বন্ধুর পাশে বন্ধু, সংকটে উত্তরণ

মিনহাজ তুহিন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
প্রকাশ : ০৮ জানুয়ারি ২০২৩, ১০: ৩০
আপডেট : ০৯ জানুয়ারি ২০২৩, ১৬: ৪৭

‘একটাই কথা আছে বাংলাতে/ বুক আর মুখ বলে এক সাথে/ সে হলো বন্ধু...’ 

নব্বইয়ের দশকের বিখ্যাত এই গানটি মনে পড়বে আপনার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলে। এখানে গেলেই শুনবেন, বন্ধুরা আছে বন্ধুদের পাশে। কোন বিভাগ, কোন সেশন সে প্রশ্ন কেউ করবে না কাউকে। ‘কেউ একজন বিপদে পড়েছে’ এ তথ্যটুকুই যথেষ্ট। বাকিটা হয়ে যাবে!

ক্ষুধার জ্বালায় পেট চোঁ-চোঁ করছে অথচ পকেটে টাকা নেই! কারও কাছে টাকা ধার নেওয়া বা বাকিতে খাবার নেবেন সে উপায়ও নেই। এমন পরিস্থিতিতে আপনার উপোষ থাকারই কথা। কিন্তু আপনি যদি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বা ছাত্রী হয়ে থাকেন, তবে আপনাকে আর উপোষ থাকতে হবে না। নির্দিষ্ট একটি খাতায় নাম, ঠিকানা লিখেই আপনি পেট ভরে খেতে পারবেন সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে। যত দিন আপনার কাছে টাকা থাকবে না, তত দিনই আপনি নাম লিখে খেতে পারবেন!

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ক্ষুধা নিবারণে তিন শিক্ষার্থী এমনই একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। আর্থিক সংকটের কারণে যাঁরা অনাহারে বা অর্ধাহারে 
থাকেন, তাঁদের জন্যই এই প্রকল্প। এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘উত্তরণ’। মূলত বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের আর্থিক সমস্যার সমাধান করাই এ প্রকল্পের 
মূল উদ্দেশ্য।

উত্তরণ নামের এ প্রকল্পের তিন উদ্যোক্তা হলেন যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের দুই শিক্ষার্থী নুর নবী রবিন ও জাহিদ হাসান এবং ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের মাহমুদুল হাসান মারুফ।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেদের দুটি হলে আছে উত্তরণ প্রকল্পের রেজিস্টার খাতা। যাত্রা শুরু যেভাবে
অভিনব এই উদ্যোগ কীভাবে নেওয়া হলো তা শোনা যাক প্রধান উদ্যোক্তা নুর নবী রবিনের মুখেই। রবিন জানান, করোনা-পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পর অনেক শিক্ষার্থী আর্থিক সমস্যায় ভুগছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক বিভিন্ন ফেসবুক পেজে কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান খাবারের সমস্যার কথা। আবার মাস শেষে হলগুলোতে দেখা যায় কিছু শিক্ষার্থী থাকেন অর্ধাহারে, কেউবা শুধু ডাল-ভাত খেয়ে দিন পার করে দেন। একই সমস্যা দেখা যায় ছাত্রীদের হলেও।

এই সমস্যাগুলো নজরে এলে উদ্যোক্তারা বিষয়টি মন থেকে মেনে নিতে পারেননি। তাই গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে রবিন ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়ে জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ খাবারের সংকটে থাকলে যেন তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সেই পোস্ট দেখে তাঁকে সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসেন জাহিদ ও মারুফ। একই সময় এগিয়ে আসেন যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রেজাউল করিম। ধীরে ধীরে এই প্রকল্পে যুক্ত হন বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও কয়েকজন শিক্ষক ও শিক্ষার্থী। খাবারের সংকট থেকে উত্তরণের এই প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক নাম দেওয়া হয় উত্তরণ।
 
সুবিধা পাওয়া যায় যেভাবে
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেদের দুটি এবং মেয়েদের দুটি মোট চারটি হলের ডাইনিং রুমে উত্তরণ প্রকল্পের রেজিস্টার খাতা রাখা আছে। হলগুলো যথাক্রমে সোহরাওয়ার্দী ও আলাওল এবং প্রীতিলতা ও খালেদা জিয়া হল। এ খাতায় নাম, ঠিকানা লিখে ও স্বাক্ষর করে ডাইনিং থেকে খাবার খেতে পারবেন যেকোনো শিক্ষার্থী। মাস শেষে উত্তরণের পক্ষ থেকে ডাইনিং পরিচালককে টাকা পরিশোধ করা হয়। এই প্রকল্পের সুবিধাভোগীদের নাম-ঠিকানা গোপন রাখা হয়।

অর্থের জোগান হয় যেভাবেপ্রকল্পের শুরুর দিকে তিন উদ্যোক্তা নিজেদের পকেট থেকে খাবারের টাকা পরিশোধ করতেন। পরে সাধারণ শিক্ষার্থী 
ও শিক্ষকেরা এগিয়ে আসেন। তাঁদের মধ্যে একজন শিক্ষক নিজেই দুটি হলের টাকা পরিশোধ করেন। শিক্ষকদের মধ্যে ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক এস এম মনিরুল হাসান, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেকান্দর চৌধুরী, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রেজাউল করিম, মাধব দীপ, খালেদা জিয়া হলের প্রভোস্ট ড. সাঈদুল ইসলাম, প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিভাগের অধ্যাপক ড. আতিয়ার রহমান, ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. শওকত আরা বেগম, প্রীতিলতা হলের ভারপ্রাপ্ত প্রভোস্ট শায়লা বিনতে হোসাইন এই প্রকল্পে আর্থিক অনুদান দিচ্ছেন।

অন্যান্য কার্যক্রম
শুধু যে খাবারদাবারেই সহায়তা করে উত্তরণ, বিষয়টি তেমন নয়। আরও কিছু কার্যক্রম আছে সংগঠনটির। খাবারের সমস্যার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের অন্যান্য সমস্যা নিরসনেও কাজ করে ‘সংকটে উত্তরণ’ স্লোগানে গড়ে ওঠা এই প্রকল্প। আর্থিক সংকটে থাকায় যাঁরা শীতের কম্বল কিনতে পারছেন না, তাঁদের দেওয়া হচ্ছে কম্বল। এখন পর্যন্ত ৪০ জন শিক্ষার্থীকে কম্বল দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ভর্তি ফি, পরীক্ষার ফি, গাড়িভাড়াসহ যেকোনো সমস্যায় এই প্রকল্প থেকে শিক্ষার্থীদের সাহায্য করা হচ্ছে।

স্বাগত জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষার্থীদের এগিয়ে আসাকে স্বাগত জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও। বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর ড. রবিউল হাসান ভূঁইয়া বলেন, ‘এটা প্রশংসনীয় উদ্যোগ। আমরা এ ধরনের উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। না খেয়ে পড়া যায় না, ঘুমানোও যায় না। এই উদ্যোগের ফলে শিক্ষার্থীদের অন্তত আর না খেয়ে থাকতে হবে না।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত