নজরুল জাহিদ
যৌনতা মানুষের আদিমতম প্রবৃত্তি। কিন্তু আদিম মানুষের যৌনতা, আর আধুনিক মানুষের যৌনতায় প্রভেদ আছে। আদিকালে যা বংশবিস্তারের জন্য নিতান্ত রুটিন একটা প্রয়োজন ছিল, বুদ্ধিমান মানবজাতি তাকে ক্রমে দেহ-মনের পূর্ণ বিকাশ আর পরিতৃপ্তির উপায় হিসেবে নির্মাণ করেছে। মানুষ যেমন কাঁচা মাংসকে ক্রমে রান্না করা খাওয়া শিখেছে, তেমন যৌনতাকেও কল্পনায়, শৃঙ্গারে, উপাচারে, রাগমোচনে তুরীয় আনন্দ উপভোগের মাধ্যমে শিল্পে পরিণত করেছে। ‘হ্যাভিং সেক্স’-কে ‘মেকিং লাভ’-এ রূপ দিয়েছে।
কিন্তু যৌনতার এই অভিযাত্রায় নারী আর পুরুষের প্রাপ্তি সমান থাকেনি। একযাত্রায় দুই ফল হয়েছে। আদিম মাতৃতান্ত্রিক সমাজ কাঠামো থেকে পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতা-কাঠামোর রূপান্তরে প্রধানত বঞ্চিত হয়েছে নারী। এই বঞ্চনা কেবল রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক নয়, মানসিক ও শারীরিকও। নারী-পুরুষের বৈষম্য ঘোচাতে তাই যৌনতার মুক্তি দরকার।
এই নিবন্ধে আমরা খুব সংক্ষেপে যৌনতার এই জার্নিটা দেখতে চাইব। দেখতে চাইব পুরুষের ‘ক্ষমতা’ কীভাবে তৈরি হলো, কীভাবে তা নারীর মনোদৈহিক বিকাশের পথে বাধা দিল এবং সফল যৌনতা কীভাবে নারী-পুরুষের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য দূর করার উপায় হিসেবে কাজে লাগতে পারে।
আদিজ্ঞান: শ্বাপদসংকুল বৈরী পৃথিবীতে মানুষের টিকে থাকা কঠিন ছিল। অন্য হিংস্র প্রাণিকুলের সঙ্গে যুঝে টিকে থাকার জন্য মানুষের নিজ গোষ্ঠীর লোকবল বাড়ানোর প্রয়োজন ছিল। কিন্তু বংশবৃদ্ধির ক্ষেত্রে সকল স্তন্যপায়ী (mammal) প্রাণীর মধ্যে মানুষের প্রধান সীমাবদ্ধতা ছিল তাদের নারীরা বছরে একবারের বেশি সন্তান জন্ম দিতে পারে না (uniparous) এবং শারীরিক শক্তিতে দুর্বল হওয়ায় মানুষের বাচ্চা বাঁচেও কম।
অন্যদিকে শত্রুপক্ষের নারীরা একবারে অনেকগুলো বাচ্চা দিতে পারে (pluriparous) এবং সেসব বাচ্চারা বেঁচেও থাকে বেশি সংখ্যায়। গোষ্ঠীর শক্তিবৃদ্ধির জন্য প্রচুর সন্তান জন্মদান প্রয়োজন—সারভাইভালের এই আদিজ্ঞান যত বাড়ল, নারীর গুরুত্বও তত বাড়তে থাকল। ফলে প্রিমিটিভ সমাজ হয়ে উঠল নারীপ্রধান। যেহেতু বছরে একটি মাত্র সন্তান হওয়ায় একজন নারীর পক্ষে গোষ্ঠীর চাহিদার তুলনায় সাপ্লাই নিশ্চিত করা ছিল অসম্ভব, সেহেতু পুরুষের বহুগামিতাও প্রয়োজনেরই অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যৌনতায় বহুগামিতা (polygamy) না থাকলে মানবজাতি পৃথিবীতে টিকতে পারত না।
উদ্বৃত্ত পুঁজি: আদিকালের কোনো এক স্তরে মানুষের হাতে জমিয়ে রাখার মতো খাদ্য এল, আর বসে থাকার মতো সময়ও এল। এই অবসরে উন্নত মস্তিষ্কের মানুষ যৌনতাকে প্রজনন (reproduction) থেকে বিনোদনে (recreation) উত্তীর্ণ করার ফুরসত পেল। মানুষ ছাড়া অন্য কোনো প্রাণীর জীবনে এই অবসর না আসায় তারা যৌনতাকে বিনোদনে রূপ দিতে পারল না। এ কারণেই মানুষ ছাড়া অন্য কোনো প্রাণী কদাচ সন্তান ধারণ ভিন্ন নিজ শরীরের আরাম বা আনন্দের জন্য সেক্স করে। ঠিক কোন সময়ে এই পরিবর্তনটা ঘটল, তা স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। কারণ সম্পদের বিভাজন পৃথিবীর সবখানে একই সময়ে সর্বজনীনভাবে ঘটেনি। যেমন, শীতপ্রধান অঞ্চলের মানুষের শীতের জন্য খাদ্য মজুত রাখার প্রয়োজন, আর গ্রীষ্মপ্রধান দেশের মানুষের সেই প্রয়োজন এক ছিল না। আফ্রিকা থেকে প্রথম মানব অভিবাসন শুরু হয়ে তারপর প্রাগৈতিহাসিক যত অভিবাসন হয়েছে, তারও কারণ এক নয়।
যৌনতার আরেক রূপ: সময়ের সঙ্গে মানুষ যৌনতার আরেক রূপ আবিষ্কার করে। গোষ্ঠীর লোকবল বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নিজের আনন্দের জন্যও যৌনসঙ্গমের প্রয়োজন বোধ করতে শেখে তারা। অন্যদিকে গর্ভকাল (গর্ভস্থ সন্তানের ক্ষতির আশঙ্কায় গর্ভকালে সঙ্গম অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ থাকা) ও মাসিকের সময় যৌনমিলন বন্ধ থাকা—এই দুই কারণে পুরুষ আরও বহুগামী হয়ে উঠল। মনে রাখতে হবে, তার আগ থেকেই প্রাকৃতিক কারণে নারীর তুলনায় পুরুষের মধ্যে বহুগামিতার প্রাবল্য ছিল। সেই প্রবৃত্তি (instinct) এখনো আছে। তবে তা আইন, নীতি, প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা ইত্যাদি দ্বারা অনেকাংশে আধুনিক মানুষ নিয়ন্ত্রণও করতে শিখেছে। মানবজাতির একগামিতার
(monogamy) অভিমুখে প্রাতিষ্ঠানিক যাত্রার ইতিহাস মাত্র এক হাজার বছরের মতো।
যৌনতার ধরন: নারী ও পুরুষের যৌনতার ধরন আলাদা (কারণটা প্রাকৃতিক, এবং অজানা)। শরীর সঞ্জাত পরিতৃপ্তির উপায়ও উভয়ের সমান নয়। পুরুষের যৌনতৃপ্তি যদি সমদ্বিবাহু (isoceles) ত্রিভুজ হয়, তাহলে নারীর যৌনতৃপ্তিকে rainbow বা বড়জোর সমবাহু (equilateral) ত্রিভুজের সঙ্গে তুলনা করা যায়। পুরুষ মোরগের মতো দৌড়ে উঠে হাঁসের মতো নেমে যেতে পারে। নারীর জ্বলতে সময় লাগে, নিভতেও সময় লাগে।
নারীর শরীর ‘দেখে’ বা ‘ছুঁয়ে’ পুরুষ যেভাবে ‘উত্তেজিত’ হয়, পুরুষের শরীর দেখে বা ছুঁয়ে নারী সেভাবে উত্তেজিত হয় না। পৃথিবীই যেহেতু মনুষ্য বসবাসযোগ্য একমাত্র গ্রহ (এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত), এবং নারী যেহেতু বছরে একবার তাও একটিমাত্র সন্তান প্রসব করতে পারে, পুরুষের তাই এই ‘যাচ্ছেতাই’ যৌন-ইচ্ছা ও ‘ধরো তক্তা মারো পেরেক’ টাইপ সেক্স করার উদ্দীপনা থাকাটা দরকারি ছিল। শিক্ষা, সভ্যতা, জনসংখ্যা ও পরিবেশের ভারসাম্য বিবেচনায় এখন আর সেই দরকার নেই।
যৌনতৃপ্তি: এতকাল যে যৌনতা কেবল গর্ভধারণের উদ্দেশ্যে যোনিগর্ভে নিছক বীর্যপাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, ইতিহাসের এই পর্বে তাতে যৌনতৃপ্তির বিষয়টা যুক্ত হলো। যৌনজীবনে এই প্রথম পুরুষ একটা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হলো। যেনতেন উপায়ে বীর্য স্খলন হলেই যৌনতায় পুরুষের প্রয়োজন ও তৃপ্তি দুটোই মেলে।
কিন্তু নারীর যেহেতু অমন কোনো স্খলন নেই, তাই তার যৌনতৃপ্তি হওয়া, না-হওয়া, হওয়া দরকার কি-না, এমন বিষয়গুলো যৌনজীবনে সন্নিবেশিত হতে থাকল। যৌনতায় নারীর দাবি স্পষ্ট হতে শুরু করায় এবং যৌনতায় তার প্যাসিভ ভূমিকার পাশাপাশি অ্যাকটিভ ভূমিকার জন্ম হওয়ায় নারীকে নিয়ন্ত্রণেরও প্রয়োজন দেখা দিল। যৌনতায় শৃঙ্গার, আসন বৈচিত্র্য, রাগমোচন, নারীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার আগমন ঘটতে শুরু করায় তাকে নিয়ন্ত্রণের জন্য ধর্ম, নীতিশাস্ত্র ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ কাঠামোর প্রতিষ্ঠাও শুরু হলো।
একই সময়ে সম্পদে ‘আমার’ ধারণা পোক্ত হলো। বলা বাহুল্য সেই ‘আমি’টা পুরুষ। গর্ভ, মাসিক, সন্তান সংরক্ষণ ইত্যাদি শারীরিক কারণে নারীর জন্য আয়েশের বা অবসরের সুবিধা বরাবর ছিল কম। পক্ষান্তরে, সম্পদের মালিকানায় পুরুষের প্রাধান্য বিস্তার, আয়েশি পুরুষের সংখ্যা বৃদ্ধি ইত্যাদির হাত ধরে গোষ্ঠীপতি থেকে পুরুষ রাজ্যপতি (বা রাষ্ট্রপতি) হয়ে নারীর ওপর তার ক্ষমতার বিস্তার ঘটাতে সমর্থ হলো।
যৌন আনন্দ বনাম ক্ষমতা: আদিতে যে যৌনতায় আনন্দের তুলনায় প্রয়োজন বেশি ছিল। ক্রমে সেই যৌনতায় প্রয়োজনের তুলনায় আনন্দ বেশি লক্ষ্য হয়ে উঠল। কিন্তু পুরুষের এই একচেটিয়া আনন্দে বাধ সাধল নারীর ‘যৌনচাহিদা’ বা রাগমোচনের আকাঙ্ক্ষা। কেবল গর্ভবতী করাই নয়, নারীকে তৃপ্ত করাটাও একটা দায়িত্ব হয়ে দাঁড়াল। ফলে এই প্রথম পুরুষ সন্ত্রস্ত (threatened) বোধ করতে শুরু করল।
দেখা গেল, পুরুষশাসিত সমাজে পুরুষের একমাত্র পরাজয় ঘটতে শুরু করল যৌনমিলনে। পুরুষ দিগ্বিজয় করলেও তার উত্থানরহিত পুরুষাঙ্গ বা অকালপতনের আশঙ্কা তাকে নারীর সামনে ভীত করে তুলল। অতএব, স্বয়ংক্রিয়ভাবেই দুর্বলতা ঢাকার পুরুষতান্ত্রিক উপায় হয়ে দাঁড়াল ঔদ্ধত্য। যৌনতায় প্রবেশ ঘটল ক্ষমতার। পুরুষ হয়ে উঠল নারীর মালিক। নারী যেন বিছানায় বেশি না চায়, তার জন্য কেবল শাস্ত্রই নয়; বরং পদ্ধতিরও আবিষ্কার হলো (যেমন FGM)।
প্রেম: একই সঙ্গে শিক্ষারও বিস্তার হচ্ছিল। (কিছু) মানুষ আহার-নিদ্রার জন্য ‘প্রয়োজন’ নয়—এমন বিষয়ের (শিল্প, সাহিত্য, সৌন্দর্য ইত্যাদি) প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠল। ইতিহাসের এই পর্বেই প্রথম মানুষের জীবনে পরিণত রূপে প্রেম এল। প্রেমের সঙ্গে রাষ্ট্রিক না হোক, ব্যক্তিক জীবনে নারীর মূল্য ফিরে আসতে শুরু করল।
কিন্তু তত দিনে পুরুষতন্ত্র নারীকে কেবল সম্পদেই নয়, চৈতন্যেও দৈন্যদশায় ডুবিয়ে দিয়েছে। নারী কেবল পুরুষের কাছেই নয়, নিজের কাছেও ‘অবজেক্ট’ হয়ে উঠেছে। ফরাসি সমাজতাত্ত্বিক ও রাজনীতিক সিমন দ্য বোভোয়ারের ভাষায়—‘মানুষ’ হয়ে জন্মে (পুরুষতন্ত্রের জাঁতাকলে) সে নারী হয়ে উঠেছে। এই অচলাবস্থা থেকে বেরোতে প্রেমের বিকল্প আর কিছু নেই। প্রেম মানেই শ্রদ্ধার সোপান বেয়ে নারী-পুরুষের সমান মর্যাদার জীবন উদ্যাপন করা। প্রেম মানেই সফল যৌনতা, যেখানে নারী কেবল ‘গ্রহীতা’ নয়; দাতাও। প্রেম মানেই এক মনোরম লড়াই, যেখানে উভয় পক্ষ সমানভাবে জয়ী হয়; যেখানে পুরুষের ‘ক্ষমতা’ নারীর স্বাধীন সম্মতিতে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না।
লেখক: বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধির কার্যালয়ের মানবাধিকার বিষয়ক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা
যৌনতা মানুষের আদিমতম প্রবৃত্তি। কিন্তু আদিম মানুষের যৌনতা, আর আধুনিক মানুষের যৌনতায় প্রভেদ আছে। আদিকালে যা বংশবিস্তারের জন্য নিতান্ত রুটিন একটা প্রয়োজন ছিল, বুদ্ধিমান মানবজাতি তাকে ক্রমে দেহ-মনের পূর্ণ বিকাশ আর পরিতৃপ্তির উপায় হিসেবে নির্মাণ করেছে। মানুষ যেমন কাঁচা মাংসকে ক্রমে রান্না করা খাওয়া শিখেছে, তেমন যৌনতাকেও কল্পনায়, শৃঙ্গারে, উপাচারে, রাগমোচনে তুরীয় আনন্দ উপভোগের মাধ্যমে শিল্পে পরিণত করেছে। ‘হ্যাভিং সেক্স’-কে ‘মেকিং লাভ’-এ রূপ দিয়েছে।
কিন্তু যৌনতার এই অভিযাত্রায় নারী আর পুরুষের প্রাপ্তি সমান থাকেনি। একযাত্রায় দুই ফল হয়েছে। আদিম মাতৃতান্ত্রিক সমাজ কাঠামো থেকে পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতা-কাঠামোর রূপান্তরে প্রধানত বঞ্চিত হয়েছে নারী। এই বঞ্চনা কেবল রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক নয়, মানসিক ও শারীরিকও। নারী-পুরুষের বৈষম্য ঘোচাতে তাই যৌনতার মুক্তি দরকার।
এই নিবন্ধে আমরা খুব সংক্ষেপে যৌনতার এই জার্নিটা দেখতে চাইব। দেখতে চাইব পুরুষের ‘ক্ষমতা’ কীভাবে তৈরি হলো, কীভাবে তা নারীর মনোদৈহিক বিকাশের পথে বাধা দিল এবং সফল যৌনতা কীভাবে নারী-পুরুষের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য দূর করার উপায় হিসেবে কাজে লাগতে পারে।
আদিজ্ঞান: শ্বাপদসংকুল বৈরী পৃথিবীতে মানুষের টিকে থাকা কঠিন ছিল। অন্য হিংস্র প্রাণিকুলের সঙ্গে যুঝে টিকে থাকার জন্য মানুষের নিজ গোষ্ঠীর লোকবল বাড়ানোর প্রয়োজন ছিল। কিন্তু বংশবৃদ্ধির ক্ষেত্রে সকল স্তন্যপায়ী (mammal) প্রাণীর মধ্যে মানুষের প্রধান সীমাবদ্ধতা ছিল তাদের নারীরা বছরে একবারের বেশি সন্তান জন্ম দিতে পারে না (uniparous) এবং শারীরিক শক্তিতে দুর্বল হওয়ায় মানুষের বাচ্চা বাঁচেও কম।
অন্যদিকে শত্রুপক্ষের নারীরা একবারে অনেকগুলো বাচ্চা দিতে পারে (pluriparous) এবং সেসব বাচ্চারা বেঁচেও থাকে বেশি সংখ্যায়। গোষ্ঠীর শক্তিবৃদ্ধির জন্য প্রচুর সন্তান জন্মদান প্রয়োজন—সারভাইভালের এই আদিজ্ঞান যত বাড়ল, নারীর গুরুত্বও তত বাড়তে থাকল। ফলে প্রিমিটিভ সমাজ হয়ে উঠল নারীপ্রধান। যেহেতু বছরে একটি মাত্র সন্তান হওয়ায় একজন নারীর পক্ষে গোষ্ঠীর চাহিদার তুলনায় সাপ্লাই নিশ্চিত করা ছিল অসম্ভব, সেহেতু পুরুষের বহুগামিতাও প্রয়োজনেরই অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যৌনতায় বহুগামিতা (polygamy) না থাকলে মানবজাতি পৃথিবীতে টিকতে পারত না।
উদ্বৃত্ত পুঁজি: আদিকালের কোনো এক স্তরে মানুষের হাতে জমিয়ে রাখার মতো খাদ্য এল, আর বসে থাকার মতো সময়ও এল। এই অবসরে উন্নত মস্তিষ্কের মানুষ যৌনতাকে প্রজনন (reproduction) থেকে বিনোদনে (recreation) উত্তীর্ণ করার ফুরসত পেল। মানুষ ছাড়া অন্য কোনো প্রাণীর জীবনে এই অবসর না আসায় তারা যৌনতাকে বিনোদনে রূপ দিতে পারল না। এ কারণেই মানুষ ছাড়া অন্য কোনো প্রাণী কদাচ সন্তান ধারণ ভিন্ন নিজ শরীরের আরাম বা আনন্দের জন্য সেক্স করে। ঠিক কোন সময়ে এই পরিবর্তনটা ঘটল, তা স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। কারণ সম্পদের বিভাজন পৃথিবীর সবখানে একই সময়ে সর্বজনীনভাবে ঘটেনি। যেমন, শীতপ্রধান অঞ্চলের মানুষের শীতের জন্য খাদ্য মজুত রাখার প্রয়োজন, আর গ্রীষ্মপ্রধান দেশের মানুষের সেই প্রয়োজন এক ছিল না। আফ্রিকা থেকে প্রথম মানব অভিবাসন শুরু হয়ে তারপর প্রাগৈতিহাসিক যত অভিবাসন হয়েছে, তারও কারণ এক নয়।
যৌনতার আরেক রূপ: সময়ের সঙ্গে মানুষ যৌনতার আরেক রূপ আবিষ্কার করে। গোষ্ঠীর লোকবল বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নিজের আনন্দের জন্যও যৌনসঙ্গমের প্রয়োজন বোধ করতে শেখে তারা। অন্যদিকে গর্ভকাল (গর্ভস্থ সন্তানের ক্ষতির আশঙ্কায় গর্ভকালে সঙ্গম অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ থাকা) ও মাসিকের সময় যৌনমিলন বন্ধ থাকা—এই দুই কারণে পুরুষ আরও বহুগামী হয়ে উঠল। মনে রাখতে হবে, তার আগ থেকেই প্রাকৃতিক কারণে নারীর তুলনায় পুরুষের মধ্যে বহুগামিতার প্রাবল্য ছিল। সেই প্রবৃত্তি (instinct) এখনো আছে। তবে তা আইন, নীতি, প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা ইত্যাদি দ্বারা অনেকাংশে আধুনিক মানুষ নিয়ন্ত্রণও করতে শিখেছে। মানবজাতির একগামিতার
(monogamy) অভিমুখে প্রাতিষ্ঠানিক যাত্রার ইতিহাস মাত্র এক হাজার বছরের মতো।
যৌনতার ধরন: নারী ও পুরুষের যৌনতার ধরন আলাদা (কারণটা প্রাকৃতিক, এবং অজানা)। শরীর সঞ্জাত পরিতৃপ্তির উপায়ও উভয়ের সমান নয়। পুরুষের যৌনতৃপ্তি যদি সমদ্বিবাহু (isoceles) ত্রিভুজ হয়, তাহলে নারীর যৌনতৃপ্তিকে rainbow বা বড়জোর সমবাহু (equilateral) ত্রিভুজের সঙ্গে তুলনা করা যায়। পুরুষ মোরগের মতো দৌড়ে উঠে হাঁসের মতো নেমে যেতে পারে। নারীর জ্বলতে সময় লাগে, নিভতেও সময় লাগে।
নারীর শরীর ‘দেখে’ বা ‘ছুঁয়ে’ পুরুষ যেভাবে ‘উত্তেজিত’ হয়, পুরুষের শরীর দেখে বা ছুঁয়ে নারী সেভাবে উত্তেজিত হয় না। পৃথিবীই যেহেতু মনুষ্য বসবাসযোগ্য একমাত্র গ্রহ (এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত), এবং নারী যেহেতু বছরে একবার তাও একটিমাত্র সন্তান প্রসব করতে পারে, পুরুষের তাই এই ‘যাচ্ছেতাই’ যৌন-ইচ্ছা ও ‘ধরো তক্তা মারো পেরেক’ টাইপ সেক্স করার উদ্দীপনা থাকাটা দরকারি ছিল। শিক্ষা, সভ্যতা, জনসংখ্যা ও পরিবেশের ভারসাম্য বিবেচনায় এখন আর সেই দরকার নেই।
যৌনতৃপ্তি: এতকাল যে যৌনতা কেবল গর্ভধারণের উদ্দেশ্যে যোনিগর্ভে নিছক বীর্যপাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, ইতিহাসের এই পর্বে তাতে যৌনতৃপ্তির বিষয়টা যুক্ত হলো। যৌনজীবনে এই প্রথম পুরুষ একটা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হলো। যেনতেন উপায়ে বীর্য স্খলন হলেই যৌনতায় পুরুষের প্রয়োজন ও তৃপ্তি দুটোই মেলে।
কিন্তু নারীর যেহেতু অমন কোনো স্খলন নেই, তাই তার যৌনতৃপ্তি হওয়া, না-হওয়া, হওয়া দরকার কি-না, এমন বিষয়গুলো যৌনজীবনে সন্নিবেশিত হতে থাকল। যৌনতায় নারীর দাবি স্পষ্ট হতে শুরু করায় এবং যৌনতায় তার প্যাসিভ ভূমিকার পাশাপাশি অ্যাকটিভ ভূমিকার জন্ম হওয়ায় নারীকে নিয়ন্ত্রণেরও প্রয়োজন দেখা দিল। যৌনতায় শৃঙ্গার, আসন বৈচিত্র্য, রাগমোচন, নারীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার আগমন ঘটতে শুরু করায় তাকে নিয়ন্ত্রণের জন্য ধর্ম, নীতিশাস্ত্র ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ কাঠামোর প্রতিষ্ঠাও শুরু হলো।
একই সময়ে সম্পদে ‘আমার’ ধারণা পোক্ত হলো। বলা বাহুল্য সেই ‘আমি’টা পুরুষ। গর্ভ, মাসিক, সন্তান সংরক্ষণ ইত্যাদি শারীরিক কারণে নারীর জন্য আয়েশের বা অবসরের সুবিধা বরাবর ছিল কম। পক্ষান্তরে, সম্পদের মালিকানায় পুরুষের প্রাধান্য বিস্তার, আয়েশি পুরুষের সংখ্যা বৃদ্ধি ইত্যাদির হাত ধরে গোষ্ঠীপতি থেকে পুরুষ রাজ্যপতি (বা রাষ্ট্রপতি) হয়ে নারীর ওপর তার ক্ষমতার বিস্তার ঘটাতে সমর্থ হলো।
যৌন আনন্দ বনাম ক্ষমতা: আদিতে যে যৌনতায় আনন্দের তুলনায় প্রয়োজন বেশি ছিল। ক্রমে সেই যৌনতায় প্রয়োজনের তুলনায় আনন্দ বেশি লক্ষ্য হয়ে উঠল। কিন্তু পুরুষের এই একচেটিয়া আনন্দে বাধ সাধল নারীর ‘যৌনচাহিদা’ বা রাগমোচনের আকাঙ্ক্ষা। কেবল গর্ভবতী করাই নয়, নারীকে তৃপ্ত করাটাও একটা দায়িত্ব হয়ে দাঁড়াল। ফলে এই প্রথম পুরুষ সন্ত্রস্ত (threatened) বোধ করতে শুরু করল।
দেখা গেল, পুরুষশাসিত সমাজে পুরুষের একমাত্র পরাজয় ঘটতে শুরু করল যৌনমিলনে। পুরুষ দিগ্বিজয় করলেও তার উত্থানরহিত পুরুষাঙ্গ বা অকালপতনের আশঙ্কা তাকে নারীর সামনে ভীত করে তুলল। অতএব, স্বয়ংক্রিয়ভাবেই দুর্বলতা ঢাকার পুরুষতান্ত্রিক উপায় হয়ে দাঁড়াল ঔদ্ধত্য। যৌনতায় প্রবেশ ঘটল ক্ষমতার। পুরুষ হয়ে উঠল নারীর মালিক। নারী যেন বিছানায় বেশি না চায়, তার জন্য কেবল শাস্ত্রই নয়; বরং পদ্ধতিরও আবিষ্কার হলো (যেমন FGM)।
প্রেম: একই সঙ্গে শিক্ষারও বিস্তার হচ্ছিল। (কিছু) মানুষ আহার-নিদ্রার জন্য ‘প্রয়োজন’ নয়—এমন বিষয়ের (শিল্প, সাহিত্য, সৌন্দর্য ইত্যাদি) প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠল। ইতিহাসের এই পর্বেই প্রথম মানুষের জীবনে পরিণত রূপে প্রেম এল। প্রেমের সঙ্গে রাষ্ট্রিক না হোক, ব্যক্তিক জীবনে নারীর মূল্য ফিরে আসতে শুরু করল।
কিন্তু তত দিনে পুরুষতন্ত্র নারীকে কেবল সম্পদেই নয়, চৈতন্যেও দৈন্যদশায় ডুবিয়ে দিয়েছে। নারী কেবল পুরুষের কাছেই নয়, নিজের কাছেও ‘অবজেক্ট’ হয়ে উঠেছে। ফরাসি সমাজতাত্ত্বিক ও রাজনীতিক সিমন দ্য বোভোয়ারের ভাষায়—‘মানুষ’ হয়ে জন্মে (পুরুষতন্ত্রের জাঁতাকলে) সে নারী হয়ে উঠেছে। এই অচলাবস্থা থেকে বেরোতে প্রেমের বিকল্প আর কিছু নেই। প্রেম মানেই শ্রদ্ধার সোপান বেয়ে নারী-পুরুষের সমান মর্যাদার জীবন উদ্যাপন করা। প্রেম মানেই সফল যৌনতা, যেখানে নারী কেবল ‘গ্রহীতা’ নয়; দাতাও। প্রেম মানেই এক মনোরম লড়াই, যেখানে উভয় পক্ষ সমানভাবে জয়ী হয়; যেখানে পুরুষের ‘ক্ষমতা’ নারীর স্বাধীন সম্মতিতে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না।
লেখক: বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধির কার্যালয়ের মানবাধিকার বিষয়ক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা
শেখ হাসিনার পতিত স্বৈরাচারী সরকার সাড়ে ১৫ বছর ধরে এ দেশের জনগণের মাথাপিছু জিডিপি প্রশংসনীয় গতিতে বাড়ার গল্প সাজিয়ে শাসন করেছে। মাথাপিছু জিডিপি প্রকৃতপক্ষে একটি মারাত্মক ত্রুটিপূর্ণ কনসেপ্ট। এটার সবচেয়ে মারাত্মক সীমাবদ্ধতা হলো, এটা একটা গড়, যেটা স্বল্পসংখ্যক ধনী এবং বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্ন-মধ্যবিত্ত
১১ ঘণ্টা আগেআমাদের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস পৃথিবীকে জলবায়ু-বিপর্যয় থেকে রক্ষার জন্য ‘শূন্য বর্জ্য ও শূন্য কার্বন’-এর ওপর ভিত্তি করে একটি নতুন জীবনধারা গড়ে তোলা প্রয়োজন বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন।
১১ ঘণ্টা আগেআমেরিকার ১৩২ বছরের পুরোনো রেকর্ড ভেঙে একবার হেরে যাওয়ার পর দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রথম মেয়াদে ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ট্রাম্প।
১১ ঘণ্টা আগেজগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বড্ড কষ্ট বুকে নিয়েই ‘সব শালারা বাটপার’ স্লোগানটি দিয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরেই তাঁরা দ্বিতীয় ক্যাম্পাস পাচ্ছেন না। ঠিকাদারেরা ভেলকিবাজি করছেন।ক্যাম্পাসের জন্য জমিও অধিগ্রহণ করা হয়নি।
১১ ঘণ্টা আগে