বিজয়নগর (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রতিনিধি
গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ছিলেন আওরঙ্গজেব খান লেনিন। তাঁর ছোট ভাই সেলিম ওমরাও খান ছিলেন নামকরা সাপ্তাহিক বিচিত্রার সাংবাদিক। সেই সুবাদে আমরা সাংবাদিকেরা তাঁকে ডাকতাম ‘লেনিন ভাই’ বলে।
গুলশানে সেই লেনিন ভাইয়ের দিনকাল ভালোই চলছিল। হঠাৎ একদিন রাতে বনানীর ট্রাম্পস ক্লাবের নিচে খুন হলেন চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী। কপাল পুড়ল লেনিন ভাইয়ের। তাঁকে গুলশান থানা থেকে সরিয়ে নেওয়া হলো ঢাকা রেঞ্জে। তাঁর বদলে এলেন সুদর্শন ফারুক আহমেদ।
একদিন সকালে গুলশান থানায় ওসির রুমে উঁকি দিয়ে দেখি সাবেক ও বর্তমান দুই ওসি বসে গভীর আলোচনায় মগ্ন। আমাকে ভেতরে ঢুকতে দেখেই দুজনে চুপ হয়ে গেলেন। আমি টের পেয়ে বললাম, কথা শেষ করেন, পরে আসছি।
গুলশান থানা তখন ছিল ১ ও ২ নম্বর গোলচত্বরের মাঝামাঝি একটি পুরোনো দোতলা বাড়িতে। সেই বাড়ির বসার ঘরটি ছিল ওসির কক্ষ। ওসির কক্ষের সামনে বিশাল আকারের একটি বারান্দা। দর্শনার্থী বসার জন্য বারান্দার দুপাশে দুটি কাঠের বেঞ্চ রাখা। একটি বেঞ্চে বসে তাঁদের কথা শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছি।
লেনিন ভাই কথা বলতেন উচ্চ স্বরে। সেই তুলনায় ফারুক আহমেদ বেশ অনুচ্চ। লেনিন ভাই ভেতরে যা বলছেন তার প্রায় সবই বাইরে থেকে শোনা যাচ্ছে। তিনি মাঝেমধ্যে গলার জোর আরও বাড়িয়ে দিয়ে কথা বলছেন। কিন্তু ফারুক আহমেদের কথা শোনা যাচ্ছে না। হঠাৎ লেনিন ভাইয়ের একটি কথা আমার কানে আসার পর মনে হলো, এবার একটু আড়িপাতা যেতে পারে। কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করছি তাঁরা কী বলছেন। কিছু বিষয় আবছা আবছা বুঝতে পারলাম। মনে হলো তাঁরা কোনো নারীর ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে কথা বলছেন। তবে পুরো ঘটনা আর উদ্ধার করতে পারলাম না।
মিনিট বিশেক পরে বেরিয়ে এলেন লেনিন ভাই। বেরিয়েই হনহন করে হাঁটা দিলেন। আমি তাঁকে ডাক দিতেই ইশারা করলেন বাইরে চলে আসার জন্য। তাঁর পিছু নিয়ে থানার বাইরে এলাম। এটা ১৯৯৯ সালের ১৭-১৮ মার্চের ঘটনা।
লেনিন ভাইয়ের মেজাজ গরম। রাস্তায় দাঁড়িয়ে তিনি নিজের কপালকে দোষারোপ করছেন। কী হয়েছে জানতে চাইলে যা বললেন তা শুনে পিলে চমকে গেল। বললেন, থানার ভেতরে কোনো এক ব্রিটিশ নারী নাকি ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ব্রিটিশ হাইকমিশন থেকে আইজিপিকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। সেই চিঠি কমিশনারের কাছে এসেছে। তিনি তদন্ত শুরু করেছেন। ফারুক আহমেদ নাকি তদন্ত কমিটির কোনো এক সদস্যকে বলেছেন, তিনি যোগদানের পর এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। এটা আগের ওসির আমলে হলেও হতে পারে। লেনিন ভাই আর বিস্তারিত কিছু জানেন না। শুধু এটুকু শুনেই মাথা গরম হয়েছে বলে ফারুক আহমেদের কাছে ছুটে এসেছেন। আমাকে বললেন, আমি যেন খোঁজ করে আসল ঘটনা বের করি।
যেকোনো পেশাদার সংবাদকর্মীর জন্য খবরের এতটুকু ক্লুই যথেষ্ট। তাঁকে বিদায় দিয়ে গেলাম ওসি ফারুক আহমেদের কাছে। তিনি বেশ চিন্তিত, কিন্তু কিছু বললেন না। মনে হলো, বিষয়টি স্পর্শকাতর, কমিশনার ছাড়া কেউ কথা বলবেন না। এলাম কমিশনারের অফিসে। ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার ছিলেন এ কে এম শামসুদ্দিন। ডিএমপি সদর দপ্তরে ঢুকতেই যে লাল ভবন, এর দোতলায় বসতেন তিনি। কাঠের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হতো। তাঁকে সহজেই পেয়ে গেলাম। কিন্তু তিনিও কিছু বলতে চাইলেন না। শুধু এটুকু বললেন, এসবির প্রধান নুরুল আলমকে প্রধান করে এ নিয়ে একটি কমিটি হয়েছে। নুরুল আলম ছাড়া কেউ কিছু জানেন না।
গেলাম এসবিতে, অ্যাডিশনাল আইজি অফিসে নেই। তিনি সিআইডির প্রধানের সঙ্গে জরুরি মিটিং করছেন। তখন সিআইডির প্রধান ছিলেন মুহা. নুরুল হুদা। পরে তিনি আইজিপি হয়েছিলেন। ঘণ্টা দেড়েক বসে থাকলাম, মিটিং আর শেষ হয় না। এদিকে সময় চলে যাচ্ছে, কিন্তু কিছুই বের করতে পারছি না। ছুটলাম পুলিশ সদর দপ্তরে আইজিপির কাছে, তিনি যদি কিছু বলেন।
এ ওয়াই বি আই সিদ্দিকী তখন আইজিপি। তিনি রেডিও-টিভিতে গান গাইতেন বুরহান সিদ্দিকী নামে। তাঁর একটি সুবিধা ছিল, তিনি নিজ থেকে কোনো কিছু বলতেন না, কিন্তু কোনো কিছু জানতে চাইলে অস্বীকার করতেন না। সারা দিনের দৌড়াদৌড়ির কথা তাঁকে বললাম। তিনি সব শুনে একজন কর্মকর্তার কাছে পাঠালেন। সেই কর্মকর্তা আমাকে একটি চিঠি পড়তে দিলেন, কিন্তু তার কপি আর দিলেন না।
চিঠিটি ঢাকায় ব্রিটিশ হাইকমিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারি জিওফ্রে ফেয়ারের লেখা। তিনি লিখেছেন, কিছুদিন আগে বাংলাদেশে কর্মরত ২৭-২৮ বছরের এক ব্রিটিশ নারী গভীর রাতে নিজের বাসায় ঢুকে দেখেন ভেতরের সবকিছু চুরি হয়ে গেছে। সেই রাতেই তিনি যান গুলশান থানায় অভিযোগ জানাতে। এরপর থানার চার পুলিশ সদস্য গভীর রাতে তাঁকে আটকে রেখে ধর্ষণ করেন। এতে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। জ্ঞান ফিরে আসার পর বাসায় ফিরে যান এবং দুই দিনের মধ্যে দেশ ছেড়ে চলে যান। নিজের দেশে যাওয়ার পর প্রতিকার চেয়ে সরকারের কাছে আবেদন করেন। চিঠিতে বলা হয়, এ ঘটনার পর ঢাকায় বসবাস করা ব্রিটিশ নারীদের রাতের বেলা সঙ্গী ছাড়া থানায় যেতে বারণ করা হয়েছে।
সব নোট করে নিয়ে অফিসে গিয়ে লিখতে বসেছি, হঠাৎ শুনি বিবিসি বাংলা সেই খবরই প্রচার করছে। তাদের খবরে আমার চেয়ে আরও অনেক বেশি তথ্য। সেই খবর প্রচারের পর শুরু হলো তোলপাড়। এক দিনের মধ্যে পরিস্থিতি গরম হয়ে উঠল। এক দিন পর পত্রিকায় খবর এল—ঢাকা-লন্ডন সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে।
মোহাম্মদ নাসিম তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এ ঘটনা নিয়ে তিনি প্রতিদিনই সাংবাদিকদের ব্রিফ করছেন, কিন্তু খবর আর থামছে না। অনেক পত্রিকা সেই খবরকে কেন্দ্র করে পুলিশের বিরুদ্ধে নানা ধরনের খবর প্রচার করতে শুরু করল। পরিস্থিতি ভয়ংকর আকার ধারণ করল। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশের পক্ষ থেকে কমিটির পর কমিটি গঠন করা হলো, কিন্তু কথিত ধর্ষকদের আর খুঁজে পাওয়া গেল না।
অবশ্য তখন এ ঘটনা নিয়ে অন্য রকম একটি প্রচারও ছিল। বলা হচ্ছিল, বাংলাদেশে তেল-গ্যাসক্ষেত্র ইজারা পাওয়ার ক্ষেত্রে ব্রিটিশ কোম্পানিগুলো পিছিয়ে পড়ছিল। হাইকমিশনের কয়েকজন কর্মকর্তা কয়েকটি কোম্পানির পক্ষে চেষ্টা-তদবির করছিলেন। কিন্তু তাতে কাজ না হওয়ায় তাঁরা ক্ষুব্ধ হন। এরপর বেনামি এই নারীর গল্প ফাঁদেন। অবশ্য এটা সত্যি, দূতাবাসের সেই চিঠিতে ধর্ষণের শিকার সেই নারীর কোনো নাম-পরিচয় ছিল না। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বারবার নাম-পরিচয় চাওয়া হচ্ছিল। কিন্তু তাঁরা সেটা দিতে পারছিলেন না। ডিএফআইডি তখন বাংলাদেশে একটি প্রকল্প নিয়ে এগোচ্ছিল। এ ঘটনার কারণে সেটাও থেমে যায়। পরিস্থিতি এতটাই উত্তপ্ত হয়ে যায়, এ নিয়ে প্রতিদিনই রেডিও এবং পত্রিকায় খবর হতে থাকে।
ঢাকায় তখন ব্রিটিশ হাইকমিশনার ছিলেন ডেভিড সি ওয়াকার। ১৯৯৯ সালের ২৩ মার্চে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ডেভিডের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। তাঁরা দুজনেই পরিস্থিতি ঠান্ডা করতে একমত হন। বৈঠক চলতে থাকে আর আমরা এক ডজন সাংবাদিক ফলাফল জানতে অপেক্ষা করি। দীর্ঘ বৈঠকের পর বের হয়ে আসেন দুজনে। মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম আমাদের বলেন, থানায় ধর্ষণ নিয়ে যে খবর প্রচারিত হয়েছে, সেটি ঠিক নয়। সরকার তদন্ত করে নিশ্চিত হয়েছে, গুলশান থানায় এ ধরনের ধর্ষণের কোনো ঘটনা ঘটেনি। তদন্তের সবকিছু ডেভিডকে বলা হয়েছে। বৈঠকে ব্রিটিশ হাইকমিশনার তাঁদের সঙ্গে একমত হয়েছেন বলে আমাদের বলা হয়। ডেভিড তখন সাংবাদিকদের বলেন, এ ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনে বাংলাদেশ যে আন্তরিকতা দেখিয়েছে, তাতে তিনি মুগ্ধ। এই যৌথ ব্রিফিংয়ের পর ঘটনাটি মোটামুটি থেমে যায়।
অনেক দিন পর গুলশান থানার সামনে দিয়ে উত্তর দিকে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ ঘটনাটি মনে পড়ে গেল। এখনো মাঝে মাঝে মনে হয়, আদৌ কি সেদিন এমন কোনো ঘটনা ঘটেছিল, নাকি ঘটেনি? আমি আসলে এর কিছুই জানতে পারিনি। জীবনে কত ঘটনার যে রহস্য ভেদ করা সম্ভব হয়নি।
আরও পড়ুন:
গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ছিলেন আওরঙ্গজেব খান লেনিন। তাঁর ছোট ভাই সেলিম ওমরাও খান ছিলেন নামকরা সাপ্তাহিক বিচিত্রার সাংবাদিক। সেই সুবাদে আমরা সাংবাদিকেরা তাঁকে ডাকতাম ‘লেনিন ভাই’ বলে।
গুলশানে সেই লেনিন ভাইয়ের দিনকাল ভালোই চলছিল। হঠাৎ একদিন রাতে বনানীর ট্রাম্পস ক্লাবের নিচে খুন হলেন চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী। কপাল পুড়ল লেনিন ভাইয়ের। তাঁকে গুলশান থানা থেকে সরিয়ে নেওয়া হলো ঢাকা রেঞ্জে। তাঁর বদলে এলেন সুদর্শন ফারুক আহমেদ।
একদিন সকালে গুলশান থানায় ওসির রুমে উঁকি দিয়ে দেখি সাবেক ও বর্তমান দুই ওসি বসে গভীর আলোচনায় মগ্ন। আমাকে ভেতরে ঢুকতে দেখেই দুজনে চুপ হয়ে গেলেন। আমি টের পেয়ে বললাম, কথা শেষ করেন, পরে আসছি।
গুলশান থানা তখন ছিল ১ ও ২ নম্বর গোলচত্বরের মাঝামাঝি একটি পুরোনো দোতলা বাড়িতে। সেই বাড়ির বসার ঘরটি ছিল ওসির কক্ষ। ওসির কক্ষের সামনে বিশাল আকারের একটি বারান্দা। দর্শনার্থী বসার জন্য বারান্দার দুপাশে দুটি কাঠের বেঞ্চ রাখা। একটি বেঞ্চে বসে তাঁদের কথা শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছি।
লেনিন ভাই কথা বলতেন উচ্চ স্বরে। সেই তুলনায় ফারুক আহমেদ বেশ অনুচ্চ। লেনিন ভাই ভেতরে যা বলছেন তার প্রায় সবই বাইরে থেকে শোনা যাচ্ছে। তিনি মাঝেমধ্যে গলার জোর আরও বাড়িয়ে দিয়ে কথা বলছেন। কিন্তু ফারুক আহমেদের কথা শোনা যাচ্ছে না। হঠাৎ লেনিন ভাইয়ের একটি কথা আমার কানে আসার পর মনে হলো, এবার একটু আড়িপাতা যেতে পারে। কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করছি তাঁরা কী বলছেন। কিছু বিষয় আবছা আবছা বুঝতে পারলাম। মনে হলো তাঁরা কোনো নারীর ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে কথা বলছেন। তবে পুরো ঘটনা আর উদ্ধার করতে পারলাম না।
মিনিট বিশেক পরে বেরিয়ে এলেন লেনিন ভাই। বেরিয়েই হনহন করে হাঁটা দিলেন। আমি তাঁকে ডাক দিতেই ইশারা করলেন বাইরে চলে আসার জন্য। তাঁর পিছু নিয়ে থানার বাইরে এলাম। এটা ১৯৯৯ সালের ১৭-১৮ মার্চের ঘটনা।
লেনিন ভাইয়ের মেজাজ গরম। রাস্তায় দাঁড়িয়ে তিনি নিজের কপালকে দোষারোপ করছেন। কী হয়েছে জানতে চাইলে যা বললেন তা শুনে পিলে চমকে গেল। বললেন, থানার ভেতরে কোনো এক ব্রিটিশ নারী নাকি ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ব্রিটিশ হাইকমিশন থেকে আইজিপিকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। সেই চিঠি কমিশনারের কাছে এসেছে। তিনি তদন্ত শুরু করেছেন। ফারুক আহমেদ নাকি তদন্ত কমিটির কোনো এক সদস্যকে বলেছেন, তিনি যোগদানের পর এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। এটা আগের ওসির আমলে হলেও হতে পারে। লেনিন ভাই আর বিস্তারিত কিছু জানেন না। শুধু এটুকু শুনেই মাথা গরম হয়েছে বলে ফারুক আহমেদের কাছে ছুটে এসেছেন। আমাকে বললেন, আমি যেন খোঁজ করে আসল ঘটনা বের করি।
যেকোনো পেশাদার সংবাদকর্মীর জন্য খবরের এতটুকু ক্লুই যথেষ্ট। তাঁকে বিদায় দিয়ে গেলাম ওসি ফারুক আহমেদের কাছে। তিনি বেশ চিন্তিত, কিন্তু কিছু বললেন না। মনে হলো, বিষয়টি স্পর্শকাতর, কমিশনার ছাড়া কেউ কথা বলবেন না। এলাম কমিশনারের অফিসে। ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার ছিলেন এ কে এম শামসুদ্দিন। ডিএমপি সদর দপ্তরে ঢুকতেই যে লাল ভবন, এর দোতলায় বসতেন তিনি। কাঠের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হতো। তাঁকে সহজেই পেয়ে গেলাম। কিন্তু তিনিও কিছু বলতে চাইলেন না। শুধু এটুকু বললেন, এসবির প্রধান নুরুল আলমকে প্রধান করে এ নিয়ে একটি কমিটি হয়েছে। নুরুল আলম ছাড়া কেউ কিছু জানেন না।
গেলাম এসবিতে, অ্যাডিশনাল আইজি অফিসে নেই। তিনি সিআইডির প্রধানের সঙ্গে জরুরি মিটিং করছেন। তখন সিআইডির প্রধান ছিলেন মুহা. নুরুল হুদা। পরে তিনি আইজিপি হয়েছিলেন। ঘণ্টা দেড়েক বসে থাকলাম, মিটিং আর শেষ হয় না। এদিকে সময় চলে যাচ্ছে, কিন্তু কিছুই বের করতে পারছি না। ছুটলাম পুলিশ সদর দপ্তরে আইজিপির কাছে, তিনি যদি কিছু বলেন।
এ ওয়াই বি আই সিদ্দিকী তখন আইজিপি। তিনি রেডিও-টিভিতে গান গাইতেন বুরহান সিদ্দিকী নামে। তাঁর একটি সুবিধা ছিল, তিনি নিজ থেকে কোনো কিছু বলতেন না, কিন্তু কোনো কিছু জানতে চাইলে অস্বীকার করতেন না। সারা দিনের দৌড়াদৌড়ির কথা তাঁকে বললাম। তিনি সব শুনে একজন কর্মকর্তার কাছে পাঠালেন। সেই কর্মকর্তা আমাকে একটি চিঠি পড়তে দিলেন, কিন্তু তার কপি আর দিলেন না।
চিঠিটি ঢাকায় ব্রিটিশ হাইকমিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারি জিওফ্রে ফেয়ারের লেখা। তিনি লিখেছেন, কিছুদিন আগে বাংলাদেশে কর্মরত ২৭-২৮ বছরের এক ব্রিটিশ নারী গভীর রাতে নিজের বাসায় ঢুকে দেখেন ভেতরের সবকিছু চুরি হয়ে গেছে। সেই রাতেই তিনি যান গুলশান থানায় অভিযোগ জানাতে। এরপর থানার চার পুলিশ সদস্য গভীর রাতে তাঁকে আটকে রেখে ধর্ষণ করেন। এতে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। জ্ঞান ফিরে আসার পর বাসায় ফিরে যান এবং দুই দিনের মধ্যে দেশ ছেড়ে চলে যান। নিজের দেশে যাওয়ার পর প্রতিকার চেয়ে সরকারের কাছে আবেদন করেন। চিঠিতে বলা হয়, এ ঘটনার পর ঢাকায় বসবাস করা ব্রিটিশ নারীদের রাতের বেলা সঙ্গী ছাড়া থানায় যেতে বারণ করা হয়েছে।
সব নোট করে নিয়ে অফিসে গিয়ে লিখতে বসেছি, হঠাৎ শুনি বিবিসি বাংলা সেই খবরই প্রচার করছে। তাদের খবরে আমার চেয়ে আরও অনেক বেশি তথ্য। সেই খবর প্রচারের পর শুরু হলো তোলপাড়। এক দিনের মধ্যে পরিস্থিতি গরম হয়ে উঠল। এক দিন পর পত্রিকায় খবর এল—ঢাকা-লন্ডন সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে।
মোহাম্মদ নাসিম তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এ ঘটনা নিয়ে তিনি প্রতিদিনই সাংবাদিকদের ব্রিফ করছেন, কিন্তু খবর আর থামছে না। অনেক পত্রিকা সেই খবরকে কেন্দ্র করে পুলিশের বিরুদ্ধে নানা ধরনের খবর প্রচার করতে শুরু করল। পরিস্থিতি ভয়ংকর আকার ধারণ করল। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশের পক্ষ থেকে কমিটির পর কমিটি গঠন করা হলো, কিন্তু কথিত ধর্ষকদের আর খুঁজে পাওয়া গেল না।
অবশ্য তখন এ ঘটনা নিয়ে অন্য রকম একটি প্রচারও ছিল। বলা হচ্ছিল, বাংলাদেশে তেল-গ্যাসক্ষেত্র ইজারা পাওয়ার ক্ষেত্রে ব্রিটিশ কোম্পানিগুলো পিছিয়ে পড়ছিল। হাইকমিশনের কয়েকজন কর্মকর্তা কয়েকটি কোম্পানির পক্ষে চেষ্টা-তদবির করছিলেন। কিন্তু তাতে কাজ না হওয়ায় তাঁরা ক্ষুব্ধ হন। এরপর বেনামি এই নারীর গল্প ফাঁদেন। অবশ্য এটা সত্যি, দূতাবাসের সেই চিঠিতে ধর্ষণের শিকার সেই নারীর কোনো নাম-পরিচয় ছিল না। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বারবার নাম-পরিচয় চাওয়া হচ্ছিল। কিন্তু তাঁরা সেটা দিতে পারছিলেন না। ডিএফআইডি তখন বাংলাদেশে একটি প্রকল্প নিয়ে এগোচ্ছিল। এ ঘটনার কারণে সেটাও থেমে যায়। পরিস্থিতি এতটাই উত্তপ্ত হয়ে যায়, এ নিয়ে প্রতিদিনই রেডিও এবং পত্রিকায় খবর হতে থাকে।
ঢাকায় তখন ব্রিটিশ হাইকমিশনার ছিলেন ডেভিড সি ওয়াকার। ১৯৯৯ সালের ২৩ মার্চে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ডেভিডের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। তাঁরা দুজনেই পরিস্থিতি ঠান্ডা করতে একমত হন। বৈঠক চলতে থাকে আর আমরা এক ডজন সাংবাদিক ফলাফল জানতে অপেক্ষা করি। দীর্ঘ বৈঠকের পর বের হয়ে আসেন দুজনে। মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম আমাদের বলেন, থানায় ধর্ষণ নিয়ে যে খবর প্রচারিত হয়েছে, সেটি ঠিক নয়। সরকার তদন্ত করে নিশ্চিত হয়েছে, গুলশান থানায় এ ধরনের ধর্ষণের কোনো ঘটনা ঘটেনি। তদন্তের সবকিছু ডেভিডকে বলা হয়েছে। বৈঠকে ব্রিটিশ হাইকমিশনার তাঁদের সঙ্গে একমত হয়েছেন বলে আমাদের বলা হয়। ডেভিড তখন সাংবাদিকদের বলেন, এ ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনে বাংলাদেশ যে আন্তরিকতা দেখিয়েছে, তাতে তিনি মুগ্ধ। এই যৌথ ব্রিফিংয়ের পর ঘটনাটি মোটামুটি থেমে যায়।
অনেক দিন পর গুলশান থানার সামনে দিয়ে উত্তর দিকে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ ঘটনাটি মনে পড়ে গেল। এখনো মাঝে মাঝে মনে হয়, আদৌ কি সেদিন এমন কোনো ঘটনা ঘটেছিল, নাকি ঘটেনি? আমি আসলে এর কিছুই জানতে পারিনি। জীবনে কত ঘটনার যে রহস্য ভেদ করা সম্ভব হয়নি।
আরও পড়ুন:
বিশ্বের ক্যাথলিক খ্রিষ্টান ধর্মের সর্বোচ্চ নেতা পোপ ফ্রান্সিস ও বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের নামে যৌথভাবে একটি উদ্যোগ শুরু করেছে ভ্যাটিকান। বিশ্ব মানবতার জন্য একটি রূপান্তরমূলক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ভবিষ্যৎ গঠনের লক্ষ্যে ‘পোপ ফ্রান্সিস থ্রি জিরোস ক্লাব’—নামের উদ্যোগটি চালু
২ ঘণ্টা আগেভারতীয় সংবাদ সংস্থা এএনআইকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেছেন, ‘ইসকনের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো কর্মসূচি দেয়নি হেফাজতে ইসলাম বরং মুসলিমদের উত্তেজিত হওয়া থেকে বিরত রাখতে এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হেফাজত দায়িত্ব নিয়েছে
৩ ঘণ্টা আগেসাবেক প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করীম আর নেই। আজ শনিবার ভোর পৌনে ৫টার দিকে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্নাইলাইহি রাজিউন।
৩ ঘণ্টা আগেহোটেল সোনারগাঁওয়ে চলছে আন্তর্জাতিক ভূরাজনৈতিক সম্মেলন। বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ এ সম্মেলনের আয়োজন করেছে। এতে ৮০ টিরও বেশি দেশ থেকে ২০০ জনের বেশি আলোচক, ৩০০ জন প্রতিনিধিসহ ৮০০ শোর অংশগ্রহণকারী রয়েছেন।
৪ ঘণ্টা আগে