জাহীদ রেজা নূর
কয়েকটি বিষয়ে মনে হয়, খোলামেলা আলোচনা হওয়া ভালো। যদিও আবেগের তুঙ্গে থাকা অবস্থায় বাস্তবতাবোধ বিভ্রান্ত হয়, তবু সত্যের সঙ্গে থাকতে হলে ইতিহাসের নির্মোহ বয়ানের কাছে বিশ্বস্ত থাকতেই হবে।
মুক্তিযুদ্ধোত্তর দেশটা এগোনোর পথে সাধারণ কিছু বিষয় নিয়ে ইতিহাসে যে ঘোঁট পাকানো হয়েছে, তা থেকে বেরিয়ে আসা জরুরি। সেটা গবেষণাসাপেক্ষ। এখানে কিছু বিষয় তুলে ধরব, যা মূলত ভবিষ্যৎ গবেষণার দুয়ার খুলে দিতে পারে। বলে রাখা ভালো, এর বাইরে আরও অনেক বিষয় আছে, যার নির্মোহ বয়ান আগামী প্রজন্মের জন্য খুবই প্রয়োজনীয় হয়ে উঠবে।
দুই. একটা অদ্ভুত প্রবণতার সৃষ্টি হয়েছে দেশে, যদি কোনো কথা কারও স্বার্থে আঘাত করে, তাহলে শুরুতেই ‘একাত্তরে কোথায় ছিলি’ ধরনের প্রশ্ন করে তাকে থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়; কিংবা অনায়াসে বলে দেওয়া হয়, ‘তুই রাজাকার।’‘রাজাকার’ বা ‘আলবদর’ শব্দগুলো যে এতটা হেলাফেলা করে উচ্চারণ করতে হয় না, সে অনুভবশক্তিও এই মানুষদের নেই। যাকে-তাকে ‘রাজাকার’ বলা হলে সত্যিকারের রাজাকারদের অপরাধের গুরুত্ব লঘু হয়ে যায়। ১৯৭১ সালে এই রাজাকার আর আলবদররা কিন্তু ত্রাসের রাজত্ব চালিয়েছিল এই ভূখণ্ডের মানুষের ওপরই। এখানকার গ্রামগঞ্জ জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিয়েছে, এখানকার মানুষকেই হত্যা করেছে। ৯ মাস মূলত এখানকার মানুষই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আর রাজাকার, আলবদর, শান্তি কমিটির অত্যাচার সহ্য করেছে।
এখন কেউ যদি মনে করে, তাঁরা তো যুদ্ধের সময় ভারতে যাননি, তাহলে তাঁদের কথা ভাবতে হবে কেন? মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে হলে তো তাঁরা সবাই সীমানা পেরিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতেন! তাহলে বুঝতে হবে, ১৯৭১ সালের রাজনৈতিক পটভূমি সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা তাদের নেই। এদের ভাবখানা এমন, যেন কোনো দেশে যুদ্ধ হলে বোধ হয় দেশের সব মানুষ ‘মহানন্দে’ ভিন্ন দেশে শরণার্থী হয়ে পাড়ি জমায়। নিজ দেশে পরবাসী হয়ে বসবাস করা এই মানুষদের দীর্ঘশ্বাসে যেন মুক্তিযুদ্ধের স্পিরিট নেই! যারা এই অপবাদ দেয়, তাদের কেউ বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সময়ে চলা যুদ্ধগুলোর বিশ্লেষণ করে দেখেনি। দেখেনি যে যতক্ষণ পর্যন্ত আক্রান্ত না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত মানুষ নিজ দেশের মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকতেই পছন্দ করে।
তিন. এখন কেউ যদি মনে করে, উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়াটাই মুক্তিযুদ্ধের সেরা সার্থকতা, তাহলে সে আহাম্মকের স্বর্গে বাস করছে। যে নব্বই লাখ শরণার্থী একান্ত নিরুপায় হয়ে নিজ ভিটেমাটি ছেড়ে ভারতে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন, তাঁরা জানেন, শরণার্থী জীবন কতটা ভয়ংকর হতে পারে। শরণার্থী জীবন তাঁদের কাঙ্ক্ষিত জীবন ছিল না। কিন্তু সে জীবনটাই যাপন করতে হয়েছে তাঁদের। শরণার্থীশিবিরে মানুষের সেই দুঃসহ জীবনযাপনের চিত্র দেখতে পাবেন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তৈরি হওয়া তথ্যচিত্রগুলোয়।
শরণার্থীরা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেননি, কিন্তু যুদ্ধের প্রতিটি আঘাত তাঁরা সহ্য করেছেন। এখন কেউ যদি বলে, তাঁরা তো শরণার্থী হয়ে ভারতে পালিয়েছেন, তাঁদের আর কী অবদান আছে, তাহলে সেটা হবে ইতিহাসের প্রতি জঘন্য অন্যায়। এই মানুষেরা কেউ স্বেচ্ছায় দেশ ছাড়েননি। দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সতীর্থদের অত্যাচারই ছিল তাঁদের দেশত্যাগের মূল কারণ। বেদনাদায়ক যে সময়টা তাঁরা কাটিয়েছেন, তা তাঁদের জীবনের স্বাভাবিক গতিপথকেই পাল্টে দিয়েছে।
এ ছাড়া যাঁরা সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে, ক্রীড়ার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন, কিংবা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তৈরি হাসপাতালে যাঁরা কাজ করেছেন, তাঁরা কারা? আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের পক্ষে যাঁরা কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়েছেন, তাঁরাই-বা কারা?
যুদ্ধটা যে অস্ত্র হাতে সামনাসামনি যুদ্ধের পাশাপাশি আরও বহু জায়গায় একই সঙ্গে চলেছে, সে সত্য অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।
চার. অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন মূলত তরুণ–যুবকেরা। প্রৌঢ়রাও ছিলেন। ১১টি সেক্টরে বিভক্ত রণক্ষেত্রে সামরিক-আধা সামরিক বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছেন সেই সব তরুণ-যুবক, যাঁরা আগে কোনো দিন অস্ত্র হাতে নেননি। বিজয় নিশান আর মুক্ত স্বদেশের প্রতি বিশ্বস্ততাই তাঁদের ডেকে এনেছিল এই মৃত্যুর উৎসবে।
‘নাইন মান্থস টু ফ্রিডম’ তথ্যচিত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ক্যাম্প থেকে যখন ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি ভেসে আসছিল, তখন বোঝা যাচ্ছিল, কী অসীম প্রত্যয় নিয়ে এই মানুষেরা শত্রুর মোকাবিলা করেছেন।
যুদ্ধশেষে তাঁদের বেশির ভাগই অস্ত্র জমা দিয়ে ফিরে গিয়েছিলেন নিজ কাজে। তাঁদের বেশির ভাগই কোনো ধরনের সরকারি স্বীকৃতির জন্য হন্যে হয়ে পড়ে থাকেননি। তাঁদের অনেকেরই জীবন স্বপ্নের মতো হয়নি, আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়েছেন অনেকে।
মাঝে মাঝেই মুক্তিযোদ্ধাদের যে অমানবিক অবস্থায় জীবনযাপন করার খবর বের হয় পত্রিকায়, তাতে আমরা মর্মাহত হই। কিন্তু আদতে তাঁদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সুফল বয়ে নিয়ে যাওয়া যায়নি।
মুক্তিযোদ্ধা ও জাল মুক্তিযোদ্ধার প্রশ্নটিও এখন পর্যন্ত মীমাংসিত হয়নি। এই সরকারের আমলে স্বীকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতার পরিমাণ বেড়েছে, এটা বড় সুসংবাদ; কিন্তু আদতেই সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধারা এর সুফল পেলেন কি না, তা নিয়ে এখনো নির্ভরযোগ্য তথ্য অন্তত আমার কাছে নেই।
আমাদের এই গণযুদ্ধটাকে শুধু সামরিক যুদ্ধ বলে চালিয়ে দেওয়ার প্রবণতাও দেখা যায়। খেতাবের প্রায় সবই পেয়েছেন সেই সামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই। মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে পরবর্তীকালে যেসব বইপত্র বের হয়েছে, তাতে অসীম সাহসী বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধাদের ফ্রন্টলাইনের অভিজ্ঞতার রোমহর্ষক বিবরণ পাই; তাতে মনে হয়, খেতাব দেওয়ার ব্যাপারটা আরও একটু বিস্তৃত হতে পারত। বেশিসংখ্যক বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধার নামও এখানে থাকতে পারত।
পাঁচ. যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস এ দেশে থেকেই কাজ করেছেন, সরকারি বা বেসরকারি কাজ? তাঁদেরও অনায়াসে রাজাকার আখ্যা দেওয়া হবে? যাঁরা এ রকম হইহই-রইরই পছন্দ করেন, তাঁদের পড়ে দেখতে বলব, আবু জাফর শামসুদ্দীন আর সরদার ফজলুল করিমের লেখা। মুক্তিযুদ্ধ কোনো এক স্তরের ঘটনা ছিল না। এর প্রতিটি পরতই গুরুত্বপূর্ণ। রাজাকার, আলবদর তথা পাকিস্তানপন্থীরা ছাড়া আর সবাই ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, যদি এই সত্যকে বাস্তব ধরে এগোই, তাহলে এই প্রগলভতা থাকবে না। তখন নানা পরতের যুদ্ধটা উঠে আসবে।
অবরুদ্ধ নগরী থেকে যাঁরা সঙ্গোপনে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতা কিংবা তাদের এ দেশীয় তাঁবেদারদের খবর পৌঁছে দিয়েছেন ওপারে বাংলাদেশ সরকারের কাছে, তাঁরা কি মুক্তিযোদ্ধা নন?
এ দেশে পাকিস্তানপন্থীদের দাপটের মধ্যে বসবাস করেও যে অসম সাহস তাঁরা দেখিয়েছেন, তার মূল্যায়ন কতটা হয়েছে?
শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের লেখা একটি স্লিপ তুলে দিচ্ছি, যেটা তিনি ওপারে পাঠানোর জন্য দিয়েছিলেন একজন মেসেঞ্জারকে। স্লিপে লেখা ছিল: ইমানের বরকতে
১. মন্ত্রী আবুল কাশেম–ঢাকেশ্বরী বস্ত্রালয়ের মালিক, বর্তমান নাম কাশেম টেক্সটাইল মিলস।
২. মাওলানা আমিনুল ইসলাম–সদরঘাটের বিখ্যাত ব্রাহ্মসমাজ লাইব্রেরি ও যাবতীয় সম্পত্তির মালিক। এপ্রিলের প্রথমভাগে লাইব্রেরি লুট করিয়ে ১০ টাকা মণ দরে বই বিক্রি করেন। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকাও ওই একই দরে বিক্রি হয়। বর্তমানে নিজ নামে এলট করিয়ে দখলদার।
৩. মাওলানা আবদুল মান্নান–মদন মোহন বসাক মন্দির ভবনের বর্তমান মালিক। এখানে সংক্ষেপে যা লেখা হয়েছে, তাতে অস্পষ্ট কিছু নেই। এভাবে পাকিস্তানিদের দোসর হয়ে এ দেশে কারা কী ঘটাচ্ছে, সে খবর কলকাতায় অবস্থিত বাংলাদেশ সরকারের কাছে পৌঁছে যেত।
ছয়. নিজ স্বার্থে দেশের ইতিহাসকে বিকৃতভাবে তৈরি না করে ইতিহাসের নির্মোহ বয়ান নির্মাণ করলেই তা টিকে থাকবে। ছেষট্টির ৬ দফা আন্দোলনের কিছুদিন আগে থেকে পাকিস্তানের জাতীয় রাজনীতিতে যে পরিবর্তন এসেছিল, শেখ মুজিবুর রহমান যখন সবাইকে ছাড়িয়ে পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র নির্ভরযোগ্য নেতা হয়ে উঠছিলেন, তরুণ নেতৃত্বের প্রতি আস্থা এনেছিলেন, ইত্তেফাক ও ছাত্রলীগ সে সময় যে ভূমিকা পালন করেছিল, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার মধ্যে যে বন্ধন সৃষ্টি হয়েছিল, ‘ভোটের আগে ভাত চাই’ স্লোগান তুলে যারা গণতান্ত্রিক পদযাত্রা ভন্ডুল করতে চেয়েছিল এবং সত্তরের নির্বাচনে বিজয়ের পর আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঠিক মূল্যায়ন না হলে ইতিহাস বিকৃত হতে থাকবে।
নতুন নতুন মোড়লেরা এসে কৃতিত্বের দাবিদার হবে। ৯০ শতাংশ সত্যের সঙ্গে ১০ শতাংশ মিথ্যে মিশিয়ে দিয়ে এরা ইতিহাসকে কলঙ্কিত করতেই থাকবে। এ কারণেই নির্মোহ ইতিহাস তুলে আনা দরকার।
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
কয়েকটি বিষয়ে মনে হয়, খোলামেলা আলোচনা হওয়া ভালো। যদিও আবেগের তুঙ্গে থাকা অবস্থায় বাস্তবতাবোধ বিভ্রান্ত হয়, তবু সত্যের সঙ্গে থাকতে হলে ইতিহাসের নির্মোহ বয়ানের কাছে বিশ্বস্ত থাকতেই হবে।
মুক্তিযুদ্ধোত্তর দেশটা এগোনোর পথে সাধারণ কিছু বিষয় নিয়ে ইতিহাসে যে ঘোঁট পাকানো হয়েছে, তা থেকে বেরিয়ে আসা জরুরি। সেটা গবেষণাসাপেক্ষ। এখানে কিছু বিষয় তুলে ধরব, যা মূলত ভবিষ্যৎ গবেষণার দুয়ার খুলে দিতে পারে। বলে রাখা ভালো, এর বাইরে আরও অনেক বিষয় আছে, যার নির্মোহ বয়ান আগামী প্রজন্মের জন্য খুবই প্রয়োজনীয় হয়ে উঠবে।
দুই. একটা অদ্ভুত প্রবণতার সৃষ্টি হয়েছে দেশে, যদি কোনো কথা কারও স্বার্থে আঘাত করে, তাহলে শুরুতেই ‘একাত্তরে কোথায় ছিলি’ ধরনের প্রশ্ন করে তাকে থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়; কিংবা অনায়াসে বলে দেওয়া হয়, ‘তুই রাজাকার।’‘রাজাকার’ বা ‘আলবদর’ শব্দগুলো যে এতটা হেলাফেলা করে উচ্চারণ করতে হয় না, সে অনুভবশক্তিও এই মানুষদের নেই। যাকে-তাকে ‘রাজাকার’ বলা হলে সত্যিকারের রাজাকারদের অপরাধের গুরুত্ব লঘু হয়ে যায়। ১৯৭১ সালে এই রাজাকার আর আলবদররা কিন্তু ত্রাসের রাজত্ব চালিয়েছিল এই ভূখণ্ডের মানুষের ওপরই। এখানকার গ্রামগঞ্জ জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিয়েছে, এখানকার মানুষকেই হত্যা করেছে। ৯ মাস মূলত এখানকার মানুষই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আর রাজাকার, আলবদর, শান্তি কমিটির অত্যাচার সহ্য করেছে।
এখন কেউ যদি মনে করে, তাঁরা তো যুদ্ধের সময় ভারতে যাননি, তাহলে তাঁদের কথা ভাবতে হবে কেন? মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে হলে তো তাঁরা সবাই সীমানা পেরিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতেন! তাহলে বুঝতে হবে, ১৯৭১ সালের রাজনৈতিক পটভূমি সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা তাদের নেই। এদের ভাবখানা এমন, যেন কোনো দেশে যুদ্ধ হলে বোধ হয় দেশের সব মানুষ ‘মহানন্দে’ ভিন্ন দেশে শরণার্থী হয়ে পাড়ি জমায়। নিজ দেশে পরবাসী হয়ে বসবাস করা এই মানুষদের দীর্ঘশ্বাসে যেন মুক্তিযুদ্ধের স্পিরিট নেই! যারা এই অপবাদ দেয়, তাদের কেউ বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সময়ে চলা যুদ্ধগুলোর বিশ্লেষণ করে দেখেনি। দেখেনি যে যতক্ষণ পর্যন্ত আক্রান্ত না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত মানুষ নিজ দেশের মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকতেই পছন্দ করে।
তিন. এখন কেউ যদি মনে করে, উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়াটাই মুক্তিযুদ্ধের সেরা সার্থকতা, তাহলে সে আহাম্মকের স্বর্গে বাস করছে। যে নব্বই লাখ শরণার্থী একান্ত নিরুপায় হয়ে নিজ ভিটেমাটি ছেড়ে ভারতে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন, তাঁরা জানেন, শরণার্থী জীবন কতটা ভয়ংকর হতে পারে। শরণার্থী জীবন তাঁদের কাঙ্ক্ষিত জীবন ছিল না। কিন্তু সে জীবনটাই যাপন করতে হয়েছে তাঁদের। শরণার্থীশিবিরে মানুষের সেই দুঃসহ জীবনযাপনের চিত্র দেখতে পাবেন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তৈরি হওয়া তথ্যচিত্রগুলোয়।
শরণার্থীরা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেননি, কিন্তু যুদ্ধের প্রতিটি আঘাত তাঁরা সহ্য করেছেন। এখন কেউ যদি বলে, তাঁরা তো শরণার্থী হয়ে ভারতে পালিয়েছেন, তাঁদের আর কী অবদান আছে, তাহলে সেটা হবে ইতিহাসের প্রতি জঘন্য অন্যায়। এই মানুষেরা কেউ স্বেচ্ছায় দেশ ছাড়েননি। দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সতীর্থদের অত্যাচারই ছিল তাঁদের দেশত্যাগের মূল কারণ। বেদনাদায়ক যে সময়টা তাঁরা কাটিয়েছেন, তা তাঁদের জীবনের স্বাভাবিক গতিপথকেই পাল্টে দিয়েছে।
এ ছাড়া যাঁরা সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে, ক্রীড়ার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন, কিংবা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তৈরি হাসপাতালে যাঁরা কাজ করেছেন, তাঁরা কারা? আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের পক্ষে যাঁরা কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়েছেন, তাঁরাই-বা কারা?
যুদ্ধটা যে অস্ত্র হাতে সামনাসামনি যুদ্ধের পাশাপাশি আরও বহু জায়গায় একই সঙ্গে চলেছে, সে সত্য অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।
চার. অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন মূলত তরুণ–যুবকেরা। প্রৌঢ়রাও ছিলেন। ১১টি সেক্টরে বিভক্ত রণক্ষেত্রে সামরিক-আধা সামরিক বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছেন সেই সব তরুণ-যুবক, যাঁরা আগে কোনো দিন অস্ত্র হাতে নেননি। বিজয় নিশান আর মুক্ত স্বদেশের প্রতি বিশ্বস্ততাই তাঁদের ডেকে এনেছিল এই মৃত্যুর উৎসবে।
‘নাইন মান্থস টু ফ্রিডম’ তথ্যচিত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ক্যাম্প থেকে যখন ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি ভেসে আসছিল, তখন বোঝা যাচ্ছিল, কী অসীম প্রত্যয় নিয়ে এই মানুষেরা শত্রুর মোকাবিলা করেছেন।
যুদ্ধশেষে তাঁদের বেশির ভাগই অস্ত্র জমা দিয়ে ফিরে গিয়েছিলেন নিজ কাজে। তাঁদের বেশির ভাগই কোনো ধরনের সরকারি স্বীকৃতির জন্য হন্যে হয়ে পড়ে থাকেননি। তাঁদের অনেকেরই জীবন স্বপ্নের মতো হয়নি, আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়েছেন অনেকে।
মাঝে মাঝেই মুক্তিযোদ্ধাদের যে অমানবিক অবস্থায় জীবনযাপন করার খবর বের হয় পত্রিকায়, তাতে আমরা মর্মাহত হই। কিন্তু আদতে তাঁদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সুফল বয়ে নিয়ে যাওয়া যায়নি।
মুক্তিযোদ্ধা ও জাল মুক্তিযোদ্ধার প্রশ্নটিও এখন পর্যন্ত মীমাংসিত হয়নি। এই সরকারের আমলে স্বীকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতার পরিমাণ বেড়েছে, এটা বড় সুসংবাদ; কিন্তু আদতেই সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধারা এর সুফল পেলেন কি না, তা নিয়ে এখনো নির্ভরযোগ্য তথ্য অন্তত আমার কাছে নেই।
আমাদের এই গণযুদ্ধটাকে শুধু সামরিক যুদ্ধ বলে চালিয়ে দেওয়ার প্রবণতাও দেখা যায়। খেতাবের প্রায় সবই পেয়েছেন সেই সামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই। মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে পরবর্তীকালে যেসব বইপত্র বের হয়েছে, তাতে অসীম সাহসী বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধাদের ফ্রন্টলাইনের অভিজ্ঞতার রোমহর্ষক বিবরণ পাই; তাতে মনে হয়, খেতাব দেওয়ার ব্যাপারটা আরও একটু বিস্তৃত হতে পারত। বেশিসংখ্যক বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধার নামও এখানে থাকতে পারত।
পাঁচ. যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস এ দেশে থেকেই কাজ করেছেন, সরকারি বা বেসরকারি কাজ? তাঁদেরও অনায়াসে রাজাকার আখ্যা দেওয়া হবে? যাঁরা এ রকম হইহই-রইরই পছন্দ করেন, তাঁদের পড়ে দেখতে বলব, আবু জাফর শামসুদ্দীন আর সরদার ফজলুল করিমের লেখা। মুক্তিযুদ্ধ কোনো এক স্তরের ঘটনা ছিল না। এর প্রতিটি পরতই গুরুত্বপূর্ণ। রাজাকার, আলবদর তথা পাকিস্তানপন্থীরা ছাড়া আর সবাই ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, যদি এই সত্যকে বাস্তব ধরে এগোই, তাহলে এই প্রগলভতা থাকবে না। তখন নানা পরতের যুদ্ধটা উঠে আসবে।
অবরুদ্ধ নগরী থেকে যাঁরা সঙ্গোপনে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতা কিংবা তাদের এ দেশীয় তাঁবেদারদের খবর পৌঁছে দিয়েছেন ওপারে বাংলাদেশ সরকারের কাছে, তাঁরা কি মুক্তিযোদ্ধা নন?
এ দেশে পাকিস্তানপন্থীদের দাপটের মধ্যে বসবাস করেও যে অসম সাহস তাঁরা দেখিয়েছেন, তার মূল্যায়ন কতটা হয়েছে?
শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের লেখা একটি স্লিপ তুলে দিচ্ছি, যেটা তিনি ওপারে পাঠানোর জন্য দিয়েছিলেন একজন মেসেঞ্জারকে। স্লিপে লেখা ছিল: ইমানের বরকতে
১. মন্ত্রী আবুল কাশেম–ঢাকেশ্বরী বস্ত্রালয়ের মালিক, বর্তমান নাম কাশেম টেক্সটাইল মিলস।
২. মাওলানা আমিনুল ইসলাম–সদরঘাটের বিখ্যাত ব্রাহ্মসমাজ লাইব্রেরি ও যাবতীয় সম্পত্তির মালিক। এপ্রিলের প্রথমভাগে লাইব্রেরি লুট করিয়ে ১০ টাকা মণ দরে বই বিক্রি করেন। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকাও ওই একই দরে বিক্রি হয়। বর্তমানে নিজ নামে এলট করিয়ে দখলদার।
৩. মাওলানা আবদুল মান্নান–মদন মোহন বসাক মন্দির ভবনের বর্তমান মালিক। এখানে সংক্ষেপে যা লেখা হয়েছে, তাতে অস্পষ্ট কিছু নেই। এভাবে পাকিস্তানিদের দোসর হয়ে এ দেশে কারা কী ঘটাচ্ছে, সে খবর কলকাতায় অবস্থিত বাংলাদেশ সরকারের কাছে পৌঁছে যেত।
ছয়. নিজ স্বার্থে দেশের ইতিহাসকে বিকৃতভাবে তৈরি না করে ইতিহাসের নির্মোহ বয়ান নির্মাণ করলেই তা টিকে থাকবে। ছেষট্টির ৬ দফা আন্দোলনের কিছুদিন আগে থেকে পাকিস্তানের জাতীয় রাজনীতিতে যে পরিবর্তন এসেছিল, শেখ মুজিবুর রহমান যখন সবাইকে ছাড়িয়ে পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র নির্ভরযোগ্য নেতা হয়ে উঠছিলেন, তরুণ নেতৃত্বের প্রতি আস্থা এনেছিলেন, ইত্তেফাক ও ছাত্রলীগ সে সময় যে ভূমিকা পালন করেছিল, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার মধ্যে যে বন্ধন সৃষ্টি হয়েছিল, ‘ভোটের আগে ভাত চাই’ স্লোগান তুলে যারা গণতান্ত্রিক পদযাত্রা ভন্ডুল করতে চেয়েছিল এবং সত্তরের নির্বাচনে বিজয়ের পর আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঠিক মূল্যায়ন না হলে ইতিহাস বিকৃত হতে থাকবে।
নতুন নতুন মোড়লেরা এসে কৃতিত্বের দাবিদার হবে। ৯০ শতাংশ সত্যের সঙ্গে ১০ শতাংশ মিথ্যে মিশিয়ে দিয়ে এরা ইতিহাসকে কলঙ্কিত করতেই থাকবে। এ কারণেই নির্মোহ ইতিহাস তুলে আনা দরকার।
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
দলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
১ ঘণ্টা আগেশেখ হাসিনা সরকারের পতনের ১০০ দিন পার হয়ে গেছে। ১০০ দিনে অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কিছু যে হয়নি, তা নয়। তবে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে অস্থিরতার লক্ষণ অস্পষ্ট নয়। এর মধ্যেই তিন দফায় উপদেষ্টার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।
২ ঘণ্টা আগেবাংলা ভাষায় অতিপরিচিত একটি শব্দবন্ধ হলো ‘খোলনলচে’। যাপিত জীবনে কমবেশি আমরা সবাই শব্দবন্ধটি প্রয়োগ করেছি। বাংলা বাগধারায় আমরা পড়েছি ‘খোলনলচে পালটানো’। বাংলা অভিধানে খোল শব্দের একাধিক অর্থ রয়েছে।
২ ঘণ্টা আগেঅফিসে যাতায়াতের সময় স্টাফ বাসে পরিচয়ের সূত্রে ফারজানা আক্তার আজিমপুরে নিজের বাসায় সাবলেট দিয়েছিলেন ফাতেমা আক্তার শাপলা নামের এক নারীকে। কিন্তু ফাতেমা যে একটি প্রতারক চক্রের সদস্য, সেটা তাঁর জানা ছিল না।
২ ঘণ্টা আগে