বিভুরঞ্জন সরকার
বিরোধী দল, নির্বাচন–এসব গণতন্ত্রের প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ছাড়া বহুদলীয় গণতন্ত্র হয় না। আবার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শক্তিশালী বিরোধী দলের উপস্থিতিও অতি জরুরি। বাংলাদেশে এখন কেমন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কার্যকর আছে, তা নিয়ে বিতর্ক করা যেতে পারে। তবে একমত হওয়া সহজ হবে না। আমরা বহুদলীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় আছি বলে দাবি করা হলেও দেশে অংশগ্রহণমূলক না হয়ে বিতর্কিত নির্বাচন হচ্ছে, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে এবং জাতীয় সংসদে প্রকৃত বিরোধী দলের অনুপস্থিতির কারণে সংসদের প্রতি মানুষের আগ্রহ কমছে।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আগে মানুষের যে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল, দিন দিন তা-ও আর থাকছে না। মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সমস্যা এখন আর রাজনৈতিক দলের কর্মসূচির মধ্যে নেই। ক্ষমতার বাইরে থেকেও যে জনকল্যাণে নিয়োজিত থাকা যায়, বিপদে-আপদে মানুষের পাশে থেকে যে তাদের সঙ্গে একটি হার্দিক সম্পর্ক তৈরি করা যায়, স্থানীয় কিছু সমস্যা যে স্থানীয় উদ্যোগেও সমাধান করা যায়, এগুলো এখন আর কারও বিবেচনার মধ্যে থাকে না।
সরকারের ওপর নির্ভরতা বেড়েছে। সবকিছুর জন্যই সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকা এখন বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘এটা আমাদের দাবি, এটা দিতে হবে’–এ-ই হয়ে উঠেছে আজকের রাজনীতির মূল কথা। সাধারণ মানুষকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে তোলা রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব হলেও এখন আর রাজনৈতিক দলগুলো সে দায়িত্ব সেভাবে পালন করে না।
ক্ষমতায় থাকা এবং ক্ষমতায় যাওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা মানুষকে আর উৎসাহিত করছে না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, আমি বাংলার মানুষের ভালোবাসা চাই।’ তিনি কিন্তু দুটোই পেয়েছিলেন। মানুষ তাঁকে বিশ্বাস করেছিল, তাঁকে আস্থায় নিয়েছিল। মওলানা ভাসানী কিংবা মণি সিংহ, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের মতো নেতারা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য কামড়াকামড়ি করেননি বলেই মানুষের ভালোবাসা পেয়েছিলেন।
শেখ মুজিব কিন্তু তাঁর শর্ত না মানা হলে নির্বাচনে না-যাওয়ার জন্য গোঁ ধরে থাকেননি; বরং ইয়াহিয়ার এলএফওর (লিগাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার) অধীনেই ১৯৭০ সালের নির্বাচনে গিয়েছিলেন। তিনি আন্দোলন এবং আলোচনা দুই অস্ত্রকেই ব্যবহার করেছেন। আইয়ুব খান কিংবা ইয়াহিয়া খান তাঁর সঙ্গে ভালো আচরণ করেননি বলে তাঁদের সঙ্গে কথা বলা বা আলোচনার দুয়ার বন্ধ করে দেননি। তিনি চেষ্টা করেছেন শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সমঝোতার। ‘এক দফা এক দাবি’—এই চরম অবস্থায় যাওয়ার আগে মাঠ তৈরির কাজ করতে হতো। গায়ের শক্তি দিয়ে নয়; বরং কৌশলের শক্তি দিয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার চেষ্টা এখন আর তেমন দেখা যায় না। এখনকার রাজনীতি কৌশলের খেলা না হয়ে বাহুবলের খেলা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই মানুষের সঙ্গে রাজনীতির দূরত্ব তৈরি হয়েছে, নেতাদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সংযোগ কমে আসছে। তৃণমূল পর্যায়ে মানুষের সঙ্গে থেকে, তাদের সুখ-দুঃখের ভাগীদার হয়ে এখন আর নেতা হতে হয় না। এখন নেতা ওপর থেকে জনতার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। জনগণ নিরূপায় হয়ে তা মেনে নিতে বাধ্য হয়।
এটা ঠিক যে ব্যক্তিগত প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির বিষয়টি রাজনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি হওয়ার সংস্কৃতিও একদিনে তৈরি হয়নি, ধীরে ধীরেই হয়েছে। চাহিদাপত্র হাতে নিয়ে যে রাজনীতি তার শেষ কোথায়—তা কেউ বলতে পারবে না। গত দুটি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে বিশেষ পরিস্থিতিতে। ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি, ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিলেও সংসদে বিরোধী দলের মর্যাদালাভ করতে পারেনি।
দশম ও একাদশ সংসদে অনুগত বিরোধী দলের ভূমিকায় আছে জাতীয় পার্টি। সংসদে উত্তাপ ছড়ানোর ভূমিকায় জাতীয় পার্টি নেই। প্রয়াত স্বৈরশাসক এরশাদের হাতে গড়া এ দলটি গাছেরটা খাওয়া ও তলারটা কুড়ানোর রাজনীতি করছে; অর্থাৎ তারা যেমন আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের সঙ্গে আছে, তেমনি বিরোধী দলেও আছে ঘোষণা দিয়েই। এটাকে গণতান্ত্রিক রাজনীতির এক আজব বৈশিষ্ট্য হিসেবেই হয়তো একসময় উল্লেখ করা হবে।
বিএনপিকে বলা হয় আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ দল। বিএনপির জনসমর্থন বেশি, না আওয়ামী লীগের—তা নিয়ে তর্কবিতর্ক করার সুযোগ আছে। সাংগঠনিক শক্তি এবং জনসমর্থন বিচারে আওয়ামী লীগের চেয়ে বিএনপি পিছিয়ে আছে, এটা মানতে সবাই রাজি না হলেও বাস্তবতা অনেকটা তেমনই।
পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে মনে করা হতো আওয়ামী লীগ আর বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় যেতে পারবে না। এখন বলা হচ্ছে, বিএনপির হাতে আর কখনো বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের ভার যাবে না। আসলে কী হবে, তা নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী হয়তো কেউ কেউ করতে পারবেন; কিন্তু সেটা শেষ কথা হবে না । ‘রাজনীতিতে শেষ কথা নেই’ বলে যে বাক্যটি চালু হয়েছে, তা একেবারে উপেক্ষা করার মতো নয়।
২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় এবং শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রিত্বে দ্বিতীয় দফায় আওয়ামী লীগের সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে কিছু গুণগত পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছে, যা অনেক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষক গভীরে গিয়ে অনুধাবন করতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। বর্তমান শতাব্দীর সূচনায় দেশের ভেতরের এবং বিশ্বপরিসরে পরিবর্তিত পরিস্থিতি ও বাস্তবতায় আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার কিছু রাজনৈতিক পদক্ষেপ এবং সিদ্ধান্ত আমাদের দেশের রাজনীতির গতানুগতিক ধারা পরিবর্তনে বাতাস ছড়িয়েছে। সরকারবিরোধী রাজনীতিকে অকার্যকর করার জন্য শেখ হাসিনার কৌশলী পদক্ষেপগুলো অনেকেই আমলে নিতে পারেননি। আমাদের দেশের রাজনীতিতে শত্রু-মিত্র বাছাইয়ের সনাতন পথে না হেঁটে শেখ হাসিনা একটু অন্য পথে চলে ভালো ফল পেয়েছেন। তিনি তাঁর বিবেচনায় বড় শত্রুকে মোকাবিলার জন্য ছোট শত্রুর সঙ্গে মিত্রতার সম্পর্ক গড়েছেন। তিনি আসলে কী করতে চান, তা অনেক সময় অস্পষ্ট রেখেছেন। অথচ বিএনপি তার চেনা পথে চলে, রাজপথ গরম করার রাজনীতি অব্যাহত রেখে সরকারের গদি টলাতে না পারলেও মানুষের মনে চরম বিরক্তি উৎপাদনে সক্ষম হয়েছে। বিএনপি মিত্র হিসেবে জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গে নিয়ে সারা দেশে আগুন জ্বালিয়ে সরকারের আসন পোড়ানোর বদলে নিজেদের কপাল পুড়িয়েছে। বাসে-ট্রেনে-লঞ্চে আগুন দেওয়ার উত্তাপ সরকার পর্যন্ত না গেলেও অসংখ্য গরিব মানুষের সংসারে গিয়ে লেগেছে এবং তাতে বিএনপির প্রতি তাদের সমর্থন বাড়েনি। এখন বিএনপি না পারছে সংসদের ভেতরে চাপ সৃষ্টি করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে, না পারছে রাজপথে তাপ ছড়িয়ে সরকারের গদিতে থাকার পরিবেশ অসহনীয় করে তুলতে।
দীর্ঘ সময় করোনা-ঘুম দিয়ে বিএনপি এখন সিরিজ মিটিং করছে করণীয় ঠিক করতে। আগে করণীয় ঠিক করতে তো বিএনপিকে এত লম্বা সময় ধরে মিটিং-সিটিং করতে হয়নি। এবার কেন লাগছে? কারণ বিএনপি কিছুটা কল্পলোকে বিচরণ করেই এত দিন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বা কর্মসূচি দিয়ে হাত পুড়িয়ে এখন অতিসাবধানে চলতে চাইছে। বিএনপি বুঝেছে যে সাবধানের মার নেই। এই সহজ পাঠটি নিতে গিয়ে বিএনপি সম্ভবত এটাও ভুলে বসেছে যে মারেরও কিন্তু সাবধান নেই! অর্থাৎ বিপদ বা সমস্যা বলে-কয়ে আসে না। বিএনপি সাবধানে পথ চলতে গিয়ে যেন এই ভুল করে না বসে যে, সবাই একসঙ্গে পথে নেমে এলেই আওয়ামী লীগ সরকার দৌড়ে পালাবে। হাতি কাদায় পড়লে মশাও তার সঙ্গে মশকরা করে। বিএনপিকে এখন নানাজন নানা পরামর্শ দিচ্ছে। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, জেনারেল ইবরাহিম, মাহমুদুর রহমান মান্না, নুরুল হক নুর থেকে শুরু করে ‘গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল’ বা ‘ঢাল নেই তলোয়ার নেই, নিধিরাম সরদার’ গোছের অনেকেই বিএনপিকে রাজপথে নেমে আগুন জ্বালানোর বুদ্ধি দিচ্ছেন।
রাজপথে মানুষের ঢল নামলেই যেমন সরকারের পরিবর্তন হয় না, আবার জবরদস্তি করে সরকারের পতন ঘটালেও যে সাধারণ মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না–এর অনেক দৃষ্টান্ত পৃথিবীর কিছু দেশের সাম্প্রতিক ঘটনা থেকেও দেওয়া যায়। দেশের মানুষ আন্তরিকভাবে পরিবর্তন তখনই চাইবে, যখন বুঝতে পারবে যে সেই পরিবর্তন তাকে গরম কড়াই থেকে জ্বলন্ত চুলায় ফেলবে না।
বিএনপির সিরিজ মতবিনিময় সভায় তৃণমূল নেতাদের কেউ কেউ বলেছেন, নব্বইয়ের এরশাদবিরোধী আন্দোলনের ধারায় রাজপথে নেমে সফল হওয়া যাবে না।
কারণ, গত এক দশকে রাষ্ট্রযন্ত্র ও প্রশাসন অনেক বদলে গেছে। এখনকার রাষ্ট্রযন্ত্র কট্টর দলীয় লোকজন দিয়ে সাজানো। এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়েই কর্মপন্থা ঠিক করতে হবে।
সরকারকে সরানোর আন্দোলনের নেতৃত্ব দেবেন কে বা কারা? বিএনপি সরকার গঠন করলে কে হবেন প্রধানমন্ত্রী—খালেদা জিয়া, নাকি তারেক রহমান? না অন্য কেউ? একটি ‘মুখ’ সামনে স্পষ্ট না হয়ে উঠলে মানুষকে সাধারণত পরিবর্তনমুখী হতে দেখা যায় না। বিএনপি যে বদলেছে, সেটা মানুষের কাছে পরিষ্কার করতে না পারা পর্যন্ত বিএনপির সামনে অপেক্ষার বিকল্প বুঝি নেই।
লেখক: সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
বিরোধী দল, নির্বাচন–এসব গণতন্ত্রের প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ছাড়া বহুদলীয় গণতন্ত্র হয় না। আবার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শক্তিশালী বিরোধী দলের উপস্থিতিও অতি জরুরি। বাংলাদেশে এখন কেমন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কার্যকর আছে, তা নিয়ে বিতর্ক করা যেতে পারে। তবে একমত হওয়া সহজ হবে না। আমরা বহুদলীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় আছি বলে দাবি করা হলেও দেশে অংশগ্রহণমূলক না হয়ে বিতর্কিত নির্বাচন হচ্ছে, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে এবং জাতীয় সংসদে প্রকৃত বিরোধী দলের অনুপস্থিতির কারণে সংসদের প্রতি মানুষের আগ্রহ কমছে।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আগে মানুষের যে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল, দিন দিন তা-ও আর থাকছে না। মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সমস্যা এখন আর রাজনৈতিক দলের কর্মসূচির মধ্যে নেই। ক্ষমতার বাইরে থেকেও যে জনকল্যাণে নিয়োজিত থাকা যায়, বিপদে-আপদে মানুষের পাশে থেকে যে তাদের সঙ্গে একটি হার্দিক সম্পর্ক তৈরি করা যায়, স্থানীয় কিছু সমস্যা যে স্থানীয় উদ্যোগেও সমাধান করা যায়, এগুলো এখন আর কারও বিবেচনার মধ্যে থাকে না।
সরকারের ওপর নির্ভরতা বেড়েছে। সবকিছুর জন্যই সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকা এখন বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘এটা আমাদের দাবি, এটা দিতে হবে’–এ-ই হয়ে উঠেছে আজকের রাজনীতির মূল কথা। সাধারণ মানুষকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে তোলা রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব হলেও এখন আর রাজনৈতিক দলগুলো সে দায়িত্ব সেভাবে পালন করে না।
ক্ষমতায় থাকা এবং ক্ষমতায় যাওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা মানুষকে আর উৎসাহিত করছে না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, আমি বাংলার মানুষের ভালোবাসা চাই।’ তিনি কিন্তু দুটোই পেয়েছিলেন। মানুষ তাঁকে বিশ্বাস করেছিল, তাঁকে আস্থায় নিয়েছিল। মওলানা ভাসানী কিংবা মণি সিংহ, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের মতো নেতারা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য কামড়াকামড়ি করেননি বলেই মানুষের ভালোবাসা পেয়েছিলেন।
শেখ মুজিব কিন্তু তাঁর শর্ত না মানা হলে নির্বাচনে না-যাওয়ার জন্য গোঁ ধরে থাকেননি; বরং ইয়াহিয়ার এলএফওর (লিগাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার) অধীনেই ১৯৭০ সালের নির্বাচনে গিয়েছিলেন। তিনি আন্দোলন এবং আলোচনা দুই অস্ত্রকেই ব্যবহার করেছেন। আইয়ুব খান কিংবা ইয়াহিয়া খান তাঁর সঙ্গে ভালো আচরণ করেননি বলে তাঁদের সঙ্গে কথা বলা বা আলোচনার দুয়ার বন্ধ করে দেননি। তিনি চেষ্টা করেছেন শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সমঝোতার। ‘এক দফা এক দাবি’—এই চরম অবস্থায় যাওয়ার আগে মাঠ তৈরির কাজ করতে হতো। গায়ের শক্তি দিয়ে নয়; বরং কৌশলের শক্তি দিয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার চেষ্টা এখন আর তেমন দেখা যায় না। এখনকার রাজনীতি কৌশলের খেলা না হয়ে বাহুবলের খেলা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই মানুষের সঙ্গে রাজনীতির দূরত্ব তৈরি হয়েছে, নেতাদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সংযোগ কমে আসছে। তৃণমূল পর্যায়ে মানুষের সঙ্গে থেকে, তাদের সুখ-দুঃখের ভাগীদার হয়ে এখন আর নেতা হতে হয় না। এখন নেতা ওপর থেকে জনতার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। জনগণ নিরূপায় হয়ে তা মেনে নিতে বাধ্য হয়।
এটা ঠিক যে ব্যক্তিগত প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির বিষয়টি রাজনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি হওয়ার সংস্কৃতিও একদিনে তৈরি হয়নি, ধীরে ধীরেই হয়েছে। চাহিদাপত্র হাতে নিয়ে যে রাজনীতি তার শেষ কোথায়—তা কেউ বলতে পারবে না। গত দুটি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে বিশেষ পরিস্থিতিতে। ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি, ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিলেও সংসদে বিরোধী দলের মর্যাদালাভ করতে পারেনি।
দশম ও একাদশ সংসদে অনুগত বিরোধী দলের ভূমিকায় আছে জাতীয় পার্টি। সংসদে উত্তাপ ছড়ানোর ভূমিকায় জাতীয় পার্টি নেই। প্রয়াত স্বৈরশাসক এরশাদের হাতে গড়া এ দলটি গাছেরটা খাওয়া ও তলারটা কুড়ানোর রাজনীতি করছে; অর্থাৎ তারা যেমন আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের সঙ্গে আছে, তেমনি বিরোধী দলেও আছে ঘোষণা দিয়েই। এটাকে গণতান্ত্রিক রাজনীতির এক আজব বৈশিষ্ট্য হিসেবেই হয়তো একসময় উল্লেখ করা হবে।
বিএনপিকে বলা হয় আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ দল। বিএনপির জনসমর্থন বেশি, না আওয়ামী লীগের—তা নিয়ে তর্কবিতর্ক করার সুযোগ আছে। সাংগঠনিক শক্তি এবং জনসমর্থন বিচারে আওয়ামী লীগের চেয়ে বিএনপি পিছিয়ে আছে, এটা মানতে সবাই রাজি না হলেও বাস্তবতা অনেকটা তেমনই।
পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে মনে করা হতো আওয়ামী লীগ আর বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় যেতে পারবে না। এখন বলা হচ্ছে, বিএনপির হাতে আর কখনো বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের ভার যাবে না। আসলে কী হবে, তা নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী হয়তো কেউ কেউ করতে পারবেন; কিন্তু সেটা শেষ কথা হবে না । ‘রাজনীতিতে শেষ কথা নেই’ বলে যে বাক্যটি চালু হয়েছে, তা একেবারে উপেক্ষা করার মতো নয়।
২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় এবং শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রিত্বে দ্বিতীয় দফায় আওয়ামী লীগের সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে কিছু গুণগত পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছে, যা অনেক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষক গভীরে গিয়ে অনুধাবন করতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। বর্তমান শতাব্দীর সূচনায় দেশের ভেতরের এবং বিশ্বপরিসরে পরিবর্তিত পরিস্থিতি ও বাস্তবতায় আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার কিছু রাজনৈতিক পদক্ষেপ এবং সিদ্ধান্ত আমাদের দেশের রাজনীতির গতানুগতিক ধারা পরিবর্তনে বাতাস ছড়িয়েছে। সরকারবিরোধী রাজনীতিকে অকার্যকর করার জন্য শেখ হাসিনার কৌশলী পদক্ষেপগুলো অনেকেই আমলে নিতে পারেননি। আমাদের দেশের রাজনীতিতে শত্রু-মিত্র বাছাইয়ের সনাতন পথে না হেঁটে শেখ হাসিনা একটু অন্য পথে চলে ভালো ফল পেয়েছেন। তিনি তাঁর বিবেচনায় বড় শত্রুকে মোকাবিলার জন্য ছোট শত্রুর সঙ্গে মিত্রতার সম্পর্ক গড়েছেন। তিনি আসলে কী করতে চান, তা অনেক সময় অস্পষ্ট রেখেছেন। অথচ বিএনপি তার চেনা পথে চলে, রাজপথ গরম করার রাজনীতি অব্যাহত রেখে সরকারের গদি টলাতে না পারলেও মানুষের মনে চরম বিরক্তি উৎপাদনে সক্ষম হয়েছে। বিএনপি মিত্র হিসেবে জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গে নিয়ে সারা দেশে আগুন জ্বালিয়ে সরকারের আসন পোড়ানোর বদলে নিজেদের কপাল পুড়িয়েছে। বাসে-ট্রেনে-লঞ্চে আগুন দেওয়ার উত্তাপ সরকার পর্যন্ত না গেলেও অসংখ্য গরিব মানুষের সংসারে গিয়ে লেগেছে এবং তাতে বিএনপির প্রতি তাদের সমর্থন বাড়েনি। এখন বিএনপি না পারছে সংসদের ভেতরে চাপ সৃষ্টি করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে, না পারছে রাজপথে তাপ ছড়িয়ে সরকারের গদিতে থাকার পরিবেশ অসহনীয় করে তুলতে।
দীর্ঘ সময় করোনা-ঘুম দিয়ে বিএনপি এখন সিরিজ মিটিং করছে করণীয় ঠিক করতে। আগে করণীয় ঠিক করতে তো বিএনপিকে এত লম্বা সময় ধরে মিটিং-সিটিং করতে হয়নি। এবার কেন লাগছে? কারণ বিএনপি কিছুটা কল্পলোকে বিচরণ করেই এত দিন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বা কর্মসূচি দিয়ে হাত পুড়িয়ে এখন অতিসাবধানে চলতে চাইছে। বিএনপি বুঝেছে যে সাবধানের মার নেই। এই সহজ পাঠটি নিতে গিয়ে বিএনপি সম্ভবত এটাও ভুলে বসেছে যে মারেরও কিন্তু সাবধান নেই! অর্থাৎ বিপদ বা সমস্যা বলে-কয়ে আসে না। বিএনপি সাবধানে পথ চলতে গিয়ে যেন এই ভুল করে না বসে যে, সবাই একসঙ্গে পথে নেমে এলেই আওয়ামী লীগ সরকার দৌড়ে পালাবে। হাতি কাদায় পড়লে মশাও তার সঙ্গে মশকরা করে। বিএনপিকে এখন নানাজন নানা পরামর্শ দিচ্ছে। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, জেনারেল ইবরাহিম, মাহমুদুর রহমান মান্না, নুরুল হক নুর থেকে শুরু করে ‘গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল’ বা ‘ঢাল নেই তলোয়ার নেই, নিধিরাম সরদার’ গোছের অনেকেই বিএনপিকে রাজপথে নেমে আগুন জ্বালানোর বুদ্ধি দিচ্ছেন।
রাজপথে মানুষের ঢল নামলেই যেমন সরকারের পরিবর্তন হয় না, আবার জবরদস্তি করে সরকারের পতন ঘটালেও যে সাধারণ মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না–এর অনেক দৃষ্টান্ত পৃথিবীর কিছু দেশের সাম্প্রতিক ঘটনা থেকেও দেওয়া যায়। দেশের মানুষ আন্তরিকভাবে পরিবর্তন তখনই চাইবে, যখন বুঝতে পারবে যে সেই পরিবর্তন তাকে গরম কড়াই থেকে জ্বলন্ত চুলায় ফেলবে না।
বিএনপির সিরিজ মতবিনিময় সভায় তৃণমূল নেতাদের কেউ কেউ বলেছেন, নব্বইয়ের এরশাদবিরোধী আন্দোলনের ধারায় রাজপথে নেমে সফল হওয়া যাবে না।
কারণ, গত এক দশকে রাষ্ট্রযন্ত্র ও প্রশাসন অনেক বদলে গেছে। এখনকার রাষ্ট্রযন্ত্র কট্টর দলীয় লোকজন দিয়ে সাজানো। এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়েই কর্মপন্থা ঠিক করতে হবে।
সরকারকে সরানোর আন্দোলনের নেতৃত্ব দেবেন কে বা কারা? বিএনপি সরকার গঠন করলে কে হবেন প্রধানমন্ত্রী—খালেদা জিয়া, নাকি তারেক রহমান? না অন্য কেউ? একটি ‘মুখ’ সামনে স্পষ্ট না হয়ে উঠলে মানুষকে সাধারণত পরিবর্তনমুখী হতে দেখা যায় না। বিএনপি যে বদলেছে, সেটা মানুষের কাছে পরিষ্কার করতে না পারা পর্যন্ত বিএনপির সামনে অপেক্ষার বিকল্প বুঝি নেই।
লেখক: সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
দলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
২ ঘণ্টা আগেশেখ হাসিনা সরকারের পতনের ১০০ দিন পার হয়ে গেছে। ১০০ দিনে অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কিছু যে হয়নি, তা নয়। তবে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে অস্থিরতার লক্ষণ অস্পষ্ট নয়। এর মধ্যেই তিন দফায় উপদেষ্টার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।
২ ঘণ্টা আগেবাংলা ভাষায় অতিপরিচিত একটি শব্দবন্ধ হলো ‘খোলনলচে’। যাপিত জীবনে কমবেশি আমরা সবাই শব্দবন্ধটি প্রয়োগ করেছি। বাংলা বাগধারায় আমরা পড়েছি ‘খোলনলচে পালটানো’। বাংলা অভিধানে খোল শব্দের একাধিক অর্থ রয়েছে।
২ ঘণ্টা আগেঅফিসে যাতায়াতের সময় স্টাফ বাসে পরিচয়ের সূত্রে ফারজানা আক্তার আজিমপুরে নিজের বাসায় সাবলেট দিয়েছিলেন ফাতেমা আক্তার শাপলা নামের এক নারীকে। কিন্তু ফাতেমা যে একটি প্রতারক চক্রের সদস্য, সেটা তাঁর জানা ছিল না।
২ ঘণ্টা আগে