এ কে এম শামসুদ্দিন
গত ২৭ জুলাই ‘জাতীয় পাবলিক সার্ভিস দিবস’ ও ‘জনপ্রশাসন পদক ২০২০-২১’ প্রদান অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রজাতন্ত্রের সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জনগণের শাসক নয়, সেবক হিসেবে কাজ করবে।’ গত কয়েক বছরে কিছু কিছু সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীর আচরণ এমন নিম্নপর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে যে পুরো সার্ভিস ক্যাডার সম্পর্কেই সাধারণ জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। অতীতে এসব নিয়ে অবশ্য কম সমালোচনা হয়নি; বর্তমানেও প্রচুর লেখালেখি হচ্ছে। কিন্তু অবস্থার উন্নতির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। অবস্থাগতিকে মনে হয়, সরকারি কর্মকর্তারা আজকাল সবকিছুর ঊর্ধ্বে নিজেদের স্থান দেওয়ার চেষ্টা করছেন। সরকারের কিছু কিছু দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাঁদের এই অবস্থান ধরে রাখার জন্য বিভিন্ন বিধিবিধান ও আইনও পাস করিয়ে নিচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যটি খুবই প্রাসঙ্গিক।
তবে দেশের বর্তমান সংকটকালে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রাজনীতিকদের পাশ কাটিয়ে আমলানির্ভরতাও এর জন্য দায়ী, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রশাসনের উচ্চপর্যায় থেকে মাঠপর্যায় পর্যন্ত ক্ষমতাচর্চায়, দৃষ্টিকটুভাবে জনপ্রতিনিধিদের টেক্কা দিতেও আমলারা পিছপা হচ্ছেন না।
এ কথা ঠিক, এক যুগ ধরে দুর্নীতির দুর্বৃত্তায়ন দেশকে এমনভাবে গ্রাস করে চলেছে, এই প্রবণতা ভবিষ্যতে কোথায় গিয়ে যে ঠেকে, বলা মুশকিল। বড় বড় দুর্নীতি করে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রশ্রয়ে দুর্নীতিবাজেরা যেভাবে পরিত্রাণ পেয়ে যাচ্ছে, তাতে দুর্নীতিকেই উৎসাহিত করা হচ্ছে। ক্ষমতাধর রাজনীতিবিদ ও আমলা সমন্বিত সিন্ডিকেট যখন দুর্নীতির একই ঘাটে জল খেতে শুরু করে, তখন তা দমন করা সত্যিই দুরূহ হয়ে পড়ে।
আমলাদের দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার খবর স্বাধীনতার পর থেকেই শুনে আসছি। ১৯৭২-৭৩ সালে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল সফরকালে বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একবার তাঁর বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘এত চোরের চোর। চোর কোথা থেকে যে পয়দা হয়েছে, আমি জানি না। পাকিস্তানিরা সব নিয়ে গেছে কিন্তু এই চোরগুলো রেখে গেছে আমার কাছে। এই চোরগুলো নিয়ে গেলে আমি বাঁচতাম। শতকরা ২০ জন লোক শিক্ষিত। তার মধ্যে শতকরা ৫ জন আমরা বলতে পারি উচ্চশিক্ষিত। আজকে একটা প্রশ্ন আমার, এই যে দুর্নীতির কথা বললাম, আমার কৃষক দুর্নীতিবাজ? নাহ্…। আমার শ্রমিক? নাহ্…। তাহলে কে…? ঘুষ খায় কারা? স্মাগলিং করে কারা? বিদেশি এজেন্ট হয় কারা? বিদেশে টাকা চালান করে কারা? এই আমরা যারা শতকরা ৫ জন শিক্ষিত লোক, এই আমাদের মধ্যে ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ। এবং এই আমাদের চরিত্রের সংশোধন করতে হবে, আত্মসমালোচনা করতে হবে। এসব দুর্নীতিবাজ এই শতকরা ৫ জনের মধ্যেই, এর বাইরে নাই। কেন নাই...? কারণ আমার কৃষক দিনভর পরিশ্রম করে। সবাইকে আজ একটি কথা বলব, আমাদের চরিত্রের পরিবর্তন হয় নাই।’ বঙ্গবন্ধু অন্য আরেকটি অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘আমার দেশের গরিব মানুষের ট্যাক্সের টাকায় লেখাপড়া করে আজ আপনারা বড় বড় কর্মকর্তা। আমার এই জনগণের সেবায় আপনাদের নিজেদের উৎসর্গ করতে হবে। সবকিছুর ঊর্ধ্বে জাতির স্বার্থকে স্থান দিতে হবে।’
গত ২৭ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ভাষণেরই যেন প্রতিধ্বনি ঘটেছে। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর ভাষণের উদ্ধৃতি তুলে ধরে বলেন, সে সময় জাতির পিতা বলেছিলেন, ‘সরকারি কর্মচারীদের আমি অনুরোধ করি, যাদের অর্থে আমাদের সংসার চলে, তাদের সেবা করুন, তাদের যাতে কষ্ট না হয় তার দিকে খেয়াল রাখুন। তাদের প্রতি কোনো অন্যায় আচরণ করবেন না। তাহলে আল্লাহর আরশ পর্যন্ত কেঁপে উঠবে। আপনাদের কাছে অনুরোধ রইল, আপনারা মানুষের সেবা করুন। মানুষের সেবার মতো শান্তি দুনিয়ার আর কিছুতে হয় না। একজন গরিব যদি হাত তুলে আপনার জন্য দোয়া করেন, আল্লাহ সেটা কবুল করে নেন।’ বঙ্গবন্ধুকে উদ্ধৃত করে প্রধানমন্ত্রীর এই মূল্যবান বক্তব্যগুলো সরকারি কর্মকর্তাদের কানে পৌঁছালেও বাস্তব ক্ষেত্রে এর কতটুকু প্রতিফলন ঘটে, তা খুলে বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।
আমলাতন্ত্র এক অদ্ভুত রাষ্ট্রশাসন পদ্ধতি। আমলাতন্ত্র দেশের নাগরিকদের কাছে যত ঘোরপ্যাঁচের মনে হোক না কেন, রাষ্ট্র পরিচালনায় এর বিকল্পও নেই। এ প্রসঙ্গে সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের ভাষায় বলতে হয়, ‘আমলাতন্ত্রের বিকল্প কেউ বের করতে পারেনি। রাশিয়া চেষ্টা করে পারেনি; চীনও পারেনি। ফেরাউনও পারেনি। সেই মহান আমলাতন্ত্র আমাদের মাঝেও আছে।’
এ ভূখণ্ডে ইংরেজ আমলেই আমলাতন্ত্রের গোড়াপত্তন হয়। সে আমলে কিছু উচ্চপদস্থ কর্মচারী দেশ শাসনে ইংরেজদের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন। রবার্ট ক্লাইভ তাঁর শাসনব্যবস্থায় সনাতন আমলাতন্ত্র প্রায় পুরোপুরি অব্যাহত রাখলেও ওয়ারেন হেস্টিংস আমলাতন্ত্রে কিছুটা পরিবর্তন এনেছিলেন। তিনি এমন এক নতুন আমলাতন্ত্রের প্রবর্তন করেন, যাতে ইউরোপীয়দের সংখ্যাধিক্য ও প্রাধান্য বজায় থাকে। উচ্চপদগুলো থাকত ইউরোপীয়দের দখলে আর নিম্নপদে নিয়োগ দেওয়া হতো স্থানীয় ব্যক্তিদের। কিন্তু লর্ড কর্নওয়ালিশ স্থানীয় কর্মচারীসমেত এই মিশ্রিত আমলাতন্ত্র বাতিল করে নিরঙ্কুশভাবে শ্বেতাঙ্গদের নিয়ে গঠিত ঔপনিবেশিক আমলাতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপন করেন। কালক্রমে আমলাতন্ত্রের সেই ধারা আজও বিরাজমান।
এ প্রসঙ্গে সরকারি কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধুর আরও একটি ভাষণের কথা মনে পড়ে গেল। তিনি বলেছিলেন, ‘সরকারি কর্মচারীদের বলি, মনে রাখবেন, এটা স্বাধীন দেশ, ব্রিটিশের কলোনি নয়। পাকিস্তানের কলোনি নয়। আমার গরিব মানুষ নিজেরা কামাই করে খায়। আপনি চাকরি করেন। ওদেরই পরিশ্রমের পয়সায় আপনি মাইনে পান। সরকারি কর্মচারীরা একটি আলাদা জাতি নয়। দেশের সাত কোটি মানুষের যে অধিকার, সরকারি কর্মচারীদেরও সেই অধিকার!’
এই দুর্বিনীত আচরণের জন্য শুধু সরকারি কর্মকর্তাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। রাজনৈতিক সরকারের কিছু ভুল সিদ্ধান্ত এর জন্য দায়ী। এটি সব সরকারের আমলেই ঘটেছে। রাজনৈতিক ফায়দা নিতে তাঁদের যখন ব্যবহার করা হয়, তখন তাঁরা সুযোগ নেবেনই। এর ফলে তাঁদের উভয়ের মধ্যে ঘটে একধরনের অনৈতিক বোঝাপড়া। ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থের জন্য রাজনীতিক ও আমলা মিলে যখন সিন্ডিকেট তৈরি হয়, তখন বেহিসাবি দুর্নীতি হবেই। রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, আমলা, ঠিকাদার বা ব্যবসায়ী, প্রকৌশলী সবাই যদি একই সূত্রে আবদ্ধ হন তাহলে তো কথাই নেই। বর্তমানে বাংলাদেশের অধিকাংশ মেগা প্রকল্পের নামে তাঁদের পারস্পরিক যোগসাজশে নির্মাণ ব্যয় বাড়িয়ে দিয়ে যে অর্থ লুটপাট হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে শক্ত কোনো পদক্ষেপ নিতে না পারায় এই অনৈতিক অনুশীলন যেন নিয়মে পরিণত হয়ে গেছে। বাংলাদেশে এই সিন্ডিকেট বাদে আরও একটি ভয়ংকর সিন্ডিকেট আছে। তাঁরা হলেন ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। তাঁদের নিয়ে কথা বলতে গেলেও আজকাল অনেকবার ভাবতে হয়। ব্যবসায়ী এই সিন্ডিকেটের কতিপয় মুখচেনা ব্যক্তিদের যখন দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে দেশের অর্থনীতি খাতের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নাক গলাতে দেখা যায়, তখন দুর্নীতির এই ঘোড়দৌড় থামাবে কে? একটি রাজনৈতিক সরকারের প্রায় ৬৩ শতাংশ সাংসদ যদি ব্যবসায়ী হন এবং সেই সরকারের মন্ত্রিসভার অধিকাংশই যদি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকেন, তাহলে অবস্থাটা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না।
রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাবে কতিপয় আমলার যে দাপট বেড়েছে, তার জন্য রাজনীতিবিদেরাই দায়ী। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান থেকেই উত্তরাধিকারসূত্রে আমরা এই আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা পেয়েছি। তবে সেই আমলে আমলাতন্ত্র ছিল দক্ষতার জোরে খুবই দাপুটে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর আমলাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা একই রকম থাকলেও মানের অবনতি ঘটেছে। দেখা গেছে, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে দক্ষতা ও যোগ্যতার বলে বিভিন্ন ক্যাডারে নিযুক্ত হলেও এমন অনেকেই ছিলেন, যাঁরা রাজনৈতিক চাপে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেননি অথবা তাঁদের যোগ্যতার মূল্যায়ন হয়নি। অপরদিকে রাজনৈতিক বিবেচনায় অযোগ্য ব্যক্তিরা তাঁদের টপকে দখল করে নিয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো। ফলে যোগ্যতার স্বীকৃতি না পেয়ে যোগ্য ব্যক্তিদের হতাশা বেড়েছে। দিন যতই গড়িয়েছে, এই প্রবণতা ততই বেড়েছে। আর এখন তো কথাই নেই; পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে প্রশাসনের চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের একটাই পথ, তা হলো দক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তিদের যথাযথ মূল্যায়ন করে প্রশাসনের পেশাদারত্বকে ফিরিয়ে আনা। এর জন্য চাই যোগ্য ব্যক্তিদের গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করা। শুধু মুখে না বলে বাস্তব ক্ষেত্রেও যোগ্যতম কর্মকর্তাদের পদোন্নতি নিশ্চিত করা। সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পদের যে হিসাব চাওয়া হয়েছে, কেউ দোষী সাব্যস্ত হলে রাজনৈতিক বিবেচনা বিসর্জন দিয়ে কড়া আইনি ব্যবস্থা নেওয়া। এর কোনো বিকল্প নেই।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ও কলামিস্ট
গত ২৭ জুলাই ‘জাতীয় পাবলিক সার্ভিস দিবস’ ও ‘জনপ্রশাসন পদক ২০২০-২১’ প্রদান অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রজাতন্ত্রের সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জনগণের শাসক নয়, সেবক হিসেবে কাজ করবে।’ গত কয়েক বছরে কিছু কিছু সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীর আচরণ এমন নিম্নপর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে যে পুরো সার্ভিস ক্যাডার সম্পর্কেই সাধারণ জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। অতীতে এসব নিয়ে অবশ্য কম সমালোচনা হয়নি; বর্তমানেও প্রচুর লেখালেখি হচ্ছে। কিন্তু অবস্থার উন্নতির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। অবস্থাগতিকে মনে হয়, সরকারি কর্মকর্তারা আজকাল সবকিছুর ঊর্ধ্বে নিজেদের স্থান দেওয়ার চেষ্টা করছেন। সরকারের কিছু কিছু দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাঁদের এই অবস্থান ধরে রাখার জন্য বিভিন্ন বিধিবিধান ও আইনও পাস করিয়ে নিচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যটি খুবই প্রাসঙ্গিক।
তবে দেশের বর্তমান সংকটকালে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রাজনীতিকদের পাশ কাটিয়ে আমলানির্ভরতাও এর জন্য দায়ী, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রশাসনের উচ্চপর্যায় থেকে মাঠপর্যায় পর্যন্ত ক্ষমতাচর্চায়, দৃষ্টিকটুভাবে জনপ্রতিনিধিদের টেক্কা দিতেও আমলারা পিছপা হচ্ছেন না।
এ কথা ঠিক, এক যুগ ধরে দুর্নীতির দুর্বৃত্তায়ন দেশকে এমনভাবে গ্রাস করে চলেছে, এই প্রবণতা ভবিষ্যতে কোথায় গিয়ে যে ঠেকে, বলা মুশকিল। বড় বড় দুর্নীতি করে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রশ্রয়ে দুর্নীতিবাজেরা যেভাবে পরিত্রাণ পেয়ে যাচ্ছে, তাতে দুর্নীতিকেই উৎসাহিত করা হচ্ছে। ক্ষমতাধর রাজনীতিবিদ ও আমলা সমন্বিত সিন্ডিকেট যখন দুর্নীতির একই ঘাটে জল খেতে শুরু করে, তখন তা দমন করা সত্যিই দুরূহ হয়ে পড়ে।
আমলাদের দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার খবর স্বাধীনতার পর থেকেই শুনে আসছি। ১৯৭২-৭৩ সালে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল সফরকালে বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একবার তাঁর বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘এত চোরের চোর। চোর কোথা থেকে যে পয়দা হয়েছে, আমি জানি না। পাকিস্তানিরা সব নিয়ে গেছে কিন্তু এই চোরগুলো রেখে গেছে আমার কাছে। এই চোরগুলো নিয়ে গেলে আমি বাঁচতাম। শতকরা ২০ জন লোক শিক্ষিত। তার মধ্যে শতকরা ৫ জন আমরা বলতে পারি উচ্চশিক্ষিত। আজকে একটা প্রশ্ন আমার, এই যে দুর্নীতির কথা বললাম, আমার কৃষক দুর্নীতিবাজ? নাহ্…। আমার শ্রমিক? নাহ্…। তাহলে কে…? ঘুষ খায় কারা? স্মাগলিং করে কারা? বিদেশি এজেন্ট হয় কারা? বিদেশে টাকা চালান করে কারা? এই আমরা যারা শতকরা ৫ জন শিক্ষিত লোক, এই আমাদের মধ্যে ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ। এবং এই আমাদের চরিত্রের সংশোধন করতে হবে, আত্মসমালোচনা করতে হবে। এসব দুর্নীতিবাজ এই শতকরা ৫ জনের মধ্যেই, এর বাইরে নাই। কেন নাই...? কারণ আমার কৃষক দিনভর পরিশ্রম করে। সবাইকে আজ একটি কথা বলব, আমাদের চরিত্রের পরিবর্তন হয় নাই।’ বঙ্গবন্ধু অন্য আরেকটি অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘আমার দেশের গরিব মানুষের ট্যাক্সের টাকায় লেখাপড়া করে আজ আপনারা বড় বড় কর্মকর্তা। আমার এই জনগণের সেবায় আপনাদের নিজেদের উৎসর্গ করতে হবে। সবকিছুর ঊর্ধ্বে জাতির স্বার্থকে স্থান দিতে হবে।’
গত ২৭ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ভাষণেরই যেন প্রতিধ্বনি ঘটেছে। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর ভাষণের উদ্ধৃতি তুলে ধরে বলেন, সে সময় জাতির পিতা বলেছিলেন, ‘সরকারি কর্মচারীদের আমি অনুরোধ করি, যাদের অর্থে আমাদের সংসার চলে, তাদের সেবা করুন, তাদের যাতে কষ্ট না হয় তার দিকে খেয়াল রাখুন। তাদের প্রতি কোনো অন্যায় আচরণ করবেন না। তাহলে আল্লাহর আরশ পর্যন্ত কেঁপে উঠবে। আপনাদের কাছে অনুরোধ রইল, আপনারা মানুষের সেবা করুন। মানুষের সেবার মতো শান্তি দুনিয়ার আর কিছুতে হয় না। একজন গরিব যদি হাত তুলে আপনার জন্য দোয়া করেন, আল্লাহ সেটা কবুল করে নেন।’ বঙ্গবন্ধুকে উদ্ধৃত করে প্রধানমন্ত্রীর এই মূল্যবান বক্তব্যগুলো সরকারি কর্মকর্তাদের কানে পৌঁছালেও বাস্তব ক্ষেত্রে এর কতটুকু প্রতিফলন ঘটে, তা খুলে বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।
আমলাতন্ত্র এক অদ্ভুত রাষ্ট্রশাসন পদ্ধতি। আমলাতন্ত্র দেশের নাগরিকদের কাছে যত ঘোরপ্যাঁচের মনে হোক না কেন, রাষ্ট্র পরিচালনায় এর বিকল্পও নেই। এ প্রসঙ্গে সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের ভাষায় বলতে হয়, ‘আমলাতন্ত্রের বিকল্প কেউ বের করতে পারেনি। রাশিয়া চেষ্টা করে পারেনি; চীনও পারেনি। ফেরাউনও পারেনি। সেই মহান আমলাতন্ত্র আমাদের মাঝেও আছে।’
এ ভূখণ্ডে ইংরেজ আমলেই আমলাতন্ত্রের গোড়াপত্তন হয়। সে আমলে কিছু উচ্চপদস্থ কর্মচারী দেশ শাসনে ইংরেজদের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন। রবার্ট ক্লাইভ তাঁর শাসনব্যবস্থায় সনাতন আমলাতন্ত্র প্রায় পুরোপুরি অব্যাহত রাখলেও ওয়ারেন হেস্টিংস আমলাতন্ত্রে কিছুটা পরিবর্তন এনেছিলেন। তিনি এমন এক নতুন আমলাতন্ত্রের প্রবর্তন করেন, যাতে ইউরোপীয়দের সংখ্যাধিক্য ও প্রাধান্য বজায় থাকে। উচ্চপদগুলো থাকত ইউরোপীয়দের দখলে আর নিম্নপদে নিয়োগ দেওয়া হতো স্থানীয় ব্যক্তিদের। কিন্তু লর্ড কর্নওয়ালিশ স্থানীয় কর্মচারীসমেত এই মিশ্রিত আমলাতন্ত্র বাতিল করে নিরঙ্কুশভাবে শ্বেতাঙ্গদের নিয়ে গঠিত ঔপনিবেশিক আমলাতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপন করেন। কালক্রমে আমলাতন্ত্রের সেই ধারা আজও বিরাজমান।
এ প্রসঙ্গে সরকারি কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধুর আরও একটি ভাষণের কথা মনে পড়ে গেল। তিনি বলেছিলেন, ‘সরকারি কর্মচারীদের বলি, মনে রাখবেন, এটা স্বাধীন দেশ, ব্রিটিশের কলোনি নয়। পাকিস্তানের কলোনি নয়। আমার গরিব মানুষ নিজেরা কামাই করে খায়। আপনি চাকরি করেন। ওদেরই পরিশ্রমের পয়সায় আপনি মাইনে পান। সরকারি কর্মচারীরা একটি আলাদা জাতি নয়। দেশের সাত কোটি মানুষের যে অধিকার, সরকারি কর্মচারীদেরও সেই অধিকার!’
এই দুর্বিনীত আচরণের জন্য শুধু সরকারি কর্মকর্তাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। রাজনৈতিক সরকারের কিছু ভুল সিদ্ধান্ত এর জন্য দায়ী। এটি সব সরকারের আমলেই ঘটেছে। রাজনৈতিক ফায়দা নিতে তাঁদের যখন ব্যবহার করা হয়, তখন তাঁরা সুযোগ নেবেনই। এর ফলে তাঁদের উভয়ের মধ্যে ঘটে একধরনের অনৈতিক বোঝাপড়া। ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থের জন্য রাজনীতিক ও আমলা মিলে যখন সিন্ডিকেট তৈরি হয়, তখন বেহিসাবি দুর্নীতি হবেই। রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, আমলা, ঠিকাদার বা ব্যবসায়ী, প্রকৌশলী সবাই যদি একই সূত্রে আবদ্ধ হন তাহলে তো কথাই নেই। বর্তমানে বাংলাদেশের অধিকাংশ মেগা প্রকল্পের নামে তাঁদের পারস্পরিক যোগসাজশে নির্মাণ ব্যয় বাড়িয়ে দিয়ে যে অর্থ লুটপাট হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে শক্ত কোনো পদক্ষেপ নিতে না পারায় এই অনৈতিক অনুশীলন যেন নিয়মে পরিণত হয়ে গেছে। বাংলাদেশে এই সিন্ডিকেট বাদে আরও একটি ভয়ংকর সিন্ডিকেট আছে। তাঁরা হলেন ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। তাঁদের নিয়ে কথা বলতে গেলেও আজকাল অনেকবার ভাবতে হয়। ব্যবসায়ী এই সিন্ডিকেটের কতিপয় মুখচেনা ব্যক্তিদের যখন দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে দেশের অর্থনীতি খাতের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নাক গলাতে দেখা যায়, তখন দুর্নীতির এই ঘোড়দৌড় থামাবে কে? একটি রাজনৈতিক সরকারের প্রায় ৬৩ শতাংশ সাংসদ যদি ব্যবসায়ী হন এবং সেই সরকারের মন্ত্রিসভার অধিকাংশই যদি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকেন, তাহলে অবস্থাটা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না।
রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাবে কতিপয় আমলার যে দাপট বেড়েছে, তার জন্য রাজনীতিবিদেরাই দায়ী। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান থেকেই উত্তরাধিকারসূত্রে আমরা এই আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা পেয়েছি। তবে সেই আমলে আমলাতন্ত্র ছিল দক্ষতার জোরে খুবই দাপুটে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর আমলাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা একই রকম থাকলেও মানের অবনতি ঘটেছে। দেখা গেছে, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে দক্ষতা ও যোগ্যতার বলে বিভিন্ন ক্যাডারে নিযুক্ত হলেও এমন অনেকেই ছিলেন, যাঁরা রাজনৈতিক চাপে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেননি অথবা তাঁদের যোগ্যতার মূল্যায়ন হয়নি। অপরদিকে রাজনৈতিক বিবেচনায় অযোগ্য ব্যক্তিরা তাঁদের টপকে দখল করে নিয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো। ফলে যোগ্যতার স্বীকৃতি না পেয়ে যোগ্য ব্যক্তিদের হতাশা বেড়েছে। দিন যতই গড়িয়েছে, এই প্রবণতা ততই বেড়েছে। আর এখন তো কথাই নেই; পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে প্রশাসনের চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের একটাই পথ, তা হলো দক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তিদের যথাযথ মূল্যায়ন করে প্রশাসনের পেশাদারত্বকে ফিরিয়ে আনা। এর জন্য চাই যোগ্য ব্যক্তিদের গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করা। শুধু মুখে না বলে বাস্তব ক্ষেত্রেও যোগ্যতম কর্মকর্তাদের পদোন্নতি নিশ্চিত করা। সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পদের যে হিসাব চাওয়া হয়েছে, কেউ দোষী সাব্যস্ত হলে রাজনৈতিক বিবেচনা বিসর্জন দিয়ে কড়া আইনি ব্যবস্থা নেওয়া। এর কোনো বিকল্প নেই।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ও কলামিস্ট
দলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
১ দিন আগেশেখ হাসিনা সরকারের পতনের ১০০ দিন পার হয়ে গেছে। ১০০ দিনে অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কিছু যে হয়নি, তা নয়। তবে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে অস্থিরতার লক্ষণ অস্পষ্ট নয়। এর মধ্যেই তিন দফায় উপদেষ্টার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।
১ দিন আগেবাংলা ভাষায় অতিপরিচিত একটি শব্দবন্ধ হলো ‘খোলনলচে’। যাপিত জীবনে কমবেশি আমরা সবাই শব্দবন্ধটি প্রয়োগ করেছি। বাংলা বাগধারায় আমরা পড়েছি ‘খোলনলচে পালটানো’। বাংলা অভিধানে খোল শব্দের একাধিক অর্থ রয়েছে।
১ দিন আগেঅফিসে যাতায়াতের সময় স্টাফ বাসে পরিচয়ের সূত্রে ফারজানা আক্তার আজিমপুরে নিজের বাসায় সাবলেট দিয়েছিলেন ফাতেমা আক্তার শাপলা নামের এক নারীকে। কিন্তু ফাতেমা যে একটি প্রতারক চক্রের সদস্য, সেটা তাঁর জানা ছিল না।
১ দিন আগে