সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
আমাদের বিদ্যমান ব্যবস্থাটা এ রকমেরই যে স্বৈরাচারীরা অতি সহজে পার পেয়ে যায় এবং পুনর্বাসিত হয়। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতন ঘটে ঠিকই, কিন্তু লোকটি আবার ফেরতও আসেন। তাঁর জেল হয়, কিন্তু লোকটির আসল যে দুটি অপরাধ, সেই দুটির কোনোটিরই বিচার হয় না। মস্ত বড় অপরাধ ছিল রাষ্ট্রক্ষমতা জবরদখল করা। সেটি নির্জলা রাষ্ট্রদ্রোহ। তার বিচার না করে আলতু-ফালতু সব অপরাধ নিয়ে টানাটানি করা হয়। এরশাদের দ্বিতীয় অপরাধ মঞ্জুর হত্যায় তাঁর সংশ্লিষ্টতা। এই অপরাধটির জন্য তাঁকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। আদালতের আদেশে তদন্ত হয়েছে, কিন্তু তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত হলো না; পুনঃ তদন্ত, তারপরে আবার তদন্ত, বিচারক বদলি—এভাবে সময়ক্ষেপণের মধ্য দিয়ে তিনি নির্বিচারে পরলোকে চলে গেলেন। রাষ্ট্র উদাসীন—এমন কথা কেউ বলতে পারবে না, কিন্তু প্রয়োজনমাফিক সে উদাসীন হতে জানে বৈকি।
এরশাদের স্বৈরশাসনের পতনের অনুঘটকদের মধ্যে দুজন ছিলেন প্রধান—ডা. শামসুল আলম খান মিলন ও কিশোর নূর হোসেন। এটা ভেবে লজ্জায় ও দুঃখে আমাদের অধীর হতে হয় যে তাঁদের হত্যার কোনো বিচার হয়নি। মিলনের মা বলেছিলেন, বিচার পাওয়ার আশা তিনি আর করেন না। ঘাতক এরশাদ তো পালিয়েই গেছেন। নূর হোসেনের মা বিচার পাওয়ার আশা তো ছেড়ে দিয়েছেনই, উল্টো মৃত সন্তানকে অপমানের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য অবস্থান ধর্মঘট করেছিলেন জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে। (আর কোথাও কি জায়গা আছে যাওয়ার?) নূর হোসেনের অসম্মান করেছেন পতনের পরে উত্থিত এরশাদের জাতীয় পার্টির নেতা মসিউর রহমান রাঙ্গা। তিনি বলেছেন, ‘নূর হোসেন কোনো বিবেচনাযোগ্য ব্যক্তি ছিল না; তাকে নিয়ে রাজনৈতিক স্বার্থবাদীরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে হইচই করেছে, নূর হোসেন আসলে ছিল একজন ভবঘুরে, নেশাখোর; সে ইয়াবা ও ফেনসিডিল সেবন করত।’ বলার পরে মহামতির খেয়াল হয়েছে যে নূর হোসেনকে যখন তাঁদের মহান নেতা স্বৈরাচার এরশাদ হত্যা করেন, তখন দেশে ইয়াবার তো নয়ই, ফেনসিডিলেরও প্রচলন ছিল না। তবে খেয়াল তিনি মোটেই করতেন না যদি নূর হোসেনের মা সন্তানের সম্মান রক্ষার জন্য উদ্যোগটা না নিতেন। এরশাদ জেলে গিয়েছিলেন, জেল থেকে বের হয়ে শহীদ নূর হোসেনদের বাড়িতে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন মাফ চাইবার জন্য; জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে নূর হোসেনের মৃত্যুর জন্য দুঃখও প্রকাশ করেছেন; তিনি প্রস্থান করেছেন, কিন্তু তাঁর সুযোগ্য রাজনৈতিক চেলা মসিউর রহমান রাঙ্গা নূর হোসেনকে দিব্যি অপমান করছেন।
এমনটা যে ঘটছে তার কারণটা কী? কারণ হলো স্বৈরাচারী যায় ঠিকই, কিন্তু স্বৈরাচার যায় না; থেকে যায় এবং ব্যবস্থার আনুকূল্য পেয়ে রয়ে যাওয়া স্বৈরাচার আরও খলবল করে ওঠে। আমাদের দেখতে ও সহ্য করতে হয়েছে আইয়ুব খানের পতনের পর তাঁর চেলা ইয়াহিয়া খানের আপন প্রভুকেও ছাড়িয়ে যাওয়ার ঘটনা। কারণ ওই একই—হাকিম বদলায়, হুকুম বদলায় না এবং হাকিমের হুকুম দেওয়ার ক্ষমতাটা আরও বাড়ে। ভালো মানুষেরা তো দুর্বল, তাঁদের ক্ষমতা নেই, তাঁরা বিচ্ছিন্ন, একাকী এবং গোটা ব্যবস্থা তাঁদের বিরুদ্ধে। কর্তৃত্ব ঠগদের হাতে। তবে ভালো মানুষেরা পারেন, যখন তাঁরা একত্র হন। একত্র হয়েছিলেন বলেই আইয়ুব ও ইয়াহিয়া খানের পতন, বাংলাদেশের অভ্যুদয়, এরশাদের বিদায়—এসব ঘটনা ঘটেছে।
২.
বিশ্বজুড়ে ব্যাপ্ত পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটা এখন বর্বরতার শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে। পুঁজিবাদমনস্ক অতিনিকৃষ্ট স্তরের মানুষেরা রাষ্ট্রের কর্তা হচ্ছেন, রাষ্ট্রকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছেন, সঙ্গে আছেন ব্যবসায়ীরা; তবে এটা যেমন সত্য, তেমনি সত্য এটাও যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটা এখন ভেঙে পড়বে-পড়বে অবস্থায় পৌঁছে গেছে। তার সব খেলা, কৌশল, প্রতিষ্ঠানই এখন দুর্বল হয়ে পড়েছে। ধরা যাক নোবেল পুরস্কারের কথাই। এই পুরস্কার একসময় অত্যন্ত গৌরবজনক ছিল, এখন আর তেমন নেই; বিশেষ করে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের অবস্থাটা তো বেশ কাহিল। চার বছর আগে দেখা গেল দেওয়ার মতো কোনো লেখক নেই, তাই পুরস্কার দেওয়া হলো একজন সংগীত রচয়িতা ও গায়ককে। পরের বছর পুরস্কার দেওয়াই হলো না; কারণ? কারণ দাতা প্রতিষ্ঠানের ভেতরে যৌন কেলেঙ্কারির ঘটনা। পরে পুরস্কার যে দুজনকে দেওয়া হয়েছে জানা গেল, তাঁদের একজন বসনিয়ায় গণহত্যাকে সক্রিয়ভাবে সমর্থন করেছেন। অর্থনীতিতে নোবেল পেয়েছেন তিনজন; তাঁদের দুজন আবার স্বামী-স্ত্রী। স্বামীটি বাঙালি। সেই খবরে বাঙালি মহলে বেশ উৎফুল্ল দেখা গিয়েছিল, পরে সেটা স্তিমিত হয়ে গেছে। কারণ, জানা গেছে বাঙালি ভদ্রলোকের নাম অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়—নৈতিক দিক থেকে মোটেই প্রশংসনীয় মানের নন। তাঁর প্রথম স্ত্রী ছিলেন বাঙালি, তিনিও উঁচু স্তরের একজন অধ্যাপক ছিলেন। যাঁর সঙ্গে মিলে তিনি পুরস্কারটি পেলেন, তিনি তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী। ফরাসি বংশোদ্ভূত এই নারী একদা তাঁর ছাত্রী ছিলেন; দারিদ্র্য নিয়ে গবেষণা করতে তাঁরা ভারতে কয়েক বছর একত্রে কাটিয়েছেন। ছাত্রীটিকে বিয়ে করতে তাঁর বিশেষ রকমের আগ্রহ যে ছিল তা নয়; কিন্তু না করে উপায় থাকেনি। কেননা, ছাত্রী ঘোষণা দেন যে তিনি মা হতে যাচ্ছেন এবং তাঁর হবু সন্তানের পিতা অন্য কেউ নন, তাঁর শিক্ষকই। ফলে প্রথম স্ত্রী পরিত্যক্ত হয়েছেন। সেই স্ত্রী ইংল্যান্ডে চলে গেছেন একমাত্র পুত্রসন্তানটি সঙ্গে নিয়ে। ঘটনাধারার অত্যাচারে পুত্রটি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং একসময় আত্মহত্যাই করে ফেলে। সেটা গেল পারিবারিক তথ্য, এ নিয়ে আমাদের কোনো দুশ্চিন্তার কারণ নেই; তবে লক্ষ করার বিষয় হলো তাঁর চিন্তাধারা, যেটি খাঁটি পুঁজিবাদী এবং যেটির প্রচারে তিনি সবেগে অংশ নিচ্ছেন। তাঁর বইপত্র পড়ার সুযোগ এখনো আমাদের হয়নি, তবে সাক্ষাৎকার পড়ে বিলক্ষণ জানা গেছে, তিনি কোন ঘরানার মানুষ। পুঁজিবাদী তো হবেনই, না হয়ে উপায় নেই; কিন্তু মনে হচ্ছে বেশ কট্টরপন্থী। যেমন তিনি বলেছেন, উন্নয়নের জন্য দুর্নীতি কোনো অন্তরায় নয়; অর্থাৎ প্রকারান্তরে বলা যে উন্নতি চাইলে দুর্নীতি মেনে নিতে হবে, যে বাণীর উচ্চারণ আমরা নিম্ন, উচ্চ, নীরব কণ্ঠে অহরহ শুনছি, বাধ্য হচ্ছি শুনতে। তিনি আরও একটা কথা বলেছেন। জানিয়েছেন যে বর্তমান সময়ে সারা বিশ্বে বেশি আদর পাচ্ছে অতি ধনীরা ও অতি গরিবেরা। যত কষ্ট মধ্যবিত্তের। মধ্যবিত্ত যে কষ্টে আছে এবং অতি ধনীরা যে আদর পাচ্ছে, সেটা তো আমাদেরও অভিজ্ঞতা। কিন্তু অতি গরিব? হ্যাঁ, তারাও আদর পায়। তাদের জন্য এনজিও আছে, দাতারা আছে, এমনকি স্বীয় ব্যথায়-কাতর মধ্যবিত্তও রয়েছে; কিন্তু এই ব্যবস্থাটা যে ভাঙা দরকার, অন্ততপক্ষে অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠা যে অত্যাবশ্যক, সেটা তো আমরা খুবই অনুভব করি। তবে ভরসা রাখি যে এ ব্যবস্থাটা ভাঙবে; ভাঙবে এই জন্য যে বঞ্চিত মানুষের সংখ্যাই অধিক এবং তারা এ ব্যবস্থা মেনে নেবে না; মেনে নিচ্ছে না।
পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটা যে পিতৃতান্ত্রিক, সেটা তো পদে পদে টের পাই। বাঙালি সমাজে পিতৃতান্ত্রিকতার তৎপরতা সামন্তবাদের আধিপত্যের কালে বেশ ভালোভাবেই ছিল, পরেও যে একেবারে বিদায় নিয়েছে তা নয়; বরং আরও দুর্বার হয়ে উঠেছে। বাংলা সাহিত্যে নারীদের প্রতি সহানুভূতিশীল বলে পরিচিত লেখকদের বেলাতেও দেখা গেছে তাদেরও টানটা বাবার দিকেই। বাবা অনেক ক্ষেত্রেই কর্তব্য পালনে অপারগ, কখনো কখনো করুণার পাত্র, কিন্তু তাঁরাই কর্তা; তাঁদের প্রতিই পুত্রদের তো অবশ্যই, কন্যাদেরও বিশেষ রকমের পক্ষপাত। শরৎচন্দ্র ও বিভূতিভূষণের কথা বেশ স্মরণে আসে। ১৯৩৫ সালে লেখা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দৃষ্টি-প্রদীপ’ উপন্যাসে একজন পিতার কথা আছে, তিনি দার্জিলিংয়ের চা-বাগানের অফিসার ছিলেন। দাপুটে মানুষ। স্নেহপ্রবণও। তবে কর্তৃত্বপরায়ণ এবং মদাসক্ত। সপ্তাহে অন্তত একবার মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপান না করলে তাঁর চলত না এবং সেই সময়ে তিনি স্ত্রী-সন্তান কোনো বাছবিচার করতেন না, সবাইকে ইচ্ছামতো পেটাতেন। মদাসক্তির কারণেই হবে, একসময়ে তিনি কর্মচ্যুত হলেন। তাঁকে চলে আসতে হলো পৈতৃক গৃহে। চাকরি নেই; চাকরি খোঁজেন, পান না। থাকেন বড় ভাইয়ের কর্তৃত্বাধীন। আশ্রিত। পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা কাকে বলে, সেটা তিনি যতটা না বোঝেন, তার চেয়ে বেশি বোঝেন তাঁর স্ত্রী। একান্নবর্তী পরিবার কত যে বীভৎস হতে পারে, তার ছবি সামন্তবাদের-প্রতি-পিছুটানসম্পন্ন ঔপন্যাসিকের পক্ষেও আড়াল করাটা সম্ভব হয় না।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আমাদের বিদ্যমান ব্যবস্থাটা এ রকমেরই যে স্বৈরাচারীরা অতি সহজে পার পেয়ে যায় এবং পুনর্বাসিত হয়। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতন ঘটে ঠিকই, কিন্তু লোকটি আবার ফেরতও আসেন। তাঁর জেল হয়, কিন্তু লোকটির আসল যে দুটি অপরাধ, সেই দুটির কোনোটিরই বিচার হয় না। মস্ত বড় অপরাধ ছিল রাষ্ট্রক্ষমতা জবরদখল করা। সেটি নির্জলা রাষ্ট্রদ্রোহ। তার বিচার না করে আলতু-ফালতু সব অপরাধ নিয়ে টানাটানি করা হয়। এরশাদের দ্বিতীয় অপরাধ মঞ্জুর হত্যায় তাঁর সংশ্লিষ্টতা। এই অপরাধটির জন্য তাঁকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। আদালতের আদেশে তদন্ত হয়েছে, কিন্তু তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত হলো না; পুনঃ তদন্ত, তারপরে আবার তদন্ত, বিচারক বদলি—এভাবে সময়ক্ষেপণের মধ্য দিয়ে তিনি নির্বিচারে পরলোকে চলে গেলেন। রাষ্ট্র উদাসীন—এমন কথা কেউ বলতে পারবে না, কিন্তু প্রয়োজনমাফিক সে উদাসীন হতে জানে বৈকি।
এরশাদের স্বৈরশাসনের পতনের অনুঘটকদের মধ্যে দুজন ছিলেন প্রধান—ডা. শামসুল আলম খান মিলন ও কিশোর নূর হোসেন। এটা ভেবে লজ্জায় ও দুঃখে আমাদের অধীর হতে হয় যে তাঁদের হত্যার কোনো বিচার হয়নি। মিলনের মা বলেছিলেন, বিচার পাওয়ার আশা তিনি আর করেন না। ঘাতক এরশাদ তো পালিয়েই গেছেন। নূর হোসেনের মা বিচার পাওয়ার আশা তো ছেড়ে দিয়েছেনই, উল্টো মৃত সন্তানকে অপমানের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য অবস্থান ধর্মঘট করেছিলেন জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে। (আর কোথাও কি জায়গা আছে যাওয়ার?) নূর হোসেনের অসম্মান করেছেন পতনের পরে উত্থিত এরশাদের জাতীয় পার্টির নেতা মসিউর রহমান রাঙ্গা। তিনি বলেছেন, ‘নূর হোসেন কোনো বিবেচনাযোগ্য ব্যক্তি ছিল না; তাকে নিয়ে রাজনৈতিক স্বার্থবাদীরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে হইচই করেছে, নূর হোসেন আসলে ছিল একজন ভবঘুরে, নেশাখোর; সে ইয়াবা ও ফেনসিডিল সেবন করত।’ বলার পরে মহামতির খেয়াল হয়েছে যে নূর হোসেনকে যখন তাঁদের মহান নেতা স্বৈরাচার এরশাদ হত্যা করেন, তখন দেশে ইয়াবার তো নয়ই, ফেনসিডিলেরও প্রচলন ছিল না। তবে খেয়াল তিনি মোটেই করতেন না যদি নূর হোসেনের মা সন্তানের সম্মান রক্ষার জন্য উদ্যোগটা না নিতেন। এরশাদ জেলে গিয়েছিলেন, জেল থেকে বের হয়ে শহীদ নূর হোসেনদের বাড়িতে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন মাফ চাইবার জন্য; জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে নূর হোসেনের মৃত্যুর জন্য দুঃখও প্রকাশ করেছেন; তিনি প্রস্থান করেছেন, কিন্তু তাঁর সুযোগ্য রাজনৈতিক চেলা মসিউর রহমান রাঙ্গা নূর হোসেনকে দিব্যি অপমান করছেন।
এমনটা যে ঘটছে তার কারণটা কী? কারণ হলো স্বৈরাচারী যায় ঠিকই, কিন্তু স্বৈরাচার যায় না; থেকে যায় এবং ব্যবস্থার আনুকূল্য পেয়ে রয়ে যাওয়া স্বৈরাচার আরও খলবল করে ওঠে। আমাদের দেখতে ও সহ্য করতে হয়েছে আইয়ুব খানের পতনের পর তাঁর চেলা ইয়াহিয়া খানের আপন প্রভুকেও ছাড়িয়ে যাওয়ার ঘটনা। কারণ ওই একই—হাকিম বদলায়, হুকুম বদলায় না এবং হাকিমের হুকুম দেওয়ার ক্ষমতাটা আরও বাড়ে। ভালো মানুষেরা তো দুর্বল, তাঁদের ক্ষমতা নেই, তাঁরা বিচ্ছিন্ন, একাকী এবং গোটা ব্যবস্থা তাঁদের বিরুদ্ধে। কর্তৃত্ব ঠগদের হাতে। তবে ভালো মানুষেরা পারেন, যখন তাঁরা একত্র হন। একত্র হয়েছিলেন বলেই আইয়ুব ও ইয়াহিয়া খানের পতন, বাংলাদেশের অভ্যুদয়, এরশাদের বিদায়—এসব ঘটনা ঘটেছে।
২.
বিশ্বজুড়ে ব্যাপ্ত পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটা এখন বর্বরতার শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে। পুঁজিবাদমনস্ক অতিনিকৃষ্ট স্তরের মানুষেরা রাষ্ট্রের কর্তা হচ্ছেন, রাষ্ট্রকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছেন, সঙ্গে আছেন ব্যবসায়ীরা; তবে এটা যেমন সত্য, তেমনি সত্য এটাও যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটা এখন ভেঙে পড়বে-পড়বে অবস্থায় পৌঁছে গেছে। তার সব খেলা, কৌশল, প্রতিষ্ঠানই এখন দুর্বল হয়ে পড়েছে। ধরা যাক নোবেল পুরস্কারের কথাই। এই পুরস্কার একসময় অত্যন্ত গৌরবজনক ছিল, এখন আর তেমন নেই; বিশেষ করে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের অবস্থাটা তো বেশ কাহিল। চার বছর আগে দেখা গেল দেওয়ার মতো কোনো লেখক নেই, তাই পুরস্কার দেওয়া হলো একজন সংগীত রচয়িতা ও গায়ককে। পরের বছর পুরস্কার দেওয়াই হলো না; কারণ? কারণ দাতা প্রতিষ্ঠানের ভেতরে যৌন কেলেঙ্কারির ঘটনা। পরে পুরস্কার যে দুজনকে দেওয়া হয়েছে জানা গেল, তাঁদের একজন বসনিয়ায় গণহত্যাকে সক্রিয়ভাবে সমর্থন করেছেন। অর্থনীতিতে নোবেল পেয়েছেন তিনজন; তাঁদের দুজন আবার স্বামী-স্ত্রী। স্বামীটি বাঙালি। সেই খবরে বাঙালি মহলে বেশ উৎফুল্ল দেখা গিয়েছিল, পরে সেটা স্তিমিত হয়ে গেছে। কারণ, জানা গেছে বাঙালি ভদ্রলোকের নাম অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়—নৈতিক দিক থেকে মোটেই প্রশংসনীয় মানের নন। তাঁর প্রথম স্ত্রী ছিলেন বাঙালি, তিনিও উঁচু স্তরের একজন অধ্যাপক ছিলেন। যাঁর সঙ্গে মিলে তিনি পুরস্কারটি পেলেন, তিনি তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী। ফরাসি বংশোদ্ভূত এই নারী একদা তাঁর ছাত্রী ছিলেন; দারিদ্র্য নিয়ে গবেষণা করতে তাঁরা ভারতে কয়েক বছর একত্রে কাটিয়েছেন। ছাত্রীটিকে বিয়ে করতে তাঁর বিশেষ রকমের আগ্রহ যে ছিল তা নয়; কিন্তু না করে উপায় থাকেনি। কেননা, ছাত্রী ঘোষণা দেন যে তিনি মা হতে যাচ্ছেন এবং তাঁর হবু সন্তানের পিতা অন্য কেউ নন, তাঁর শিক্ষকই। ফলে প্রথম স্ত্রী পরিত্যক্ত হয়েছেন। সেই স্ত্রী ইংল্যান্ডে চলে গেছেন একমাত্র পুত্রসন্তানটি সঙ্গে নিয়ে। ঘটনাধারার অত্যাচারে পুত্রটি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং একসময় আত্মহত্যাই করে ফেলে। সেটা গেল পারিবারিক তথ্য, এ নিয়ে আমাদের কোনো দুশ্চিন্তার কারণ নেই; তবে লক্ষ করার বিষয় হলো তাঁর চিন্তাধারা, যেটি খাঁটি পুঁজিবাদী এবং যেটির প্রচারে তিনি সবেগে অংশ নিচ্ছেন। তাঁর বইপত্র পড়ার সুযোগ এখনো আমাদের হয়নি, তবে সাক্ষাৎকার পড়ে বিলক্ষণ জানা গেছে, তিনি কোন ঘরানার মানুষ। পুঁজিবাদী তো হবেনই, না হয়ে উপায় নেই; কিন্তু মনে হচ্ছে বেশ কট্টরপন্থী। যেমন তিনি বলেছেন, উন্নয়নের জন্য দুর্নীতি কোনো অন্তরায় নয়; অর্থাৎ প্রকারান্তরে বলা যে উন্নতি চাইলে দুর্নীতি মেনে নিতে হবে, যে বাণীর উচ্চারণ আমরা নিম্ন, উচ্চ, নীরব কণ্ঠে অহরহ শুনছি, বাধ্য হচ্ছি শুনতে। তিনি আরও একটা কথা বলেছেন। জানিয়েছেন যে বর্তমান সময়ে সারা বিশ্বে বেশি আদর পাচ্ছে অতি ধনীরা ও অতি গরিবেরা। যত কষ্ট মধ্যবিত্তের। মধ্যবিত্ত যে কষ্টে আছে এবং অতি ধনীরা যে আদর পাচ্ছে, সেটা তো আমাদেরও অভিজ্ঞতা। কিন্তু অতি গরিব? হ্যাঁ, তারাও আদর পায়। তাদের জন্য এনজিও আছে, দাতারা আছে, এমনকি স্বীয় ব্যথায়-কাতর মধ্যবিত্তও রয়েছে; কিন্তু এই ব্যবস্থাটা যে ভাঙা দরকার, অন্ততপক্ষে অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠা যে অত্যাবশ্যক, সেটা তো আমরা খুবই অনুভব করি। তবে ভরসা রাখি যে এ ব্যবস্থাটা ভাঙবে; ভাঙবে এই জন্য যে বঞ্চিত মানুষের সংখ্যাই অধিক এবং তারা এ ব্যবস্থা মেনে নেবে না; মেনে নিচ্ছে না।
পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটা যে পিতৃতান্ত্রিক, সেটা তো পদে পদে টের পাই। বাঙালি সমাজে পিতৃতান্ত্রিকতার তৎপরতা সামন্তবাদের আধিপত্যের কালে বেশ ভালোভাবেই ছিল, পরেও যে একেবারে বিদায় নিয়েছে তা নয়; বরং আরও দুর্বার হয়ে উঠেছে। বাংলা সাহিত্যে নারীদের প্রতি সহানুভূতিশীল বলে পরিচিত লেখকদের বেলাতেও দেখা গেছে তাদেরও টানটা বাবার দিকেই। বাবা অনেক ক্ষেত্রেই কর্তব্য পালনে অপারগ, কখনো কখনো করুণার পাত্র, কিন্তু তাঁরাই কর্তা; তাঁদের প্রতিই পুত্রদের তো অবশ্যই, কন্যাদেরও বিশেষ রকমের পক্ষপাত। শরৎচন্দ্র ও বিভূতিভূষণের কথা বেশ স্মরণে আসে। ১৯৩৫ সালে লেখা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দৃষ্টি-প্রদীপ’ উপন্যাসে একজন পিতার কথা আছে, তিনি দার্জিলিংয়ের চা-বাগানের অফিসার ছিলেন। দাপুটে মানুষ। স্নেহপ্রবণও। তবে কর্তৃত্বপরায়ণ এবং মদাসক্ত। সপ্তাহে অন্তত একবার মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপান না করলে তাঁর চলত না এবং সেই সময়ে তিনি স্ত্রী-সন্তান কোনো বাছবিচার করতেন না, সবাইকে ইচ্ছামতো পেটাতেন। মদাসক্তির কারণেই হবে, একসময়ে তিনি কর্মচ্যুত হলেন। তাঁকে চলে আসতে হলো পৈতৃক গৃহে। চাকরি নেই; চাকরি খোঁজেন, পান না। থাকেন বড় ভাইয়ের কর্তৃত্বাধীন। আশ্রিত। পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা কাকে বলে, সেটা তিনি যতটা না বোঝেন, তার চেয়ে বেশি বোঝেন তাঁর স্ত্রী। একান্নবর্তী পরিবার কত যে বীভৎস হতে পারে, তার ছবি সামন্তবাদের-প্রতি-পিছুটানসম্পন্ন ঔপন্যাসিকের পক্ষেও আড়াল করাটা সম্ভব হয় না।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শেখ হাসিনার পতিত স্বৈরাচারী সরকার সাড়ে ১৫ বছর ধরে এ দেশের জনগণের মাথাপিছু জিডিপি প্রশংসনীয় গতিতে বাড়ার গল্প সাজিয়ে শাসন করেছে। মাথাপিছু জিডিপি প্রকৃতপক্ষে একটি মারাত্মক ত্রুটিপূর্ণ কনসেপ্ট। এটার সবচেয়ে মারাত্মক সীমাবদ্ধতা হলো, এটা একটা গড়, যেটা স্বল্পসংখ্যক ধনী এবং বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্ন-মধ্যবিত্ত
১৭ ঘণ্টা আগেআমাদের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস পৃথিবীকে জলবায়ু-বিপর্যয় থেকে রক্ষার জন্য ‘শূন্য বর্জ্য ও শূন্য কার্বন’-এর ওপর ভিত্তি করে একটি নতুন জীবনধারা গড়ে তোলা প্রয়োজন বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন।
১৭ ঘণ্টা আগেআমেরিকার ১৩২ বছরের পুরোনো রেকর্ড ভেঙে একবার হেরে যাওয়ার পর দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রথম মেয়াদে ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ট্রাম্প।
১৭ ঘণ্টা আগেজগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বড্ড কষ্ট বুকে নিয়েই ‘সব শালারা বাটপার’ স্লোগানটি দিয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরেই তাঁরা দ্বিতীয় ক্যাম্পাস পাচ্ছেন না। ঠিকাদারেরা ভেলকিবাজি করছেন।ক্যাম্পাসের জন্য জমিও অধিগ্রহণ করা হয়নি।
১৭ ঘণ্টা আগে