস্তাবিত রাষ্ট্রটি এককেন্দ্রিক হবে না, এর থাকবে দুটি অংশ—একটি ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিমে, অপরটি উত্তর-পূর্বে; দুটি অংশই হবে ‘স্বাধীন’। জোর দিয়েই বলা হয়েছিল যে, constituent states shall be autonomous and sovereign। অর্থাৎ তারা কেবল যে স্বায়ত্তশাসিত হবে তা-ই নয়, তাদের ‘সার্বভৌমত্ব’ও থাকবে। তখন পাকিস্তান ছিল একটা ধারণা। কিন্তু ১৯৪৬ সালে যখন দেখা গেল ধারণাটির বাস্তবায়ন ঘটতে যাচ্ছে, তখন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ইচ্ছানুসারে এবং তাঁর নিকটস্থ ব্যক্তিদের সমর্থন অনুযায়ী ব্যবস্থাপক পরিষদসমূহের সদস্যদের এক সম্মেলনে প্রস্তাবটি সংশোধন করে নিয়ে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জায়গায় একটি এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রের কথা বসিয়ে দেওয়ার কাজটি সম্পন্ন করা হলো। পাকিস্তানের জন্য জিন্নাহ সাহেব প্রাণপাত করছেন, অথচ তিনি শাসনকর্তা হবেন শুধু একটি অংশের, এটি কেমন কথা! তিনি অখণ্ড পাকিস্তান চাইলেন, নেহরু যেমন চাইছিলেন অখণ্ড ভারত। আদি প্রস্তাবের সংশোধনীটি তিনি উত্থাপন করিয়ে নিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে দিয়েই, যিনি তখন কেবল বাংলার প্রধানমন্ত্রী তাই নন, ভারতবর্ষে একমাত্র পাকিস্তানপন্থী প্রধানমন্ত্রীও বটে। ইতিহাসের কৌতুক এখানেও যে, মূল নায়ক, কুশলী জিন্নাহ আদি প্রস্তাবটি উত্থাপন করিয়েছিলেন যাঁকে দিয়ে, সেই এ কে ফজলুল হকও ছিলেন বাংলার তখনকার প্রধানমন্ত্রী এবং যাঁকে দিয়ে তিনি সেই প্রস্তাব সংশোধনের মাধ্যমে কিম্ভূতরূপে বিকৃত করার প্রস্তাব উত্থাপন করালেন, সেই সোহরাওয়ার্দীও ছিলেন বাংলারই প্রধানমন্ত্রী। শুধু তা-ই নয়, আরদ্ধ কর্মটি সম্পাদিত হওয়ার পর ‘শের-ই- বাংলা’ ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী দুজনেই পেয়েছিলেন একই রকমের সমাদর। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াকালীনই ফজলুল হককে নানাভাবে অপদস্থ করে বাংলার প্রধানমন্ত্রিত্ব ও মুসলিম লীগে তাঁর অবস্থান দুই জায়গা থেকেই ঠেলে-ধাক্কিয়ে বের করে দেওয়া হলো। এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরে সোহরাওয়ার্দীকে প্রায় একইভাবে নতুন রাষ্ট্রের পূর্বাংশের প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে তো অবশ্যই, এমনকি গণপরিষদের সদস্যপদ থেকেও বঞ্চিত করা হলো। পাকিস্তানের কোনো অঞ্চলেরই বাসিন্দা নন, এ কারণে পাকিস্তানের নতুন শাসকদের মধ্যে যাঁদের পক্ষে গণপরিষদের সদস্য থাকার উপায় ছিল না, এমন ছয়জনকে পূর্ব বাংলার ব্যবস্থাপক পরিষদের সদস্যদের কোটা থেকে গণপরিষদে পাঠানো হলো। এঁদের মধ্যে নবাবজাদা লিয়াকত আলী খানও ছিলেন প্রধান; যিনি পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হলেন এবং হওয়ার পরপরই পূর্ববঙ্গের স্বায়ত্তশাসন কীভাবে ও কতটা পরিমাণে হরণ করা যায়, সেই কাজে তৎপর হয়ে উঠলেন। অখণ্ড বাংলাকে যে বিভক্ত করা হয়েছে, তার দায়িত্ব অনেকেরই, কিন্তু প্রধান অপরাধী হচ্ছে কংগ্রেসের অভ্যন্তরের হিন্দু মহাসভাপন্থীরা। অবাঙালি পাকিস্তানপন্থীরা বাংলার সবটা না-পাওয়ায় অসন্তুষ্ট হয়েছিল অবশ্যই, কিন্তু কে জানে ভেতরে-ভেতরে এইটুকু ভেবে স্বস্তি পেয়েছিল কি না যে কলকাতাকে না-পাওয়াতে মন্দের ভালো হয়েছে। কেননা, ভারতবর্ষের ওই দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরটি পাকিস্তানে এলে সেটাকেই হয়তো রাজধানী করার দাবি উঠত। তবে তাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার যথার্থ কোনো কারণ ছিল না, কারণ বাংলার মুসলিম লীগে এমন কোনো নেতা তখন ছিলেন না, যিনি শক্তভাবে অমন দাবি তুলতে পারতেন।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি আদায়ে আন্দোলন যখন শুরু হয়, কমিউনিস্ট পার্টি তখন আওয়াজ তুলেছিল—সকল ভাষার সমান মর্যাদা চাই; অর্থাৎ কেবল বাংলা বা উর্দু নয়; পাঞ্জাবি, সিন্ধি, পশতু, বেলুচসহ পাকিস্তানের সব ভাষাকেই সমান মর্যাদা দিতে হবে। তখনকার বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সেই দাবি থেকে পার্টি সরে এসেছিল। কিন্তু সব ভাষার সমান মর্যাদার দাবি তো মোটেই অসংগত ছিল না এবং ওই দাবিই প্রমাণ করে দিচ্ছিল ‘পাকিস্তানি জাতি’ নামের একটি জাতি গঠনের চেষ্টা কতটা অন্যায়; ধরিয়ে দিচ্ছিল এই সত্যও যে পাকিস্তানে শাসন চলবে সেই অভিজাত শ্রেণির, নিজেদের মাতৃভাষা না-হওয়া সত্ত্বেও উর্দু ভাষাকে যারা সংস্কৃতির চর্চা ও যোগাযোগের ভাষা হিসেবে গণ্য ও ব্যবহার করে থাকে। সেদিন, সেই ১৯৫২ সালে, কমিউনিস্ট পার্টি যে দাবি থেকে সরে এসেছিল, পাঁচ বছর পরে ১৯৫৭ সালে উভয় পাকিস্তানের গণতন্ত্রকামী মানুষ সেই দাবির কাছে ফিরে গিয়েই পাকিস্তানের সব জাতির জন্য স্বাধীনতার দাবি তুলে ধরেছিল, গঠন করেছিল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)।
১৯৫৭ সালে ন্যাপ যখন গঠিত হচ্ছে, তখন এক ইউনিট প্রশ্নটি ছিল খুবই জীবন্ত। দীর্ঘ ৯ বছরের অপেক্ষা শেষে ১৯৫৬ সালের সংবিধান তখন সবে গৃহীত হয়েছে এবং সেই সংবিধানে এক ইউনিট গঠনকে সাংবিধানিক বৈধতা ও স্থায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ন্যাপের গঠন উপলক্ষে যে গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, তাতে সভাপতির ভাষণে মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, ‘পশ্চিম পাকিস্তানের এক ইউনিট সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলা প্রয়োজন। আওয়ামী লীগ কাউন্সিলের ১৯৫৫ সনের অক্টোবরের অধিবেশনে এক প্রস্তাবে পশ্চিম পাকিস্তানে জবরদস্তিমূলকভাবে এক ইউনিট গঠনের প্রতিবাদ জানানো হয় এবং ঘোষণা করা হয়, “যদি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যায় এবং যখনই যাইবে তখনই ইহা সমগ্র পাকিস্তানের জনমত সংগ্রহ করিয়া এবং জনসাধারণের মতামতের পূর্ণ স্বীকৃতি দিয়া এক ইউনিট আইনটি পুনর্বিবেচনা করিবেন”।’
মওলানা ভাসানী যোগ করেছিলেন, ‘এই প্রস্তাব এখনো বলবৎ আছে এবং আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় বসিয়াছে আজ দশ মাস। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের জনমত সংগ্রহের কোনো প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয় নাই। হওয়ার লক্ষণও নাই।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের স্বায়ত্তশাসন দাবির প্রতি মুসলিম লীগ, কৃষক প্রজা পার্টি ও নেজামে ইসলাম চূড়ান্ত উপেক্ষা প্রদর্শন করিয়াছে। সে জন্য দেশবাসী তাহাদিগকে ক্ষমা করে নাই। আমাদের সেই স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন সরকারও আজ উপেক্ষা প্রদর্শন করিতেছে। দেশবাসী উহা বরদাশত করিবেন কি?’
স্বায়ত্তশাসনের মর্মবাণীটিও তিনি উল্লেখ করেছেন: ‘পূর্ব পাকিস্তানের জন্য স্বায়ত্তশাসন দাবির অর্থ হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানের জন্যও স্বায়ত্তশাসন চাই’ এবং পরিষ্কারভাবে বলেছেন, ‘কয়েকজন অবাঙালি আদমজী দাউদের স্থলে কয়েকজন বাঙালি আদমজী দাউদ সৃষ্টিই যদি ৬ দফার লক্ষ্য হইয়া থাকে, তবে স্বায়ত্তশাসনের নামে বাংলার কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষ কোনো দিনই তার জন্য বুকের রক্ত ঢালিতে যাইবে না।’
বুকের রক্ত ঢালতে তারা অবশ্যই এগিয়ে গিয়েছিল। মেহনতি মানুষ উনসত্তরের অভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছে, প্রাণও দিয়েছে। এবং প্রাণ দিয়েছে তারা একাত্তরের যুদ্ধে, অতি অবিশ্বাস্য সংখ্যায়। নতুন ধনীদের সৃষ্টি করবে বলে নয়, নিজেদের মুক্ত করতে পারবে–এই আশাতেই। তাদের সেই আশা পূরণ হয়নি। সংখ্যা বেড়েছে একদিকে ধনীদের, অপরদিকে গরিবদের।
ভাসানীর আশঙ্কা ছিল যে এমনটাই ঘটবে, যদি না স্বাধীনতার জন্য আন্দোলনের নেতৃত্ব থাকে মেহনতি মানুষের স্বার্থের পাহারাদার রাজনৈতিক দলের হাতে। তাঁর ওই বক্তৃতাতেই মওলানা ভাসানী কিন্তু নেতৃত্বের প্রশ্নটিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল এই রকমের: ‘আজ প্রশ্ন ওঠে, কোন নেতৃত্বে স্বায়ত্তশাসন তথা জনগণের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক অধিকার অর্জিত হইবে।’ তিনি সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে, নেতৃত্ব যদি ‘উদীয়মান বাঙালি পুঁজিপতি গোষ্ঠীর’ করতলগত হয়, তাহলে স্বায়ত্তশাসন পর্যবসিত হবে বাঙালি ধনীদের পক্ষে ‘বাংলার কৃষক-শ্রমিক তথা সমস্ত মেহনতি মানুষের ওপর শোষণ-পীড়ন চালাবার’ অধিকারে সেদিন এটি ছিল শঙ্কা। পরে সেটাই সত্য হয়েছে। পূর্ববঙ্গের মানুষ স্বাধীনতা পেয়েছে, কিন্তু শোষণের হাত থেকে মুক্তি পায়নি। দোষ পুঁজিবাদীদের নয়, পুঁজিবাদীদের যা করার কথা সেটাই করেছে; দোষ সমাজতন্ত্রীদেরই, যারা ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি এবং নেতৃত্ব দিতে পারেনি মুক্তির যুদ্ধে।
ন্যাপ যে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা এবং এক ইউনিট ও তৎসংলগ্ন সংখ্যাসাম্য নীতির বিলুপ্তি চাইছিল, সেই দাবির বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমি স্বার্থবাদীরা শক্ত অবস্থান নিয়েছে। এবং সোহরাওয়ার্দী তখন তাঁদের পক্ষেই ছিলেন। সংবিধান প্রণয়ন না করতে পারলে দেশে সামরিক শাসন জারি হবে এই বলে তিনি ভয়ও দেখাতেন; পরে সত্যি সত্যি যখন সামরিক শাসন চলে এল, ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র বাতিল হয়ে গেল, তখনো কিন্তু স্বায়ত্তশাসনের অস্বীকৃতি এবং এক ইউনিট, সংখ্যাসাম্য ইত্যাদির অত্যাচার সেই আগের মতোই রয়ে গেল; আইয়ুব খান বরং আরও কঠিন স্বরে স্বায়ত্তশাসনের দাবিদারদের বিচ্ছিন্নতাবাদী, কমিউনিস্ট-প্ররোচিত ইত্যাদি বলে গাল পাড়া শুরু করলেন। সেই সময়ে ন্যাপের পক্ষ থেকে জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত সদস্য গাউস বক্স বেজেঞ্জা স্বায়ত্তশাসন ও এক ইউনিট প্রশ্নে ন্যাপের অবস্থানের তাৎপর্য অত্যন্ত সুন্দরভাবে তুলে ধরেছিলেন।
তাঁর বক্তব্য ছিল এরকম: ‘একমাত্র আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনই সর্বক্ষেত্রে বিরাজমান বৈষম্য দূর করিয়া পাকিস্তানের জাতীয় সমস্যার সমাধান করিতে পারে। [...] শাসকগোষ্ঠী স্বীয় স্বার্থে যে সংখ্যাসাম্যনীতি আমদানি করিয়াছে, তাহা বাস্তবে পাকিস্তানের বিভিন্ন ভাষাভাষী জনগণের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও বিদ্বেষভাবের সৃষ্টি করিয়াছে। এহেন পরিস্থিতিতে পূর্ব পাকিস্তানিরা মনে করিতেছেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানিরা তাহাদের শোষণ করিতেছেন এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ‘সংখ্যালঘু’ প্রদেশের জনগণ মনে করিতেছেন যে পাঞ্জাবিরা তাহাদের শোষণ করিতেছেন।’
দেখা যাচ্ছে যে, পূর্ববঙ্গ থেকে যখন স্বায়ত্তশাসনের দাবি তোলা হয়, তখন যুক্তি হিসেবে পাকিস্তানে দুই অংশের ভেতরকার আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতা ও দূরত্বের যুক্তি তো থাকেই, ১৯৪০ সালে গৃহীত যে লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে ১৯৪৭-এ পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা, সেই প্রস্তাবের কথাও স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়। লাহোর প্রস্তাবে পরিষ্কারভাবেই বলা হয়েছে যে, প্রস্তাবিত রাষ্ট্রটি এককেন্দ্রিক হবে না, এর থাকবে দুটি অংশ—একটি ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিমে, অপরটি উত্তর-পূর্বে; দুটি অংশই হবে ‘স্বাধীন’। জোর দিয়েই বলা হয়েছিল যে, constituent states shall be autonomous and sovereign। অর্থাৎ তারা কেবল যে স্বায়ত্তশাসিত হবে তা-ই নয়, তাদের ‘সার্বভৌমত্ব’ও থাকবে। তখন পাকিস্তান ছিল একটা ধারণা। কিন্তু ১৯৪৬ সালে যখন দেখা গেল ধারণাটির বাস্তবায়ন ঘটতে যাচ্ছে, তখন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ইচ্ছানুসারে এবং তাঁর নিকটস্থ ব্যক্তিদের সমর্থন অনুযায়ী ব্যবস্থাপক পরিষদসমূহের সদস্যদের এক সম্মেলনে প্রস্তাবটি সংশোধন করে নিয়ে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জায়গায় একটি এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রের কথা বসিয়ে দেওয়ার কাজটি সম্পন্ন করা হলো। পাকিস্তানের জন্য জিন্নাহ সাহেব প্রাণপাত করছেন, অথচ তিনি শাসনকর্তা হবেন শুধু একটি অংশের, এটি কেমন কথা! তিনি অখণ্ড পাকিস্তান চাইলেন, নেহরু যেমন চাইছিলেন অখণ্ড ভারত। আদি প্রস্তাবের সংশোধনীটি তিনি উত্থাপন করিয়ে নিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে দিয়েই, যিনি তখন কেবল বাংলার প্রধানমন্ত্রী তাই নন, ভারতবর্ষে একমাত্র পাকিস্তানপন্থী প্রধানমন্ত্রীও বটে। ইতিহাসের কৌতুক এখানেও যে, মূল নায়ক, কুশলী জিন্নাহ আদি প্রস্তাবটি উত্থাপন করিয়েছিলেন যাঁকে দিয়ে, সেই এ কে ফজলুল হকও ছিলেন বাংলার তখনকার প্রধানমন্ত্রী এবং যাঁকে দিয়ে তিনি সেই প্রস্তাব সংশোধনের মাধ্যমে কিম্ভূতরূপে বিকৃত করার প্রস্তাব উত্থাপন করালেন, সেই সোহরাওয়ার্দীও ছিলেন বাংলারই প্রধানমন্ত্রী। শুধু তা-ই নয়, আরদ্ধ কর্মটি সম্পাদিত হওয়ার পর ‘শের-ই- বাংলা’ ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী দুজনেই পেয়েছিলেন একই রকমের সমাদর। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াকালীনই ফজলুল হককে নানাভাবে অপদস্থ করে বাংলার প্রধানমন্ত্রিত্ব ও মুসলিম লীগে তাঁর অবস্থান দুই জায়গা থেকেই ঠেলে-ধাক্কিয়ে বের করে দেওয়া হলো। এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরে সোহরাওয়ার্দীকে প্রায় একইভাবে নতুন রাষ্ট্রের পূর্বাংশের প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে তো অবশ্যই, এমনকি গণপরিষদের সদস্যপদ থেকেও বঞ্চিত করা হলো। পাকিস্তানের কোনো অঞ্চলেরই বাসিন্দা নন, এ কারণে পাকিস্তানের নতুন শাসকদের মধ্যে যাঁদের পক্ষে গণপরিষদের সদস্য থাকার উপায় ছিল না, এমন ছয়জনকে পূর্ব বাংলার ব্যবস্থাপক পরিষদের সদস্যদের কোটা থেকে গণপরিষদে পাঠানো হলো। এঁদের মধ্যে নবাবজাদা লিয়াকত আলী খানও ছিলেন প্রধান; যিনি পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হলেন এবং হওয়ার পরপরই পূর্ববঙ্গের স্বায়ত্তশাসন কীভাবে ও কতটা পরিমাণে হরণ করা যায়, সেই কাজে তৎপর হয়ে উঠলেন। অখণ্ড বাংলাকে যে বিভক্ত করা হয়েছে, তার দায়িত্ব অনেকেরই, কিন্তু প্রধান অপরাধী হচ্ছে কংগ্রেসের অভ্যন্তরের হিন্দু মহাসভাপন্থীরা। অবাঙালি পাকিস্তানপন্থীরা বাংলার সবটা না-পাওয়ায় অসন্তুষ্ট হয়েছিল অবশ্যই, কিন্তু কে জানে ভেতরে-ভেতরে এইটুকু ভেবে স্বস্তি পেয়েছিল কি না যে কলকাতাকে না-পাওয়াতে মন্দের ভালো হয়েছে। কেননা, ভারতবর্ষের ওই দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরটি পাকিস্তানে এলে সেটাকেই হয়তো রাজধানী করার দাবি উঠত। তবে তাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার যথার্থ কোনো কারণ ছিল না, কারণ বাংলার মুসলিম লীগে এমন কোনো নেতা তখন ছিলেন না, যিনি শক্তভাবে অমন দাবি তুলতে পারতেন।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
দলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
১৭ ঘণ্টা আগেশেখ হাসিনা সরকারের পতনের ১০০ দিন পার হয়ে গেছে। ১০০ দিনে অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কিছু যে হয়নি, তা নয়। তবে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে অস্থিরতার লক্ষণ অস্পষ্ট নয়। এর মধ্যেই তিন দফায় উপদেষ্টার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।
১৭ ঘণ্টা আগেবাংলা ভাষায় অতিপরিচিত একটি শব্দবন্ধ হলো ‘খোলনলচে’। যাপিত জীবনে কমবেশি আমরা সবাই শব্দবন্ধটি প্রয়োগ করেছি। বাংলা বাগধারায় আমরা পড়েছি ‘খোলনলচে পালটানো’। বাংলা অভিধানে খোল শব্দের একাধিক অর্থ রয়েছে।
১৭ ঘণ্টা আগেঅফিসে যাতায়াতের সময় স্টাফ বাসে পরিচয়ের সূত্রে ফারজানা আক্তার আজিমপুরে নিজের বাসায় সাবলেট দিয়েছিলেন ফাতেমা আক্তার শাপলা নামের এক নারীকে। কিন্তু ফাতেমা যে একটি প্রতারক চক্রের সদস্য, সেটা তাঁর জানা ছিল না।
১৮ ঘণ্টা আগে