মামুনুর রশীদ
আমার এক বন্ধু ঈদের পর ৬০০ টাকার ট্রেনের টিকিট যখন ২ হাজার ৪০০ টাকায় কিনতে ব্যর্থ হলো, তখন রেগেমেগে আমাকে ফোন করেছে। উত্তেজিতভাবে সে একাই বলতে শুরু করল এত রক্তক্ষয়, এত আত্মত্যাগের বিনিময়ে একটা দেশ স্বাধীন হলো আর কিছু লোক এই দেশটাকে, দেশের মাটিটাকে পুঁজি করে কোটি কোটি টাকার পাহাড় গড়ল, দেশ থেকে বিদেশে চলে গেল আর দেশে যারা আছে আমরাও টিকিট কালোবাজারি, ব্যবসায়ীদের হাতে জিম্মি হয়ে রয়েছি। আমি এ-ও জানি, তোমাদের কিছু করার নেই। বেচারা আমার কোনো কথাই শুনছে না। কারণ, তার অসুস্থ মাকে নিয়ে ঢাকায় চিকিৎসার জন্য আসতে হবে।
টেলিফোনটা রেখে আমি অনেকক্ষণ ভাবলাম। যদিও আমার ভাবনা অর্থহীন। কারণ, আমি নিজেও এক হালি ডিম ৬০ টাকা করে কিনছি। কয়েক দিন আগেই ডিমের দাম যেখানে ছিল ৩০-৩২ টাকা। একলাফে ৪০ থেকে ৪৫ হয়ে গেল এবং তারপরে আরেক লাফে এখন ৬০ টাকায় এসে ঠেকেছে। যুক্তি একটাই—জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে। চালের দাম বেড়েছে, সে-ও একই যুক্তি। কিন্তু হিসাব করে দেখা গেল প্রতি কেজিতে পরিবহন খরচ ১০ পয়সা।
১০ পয়সা পরিবহন খরচ যেখানে, সেখানে কেজিপ্রতি চালের দাম বেড়েছে ১৫ থেকে ২০ টাকা। অন্যান্য ক্ষেত্রে দাম বাড়ানোর কথা নাই-বা বললাম। কারণ, চাল ও ডিমের দামই মধ্যবিত্তের বেঁচে থাকার সংকট তৈরি করার জন্য যথেষ্ট। নিরীহ মধ্যবিত্ত সুবোধ বালকের মতো সবাই এগুলো কিনছে প্রাণরক্ষার তাগিদে। প্রতিদিন টক শোতে, পত্রিকাতে নানাভাবে বিষয়গুলো নিয়ে তুমুলতর্কবিতর্ক হচ্ছে। সরকারপক্ষের লোকদের একটাই বক্তব্য, তা হলো জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে। অবশ্য ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এই দাম বাড়াকে এক মহোৎসব বলে চিহ্নিত করেছেন। এই মহোৎসব কারা করে? জাতির কাছে তা অত্যন্ত পরিষ্কার। ব্যবসায়ীশাসিত সংসদ সদস্য এবং মন্ত্রিসভা বিষয়টিকে সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে যায় এবং লুটেরা ব্যবসায়ী চক্র, যারা চুয়াত্তরে কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করেছিল, তারা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে জাগ্রত থাকে এবং সুযোগ পেলেই জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে একটা অসহনীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। এখন তার একটা চূড়ান্ত পর্যায় চলছে। এরা জানে, কখন মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে বাধ্য হবে এবং কখন উৎসব আসবে যখন তাদের জামাকাপড় কিনতেই হবে। এরা রমজান মাসের জন্য অপেক্ষা করে, ঈদ, পূজা, বড়দিনের জন্য অপেক্ষা করে এবং নিম্নমানের পণ্য দিয়ে উচ্চমূল্যের দাম আদায় করে। এবার করোনা মহামারিতে ব্যবসা করেছে।
এসব ব্যবসায়ীর থাবা এত বড় যে করোনা যেতে না যেতেই তারা খুঁজে পেয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। সরকারের আমলাদের একটা অংশকে প্রভাবিত করে অকারণে তেলের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। সরকারের মুখপাত্রই বলছে তেলের দাম বাড়িয়ে দেওয়াতে তাদের লিটারপ্রতি ২৫ টাকা মুনাফা হয়েছে। সরকারের মুনাফা সরকারের ঘরেই চলে যাচ্ছে। কিন্তু সুবিধা যেটা হচ্ছে তা হলো অন্যান্য পণ্যের দাম ও পরিবহনের ভাড়া বাড়িয়ে দেওয়া হলো। ব্যবসায়ীরা ঐতিহাসিকভাবে এত নির্দয় যে ১৯৪৩ সালে দুর্ভিক্ষের সময় মজুতদারি করে, লবণসংকট সৃষ্টি করে মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিল। কলকাতা শহরে ওই সময়ে লঙ্গরখানা করে মানুষকে বাঁচানোর চেষ্টা করা হয়েছে। তারও আগে ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সময় এই ঢাকা শহরে হাজার হাজার লোক অনাহারে মৃত্যুবরণ করেছে। ইতিহাস প্রমাণ করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বলগাহীন লোভের কারণে এই দুর্ভিক্ষটি সংঘটিত হয়। এর আগে পুরো ভারতবর্ষে মজুতদারি, পাচার—এসবের কোনো অস্তিত্ব ছিল না।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ব্যবসায়ীরা যেন একটা সোনার খনি আবিষ্কার করলেন। মজুতদারি, কালোবাজারি এবং সীমান্তের ওপার থেকে চোরাচালানি করে এখানে পণ্যদ্রব্য বিক্রি করে লাখ লাখ কোটি টাকা মুনাফা করে। আবার বাংলাদেশ থেকে মূল্যবান দ্রব্যাদি চোরাচালানের মাধ্যমে ভারতে চলে যায়। এই সময়ে টাকার মান ভারতীয় রুপির তুলনায় অবিশ্বাস্য রকম নিচে নেমে যায়। বাংলাদেশের প্রথম সরকার এই পরিস্থিতিতে হিমশিম খেতে থাকে। কিন্তু ব্যবসায়ীদের হৃদয় একটুও কাঁপে না। ব্যবসায়ীরা প্রথম আঘাত হানে শিশুখাদ্যের ওপর। আমদানি করা দুধ বাজার থেকে প্রায় গায়েব হয়ে যায়। সরকার টিসিবির মাধ্যমে এই শিশুখাদ্য বাজারে ছাড়ে। মায়েরা তখন লাইন দিয়ে শিশুখাদ্য কেনার চেষ্টা করে। সেখানেও অসাধু ব্যবসায়ীরা টিসিবির মালামাল অন্য পথ দিয়ে সরিয়ে নেয়। সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে রেশনপ্রথা চালু করে। একদিন কারফিউ দিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে রেশন কার্ড বিতরণ করা হয়। রেশন পাওয়াতে মানুষের মধ্যে কিছুটা স্বস্তি ফিরে আসে। এ রকম হয়েছিল ১৯৫৭ সালে, দ্রব্যমূল্য মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারি হওয়ার পর নানা ধরনের শাস্তি পেয়ে ব্যবসায়ীরা কিছুটা শৃঙ্খলার মধ্যে এসেছিল।
যেকোনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ব্যবসায়ীদের লোভ লাগামহীন হয়ে পড়ে। ঘণ্টায় ঘণ্টায় তারা পণ্যের দাম বাড়ায় এবং ক্রেতা-বিক্রেতার ধৈর্যের পরীক্ষা করে। দেশের ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো যতই শক্তিশালী হতে থাকে, ততই ব্যবসায়ীদের লোভ বাড়তে থাকে। এমন একটি পরিস্থিতি যেখানে সরকার, জনগণ একটা শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে, সেখানে ব্যবসায়ীদের সংগঠনের কোনো বিবৃতি বা হুঁশিয়ারি দেখা যায় না। সেখানে আছে একটা ভোটের ব্যাপার। তারা যেকোনো ছোট সংগঠনকে বিন্দুমাত্র চটাতে চায় না। কারণ, ভোটের বিষয় আছে। দেশের বাণিজ্যমন্ত্রী একজন ব্যবসায়ী। মন্ত্রিত্ব না থাকলে তাঁর এই ব্যবসায়ীদের সঙ্গেই জীবনযাপন করতে হবে। তাই তিনি হয়তো ক্ষণিকের মন্ত্রিত্বের জন্য চিরদিনের বন্ধুদের সঙ্গে সংকট সৃষ্টি করতে চান না। তিনি সব সময়ই শ্যাম রাখি না কুল রাখি, এই ধরনের বিবৃতি দিয়ে যাচ্ছেন। ভোক্তা-অধিকার অধিদপ্তর মাঝেমধ্যে ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে কিছু ঘটনা ঘটায় এবং প্রয়োজন ও ব্যাপকতার তুলনায় তা এতই কম যে বিষয়টি হয়তো টেলিভিশনের পর্দায় তাৎক্ষণিক একটা উত্তেজনার সৃষ্টি করে। কিন্তু পরিশেষে তা হাস্যকর হয়ে দাঁড়ায়।
এই ব্যবসায়ীরা এতই ক্ষমতাবান যে তাঁরা বাংলাদেশের দৃশ্যপট পাল্টে দিয়েছেন। যেখানে তাকানো হয় সেখানেই দোকান। শহরে যেকোনো বাড়ির গ্যারেজে দোকান, রাস্তায় দোকান। গুলিস্তানের পাশে যানবাহন চলাচলের একটা পথ ছিল। সেটাও বন্ধ হয়ে এখন সেখানে নানা ধরনের দোকানপাট গড়ে উঠেছে। সদরঘাটে তো দোকানের জন্য লঞ্চঘাটেই যাওয়া যায় না। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ ও তার আশপাশের জায়গাকে একটা দোকানের আবর্জনা বলা যায়।
শুধু ঢাকাতেই নয়, ঢাকার বাইরেও ছোট ছোট শহরে ছোটবড় এত সব সুপার মার্কেট যে বাংলাদেশের নান্দনিক সৌন্দর্য একেবারেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশের যত ভোক্তা তার চেয়ে সম্ভবত দোকানের সংখ্যা বেশি। ভোক্তাদের মধ্যে একটা অংশ আছে, যাদের আয় প্রবল এবং আয়ের উৎস দুর্নীতি, কালোবাজারি ও মজুতদারি। প্রয়োজন থাক বা না থাক তারা কিনতেই অভ্যস্ত। এমন অনেক বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় পাঁচ-দশ বছরের কেনা পণ্য অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। প্রতিদিন খবরের কাগজে এসব ঠিকাদার, ব্যবসায়ী, আমলা ও রাজনীতিবিদের প্রতিবেদনও ছাপা হচ্ছে। তাতে কেউ দমছে না বরং নানাভাবে অনুপ্রাণিত হচ্ছে। আমাদের একটি দুর্নীতি দমন কমিশন আছে, তারা হয়তো বলবে, ‘প্রয়োজনের তুলনায় আমাদের সীমাবদ্ধতা অনেক’। আর একবার মামলা হলে অপরাধীরা দীর্ঘদিন সুযোগ পেয়ে যায় দেনদরবার ও আইনের মারপ্যাঁচে, এই প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা বলে কিছু থাকে না। তারপরও বাংলাদেশে সবাই সবাইকে চেনে, চেনাজানা ছাড়াও টাকার শক্তি সবচেয়ে বড় শক্তি। দুর্নীতি করে কোটি কোটি টাকা উপার্জন করে সেখানে দু-চার কোটি খরচ করলে অসুবিধা কী?
সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক ব্যবসায়ীদের মধ্যে মানবিকবোধ জাগ্রত করার কথা বলেছেন। যেটি এক অসম্ভব কল্পনা! সেটা সম্ভব একমাত্র এই ব্যবসায়ীদের কঠোর শাস্তি দিয়ে। আর সম্ভব ক্রেতারা যদি একটু ত্যাগ স্বীকার করেন। তাঁরা যদি বলেন ৫৩ টাকা হালি করে এক সপ্তাহ ডিম খাবেন না, ৩০০ টাকা কেজিতে কাঁচা মরিচ খাবেন না, এত দাম দিয়ে কোনো জিনিসই ক্রয় করবেন না, তাহলে ডিম পচে যাবে, কাঁচা মরিচ পচে যাবে, চালে পোকা দেখা দেবে। এবং অসহায় ব্যবসায়ীদের মাছি মারতে দেখা যাবে। বিপণিবিতানগুলোতে কিছুদিনের জন্য একটা বিরতি দিতে পারলে হয়তো এর কিছুটা সুরাহা হতে পারে। কিন্তু তাতেও কি লুটেরাদের বাজার করা বন্ধ হবে?
আমার এক বন্ধু ঈদের পর ৬০০ টাকার ট্রেনের টিকিট যখন ২ হাজার ৪০০ টাকায় কিনতে ব্যর্থ হলো, তখন রেগেমেগে আমাকে ফোন করেছে। উত্তেজিতভাবে সে একাই বলতে শুরু করল এত রক্তক্ষয়, এত আত্মত্যাগের বিনিময়ে একটা দেশ স্বাধীন হলো আর কিছু লোক এই দেশটাকে, দেশের মাটিটাকে পুঁজি করে কোটি কোটি টাকার পাহাড় গড়ল, দেশ থেকে বিদেশে চলে গেল আর দেশে যারা আছে আমরাও টিকিট কালোবাজারি, ব্যবসায়ীদের হাতে জিম্মি হয়ে রয়েছি। আমি এ-ও জানি, তোমাদের কিছু করার নেই। বেচারা আমার কোনো কথাই শুনছে না। কারণ, তার অসুস্থ মাকে নিয়ে ঢাকায় চিকিৎসার জন্য আসতে হবে।
টেলিফোনটা রেখে আমি অনেকক্ষণ ভাবলাম। যদিও আমার ভাবনা অর্থহীন। কারণ, আমি নিজেও এক হালি ডিম ৬০ টাকা করে কিনছি। কয়েক দিন আগেই ডিমের দাম যেখানে ছিল ৩০-৩২ টাকা। একলাফে ৪০ থেকে ৪৫ হয়ে গেল এবং তারপরে আরেক লাফে এখন ৬০ টাকায় এসে ঠেকেছে। যুক্তি একটাই—জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে। চালের দাম বেড়েছে, সে-ও একই যুক্তি। কিন্তু হিসাব করে দেখা গেল প্রতি কেজিতে পরিবহন খরচ ১০ পয়সা।
১০ পয়সা পরিবহন খরচ যেখানে, সেখানে কেজিপ্রতি চালের দাম বেড়েছে ১৫ থেকে ২০ টাকা। অন্যান্য ক্ষেত্রে দাম বাড়ানোর কথা নাই-বা বললাম। কারণ, চাল ও ডিমের দামই মধ্যবিত্তের বেঁচে থাকার সংকট তৈরি করার জন্য যথেষ্ট। নিরীহ মধ্যবিত্ত সুবোধ বালকের মতো সবাই এগুলো কিনছে প্রাণরক্ষার তাগিদে। প্রতিদিন টক শোতে, পত্রিকাতে নানাভাবে বিষয়গুলো নিয়ে তুমুলতর্কবিতর্ক হচ্ছে। সরকারপক্ষের লোকদের একটাই বক্তব্য, তা হলো জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে। অবশ্য ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এই দাম বাড়াকে এক মহোৎসব বলে চিহ্নিত করেছেন। এই মহোৎসব কারা করে? জাতির কাছে তা অত্যন্ত পরিষ্কার। ব্যবসায়ীশাসিত সংসদ সদস্য এবং মন্ত্রিসভা বিষয়টিকে সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে যায় এবং লুটেরা ব্যবসায়ী চক্র, যারা চুয়াত্তরে কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করেছিল, তারা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে জাগ্রত থাকে এবং সুযোগ পেলেই জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে একটা অসহনীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। এখন তার একটা চূড়ান্ত পর্যায় চলছে। এরা জানে, কখন মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে বাধ্য হবে এবং কখন উৎসব আসবে যখন তাদের জামাকাপড় কিনতেই হবে। এরা রমজান মাসের জন্য অপেক্ষা করে, ঈদ, পূজা, বড়দিনের জন্য অপেক্ষা করে এবং নিম্নমানের পণ্য দিয়ে উচ্চমূল্যের দাম আদায় করে। এবার করোনা মহামারিতে ব্যবসা করেছে।
এসব ব্যবসায়ীর থাবা এত বড় যে করোনা যেতে না যেতেই তারা খুঁজে পেয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। সরকারের আমলাদের একটা অংশকে প্রভাবিত করে অকারণে তেলের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। সরকারের মুখপাত্রই বলছে তেলের দাম বাড়িয়ে দেওয়াতে তাদের লিটারপ্রতি ২৫ টাকা মুনাফা হয়েছে। সরকারের মুনাফা সরকারের ঘরেই চলে যাচ্ছে। কিন্তু সুবিধা যেটা হচ্ছে তা হলো অন্যান্য পণ্যের দাম ও পরিবহনের ভাড়া বাড়িয়ে দেওয়া হলো। ব্যবসায়ীরা ঐতিহাসিকভাবে এত নির্দয় যে ১৯৪৩ সালে দুর্ভিক্ষের সময় মজুতদারি করে, লবণসংকট সৃষ্টি করে মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিল। কলকাতা শহরে ওই সময়ে লঙ্গরখানা করে মানুষকে বাঁচানোর চেষ্টা করা হয়েছে। তারও আগে ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সময় এই ঢাকা শহরে হাজার হাজার লোক অনাহারে মৃত্যুবরণ করেছে। ইতিহাস প্রমাণ করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বলগাহীন লোভের কারণে এই দুর্ভিক্ষটি সংঘটিত হয়। এর আগে পুরো ভারতবর্ষে মজুতদারি, পাচার—এসবের কোনো অস্তিত্ব ছিল না।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ব্যবসায়ীরা যেন একটা সোনার খনি আবিষ্কার করলেন। মজুতদারি, কালোবাজারি এবং সীমান্তের ওপার থেকে চোরাচালানি করে এখানে পণ্যদ্রব্য বিক্রি করে লাখ লাখ কোটি টাকা মুনাফা করে। আবার বাংলাদেশ থেকে মূল্যবান দ্রব্যাদি চোরাচালানের মাধ্যমে ভারতে চলে যায়। এই সময়ে টাকার মান ভারতীয় রুপির তুলনায় অবিশ্বাস্য রকম নিচে নেমে যায়। বাংলাদেশের প্রথম সরকার এই পরিস্থিতিতে হিমশিম খেতে থাকে। কিন্তু ব্যবসায়ীদের হৃদয় একটুও কাঁপে না। ব্যবসায়ীরা প্রথম আঘাত হানে শিশুখাদ্যের ওপর। আমদানি করা দুধ বাজার থেকে প্রায় গায়েব হয়ে যায়। সরকার টিসিবির মাধ্যমে এই শিশুখাদ্য বাজারে ছাড়ে। মায়েরা তখন লাইন দিয়ে শিশুখাদ্য কেনার চেষ্টা করে। সেখানেও অসাধু ব্যবসায়ীরা টিসিবির মালামাল অন্য পথ দিয়ে সরিয়ে নেয়। সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে রেশনপ্রথা চালু করে। একদিন কারফিউ দিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে রেশন কার্ড বিতরণ করা হয়। রেশন পাওয়াতে মানুষের মধ্যে কিছুটা স্বস্তি ফিরে আসে। এ রকম হয়েছিল ১৯৫৭ সালে, দ্রব্যমূল্য মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারি হওয়ার পর নানা ধরনের শাস্তি পেয়ে ব্যবসায়ীরা কিছুটা শৃঙ্খলার মধ্যে এসেছিল।
যেকোনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ব্যবসায়ীদের লোভ লাগামহীন হয়ে পড়ে। ঘণ্টায় ঘণ্টায় তারা পণ্যের দাম বাড়ায় এবং ক্রেতা-বিক্রেতার ধৈর্যের পরীক্ষা করে। দেশের ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো যতই শক্তিশালী হতে থাকে, ততই ব্যবসায়ীদের লোভ বাড়তে থাকে। এমন একটি পরিস্থিতি যেখানে সরকার, জনগণ একটা শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে, সেখানে ব্যবসায়ীদের সংগঠনের কোনো বিবৃতি বা হুঁশিয়ারি দেখা যায় না। সেখানে আছে একটা ভোটের ব্যাপার। তারা যেকোনো ছোট সংগঠনকে বিন্দুমাত্র চটাতে চায় না। কারণ, ভোটের বিষয় আছে। দেশের বাণিজ্যমন্ত্রী একজন ব্যবসায়ী। মন্ত্রিত্ব না থাকলে তাঁর এই ব্যবসায়ীদের সঙ্গেই জীবনযাপন করতে হবে। তাই তিনি হয়তো ক্ষণিকের মন্ত্রিত্বের জন্য চিরদিনের বন্ধুদের সঙ্গে সংকট সৃষ্টি করতে চান না। তিনি সব সময়ই শ্যাম রাখি না কুল রাখি, এই ধরনের বিবৃতি দিয়ে যাচ্ছেন। ভোক্তা-অধিকার অধিদপ্তর মাঝেমধ্যে ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে কিছু ঘটনা ঘটায় এবং প্রয়োজন ও ব্যাপকতার তুলনায় তা এতই কম যে বিষয়টি হয়তো টেলিভিশনের পর্দায় তাৎক্ষণিক একটা উত্তেজনার সৃষ্টি করে। কিন্তু পরিশেষে তা হাস্যকর হয়ে দাঁড়ায়।
এই ব্যবসায়ীরা এতই ক্ষমতাবান যে তাঁরা বাংলাদেশের দৃশ্যপট পাল্টে দিয়েছেন। যেখানে তাকানো হয় সেখানেই দোকান। শহরে যেকোনো বাড়ির গ্যারেজে দোকান, রাস্তায় দোকান। গুলিস্তানের পাশে যানবাহন চলাচলের একটা পথ ছিল। সেটাও বন্ধ হয়ে এখন সেখানে নানা ধরনের দোকানপাট গড়ে উঠেছে। সদরঘাটে তো দোকানের জন্য লঞ্চঘাটেই যাওয়া যায় না। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ ও তার আশপাশের জায়গাকে একটা দোকানের আবর্জনা বলা যায়।
শুধু ঢাকাতেই নয়, ঢাকার বাইরেও ছোট ছোট শহরে ছোটবড় এত সব সুপার মার্কেট যে বাংলাদেশের নান্দনিক সৌন্দর্য একেবারেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশের যত ভোক্তা তার চেয়ে সম্ভবত দোকানের সংখ্যা বেশি। ভোক্তাদের মধ্যে একটা অংশ আছে, যাদের আয় প্রবল এবং আয়ের উৎস দুর্নীতি, কালোবাজারি ও মজুতদারি। প্রয়োজন থাক বা না থাক তারা কিনতেই অভ্যস্ত। এমন অনেক বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় পাঁচ-দশ বছরের কেনা পণ্য অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। প্রতিদিন খবরের কাগজে এসব ঠিকাদার, ব্যবসায়ী, আমলা ও রাজনীতিবিদের প্রতিবেদনও ছাপা হচ্ছে। তাতে কেউ দমছে না বরং নানাভাবে অনুপ্রাণিত হচ্ছে। আমাদের একটি দুর্নীতি দমন কমিশন আছে, তারা হয়তো বলবে, ‘প্রয়োজনের তুলনায় আমাদের সীমাবদ্ধতা অনেক’। আর একবার মামলা হলে অপরাধীরা দীর্ঘদিন সুযোগ পেয়ে যায় দেনদরবার ও আইনের মারপ্যাঁচে, এই প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা বলে কিছু থাকে না। তারপরও বাংলাদেশে সবাই সবাইকে চেনে, চেনাজানা ছাড়াও টাকার শক্তি সবচেয়ে বড় শক্তি। দুর্নীতি করে কোটি কোটি টাকা উপার্জন করে সেখানে দু-চার কোটি খরচ করলে অসুবিধা কী?
সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক ব্যবসায়ীদের মধ্যে মানবিকবোধ জাগ্রত করার কথা বলেছেন। যেটি এক অসম্ভব কল্পনা! সেটা সম্ভব একমাত্র এই ব্যবসায়ীদের কঠোর শাস্তি দিয়ে। আর সম্ভব ক্রেতারা যদি একটু ত্যাগ স্বীকার করেন। তাঁরা যদি বলেন ৫৩ টাকা হালি করে এক সপ্তাহ ডিম খাবেন না, ৩০০ টাকা কেজিতে কাঁচা মরিচ খাবেন না, এত দাম দিয়ে কোনো জিনিসই ক্রয় করবেন না, তাহলে ডিম পচে যাবে, কাঁচা মরিচ পচে যাবে, চালে পোকা দেখা দেবে। এবং অসহায় ব্যবসায়ীদের মাছি মারতে দেখা যাবে। বিপণিবিতানগুলোতে কিছুদিনের জন্য একটা বিরতি দিতে পারলে হয়তো এর কিছুটা সুরাহা হতে পারে। কিন্তু তাতেও কি লুটেরাদের বাজার করা বন্ধ হবে?
শেখ হাসিনার পতিত স্বৈরাচারী সরকার সাড়ে ১৫ বছর ধরে এ দেশের জনগণের মাথাপিছু জিডিপি প্রশংসনীয় গতিতে বাড়ার গল্প সাজিয়ে শাসন করেছে। মাথাপিছু জিডিপি প্রকৃতপক্ষে একটি মারাত্মক ত্রুটিপূর্ণ কনসেপ্ট। এটার সবচেয়ে মারাত্মক সীমাবদ্ধতা হলো, এটা একটা গড়, যেটা স্বল্পসংখ্যক ধনী এবং বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্ন-মধ্যবিত্ত
১৪ ঘণ্টা আগেআমাদের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস পৃথিবীকে জলবায়ু-বিপর্যয় থেকে রক্ষার জন্য ‘শূন্য বর্জ্য ও শূন্য কার্বন’-এর ওপর ভিত্তি করে একটি নতুন জীবনধারা গড়ে তোলা প্রয়োজন বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন।
১৪ ঘণ্টা আগেআমেরিকার ১৩২ বছরের পুরোনো রেকর্ড ভেঙে একবার হেরে যাওয়ার পর দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রথম মেয়াদে ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ট্রাম্প।
১৪ ঘণ্টা আগেজগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বড্ড কষ্ট বুকে নিয়েই ‘সব শালারা বাটপার’ স্লোগানটি দিয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরেই তাঁরা দ্বিতীয় ক্যাম্পাস পাচ্ছেন না। ঠিকাদারেরা ভেলকিবাজি করছেন।ক্যাম্পাসের জন্য জমিও অধিগ্রহণ করা হয়নি।
১৪ ঘণ্টা আগে