বিভুরঞ্জন সরকার
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট এক ভয়ংকর বিকেল দেখেছে বাংলাদেশের মানুষ। সেদিন রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে ছিল আওয়ামী লীগের একটি সমাবেশ। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে একটি ট্রাকের ওপর স্থাপিত হয়েছিল বক্তৃতামঞ্চ। আওয়ামী লীগের সভাপতি ও তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত ছিলেন সেই মঞ্চে। যথারীতি হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে শুরু হয়েছিল সভার কাজ। সভা যখন প্রায় শেষের দিকে, পশ্চিম আকাশে সূর্য হেলে পড়লেও আঁধার নামেনি, শেখ হাসিনা বক্তৃতা করছিলেন, তখন আকস্মিকভাবে বিকট বিস্ফোরণের শব্দে চমকে ওঠেন সবাই।
সভাস্থলে গ্রেনেড ছুড়ে মারা হয়। লক্ষ্য অবশ্যই ছিলেন শেখ হাসিনা। তাঁকে হত্যা করে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার অসৎ উদ্দেশ্য নিয়েই ওই গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল। মোহাম্মদ হানিফ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তসহ আওয়ামী লীগের নেতারা মানববর্ম রচনা করে শেখ হাসিনার প্রাণ রক্ষা করেন। তবে নিহত হন ২৪ জন, যার মধ্যে ছিলেন আওয়ামী লীগের নেত্রী আইভি রহমান। তিন শতাধিক নেতা-কর্মী গুরুতর আহত হন। সেই ভয়ংকর বিকেলে বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে রচিত হয়েছিল এক কলঙ্কিত অধ্যায়। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে কলঙ্কিত ধারার সূচনা হয়েছিল, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট যেন সেই ধারারই আরেক প্রকাশ। হত্যার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতার পরিবর্তন কিংবা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নির্মূলের এই ধারা দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির সামনে খারাপ দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার সময় ক্ষমতায় ছিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। দেশে কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে প্রাথমিকভাবে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা সরকারের দায়িত্ব। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার মতো এত বড় অপরাধ যারা করেছিল, তাদের চিহ্নিত করা, গ্রেপ্তার ও আইনের হাতে সোপর্দ করার জরুরি কর্তব্যটি তৎকালীন সরকার সম্পাদনে কেবল চরমভাবে ব্যর্থতারই পরিচয় দেয়নি, বরং ঘটনাপ্রবাহ অন্য খাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টাই চালানো হয়েছে। অপরাধীরা যাতে নিরাপদে থাকতে পারে, কৌশলে সেই চেষ্টাই করা হয়েছে। নিরপরাধ
নিরীহ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে নিষ্ঠুর নির্যাতন চালানো হয়েছিল।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে দেশে হত্যা-খুনের যে রাজনীতি শুরু হয়, তার ধারাবাহিকতায়ই ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটেছে বলে মনে করা অসংগত নয়। ১৯৭৫ সালে বিএনপি নামক রাজনৈতিক দলটি ছিল না। তাই ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের দায় সরাসরি বিএনপির ওপর চাপানো যায় না। তবে ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ আওয়ামী লীগ করে থাকে। খুনিদের সঙ্গে জিয়াউর রহমানের ঘনিষ্ঠতা এবং পরস্পর নির্ভরতার বিষয়টি এককথায় নাকচও করা যায় না।
তবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পরপরই ক্ষমতা দখল করেছিলেন খোন্দকার মোশতাক আহমেদ। তিনি আওয়ামী লীগ করতেন বলে এটা বলা হয়ে থাকে যে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে তাঁর দলের লোকেরাই। মোশতাকের মন্ত্রিসভায় বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার ছয়জন বাদে আর সব সদস্যই যোগ দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার দায় থেকে আওয়ামী লীগকে একেবারে মুক্তি দেওয়া যায় না। আওয়ামী লীগের কেউ কেউ জেনেবুঝে ঘাতকদের সহযোগী হয়েছে, কেউ আবার পরিস্থিতির আকস্মিকতায় হতবিহ্বল ও ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পক্ষ বদল করেছে।
তারপর জিয়াউর রহমান ক্ষমতার কেন্দ্রে বসে বঙ্গবন্ধুর নাম ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা এবং আওয়ামী লীগকে ক্ষমতার বাইরে রাখার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়েই চলেছেন। তাই বলা যায়, হত্যার রাজনীতির পথ ধরেই জিয়ার উত্থান। দুঃখজনক যে, জিয়ার হাতে গড়া দল বিএনপিও হত্যা-খুনের রাজনীতির ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনা তার বড় প্রমাণ। ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের মতো একটি বড় রাজনৈতিক দলের সমাবেশে নিরাপত্তা দিতে সরকার শুধু ব্যর্থই হয়নি, ঘটনা-পরবর্তী সময়ে আক্রমণকারীদের রক্ষা করার সব ধরনের চেষ্টা সরকারের পক্ষ থেকে করা হয়েছিল।
২২ আগস্ট বিচারপতি জয়নুল আবেদীনকে চেয়ারম্যান করে এক সদস্যের বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছিল, যে কমিশনের উদ্দেশ্যই ছিল সম্ভবত পুরো বিষয়টিকে ধামাচাপা দেওয়া অথবা মানুষের নজর অন্যদিকে ফেরানো। এক মাস দশ দিন পর বিচারপতি জয়নুল আবেদীন ১৬২ পৃষ্ঠার এক প্রতিবেদন জমা দেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার পেছনে একটি শক্তশালী বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত ছিল। যদিও বিদেশি সেই শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থার নাম বলা হয়নি।
বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের তদন্ত প্রতিবেদনটি এমন ছিল যে বিএনপি সরকারও এই প্রতিবেদনের বক্তব্যের সঙ্গে একমত হতে না পেরে এ নিয়ে পরে আর তেমন উচ্চবাচ্য করেনি। তবে বিএনপি সরকার আত্মরক্ষার বর্ম খুঁজতে গিয়ে হাস্যকর সব পদক্ষেপ নিয়ে এটা স্পষ্ট করেছে যে গ্রেনেড হামলার রহস্য উন্মোচনে তারা আগ্রহী ছিল না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও তদন্ত সংস্থাগুলোকে প্রভাবিত করে কালক্ষেপণের নীতি নেওয়া হয়। ২০০৫ সালের ৯ জুন নোয়াখালীর সেনবাগ থেকে জজ মিয়া নামক এক ছিঁচকে অপরাধীকে ধরে তাঁর কাছ থেকে গ্রেনেড হামলার বিষয়ে স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়। পরে জানা যায়, এটা ছিল পুলিশের সাজানো নাটক।
অন্যদিকে বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা বলতে থাকেন যে আওয়ামী লীগই নিজেদের জনসমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালিয়েছে মানুষের সহানুভূতি আদায়ের জন্য এবং বিএনপি সরকারকে বিব্রত করার জন্য শেখ হাসিনা নিজেই তাঁর ব্যাগে গ্রেনেড বহন করেছেন—এমন হাস্যকর বক্তব্যও বিএনপির পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে।
নানা নাটকীয়তা শেষে ছয়বার তদন্ত কর্মকর্তা বদলে চাঞ্চল্যকর গ্রেনেড হামলা মামলার বিচারকাজ শেষ হয়েছে। বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে যে এই মামলার বিচার প্রক্রিয়া ব্যাহত হতো, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বিএনপির নেতারা মুখে আইনের শাসনের কথা বললেও কার্যত তাঁদের অবস্থান কখনো কখনো ন্যায়বিচার ও আইনের শাসনের পক্ষে ছিল না। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ক্ষেত্রে যেমন সেটা সত্য ছিল, গ্রেনেড হামলা মামলার বেলায়ও তাই।
২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকার ১ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নূরউদ্দিন গ্রেনেড হামলা মামলার রায় ঘোষণা করেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ মোট ৫২ জন আসামির মধ্যে বাবর, পিন্টুসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরীসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরীসহ মোট ১৬ জন আসামি এখন পলাতক আছেন। কয়েকজন কারাগারে আছেন। ডিজিএফআই, এনএসআই ও পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তাও দণ্ডিত হয়েছেন।
গ্রেনেড হামলা মামলার মূল আসামি মুফতি হান্নান। কিন্তু সিলেটে বোমা হামলার ঘটনায় ২০১৭ সালে তার ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। অন্যদিকে আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের যুদ্ধাপরাধ মামলায় ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় এই মামলা থেকে রেহাই পান।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায়ে তারেক রহমানকে যাবজ্জীবন দণ্ড দেওয়ায় এবং বিএনপির আরও কয়েকজন নেতা মৃত্যুদণ্ডসহ বিভিন্ন সাজা পাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই বিএনপি এই রায়ে নাখোশ হয়েছে। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর রায় প্রকাশের পর প্রতিক্রিয়ায় একে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপূর্ণ’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। আবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, বিলম্বিত হলেও এই রায়ে আমরা অখুশি নই। কিন্তু আমরা পুরোপুরি সন্তুষ্টও নই। কারণ, এই রায়ে প্ল্যানার ও মাস্টারমাইন্ডের সর্বোচ্চ শাস্তি হওয়া উচিত ছিল ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট (মৃত্যুদণ্ড)।
রাষ্ট্রপক্ষ উচ্চ আদালতে তারেক রহমানের রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করবে কি না এবং করলে রায় পরিবর্তন হবে কি না, তা নিয়ে মন্তব্য করা যাবে না। তবে একুশ আগস্টের সেই ভয়ংকর বিকেলে গ্রেনেড হামলার ঘটনায় দেশের রাজনীতিতে যে কালো অধ্যায় যুক্ত হয়েছিল, তা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে বিএনপিকে সত্য স্বীকার করতে হবে। ২১ আগস্টের ঘটনা কোনো গালগল্প নয়। ঘটনাটি ঘটেছিল এবং এমন একটি হিংসাশ্রয়ী ঘটনার সঙ্গে বিএনপির সংশ্লিষ্টতার বিষয়টিও কষ্ট কল্পনার নয়। বিএনপি শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করেছে। তবে এত বছর পরে তাদের উচিত সত্যের মুখোমুখি হওয়া। বিএনপি না বদলালে যে দেশের রাজনীতি বদলাবে না, এটা বিএনপি নেতৃত্বকে বুঝতে হবে।
লেখক: সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট এক ভয়ংকর বিকেল দেখেছে বাংলাদেশের মানুষ। সেদিন রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে ছিল আওয়ামী লীগের একটি সমাবেশ। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে একটি ট্রাকের ওপর স্থাপিত হয়েছিল বক্তৃতামঞ্চ। আওয়ামী লীগের সভাপতি ও তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত ছিলেন সেই মঞ্চে। যথারীতি হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে শুরু হয়েছিল সভার কাজ। সভা যখন প্রায় শেষের দিকে, পশ্চিম আকাশে সূর্য হেলে পড়লেও আঁধার নামেনি, শেখ হাসিনা বক্তৃতা করছিলেন, তখন আকস্মিকভাবে বিকট বিস্ফোরণের শব্দে চমকে ওঠেন সবাই।
সভাস্থলে গ্রেনেড ছুড়ে মারা হয়। লক্ষ্য অবশ্যই ছিলেন শেখ হাসিনা। তাঁকে হত্যা করে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার অসৎ উদ্দেশ্য নিয়েই ওই গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল। মোহাম্মদ হানিফ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তসহ আওয়ামী লীগের নেতারা মানববর্ম রচনা করে শেখ হাসিনার প্রাণ রক্ষা করেন। তবে নিহত হন ২৪ জন, যার মধ্যে ছিলেন আওয়ামী লীগের নেত্রী আইভি রহমান। তিন শতাধিক নেতা-কর্মী গুরুতর আহত হন। সেই ভয়ংকর বিকেলে বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে রচিত হয়েছিল এক কলঙ্কিত অধ্যায়। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে কলঙ্কিত ধারার সূচনা হয়েছিল, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট যেন সেই ধারারই আরেক প্রকাশ। হত্যার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতার পরিবর্তন কিংবা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নির্মূলের এই ধারা দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির সামনে খারাপ দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার সময় ক্ষমতায় ছিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। দেশে কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে প্রাথমিকভাবে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা সরকারের দায়িত্ব। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার মতো এত বড় অপরাধ যারা করেছিল, তাদের চিহ্নিত করা, গ্রেপ্তার ও আইনের হাতে সোপর্দ করার জরুরি কর্তব্যটি তৎকালীন সরকার সম্পাদনে কেবল চরমভাবে ব্যর্থতারই পরিচয় দেয়নি, বরং ঘটনাপ্রবাহ অন্য খাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টাই চালানো হয়েছে। অপরাধীরা যাতে নিরাপদে থাকতে পারে, কৌশলে সেই চেষ্টাই করা হয়েছে। নিরপরাধ
নিরীহ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে নিষ্ঠুর নির্যাতন চালানো হয়েছিল।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে দেশে হত্যা-খুনের যে রাজনীতি শুরু হয়, তার ধারাবাহিকতায়ই ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটেছে বলে মনে করা অসংগত নয়। ১৯৭৫ সালে বিএনপি নামক রাজনৈতিক দলটি ছিল না। তাই ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের দায় সরাসরি বিএনপির ওপর চাপানো যায় না। তবে ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ আওয়ামী লীগ করে থাকে। খুনিদের সঙ্গে জিয়াউর রহমানের ঘনিষ্ঠতা এবং পরস্পর নির্ভরতার বিষয়টি এককথায় নাকচও করা যায় না।
তবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পরপরই ক্ষমতা দখল করেছিলেন খোন্দকার মোশতাক আহমেদ। তিনি আওয়ামী লীগ করতেন বলে এটা বলা হয়ে থাকে যে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে তাঁর দলের লোকেরাই। মোশতাকের মন্ত্রিসভায় বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার ছয়জন বাদে আর সব সদস্যই যোগ দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার দায় থেকে আওয়ামী লীগকে একেবারে মুক্তি দেওয়া যায় না। আওয়ামী লীগের কেউ কেউ জেনেবুঝে ঘাতকদের সহযোগী হয়েছে, কেউ আবার পরিস্থিতির আকস্মিকতায় হতবিহ্বল ও ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পক্ষ বদল করেছে।
তারপর জিয়াউর রহমান ক্ষমতার কেন্দ্রে বসে বঙ্গবন্ধুর নাম ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা এবং আওয়ামী লীগকে ক্ষমতার বাইরে রাখার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়েই চলেছেন। তাই বলা যায়, হত্যার রাজনীতির পথ ধরেই জিয়ার উত্থান। দুঃখজনক যে, জিয়ার হাতে গড়া দল বিএনপিও হত্যা-খুনের রাজনীতির ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনা তার বড় প্রমাণ। ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের মতো একটি বড় রাজনৈতিক দলের সমাবেশে নিরাপত্তা দিতে সরকার শুধু ব্যর্থই হয়নি, ঘটনা-পরবর্তী সময়ে আক্রমণকারীদের রক্ষা করার সব ধরনের চেষ্টা সরকারের পক্ষ থেকে করা হয়েছিল।
২২ আগস্ট বিচারপতি জয়নুল আবেদীনকে চেয়ারম্যান করে এক সদস্যের বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছিল, যে কমিশনের উদ্দেশ্যই ছিল সম্ভবত পুরো বিষয়টিকে ধামাচাপা দেওয়া অথবা মানুষের নজর অন্যদিকে ফেরানো। এক মাস দশ দিন পর বিচারপতি জয়নুল আবেদীন ১৬২ পৃষ্ঠার এক প্রতিবেদন জমা দেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার পেছনে একটি শক্তশালী বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত ছিল। যদিও বিদেশি সেই শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থার নাম বলা হয়নি।
বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের তদন্ত প্রতিবেদনটি এমন ছিল যে বিএনপি সরকারও এই প্রতিবেদনের বক্তব্যের সঙ্গে একমত হতে না পেরে এ নিয়ে পরে আর তেমন উচ্চবাচ্য করেনি। তবে বিএনপি সরকার আত্মরক্ষার বর্ম খুঁজতে গিয়ে হাস্যকর সব পদক্ষেপ নিয়ে এটা স্পষ্ট করেছে যে গ্রেনেড হামলার রহস্য উন্মোচনে তারা আগ্রহী ছিল না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও তদন্ত সংস্থাগুলোকে প্রভাবিত করে কালক্ষেপণের নীতি নেওয়া হয়। ২০০৫ সালের ৯ জুন নোয়াখালীর সেনবাগ থেকে জজ মিয়া নামক এক ছিঁচকে অপরাধীকে ধরে তাঁর কাছ থেকে গ্রেনেড হামলার বিষয়ে স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়। পরে জানা যায়, এটা ছিল পুলিশের সাজানো নাটক।
অন্যদিকে বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা বলতে থাকেন যে আওয়ামী লীগই নিজেদের জনসমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালিয়েছে মানুষের সহানুভূতি আদায়ের জন্য এবং বিএনপি সরকারকে বিব্রত করার জন্য শেখ হাসিনা নিজেই তাঁর ব্যাগে গ্রেনেড বহন করেছেন—এমন হাস্যকর বক্তব্যও বিএনপির পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে।
নানা নাটকীয়তা শেষে ছয়বার তদন্ত কর্মকর্তা বদলে চাঞ্চল্যকর গ্রেনেড হামলা মামলার বিচারকাজ শেষ হয়েছে। বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে যে এই মামলার বিচার প্রক্রিয়া ব্যাহত হতো, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বিএনপির নেতারা মুখে আইনের শাসনের কথা বললেও কার্যত তাঁদের অবস্থান কখনো কখনো ন্যায়বিচার ও আইনের শাসনের পক্ষে ছিল না। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ক্ষেত্রে যেমন সেটা সত্য ছিল, গ্রেনেড হামলা মামলার বেলায়ও তাই।
২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকার ১ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নূরউদ্দিন গ্রেনেড হামলা মামলার রায় ঘোষণা করেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ মোট ৫২ জন আসামির মধ্যে বাবর, পিন্টুসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরীসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরীসহ মোট ১৬ জন আসামি এখন পলাতক আছেন। কয়েকজন কারাগারে আছেন। ডিজিএফআই, এনএসআই ও পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তাও দণ্ডিত হয়েছেন।
গ্রেনেড হামলা মামলার মূল আসামি মুফতি হান্নান। কিন্তু সিলেটে বোমা হামলার ঘটনায় ২০১৭ সালে তার ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। অন্যদিকে আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের যুদ্ধাপরাধ মামলায় ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় এই মামলা থেকে রেহাই পান।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায়ে তারেক রহমানকে যাবজ্জীবন দণ্ড দেওয়ায় এবং বিএনপির আরও কয়েকজন নেতা মৃত্যুদণ্ডসহ বিভিন্ন সাজা পাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই বিএনপি এই রায়ে নাখোশ হয়েছে। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর রায় প্রকাশের পর প্রতিক্রিয়ায় একে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপূর্ণ’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। আবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, বিলম্বিত হলেও এই রায়ে আমরা অখুশি নই। কিন্তু আমরা পুরোপুরি সন্তুষ্টও নই। কারণ, এই রায়ে প্ল্যানার ও মাস্টারমাইন্ডের সর্বোচ্চ শাস্তি হওয়া উচিত ছিল ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট (মৃত্যুদণ্ড)।
রাষ্ট্রপক্ষ উচ্চ আদালতে তারেক রহমানের রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করবে কি না এবং করলে রায় পরিবর্তন হবে কি না, তা নিয়ে মন্তব্য করা যাবে না। তবে একুশ আগস্টের সেই ভয়ংকর বিকেলে গ্রেনেড হামলার ঘটনায় দেশের রাজনীতিতে যে কালো অধ্যায় যুক্ত হয়েছিল, তা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে বিএনপিকে সত্য স্বীকার করতে হবে। ২১ আগস্টের ঘটনা কোনো গালগল্প নয়। ঘটনাটি ঘটেছিল এবং এমন একটি হিংসাশ্রয়ী ঘটনার সঙ্গে বিএনপির সংশ্লিষ্টতার বিষয়টিও কষ্ট কল্পনার নয়। বিএনপি শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করেছে। তবে এত বছর পরে তাদের উচিত সত্যের মুখোমুখি হওয়া। বিএনপি না বদলালে যে দেশের রাজনীতি বদলাবে না, এটা বিএনপি নেতৃত্বকে বুঝতে হবে।
লেখক: সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
দলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
১৪ ঘণ্টা আগেশেখ হাসিনা সরকারের পতনের ১০০ দিন পার হয়ে গেছে। ১০০ দিনে অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কিছু যে হয়নি, তা নয়। তবে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে অস্থিরতার লক্ষণ অস্পষ্ট নয়। এর মধ্যেই তিন দফায় উপদেষ্টার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।
১৪ ঘণ্টা আগেবাংলা ভাষায় অতিপরিচিত একটি শব্দবন্ধ হলো ‘খোলনলচে’। যাপিত জীবনে কমবেশি আমরা সবাই শব্দবন্ধটি প্রয়োগ করেছি। বাংলা বাগধারায় আমরা পড়েছি ‘খোলনলচে পালটানো’। বাংলা অভিধানে খোল শব্দের একাধিক অর্থ রয়েছে।
১৪ ঘণ্টা আগেঅফিসে যাতায়াতের সময় স্টাফ বাসে পরিচয়ের সূত্রে ফারজানা আক্তার আজিমপুরে নিজের বাসায় সাবলেট দিয়েছিলেন ফাতেমা আক্তার শাপলা নামের এক নারীকে। কিন্তু ফাতেমা যে একটি প্রতারক চক্রের সদস্য, সেটা তাঁর জানা ছিল না।
১৪ ঘণ্টা আগে