শাইখ সিরাজ(পরিচালক ও বার্তাপ্রধান চ্যানেল আই)
বর্তমানে কৃষির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত। সারা বিশ্বকেই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিকূল পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে; বিশেষ করে আমাদের মতো সমুদ্র নিকটবর্তী দেশগুলো এর প্রভাব টের পাচ্ছে বেশ ভালোভাবেই। কাজের প্রয়োজনে আমাকে ছুটে যেতে হয় দেশের নানা প্রান্তের কৃষকের কাছে। আমি মনে করি, কৃষকই সবচেয়ে বেশি প্রকৃতিমগ্ন।
পেশাগত কারণেই প্রকৃতির নানা অনুষঙ্গ, যেমন রোদ-বৃষ্টি-ঝড় সম্পর্কে সম্যক ধারণা তাঁদের রাখতেই হয়। যুগ যুগ ধরে পরম্পরায় পরিবেশ ও আবহাওয়া সম্পর্কে একধরনের জানা-বোঝা আমাদের দেশের কৃষকের রয়েছে। আকাশ দেখলেই তাঁরা বলে দিতে পারেন ঠিক কতক্ষণ পরে বৃষ্টি হবে। বাতাসে কান পাতলেই তাঁরা বুঝতে পারেন এবারের বর্ষায় বৃষ্টি কতটুকু হবে। পুরোপুরি না মিললেও এই হিসাব-নিকাশগুলো কৃষককে কৃষিকাজে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য সহযোগিতা করেছে দিনের পর দিন। কিন্তু জলবায়ুর পরিবর্তনের এই সময়ে এসে সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে গেছে। অসময়ের বৃষ্টি কিংবা রোদ বদলে দিয়েছে কৃষকের এত বছরের প্রকৃতির পাঠ। ফলে কৃষককেই মুখোমুখি হতে হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবের কাছে। বলতে হচ্ছে, কৃষিই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সবচেয়ে বেশি।
সব কৃষকের কাছেই আমার প্রশ্ন থাকে—আচ্ছা, রোদ-বৃষ্টির হিসাব কি ঠিক আছে? চারা কি সময়মতো গজায়? কৃষকেরা জানান, না, রোদ-বৃষ্টির চিরকালীন যে নিয়ম তা আর আগের মতো নেই। বীজ থেকে চারাও ঠিক আগের সময়ে গজাচ্ছে না। হিসাবগুলো সূক্ষ্ম হলেও প্রভাবটা অনেক বড়।
২০১৭ সালের হাওরের অকাল বন্যার কথা নিশ্চয়ই আপনাদের মনে আছে। বেসরকারি সংগঠন পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার মাঠপর্যায়ের জরিপমতে, অকাল বন্যায় সে বছর হাওরাঞ্চলের সাত জেলায় গড়ে ৭৫ ভাগ ফসল তলিয়ে যায়। এতে হাওরের কৃষকদের ২২ লাখ টন ধান এবং ১১ লাখ ৩৪ হাজার ৬০০টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রায় ২ হাজার টন মাছ, ৩০ হাজার হাঁস মারা গেছে এবং প্রায় ১ হাজার টন সবজি নষ্ট হয়েছে। সব মিলিয়ে অর্থের হিসাবে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা।
সে সময় আমি হাওরাঞ্চল ঘুরে দেখেছি। কথা বলেছি ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সঙ্গে। তাঁরা বলেছেন, আর মাত্র সাত দিন পর ঢলটা এলে এই ১৩ হাজার কোটি টাকা লোকসান হতো না। সরকারের দুর্যোগ-পরবর্তী শক্তিশালী ব্যবস্থাপনার কারণে ওই অঞ্চলের কৃষকেরা অনেকটা ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছিলেন। তা না হলে বড় ধরনের একটা বিপর্যয় ঘটে যেত। শুধু হাওরাঞ্চলের কৃষকেরাই নন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিপৎসীমায় আছে আমাদের সব কৃষক ও কৃষি খাত। তাই এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে এখন থেকেই। যেমনটি ভাবছে উন্নত দেশগুলো।
এই মুহূর্তে মনে পড়ছে পর্তুগালের হুবেল কোম্পানির কথা। বর্তমান সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনকে বড় একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে তারা। তাই তারা এখনই ভাবছে ২০ বছর পরের কৃষি নিয়ে। এ নিয়ে চলছে তাদের নানামুখী গবেষণাও। তারা মনে করছে, পর্তুগালের আগামীর কৃষির মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে সেচব্যবস্থা। সেচের পানি ভয়াবহরকম কমে আসছে। তাই তারা লবণাক্ত পানিসহিষ্ণু জাত তৈরির বিষয়ে গবেষণা করছে। এ ক্ষেত্রে বেশ সাফল্যও পেয়েছে। কিছু জাত তারা উদ্ভাবন করেছে, যেগুলোতে সেচ হিসেবে সমুদ্রের পানি দেওয়া যাবে। ভবিষ্যতে টেকনোলজিই হবে কৃষির প্রাণ।
টেকনোলজিতে যে যত উন্নত হবে, তার আয়ত্তেই থাকবে কৃষি তথা খাদ্যনিরাপত্তা। তাই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জলবায়ুতে বিশ্বের সঙ্গে টিকে থাকতে হলে টেকনোলজিতেও উন্নত হতে হবে আমাদের।
একদিকে আমাদের যেমন অসময়ে বৃষ্টি কৃষির ক্ষতি করছে। অপরদিকে বৃষ্টি না হওয়ায় খরায় উর্বরতা হারাচ্ছে অনেক অঞ্চলের মাটি; বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে এই সমস্যা প্রকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা শুধু আমাদের দেশেই নয়, ইউরোপ-অস্ট্রেলিয়া থেকে শুরু করে সারা বিশ্বকেই এ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। উন্নত বিশ্ব এখন থেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছে পরিবর্তিত জলবায়ুর সঙ্গে খাপ খাইয়ে কৃষিকে এগিয়ে নিতে।
সম্প্রতি চীনেও দেখে এসেছি, তারা প্রযুক্তির মাধ্যমে কৃষিচর্চাকে কতটা গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে তারা যেমন ফল-ফসলের উৎপাদন বাড়িয়েছে, তেমনি অক্ষুণ্ন রাখছে প্রাকৃতিক পরিবেশ।
২০১২ ও ২০১৪ সালে সমুদ্রসীমা জয়ের পর ‘ব্লু-ইকোনমি’র একটা বড় সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হয় আমাদের জন্য। মনে আছে, ২০০৫ সালে আমি ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’-এর প্রোগ্রাম ধারণ করার জন্য জাপানে যাই। সেখানে টোকিও সাগরের দীর্ঘ বালুতটজুড়ে সামুদ্রিক শৈবালের চাষ হতে দেখেছি। জাপানের রেস্তোরাঁয় অনেক খাবারেই সামুদ্রিক শৈবালের উপস্থিতি পেয়েছি। ইতিহাস বলে, ১৬৭০ সালে টোকিও সমুদ্রে প্রথম শৈবালের চাষ শুরু হয়। আর এটা ১৯৪০ সালে বাণিজ্যিক রূপ নেয়।
তারপর জাপান, চীন, কোরিয়া, ফিলিপাইনসহ বিভিন্ন দেশে শৈবাল হয়ে ওঠে এক অনন্য অর্থকরী সবজি। নানা রকম পুষ্টি, ভিটামিন, খনিজ ও আয়োডিনের বিশাল উপাদান আছে এই সামুদ্রিক শৈবালে। জাপান প্রতিবছর ২ বিলিয়ন ডলারের শৈবাল উৎপাদন করে। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাবে, সারা বিশ্বে ২৫ হাজার টন শৈবাল উৎপাদন হয়, যার বাণিজ্যিক মূল্য ৬ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। সেই হিসাবে বাংলাদেশের উপকূলীয় তটরেখার দৈর্ঘ্য প্রায় ৭১০ কিলোমিটার। ১৯টি জেলার ১৪৭টি উপজেলায় মোট ২৫ হাজার
বর্গকিলোমিটার বিস্তৃত এলাকায় শৈবাল চাষ হতে পারে কৃষি তথা ‘ব্লু-ইকোনমি’র নতুন ধারা। কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের যৌথ উদ্যোগে কক্সবাজারে শৈবাল চাষের প্রকল্প বছর চারেক আগে আমি দেখে এসেছিলাম অধ্যাপক আবদুল আজিজের আমন্ত্রণে। পরিকল্পিত উপায়ে শৈবাল চাষ করা গেলে, সেটি যেমন আমাদের পরিবেশের জন্য ভালো হবে, তেমনি অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ একটা অধ্যায় হতে পারে সামুদ্রিক শৈবাল।
‘ব্লু-ইকোনমি’র আরেকটা বড় অধ্যায় সামুদ্রিক মাছ। কাগজে-কলমে আমাদের সামুদ্রিক মাছের প্রজাতির সংখ্যা ৪৭৫ হলেও, বাস্তব অবস্থা কিন্তু ভিন্ন। বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন, সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্র ২৫০-৩০০টি জাতের অস্তিত্বের কথা বলছে। দিন দিন কমে যাচ্ছে সামুদ্রিক মাছের জাত। এর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে ভয়াবহ বিষয় চোখে পড়েছে। গত মার্চে কক্সবাজারের বেশ কিছু সামুদ্রিক মাছের বাজার আমি ঘুরে এসেছি।
যেখানে সরাসরি সমুদ্র থেকে মাছ ধরে এনে জেলেরা বিক্রি করছেন। সেখানে দেখলাম জেলেদের হাতে একেবারে ছোট থেকে শুরু করে মাঝারি বা বড়—কোনো মাছই রক্ষা পাচ্ছে না। জাল এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যাতে ছোট মাছগুলো আটকে যাচ্ছে। বড় মাছ মানুষের খাবার হিসেবে বিক্রি হচ্ছে। ছোট ছোট মাছ সামুদ্রিক ময়লা থেকে পৃথক করা যায় না। সেগুলো মুরগি ও মাছের খাদ্য হিসেবে প্রক্রিয়াজাত করে ফেলা হচ্ছে। অবিচারে সব ধরনের মাছ ধরে ফেলার জন্য দিন দিন সামুদ্রিক মাছের জাত যেমন হারিয়ে যাচ্ছে, তেমনি হুমকির মুখে আছে সামুদ্রিক প্রাণিকুলও।
শুধু মৎস্যই নয়, প্রায় ১ লাখ ১৮ হাজার বর্গকিলোমিটারের ‘ব্লু-স্পেসের’ খনিজ, জ্বালানি ও ওষুধের উপাদান আহরণ নিয়েও আমাদের তেমন কার্যক্রম ও পরিকল্পনা নেই। অন্যদিকে ভারত ও মিয়ানমার ঠিকই সমুদ্রের সম্পদ আহরণে উঠেপড়ে লেগেছে। আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, ইন্দোনেশিয়ার অর্থনীতি ‘ব্লু-ইকোনমি’ তথা সমুদ্রের অর্থনীতির ওপর অনেকাংশই নির্ভরশীল।
বাংলাদেশে পরিবেশের ক্ষতির আরও একটি বড় কারণ আমার মনে হয়, নবায়নযোগ্য জ্বালানির কম ব্যবহার। সেই আশির দশক থেকে বায়োগ্যাস, সৌরশক্তি ব্যবহার করে রান্নাবান্নার কাজ করার জন্য কৃষকদের সচেতন করার কাজ করে আসছি। কিন্তু প্রচারের তুলনায় প্রসার খুব একটা হয়নি। ইউরোপের দেশগুলোতে দেখেছি, বিশেষ করে নেদারল্যান্ডস বা জার্মানিতে বেসরকারিভাবে ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানও বায়োগ্যাসপ্ল্যান্টের মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে শক্তি উৎপাদন করে জাতীয় গ্রিডের সঙ্গে যুক্ত করছে। সরকারও এসব ব্যাপারকে বেশ উৎসাহ দিয়ে আসছে। বিশাল আকারে না হোক, ক্ষুদ্র আকারে প্রতিটি কৃষক যদি নিজের পরিবারের রান্নার কাজটা বায়োগ্যাস বা সৌরশক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে করতে পারে, তাহলে বেঁচে যাবে পরিবেশের অসংখ্য গাছ। বেশি না, পাঁচ বছরেই পাল্টে যাবে বাংলাদেশের পরিবেশের চিত্র। সবুজ-শ্যামল বাংলাদেশ সত্যিই সবুজ হয়ে উঠবে।
কৃষিকে টিকিয়ে রাখতে হলে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্যকে টিকিয়ে রাখতে হবে। যত্ন নিতে হবে পরিবেশের। না বুঝে কৃষকেরাও পরিবেশের ক্ষতি করছেন দেদার। অপরিকল্পিত পুকুর খনন, রাসায়নিকের প্রয়োগ এবং যথেচ্ছভাবে চাষবাস সাময়িক উৎপাদন বৃদ্ধি করলেও, সুদূরপ্রসারী ক্ষতিকর প্রভাব রেখে যাচ্ছে আগামী প্রজন্মের জন্য। এর জন্য মাটিও হারাচ্ছে তার উর্বরতা। তাই কৃষককেও পরিবেশ সংরক্ষণে নিরাপদ কৃষির জন্য সচেতন করে তুলতে হবে। টেকসই উন্নয়নের জন্য দেশের প্রতিজনকেই পরিবেশ সচেতন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার বিকল্প নেই।
বর্তমানে কৃষির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত। সারা বিশ্বকেই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিকূল পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে; বিশেষ করে আমাদের মতো সমুদ্র নিকটবর্তী দেশগুলো এর প্রভাব টের পাচ্ছে বেশ ভালোভাবেই। কাজের প্রয়োজনে আমাকে ছুটে যেতে হয় দেশের নানা প্রান্তের কৃষকের কাছে। আমি মনে করি, কৃষকই সবচেয়ে বেশি প্রকৃতিমগ্ন।
পেশাগত কারণেই প্রকৃতির নানা অনুষঙ্গ, যেমন রোদ-বৃষ্টি-ঝড় সম্পর্কে সম্যক ধারণা তাঁদের রাখতেই হয়। যুগ যুগ ধরে পরম্পরায় পরিবেশ ও আবহাওয়া সম্পর্কে একধরনের জানা-বোঝা আমাদের দেশের কৃষকের রয়েছে। আকাশ দেখলেই তাঁরা বলে দিতে পারেন ঠিক কতক্ষণ পরে বৃষ্টি হবে। বাতাসে কান পাতলেই তাঁরা বুঝতে পারেন এবারের বর্ষায় বৃষ্টি কতটুকু হবে। পুরোপুরি না মিললেও এই হিসাব-নিকাশগুলো কৃষককে কৃষিকাজে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য সহযোগিতা করেছে দিনের পর দিন। কিন্তু জলবায়ুর পরিবর্তনের এই সময়ে এসে সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে গেছে। অসময়ের বৃষ্টি কিংবা রোদ বদলে দিয়েছে কৃষকের এত বছরের প্রকৃতির পাঠ। ফলে কৃষককেই মুখোমুখি হতে হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবের কাছে। বলতে হচ্ছে, কৃষিই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সবচেয়ে বেশি।
সব কৃষকের কাছেই আমার প্রশ্ন থাকে—আচ্ছা, রোদ-বৃষ্টির হিসাব কি ঠিক আছে? চারা কি সময়মতো গজায়? কৃষকেরা জানান, না, রোদ-বৃষ্টির চিরকালীন যে নিয়ম তা আর আগের মতো নেই। বীজ থেকে চারাও ঠিক আগের সময়ে গজাচ্ছে না। হিসাবগুলো সূক্ষ্ম হলেও প্রভাবটা অনেক বড়।
২০১৭ সালের হাওরের অকাল বন্যার কথা নিশ্চয়ই আপনাদের মনে আছে। বেসরকারি সংগঠন পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার মাঠপর্যায়ের জরিপমতে, অকাল বন্যায় সে বছর হাওরাঞ্চলের সাত জেলায় গড়ে ৭৫ ভাগ ফসল তলিয়ে যায়। এতে হাওরের কৃষকদের ২২ লাখ টন ধান এবং ১১ লাখ ৩৪ হাজার ৬০০টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রায় ২ হাজার টন মাছ, ৩০ হাজার হাঁস মারা গেছে এবং প্রায় ১ হাজার টন সবজি নষ্ট হয়েছে। সব মিলিয়ে অর্থের হিসাবে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা।
সে সময় আমি হাওরাঞ্চল ঘুরে দেখেছি। কথা বলেছি ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সঙ্গে। তাঁরা বলেছেন, আর মাত্র সাত দিন পর ঢলটা এলে এই ১৩ হাজার কোটি টাকা লোকসান হতো না। সরকারের দুর্যোগ-পরবর্তী শক্তিশালী ব্যবস্থাপনার কারণে ওই অঞ্চলের কৃষকেরা অনেকটা ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছিলেন। তা না হলে বড় ধরনের একটা বিপর্যয় ঘটে যেত। শুধু হাওরাঞ্চলের কৃষকেরাই নন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিপৎসীমায় আছে আমাদের সব কৃষক ও কৃষি খাত। তাই এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে এখন থেকেই। যেমনটি ভাবছে উন্নত দেশগুলো।
এই মুহূর্তে মনে পড়ছে পর্তুগালের হুবেল কোম্পানির কথা। বর্তমান সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনকে বড় একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে তারা। তাই তারা এখনই ভাবছে ২০ বছর পরের কৃষি নিয়ে। এ নিয়ে চলছে তাদের নানামুখী গবেষণাও। তারা মনে করছে, পর্তুগালের আগামীর কৃষির মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে সেচব্যবস্থা। সেচের পানি ভয়াবহরকম কমে আসছে। তাই তারা লবণাক্ত পানিসহিষ্ণু জাত তৈরির বিষয়ে গবেষণা করছে। এ ক্ষেত্রে বেশ সাফল্যও পেয়েছে। কিছু জাত তারা উদ্ভাবন করেছে, যেগুলোতে সেচ হিসেবে সমুদ্রের পানি দেওয়া যাবে। ভবিষ্যতে টেকনোলজিই হবে কৃষির প্রাণ।
টেকনোলজিতে যে যত উন্নত হবে, তার আয়ত্তেই থাকবে কৃষি তথা খাদ্যনিরাপত্তা। তাই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জলবায়ুতে বিশ্বের সঙ্গে টিকে থাকতে হলে টেকনোলজিতেও উন্নত হতে হবে আমাদের।
একদিকে আমাদের যেমন অসময়ে বৃষ্টি কৃষির ক্ষতি করছে। অপরদিকে বৃষ্টি না হওয়ায় খরায় উর্বরতা হারাচ্ছে অনেক অঞ্চলের মাটি; বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে এই সমস্যা প্রকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা শুধু আমাদের দেশেই নয়, ইউরোপ-অস্ট্রেলিয়া থেকে শুরু করে সারা বিশ্বকেই এ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। উন্নত বিশ্ব এখন থেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছে পরিবর্তিত জলবায়ুর সঙ্গে খাপ খাইয়ে কৃষিকে এগিয়ে নিতে।
সম্প্রতি চীনেও দেখে এসেছি, তারা প্রযুক্তির মাধ্যমে কৃষিচর্চাকে কতটা গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে তারা যেমন ফল-ফসলের উৎপাদন বাড়িয়েছে, তেমনি অক্ষুণ্ন রাখছে প্রাকৃতিক পরিবেশ।
২০১২ ও ২০১৪ সালে সমুদ্রসীমা জয়ের পর ‘ব্লু-ইকোনমি’র একটা বড় সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হয় আমাদের জন্য। মনে আছে, ২০০৫ সালে আমি ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’-এর প্রোগ্রাম ধারণ করার জন্য জাপানে যাই। সেখানে টোকিও সাগরের দীর্ঘ বালুতটজুড়ে সামুদ্রিক শৈবালের চাষ হতে দেখেছি। জাপানের রেস্তোরাঁয় অনেক খাবারেই সামুদ্রিক শৈবালের উপস্থিতি পেয়েছি। ইতিহাস বলে, ১৬৭০ সালে টোকিও সমুদ্রে প্রথম শৈবালের চাষ শুরু হয়। আর এটা ১৯৪০ সালে বাণিজ্যিক রূপ নেয়।
তারপর জাপান, চীন, কোরিয়া, ফিলিপাইনসহ বিভিন্ন দেশে শৈবাল হয়ে ওঠে এক অনন্য অর্থকরী সবজি। নানা রকম পুষ্টি, ভিটামিন, খনিজ ও আয়োডিনের বিশাল উপাদান আছে এই সামুদ্রিক শৈবালে। জাপান প্রতিবছর ২ বিলিয়ন ডলারের শৈবাল উৎপাদন করে। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাবে, সারা বিশ্বে ২৫ হাজার টন শৈবাল উৎপাদন হয়, যার বাণিজ্যিক মূল্য ৬ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। সেই হিসাবে বাংলাদেশের উপকূলীয় তটরেখার দৈর্ঘ্য প্রায় ৭১০ কিলোমিটার। ১৯টি জেলার ১৪৭টি উপজেলায় মোট ২৫ হাজার
বর্গকিলোমিটার বিস্তৃত এলাকায় শৈবাল চাষ হতে পারে কৃষি তথা ‘ব্লু-ইকোনমি’র নতুন ধারা। কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের যৌথ উদ্যোগে কক্সবাজারে শৈবাল চাষের প্রকল্প বছর চারেক আগে আমি দেখে এসেছিলাম অধ্যাপক আবদুল আজিজের আমন্ত্রণে। পরিকল্পিত উপায়ে শৈবাল চাষ করা গেলে, সেটি যেমন আমাদের পরিবেশের জন্য ভালো হবে, তেমনি অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ একটা অধ্যায় হতে পারে সামুদ্রিক শৈবাল।
‘ব্লু-ইকোনমি’র আরেকটা বড় অধ্যায় সামুদ্রিক মাছ। কাগজে-কলমে আমাদের সামুদ্রিক মাছের প্রজাতির সংখ্যা ৪৭৫ হলেও, বাস্তব অবস্থা কিন্তু ভিন্ন। বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন, সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্র ২৫০-৩০০টি জাতের অস্তিত্বের কথা বলছে। দিন দিন কমে যাচ্ছে সামুদ্রিক মাছের জাত। এর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে ভয়াবহ বিষয় চোখে পড়েছে। গত মার্চে কক্সবাজারের বেশ কিছু সামুদ্রিক মাছের বাজার আমি ঘুরে এসেছি।
যেখানে সরাসরি সমুদ্র থেকে মাছ ধরে এনে জেলেরা বিক্রি করছেন। সেখানে দেখলাম জেলেদের হাতে একেবারে ছোট থেকে শুরু করে মাঝারি বা বড়—কোনো মাছই রক্ষা পাচ্ছে না। জাল এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যাতে ছোট মাছগুলো আটকে যাচ্ছে। বড় মাছ মানুষের খাবার হিসেবে বিক্রি হচ্ছে। ছোট ছোট মাছ সামুদ্রিক ময়লা থেকে পৃথক করা যায় না। সেগুলো মুরগি ও মাছের খাদ্য হিসেবে প্রক্রিয়াজাত করে ফেলা হচ্ছে। অবিচারে সব ধরনের মাছ ধরে ফেলার জন্য দিন দিন সামুদ্রিক মাছের জাত যেমন হারিয়ে যাচ্ছে, তেমনি হুমকির মুখে আছে সামুদ্রিক প্রাণিকুলও।
শুধু মৎস্যই নয়, প্রায় ১ লাখ ১৮ হাজার বর্গকিলোমিটারের ‘ব্লু-স্পেসের’ খনিজ, জ্বালানি ও ওষুধের উপাদান আহরণ নিয়েও আমাদের তেমন কার্যক্রম ও পরিকল্পনা নেই। অন্যদিকে ভারত ও মিয়ানমার ঠিকই সমুদ্রের সম্পদ আহরণে উঠেপড়ে লেগেছে। আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, ইন্দোনেশিয়ার অর্থনীতি ‘ব্লু-ইকোনমি’ তথা সমুদ্রের অর্থনীতির ওপর অনেকাংশই নির্ভরশীল।
বাংলাদেশে পরিবেশের ক্ষতির আরও একটি বড় কারণ আমার মনে হয়, নবায়নযোগ্য জ্বালানির কম ব্যবহার। সেই আশির দশক থেকে বায়োগ্যাস, সৌরশক্তি ব্যবহার করে রান্নাবান্নার কাজ করার জন্য কৃষকদের সচেতন করার কাজ করে আসছি। কিন্তু প্রচারের তুলনায় প্রসার খুব একটা হয়নি। ইউরোপের দেশগুলোতে দেখেছি, বিশেষ করে নেদারল্যান্ডস বা জার্মানিতে বেসরকারিভাবে ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানও বায়োগ্যাসপ্ল্যান্টের মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে শক্তি উৎপাদন করে জাতীয় গ্রিডের সঙ্গে যুক্ত করছে। সরকারও এসব ব্যাপারকে বেশ উৎসাহ দিয়ে আসছে। বিশাল আকারে না হোক, ক্ষুদ্র আকারে প্রতিটি কৃষক যদি নিজের পরিবারের রান্নার কাজটা বায়োগ্যাস বা সৌরশক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে করতে পারে, তাহলে বেঁচে যাবে পরিবেশের অসংখ্য গাছ। বেশি না, পাঁচ বছরেই পাল্টে যাবে বাংলাদেশের পরিবেশের চিত্র। সবুজ-শ্যামল বাংলাদেশ সত্যিই সবুজ হয়ে উঠবে।
কৃষিকে টিকিয়ে রাখতে হলে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্যকে টিকিয়ে রাখতে হবে। যত্ন নিতে হবে পরিবেশের। না বুঝে কৃষকেরাও পরিবেশের ক্ষতি করছেন দেদার। অপরিকল্পিত পুকুর খনন, রাসায়নিকের প্রয়োগ এবং যথেচ্ছভাবে চাষবাস সাময়িক উৎপাদন বৃদ্ধি করলেও, সুদূরপ্রসারী ক্ষতিকর প্রভাব রেখে যাচ্ছে আগামী প্রজন্মের জন্য। এর জন্য মাটিও হারাচ্ছে তার উর্বরতা। তাই কৃষককেও পরিবেশ সংরক্ষণে নিরাপদ কৃষির জন্য সচেতন করে তুলতে হবে। টেকসই উন্নয়নের জন্য দেশের প্রতিজনকেই পরিবেশ সচেতন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার বিকল্প নেই।
শেখ হাসিনার পতিত স্বৈরাচারী সরকার সাড়ে ১৫ বছর ধরে এ দেশের জনগণের মাথাপিছু জিডিপি প্রশংসনীয় গতিতে বাড়ার গল্প সাজিয়ে শাসন করেছে। মাথাপিছু জিডিপি প্রকৃতপক্ষে একটি মারাত্মক ত্রুটিপূর্ণ কনসেপ্ট। এটার সবচেয়ে মারাত্মক সীমাবদ্ধতা হলো, এটা একটা গড়, যেটা স্বল্পসংখ্যক ধনী এবং বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্ন-মধ্যবিত্ত
৫ ঘণ্টা আগেআমাদের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস পৃথিবীকে জলবায়ু-বিপর্যয় থেকে রক্ষার জন্য ‘শূন্য বর্জ্য ও শূন্য কার্বন’-এর ওপর ভিত্তি করে একটি নতুন জীবনধারা গড়ে তোলা প্রয়োজন বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন।
৫ ঘণ্টা আগেআমেরিকার ১৩২ বছরের পুরোনো রেকর্ড ভেঙে একবার হেরে যাওয়ার পর দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রথম মেয়াদে ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ট্রাম্প।
৫ ঘণ্টা আগেজগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বড্ড কষ্ট বুকে নিয়েই ‘সব শালারা বাটপার’ স্লোগানটি দিয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরেই তাঁরা দ্বিতীয় ক্যাম্পাস পাচ্ছেন না। ঠিকাদারেরা ভেলকিবাজি করছেন।ক্যাম্পাসের জন্য জমিও অধিগ্রহণ করা হয়নি।
৫ ঘণ্টা আগে