বিজয়নগর (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রতিনিধি
ভিক্টর গোমেজের সঙ্গে আমার জানাশোনা অনেক দিনের। তিনি কাজ করতেন ক্রিশ্চিয়ান কমিশন ফর ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ বা সিসিডিবি নামের একটি এনজিওতে। ভিক্টর একদিন অফিসে এসে আমাকে গ্রিন রোডের একটি বাড়িতে নিয়ে যেতে চাইলেন। যাব যাব করে বিচ্ছিরি ফরমায়েশি কাজে আটকে গেলাম সেদিন। গেলাম পরের দিন। বাড়ির নিচতলার এক ফ্ল্যাটে গিয়ে কলবেল বাজাতেই মাঝবয়সী এক নারী এসে দরজা খুলে দিলেন। ভিক্টরের সঙ্গে আমাকে দেখে ড্রয়িংরুমে বসতে বললেন। মনে হলো, আমার আসার কথা বাড়ির লোকেরা আগে থেকেই জানতেন।
একটু পর ড্রয়িংরুমে এলেন এক বয়স্ক নারী। ভিক্টর পরিচয় করিয়ে দিলেন, ‘উনি থ্যালমা গোমেজ’। তাঁর বাম হাতে ধরা নীল রঙের একটি চিঠির খাম। খামটি আমার হাতে দিতে দিতে বললেন, ‘এই চিঠি আমার জীবনটাকে ওলটপালট করে দিয়েছে। সাত দিন ধরে খেতে ও ঘুমাতে পারছি না। আমার ছেলেমেয়েরা বিদেশে, তারাও অস্থির।’
চিঠিটা হাতে নিয়ে দেখি বিদেশ থেকে আসা। খামের ওপরে প্রেরকের ঠিকানা বলতে লেখা, হিলি গোমেজ, লন্ডন। প্রাপকের নামের জায়গায় ‘থ্যালমা গোমেজ, হাসনাবাদ, নবাবগঞ্জ, খালপাড়, ঢাকা’ লেখা। খামের ওপরে ডান দিকে বাহরাইনের ডাকটিকিট লাগানো। ভেতরে হ্যাট পরা এক বৃদ্ধের পোস্টকার্ড সাইজের রঙিন ছবি, ছবির উল্টো দিকে ‘হিলি গোমেজ’ নাম সই করা। তার পাশে থ্যালমা গোমেজের নাম। বাংলা ও ইংরেজিতে লেখা, ‘আমি তোমাকে ভুলিনি, আমি ফিরে এসেছি, আজ জীবিত থাকলেও নেই।’ আরেক পাশে ছোট করে চারটি নাম লেখা—শান্তি, দিলীপ, বাদল ও করুণা।
ছবিটা হাতে নিয়ে বৃদ্ধার কাছে জানতে চাইলাম, উনি কে। আমার মুখের কথা শেষ না হতেই বৃদ্ধা বললেন, আমার স্বামী। ৪৩ বছর আগে এক ব্রিটিশ জাহাজসমেত নিখোঁজ হন জাপানের কোনো এক বন্দর থেকে। এত বছরেও তাঁর কোনো খোঁজ ছিল না। কয়েক দিন আগে এই চিঠি এসেছে। আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, এই ছবি দেখে চিনতে পারলেন? জবাব তৈরিই ছিল। বললেন, ঠোঁট ও কানের লতি দেখে চিনেছি। পাশে অন্য চারটি নাম কার? ‘এগুলো আমার ছেলেমেয়ের নাম।’ আমার সামনে সোফায় বসা ভিক্টর এসব শুনতে শুনতে বললেন, চিঠিটা আসার পর পুরো পরিবার আনন্দ-বেদনায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। তারা এখন কী করবে বুঝতে পারছে না।
থ্যালমা বললেন, চিঠিটা ২২ জানুয়ারি (২০০০ সাল) নবাবগঞ্জের ঠিকানায় এসেছে। এরপর তিনি চিঠিটি নিয়ে গ্রিন রোডে মেয়ের বাসায় আসেন। এটা তাঁর ছোট মেয়ে করুণার বাসা। থ্যালমা বললেন, চিঠি পাওয়ার পর তাঁর মনে হয়েছে, এত দিন নিখোঁজ লোকটি বেঁচে আছেন, হয়তো তাঁর কোনো বন্ধু বাহরাইন থেকে চিঠিটা ডাকে ছেড়ে দিয়েছেন। এটুকু বলতেই তাঁর গলা ধরে আসে।
আমি থ্যালমার মুখের দিকে তাকাই। তাঁর চোখে দুকূল ভাসানো ভালোবাসা। বয়সের ভারে চামড়া ভেতরে আশ্রয় নেওয়া চোখের নিচে বিন্দু বিন্দু পানি। এই অবস্থায় কাউকে প্রশ্ন করা সহজ নয়। তবু কীভাবে শুরু করব, ভাবতে ভাবতে বললাম, গোমেজ সাহেব কীভাবে নিখোঁজ হয়েছিলেন? প্রশ্নটা ছুড়ে দিয়েই মনে হলো, মাটিতে ঠিক কোপটি পড়েছে। রোদ পেয়ে অমনি দলে দলে বেরিয়ে আসছে পুরোনো সব স্মৃতি।
থ্যালমা বলতে শুরু করলেন। নবাবগঞ্জের হাসনাবাদ খালপাড়ের যে গ্রামে তাঁরা থাকতেন, ৪৪ বছর আগে সে গ্রাম থেকে বেরিয়েছিলেন দুরন্ত যুবক হিলি গোমেজ। পেশায় জাহাজের নাবিক। ঘুরে বেড়াতেন বন্দর থেকে বন্দরে। সাগরে বেড়ানোর নেশা তাঁকে পেয়ে বসেছিল কৈশোর থেকেই। সে কারণে শখ করে জাহাজে চাকরি নিয়েছিলেন।
স্বামী-স্ত্রী আর সন্তানদের নিয়ে তাঁদের সুখের সংসার। বড় মেয়ে শান্তির বয়স তখন ১০। দ্বিতীয় ছেলে দিলীপ ৬, আর বাদল ৪ বছর। ছোট মেয়ে করুণার জন্ম ১৯৫৬ সালের মে মাসে।
হিলি গোমেজ তখন ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান বুলার্ড কিং অ্যান্ড কোম্পানির একটি জাহাজে চাকরি করতেন। আমটাটা, আমটালি, আমব্রেলা ও আমবার্ড নামে চারটি জাহাজ ছিল এই কোম্পানির। হিলি গোমেজ জাহাজে থাকা অবস্থায় জানতে পারেন করুণার জন্মের খবর। খবর শুনে তাকে দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন বাবা। কোম্পানির জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে এলে ক্যাপ্টেনকে না বলেই সোজা হাসনাবাদের বাড়িতে চলে আসেন তিনি।
১৯৫৬ সালের ১৬ জুন রাতে স্টিমারযোগে মইনট ঘাট (বর্তমানে বিলুপ্ত) হয়ে বাড়িতে আসেন হিলি গোমেজ। বাড়িতে এসে মেয়েকে একনজর দেখে সে রাতেই আবার চলে যান। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে তাঁদের জাহাজ যায় করাচি বন্দরে, সেখান থেকে জাপানে। জাপানের কোনো এক বন্দর থেকে জাহাজটি ছাড়ার ৮ দিন পর সেটি নিখোঁজ হয়।
থ্যালমা সেই ঘটনা জানতে পারেন দেড় মাস পর। জাহাজ কর্তৃপক্ষ তাঁর বাসায় চিঠি দিয়ে জানায়, বন্দর থেকে ছাড়ার পর জাহাজটি নিখোঁজ হয়। ক্রুসহ জাহাজে লোক ছিলেন ২৮৪ জন। দুর্ঘটনায় পড়ার আগে জাহাজ থেকে ‘এসওএস’ বার্তা পাওয়ার পর কাছের বন্দর থেকে উদ্ধারকারী হেলিকপ্টার পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু জাহাজের আর কোনো খোঁজ মেলেনি।
চিঠিতে কর্তৃপক্ষ আরও জানিয়েছিল, বিশাল আয়তনের এই জাহাজ ডুবতে কমপক্ষে ১২ দিন লাগার কথা। কিন্তু তারা জাহাজটির কাউকেই খুঁজে পায়নি। এই জাহাজে কাজ করতেন তাঁদের গ্রামের আরেক যুবক সনাতন। শেষ মুহূর্তে ডাক্তারি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলে তাঁকে জাহাজ থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়। তিনি ফিরে এসে জানান, জাহাজটি বন্দর ছেড়ে যাওয়ার আগমুহূর্তে ক্যাপ্টেন জাহাজ পরিদর্শনে এসে অতিরিক্ত যাত্রী ও মালামাল দেখে অসম্মতি জানান। তিনি বলেন, এ জাহাজের মালামাল না কমালে গভীর সাগরে ডুবে যেতে পারে। কিন্তু জাহাজ কর্তৃপক্ষ তাঁর কথা না শুনে নতুন ক্যাপ্টেন নিয়োগ করেন। জাহাজের প্রথম ক্যাপ্টেন সে সময় হিলিকে এ জাহাজে যেতে নিষেধ করেন, কিন্তু হিলি তাঁর কথা শোনেননি।
থ্যালমা বললেন, এ ঘটনা ১৯৫৬ সালের। এরপর দীর্ঘ সময় জাহাজ ও নাবিকদের আর কোনো খোঁজ তিনি পাননি। সর্বশেষ করাচি বন্দর থেকে হিলি তাঁকে চিঠি লিখেছিলেন। জাহাজে চাকরি করার সময় কোম্পানি প্রতি মাসে ৭০ টাকা করে তাঁদের বাড়ির ঠিকানায় পাঠাত। হিলি নিখোঁজ হওয়ার তিন মাস পর তা-ও বন্ধ হয়ে যায়।
থ্যালমা বলেন, হিলি নিখোঁজ হওয়ার পর চার সন্তান নিয়ে পানিতে পড়েন তিনি। অভাব-অনটন তখন নিত্যসঙ্গী। খরচ চালাতে না পেরে দুই সন্তান শান্তি ও দিলীপকে অনাথ আশ্রমে পাঠান। একজন মিশনারি ফাদার তাঁদের দেখাশোনা করেন। স্বামী নিখোঁজ হওয়ার পর ক্ষতিপূরণ চেয়ে তিনি কোম্পানির বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেন, কিন্তু কোম্পানি তাঁকে জানিয়ে দেয়, যুদ্ধে জাহাজ বিধ্বস্ত না হলে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিধান নেই। এভাবে দিন চলে যায়।
থ্যালমার অপেক্ষার পালা দীর্ঘ হতে হতে চার সন্তান বড় হয়। বড় ছেলে দিলীপ আমেরিকায় ভালো চাকরি করেন। বাদল চাকরি করেন ওমানের মাসকট বিমানবন্দরে। বড় মেয়ে শান্তি স্বামীর সঙ্গে মুম্বাইবাসী। সেদিনের এক মাসের কন্যা করুণাও মাঝবয়সী নারী। থ্যালমার বয়সও কম হয়নি, তিনি তখন ৭২-এ। চোখে ভালো দেখতে না পেলেও ছবিতে একপলক দেখেই স্বামীকে চিনতে পারেন।
থ্যালমার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল ২০০০ সালের ২৫ জানুয়ারি, মঙ্গলবার। সেদিন করুণা আমাকে বলেছিলেন, বাবাকে নিজের চোখে না দেখলেও তাঁর সব গল্প মুখস্থ। শুনেছেন, বাবা তাঁর বড় মেয়ে শান্তির জন্য বিভিন্ন বন্দর থেকে ডাকে কেক পাঠাতেন। সেই কেকের মধ্যে লুকানো থাকত কানের দুল বা নাকফুলের মতো উপহার। কেকটা মুখে দিলেই বেরিয়ে আসত উপহার। সেই উপহার পেয়ে আনন্দে কেঁদে ফেলতেন শান্তিদি। করুণা বারবার বললেন, আমি যেন ভালো করে একটা রিপোর্ট করি, যাতে বাবা ফিরে আসেন।
হিলি গোমেজের সেই রিপোর্ট জনকণ্ঠে ছাপা হয়েছিল ২০০০ সালের ২৬ জানুয়ারি, বুধবার। এরপর অনেক দিন আর থ্যালমা বা করুণার সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি। ভিক্টরও অন্য চাকরি নিয়ে বিদেশে চলে যান। বছর তিনেক পরে করুণাদের বাড়ির রাস্তা দিয়ে ধানমন্ডির প্রোব ম্যাগাজিনে যাচ্ছিলাম। কী মনে হলো, করুণাদের ফ্ল্যাটে কলবেল বাজালাম। দরজা খুললেন অন্য এক নারী। জিজ্ঞেস করতেই বললেন, করুণারা নেই, তাঁরা এ বাসার নতুন ভাড়াটে। করুণার মায়ের কথা শুনে বললেন, পাশের ভাড়াটেরা তাঁকে বলেছেন, নিখোঁজ স্বামীর ফিরে আসার প্রতীক্ষায় করুণার মা সারাক্ষণ বারান্দায় বসে থাকতেন, রাতেও। সহজে বিছানায় যেতেন না। একদিন ভোরবেলা তাঁকে বারান্দায় মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।
এই নারীর কথা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। অফিসে এসে পুরোনো রিপোর্টটা আবার বের করলাম। রিপোর্টে আছে, হিলির জাহাজটা দুর্ঘটনায় পড়েছিল ১৯৫৬ সালে, থ্যালমা আমাকে সেটাই বলেছিলেন। ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখলাম, বুলার্ড কিং অ্যান্ড কোম্পানি নামে ব্রিটিশ একটি প্রতিষ্ঠান আছে। সেই কোম্পানির একটি জাহাজের নামও ছিল আমটাটা (Umtata)। টর্পেডোর আঘাতে সেটা ডুবে যায় ১৯৪২ সালে, ১৯৫৬ সালে নয়। ৪২ থেকে ৫৬-তে তো অনেক ফারাক। মনে একটু খটকা লাগল।
লেখাটা শেষ করার আগে মার্কিন গল্পকার মারজরি কিনান রাউলিংসের ‘আ মাদার ইন ম্যানভিল’ গল্পটা মনে পড়ে গেল। অনাথ আশ্রমের বেড়ে ওঠা বালক জেরি সারাক্ষণ তার মায়ের কথা বলত। পাহাড়ের ওপারে মা থাকে, জন্মদিনে মা তাকে উপহার পাঠাত। কিন্তু এতিমখানায় বড় হওয়া জেরির আসলে কেউই ছিল না। মায়ের সঙ্গে তার বসবাস ছিল শুধু কল্পনাতে।
আমার মনেও ধন্দ। থ্যালমার চিঠির গল্প জেরির মতো নয় তো? সত্যিই কি এত বছর পরে হিলি সেই চিঠি লিখেছিলেন? নাকি অন্য কিছু?
আসলে মানুষের জীবনের গল্প বড় অদ্ভুত, সে গল্প হয়তো কখনো মেলে, কখনো মেলে না।
আরও পড়ুন:
ভিক্টর গোমেজের সঙ্গে আমার জানাশোনা অনেক দিনের। তিনি কাজ করতেন ক্রিশ্চিয়ান কমিশন ফর ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ বা সিসিডিবি নামের একটি এনজিওতে। ভিক্টর একদিন অফিসে এসে আমাকে গ্রিন রোডের একটি বাড়িতে নিয়ে যেতে চাইলেন। যাব যাব করে বিচ্ছিরি ফরমায়েশি কাজে আটকে গেলাম সেদিন। গেলাম পরের দিন। বাড়ির নিচতলার এক ফ্ল্যাটে গিয়ে কলবেল বাজাতেই মাঝবয়সী এক নারী এসে দরজা খুলে দিলেন। ভিক্টরের সঙ্গে আমাকে দেখে ড্রয়িংরুমে বসতে বললেন। মনে হলো, আমার আসার কথা বাড়ির লোকেরা আগে থেকেই জানতেন।
একটু পর ড্রয়িংরুমে এলেন এক বয়স্ক নারী। ভিক্টর পরিচয় করিয়ে দিলেন, ‘উনি থ্যালমা গোমেজ’। তাঁর বাম হাতে ধরা নীল রঙের একটি চিঠির খাম। খামটি আমার হাতে দিতে দিতে বললেন, ‘এই চিঠি আমার জীবনটাকে ওলটপালট করে দিয়েছে। সাত দিন ধরে খেতে ও ঘুমাতে পারছি না। আমার ছেলেমেয়েরা বিদেশে, তারাও অস্থির।’
চিঠিটা হাতে নিয়ে দেখি বিদেশ থেকে আসা। খামের ওপরে প্রেরকের ঠিকানা বলতে লেখা, হিলি গোমেজ, লন্ডন। প্রাপকের নামের জায়গায় ‘থ্যালমা গোমেজ, হাসনাবাদ, নবাবগঞ্জ, খালপাড়, ঢাকা’ লেখা। খামের ওপরে ডান দিকে বাহরাইনের ডাকটিকিট লাগানো। ভেতরে হ্যাট পরা এক বৃদ্ধের পোস্টকার্ড সাইজের রঙিন ছবি, ছবির উল্টো দিকে ‘হিলি গোমেজ’ নাম সই করা। তার পাশে থ্যালমা গোমেজের নাম। বাংলা ও ইংরেজিতে লেখা, ‘আমি তোমাকে ভুলিনি, আমি ফিরে এসেছি, আজ জীবিত থাকলেও নেই।’ আরেক পাশে ছোট করে চারটি নাম লেখা—শান্তি, দিলীপ, বাদল ও করুণা।
ছবিটা হাতে নিয়ে বৃদ্ধার কাছে জানতে চাইলাম, উনি কে। আমার মুখের কথা শেষ না হতেই বৃদ্ধা বললেন, আমার স্বামী। ৪৩ বছর আগে এক ব্রিটিশ জাহাজসমেত নিখোঁজ হন জাপানের কোনো এক বন্দর থেকে। এত বছরেও তাঁর কোনো খোঁজ ছিল না। কয়েক দিন আগে এই চিঠি এসেছে। আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, এই ছবি দেখে চিনতে পারলেন? জবাব তৈরিই ছিল। বললেন, ঠোঁট ও কানের লতি দেখে চিনেছি। পাশে অন্য চারটি নাম কার? ‘এগুলো আমার ছেলেমেয়ের নাম।’ আমার সামনে সোফায় বসা ভিক্টর এসব শুনতে শুনতে বললেন, চিঠিটা আসার পর পুরো পরিবার আনন্দ-বেদনায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। তারা এখন কী করবে বুঝতে পারছে না।
থ্যালমা বললেন, চিঠিটা ২২ জানুয়ারি (২০০০ সাল) নবাবগঞ্জের ঠিকানায় এসেছে। এরপর তিনি চিঠিটি নিয়ে গ্রিন রোডে মেয়ের বাসায় আসেন। এটা তাঁর ছোট মেয়ে করুণার বাসা। থ্যালমা বললেন, চিঠি পাওয়ার পর তাঁর মনে হয়েছে, এত দিন নিখোঁজ লোকটি বেঁচে আছেন, হয়তো তাঁর কোনো বন্ধু বাহরাইন থেকে চিঠিটা ডাকে ছেড়ে দিয়েছেন। এটুকু বলতেই তাঁর গলা ধরে আসে।
আমি থ্যালমার মুখের দিকে তাকাই। তাঁর চোখে দুকূল ভাসানো ভালোবাসা। বয়সের ভারে চামড়া ভেতরে আশ্রয় নেওয়া চোখের নিচে বিন্দু বিন্দু পানি। এই অবস্থায় কাউকে প্রশ্ন করা সহজ নয়। তবু কীভাবে শুরু করব, ভাবতে ভাবতে বললাম, গোমেজ সাহেব কীভাবে নিখোঁজ হয়েছিলেন? প্রশ্নটা ছুড়ে দিয়েই মনে হলো, মাটিতে ঠিক কোপটি পড়েছে। রোদ পেয়ে অমনি দলে দলে বেরিয়ে আসছে পুরোনো সব স্মৃতি।
থ্যালমা বলতে শুরু করলেন। নবাবগঞ্জের হাসনাবাদ খালপাড়ের যে গ্রামে তাঁরা থাকতেন, ৪৪ বছর আগে সে গ্রাম থেকে বেরিয়েছিলেন দুরন্ত যুবক হিলি গোমেজ। পেশায় জাহাজের নাবিক। ঘুরে বেড়াতেন বন্দর থেকে বন্দরে। সাগরে বেড়ানোর নেশা তাঁকে পেয়ে বসেছিল কৈশোর থেকেই। সে কারণে শখ করে জাহাজে চাকরি নিয়েছিলেন।
স্বামী-স্ত্রী আর সন্তানদের নিয়ে তাঁদের সুখের সংসার। বড় মেয়ে শান্তির বয়স তখন ১০। দ্বিতীয় ছেলে দিলীপ ৬, আর বাদল ৪ বছর। ছোট মেয়ে করুণার জন্ম ১৯৫৬ সালের মে মাসে।
হিলি গোমেজ তখন ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান বুলার্ড কিং অ্যান্ড কোম্পানির একটি জাহাজে চাকরি করতেন। আমটাটা, আমটালি, আমব্রেলা ও আমবার্ড নামে চারটি জাহাজ ছিল এই কোম্পানির। হিলি গোমেজ জাহাজে থাকা অবস্থায় জানতে পারেন করুণার জন্মের খবর। খবর শুনে তাকে দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন বাবা। কোম্পানির জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে এলে ক্যাপ্টেনকে না বলেই সোজা হাসনাবাদের বাড়িতে চলে আসেন তিনি।
১৯৫৬ সালের ১৬ জুন রাতে স্টিমারযোগে মইনট ঘাট (বর্তমানে বিলুপ্ত) হয়ে বাড়িতে আসেন হিলি গোমেজ। বাড়িতে এসে মেয়েকে একনজর দেখে সে রাতেই আবার চলে যান। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে তাঁদের জাহাজ যায় করাচি বন্দরে, সেখান থেকে জাপানে। জাপানের কোনো এক বন্দর থেকে জাহাজটি ছাড়ার ৮ দিন পর সেটি নিখোঁজ হয়।
থ্যালমা সেই ঘটনা জানতে পারেন দেড় মাস পর। জাহাজ কর্তৃপক্ষ তাঁর বাসায় চিঠি দিয়ে জানায়, বন্দর থেকে ছাড়ার পর জাহাজটি নিখোঁজ হয়। ক্রুসহ জাহাজে লোক ছিলেন ২৮৪ জন। দুর্ঘটনায় পড়ার আগে জাহাজ থেকে ‘এসওএস’ বার্তা পাওয়ার পর কাছের বন্দর থেকে উদ্ধারকারী হেলিকপ্টার পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু জাহাজের আর কোনো খোঁজ মেলেনি।
চিঠিতে কর্তৃপক্ষ আরও জানিয়েছিল, বিশাল আয়তনের এই জাহাজ ডুবতে কমপক্ষে ১২ দিন লাগার কথা। কিন্তু তারা জাহাজটির কাউকেই খুঁজে পায়নি। এই জাহাজে কাজ করতেন তাঁদের গ্রামের আরেক যুবক সনাতন। শেষ মুহূর্তে ডাক্তারি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলে তাঁকে জাহাজ থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়। তিনি ফিরে এসে জানান, জাহাজটি বন্দর ছেড়ে যাওয়ার আগমুহূর্তে ক্যাপ্টেন জাহাজ পরিদর্শনে এসে অতিরিক্ত যাত্রী ও মালামাল দেখে অসম্মতি জানান। তিনি বলেন, এ জাহাজের মালামাল না কমালে গভীর সাগরে ডুবে যেতে পারে। কিন্তু জাহাজ কর্তৃপক্ষ তাঁর কথা না শুনে নতুন ক্যাপ্টেন নিয়োগ করেন। জাহাজের প্রথম ক্যাপ্টেন সে সময় হিলিকে এ জাহাজে যেতে নিষেধ করেন, কিন্তু হিলি তাঁর কথা শোনেননি।
থ্যালমা বললেন, এ ঘটনা ১৯৫৬ সালের। এরপর দীর্ঘ সময় জাহাজ ও নাবিকদের আর কোনো খোঁজ তিনি পাননি। সর্বশেষ করাচি বন্দর থেকে হিলি তাঁকে চিঠি লিখেছিলেন। জাহাজে চাকরি করার সময় কোম্পানি প্রতি মাসে ৭০ টাকা করে তাঁদের বাড়ির ঠিকানায় পাঠাত। হিলি নিখোঁজ হওয়ার তিন মাস পর তা-ও বন্ধ হয়ে যায়।
থ্যালমা বলেন, হিলি নিখোঁজ হওয়ার পর চার সন্তান নিয়ে পানিতে পড়েন তিনি। অভাব-অনটন তখন নিত্যসঙ্গী। খরচ চালাতে না পেরে দুই সন্তান শান্তি ও দিলীপকে অনাথ আশ্রমে পাঠান। একজন মিশনারি ফাদার তাঁদের দেখাশোনা করেন। স্বামী নিখোঁজ হওয়ার পর ক্ষতিপূরণ চেয়ে তিনি কোম্পানির বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেন, কিন্তু কোম্পানি তাঁকে জানিয়ে দেয়, যুদ্ধে জাহাজ বিধ্বস্ত না হলে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিধান নেই। এভাবে দিন চলে যায়।
থ্যালমার অপেক্ষার পালা দীর্ঘ হতে হতে চার সন্তান বড় হয়। বড় ছেলে দিলীপ আমেরিকায় ভালো চাকরি করেন। বাদল চাকরি করেন ওমানের মাসকট বিমানবন্দরে। বড় মেয়ে শান্তি স্বামীর সঙ্গে মুম্বাইবাসী। সেদিনের এক মাসের কন্যা করুণাও মাঝবয়সী নারী। থ্যালমার বয়সও কম হয়নি, তিনি তখন ৭২-এ। চোখে ভালো দেখতে না পেলেও ছবিতে একপলক দেখেই স্বামীকে চিনতে পারেন।
থ্যালমার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল ২০০০ সালের ২৫ জানুয়ারি, মঙ্গলবার। সেদিন করুণা আমাকে বলেছিলেন, বাবাকে নিজের চোখে না দেখলেও তাঁর সব গল্প মুখস্থ। শুনেছেন, বাবা তাঁর বড় মেয়ে শান্তির জন্য বিভিন্ন বন্দর থেকে ডাকে কেক পাঠাতেন। সেই কেকের মধ্যে লুকানো থাকত কানের দুল বা নাকফুলের মতো উপহার। কেকটা মুখে দিলেই বেরিয়ে আসত উপহার। সেই উপহার পেয়ে আনন্দে কেঁদে ফেলতেন শান্তিদি। করুণা বারবার বললেন, আমি যেন ভালো করে একটা রিপোর্ট করি, যাতে বাবা ফিরে আসেন।
হিলি গোমেজের সেই রিপোর্ট জনকণ্ঠে ছাপা হয়েছিল ২০০০ সালের ২৬ জানুয়ারি, বুধবার। এরপর অনেক দিন আর থ্যালমা বা করুণার সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি। ভিক্টরও অন্য চাকরি নিয়ে বিদেশে চলে যান। বছর তিনেক পরে করুণাদের বাড়ির রাস্তা দিয়ে ধানমন্ডির প্রোব ম্যাগাজিনে যাচ্ছিলাম। কী মনে হলো, করুণাদের ফ্ল্যাটে কলবেল বাজালাম। দরজা খুললেন অন্য এক নারী। জিজ্ঞেস করতেই বললেন, করুণারা নেই, তাঁরা এ বাসার নতুন ভাড়াটে। করুণার মায়ের কথা শুনে বললেন, পাশের ভাড়াটেরা তাঁকে বলেছেন, নিখোঁজ স্বামীর ফিরে আসার প্রতীক্ষায় করুণার মা সারাক্ষণ বারান্দায় বসে থাকতেন, রাতেও। সহজে বিছানায় যেতেন না। একদিন ভোরবেলা তাঁকে বারান্দায় মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।
এই নারীর কথা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। অফিসে এসে পুরোনো রিপোর্টটা আবার বের করলাম। রিপোর্টে আছে, হিলির জাহাজটা দুর্ঘটনায় পড়েছিল ১৯৫৬ সালে, থ্যালমা আমাকে সেটাই বলেছিলেন। ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখলাম, বুলার্ড কিং অ্যান্ড কোম্পানি নামে ব্রিটিশ একটি প্রতিষ্ঠান আছে। সেই কোম্পানির একটি জাহাজের নামও ছিল আমটাটা (Umtata)। টর্পেডোর আঘাতে সেটা ডুবে যায় ১৯৪২ সালে, ১৯৫৬ সালে নয়। ৪২ থেকে ৫৬-তে তো অনেক ফারাক। মনে একটু খটকা লাগল।
লেখাটা শেষ করার আগে মার্কিন গল্পকার মারজরি কিনান রাউলিংসের ‘আ মাদার ইন ম্যানভিল’ গল্পটা মনে পড়ে গেল। অনাথ আশ্রমের বেড়ে ওঠা বালক জেরি সারাক্ষণ তার মায়ের কথা বলত। পাহাড়ের ওপারে মা থাকে, জন্মদিনে মা তাকে উপহার পাঠাত। কিন্তু এতিমখানায় বড় হওয়া জেরির আসলে কেউই ছিল না। মায়ের সঙ্গে তার বসবাস ছিল শুধু কল্পনাতে।
আমার মনেও ধন্দ। থ্যালমার চিঠির গল্প জেরির মতো নয় তো? সত্যিই কি এত বছর পরে হিলি সেই চিঠি লিখেছিলেন? নাকি অন্য কিছু?
আসলে মানুষের জীবনের গল্প বড় অদ্ভুত, সে গল্প হয়তো কখনো মেলে, কখনো মেলে না।
আরও পড়ুন:
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেছেন, বিভিন্ন ইস্যুর পাশাপাশি রোহিঙ্গা ইস্যুর পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গোপসাগর বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গত ৮ বছরে এই সংকট নিরসনে বড় প্রতিবেশীর কাছ থেকে সহযোগিতা, প্রত্যাশার চেয়ে কম। শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনেরও বঙ্গোপসাগর ঘিরে আলাদা আলাদা
৬ মিনিট আগেবিশ্বের ক্যাথলিক খ্রিষ্টান ধর্মের সর্বোচ্চ নেতা পোপ ফ্রান্সিস ও বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের নামে যৌথভাবে একটি উদ্যোগ শুরু করেছে ভ্যাটিকান। বিশ্ব মানবতার জন্য একটি রূপান্তরমূলক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ভবিষ্যৎ গঠনের লক্ষ্যে ‘পোপ ফ্রান্সিস থ্রি জিরোস ক্লাব’—নামের উদ্যোগটি চালু
৪ ঘণ্টা আগেভারতীয় সংবাদ সংস্থা এএনআইকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেছেন, ‘ইসকনের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো কর্মসূচি দেয়নি হেফাজতে ইসলাম বরং মুসলিমদের উত্তেজিত হওয়া থেকে বিরত রাখতে এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হেফাজত দায়িত্ব নিয়েছে
৫ ঘণ্টা আগেসাবেক প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করীম আর নেই। আজ শনিবার ভোর পৌনে ৫টার দিকে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্নাইলাইহি রাজিউন।
৬ ঘণ্টা আগে