ড. এম আবদুল আলীম
মাতা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমি সবার কাছেই প্রিয়। এ ক্ষেত্রে বাঙালির আবেগ একটু গভীর এবং ভিন্ন ব্যঞ্জনার দ্যোতক। কেননা, এই জাতি মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছে এবং বুকের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করেছে, এমনকি জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করেছে। কালে কালে পরাধীনতা ও শোষণ-বঞ্চনার জাঁতাকলে পিষ্ট হলেও এই জাতি সর্বপ্রথম নিজস্ব অস্তিত্ব নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে। এই আন্দোলন পূর্ববঙ্গের মানুষের চেতনায় শোষণমুক্তির এমন এক সঞ্জীবনী সুধার পরশ বুলিয়ে দেয়, যার ফলে সমগ্র জাতি জেগে ওঠে এবং স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে পরাক্রমশালী পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করে। দীর্ঘকালের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শোষণের কারণে পুঞ্জীভূত হওয়া ক্ষোভের বিস্ফোরণ যেন ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই ঘটে। এর ফলে ধাপে ধাপে গড়ে ওঠা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে স্বৈরাচারের আসন টলে ওঠে এবং অর্জিত হয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। বাঙালির এই স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জনের সংগ্রামে মূল নেতৃত্ব দিয়েছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
ভাষা আন্দোলনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও মতাদর্শের অগণিত নেতা-কর্মী সক্রিয় ভূমিকা পালন করলেও এই চেতনা লালন ও বাস্তবায়নে শেখ মুজিবুর রহমানের মতো দৃঢ়তা ও আন্তরিকতা আর কেউ প্রদর্শন করতে পারেননি। আর এখানেই তাঁর বাঙালিয়ানা ও নেতৃত্বের স্বকীয়তা। অনেকে ভাষা আন্দোলনে সামনের কাতারে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন বটে; কিন্তু পরবর্তীকালে শেখ মুজিবের মতো কেউই বাঙালি জাতীয়তাবাদ, বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির মূল স্পিরিটের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রাখতে পারেননি। সর্বোপরি, এই চেতনাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ব্যাপকভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মূল স্রোত থেকেও তারা ছিটকে পড়েছেন। ইতিহাসের এই দীর্ঘ পথপরিক্রমায় বাঙালির যে অভিযাত্রা, তাতে অগণিত নেতার সম্মিলন ঘটেছে বটে, কিন্তু দিশেহারা জাতিকে মুক্ত স্বাধীন দেশ অর্জনে পথ দেখিয়ে কান্ডারির ভূমিকা পালন করেছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বিভাগপূর্ব কালে শেখ মুজিবুর রহমান ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ও পাকিস্তান আন্দোলনের সক্রিয় কর্মীরূপে নিজেকে রাজনীতির মাঠে পরিচিত করেন। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের মতো উদারচিত্তের রাজনীতিবিদের সান্নিধ্য তাঁর চেতনার মর্মমূলে প্রোথিত করেছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার ভ্রুণকোষ। বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য ও বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি তাঁর দরদ ছিল আজন্ম। লালন, হাসন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও জীবনানন্দ যে চিরায়ত বাংলার রূপচ্ছবি ও বাঙালিত্বের অন্বেষণে বিভোর ছিলেন, শেখ মুজিব সেই পথের পথিক। বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও বাংলা গান তিনি গভীরভাবে আত্মস্থ করেছিলেন। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’র পাতায় পাতায় রয়েছে এর বিবরণ। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর পশ্চিম পাকিস্তানে গেলে সেখানকার মানুষ তাঁর কাছে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার যৌক্তিকতা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি তাদের কাছে ভাষা আন্দোলনের মূল দাবি ও বাংলা ভাষার মাহাত্ম্যের কথা তুলে ধরেন এবং তাদের জিজ্ঞাসু মনের কৌতূহল মেটাতে অবলীলায় রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের কবিতা আবৃত্তি করে শোনান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও আব্বাসউদ্দীনের গান তাঁর চিত্তে স্থায়ী আসন লাভ করেছিল। শিল্পী আব্বাসউদ্দীন ছিলেন তাঁর ভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়ার অন্যতম প্রেরণাদাতা। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন: ‘আমি আব্বাসউদ্দীন সাহেবের একজন ভক্ত হয়ে পড়েছিলাম। তিনি আমাকে বলেছিলেন: মুজিব, বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে। বাংলা রাষ্ট্রভাষা না হলে বাংলার কৃষ্টি, সভ্যতা সব শেষ হয়ে যাবে। আজ যে গানকে তুমি ভালোবাস, এর মাধুর্য ও মর্যাদা নষ্ট হয়ে যাবে। যা কিছু হোক, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতেই হবে।’ রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি ছিল তাঁর কাছে খুবই প্রিয়। বক্তৃতার মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি উচ্চারণ করতেন বাংলা ভাষার কালজয়ী গান ও কবিতার পঙ্ক্তিমালা। পাকিস্তানের কারাগারে মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও তিনি গেয়েছেন বাঙালিত্বের জয়গান। ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বদানের বিষয়টি তাঁর বাঙালিত্বের অহংকার এবং বাংলা ভাষার প্রতি গভীর ভালোবাসা থেকেই এসেছে। মাতৃভাষার প্রতি গভীর ভালোবাসা থেকেই তাঁর মধ্যে এসেছে মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা; অর্থাৎ ভাষাকে ভালোবাসতে গিয়েই তিনি দেশকে ভালোবেসেছেন।
বঙ্গবন্ধু ১৯৪৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকায় আসেন। এখানে এসে তিনি ও তাঁর সঙ্গীরা বুঝতে পারলেন মুসলিম লীগ সরকার অন্ধকারের পথ বেছে নিয়েছে; সেই পথে জাতির মুক্তির আশা সুদূর পরাহত। তাই তাঁরা খুঁজলেন নতুন পথ। এরই অংশ হিসেবে তাঁরা গড়ে তুললেন অপেক্ষাকৃত উদার ও অসাম্প্রদায়িক চেতনাধারার রাজনৈতিক দল ও ছাত্রসংগঠন। একই সঙ্গে পাকিস্তান সরকারের বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি অবজ্ঞার প্রতিকারে এবং পাকিস্তান গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাংলা ভাষাবিষয়ক প্রস্তাব নাকচ হওয়ার প্রতিবাদে পূর্ববঙ্গের ছাত্রসমাজ, রাজনীতিবিদ ও সচেতন বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে তাঁরাও রাজপথে নেমে আসেন। এই আন্দোলনে নেতৃত্বদানের সূত্র ধরে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ববঙ্গের রাজনীতির মাঠে সামনের কাতারে চলে আসেন। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই ঢাকার রাজপথে শুরু হয় তাঁর দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে চলা। কেবল ঢাকার রাজপথই নয়, বাংলার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে শুরু হয় তাঁর রাজনৈতিক অভিযাত্রা। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ভাষা আন্দোলনের কর্মসূচিতে পিকেটিং করতে গিয়ে তিনি পুলিশের লাঠির আঘাতে আহত হন। তাঁকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। তিনি ছিলেন দৃঢ়প্রত্যয়ী, ফলে জেল-জুলুম-নির্যাতন করে তাঁকে দমাতে পারেনি।
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় বঙ্গবন্ধু কারাগারে বন্দী ছিলেন। ১৯৪৯ সালের শুরুতে তাঁকে নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করে কারাবন্দী করা হয়। ১৯৫১ সালের মাঝামাঝি তাঁকে ফরিদপুর কারাগার থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা তাঁর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করতেন। জেলখানায় বসেই তিনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেন। আন্দোলনের কর্মপন্থা নির্ধারণে তিনি তাঁদের নানা পরামর্শ দিতেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন পল্টন ময়দানের জনসভায় উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিলে পূর্ব বাংলার ছাত্রসমাজ গর্জে ওঠে। শেখ মুজিব তখন নিরাপত্তাবন্দী হিসেবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। এ সময় আন্দোলনের করণীয় ঠিক করতে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন খালেক নেওয়াজ খান, কাজী গোলাম মাহবুব, অলি আহাদ, এম এ ওয়াদুদসহ অনেক ছাত্রনেতা। ১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি গঠন করা হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করা এবং নিরাপত্তাবন্দী শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবিসহ বিভিন্ন দাবি আদায়ে ২১ ফেব্রুয়ারি কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করায় ১৯৫২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান ও মহিউদ্দীন আহমেদকে ফরিদপুর কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। পথে নারায়ণগঞ্জের ছাত্রনেতারা তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে তিনি ভাষা আন্দোলনসহ বিভিন্ন বিষয়ে তাঁদের নির্দেশনা দেন। ১৯৫২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়া তাঁদের এই অনশন ভাষা আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করে। ২৮ ফেব্রুয়ারি কারামুক্ত হয়ে শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যদের সমবেদনা জানিয়ে বিবৃতি দেন। পরে ঢাকায় ফিরে এসে যোগ দেন সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সম্মেলনে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে সোহরাওয়ার্দীর বিবৃতি আনতে ছুটে যান পশ্চিম পাকিস্তানে। চীনের শান্তি সম্মেলনে বাংলা ভাষায় ভাষণ প্রদান, পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বিবৃতি আদায়, ভাষা আন্দোলনের বন্দীদের মুক্তি দাবি, ভাষা আন্দোলন বিষয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের সুধীমহলকে পরিষ্কার ধারণা প্রদান, প্রথম শহীদ দিবস পালন, চুয়ান্নর নির্বাচন, আইনসভার ভেতরে-বাইরে বাংলা ভাষা ও বাঙালিত্বের গৌরব প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা পালন করেন। পরবর্তী কালে স্বাধিকার সংগ্রামের উত্তাল দিনগুলোতে তিনি বাঙালিয়ানা ও একুশের চেতনাকে সবার ওপরে স্থান দিয়েছেন। এ ছাড়া স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান তথা সংবিধানে এই ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদাদান এবং সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলনে তিনি গুরুদায়িত্ব পালন করেন। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বাংলা ভাষায় বক্তৃতা প্রদান করে তিনি এই ভাষাকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন, তা নিঃসন্দেহে শ্লাঘার বিষয়। সবই করেছেন বাংলা ভাষা ও বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনা থেকে। নেতৃত্বের গুণাবলি ও বাঙালিত্বের পরাকাষ্ঠায় সব নেতাকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন বলেই জাতি তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ ও ‘জাতির পিতা’র মর্যাদাপূর্ণ আসনে অধিষ্ঠিত করেছে।
লেখক: গবেষক, প্রাবন্ধিক; শিক্ষক, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
মাতা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমি সবার কাছেই প্রিয়। এ ক্ষেত্রে বাঙালির আবেগ একটু গভীর এবং ভিন্ন ব্যঞ্জনার দ্যোতক। কেননা, এই জাতি মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছে এবং বুকের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করেছে, এমনকি জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করেছে। কালে কালে পরাধীনতা ও শোষণ-বঞ্চনার জাঁতাকলে পিষ্ট হলেও এই জাতি সর্বপ্রথম নিজস্ব অস্তিত্ব নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে। এই আন্দোলন পূর্ববঙ্গের মানুষের চেতনায় শোষণমুক্তির এমন এক সঞ্জীবনী সুধার পরশ বুলিয়ে দেয়, যার ফলে সমগ্র জাতি জেগে ওঠে এবং স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে পরাক্রমশালী পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করে। দীর্ঘকালের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শোষণের কারণে পুঞ্জীভূত হওয়া ক্ষোভের বিস্ফোরণ যেন ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই ঘটে। এর ফলে ধাপে ধাপে গড়ে ওঠা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে স্বৈরাচারের আসন টলে ওঠে এবং অর্জিত হয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। বাঙালির এই স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জনের সংগ্রামে মূল নেতৃত্ব দিয়েছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
ভাষা আন্দোলনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও মতাদর্শের অগণিত নেতা-কর্মী সক্রিয় ভূমিকা পালন করলেও এই চেতনা লালন ও বাস্তবায়নে শেখ মুজিবুর রহমানের মতো দৃঢ়তা ও আন্তরিকতা আর কেউ প্রদর্শন করতে পারেননি। আর এখানেই তাঁর বাঙালিয়ানা ও নেতৃত্বের স্বকীয়তা। অনেকে ভাষা আন্দোলনে সামনের কাতারে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন বটে; কিন্তু পরবর্তীকালে শেখ মুজিবের মতো কেউই বাঙালি জাতীয়তাবাদ, বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির মূল স্পিরিটের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রাখতে পারেননি। সর্বোপরি, এই চেতনাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ব্যাপকভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মূল স্রোত থেকেও তারা ছিটকে পড়েছেন। ইতিহাসের এই দীর্ঘ পথপরিক্রমায় বাঙালির যে অভিযাত্রা, তাতে অগণিত নেতার সম্মিলন ঘটেছে বটে, কিন্তু দিশেহারা জাতিকে মুক্ত স্বাধীন দেশ অর্জনে পথ দেখিয়ে কান্ডারির ভূমিকা পালন করেছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বিভাগপূর্ব কালে শেখ মুজিবুর রহমান ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ও পাকিস্তান আন্দোলনের সক্রিয় কর্মীরূপে নিজেকে রাজনীতির মাঠে পরিচিত করেন। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের মতো উদারচিত্তের রাজনীতিবিদের সান্নিধ্য তাঁর চেতনার মর্মমূলে প্রোথিত করেছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার ভ্রুণকোষ। বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য ও বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি তাঁর দরদ ছিল আজন্ম। লালন, হাসন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও জীবনানন্দ যে চিরায়ত বাংলার রূপচ্ছবি ও বাঙালিত্বের অন্বেষণে বিভোর ছিলেন, শেখ মুজিব সেই পথের পথিক। বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও বাংলা গান তিনি গভীরভাবে আত্মস্থ করেছিলেন। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’র পাতায় পাতায় রয়েছে এর বিবরণ। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর পশ্চিম পাকিস্তানে গেলে সেখানকার মানুষ তাঁর কাছে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার যৌক্তিকতা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি তাদের কাছে ভাষা আন্দোলনের মূল দাবি ও বাংলা ভাষার মাহাত্ম্যের কথা তুলে ধরেন এবং তাদের জিজ্ঞাসু মনের কৌতূহল মেটাতে অবলীলায় রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের কবিতা আবৃত্তি করে শোনান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও আব্বাসউদ্দীনের গান তাঁর চিত্তে স্থায়ী আসন লাভ করেছিল। শিল্পী আব্বাসউদ্দীন ছিলেন তাঁর ভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়ার অন্যতম প্রেরণাদাতা। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন: ‘আমি আব্বাসউদ্দীন সাহেবের একজন ভক্ত হয়ে পড়েছিলাম। তিনি আমাকে বলেছিলেন: মুজিব, বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে। বাংলা রাষ্ট্রভাষা না হলে বাংলার কৃষ্টি, সভ্যতা সব শেষ হয়ে যাবে। আজ যে গানকে তুমি ভালোবাস, এর মাধুর্য ও মর্যাদা নষ্ট হয়ে যাবে। যা কিছু হোক, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতেই হবে।’ রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি ছিল তাঁর কাছে খুবই প্রিয়। বক্তৃতার মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি উচ্চারণ করতেন বাংলা ভাষার কালজয়ী গান ও কবিতার পঙ্ক্তিমালা। পাকিস্তানের কারাগারে মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও তিনি গেয়েছেন বাঙালিত্বের জয়গান। ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বদানের বিষয়টি তাঁর বাঙালিত্বের অহংকার এবং বাংলা ভাষার প্রতি গভীর ভালোবাসা থেকেই এসেছে। মাতৃভাষার প্রতি গভীর ভালোবাসা থেকেই তাঁর মধ্যে এসেছে মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা; অর্থাৎ ভাষাকে ভালোবাসতে গিয়েই তিনি দেশকে ভালোবেসেছেন।
বঙ্গবন্ধু ১৯৪৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকায় আসেন। এখানে এসে তিনি ও তাঁর সঙ্গীরা বুঝতে পারলেন মুসলিম লীগ সরকার অন্ধকারের পথ বেছে নিয়েছে; সেই পথে জাতির মুক্তির আশা সুদূর পরাহত। তাই তাঁরা খুঁজলেন নতুন পথ। এরই অংশ হিসেবে তাঁরা গড়ে তুললেন অপেক্ষাকৃত উদার ও অসাম্প্রদায়িক চেতনাধারার রাজনৈতিক দল ও ছাত্রসংগঠন। একই সঙ্গে পাকিস্তান সরকারের বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি অবজ্ঞার প্রতিকারে এবং পাকিস্তান গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাংলা ভাষাবিষয়ক প্রস্তাব নাকচ হওয়ার প্রতিবাদে পূর্ববঙ্গের ছাত্রসমাজ, রাজনীতিবিদ ও সচেতন বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে তাঁরাও রাজপথে নেমে আসেন। এই আন্দোলনে নেতৃত্বদানের সূত্র ধরে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ববঙ্গের রাজনীতির মাঠে সামনের কাতারে চলে আসেন। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই ঢাকার রাজপথে শুরু হয় তাঁর দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে চলা। কেবল ঢাকার রাজপথই নয়, বাংলার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে শুরু হয় তাঁর রাজনৈতিক অভিযাত্রা। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ভাষা আন্দোলনের কর্মসূচিতে পিকেটিং করতে গিয়ে তিনি পুলিশের লাঠির আঘাতে আহত হন। তাঁকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। তিনি ছিলেন দৃঢ়প্রত্যয়ী, ফলে জেল-জুলুম-নির্যাতন করে তাঁকে দমাতে পারেনি।
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় বঙ্গবন্ধু কারাগারে বন্দী ছিলেন। ১৯৪৯ সালের শুরুতে তাঁকে নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করে কারাবন্দী করা হয়। ১৯৫১ সালের মাঝামাঝি তাঁকে ফরিদপুর কারাগার থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা তাঁর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করতেন। জেলখানায় বসেই তিনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেন। আন্দোলনের কর্মপন্থা নির্ধারণে তিনি তাঁদের নানা পরামর্শ দিতেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন পল্টন ময়দানের জনসভায় উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিলে পূর্ব বাংলার ছাত্রসমাজ গর্জে ওঠে। শেখ মুজিব তখন নিরাপত্তাবন্দী হিসেবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। এ সময় আন্দোলনের করণীয় ঠিক করতে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন খালেক নেওয়াজ খান, কাজী গোলাম মাহবুব, অলি আহাদ, এম এ ওয়াদুদসহ অনেক ছাত্রনেতা। ১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি গঠন করা হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করা এবং নিরাপত্তাবন্দী শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবিসহ বিভিন্ন দাবি আদায়ে ২১ ফেব্রুয়ারি কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করায় ১৯৫২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান ও মহিউদ্দীন আহমেদকে ফরিদপুর কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। পথে নারায়ণগঞ্জের ছাত্রনেতারা তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে তিনি ভাষা আন্দোলনসহ বিভিন্ন বিষয়ে তাঁদের নির্দেশনা দেন। ১৯৫২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়া তাঁদের এই অনশন ভাষা আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করে। ২৮ ফেব্রুয়ারি কারামুক্ত হয়ে শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যদের সমবেদনা জানিয়ে বিবৃতি দেন। পরে ঢাকায় ফিরে এসে যোগ দেন সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সম্মেলনে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে সোহরাওয়ার্দীর বিবৃতি আনতে ছুটে যান পশ্চিম পাকিস্তানে। চীনের শান্তি সম্মেলনে বাংলা ভাষায় ভাষণ প্রদান, পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বিবৃতি আদায়, ভাষা আন্দোলনের বন্দীদের মুক্তি দাবি, ভাষা আন্দোলন বিষয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের সুধীমহলকে পরিষ্কার ধারণা প্রদান, প্রথম শহীদ দিবস পালন, চুয়ান্নর নির্বাচন, আইনসভার ভেতরে-বাইরে বাংলা ভাষা ও বাঙালিত্বের গৌরব প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা পালন করেন। পরবর্তী কালে স্বাধিকার সংগ্রামের উত্তাল দিনগুলোতে তিনি বাঙালিয়ানা ও একুশের চেতনাকে সবার ওপরে স্থান দিয়েছেন। এ ছাড়া স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান তথা সংবিধানে এই ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদাদান এবং সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলনে তিনি গুরুদায়িত্ব পালন করেন। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বাংলা ভাষায় বক্তৃতা প্রদান করে তিনি এই ভাষাকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন, তা নিঃসন্দেহে শ্লাঘার বিষয়। সবই করেছেন বাংলা ভাষা ও বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনা থেকে। নেতৃত্বের গুণাবলি ও বাঙালিত্বের পরাকাষ্ঠায় সব নেতাকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন বলেই জাতি তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ ও ‘জাতির পিতা’র মর্যাদাপূর্ণ আসনে অধিষ্ঠিত করেছে।
লেখক: গবেষক, প্রাবন্ধিক; শিক্ষক, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
দলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
২১ ঘণ্টা আগেশেখ হাসিনা সরকারের পতনের ১০০ দিন পার হয়ে গেছে। ১০০ দিনে অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কিছু যে হয়নি, তা নয়। তবে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে অস্থিরতার লক্ষণ অস্পষ্ট নয়। এর মধ্যেই তিন দফায় উপদেষ্টার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।
২১ ঘণ্টা আগেবাংলা ভাষায় অতিপরিচিত একটি শব্দবন্ধ হলো ‘খোলনলচে’। যাপিত জীবনে কমবেশি আমরা সবাই শব্দবন্ধটি প্রয়োগ করেছি। বাংলা বাগধারায় আমরা পড়েছি ‘খোলনলচে পালটানো’। বাংলা অভিধানে খোল শব্দের একাধিক অর্থ রয়েছে।
১ দিন আগেঅফিসে যাতায়াতের সময় স্টাফ বাসে পরিচয়ের সূত্রে ফারজানা আক্তার আজিমপুরে নিজের বাসায় সাবলেট দিয়েছিলেন ফাতেমা আক্তার শাপলা নামের এক নারীকে। কিন্তু ফাতেমা যে একটি প্রতারক চক্রের সদস্য, সেটা তাঁর জানা ছিল না।
১ দিন আগে