‘আম্মা, ভাত দ্যান!’

হাবীব ইমন
প্রকাশ : ১৩ আগস্ট ২০২১, ০৮: ৫৯

একটি পোকা কানের মধ্যে সমানে চিৎকার করে যাচ্ছে—‘আম্মা ভাত দ্যান!’

কোনো ধরনের ভয়াবহ পরিস্থিতি নিতে পারি না। সম্ভবত পোস্ট প্যানডেমিক ট্রমার মধ্যে পড়ে গেছি। নিজেকে কেমন যেন অপদার্থ লাগে। ছোটবেলায় দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের মর্মস্পর্শী ছবি অনেকবার দেখতাম, জয়নুলের কথা, বিশেষ করে বাংলা ১৩৫০ সালের মন্বন্তর নিয়ে দুর্ভিক্ষ সিরিজের কাজগুলোর কথা আমার বারবার মনে দাগ কাটে। জয়নুল আবেদিন আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন প্রায় পাঁচ দশক হয়ে যাচ্ছে। এই সময়ে সংকট, দুর্দশা আর বিপর্যয়ে জয়নুলের কাজের প্রসঙ্গ বারবার ফিরে এসেছে। আজও তাই করোনার এই মহামারিকালে জয়নুলের দেখানো পথে তাঁর ছাত্ররা কতটা হাঁটলেন? সময় ও জীবনকে ধরে আঁকা সে রকম কাজগুলো আজকের শিল্পীদের তুলিতে কোথায়?

প্রায় প্রতিদিনই সন্ধ্যা না পেরোতেই বাসা থেকে শিশুর দলবদ্ধ চিৎকার শুনতে পাই। প্রথমে ওরা অল্প কয়েকজন ছিল। এখন ওদের দলটা আরেকটু বড় হয়েছে, ভারী হয়েছে। ‘আম্মা ভাত দ্যান!’—ক্ষুধিত শিশুদের হাহাকার দিনদিন বেড়ে চলছে। খুব তাড়াতাড়িই মর্মান্তিক বাস্তবতার পূর্বাভাস আমাদের সামনে চলে এসেছে। অপুষ্টি, পানির নিরাপত্তাহীনতা ও মড়কের মতো বিষয়গুলো শিশুদের ভোগাবে। 

আন্তর্জাতিক শিশুকেন্দ্রিক উন্নয়ন সংস্থা ওয়ার্ল্ডভিশন বলছে, করোনার প্রভাবে পরিবারের অর্থনৈতিক মন্দার কারণে পিতামাতা ও অভিভাবকদের চাপ তৈরি হওয়ায় শিশুরা ক্রমাগত নিঃসঙ্গতা অনুভব করছে। এ ছাড়া ‘আউট অব টাইমস’ শিরোনামে ২০২০ সালের জুলাইয়ে এক প্রতিবেদনে সতর্ক করা হয়েছিল, কোভিড-১৯-এর অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবে শিশুর ক্ষুধা বৃদ্ধির যে আশঙ্কা করা হয়েছিল, তা ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। উন্নয়ন সংস্থা ওয়ার্ল্ডভিশন বলছে, পিতামাতার পর্যাপ্ত খাবার কেনার সামর্থ্যের অভাবে এই অঞ্চলের সিংহভাগ শিশু ভিক্ষাবৃত্তি, শিশুশ্রম ও বাল্যবিবাহের ঝুঁকিতে পড়তে পারে। তাদের পরিচালিত একটি র‍্যাপিড অ্যাসেসমেন্টে দেখা গেছে, বাংলাদেশে লকডাউনের প্রভাবে পরিবারের আয় কমে যাওয়ায় আরও ৮৭ শতাংশ শিশু উদ্বিগ্ন। চরম বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে ওদের জীবন কাটছে। 
এই করোনাকাল কি কেড়ে নিয়েছে ওদের শৈশবের আনন্দময় দিনগুলো? কেড়ে নিয়েছে তার শিক্ষার অধিকারটুকু? কে জানে? হয়তো বড়সড় পণ্ডিতজনেরা অনেক তেল-জল ব্যয় করে এর নিদান দেবেন। এই শিশুদের কোনো দিন জানাও হবে না ওদের নিয়ে গবেষণার ইতিবৃত্ত। অন্যদিকে হয়তো ওদের জন্য অনেক পরিকল্পনা হবে। ওরা কেবল ফিরে পাবে না হারিয়ে যাওয়া শৈশব। 

খিলগাঁও রেলগেটের পাশে তিনটে বাচ্চা কাড়াকাড়ি করছে একটি বাটি নিয়ে। কী খাচ্ছ? বাসন উঁচিয়ে উত্তর দেয়, মুড়ি। এরা কারা—জিজ্ঞাসা করতেই কেঁদে ফেলেন একজন নারী। শিল্পী তাঁর নাম। তিনি বলেন, ‘সব কটাই আমার ছাও (বাচ্চা)। ঘরে খাওনের কিচ্ছু নাই। পোলাপাইনগুলা কান্দে। যেই বাসায় কাম করতাম, হেরাও ঘরে ঢুকবার দেয় না। এই পোলাপানগুলার লাইগা খাওন ক্যামনে জোগাড় করুম, চিন্তায় আমার পরানে পানি নাই।’

মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকা শিল্পীর মুখে কথা নেই। ফ্যালফ্যাল করে সন্তানদের দিকে তাকিয়ে আছেন। কোথা থেকে কোনো সাহায্য পাওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করতেই হুঁশ ফিরল তাঁর। চোখে তখনো পানি শুকায়নি। কণ্ঠে রাজ্যের আক্ষেপ নিয়ে বললেন, ‘সাহায্য কে দিব! কাউন্সিলরের কাছে গিয়া কতবার ঘুইরা আইছি, কিছুই দেন নাই। এই অভাবের দিনে সরকার আমাগো কি কিছু দিতে পারে না?’

 রাজধানীজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে শিল্পীর মতো এমন হাজারো নিরন্ন মানুষের হাহাকার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুসারে, এদের সংখ্যা ২০ লাখেরও বেশি। করোনার বিস্তার রোধে ঘরে থাকা, স্বাস্থ্যবিধি, সামাজিক দূরত্ব মানা, ঘন ঘন হাত ধোয়া, মাস্ক পরার মতো নির্দেশনাগুলো এদের কাছে উপহাস ছাড়া আর কিছুই নয়। লকডাউন এদের কাছে ‘সুরক্ষা’ নয়, ‘যন্ত্রণা’। শিল্পীর মতো পেটে ক্ষুধা বয়ে বেড়ানো ভাগ্যহত মানুষগুলোর কাছে লকডাউন মানেই বিষফোড়া। খাবারের খোঁজে দিন-রাত আক্ষেপ করতে থাকা মানুষ যেন সমাজের বিদ্যমান অসংগতি আর বৈষম্যকেই দেখিয়ে দিচ্ছে চোখে আঙুল দিয়ে।

হাইকোর্ট এলাকা, রমনা, কমলাপুর, কাওরান বাজার (তেজগাঁও) রেলস্টেশন, এজিবি কলোনিসহ রাজধানীজুড়েই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে বস্তা, পলিথিন দিয়ে ঘর তুলে বাস করা ছিন্নমূল মানুষ। যেখানে রান্না, খাওয়া, সেখানেই দিনের শুরু আর রাত শেষ হয় এদের। স্বাস্থ্যবিধি দূরের কথা, কারও মুখে মাস্কও নেই। লকডাউনের সময় কাজ থাকে না, খাওয়াও জোটে না। ঘরে খাদ্যের জন্য সন্তানের করুণ চাহনি আর বাইরে পুলিশের লাঠিপেটা। মানুষের কাছে পেটের ক্ষুধাই সবচেয়ে বড় মহামারি।

বিশ্ব খাদ্য সংস্থার সহায়তায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ‘নগর আর্থসামাজিক অবস্থা জরিপ-২০১৯’-এর ফলাফলে উঠে এসেছে রাজধানীসহ মহানগরগুলোতে নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের ক্ষুধার হাহাকারের এক চিত্র। দেশের মহানগরগুলোতে ৮ দশমিক ২২ শতাংশ পরিবারের কোনো না কোনো সদস্যকে খাবার না থাকায় ক্ষুধার্ত অবস্থায়ই রাত কাটাতে হয়েছে (করোনাকালের আগেই)।

একসময় যে সন্তানকে পায়ের ওপরে বালিশ পেতে শোনাতেন অনাহারি রাক্ষুসের কেচ্ছা, সেই ক্ষুধার তাড়না তাঁকেও পেয়ে বসেছে। ভুলতে বসেছেন সেই সন্তানের নাম। সেই মা আজ ভিক্ষা করেন। মানুষ বের হয় না, তাই ভিক্ষা মেলে না। তবু রাস্তার ধারে দুচোখে অপেক্ষা নিয়ে বসে থাকেন। জিজ্ঞাসা করতেই মাথা নিচু তাঁর, মাথা তুলে ছলছলে চোখে জানালেন, ‘ভিক্ষা নাই, পয়সা নাই, খাওনও নাই। তয় বাতাসের এই অসুখটা চইলা গেলে আবারও প্যাট ভইরা খামু।’

সময়টা ১৯৩৯ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। সেই যুদ্ধের থাবা থেকে বাংলাদেশও রেহাই পেল না। তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের নিষ্ঠুর নীতির কারণে বাংলায় খাদ্যের সংকট দেখা দিল। তিনি বাংলার মানুষের মুখের গ্রাসের আকাল বানিয়ে ব্রিটিশ সৈন্যদের খাবারসহ অন্যান্য রসদ জোগালেন। যার ফলে বাংলা ১৩৫০ সালে বাংলায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। গ্রামে-শহরে অগণিত মানুষ। ক্ষুধার তাড়নায় ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। কাক ও কুকুরের সঙ্গে বুভুক্ষু মানুষ অখাদ্য-কুখাদ্য খুঁজে ফিরছে ডাস্টবিনে, নর্দমায়। সেই চিত্র বুঝি আবার ফিরে আসছে।

বিকেলে একদিন বের হয়েছি, কিছু জিনিসপত্র কেনার জন্য। ফেরার পথে হাতে থাকা খাবারের ব্যাগটা ছিনিয়ে নিল কয়েকটি শিশু। এ রকম দৃশ্য আগে দেখিনি। একটা চাপা যন্ত্রণা অনুভব করলাম। আর মাথার ভেতরে তখন ওই একটা চিৎকার ঘুরছে তো ঘুরছেই—‘আম্মা, ভাত দ্যান!’ 

লেখক: সহকারী সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত