কামরুল হাসান, ঢাকা
কুর্মিটোলা র্যাব হেডকোয়ার্টার্সে এক কর্মকর্তার রুমে বসে খোশগল্প করছি। কথায় কথায় কানে এল, বেনাপোল থেকে নাকি এক ভারতীয়কে আটক করে এখানে আনা হয়েছে। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা ব্যস্ত তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা নিয়ে। লোকটা কে? যে কর্মকর্তার কক্ষে বসে ছিলাম, তাঁকে প্রশ্ন করতেই একটু থতমত খেয়ে তিনি বললেন, ‘নাম জানি না ভাই। শুনেছি, সে নাকি বুকি (ক্রিকেট জুয়াড়ি)।’
এতটুকু শুনেই মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেল। জীবনে বহু চোর, ডাকাত, অস্ত্রবাজ, ছিনতাইকারী দেখেছি। শীর্ষ সন্ত্রাসীর সামনে বসে কথা বলেছি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সিরিয়াল কিলারের সাক্ষাৎকার নিয়েছি। কিন্তু ক্রিকেট জুয়াড়ি! ভাবতেই আরাম লাগছে। কথায় কথায় আবদার করলাম, সেই জুয়াড়িকে দেখতে চাই। কর্মকর্তা আমার আবদার এড়াতে পারেন না। শুধু বললেন, ‘এটা তো ভাই এডিজি স্যার দেখছেন।’
র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এডিজি) তখন জিয়াউল আহসান। গেলাম তাঁর কক্ষে। তিনি আমার আবদার শুনে একটু মুচকি হেসে বললেন, ‘আচ্ছা, বসেন।’ মিনিট ত্রিশেক পর আমার সামনে আনা হলো টেকো মাথার মাঝারি উচ্চতার সেই ব্যক্তিকে। আমি নাম-ঠিকানা জানতে চাইলাম। বললেন, নাম অতনু দত্ত। পিতার নাম মণীন্দ্র দত্ত। কলকাতার রিজেন্ট পার্ক এলাকার ৯৯ নম্বর সড়কের ড্রিমটপ রেসিডেন্সিতে থাকেন। এরপর যত প্রশ্ন করি, একটারও কোনো জবাব দেন না; বিশেষ করে আমার মাথায় ঘুরছিল, জুয়াটা কী করে হয়, সেটা জানা। কিন্তু তিনি সে সম্পর্কে কিছুই বললেন না। তবে অতনু দত্ত না বললেও আমি হাল ছাড়িনি। কয়েক দিনের মধ্যে আমার কাছে সব পরিষ্কার হয়ে এল।
তার আগে বলি, ক্রিকেট খেলা যাঁরা দেখেন, তাঁরা সবাই আইসিসির (ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল) পাশাপাশি আরও একটি নামের সঙ্গে বেশ পরিচিত, তা হলো ‘আকসু’। আইসিসির অঙ্গসংগঠন ‘অ্যান্টি করাপশন অ্যান্ড সিকিউরিটি ইউনিট’ বা আকসুকে ক্রিকেটাররা ডরান যমের মতো। এর কারণও আছে। জুয়া ঠেকিয়ে ভদ্রলোকের খেলা ক্রিকেটের ভাবমূর্তি ঠিক রাখতে আকসু সব সময় থাকে পুলিশের ভূমিকায়। সেই আকসু আগাম হুঁশিয়ারি দিয়েছিল ঢাকার ক্রিকেটে জুয়া হবে বলে।
আমি যে ঘটনা বলছি, সেটা ২০১৪ সালের। এর আগে ২০১৩ সালের ২৪ মার্চ নিউজিল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকার খেলা নিয়ে বেটিং (বাজি) করার অপরাধে ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যের লুধিয়ানা শহরের একটি বাড়ি থেকে ৩৬টি মোবাইল ফোনসহ চার যুবককে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। যুবকেরাই প্রথম ফাঁস করেছিলেন নতুন ধরনের ক্রিকেট জুয়ার ছক। এরপর পাঞ্জাব পুলিশ সেই ছকের কথা জানিয়েছিল আকসুকে। প্রথম দফায় এই গল্প শুনে আমার কাছেও খুব অদ্ভুত মনে হয়েছিল বিষয়টা।
এবার সেই পদ্ধতিটা বলি, ক্রিকেট নিয়ে কোটি কোটি টাকার জুয়ার গল্প নতুন কিছু নয়। সেই জুয়াড়িদের কেউই কিন্তু মাঠে যান না। তাঁরা থাকেন মাঠের বাইরে দিল্লি, ঢাকা বা দুবাইয়ের মতো শহরে। কিন্তু তাঁদের লোক থাকে খেলার মাঠে। সেই লোকদের কানে লাগানো থাকে মোবাইল ফোন। মাঠের খেলার সব তথ্য তাঁরা হালনাগাদ টেলিফোনে জানিয়ে দেন ফোনের অন্য প্রান্তে থাকা লোকটিকে। জুয়াড়িরা যেহেতু টেলিভিশন বা ইন্টারনেটে খেলা দেখে বাজি ধরেন, কাজেই তাঁরা বাড়তি কিছু সময় হাতে পান। এই সময়টা কাজে লাগিয়েই জুয়া জেতেন। বিষয়টা আরেকটু খোলাসা করি। ধরুন, মিরপুর মাঠে কোনো খেলোয়াড় আউট হলো, সেটা টেলিভিশনের পর্দায় আসতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগে, কিন্তু টেলিফোনে সেটা সঙ্গে সঙ্গে বলা যায়। এটাই হলো জুয়ার সময়ের পার্থক্য।
আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, ২০১৪ সালের ২১ মার্চ ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ হয়েছিল ঢাকার মিরপুর স্টেডিয়ামে। সেই ম্যাচের সময় গোয়েন্দারা লক্ষ করলেন, মাঠে বসে কিছু লোক সার্বক্ষণিক টেলিফোনে কথা বলছিলেন। খেলার পুরো সময় তাঁদের ফোনের সংযোগ সচল। এ রকম কয়েকজনকে সন্দেহ করার সময় তাঁরাও বিষয়টি টের পান। এরপর দ্রুত সটকে পড়েন। কিন্তু সেই দলের অতনু দত্ত আর সরতে পারেননি। র্যাবের গোয়েন্দারা মাঠ থেকেই তাঁকে পাকড়াও করেন। ওই সময় আকসুর প্রধান ছিলেন যোগীন্দ্র পল সিং। তিনিও উপস্থিত ছিলেন মিরপুরের মাঠে। অতনুকে আটক করতে দেখে আকসুর আঞ্চলিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাপক ধরমবীর সিং যাদব এগিয়ে যান। তিনি র্যাবের গোয়েন্দাকে বলেন, অতনু হলো তাঁর গোপন তথ্যদাতা (সোর্স)। এরপর র্যাব তাঁকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। কিন্তু ছেড়ে দিলেও র্যাব অতনুর ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে শুরু করে।
দেখা যায়, অতনু ব্যবসায়ী ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন। এরপর নিজেকে ‘ক্রিকেট ফ্যান’ পরিচয় দিয়ে মিরপুরে গ্র্যান্ড প্রিন্স হোটেলে ওঠেন। অতনুর ফোন নম্বর অনুসরণ করতে গিয়ে গোয়েন্দারা জানতে পারেন, ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের সময় তিনি যখন ফোনে কথা বলছিলেন, তখন ফোনের অপর প্রান্তে ছিলেন কলকাতার জুয়াড়ি কুনাল দাগা। পরে হোটেল থেকে অতনুর পাসপোর্টের কপি নিয়ে তাঁকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। অতনু বিষয়টি বুঝতে পেরে পালানোর পথ খুঁজতে থাকেন।
গ্র্যান্ড প্রিন্স হোটেলের ব্যবস্থাপক জাহিদ হাসান আমাকে বলেছিলেন, গোয়েন্দারা পিছু নিয়েছেন দেখে ১ এপ্রিল চট্টগ্রামে খেলা দেখতে যাওয়ার কথা বলে হোটেল থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন অতনু। তিনি সব মালপত্র হোটেলে ফেলে যান, যাতে কেউ সন্দেহ না করে।
র্যাবের একজন কর্মকর্তা বললেন, পালানোর আগের দিন ধরমবীর সিং যাদবের সঙ্গে টেলিফোনে অতনুর কথা হয়েছিল। যাদব তাঁকে বলেছিলেন, ‘তোমাকে ফলো করা হচ্ছে। একবার বাঁচাতে পারলেও দ্বিতীয়বার বাঁচানো যাবে না। তুমি দ্রুত বাংলাদেশ ছেড়ে যাও।’ এরপর ৩ এপ্রিল (২০১৪) রাতে যশোরের বেনাপোল সীমান্ত অতিক্রম করার সময় ইমিগ্রেশনের ওসি মনিরুজ্জামান তাঁকে আটক করেন।
কয়েক দিন পর মিরপুর থানার অপারেশন কর্মকর্তা আফজাল হোসেন আমাকে বললেন, অতনুর বিরুদ্ধে ২০১৪ সালের ৬ এপ্রিল তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৬৩ ধারায় মামলা হয়। সেই মামলায় অতনুকে গ্রেপ্তার করে পাঠানো হয় আদালতে। এরপর মহানগর হাকিম মাহবুবুর রহমান তাঁকে জামিন দেন। জামিন পেয়ে গা ঢাকা দেন অতনু। আজও তাঁর কোনো খোঁজ মেলেনি।
মনে আছে, বেশ কয়েকজন আইনজীবী অতনু দত্তের মামলা পরিচালনা করেছিলেন। তাঁদের একজন এমদাদ হোসেন আমাকে বলেছিলেন, ঢাকার নামকরা এক ক্রীড়া সংগঠক অতনুর জামিনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তবে ওই ক্রীড়া সংগঠকের নাম তিনি বলতে চাননি।
রিপোর্টার হিসেবে এ বিষয়ে আরও জানতে আকসুর প্রধান যোগীন্দ্র পল সিং (ওয়াই পি সিং) ও ধরমবীর সিং যাদবকে আকসুর ওয়েবসাইটে দেওয়া নম্বরে ফোন করেছিলাম। দুজনই আমার ফোন সিরিভ করেছিলেন। ফোনে সব কথা শুনে বলেছিলেন, ‘না, না, আমি সে লোক নই। রং নম্বর।’ পরে আইসিসি ও আকসুকে এ বিষয়ে বক্তব্য চেয়ে ই-মেইল করেছিলাম, কিন্তু তারা কোনো জবাব দেয়নি। দুদিন পর আকসুর আরেক আঞ্চলিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাপক নিরঞ্জন সিং বার্ক আমাকে ফোন করেন। তিনি তখনকার বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী নিজাম উদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন। তাঁর কথা অনুযায়ী যোগাযোগও করেছিলাম।
বেশ কয়েক মাস পর র্যাব ওই ঘটনার তদন্ত গুছিয়ে এনেছিল। একদিন র্যাবের তখনকার এডিজি কর্নেল জিয়াউল আহসান আমাকে বললেন, জুয়াড়ি অতনু দত্তের সঙ্গে আকসুর সেই কর্মকর্তা ধরমবীর সিং যাদবের ঘনিষ্ঠতা ছিল। তাঁরা একসঙ্গে এই কাজ করেন। এ ঘটনার কয়েক বছর পর বাংলাদেশ-ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচ চলাকালে চট্টগ্রাম থেকে তিন ভারতীয় জুয়াড়িকে এনএসআই (জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা) আটক করে তুলে দিয়েছিল পুলিশের হাতে। এরপর শুনলাম, দীপ আগারওয়াল নামের এক জুয়াড়ি বাংলাদেশি অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানকেও ম্যাচ গড়াপেটার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। আইসিসির এক কর্মকর্তা একবার সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ৫০টি ম্যাচ পাতানোর ঘটনা তাঁরা তদন্ত করছেন, যেগুলোর বেশির ভাগই ছিল ভারত-সংশ্লিষ্ট। সবার কথায় আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে এল, ক্রিকেট ম্যাচ গড়াপেটা বা পাতানো খেলার যে অভিযোগ আমরা হরহামেশা শুনি, তার সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে আকসু এবং ক্রীড়া সংস্থাগুলোর লোকজনও জড়িত। ‘বেড়ায় ক্ষেত খায়’ বা ‘শর্ষের ভেতরে ভূত’ থাকার যে গল্প আছে, এ ক্ষেত্রে তা শতভাগ সত্যি হয়ে যায়।
আরও পড়ুন:
কুর্মিটোলা র্যাব হেডকোয়ার্টার্সে এক কর্মকর্তার রুমে বসে খোশগল্প করছি। কথায় কথায় কানে এল, বেনাপোল থেকে নাকি এক ভারতীয়কে আটক করে এখানে আনা হয়েছে। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা ব্যস্ত তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা নিয়ে। লোকটা কে? যে কর্মকর্তার কক্ষে বসে ছিলাম, তাঁকে প্রশ্ন করতেই একটু থতমত খেয়ে তিনি বললেন, ‘নাম জানি না ভাই। শুনেছি, সে নাকি বুকি (ক্রিকেট জুয়াড়ি)।’
এতটুকু শুনেই মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেল। জীবনে বহু চোর, ডাকাত, অস্ত্রবাজ, ছিনতাইকারী দেখেছি। শীর্ষ সন্ত্রাসীর সামনে বসে কথা বলেছি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সিরিয়াল কিলারের সাক্ষাৎকার নিয়েছি। কিন্তু ক্রিকেট জুয়াড়ি! ভাবতেই আরাম লাগছে। কথায় কথায় আবদার করলাম, সেই জুয়াড়িকে দেখতে চাই। কর্মকর্তা আমার আবদার এড়াতে পারেন না। শুধু বললেন, ‘এটা তো ভাই এডিজি স্যার দেখছেন।’
র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এডিজি) তখন জিয়াউল আহসান। গেলাম তাঁর কক্ষে। তিনি আমার আবদার শুনে একটু মুচকি হেসে বললেন, ‘আচ্ছা, বসেন।’ মিনিট ত্রিশেক পর আমার সামনে আনা হলো টেকো মাথার মাঝারি উচ্চতার সেই ব্যক্তিকে। আমি নাম-ঠিকানা জানতে চাইলাম। বললেন, নাম অতনু দত্ত। পিতার নাম মণীন্দ্র দত্ত। কলকাতার রিজেন্ট পার্ক এলাকার ৯৯ নম্বর সড়কের ড্রিমটপ রেসিডেন্সিতে থাকেন। এরপর যত প্রশ্ন করি, একটারও কোনো জবাব দেন না; বিশেষ করে আমার মাথায় ঘুরছিল, জুয়াটা কী করে হয়, সেটা জানা। কিন্তু তিনি সে সম্পর্কে কিছুই বললেন না। তবে অতনু দত্ত না বললেও আমি হাল ছাড়িনি। কয়েক দিনের মধ্যে আমার কাছে সব পরিষ্কার হয়ে এল।
তার আগে বলি, ক্রিকেট খেলা যাঁরা দেখেন, তাঁরা সবাই আইসিসির (ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল) পাশাপাশি আরও একটি নামের সঙ্গে বেশ পরিচিত, তা হলো ‘আকসু’। আইসিসির অঙ্গসংগঠন ‘অ্যান্টি করাপশন অ্যান্ড সিকিউরিটি ইউনিট’ বা আকসুকে ক্রিকেটাররা ডরান যমের মতো। এর কারণও আছে। জুয়া ঠেকিয়ে ভদ্রলোকের খেলা ক্রিকেটের ভাবমূর্তি ঠিক রাখতে আকসু সব সময় থাকে পুলিশের ভূমিকায়। সেই আকসু আগাম হুঁশিয়ারি দিয়েছিল ঢাকার ক্রিকেটে জুয়া হবে বলে।
আমি যে ঘটনা বলছি, সেটা ২০১৪ সালের। এর আগে ২০১৩ সালের ২৪ মার্চ নিউজিল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকার খেলা নিয়ে বেটিং (বাজি) করার অপরাধে ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যের লুধিয়ানা শহরের একটি বাড়ি থেকে ৩৬টি মোবাইল ফোনসহ চার যুবককে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। যুবকেরাই প্রথম ফাঁস করেছিলেন নতুন ধরনের ক্রিকেট জুয়ার ছক। এরপর পাঞ্জাব পুলিশ সেই ছকের কথা জানিয়েছিল আকসুকে। প্রথম দফায় এই গল্প শুনে আমার কাছেও খুব অদ্ভুত মনে হয়েছিল বিষয়টা।
এবার সেই পদ্ধতিটা বলি, ক্রিকেট নিয়ে কোটি কোটি টাকার জুয়ার গল্প নতুন কিছু নয়। সেই জুয়াড়িদের কেউই কিন্তু মাঠে যান না। তাঁরা থাকেন মাঠের বাইরে দিল্লি, ঢাকা বা দুবাইয়ের মতো শহরে। কিন্তু তাঁদের লোক থাকে খেলার মাঠে। সেই লোকদের কানে লাগানো থাকে মোবাইল ফোন। মাঠের খেলার সব তথ্য তাঁরা হালনাগাদ টেলিফোনে জানিয়ে দেন ফোনের অন্য প্রান্তে থাকা লোকটিকে। জুয়াড়িরা যেহেতু টেলিভিশন বা ইন্টারনেটে খেলা দেখে বাজি ধরেন, কাজেই তাঁরা বাড়তি কিছু সময় হাতে পান। এই সময়টা কাজে লাগিয়েই জুয়া জেতেন। বিষয়টা আরেকটু খোলাসা করি। ধরুন, মিরপুর মাঠে কোনো খেলোয়াড় আউট হলো, সেটা টেলিভিশনের পর্দায় আসতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগে, কিন্তু টেলিফোনে সেটা সঙ্গে সঙ্গে বলা যায়। এটাই হলো জুয়ার সময়ের পার্থক্য।
আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, ২০১৪ সালের ২১ মার্চ ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ হয়েছিল ঢাকার মিরপুর স্টেডিয়ামে। সেই ম্যাচের সময় গোয়েন্দারা লক্ষ করলেন, মাঠে বসে কিছু লোক সার্বক্ষণিক টেলিফোনে কথা বলছিলেন। খেলার পুরো সময় তাঁদের ফোনের সংযোগ সচল। এ রকম কয়েকজনকে সন্দেহ করার সময় তাঁরাও বিষয়টি টের পান। এরপর দ্রুত সটকে পড়েন। কিন্তু সেই দলের অতনু দত্ত আর সরতে পারেননি। র্যাবের গোয়েন্দারা মাঠ থেকেই তাঁকে পাকড়াও করেন। ওই সময় আকসুর প্রধান ছিলেন যোগীন্দ্র পল সিং। তিনিও উপস্থিত ছিলেন মিরপুরের মাঠে। অতনুকে আটক করতে দেখে আকসুর আঞ্চলিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাপক ধরমবীর সিং যাদব এগিয়ে যান। তিনি র্যাবের গোয়েন্দাকে বলেন, অতনু হলো তাঁর গোপন তথ্যদাতা (সোর্স)। এরপর র্যাব তাঁকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। কিন্তু ছেড়ে দিলেও র্যাব অতনুর ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে শুরু করে।
দেখা যায়, অতনু ব্যবসায়ী ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন। এরপর নিজেকে ‘ক্রিকেট ফ্যান’ পরিচয় দিয়ে মিরপুরে গ্র্যান্ড প্রিন্স হোটেলে ওঠেন। অতনুর ফোন নম্বর অনুসরণ করতে গিয়ে গোয়েন্দারা জানতে পারেন, ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের সময় তিনি যখন ফোনে কথা বলছিলেন, তখন ফোনের অপর প্রান্তে ছিলেন কলকাতার জুয়াড়ি কুনাল দাগা। পরে হোটেল থেকে অতনুর পাসপোর্টের কপি নিয়ে তাঁকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। অতনু বিষয়টি বুঝতে পেরে পালানোর পথ খুঁজতে থাকেন।
গ্র্যান্ড প্রিন্স হোটেলের ব্যবস্থাপক জাহিদ হাসান আমাকে বলেছিলেন, গোয়েন্দারা পিছু নিয়েছেন দেখে ১ এপ্রিল চট্টগ্রামে খেলা দেখতে যাওয়ার কথা বলে হোটেল থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন অতনু। তিনি সব মালপত্র হোটেলে ফেলে যান, যাতে কেউ সন্দেহ না করে।
র্যাবের একজন কর্মকর্তা বললেন, পালানোর আগের দিন ধরমবীর সিং যাদবের সঙ্গে টেলিফোনে অতনুর কথা হয়েছিল। যাদব তাঁকে বলেছিলেন, ‘তোমাকে ফলো করা হচ্ছে। একবার বাঁচাতে পারলেও দ্বিতীয়বার বাঁচানো যাবে না। তুমি দ্রুত বাংলাদেশ ছেড়ে যাও।’ এরপর ৩ এপ্রিল (২০১৪) রাতে যশোরের বেনাপোল সীমান্ত অতিক্রম করার সময় ইমিগ্রেশনের ওসি মনিরুজ্জামান তাঁকে আটক করেন।
কয়েক দিন পর মিরপুর থানার অপারেশন কর্মকর্তা আফজাল হোসেন আমাকে বললেন, অতনুর বিরুদ্ধে ২০১৪ সালের ৬ এপ্রিল তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৬৩ ধারায় মামলা হয়। সেই মামলায় অতনুকে গ্রেপ্তার করে পাঠানো হয় আদালতে। এরপর মহানগর হাকিম মাহবুবুর রহমান তাঁকে জামিন দেন। জামিন পেয়ে গা ঢাকা দেন অতনু। আজও তাঁর কোনো খোঁজ মেলেনি।
মনে আছে, বেশ কয়েকজন আইনজীবী অতনু দত্তের মামলা পরিচালনা করেছিলেন। তাঁদের একজন এমদাদ হোসেন আমাকে বলেছিলেন, ঢাকার নামকরা এক ক্রীড়া সংগঠক অতনুর জামিনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তবে ওই ক্রীড়া সংগঠকের নাম তিনি বলতে চাননি।
রিপোর্টার হিসেবে এ বিষয়ে আরও জানতে আকসুর প্রধান যোগীন্দ্র পল সিং (ওয়াই পি সিং) ও ধরমবীর সিং যাদবকে আকসুর ওয়েবসাইটে দেওয়া নম্বরে ফোন করেছিলাম। দুজনই আমার ফোন সিরিভ করেছিলেন। ফোনে সব কথা শুনে বলেছিলেন, ‘না, না, আমি সে লোক নই। রং নম্বর।’ পরে আইসিসি ও আকসুকে এ বিষয়ে বক্তব্য চেয়ে ই-মেইল করেছিলাম, কিন্তু তারা কোনো জবাব দেয়নি। দুদিন পর আকসুর আরেক আঞ্চলিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাপক নিরঞ্জন সিং বার্ক আমাকে ফোন করেন। তিনি তখনকার বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী নিজাম উদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন। তাঁর কথা অনুযায়ী যোগাযোগও করেছিলাম।
বেশ কয়েক মাস পর র্যাব ওই ঘটনার তদন্ত গুছিয়ে এনেছিল। একদিন র্যাবের তখনকার এডিজি কর্নেল জিয়াউল আহসান আমাকে বললেন, জুয়াড়ি অতনু দত্তের সঙ্গে আকসুর সেই কর্মকর্তা ধরমবীর সিং যাদবের ঘনিষ্ঠতা ছিল। তাঁরা একসঙ্গে এই কাজ করেন। এ ঘটনার কয়েক বছর পর বাংলাদেশ-ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচ চলাকালে চট্টগ্রাম থেকে তিন ভারতীয় জুয়াড়িকে এনএসআই (জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা) আটক করে তুলে দিয়েছিল পুলিশের হাতে। এরপর শুনলাম, দীপ আগারওয়াল নামের এক জুয়াড়ি বাংলাদেশি অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানকেও ম্যাচ গড়াপেটার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। আইসিসির এক কর্মকর্তা একবার সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ৫০টি ম্যাচ পাতানোর ঘটনা তাঁরা তদন্ত করছেন, যেগুলোর বেশির ভাগই ছিল ভারত-সংশ্লিষ্ট। সবার কথায় আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে এল, ক্রিকেট ম্যাচ গড়াপেটা বা পাতানো খেলার যে অভিযোগ আমরা হরহামেশা শুনি, তার সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে আকসু এবং ক্রীড়া সংস্থাগুলোর লোকজনও জড়িত। ‘বেড়ায় ক্ষেত খায়’ বা ‘শর্ষের ভেতরে ভূত’ থাকার যে গল্প আছে, এ ক্ষেত্রে তা শতভাগ সত্যি হয়ে যায়।
আরও পড়ুন:
ভারতীয় সংবাদ সংস্থা এএনআইকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেছেন, ‘ইসকনের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো কর্মসূচি দেয়নি হেফাজতে ইসলাম বরং মুসলিমদের উত্তেজিত হওয়া থেকে বিরত রাখতে এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হেফাজত দায়িত্ব নিয়েছে
২১ মিনিট আগেসাবেক প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করীম আর নেই। আজ শনিবার ভোর পৌনে ৫টার দিকে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্নাইলাইহি রাজিউন।
১ ঘণ্টা আগেহোটেল সোনারগাঁওয়ে চলছে আন্তর্জাতিক ভূরাজনৈতিক সম্মেলন। বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ এ সম্মেলনের আয়োজন করেছে। এতে ৮০ টিরও বেশি দেশ থেকে ২০০ জনের বেশি আলোচক, ৩০০ জন প্রতিনিধিসহ ৮০০ শোর অংশগ্রহণকারী রয়েছেন।
১ ঘণ্টা আগেসেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত ‘বে অব বেঙ্গল সম্মেলন’ শুরু হয়েছে। এবারের সম্মেলনে উপস্থিত থাকছেন দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোসহ বিভিন্ন দেশের ৮০০ জন অতিথি। প্রথম দিন অনুষ্ঠানে উদ্বোধনী বক্তা হিসেবে উপস্থিত আছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
৩ ঘণ্টা আগে