ভাগ্যোন্নয়নে মালদ্বীপে গেলেও নানা ভোগান্তিতে প্রবাসীরা

সাইফুল মাসুম, মালদ্বীপ থেকে ফিরে
প্রকাশ : ১৫ ডিসেম্বর ২০২১, ১০: ০০
আপডেট : ১৫ ডিসেম্বর ২০২১, ১১: ৩৪

ভারত মহাসাগরের বুকে জেগে থাকা প্রায় ১২০০ দ্বীপ নিয়ে গঠিত রাষ্ট্র মালদ্বীপ। নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের টানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে পর্যটকেরা ভিড় করেন এই দেশে। তবে বাংলাদেশ থেকে মালদ্বীপে পাড়ি দেওয়া বড় অংশই শ্রমিক। উপার্জনের জন্যই তাঁরা এই দ্বীপরাষ্ট্রে যান, যাদের একটি বড় অংশই এখন নানা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে ভিসা ছাড়া মালদ্বীপে যাওয়া বাংলাদেশিরা সবচেয়ে বেশি সংকটে রয়েছেন। কাজের সুযোগ পেলেও তাঁরা ঠিকমতো মজুরি পান না। 

মালে শহরের চেক মার্কেট এলাকায় কথা হয় কয়েকজন প্রবাসী বাংলাদেশির সঙ্গে। তাঁরা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে কাজ পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন। কারোরই মালদ্বীপে বসবাসের বৈধ কাগজপত্র নেই। তাদের কেউ পর্যটন ভিসায় এসে মালেতে পালিয়ে রয়েছেন। অনেকে দালালের কথায় ভালো কাজ পাওয়ার প্রলোভনে মালদ্বীপে এসেছেন। আবার কারও কারও বৈধ কাগজের মেয়াদ ফুরিয়ে গেছে, তবু তাঁরা দেশে ফেরেননি। এই ভাগ্যবিড়ম্বিত প্রবাসীদের দিয়ে স্থানীয়রা বাসাবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের খুচরো কাজ করিয়ে নেন। ন্যায্য পাওনা তো দূর, ধরিয়ে দেন নামমাত্র মজুরি। 

ফেনীর সোনাগাজী থেকে আসা আবু রায়হান (ছদ্মনাম) নির্মাণশ্রমিকের কাজ করেন মালদ্বীপের হুলহুমালে শহরে। চার বছর আগে জীবিকার সন্ধানে এই দ্বীপরাষ্ট্রে আসেন। তিনি বলেন, মালিক যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাঁকে কাজে নিয়েছেন, সেই অনুসারে বেতন দিচ্ছেন না। অনেক টাকা খরচ করে বিদেশে এসেছেন। এখন হুট করে দেশে ফেরাও তাঁর পক্ষে কঠিন। 

মালদ্বীপে অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশনে এসে অনেক প্রবাসী শ্রমিক তাঁদের সমস্যার কথা বলেন এবং সমাধানের অনুরোধ করেন। ৫ ডিসেম্বর সকালে মালদ্বীপের বাংলাদেশ হাইকমিশনে অন্তত ১৫ জন প্রবাসী বাংলাদেশির দেখা মেলে। নানা সমস্যা নিয়ে তাঁরা সেখানে ভিড় করেছেন। তাঁদের অধিকাংশেরই অভিযোগ, মালিক ঠিকমতো বেতন দেয় না। ন্যায্য মজুরি চাইলে হয়রানির শিকার হতে হয়। 

মালদ্বীপে বসবাস করা প্রবাসী শ্রমিকদের ৭০ শতাংশই বাংলাদেশি। ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটানেরও কিছু প্রবাসী সেখানে রয়েছেন। বৈধ ভিসা না থাকায় গত এক বছরে মালদ্বীপ সরকার নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় প্রায় ১০ হাজারের বেশি শ্রমিককে নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠিয়েছে। পাশাপাশি তারা বাংলাদেশিদের বৈধতা দেওয়ার কাজও শুরু করেছে। প্রায় এক বছর আগে মালে স্টেডিয়ামে আনুষ্ঠানিকভাবে এ কার্যক্রম শুরু হয়। সেখানে প্রায় ৩৮ হাজার অনিয়মিত বাংলাদেশি কর্মী নিবন্ধন করেন। পরে অনলাইনে ২ হাজার কর্মী নিবন্ধন করেন। সব মিলিয়ে ৪০ হাজার শ্রমিক নিবন্ধন করেছেন। তবে প্রক্রিয়া এখনো শেষ না হওয়ায় তাঁরা বৈধতা পাননি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মালদ্বীপ সরকার নিজেদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রয়োজনে বাংলাদেশি প্রবাসী শ্রমিক নিতে হবে। এখানকার নির্মাণশিল্পের চাহিদা অন্য কোনো দেশের শ্রমিকেরা মেটাতে পারেননি। এর কারণ বাংলাদেশি প্রবাসীরা কাজের প্রতি আন্তরিক, পরিশ্রমী। 

ভাগ্যোন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ থেকে বহু মানুষ মালদ্বীপে পাড়ি জমিয়েছেনবাংলাদেশ হাইকমিশনের তথ্য বলছে, মালদ্বীপের স্থানীয় জনসংখ্যা রয়েছে প্রায় ৫ লাখ। আর বাংলাদেশি প্রবাসী রয়েছেন ১ লাখের মতো। তবে বেসরকারি হিসাবে প্রবাসী বাংলাদেশির সংখ্যা আরও অনেক বেশি। মালদ্বীপ সরকার দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ থেকে অদক্ষ শ্রমিক নিলেও ২০১৯ সাল থেকে এ প্রক্রিয়া বন্ধ রেখেছে। তবে দক্ষ শ্রমিক নেওয়ার বিষয়ে মালদ্বীপ সরকারের নিষেধাজ্ঞা নেই। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মালদ্বীপে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত রিয়ার অ্যাডমিরাল নাজমুল হাসান বলেন, ‘মালদ্বীপে প্রায় এক লাখ প্রবাসী বাংলাদেশি আছেন। এ দেশের সরকারের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, তাঁদের মধ্যে প্রায় ৫০ হাজারই অনিয়মিত; অর্থাৎ বৈধ ভিসা ছাড়া বসবাস করছেন। এটা সত্যি যে অনিয়মিতদের প্রতিদিনই নানাভাবে ঠকানো হচ্ছে। তাঁদের ন্যায্য পারিশ্রমিক দেওয়া হচ্ছে না। আমরা নিয়মিত এ ধরনের অভিযোগ পাচ্ছি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে আমরা সমাধানের চেষ্টা করি।’ 

দেশে টাকা পাঠাতেও ভোগান্তি
চাঁদপুর জেলার মতলবের হাবিব মিয়া ১৪ বছর ধরে কাজ করেন মালদ্বীপের হুলহুমালেতে। তিনি সেখানে ‘রেড ওয়েভ’ নামে একটি সুপার শপে কাজ করেন। তিনি বলেন, মালদ্বীপে প্রবাসীদের নিয়োগের সময় ডলারে বেতন দেওয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু বেতন দেওয়া হয় দেশটির নিজস্ব মুদ্রা রুপিয়াতে। এখানেই দেখা দেয় সমস্যা। সরকারিভাবে ১৫ রুপিয়া দিয়ে কিনতে হয় এক ডলার। কোম্পানিগুলো কর্মীদের রুপিয়া দিয়ে বেতন পরিশোধ করে সরকারি দরেই। প্রবাসীদের দেশে পরিবার-পরিজনের কাছে ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাঠাতে হয় আবার ডলার হিসেবে। এ জন্য ডলার কিনতে হয় তাদের। কেনার সময় এক ডলার কিনতে ১৯ রুপিয়া দিতে হয়। এতে প্রতি ডলারে তিন থেকে চার রুপিয়া থেকে বঞ্চিত হন বাংলাদেশি প্রবাসীরা। টাকায় হিসাব করলে প্রতি ডলারে প্রবাসী কর্মীরা বঞ্চিত হন ১৬ থেকে ২০ টাকা। এ ছাড়া বিকাশে টাকা পাঠাতে হয় দালালের মাধ্যমে। এর জন্য প্রতি ৫ হাজারে খরচ করতে হয় বাড়তি ৩০০ টাকা। এই টাকা দালালের পকেটে যায়। 

মালদ্বীপের প্রবাসী সোশ্যাল ওয়ার্কার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এমরান হোসেন তালুকদার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকার যদি এখানে বাণিজ্যিক ব্যাংক চালু করে, তাহলে এই সমস্যার সমাধান হবে। মালদ্বীপের নিম্ন আয়ের প্রবাসী বাংলাদেশিরা এর সুফল পাবেন।’ 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত রিয়ার অ্যাডমিরাল নাজমুল হাসান বলেন, ‘মালদ্বীপে আমরা বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকের শাখা খোলার চেষ্টা করছি। বাংলাদেশের একটি বেসরকারি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও এমডি এখানে এসেছেন। আমি তাঁদের মালদ্বীপের অর্থমন্ত্রীর কাছে নিয়ে গেছি। আশা করি খুব শিগগিরই তারা শাখা খুলতে পারবে। এখানে দেশি ব্যাংক চালু হলে প্রবাসীদের আর দুঃখ থাকবে না।’ 

প্রধানমন্ত্রীর মালদ্বীপ সফরে নতুন আশা
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চলতি মাসের শেষ দিকে মালদ্বীপ সফরের সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন মালদ্বীপে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত রিয়ার অ্যাডমিরাল নাজমুল হাসান। তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর সফরে মালদ্বীপ সরকারের সঙ্গে বেশ কয়েকটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করবেন। এতে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক সম্পর্কের উন্নয়ন এবং মালদ্বীপে যেসব বাংলাদেশি অনিয়মিত হিসেবে রয়েছেন, তাঁদের নিয়মিতকরণের বিষয় বেশি গুরুত্ব পাবে। এর মাধ্যমে প্রবাসীদের সংকট অনেকাংশে সমাধান হবে। তবে প্রধানমন্ত্রী কবে মালদ্বীপ সফর করবেন, সেই দিন-তারিখ এখনো চূড়ান্ত হয়নি।’ 

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত