বোকাদের দল

রুমা মোদক
প্রকাশ : ০৫ আগস্ট ২০২১, ০৯: ৩০

দীর্ঘদিন আমাদের থিয়েটার দল জীবন সংকেতের কোনো কার্যালয় ছিল না, কোনো নির্দিষ্ট স্থান ছিল না রিহার্সাল করার মতো। তখন ‘স্ত্রীর পত্র’-এর রিহার্সাল হচ্ছে আমার বাসার লিভিংরুমে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্পকে নাট্যরূপ দেওয়ার খাতিরে বেশ বদমেজাজি এক বরের চরিত্র তৈরি করতে হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের ফ্লেভার অক্ষুণ্ণ রেখে যতটা চেষ্টা করা যায়, করেছি। রিহার্সাল দেখে কাব্য পদ্য কাঁদো কাঁদো চোখে ভেতরের ঘরে এসে আমাকে বলে, ‘মা, তারেক মামা বনি আন্টির সঙ্গে প্রতিদিন ঝগড়া করে কেন?’ আমি হেসেই সারা। বনি তখন ‘স্ত্রীর পত্র’ নাটকে মৃণালের চরিত্র করত।

অসাধারণ নাট্যকর্মী ছিল তারেক। অসাধারণ গানের গলা। কত দিন মঞ্চে ওঠার আগমুহূর্তে ওকে আমি শুরুর ভণিতা লিখে দিয়েছি, ও একবার চোখ বুলিয়ে নির্ভুল দেহের ভাষাসহযোগে মঞ্চে উপস্থাপন করেছে। এমন অসাধারণ পারফর্মার দলের সম্পদ।

তারেক ছিল, হ্যাঁ ও এখন অতীত। ছয় বছর আগে মাত্র ৩০ বছর বয়সে পরপারে পাড়ি জমানো তারেকের অভাব আমাদের দলে পূরণ হয়নি এখনো, হবেও না কোনো দিন।

সংসদে চলচ্চিত্র কল্যাণ বিল ২০২১ পাস হলো যেদিন, আমার খুব তারেককে মনে পড়ছিল। শেষের দিকে তারেক আমাদের কাছে খুব অসহনীয় হয়ে উঠেছিল। প্রায়ই ফোন করে টাকা চাইত—দিদি, দেন না ১০০ টাকা, দিদি ২০০টা টাকা। খুব বড় অঙ্কের চাহিদা ছিল না তার। কী মেধাবী অভিনেতা তারেক, বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী। ওর কোনো পেশা ছিল না। একটা চাকরি খুঁজছিল হন্যে হয়ে।

ইরাজের ওপর আমি খুব নির্ভর করি, আমার টুকটাক লেখা ও টাইপ করে দেয়। একটাও বানান ভুল করে না। ওর টাইপে প্রুফ না দেখলেও চলে। প্রাইম ইউনিভার্সিটি থেকে এলএলবি করেছিল। একদিন এক চিঠিতে ডিগ্রি বাতিল হয়ে গেল। শিক্ষিত, দক্ষ ছেলেটা বেকার ঘুরে বেড়ায়। এখানে-ওখানে বসে টাইপ করে দু-চার শ টাকা রোজগার করে অনিয়মিত। 

আমাদের থিয়েটার দলের অতিনির্ভরশীল কর্মী সে। কি অভিনয়, কি সেট ডিজাইন, কি মালামাল টানাটানি! ইভান বা অনীকের কথাই বাদ থাকে কেন? দিনভর দোকানে দোকানে পণ্যসামগ্রী পৌঁছে দিয়ে রিহার্সালে আসে ক্লান্ত, শ্রান্ত, ঘেমে, নেয়ে। মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক হয়ে যায়। কী রে, কী হলো? দিদি, টেনশনে আছি, এ মাসে যদি টার্গেট না হয়!

আমাদের মঞ্চের এই কুশীলবেরা, আলোর নিচে বীর মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি কিংবা তুখোড় রাজনীতিবিদ, বাউল কিংবা প্রতিবাদে ফেটে পড়া যুবক। বাস্তব জীবনযুদ্ধে তারা বড় অসহায় আর নিরুপায়।

তাদের জন্য কেউ কোথাও নেই। হাইকোর্টে থেমিসের মূর্তি অপসারণ হবে, প্রতিবাদে ব্যানার নিয়ে এই থিয়েটারের ছেলেগুলো সবার সামনে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সুনিশ্চিত করার দাবিতে থিয়েটারের কর্মীরা সম্মুখ সারিতে। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে পথনাটক করে জীবন বিপন্ন করে থিয়েটারের ছেলেরা।

রাজনৈতিক নেতারা পাজেরো গাড়ি দৌড়ায় আর মঞ্চের ছেলেরা ঘর্মাক্ত ক্লান্তি নিয়ে মঞ্চে ফিরে যায়। আমি সারা দেশে শত শত মঞ্চকর্মী দেখে ভাবি, এরা কিসের নেশায় মঞ্চ আঁকড়ে পড়ে থাকে? কী পায় তারা মঞ্চ থেকে? কিছু পাবে কোনো দিন—এমন হাতছানিও থাকে না কোথাও।

তবু এরা মঞ্চে থাকে, মঞ্চকে রাজপথে নিয়ে যায়, রাজপথকে নিয়ে যায় মঞ্চে। রাজনীতিবিদদের বাইরে মঞ্চকর্মীদের মতো এমন সামাজিক দায়বদ্ধতা আমি শিল্পের কোনো শাখায় আর দেখিনি, দেখি না।

এদের কল্যাণ নিয়ে, বেঁচেবর্তে থাকা নিয়ে সমাজের কারও কোনো চিন্তাও দেখি না। শিল্পের অঙ্গনে এরা এক ভাগ্যহত গোষ্ঠী। আখের গোছানোর দৌড়ে শামিল হতে না পারা বোকার দল। এদের কথা ভাবা দূরে থাক, স্বীকার করার মতো কেউ কোথাও নেই এই দেশে। অথচ বছরের পর বছর এরা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়েই যাচ্ছে...তাড়িয়েই যাচ্ছে...। 

লেখক: সাহিত্যিক

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত