কামরুল হাসান, ঢাকা
নজরুলের গানে ‘বিনোদ-বেণী’ বলে একটা কথা আছে। দীঘল কালো চুলের কিশোরীর মাথায় সে রকমই বেণি করা। শ্যামলা বরন মেয়েটির মুখটা একেবারেই শান্ত, দেখলে মনে হয় ভাজা মাছটিও উল্টে খেতে জানে না। কোনো কিছু জিজ্ঞেস করলে ইংরেজির মতো করে বাংলা উচ্চারণ করে। অবাঙালির মুখে প্রথম প্রথম বাংলা শব্দ যেভাবে আছাড় খায়, অনেকটা সেই রকম। তাই আশ্রয়কেন্দ্রের সবাই এই কিশোরীর নাম দিয়েছে ‘লন্ডনী কইন্যা’।
দুই সপ্তাহ ধরে মেয়েটি রয়েছে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল ভবঘুরে আশ্রয়কেন্দ্রে। দলেবলে আমরা সেখানে এসেছি মেয়েটির সত্যিকারের পরিচয় জানতে। আমাদের দলে আছেন মানবাধিকার সংগঠনের একদল কর্মী, ইটিভির সাংবাদিক সুপন রায় ও তাঁর ক্যামেরাপারসন। আমরা যাওয়ার আগেই সেখানে হাজির হয়েছেন জনকণ্ঠের নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি রুমন রেজা। মানবাধিকার সংগঠন ও আশ্রয়কেন্দ্রের কর্মকর্তারা ধরে নিয়েছেন, এই মেয়ে তার নিজের পরিচয় নিয়ে সবাইকে ধন্দে ফেলে দিয়েছে।
তার আগে বলি, মেয়েটি এই আশ্রয়কেন্দ্রে এল কী করে। ২০০০ সালের ২৪ অক্টোবর এক ব্যক্তি তাকে নিয়ে ধানমন্ডি থানায় হাজির হন। পুলিশকে জানান, খুব সকালে তিনি লেকের পাড়ে হাঁটতে গিয়ে দেখেন, ধানমন্ডি ৮ নম্বর ব্রিজের কাছে একা দাঁড়িয়ে কাঁদছে মেয়েটি। ১২-১৩ বছরের মেয়েটির পরিচয় জানতে চাইলে সে জানায়, তার নাম ফ্লোরা। তারা বাঙালি ব্রিটিশ। বাড়িতে সবাই বাংলায় কথা বলে। গেল রাতের ফ্লাইটে সে বাবার সঙ্গে লন্ডন থেকে ঢাকায় এসেছে। কিন্তু বিমানবন্দরে নামার পর বাবাকে হারিয়ে ফেলে। এরপর তাঁর আর কোনো খোঁজ পায়নি। বিমানবন্দরের বাইরে উদ্দেশ্যহীন ঘোরাফেরার সময় এক লোক তাকে বেবিট্যাক্সিতে করে এনে ধানমন্ডি ব্রিজের কাছের রাস্তায় ছেড়ে দেয়। এই শহরের সে কিছুই চেনে না। তার কাছে কারও কোনো ঠিকানা নেই।
ধানমন্ডি থানা-পুলিশের একজন কর্মকর্তা অনেকক্ষণ মেয়েটির সঙ্গে কথা বলে দেশে বা বিদেশের কোনো ঠিকানা উদ্ধারের চেষ্টা করেন। ব্যর্থ হয়ে তাকে এক বেলা থানায় রেখে একটি জিডি করে পাঠানো হয় মিরপুর ভবঘুরে আশ্রয়কেন্দ্রে। সেখানে যাওয়ার পর দেখা গেল, ওই আশ্রয়কেন্দ্রে মেয়েটিকে রাখার মতো ভালো পরিবেশ নেই। এরপর তাকে পাঠানো হয় নতুন তৈরি করা গোদনাইল আশ্রয়কেন্দ্রে। সেই থেকে মেয়েটি সেখানেই আছে।
সরকারের সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা মেয়েটির সঙ্গে কয়েক দফা কথা বলেছেন। এরপর তাঁরা মেয়েটির পরিবারকে খুঁজে বের করতে মানবাধিকার সংগঠনের সহায়তা চেয়েছেন। মানবাধিকার সংস্থা এ দায়িত্ব পাওয়ার পর মেয়েটির দেশের আসার দিনক্ষণ ধরে সব এয়ারলাইনসে খোঁজ করেছে। কিন্তু এই নামে কোনো যাত্রীর খোঁজ পায়নি। এরপর খোঁজা হয় সিলেট ও চট্টগ্রাম রুমের অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট। সেখানেও এ নামে কোনো যাত্রী নেই। একদিন মেয়েটিকে নিয়ে বিমানবন্দরের বিভিন্ন এলাকায় ঘোরানো হয়। সেদিন ক্যানোপি এরিয়া দেখিয়ে বলে, এখান থেকেই সে বাবাকে হারিয়ে ফেলে। বিমানবন্দর ঘুরিয়ে দেখার সময় একটি ঘটনা ঘটে, এক শ্বেতাঙ্গ বিদেশি দেখে ‘পাপা’ বলে চিৎকার করে ওঠে মেয়েটি। তার চিৎকারে সেই বিদেশিও হতভম্ব হয়ে যান। পরে সবাই এ জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। এরপর সবাই ধরে নেন, সত্যিই মেয়েটি বিদেশ থেকে এসেছে।
মানবাধিকার সংস্থা এরপর মেয়েটির ছবি ও নাম দিয়ে ঢাকার ব্রিটিশ দূতাবাসে চিঠি পাঠায়। কিন্তু তারাও এ নিয়ে কোনো কিছু জানাতে পারে না। এ খবর ধীরে ধীরে পত্রিকা অফিসেও চলে আসে। আমার বস শংকর কুমার দে ২০০০ সালের ১৭ ডিসেম্বর মেয়েটিকে নিয়ে একটি রিপোর্ট করেন, ‘অনিশ্চয়তার আবর্তে ফ্লোরার ভবিষ্যৎ’। সে রিপোর্টে মেয়েটির ছবিও ছাপা হয়। রিপোর্ট ছাপার এক দিন পর শংকর কুমার দে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হন। ফলোআপের দায়িত্ব পড়ে আমার ওপর। আমি মানবাধিকার সংগঠন থেকে শুরু করে দরকারি সব তথ্য জোগাড়ের চেষ্টা করি। কিন্তু সন্দেহ হয়, এই গল্পের কোথাও কোনো ফাঁক আছে। এরপর একদিন গোদনাইলে যাই মেয়েটির সঙ্গে কথা বলতে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে তখন অত কড়াকড়ি ছিল না। সাংবাদিক পরিচয় দিলেই কাজ হতো।
মেয়েটির সঙ্গে কথা বলে বের হওয়ার মুখে আশ্রয়কেন্দ্রের পরিচালক রুহুল আমিন আমাকে একটি মজার তথ্য দেন। তিনি বলেন, দুদিন আগে কুমিল্লার মুরাদনগর থানা থেকে আবদুস সালাম ভূঁইয়া নামের এক ব্যক্তি আসেন মেয়েটির খোঁজ নিতে। তিনি এসে বলেন, মেয়েটি তাঁর, নাম খায়রুন নেছা। তিন মাস আগে সে হঠাৎ নিখোঁজ হয়। তাঁরা বিভিন্ন স্থানে খোঁজ করেছেন, কিন্তু কোনো খোঁজ পাননি। আমি জানতে চাইলাম, মেয়েটিকে মুখোমুখি করেছিলেন কি না। তিনি বললেন, সেটা করার পর মেয়েটি বলেছে, সালাম ভূঁইয়াকে সে চেনে না। কোনো জিডি বা পুলিশ রিপোর্ট ছিল? আশ্রয়কেন্দ্রের প্রধান বললেন, তিনি সেটা করেননি। আমি তাঁকে বলেছি ছবিসহ থানায় রিপোর্ট করতে। তিনি গ্রামে ফিরে গেছেন ছবিসহ রিপোর্ট করার জন্য। তবে পত্রিকায় মেয়েটির ছবি ছাপা হওয়ার পর সে সময় আরও কয়েকজন মেয়েটির অভিভাবকত্ব দাবি করে বসেন। দুজন মেয়েটিকে দত্তক নিতে চান। কিন্তু মেয়েটি কোথাও যেতে রাজি হচ্ছিল না।
সপ্তাহখানেক পরে আবদুস সালাম ভূঁইয়া আসেন আমার কাছে, ইস্কাটনে জনকণ্ঠ ভবনে। তিনি তাঁর পরিবারের অ্যালবাম এবং জিডির কপি আমাকে দেখিয়ে বলেন, সেই ফ্লোরা তাঁরই মেয়ে। তাঁর তিন মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে মেয়েটি মেজ। সে স্থানীয় স্কুলে নাইনে পড়ে। তিনি স্কুলের ছবিও আমাকে দেখান। সালাম ভূঁইয়া বলেন, মাস তিনেক আগে পড়া না পারায় তাঁর বড় ছেলে তাকে থাপ্পড় মেরেছিল। সেই রাগে সে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। এরপর তার আর কোনো খোঁজ নেই। তাঁরা সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজ করেছেন। আমি জানতে চাইলাম, তাহলে এখন মেয়েটি আপনাকে চিনছে না কেন? কোনো রাগ ছিল? তিনি ছলছল চোখে বললেন, না ভাই, সে রকম কিছুই নেই। বুঝতে পারছি না মেয়েটির কী হলো। তাঁর কাছে জানতে চাইলাম, আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার আগে তিন মাস মেয়েটি কোথায় ছিল? তিনি বললেন, কোনো আত্মীয়ের বাসায় যায়নি। আমার কাছে সবকিছু কেমন গোলমেলে লাগছে। একবার মনে হচ্ছে, লোকটা ঠিক, আবার মনে হচ্ছে ভুল। মানবাধিকার সংস্থার লোকেরা নতুন একটি পরিকল্পনা করেন। তাঁরা মেয়েটির ছবি নিয়ে গ্রামের বাড়িতে যান পরিচয় নিশ্চিত হতে। সেই দলের কর্মকর্তারা ফিরে এসে জানান, সালাম ভূঁইয়ার দাবি ঠিক, মেয়েটি তাঁরই। স্কুলের শিক্ষকও ছবি দেখে পরিচয় নিশ্চিত করেছেন। তারপরও সবাইকে বোকা বানিয়ে মেয়েটি বলছে, তার মতো কেউ হতে পারে। সে কোনো দিন সেখানে ছিল না।
এভাবে আরও কিছুদিন চলল। একদিন হঠাৎ কে যেন মেয়েটির কাছে তার মায়ের নাম ধরে বলল, তোমার মা খুব অসুস্থ। মায়ের কথা শুনে সবাইকে অবাক করে দিয়ে কেঁদে ফেলে মেয়েটি। একপর্যায়ে সবার কাছে নিজের পরিচয়ের কথা স্বীকার করে। আশ্রয়কেন্দ্রের লোকেরা হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন। এরপর দিনক্ষণ ঠিক করেন মেয়েটিকে তার বাবার হাতে তুলে দেওয়ার জন্য।
সেই দিনে আমরা দলেবলে এসেছি মেয়েটিকে তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা দেখতে। কাগজপত্রে সই করার পর মেয়েটিকে যখন বাবার কাছে দেওয়া হলো, সে বাবাকে জড়িয়ে ধরল। আবদুস সালাম ভূঁইয়ার এত দিনের জমানো কান্না গাল-মুখ বেয়ে নেমে গেল। কিন্তু মেয়েটি তখন স্বাভাবিক। বাবার কান্না থামার পর আমি মেয়েটির কাছে জানতে চাইলাম, এত দিন ধরে কেন এমন করলে? খুব নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে মেয়েটি বলল, আমি স্বপ্ন দেখতাম, একদিন বাড়ি থেকে পালিয়ে যাব। জানতে চাইলাম, আশ্রয়কেন্দ্রে আসার আগে তিন মাস কোথায় ছিলে? এবার থেমে গেল মেয়েটি। তার চোখ ছলছল করছে। বাবার বুকে আছড়ে পড়ে বলল, আমি খারাপ লোকের পাল্লায় পড়েছিলাম। সেখানে থেকে পালিয়ে এসেছি। মেয়েটির কান্না আমাদেরও চোখ ভিজিয়ে দিল।
আরও পড়ুন:
নজরুলের গানে ‘বিনোদ-বেণী’ বলে একটা কথা আছে। দীঘল কালো চুলের কিশোরীর মাথায় সে রকমই বেণি করা। শ্যামলা বরন মেয়েটির মুখটা একেবারেই শান্ত, দেখলে মনে হয় ভাজা মাছটিও উল্টে খেতে জানে না। কোনো কিছু জিজ্ঞেস করলে ইংরেজির মতো করে বাংলা উচ্চারণ করে। অবাঙালির মুখে প্রথম প্রথম বাংলা শব্দ যেভাবে আছাড় খায়, অনেকটা সেই রকম। তাই আশ্রয়কেন্দ্রের সবাই এই কিশোরীর নাম দিয়েছে ‘লন্ডনী কইন্যা’।
দুই সপ্তাহ ধরে মেয়েটি রয়েছে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল ভবঘুরে আশ্রয়কেন্দ্রে। দলেবলে আমরা সেখানে এসেছি মেয়েটির সত্যিকারের পরিচয় জানতে। আমাদের দলে আছেন মানবাধিকার সংগঠনের একদল কর্মী, ইটিভির সাংবাদিক সুপন রায় ও তাঁর ক্যামেরাপারসন। আমরা যাওয়ার আগেই সেখানে হাজির হয়েছেন জনকণ্ঠের নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি রুমন রেজা। মানবাধিকার সংগঠন ও আশ্রয়কেন্দ্রের কর্মকর্তারা ধরে নিয়েছেন, এই মেয়ে তার নিজের পরিচয় নিয়ে সবাইকে ধন্দে ফেলে দিয়েছে।
তার আগে বলি, মেয়েটি এই আশ্রয়কেন্দ্রে এল কী করে। ২০০০ সালের ২৪ অক্টোবর এক ব্যক্তি তাকে নিয়ে ধানমন্ডি থানায় হাজির হন। পুলিশকে জানান, খুব সকালে তিনি লেকের পাড়ে হাঁটতে গিয়ে দেখেন, ধানমন্ডি ৮ নম্বর ব্রিজের কাছে একা দাঁড়িয়ে কাঁদছে মেয়েটি। ১২-১৩ বছরের মেয়েটির পরিচয় জানতে চাইলে সে জানায়, তার নাম ফ্লোরা। তারা বাঙালি ব্রিটিশ। বাড়িতে সবাই বাংলায় কথা বলে। গেল রাতের ফ্লাইটে সে বাবার সঙ্গে লন্ডন থেকে ঢাকায় এসেছে। কিন্তু বিমানবন্দরে নামার পর বাবাকে হারিয়ে ফেলে। এরপর তাঁর আর কোনো খোঁজ পায়নি। বিমানবন্দরের বাইরে উদ্দেশ্যহীন ঘোরাফেরার সময় এক লোক তাকে বেবিট্যাক্সিতে করে এনে ধানমন্ডি ব্রিজের কাছের রাস্তায় ছেড়ে দেয়। এই শহরের সে কিছুই চেনে না। তার কাছে কারও কোনো ঠিকানা নেই।
ধানমন্ডি থানা-পুলিশের একজন কর্মকর্তা অনেকক্ষণ মেয়েটির সঙ্গে কথা বলে দেশে বা বিদেশের কোনো ঠিকানা উদ্ধারের চেষ্টা করেন। ব্যর্থ হয়ে তাকে এক বেলা থানায় রেখে একটি জিডি করে পাঠানো হয় মিরপুর ভবঘুরে আশ্রয়কেন্দ্রে। সেখানে যাওয়ার পর দেখা গেল, ওই আশ্রয়কেন্দ্রে মেয়েটিকে রাখার মতো ভালো পরিবেশ নেই। এরপর তাকে পাঠানো হয় নতুন তৈরি করা গোদনাইল আশ্রয়কেন্দ্রে। সেই থেকে মেয়েটি সেখানেই আছে।
সরকারের সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা মেয়েটির সঙ্গে কয়েক দফা কথা বলেছেন। এরপর তাঁরা মেয়েটির পরিবারকে খুঁজে বের করতে মানবাধিকার সংগঠনের সহায়তা চেয়েছেন। মানবাধিকার সংস্থা এ দায়িত্ব পাওয়ার পর মেয়েটির দেশের আসার দিনক্ষণ ধরে সব এয়ারলাইনসে খোঁজ করেছে। কিন্তু এই নামে কোনো যাত্রীর খোঁজ পায়নি। এরপর খোঁজা হয় সিলেট ও চট্টগ্রাম রুমের অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট। সেখানেও এ নামে কোনো যাত্রী নেই। একদিন মেয়েটিকে নিয়ে বিমানবন্দরের বিভিন্ন এলাকায় ঘোরানো হয়। সেদিন ক্যানোপি এরিয়া দেখিয়ে বলে, এখান থেকেই সে বাবাকে হারিয়ে ফেলে। বিমানবন্দর ঘুরিয়ে দেখার সময় একটি ঘটনা ঘটে, এক শ্বেতাঙ্গ বিদেশি দেখে ‘পাপা’ বলে চিৎকার করে ওঠে মেয়েটি। তার চিৎকারে সেই বিদেশিও হতভম্ব হয়ে যান। পরে সবাই এ জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। এরপর সবাই ধরে নেন, সত্যিই মেয়েটি বিদেশ থেকে এসেছে।
মানবাধিকার সংস্থা এরপর মেয়েটির ছবি ও নাম দিয়ে ঢাকার ব্রিটিশ দূতাবাসে চিঠি পাঠায়। কিন্তু তারাও এ নিয়ে কোনো কিছু জানাতে পারে না। এ খবর ধীরে ধীরে পত্রিকা অফিসেও চলে আসে। আমার বস শংকর কুমার দে ২০০০ সালের ১৭ ডিসেম্বর মেয়েটিকে নিয়ে একটি রিপোর্ট করেন, ‘অনিশ্চয়তার আবর্তে ফ্লোরার ভবিষ্যৎ’। সে রিপোর্টে মেয়েটির ছবিও ছাপা হয়। রিপোর্ট ছাপার এক দিন পর শংকর কুমার দে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হন। ফলোআপের দায়িত্ব পড়ে আমার ওপর। আমি মানবাধিকার সংগঠন থেকে শুরু করে দরকারি সব তথ্য জোগাড়ের চেষ্টা করি। কিন্তু সন্দেহ হয়, এই গল্পের কোথাও কোনো ফাঁক আছে। এরপর একদিন গোদনাইলে যাই মেয়েটির সঙ্গে কথা বলতে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে তখন অত কড়াকড়ি ছিল না। সাংবাদিক পরিচয় দিলেই কাজ হতো।
মেয়েটির সঙ্গে কথা বলে বের হওয়ার মুখে আশ্রয়কেন্দ্রের পরিচালক রুহুল আমিন আমাকে একটি মজার তথ্য দেন। তিনি বলেন, দুদিন আগে কুমিল্লার মুরাদনগর থানা থেকে আবদুস সালাম ভূঁইয়া নামের এক ব্যক্তি আসেন মেয়েটির খোঁজ নিতে। তিনি এসে বলেন, মেয়েটি তাঁর, নাম খায়রুন নেছা। তিন মাস আগে সে হঠাৎ নিখোঁজ হয়। তাঁরা বিভিন্ন স্থানে খোঁজ করেছেন, কিন্তু কোনো খোঁজ পাননি। আমি জানতে চাইলাম, মেয়েটিকে মুখোমুখি করেছিলেন কি না। তিনি বললেন, সেটা করার পর মেয়েটি বলেছে, সালাম ভূঁইয়াকে সে চেনে না। কোনো জিডি বা পুলিশ রিপোর্ট ছিল? আশ্রয়কেন্দ্রের প্রধান বললেন, তিনি সেটা করেননি। আমি তাঁকে বলেছি ছবিসহ থানায় রিপোর্ট করতে। তিনি গ্রামে ফিরে গেছেন ছবিসহ রিপোর্ট করার জন্য। তবে পত্রিকায় মেয়েটির ছবি ছাপা হওয়ার পর সে সময় আরও কয়েকজন মেয়েটির অভিভাবকত্ব দাবি করে বসেন। দুজন মেয়েটিকে দত্তক নিতে চান। কিন্তু মেয়েটি কোথাও যেতে রাজি হচ্ছিল না।
সপ্তাহখানেক পরে আবদুস সালাম ভূঁইয়া আসেন আমার কাছে, ইস্কাটনে জনকণ্ঠ ভবনে। তিনি তাঁর পরিবারের অ্যালবাম এবং জিডির কপি আমাকে দেখিয়ে বলেন, সেই ফ্লোরা তাঁরই মেয়ে। তাঁর তিন মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে মেয়েটি মেজ। সে স্থানীয় স্কুলে নাইনে পড়ে। তিনি স্কুলের ছবিও আমাকে দেখান। সালাম ভূঁইয়া বলেন, মাস তিনেক আগে পড়া না পারায় তাঁর বড় ছেলে তাকে থাপ্পড় মেরেছিল। সেই রাগে সে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। এরপর তার আর কোনো খোঁজ নেই। তাঁরা সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজ করেছেন। আমি জানতে চাইলাম, তাহলে এখন মেয়েটি আপনাকে চিনছে না কেন? কোনো রাগ ছিল? তিনি ছলছল চোখে বললেন, না ভাই, সে রকম কিছুই নেই। বুঝতে পারছি না মেয়েটির কী হলো। তাঁর কাছে জানতে চাইলাম, আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার আগে তিন মাস মেয়েটি কোথায় ছিল? তিনি বললেন, কোনো আত্মীয়ের বাসায় যায়নি। আমার কাছে সবকিছু কেমন গোলমেলে লাগছে। একবার মনে হচ্ছে, লোকটা ঠিক, আবার মনে হচ্ছে ভুল। মানবাধিকার সংস্থার লোকেরা নতুন একটি পরিকল্পনা করেন। তাঁরা মেয়েটির ছবি নিয়ে গ্রামের বাড়িতে যান পরিচয় নিশ্চিত হতে। সেই দলের কর্মকর্তারা ফিরে এসে জানান, সালাম ভূঁইয়ার দাবি ঠিক, মেয়েটি তাঁরই। স্কুলের শিক্ষকও ছবি দেখে পরিচয় নিশ্চিত করেছেন। তারপরও সবাইকে বোকা বানিয়ে মেয়েটি বলছে, তার মতো কেউ হতে পারে। সে কোনো দিন সেখানে ছিল না।
এভাবে আরও কিছুদিন চলল। একদিন হঠাৎ কে যেন মেয়েটির কাছে তার মায়ের নাম ধরে বলল, তোমার মা খুব অসুস্থ। মায়ের কথা শুনে সবাইকে অবাক করে দিয়ে কেঁদে ফেলে মেয়েটি। একপর্যায়ে সবার কাছে নিজের পরিচয়ের কথা স্বীকার করে। আশ্রয়কেন্দ্রের লোকেরা হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন। এরপর দিনক্ষণ ঠিক করেন মেয়েটিকে তার বাবার হাতে তুলে দেওয়ার জন্য।
সেই দিনে আমরা দলেবলে এসেছি মেয়েটিকে তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা দেখতে। কাগজপত্রে সই করার পর মেয়েটিকে যখন বাবার কাছে দেওয়া হলো, সে বাবাকে জড়িয়ে ধরল। আবদুস সালাম ভূঁইয়ার এত দিনের জমানো কান্না গাল-মুখ বেয়ে নেমে গেল। কিন্তু মেয়েটি তখন স্বাভাবিক। বাবার কান্না থামার পর আমি মেয়েটির কাছে জানতে চাইলাম, এত দিন ধরে কেন এমন করলে? খুব নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে মেয়েটি বলল, আমি স্বপ্ন দেখতাম, একদিন বাড়ি থেকে পালিয়ে যাব। জানতে চাইলাম, আশ্রয়কেন্দ্রে আসার আগে তিন মাস কোথায় ছিলে? এবার থেমে গেল মেয়েটি। তার চোখ ছলছল করছে। বাবার বুকে আছড়ে পড়ে বলল, আমি খারাপ লোকের পাল্লায় পড়েছিলাম। সেখানে থেকে পালিয়ে এসেছি। মেয়েটির কান্না আমাদেরও চোখ ভিজিয়ে দিল।
আরও পড়ুন:
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে আরও ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় (শুক্রবার সকাল ৮ টা-শনিবার সকাল ৮ টা) তাঁদের মৃত্যু হয়। এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে ৪০১ জনে দাঁড়াল। গত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৯৯৪ জন রোগী। এ পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৭৮ হাজার ৫৯৫ জন
১২ মিনিট আগেপররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেছেন, রোহিঙ্গা ইস্যুর পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গোপসাগর বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গত আট বছরে এই সংকট নিরসনে বড় প্রতিবেশীর কাছ থেকে সহযোগিতা প্রত্যাশার চেয়ে কম।
২ ঘণ্টা আগেবিশ্বের ক্যাথলিক খ্রিষ্টান ধর্মের সর্বোচ্চ নেতা পোপ ফ্রান্সিস ও বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের নামে যৌথভাবে একটি উদ্যোগ শুরু করেছে ভ্যাটিকান। বিশ্ব মানবতার জন্য একটি রূপান্তরমূলক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ভবিষ্যৎ গঠনের লক্ষ্যে ‘পোপ ফ্রান্সিস থ্রি জিরোস ক্লাব’—নামের উদ্যোগটি চালু
৬ ঘণ্টা আগেভারতীয় সংবাদ সংস্থা এএনআইকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেছেন, ‘ইসকনের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো কর্মসূচি দেয়নি হেফাজতে ইসলাম বরং মুসলিমদের উত্তেজিত হওয়া থেকে বিরত রাখতে এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হেফাজত দায়িত্ব নিয়েছে
৭ ঘণ্টা আগে