বিভুরঞ্জন সরকার
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এবং নভেম্বর মাসের ৩ ও ৭ তারিখে সংঘটিত ঘটনাবলি বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে অভিঘাত সৃষ্টি করেছে, যে নিষ্ঠুরতার জন্ম দিয়েছে, তা সহজে কাটবে বলে মনে হয় না। ১৫ আগস্ট হত্যা করা হয় স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী তরুণ সদস্য এই হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করলেও পেছনে আরও অনেকেই যে ছিলেন, সেটা এখন আর গোপন বিষয় নয়। ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর সহচর হিসেবে পরিচিত খন্দকার মোশতাক আহমদকে ক্ষমতায় বসিয়ে নিজেরা জাতির ওপর ছড়ি ঘোরাতে থাকে। সেনাবাহিনীর সিনিয়র কর্মকর্তারা বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারলেও ঘাতক চক্রের বাড়াবাড়ি, সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড অমান্য করা ইত্যাদি মেনে নিতে পারছিলেন না। তাঁরা যখন কিছু একটা করার পরিকল্পনা করছিলেন, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে যখন একটি পাল্টা ব্যবস্থার প্রস্তুতি সম্পন্ন, তখনই জেলের ভেতরে ৩ নভেম্বর সংঘটিত হয় আরও এক ভয়ংকর হত্যাকাণ্ড। বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত চার সহযোগী, তাঁর অবর্তমানে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে সফল নেতৃত্ব দিয়েছেন, সেই সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে হত্যা করে একই খুনি চক্র।
এর মধ্যে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে শুরু হয় নানা রকম রাজনৈতিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বাধীন জাসদ প্রভাবিত সৈনিক সংস্থা সেনাবাহিনীতে চরম বিশৃঙ্খল অবস্থা তৈরি করতে সক্ষম হয়। ৭ নভেম্বর ঘটে তথাকথিত এক ‘সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থান’। আর ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান।
জিয়াউর রহমানকে বলা হয় ভাগ্যের বরপুত্র। তিনি সেনা কর্মকর্তা থেকে দেশের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্নেহ পেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন তাঁর প্রতি উদার। কিন্তু জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর প্রতি সদয় হতে পারেননি; বরং বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাঁর ছিল একধরনের প্রচ্ছন্ন প্রতিহিংসাপরায়ণ মনোভাব। বঙ্গবন্ধুর প্রতি জিয়া কেন অনুদার ছিলেন, তার কারণ অনুসন্ধান প্রয়োজন। কিন্তু এই প্রয়োজনীয় কাজটি না হওয়ায় জিয়াকে নিয়ে আমাদের দেশে মাতামাতি করার লোকেরও অভাব নেই।
বঙ্গবন্ধুর কারণে সেনাবাহিনীতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে জিয়া পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা এবং হত্যার পর তাঁর নাম ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার সব অপচেষ্টারই মধ্যমণি ছিলেন। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে জিয়াকে যখন পাকিস্তানি অনুচর বলে অভিহিত করা হয়, তখন অনেকেই সেটা মেনে নিতে পারেন না। কারণ, আওয়ামী লীগ জিয়ার বিরুদ্ধে বললে সেটা কারও কারও কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয় না। কারণ, তাঁকে বীর উত্তম খেতাব দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু এবং সেনাবাহিনীর উপপ্রধানও বানিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুই। কেন, কোন পরিস্থিতিতে এসব করা হয়েছিল, তা কেউ খতিয়ে দেখার চেষ্টা করেন না।
আমাদের দেশে একশ্রেণির মানুষের মধ্যে আওয়ামী লীগবিদ্বেষ এতই প্রবল যে, আওয়ামী লীগ তথ্যপ্রমাণনির্ভর কথা বললেও তাঁরা তাকে বানোয়াট মনে করেন। জিয়াউর রহমান যেহেতু আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হয়েছিলেন, সেহেতু তাঁর সুনাম ক্ষুণ্ণ করার জন্যই তাঁকে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানি গুপ্তচর বলে থাকে–এমন ধারণা কারও হতেই পারে।
‘মেজর জিয়া’র নামের সঙ্গে বেশ কিছু মানুষের আবেগ জড়িয়ে আছে। কারণ, তাঁর কণ্ঠ থেকেই প্রথম কেউ কেউ স্বাধীনতার ঘোষণা শুনেছিলেন। তিনি ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ এমন একটি ধারণা নানা প্রচার-অপপ্রচারের মাধ্যমে জনমনে ঠাঁই পেয়েছে। জিয়া মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পেয়েছেন। কাজেই তাঁর মুক্তিযোদ্ধার ভাবমূর্তিও মানুষের মনে উজ্জ্বল। কিন্তু তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।
স্বাধীনতার পর তিনজন (জেনারেল সফিউল্লাহ, জিয়া ও খালেদ মোশাররফ) সেনা কর্মকর্তার মধ্যে ব্যক্তিত্বের বিরোধের কথা কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তার বইয়ে উল্লেখ আছে। জিয়ার আকাঙ্ক্ষা ছিল সেনাবাহিনীর প্রধান হওয়ার। সেটা হতে না পেরে তিনি ক্ষুব্ধ ছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বভাবসুলভ সরলতায় ব্যক্তিগতভাবে জিয়ার প্রতি উদারতা দেখিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু জিয়াকে সেনাবাহিনীর উপপ্রধান বানিয়েছিলেন। তাঁর জন্যই এই পদটি বঙ্গবন্ধু তৈরি করেছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর প্রতি কি জিয়া শতভাগ অনুগত ছিলেন? পরবর্তী ঘটনাবলি থেকে বলা যায়, জিয়া আদতেই বঙ্গবন্ধুর হিতৈষী ছিলেন না।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে প্রকাশ্যে নেতৃত্বদানকারী দুজন–কর্নেল ফারুক ও কর্নেল রশিদ দেশত্যাগ করার পর ব্রিটিশ টেলিভিশন চ্যানেলে এক সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেছিলেন যে, তাঁরা মুজিব হত্যার পরিকল্পনার কথা জিয়াউর রহমানকে জানিয়েছিলেন। এই সাক্ষাৎকারটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছিল। জিয়াউর রহমান তখন অত্যন্ত ‘ক্ষমতাধর’ হয়ে ওঠা সত্ত্বেও কিন্তু খুনি দুই কর্নেলের বক্তব্য অস্বীকার করেননি। বরং তিনি তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন। তিনি যদি দায়িত্ববান হতেন, বঙ্গবন্ধুর প্রতি যদি সামান্য আনুগত্য বা দরদ থাকত, তাহলে হত্যার পরিকল্পনার কথা শুনে ওই দুই কর্নেলকে পুলিশে সোপর্দ করতেন। সেটা না করে উল্টো তাঁদের এগিয়ে যাওয়ার উৎসাহ দিয়েছেন। এত বড় একটি রাষ্ট্রদ্রোহের ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে জেনেও কোনো প্রতিকারের ব্যবস্থা না করে গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ করেছেন জিয়া। সেদিন জিয়া যদি পরিকল্পনাকারীদের আইনের আওতায় আনতেন, তাহলে বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এত বড় বিয়োগান্ত ঘটনা হয়তো ঘটত না।
আসলে জিয়ার অভিলাষ ছিল অন্য রকম। তিনি ইতিহাসের নায়ক হওয়ার লোভে মত্ত হয়ে উঠেছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর শুনেও জিয়ার প্রতিক্রিয়া ছিল রহস্যজনক। তিনি বিচলিত হননি, ভারাক্রান্ত হননি। বিষয়টি তাঁর জানা ছিল বলেই স্বাভাবিক কণ্ঠে বলতে পেরেছেন: ‘সো হোয়াট? লেট ভাইস প্রেসিডেন্ট টেকওভার। উই হ্যাভ নাথিং টু ডু উইথ পলিটিক্স।’ অথচ কী কদর্যভাবেই না তিনি রাজনীতিতে জড়ালেন এবং রাজনীতিকে রাজনীতিবিদদের জন্য ডিফিকাল্ট করে দিলেন!
জিয়া ছিলেন ঠান্ডা মাথার ঘোড়েল খেলোয়াড়। মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের সুনাম কাজে লাগিয়ে তিনি স্বাধীনতাবিরোধীদের পুনর্বাসনের কাজটি ভালোভাবে করেছেন। গোলাম আযমকে দেশে ফিরিয়ে এনেছেন, ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক রাজনীতির জায়গা করে দিয়েছেন। শাহ আজিজের মতো রাজাকারকে প্রধানমন্ত্রী করে জাতিকে অপমানিত করেছেন। জাতীয় ঐক্যের নামে তিনি জাতিকে স্থায়ীভাবে চরম বিভক্তির পথে ঠেলে দিয়েছেন। জয় বাংলা স্লোগান নির্বাসনে পাঠানোর সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নাম মুছে ফেলার সব অপচেষ্টাই করেছেন। পাকিস্তানি পরাজিত সৈনিকরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের যে জায়গায় আত্মসমর্পণ করেছিল, সেখানে শিশুপার্ক বানিয়ে ইতিহাসের সঙ্গে তামাশা করেছিলেন জিয়া। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিদেশি মিশনে চাকরি দিয়ে, তাঁদের বিচারের দায়মুক্তি দিয়ে জিয়া বুঝিয়েছেন–তিনি আসলে কাদের লোক।
জিয়াউর রহমান তথাকথিত সৎ মানুষের কৃত্রিম ইমেজ নিয়ে দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে যে নীতিহীনতার বীজ রোপণ করে গেছেন, তার বিষফল এখন আমরা ভোগ করছি। তবে ইতিহাস কাউকে মার্জনা করে না।
জিয়াউর রহমান ইতিহাসের মহানায়ক শেখ মুজিবকে ইতিহাস থেকে বাদ দেওয়ার ঔদ্ধত্য দেখিয়েছেন; কিন্তু শেখ মুজিবকে তাঁর আসন থেকে সরাতে পারেননি। জিয়ার ভূমিকা নিয়ে আরও বেশি গবেষণা ও সত্যানুসন্ধান প্রয়োজন।
লেখক: সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এবং নভেম্বর মাসের ৩ ও ৭ তারিখে সংঘটিত ঘটনাবলি বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে অভিঘাত সৃষ্টি করেছে, যে নিষ্ঠুরতার জন্ম দিয়েছে, তা সহজে কাটবে বলে মনে হয় না। ১৫ আগস্ট হত্যা করা হয় স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী তরুণ সদস্য এই হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করলেও পেছনে আরও অনেকেই যে ছিলেন, সেটা এখন আর গোপন বিষয় নয়। ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর সহচর হিসেবে পরিচিত খন্দকার মোশতাক আহমদকে ক্ষমতায় বসিয়ে নিজেরা জাতির ওপর ছড়ি ঘোরাতে থাকে। সেনাবাহিনীর সিনিয়র কর্মকর্তারা বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারলেও ঘাতক চক্রের বাড়াবাড়ি, সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড অমান্য করা ইত্যাদি মেনে নিতে পারছিলেন না। তাঁরা যখন কিছু একটা করার পরিকল্পনা করছিলেন, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে যখন একটি পাল্টা ব্যবস্থার প্রস্তুতি সম্পন্ন, তখনই জেলের ভেতরে ৩ নভেম্বর সংঘটিত হয় আরও এক ভয়ংকর হত্যাকাণ্ড। বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত চার সহযোগী, তাঁর অবর্তমানে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে সফল নেতৃত্ব দিয়েছেন, সেই সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে হত্যা করে একই খুনি চক্র।
এর মধ্যে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে শুরু হয় নানা রকম রাজনৈতিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বাধীন জাসদ প্রভাবিত সৈনিক সংস্থা সেনাবাহিনীতে চরম বিশৃঙ্খল অবস্থা তৈরি করতে সক্ষম হয়। ৭ নভেম্বর ঘটে তথাকথিত এক ‘সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থান’। আর ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান।
জিয়াউর রহমানকে বলা হয় ভাগ্যের বরপুত্র। তিনি সেনা কর্মকর্তা থেকে দেশের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্নেহ পেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন তাঁর প্রতি উদার। কিন্তু জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর প্রতি সদয় হতে পারেননি; বরং বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাঁর ছিল একধরনের প্রচ্ছন্ন প্রতিহিংসাপরায়ণ মনোভাব। বঙ্গবন্ধুর প্রতি জিয়া কেন অনুদার ছিলেন, তার কারণ অনুসন্ধান প্রয়োজন। কিন্তু এই প্রয়োজনীয় কাজটি না হওয়ায় জিয়াকে নিয়ে আমাদের দেশে মাতামাতি করার লোকেরও অভাব নেই।
বঙ্গবন্ধুর কারণে সেনাবাহিনীতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে জিয়া পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা এবং হত্যার পর তাঁর নাম ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার সব অপচেষ্টারই মধ্যমণি ছিলেন। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে জিয়াকে যখন পাকিস্তানি অনুচর বলে অভিহিত করা হয়, তখন অনেকেই সেটা মেনে নিতে পারেন না। কারণ, আওয়ামী লীগ জিয়ার বিরুদ্ধে বললে সেটা কারও কারও কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয় না। কারণ, তাঁকে বীর উত্তম খেতাব দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু এবং সেনাবাহিনীর উপপ্রধানও বানিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুই। কেন, কোন পরিস্থিতিতে এসব করা হয়েছিল, তা কেউ খতিয়ে দেখার চেষ্টা করেন না।
আমাদের দেশে একশ্রেণির মানুষের মধ্যে আওয়ামী লীগবিদ্বেষ এতই প্রবল যে, আওয়ামী লীগ তথ্যপ্রমাণনির্ভর কথা বললেও তাঁরা তাকে বানোয়াট মনে করেন। জিয়াউর রহমান যেহেতু আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হয়েছিলেন, সেহেতু তাঁর সুনাম ক্ষুণ্ণ করার জন্যই তাঁকে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানি গুপ্তচর বলে থাকে–এমন ধারণা কারও হতেই পারে।
‘মেজর জিয়া’র নামের সঙ্গে বেশ কিছু মানুষের আবেগ জড়িয়ে আছে। কারণ, তাঁর কণ্ঠ থেকেই প্রথম কেউ কেউ স্বাধীনতার ঘোষণা শুনেছিলেন। তিনি ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ এমন একটি ধারণা নানা প্রচার-অপপ্রচারের মাধ্যমে জনমনে ঠাঁই পেয়েছে। জিয়া মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পেয়েছেন। কাজেই তাঁর মুক্তিযোদ্ধার ভাবমূর্তিও মানুষের মনে উজ্জ্বল। কিন্তু তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।
স্বাধীনতার পর তিনজন (জেনারেল সফিউল্লাহ, জিয়া ও খালেদ মোশাররফ) সেনা কর্মকর্তার মধ্যে ব্যক্তিত্বের বিরোধের কথা কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তার বইয়ে উল্লেখ আছে। জিয়ার আকাঙ্ক্ষা ছিল সেনাবাহিনীর প্রধান হওয়ার। সেটা হতে না পেরে তিনি ক্ষুব্ধ ছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বভাবসুলভ সরলতায় ব্যক্তিগতভাবে জিয়ার প্রতি উদারতা দেখিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু জিয়াকে সেনাবাহিনীর উপপ্রধান বানিয়েছিলেন। তাঁর জন্যই এই পদটি বঙ্গবন্ধু তৈরি করেছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর প্রতি কি জিয়া শতভাগ অনুগত ছিলেন? পরবর্তী ঘটনাবলি থেকে বলা যায়, জিয়া আদতেই বঙ্গবন্ধুর হিতৈষী ছিলেন না।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে প্রকাশ্যে নেতৃত্বদানকারী দুজন–কর্নেল ফারুক ও কর্নেল রশিদ দেশত্যাগ করার পর ব্রিটিশ টেলিভিশন চ্যানেলে এক সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেছিলেন যে, তাঁরা মুজিব হত্যার পরিকল্পনার কথা জিয়াউর রহমানকে জানিয়েছিলেন। এই সাক্ষাৎকারটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছিল। জিয়াউর রহমান তখন অত্যন্ত ‘ক্ষমতাধর’ হয়ে ওঠা সত্ত্বেও কিন্তু খুনি দুই কর্নেলের বক্তব্য অস্বীকার করেননি। বরং তিনি তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন। তিনি যদি দায়িত্ববান হতেন, বঙ্গবন্ধুর প্রতি যদি সামান্য আনুগত্য বা দরদ থাকত, তাহলে হত্যার পরিকল্পনার কথা শুনে ওই দুই কর্নেলকে পুলিশে সোপর্দ করতেন। সেটা না করে উল্টো তাঁদের এগিয়ে যাওয়ার উৎসাহ দিয়েছেন। এত বড় একটি রাষ্ট্রদ্রোহের ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে জেনেও কোনো প্রতিকারের ব্যবস্থা না করে গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ করেছেন জিয়া। সেদিন জিয়া যদি পরিকল্পনাকারীদের আইনের আওতায় আনতেন, তাহলে বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এত বড় বিয়োগান্ত ঘটনা হয়তো ঘটত না।
আসলে জিয়ার অভিলাষ ছিল অন্য রকম। তিনি ইতিহাসের নায়ক হওয়ার লোভে মত্ত হয়ে উঠেছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর শুনেও জিয়ার প্রতিক্রিয়া ছিল রহস্যজনক। তিনি বিচলিত হননি, ভারাক্রান্ত হননি। বিষয়টি তাঁর জানা ছিল বলেই স্বাভাবিক কণ্ঠে বলতে পেরেছেন: ‘সো হোয়াট? লেট ভাইস প্রেসিডেন্ট টেকওভার। উই হ্যাভ নাথিং টু ডু উইথ পলিটিক্স।’ অথচ কী কদর্যভাবেই না তিনি রাজনীতিতে জড়ালেন এবং রাজনীতিকে রাজনীতিবিদদের জন্য ডিফিকাল্ট করে দিলেন!
জিয়া ছিলেন ঠান্ডা মাথার ঘোড়েল খেলোয়াড়। মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের সুনাম কাজে লাগিয়ে তিনি স্বাধীনতাবিরোধীদের পুনর্বাসনের কাজটি ভালোভাবে করেছেন। গোলাম আযমকে দেশে ফিরিয়ে এনেছেন, ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক রাজনীতির জায়গা করে দিয়েছেন। শাহ আজিজের মতো রাজাকারকে প্রধানমন্ত্রী করে জাতিকে অপমানিত করেছেন। জাতীয় ঐক্যের নামে তিনি জাতিকে স্থায়ীভাবে চরম বিভক্তির পথে ঠেলে দিয়েছেন। জয় বাংলা স্লোগান নির্বাসনে পাঠানোর সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নাম মুছে ফেলার সব অপচেষ্টাই করেছেন। পাকিস্তানি পরাজিত সৈনিকরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের যে জায়গায় আত্মসমর্পণ করেছিল, সেখানে শিশুপার্ক বানিয়ে ইতিহাসের সঙ্গে তামাশা করেছিলেন জিয়া। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিদেশি মিশনে চাকরি দিয়ে, তাঁদের বিচারের দায়মুক্তি দিয়ে জিয়া বুঝিয়েছেন–তিনি আসলে কাদের লোক।
জিয়াউর রহমান তথাকথিত সৎ মানুষের কৃত্রিম ইমেজ নিয়ে দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে যে নীতিহীনতার বীজ রোপণ করে গেছেন, তার বিষফল এখন আমরা ভোগ করছি। তবে ইতিহাস কাউকে মার্জনা করে না।
জিয়াউর রহমান ইতিহাসের মহানায়ক শেখ মুজিবকে ইতিহাস থেকে বাদ দেওয়ার ঔদ্ধত্য দেখিয়েছেন; কিন্তু শেখ মুজিবকে তাঁর আসন থেকে সরাতে পারেননি। জিয়ার ভূমিকা নিয়ে আরও বেশি গবেষণা ও সত্যানুসন্ধান প্রয়োজন।
লেখক: সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা।
দলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
১৬ ঘণ্টা আগেশেখ হাসিনা সরকারের পতনের ১০০ দিন পার হয়ে গেছে। ১০০ দিনে অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কিছু যে হয়নি, তা নয়। তবে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে অস্থিরতার লক্ষণ অস্পষ্ট নয়। এর মধ্যেই তিন দফায় উপদেষ্টার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।
১৬ ঘণ্টা আগেবাংলা ভাষায় অতিপরিচিত একটি শব্দবন্ধ হলো ‘খোলনলচে’। যাপিত জীবনে কমবেশি আমরা সবাই শব্দবন্ধটি প্রয়োগ করেছি। বাংলা বাগধারায় আমরা পড়েছি ‘খোলনলচে পালটানো’। বাংলা অভিধানে খোল শব্দের একাধিক অর্থ রয়েছে।
১৬ ঘণ্টা আগেঅফিসে যাতায়াতের সময় স্টাফ বাসে পরিচয়ের সূত্রে ফারজানা আক্তার আজিমপুরে নিজের বাসায় সাবলেট দিয়েছিলেন ফাতেমা আক্তার শাপলা নামের এক নারীকে। কিন্তু ফাতেমা যে একটি প্রতারক চক্রের সদস্য, সেটা তাঁর জানা ছিল না।
১৬ ঘণ্টা আগে