চিররঞ্জন সরকার
আমাদের সমাজ বর্তমানে ভয়ানক রকম অস্থির ও অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছে। চারপাশে তাকালে মনে হয়, মানুষের মধ্যে ধৈর্য-সহ্য সহানুভূতির মতো গুণগুলো যেন প্রায় হারিয়েই গেছে। সব সময় একটা উগ্রতা, একটা লড়াই-লড়াই ভাব সবার মধ্যে।
ভালোবাসা মানুষকে উদার, মহৎ ও বৃহৎ করে। ‘ভালোবাসা’ শব্দটি যে মাধুর্য আর মায়া তৈরি করে, আর কোনো শব্দ বা বর্ণমালা তা করতে পারে না। কেমন যেন দুই হাত দিয়ে ঘিরে রাখা আদর আছে এই শব্দে! ‘ভালোবাসি’ উচ্চারণ করায় যে আলো ঠিকরে বেরোয়, নম্র অথচ দৃপ্ত সেই অলৌকিক আলোর ভেতর একই সঙ্গে নিজের আর ভালোবাসার মানুষটির দুজনেরই শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ পায়। আমি ভালোবাসি আর তোমার ভালোয় বাস করি আমি! তোমার ভালোটিকে চিনে নিয়েছি দেখো ঠিকঠাক! সেই সুরে জলে-স্থলে-কাছে-দূরে সত্যিই বাঁশি বেজে ওঠে! সে বাঁশি চিরকালীন যমুনার দিক থেকেই হোক বা আরশিনগরে বরাবর থেকে যাওয়া ভবঘুরে কাঙালের বুকের ভেতর থেকে উৎসারিত হোক!
আমরা ভালোবাসি শব্দটি সবচেয়ে বেশি উচ্চারণ করি। অপরকে ভালোবাসতে চাই। আবার ভালোবাসাও চাই। অথচ সেই আমরাই কেমন যেন মাঝে মাঝে ভালোবাসাহীন পাষণ্ডে পরিণত হই। তুচ্ছ কারণে ঝগড়া করি, মারামারি করি। এমনকি রক্তারক্তি কাণ্ড বাধাই। অনেক সময় খুন পর্যন্ত করি। তখন মনে হয়, ভালোবাসা যেন আমাদের জীবনে এক অচেনা অতিথি। যে কখনো আসেনি।
সাম্প্রতিক কয়েকটা ঘটনার কথা উল্লেখ করা যাক। রাজধানীর সিটি কলেজ ও ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে গত রোববার এক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে চলা এ সংঘর্ষের জেরে ওই এলাকায় যানজটের সৃষ্টি হয়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর মতে, দুই কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রায়ই নানা
ঘটনা নিয়ে বাদানুবাদ হয়। ওই দিন সিটি কলেজের শিক্ষার্থীরা ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজের ফটকে গিয়ে ‘তোরা মুরগি, সাহস থাকলে বের হ’ বলে চিৎকার করেন।
এরপরই দুই কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে মারামারি বেধে যায়।
মাত্র কয়েক দিন আগে রাজশাহী কলেজের মার্কেটিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের এক ছাত্রকে তাঁর এক সহপাঠী ছুরিকাঘাত করেন। ফেসবুক পোস্টে হাসির ইমোজি দেওয়ায় ঘটে এমন নৃশংস ঘটনা। এর আগে বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা চলাকালে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা দলের সমর্থনকে কেন্দ্র করে দেশের নানা জায়গায় সংঘাত-সংঘর্ষ ঘটেছে। এতে অনেকের প্রাণহানিও ঘটেছে।
এ ধরনের ঘটনা যারা ঘটায়, তাদের হৃদয়ে কি আদৌ কোনো প্রেম আছে? কিংবা ভালোবাসা? কারও হৃদয়ে যদি প্রকৃত ভালোবাসা থাকে, সে কখনো আরেক জনকে রক্তাক্ত করতে পারে না। খুন তো নয়ই। ভালোবাসা কম, তা আমরা সবাই বুঝলেও মাঝে মাঝে কেন জানি নতুন করে ভালোবাসার সংজ্ঞা খুঁজে ফিরি। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘তোমরা যে বলো দিবস রজনী ভালোবাসা, ভালোবাসা, সখী ভালোবাসা কারে কয়?’
‘এখনও বুঝি না ভালো, কাকে ঠিক ভালোবাসা বলে’—কবি শঙ্খ ঘোষ বলেছিলেন। ভালোবাসার মতোই ভালোবাসার দিন নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন অনেকেই। কিন্তু আপনি মানুন আর না মানুন, পয়লা ফাল্গুন আর তার পরের দিনটি নতুন প্রজন্মের বাঙালির কাছে উৎসবের দিন। পয়লা ফাল্গুন বসন্তের প্রথম দিন। আর এর পরের দিনটিই ভালোবাসা বা প্রেমের দিন হিসেবে পালন করা হচ্ছে। তবে নতুন দিনপঞ্জিকা অনুযায়ী, এবার দুটি দিবস একই দিনে হয়ে গেছে। বসন্ত আর ভালোবাসা যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।
এদিন সোশ্যাল মিডিয়ানির্ভর নতুন প্রজন্ম উৎসবে মেতে ওঠে। মেয়েরা বাসন্তী রঙের শাড়ি পরে। খোঁপায় ফুল জড়ায়। ছেলেরা হলুদ কিংবা লাল রঙের পাঞ্জাবি পরে। রঙিন প্রজাপতির মতো এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়ায়। বিভিন্ন ক্যাফে-হোটেল-রেস্টুরেন্টে ভিড় জমায়। নানা ঢংয়ে ছবি তুলে ফেসবুক সয়লাব করে।
আমাদের দেশের কবি-সাহিত্যিকেরা ফাল্গুন বা বসন্ত নিয়ে মাতামাতি করলেও ভালোবাসা দিবস ছিল তাঁদের কাছে একেবারেই অচেনা। মাত্র তিন দশক আগে বিশ্বায়নের ঢেউ থেকে বাংলাদেশের উচ্চবিত্ত সমাজের উঠোনে প্রথম ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’ বা ভালোবাসা দিবস উঁকি মারে। এরপর করপোরেট পুঁজির প্রচার-প্রচারণায় তা উচ্চবিত্তের আঙিনা পেরিয়ে মধ্যবিত্তের মনোভূমিতেও একটু একটু করে বাসা বাঁধে। এখন তো এটা প্রায় জাতীয় দিবসের রূপ পেয়েছে। ভ্যালেন্টাইনস ডে নিয়ে এখন রীতিমতো উন্মাদনা চলছে।
অনেকে বলেন, এ দিবসটি নিয়ে এত রক্ষণশীলতার কী আছে? এটা তো খুনখারাবি কিংবা ধ্বংসাত্মক কোনো ব্যাপার নয়, ভালোবাসার এবং ভালোবাসবার
একটি দিন। ভালোবাসার চেয়ে পবিত্র, এর চেয়ে প্রয়োজনীয় জিনিস এই বিশ্বসংসারে দ্বিতীয়টি আছে কি? এ দিনটি নিয়ে মাতামাতি এমনকি যদি বাড়াবাড়িও কিছু
হয়, তো ক্ষতি কি? অনেকে আবার পাল্টা যুক্তি দেন, ভালোবাসা কি কেবল এক দিনের ব্যাপার যে ভালোবাসার জন্য একটা দিবস পালন করতে হবে? এই দিনই আমরা কেবল ভালোবাসব, ভালোবাসার কথা বলব? আর বাকি দিনগুলো হৃদয়হীন পাষাণ হয়ে বসে থাকব?
কেউ কেউ আবার বাজার সংস্কৃতির দোহাই দেন। এ ধরনের দিবসের হুজুগে মাতিয়ে রেখে ব্যবসায়ীরা আসলে তাঁদের পণ্য বিক্রির সুযোগ নেন। এটা আসলে পোশাকসহ বিভিন্ন রকম পণ্যসামগ্রী, কার্ড আর চকলেট কোম্পানিগুলোর পকেট-ভর্তির দিন! আবার কেউ কেউ মনে করেন, ভ্যালেন্টাইনস ডে আসলে একটা খেলনার মতো। সবাই যেটা নিয়ে এক দিনের জন্য খেলা করতে চায়। আপনার যদি যথেচ্ছ টাকা ও ইচ্ছে থাকে এবং এই ভোগবাদী উৎসবে কাউকে নিজের করে পেতে ইচ্ছে করে, তাহলে আপনিও এই এক দিনের মজা চেটেপুটে নিতে পারেন!
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক, আজ বসন্ত!’ প্রকৃতিতে যেমন ফুল না ফুটলেও, কোকিলের কুহুধ্বনি শোনা না গেলেও ঋতুচক্রের হিসাবমতে, বসন্তদিন আসে, ঠিক তেমনি আমি-আপনি মানি আর না মানি, আমাদের অন্তরে প্রেম-ভালোবাসার যতই ঘাটতি থাক, আজ ভালোবাসা দিবস। আজ ফাগুনের মাতাল হাওয়ায় ভেসে ভেসে অসংখ্য নারী বাসন্তী রঙে নিজেদের রাঙিয়ে রাজধানীর রাজপথ, পার্ক, বইমেলা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ চত্বরসহ পুরো নগরী সুশোভিত করে তুলবে। গালে আঁকবে নানা রঙের বসন্তবরণ উলকি, মাথায় ফুলের তাজ।
ভালোবাসা দিবস যেন শুধু একটি ছেলে মেয়েকে অথবা একটি মেয়ে ছেলেকে ভালোবাসার মধ্যে সীমাবদ্ধ না হয়ে পড়ে। আমরা যেন সবাই সবাইকে ভালোবাসতে পারি, শুধু এক দিন নয়, প্রতিদিন ভালোবাসতে পারি—সেই অঙ্গীকার প্রয়োজন। আমাদের সমাজ বর্তমানে ভয়ানক রকম অস্থির ও অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছে। চারপাশে তাকালে মনে হয়, মানুষের মধ্যে ধৈর্য-সহ্য সহানুভূতির মতো গুণগুলো যেন প্রায় হারিয়েই গেছে। সব সময় একটা উগ্রতা, একটা লড়াই-লড়াই ভাব সবার মধ্যে। কেউ কাউকে সহ্য করতে পারে না। অন্যের ভালো দেখলে যেন বুক জ্বলে যায়। সে জ্বালা মেটাতেই সংশ্লিষ্টের সর্বনাশের চিন্তা চড়বড় করে ওঠে যেন মাথায়! আর তার পরিণতিতেই ঘটে যায় অপ্রীতিকর মর্মান্তিক ভয়াবহ সব ঘটনা। বদমেজাজ, বেহিসেবিপনা, উড়নচণ্ডীবৃত্তি আর স্বার্থপূরণের উচ্চাশা ঘরসংসার, আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে মানুষের দূরত্ব যেন বাড়িয়েই চলেছে। সেই গোদের ওপর বিষফোড়ার মতো জেগেছে ফেসবুক, মেসেঞ্জার, টুইটার, ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপের মতো হাজারো সোশ্যাল নেটওয়ার্ক! পাশাপাশি বসে মনের কথা বলার অভ্যাসটাই নষ্ট করে দিচ্ছে এই সব যান্ত্রিক ব্যাপার-স্যাপার।
সব মিলিয়ে হয়তো আমাদের চিরাচরিত সম্পর্কের বাঁধনগুলোই আলগা এবং ক্ষেত্রবিশেষে অপ্রয়োজনীয় ঠেকছে মানুষের কাছে। নিজের স্বার্থ, নিজের সুখ, নিজের ইচ্ছে, নিজের সুবিধেটাই বড় হয়ে উঠছে। আমাদের স্নেহ-ভালোবাসার সম্পর্কগুলোর স্বাভাবিকতা যথাযথভাবে বজায় আছে—জোর গলায় পূর্ণ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এমন দাবিও কি করতে পারছি আমরা? নাকি আমাদের সম্পর্কগুলোর স্থায়িত্ব নিয়ে দিনের পর দিন সংশয়টাই বাড়ছে, বেড়েই চলেছে? তাহলে আর বসন্তবরণ কিংবা ভালোবাসা দিবস পালনের গুরুত্ব কোথায়?
বসন্ত ও ভালোবাসা দিবস মানে এখন জড়তাকে ঝেড়ে ফেলা, নতুন প্রাণের কলরব, একে অপরের হাত ধরে হাঁটা। আমরা জানি, জীবন সব সময় সুখের নয়। বিবাদ, অশান্তি, দুঃখ-দুর্দশা সেখানে আছেই। এসব নিয়েই আমাদের চলতে হয়। কিন্তু দুঃখ-অশান্তির কালিমায় মন আবৃত রাখলে কি আমাদের জীবন সুচারুরূপে চলবে? না। কারণ, জীবন পরিবর্তনশীল। আর বসন্তবরণ বা ভালোবাসা দিবসের উৎসবের মধ্যে রয়েছে সেই উৎসাহের বার্তা। যে উৎসব বার্তা দেয় সব দুঃখ-দৈন্য তুচ্ছ হোক, মুছে যাক সব ক্লেদ-কালিমা, জীবন পূর্ণ হোক আনন্দরসে। আমরা আরও প্রত্যাশা করি, আমাদের জীবনে, সমাজে, রাজনীতিতে বসন্ত-বাতাস বয়ে যাক, প্রতিষ্ঠিত হোক গণতান্ত্রিক-সংস্কৃতি, ঘুচে যাক বিদ্বেষ-হানাহানি।
চিররঞ্জন সরকার, গবেষক ও কলামিস্ট
আমাদের সমাজ বর্তমানে ভয়ানক রকম অস্থির ও অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছে। চারপাশে তাকালে মনে হয়, মানুষের মধ্যে ধৈর্য-সহ্য সহানুভূতির মতো গুণগুলো যেন প্রায় হারিয়েই গেছে। সব সময় একটা উগ্রতা, একটা লড়াই-লড়াই ভাব সবার মধ্যে।
ভালোবাসা মানুষকে উদার, মহৎ ও বৃহৎ করে। ‘ভালোবাসা’ শব্দটি যে মাধুর্য আর মায়া তৈরি করে, আর কোনো শব্দ বা বর্ণমালা তা করতে পারে না। কেমন যেন দুই হাত দিয়ে ঘিরে রাখা আদর আছে এই শব্দে! ‘ভালোবাসি’ উচ্চারণ করায় যে আলো ঠিকরে বেরোয়, নম্র অথচ দৃপ্ত সেই অলৌকিক আলোর ভেতর একই সঙ্গে নিজের আর ভালোবাসার মানুষটির দুজনেরই শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ পায়। আমি ভালোবাসি আর তোমার ভালোয় বাস করি আমি! তোমার ভালোটিকে চিনে নিয়েছি দেখো ঠিকঠাক! সেই সুরে জলে-স্থলে-কাছে-দূরে সত্যিই বাঁশি বেজে ওঠে! সে বাঁশি চিরকালীন যমুনার দিক থেকেই হোক বা আরশিনগরে বরাবর থেকে যাওয়া ভবঘুরে কাঙালের বুকের ভেতর থেকে উৎসারিত হোক!
আমরা ভালোবাসি শব্দটি সবচেয়ে বেশি উচ্চারণ করি। অপরকে ভালোবাসতে চাই। আবার ভালোবাসাও চাই। অথচ সেই আমরাই কেমন যেন মাঝে মাঝে ভালোবাসাহীন পাষণ্ডে পরিণত হই। তুচ্ছ কারণে ঝগড়া করি, মারামারি করি। এমনকি রক্তারক্তি কাণ্ড বাধাই। অনেক সময় খুন পর্যন্ত করি। তখন মনে হয়, ভালোবাসা যেন আমাদের জীবনে এক অচেনা অতিথি। যে কখনো আসেনি।
সাম্প্রতিক কয়েকটা ঘটনার কথা উল্লেখ করা যাক। রাজধানীর সিটি কলেজ ও ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে গত রোববার এক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে চলা এ সংঘর্ষের জেরে ওই এলাকায় যানজটের সৃষ্টি হয়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর মতে, দুই কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রায়ই নানা
ঘটনা নিয়ে বাদানুবাদ হয়। ওই দিন সিটি কলেজের শিক্ষার্থীরা ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজের ফটকে গিয়ে ‘তোরা মুরগি, সাহস থাকলে বের হ’ বলে চিৎকার করেন।
এরপরই দুই কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে মারামারি বেধে যায়।
মাত্র কয়েক দিন আগে রাজশাহী কলেজের মার্কেটিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের এক ছাত্রকে তাঁর এক সহপাঠী ছুরিকাঘাত করেন। ফেসবুক পোস্টে হাসির ইমোজি দেওয়ায় ঘটে এমন নৃশংস ঘটনা। এর আগে বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা চলাকালে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা দলের সমর্থনকে কেন্দ্র করে দেশের নানা জায়গায় সংঘাত-সংঘর্ষ ঘটেছে। এতে অনেকের প্রাণহানিও ঘটেছে।
এ ধরনের ঘটনা যারা ঘটায়, তাদের হৃদয়ে কি আদৌ কোনো প্রেম আছে? কিংবা ভালোবাসা? কারও হৃদয়ে যদি প্রকৃত ভালোবাসা থাকে, সে কখনো আরেক জনকে রক্তাক্ত করতে পারে না। খুন তো নয়ই। ভালোবাসা কম, তা আমরা সবাই বুঝলেও মাঝে মাঝে কেন জানি নতুন করে ভালোবাসার সংজ্ঞা খুঁজে ফিরি। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘তোমরা যে বলো দিবস রজনী ভালোবাসা, ভালোবাসা, সখী ভালোবাসা কারে কয়?’
‘এখনও বুঝি না ভালো, কাকে ঠিক ভালোবাসা বলে’—কবি শঙ্খ ঘোষ বলেছিলেন। ভালোবাসার মতোই ভালোবাসার দিন নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন অনেকেই। কিন্তু আপনি মানুন আর না মানুন, পয়লা ফাল্গুন আর তার পরের দিনটি নতুন প্রজন্মের বাঙালির কাছে উৎসবের দিন। পয়লা ফাল্গুন বসন্তের প্রথম দিন। আর এর পরের দিনটিই ভালোবাসা বা প্রেমের দিন হিসেবে পালন করা হচ্ছে। তবে নতুন দিনপঞ্জিকা অনুযায়ী, এবার দুটি দিবস একই দিনে হয়ে গেছে। বসন্ত আর ভালোবাসা যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।
এদিন সোশ্যাল মিডিয়ানির্ভর নতুন প্রজন্ম উৎসবে মেতে ওঠে। মেয়েরা বাসন্তী রঙের শাড়ি পরে। খোঁপায় ফুল জড়ায়। ছেলেরা হলুদ কিংবা লাল রঙের পাঞ্জাবি পরে। রঙিন প্রজাপতির মতো এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়ায়। বিভিন্ন ক্যাফে-হোটেল-রেস্টুরেন্টে ভিড় জমায়। নানা ঢংয়ে ছবি তুলে ফেসবুক সয়লাব করে।
আমাদের দেশের কবি-সাহিত্যিকেরা ফাল্গুন বা বসন্ত নিয়ে মাতামাতি করলেও ভালোবাসা দিবস ছিল তাঁদের কাছে একেবারেই অচেনা। মাত্র তিন দশক আগে বিশ্বায়নের ঢেউ থেকে বাংলাদেশের উচ্চবিত্ত সমাজের উঠোনে প্রথম ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’ বা ভালোবাসা দিবস উঁকি মারে। এরপর করপোরেট পুঁজির প্রচার-প্রচারণায় তা উচ্চবিত্তের আঙিনা পেরিয়ে মধ্যবিত্তের মনোভূমিতেও একটু একটু করে বাসা বাঁধে। এখন তো এটা প্রায় জাতীয় দিবসের রূপ পেয়েছে। ভ্যালেন্টাইনস ডে নিয়ে এখন রীতিমতো উন্মাদনা চলছে।
অনেকে বলেন, এ দিবসটি নিয়ে এত রক্ষণশীলতার কী আছে? এটা তো খুনখারাবি কিংবা ধ্বংসাত্মক কোনো ব্যাপার নয়, ভালোবাসার এবং ভালোবাসবার
একটি দিন। ভালোবাসার চেয়ে পবিত্র, এর চেয়ে প্রয়োজনীয় জিনিস এই বিশ্বসংসারে দ্বিতীয়টি আছে কি? এ দিনটি নিয়ে মাতামাতি এমনকি যদি বাড়াবাড়িও কিছু
হয়, তো ক্ষতি কি? অনেকে আবার পাল্টা যুক্তি দেন, ভালোবাসা কি কেবল এক দিনের ব্যাপার যে ভালোবাসার জন্য একটা দিবস পালন করতে হবে? এই দিনই আমরা কেবল ভালোবাসব, ভালোবাসার কথা বলব? আর বাকি দিনগুলো হৃদয়হীন পাষাণ হয়ে বসে থাকব?
কেউ কেউ আবার বাজার সংস্কৃতির দোহাই দেন। এ ধরনের দিবসের হুজুগে মাতিয়ে রেখে ব্যবসায়ীরা আসলে তাঁদের পণ্য বিক্রির সুযোগ নেন। এটা আসলে পোশাকসহ বিভিন্ন রকম পণ্যসামগ্রী, কার্ড আর চকলেট কোম্পানিগুলোর পকেট-ভর্তির দিন! আবার কেউ কেউ মনে করেন, ভ্যালেন্টাইনস ডে আসলে একটা খেলনার মতো। সবাই যেটা নিয়ে এক দিনের জন্য খেলা করতে চায়। আপনার যদি যথেচ্ছ টাকা ও ইচ্ছে থাকে এবং এই ভোগবাদী উৎসবে কাউকে নিজের করে পেতে ইচ্ছে করে, তাহলে আপনিও এই এক দিনের মজা চেটেপুটে নিতে পারেন!
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক, আজ বসন্ত!’ প্রকৃতিতে যেমন ফুল না ফুটলেও, কোকিলের কুহুধ্বনি শোনা না গেলেও ঋতুচক্রের হিসাবমতে, বসন্তদিন আসে, ঠিক তেমনি আমি-আপনি মানি আর না মানি, আমাদের অন্তরে প্রেম-ভালোবাসার যতই ঘাটতি থাক, আজ ভালোবাসা দিবস। আজ ফাগুনের মাতাল হাওয়ায় ভেসে ভেসে অসংখ্য নারী বাসন্তী রঙে নিজেদের রাঙিয়ে রাজধানীর রাজপথ, পার্ক, বইমেলা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ চত্বরসহ পুরো নগরী সুশোভিত করে তুলবে। গালে আঁকবে নানা রঙের বসন্তবরণ উলকি, মাথায় ফুলের তাজ।
ভালোবাসা দিবস যেন শুধু একটি ছেলে মেয়েকে অথবা একটি মেয়ে ছেলেকে ভালোবাসার মধ্যে সীমাবদ্ধ না হয়ে পড়ে। আমরা যেন সবাই সবাইকে ভালোবাসতে পারি, শুধু এক দিন নয়, প্রতিদিন ভালোবাসতে পারি—সেই অঙ্গীকার প্রয়োজন। আমাদের সমাজ বর্তমানে ভয়ানক রকম অস্থির ও অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছে। চারপাশে তাকালে মনে হয়, মানুষের মধ্যে ধৈর্য-সহ্য সহানুভূতির মতো গুণগুলো যেন প্রায় হারিয়েই গেছে। সব সময় একটা উগ্রতা, একটা লড়াই-লড়াই ভাব সবার মধ্যে। কেউ কাউকে সহ্য করতে পারে না। অন্যের ভালো দেখলে যেন বুক জ্বলে যায়। সে জ্বালা মেটাতেই সংশ্লিষ্টের সর্বনাশের চিন্তা চড়বড় করে ওঠে যেন মাথায়! আর তার পরিণতিতেই ঘটে যায় অপ্রীতিকর মর্মান্তিক ভয়াবহ সব ঘটনা। বদমেজাজ, বেহিসেবিপনা, উড়নচণ্ডীবৃত্তি আর স্বার্থপূরণের উচ্চাশা ঘরসংসার, আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে মানুষের দূরত্ব যেন বাড়িয়েই চলেছে। সেই গোদের ওপর বিষফোড়ার মতো জেগেছে ফেসবুক, মেসেঞ্জার, টুইটার, ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপের মতো হাজারো সোশ্যাল নেটওয়ার্ক! পাশাপাশি বসে মনের কথা বলার অভ্যাসটাই নষ্ট করে দিচ্ছে এই সব যান্ত্রিক ব্যাপার-স্যাপার।
সব মিলিয়ে হয়তো আমাদের চিরাচরিত সম্পর্কের বাঁধনগুলোই আলগা এবং ক্ষেত্রবিশেষে অপ্রয়োজনীয় ঠেকছে মানুষের কাছে। নিজের স্বার্থ, নিজের সুখ, নিজের ইচ্ছে, নিজের সুবিধেটাই বড় হয়ে উঠছে। আমাদের স্নেহ-ভালোবাসার সম্পর্কগুলোর স্বাভাবিকতা যথাযথভাবে বজায় আছে—জোর গলায় পূর্ণ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এমন দাবিও কি করতে পারছি আমরা? নাকি আমাদের সম্পর্কগুলোর স্থায়িত্ব নিয়ে দিনের পর দিন সংশয়টাই বাড়ছে, বেড়েই চলেছে? তাহলে আর বসন্তবরণ কিংবা ভালোবাসা দিবস পালনের গুরুত্ব কোথায়?
বসন্ত ও ভালোবাসা দিবস মানে এখন জড়তাকে ঝেড়ে ফেলা, নতুন প্রাণের কলরব, একে অপরের হাত ধরে হাঁটা। আমরা জানি, জীবন সব সময় সুখের নয়। বিবাদ, অশান্তি, দুঃখ-দুর্দশা সেখানে আছেই। এসব নিয়েই আমাদের চলতে হয়। কিন্তু দুঃখ-অশান্তির কালিমায় মন আবৃত রাখলে কি আমাদের জীবন সুচারুরূপে চলবে? না। কারণ, জীবন পরিবর্তনশীল। আর বসন্তবরণ বা ভালোবাসা দিবসের উৎসবের মধ্যে রয়েছে সেই উৎসাহের বার্তা। যে উৎসব বার্তা দেয় সব দুঃখ-দৈন্য তুচ্ছ হোক, মুছে যাক সব ক্লেদ-কালিমা, জীবন পূর্ণ হোক আনন্দরসে। আমরা আরও প্রত্যাশা করি, আমাদের জীবনে, সমাজে, রাজনীতিতে বসন্ত-বাতাস বয়ে যাক, প্রতিষ্ঠিত হোক গণতান্ত্রিক-সংস্কৃতি, ঘুচে যাক বিদ্বেষ-হানাহানি।
চিররঞ্জন সরকার, গবেষক ও কলামিস্ট
শেখ হাসিনার পতিত স্বৈরাচারী সরকার সাড়ে ১৫ বছর ধরে এ দেশের জনগণের মাথাপিছু জিডিপি প্রশংসনীয় গতিতে বাড়ার গল্প সাজিয়ে শাসন করেছে। মাথাপিছু জিডিপি প্রকৃতপক্ষে একটি মারাত্মক ত্রুটিপূর্ণ কনসেপ্ট। এটার সবচেয়ে মারাত্মক সীমাবদ্ধতা হলো, এটা একটা গড়, যেটা স্বল্পসংখ্যক ধনী এবং বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্ন-মধ্যবিত্ত
১০ ঘণ্টা আগেআমাদের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস পৃথিবীকে জলবায়ু-বিপর্যয় থেকে রক্ষার জন্য ‘শূন্য বর্জ্য ও শূন্য কার্বন’-এর ওপর ভিত্তি করে একটি নতুন জীবনধারা গড়ে তোলা প্রয়োজন বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন।
১০ ঘণ্টা আগেআমেরিকার ১৩২ বছরের পুরোনো রেকর্ড ভেঙে একবার হেরে যাওয়ার পর দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রথম মেয়াদে ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ট্রাম্প।
১০ ঘণ্টা আগেজগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বড্ড কষ্ট বুকে নিয়েই ‘সব শালারা বাটপার’ স্লোগানটি দিয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরেই তাঁরা দ্বিতীয় ক্যাম্পাস পাচ্ছেন না। ঠিকাদারেরা ভেলকিবাজি করছেন।ক্যাম্পাসের জন্য জমিও অধিগ্রহণ করা হয়নি।
১০ ঘণ্টা আগে