মহিউদ্দিন খান মোহন
‘আচ্ছা ভাই, আজ যদি বিএনপি ক্ষমতায় থেকে এমন একটি নির্বাচন করত, আর টিআইবি তা নিয়ে এমন মন্তব্য করত, তাহলে আওয়ামী লীগ-বিএনপি নেতাদের বক্তব্য কেমন হতো?’ পরিচিত একজন জিজ্ঞেস করলেন। বললাম, ‘বিএনপির কথাগুলো আওয়ামী লীগের মুখে, আর আওয়ামী লীগের কথাগুলো বিএনপির মুখে বসিয়ে দিন, তাহলেই বুঝতে পারবেন।’ ভদ্রলোক মাথা নেড়ে সাড়া দিলেন। বাস্তবিক আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিই যেন হয়ে গেছে—‘পক্ষে গেলে দোস্ত, নয়তো দুশমন’, তা সে জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক যেকোনো বিষয়ই হোক।
সদ্য সমাপ্ত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে নিজেদের পর্যবেক্ষণের কথা জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। ১৭ জানুয়ারি সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এক সংবাদ সম্মেলনে ওই পর্যবেক্ষণ-প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেছেন। টিআইবি বলেছে, নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে দুই দলের বিপরীতমুখী ও অনড় অবস্থানের কারণে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও অবাধ হয়নি।
এই বিপরীতমুখী ও অনড় অবস্থানকেন্দ্রিক অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নের লড়াইয়ে দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের জিম্মিদশা প্রকটতর হয়েছে।সংস্থাটি বলেছে, সরকার দলের প্রার্থীদের সঙ্গে একই দলের স্বতন্ত্র ও অন্য দলের সরকার-সমর্থিত প্রার্থীদের এই পাতানো খেলায় আচরণবিধি লঙ্ঘন, সহিংস প্রতিযোগিতা হয়েছে। এ ছাড়া নির্বাচনে সংঘটিত বিভিন্ন অনিয়ম-অসংগতির তথ্যও তুলে ধরা হয়েছে।
টিআইবির পর্যবেক্ষণ রিপোর্ট প্রকাশের পরদিন এ-সম্পর্কে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি টিআইবিকে বিএনপির দালাল আখ্যায়িত করে বলেছেন, ‘তাদের বক্তব্য একপেশে। একটা পক্ষের ওকালতি করে সরকারের বিরুদ্ধে তারা যা খুশি বলে। এককথায় সরকারবিরোধী।’
অপরদিকে টিআইবির রিপোর্টকে জনমতের প্রতিফলন বলে মনে করে বিএনপি। ১৯ জানুয়ারি স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেছেন, ‘সবাই তো বলেছে যে নির্বাচন সুষ্ঠু হয় নাই। কাজেই টিআইবি যা বলেছে, এটা জনমতের প্রতিফলন। আমরা (বিএনপি) যা বলেছি, সেটাও জনমতের প্রতিফলন। ফলে যদি আমাদের কথা মিলে যায়, সেটা একজন আরেকজনকে পছন্দ করার জন্য না, এটা সত্য বলার জন্য।’
(আজকের পত্রিকা, ২০ জানুয়ারি) যেকোনো বিষয়ে আওয়ামী লীগ-বিএনপির অবস্থান-প্রতিক্রিয়া পপগুরু আযম খানের গান ‘আলাল যদি ডাইনে যায়, দুলাল যায় বাঁয়ের’ কথা মনে করিয়ে দেয়। এই দুই দল কোনো বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করবে—এটা আশা করাও দুরাশা।
টিআইবি একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার বাংলাদেশ চ্যাপটার। তারা তাদের নীতিমালা অনুসারে বিভিন্ন সময়ে জাতীয় বিভিন্ন ইস্যু সম্পর্কে অভিমত বা পর্যবেক্ষণ রিপোর্ট দিয়ে থাকে। সরকার কিংবা কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের পক্ষাবলম্বন, দালালি কিংবা তল্পীবহনের আবশ্যকতা তাদের আছে বলে মনে হয় না। সমস্যা হলো, শুধু টিআইবি নয়, যেকোনো দেশীয় কিংবা আন্তর্জাতিক সংস্থার রিপোর্ট যখন যে দলের বিরুদ্ধে যায়, তখন তারা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। মনে পড়ে, বিএনপির ২০০১-২০০৬ শাসনামলের কথা। এই টিআইবি তখন দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশ শীর্ষে বলে পর্যবেক্ষণ দিয়েছিল।
সে সময়ের বিরোধী দল ও আজকের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সেটা সমর্থন করেছিল। এখনো আওয়ামী লীগের নেতারা বিএনপিকে ঘায়েল করতে প্রসঙ্গক্রমে টিআইবির সেই প্রতিবেদনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে থাকেন। আর তখন ক্ষমতাসীন বিএনপি ওই সব রিপোর্টকে ‘পক্ষপাতদুষ্ট ও বস্তুনিষ্ঠ নয়’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছিল। এ যেন একই রেকর্ডের এপিঠ-ওপিঠ বাজে, শুধু কণ্ঠশিল্পীর পরিবর্তন।
একই ব্যাপার ঘটছে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনকে কোন রাষ্ট্র ‘স্বীকৃতি’ দিল বা না দিল, তা নিয়ে বিএনপি বলে চলেছে, প্রহসনের (তাদের ভাষায়) ওই ডামি নির্বাচনকে বিশ্বের কোনো দেশ স্বীকৃতি দেয়নি। এখানে বলে নেওয়া দরকার, কোনো একটি দেশের নির্বাচনকে অপর কোনো দেশের স্বীকৃতি দেওয়ার কিছু নেই, এখতিয়ারও নেই। সাধারণত বিজয়ী দলের নেতাকে অন্য দেশের সরকারপ্রধানেরা অভিনন্দন জানিয়ে থাকেন। স্বীকৃতি দরকার হয় নতুন কোনো দেশ স্বাধীন হলে। এবারে নির্বাচনের পর যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য, ভারত, চীন, রাশিয়া, ফ্রান্স, কানাডাসহ বহসংখ্যক দেশের সরকারপ্রধান বা তাঁদের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানানো হয়েছে।
এমনকি নির্বাচনের পর নতুন সরকারে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্রসহ ঢাকার সব দেশের কূটনীতিকেরা উপস্থিত ছিলেন। নির্বাচন যদি তাঁদের কাছে গ্রহণযোগ্য না-ই হয়ে থাকবে, তাহলে যে আমেরিকা এই নির্বাচন নিয়ে এত দৌড়ঝাঁপ করল, হুঁশিয়ারি দিল, সেই আমেরিকার রাষ্ট্রদূত পিটার হাস কেন ওই অনুষ্ঠানে হাজির থাকলেন? তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশের কূটনীতিক মন্ত্রীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে, তাঁদের সরকার বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী বলে জানিয়েছেন।
এটা ঠিক, যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যসহ কয়েকটি প্রভাবশালী রাষ্ট্র নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হয়নি বলে মন্তব্য করেছে। তাদের এ মন্তব্যকে বেঠিক বলা যাবে না। ৭ জানুয়ারি নির্বাচন যে ব্যাপক অর্থে অংশগ্রহণমূলক হয়নি, তা কি অস্বীকার করা যাবে? কেননা, বিএনপি কিংবা আওয়ামী লীগ এই দুই দলের যেকোনো একটিকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশে অর্থবহ নির্বাচন হতে পারে না। তাই বলে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনকে বিশ্বের কোনো দেশ কি প্রত্যাখ্যান করেছে? সবচেয়ে বড় কথা, ভোটকেন্দ্রে যাক বা না যাক, বাংলাদেশের জনগণ এ নির্বাচনকে প্রত্যাখ্যান করেছে—এ কথাও বলা যাবে না; বরং নির্বাচন-পরবর্তী তাদের নীরবতাকে ‘মৌনতা সম্মতির লক্ষণ’ বলেই ধরে নেওয়া যায়।
এদিকে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস অভিনন্দন জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। নিজের স্বাক্ষরিত বার্তায় তিনি বাংলাদেশের মানুষের কল্যাণে শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গে কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছেন। কমনওয়েলথ মহাসচিব প্যাট্রিসিয়া স্কটল্যান্ডও এক বার্তায় এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের ঢাকার রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সংস্থাটির পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস ১৭ জানুয়ারি নবনিযুক্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আগামী দিনে পারস্পরিক স্বার্থকে এগিয়ে নিতে বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে যুক্তরাষ্ট্র উন্মুখ বলে জানিয়েছেন।
কোনো একটি দেশে নতুন নির্বাচন এবং সরকার গঠিত হলে বিশ্ব নেতাদের এ ধরনের অভিনন্দন জানানো একটি প্রথাগত রীতি ও রাষ্ট্রাচারের অংশ। দুঃখজনক হলো, এই ট্র্যাডিশনাল বিষয়টি নিয়ে আমাদের দেশে চলছে কাদা ছোড়াছুড়ি। ২২ জানুয়ারি আজকের পত্রিকার শেষ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত দুটি সংবাদ অনেকেরই মনোযোগ আকর্ষণ করে থাকবে।
একটি খবরের শিরোনাম, ‘কারও অভিনন্দনের জন্য চাতক পাখির মতো তাকিয়ে নেই,’ বললেন ওবায়দুল কাদের। অপরটির শিরোনাম, ‘সমর্থন জোগাড়ে দেশে দেশে ধরনা দিচ্ছে সরকার’, রিজভীর মন্তব্য। সংবাদ দুটির বিষয়বস্তু ব্যাখ্যা করার দরকার আছে বলে মনে হয় না। শুধু বলা দরকার মনে করছি, কত তুচ্ছ বিষয় নিয়ে আমাদের নেতারা বাহাসে লিপ্ত হতে পারেন! প্রশ্ন হলো, বিদেশিদের অভিনন্দন কেন এত জরুরি মনে হচ্ছে?
একটি দেশের নির্বাচনকে সে দেশের জনগণ স্বীকৃতি দিল কি না, সেটা হলো বিবেচ্য। বিদেশিদের স্বীকৃতি-অভিনন্দন এ ক্ষেত্রে জরুরি নয়, সৌজন্যের বিষয় মাত্র। এটা নিয়ে অতি আনন্দিত কিংবা উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। দেশবাসী গ্রহণ না করলে গোটা বিশ্বের সব রাষ্ট্র অভিনন্দন জানালেও যেমন লাভ নেই, তেমনি জনসাধারণ একটি নির্বাচনকে মেনে নিলে বিশ্ব মোড়লেরা কে কী বলল, তাতে কিছু আসে-যায় না।
কিন্তু আমাদের রাজনীতিকেরা বিদেশিদের সার্টিফিকেটকে অতীব মূল্যবান মনে করেন। যেন তাঁদের প্রদত্ত সনদই রক্ষাকবচ। আর তা নিয়ে তাঁরা শুরু করেন বাগ্যুদ্ধ। এটা যে জাতি হিসেবে আমাদের কতটা হেয়প্রতিপন্ন করে, সেটা তাঁরা বুঝতেই চান না।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজননীতি বিশ্লেষক
‘আচ্ছা ভাই, আজ যদি বিএনপি ক্ষমতায় থেকে এমন একটি নির্বাচন করত, আর টিআইবি তা নিয়ে এমন মন্তব্য করত, তাহলে আওয়ামী লীগ-বিএনপি নেতাদের বক্তব্য কেমন হতো?’ পরিচিত একজন জিজ্ঞেস করলেন। বললাম, ‘বিএনপির কথাগুলো আওয়ামী লীগের মুখে, আর আওয়ামী লীগের কথাগুলো বিএনপির মুখে বসিয়ে দিন, তাহলেই বুঝতে পারবেন।’ ভদ্রলোক মাথা নেড়ে সাড়া দিলেন। বাস্তবিক আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিই যেন হয়ে গেছে—‘পক্ষে গেলে দোস্ত, নয়তো দুশমন’, তা সে জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক যেকোনো বিষয়ই হোক।
সদ্য সমাপ্ত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে নিজেদের পর্যবেক্ষণের কথা জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। ১৭ জানুয়ারি সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এক সংবাদ সম্মেলনে ওই পর্যবেক্ষণ-প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেছেন। টিআইবি বলেছে, নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে দুই দলের বিপরীতমুখী ও অনড় অবস্থানের কারণে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও অবাধ হয়নি।
এই বিপরীতমুখী ও অনড় অবস্থানকেন্দ্রিক অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নের লড়াইয়ে দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের জিম্মিদশা প্রকটতর হয়েছে।সংস্থাটি বলেছে, সরকার দলের প্রার্থীদের সঙ্গে একই দলের স্বতন্ত্র ও অন্য দলের সরকার-সমর্থিত প্রার্থীদের এই পাতানো খেলায় আচরণবিধি লঙ্ঘন, সহিংস প্রতিযোগিতা হয়েছে। এ ছাড়া নির্বাচনে সংঘটিত বিভিন্ন অনিয়ম-অসংগতির তথ্যও তুলে ধরা হয়েছে।
টিআইবির পর্যবেক্ষণ রিপোর্ট প্রকাশের পরদিন এ-সম্পর্কে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি টিআইবিকে বিএনপির দালাল আখ্যায়িত করে বলেছেন, ‘তাদের বক্তব্য একপেশে। একটা পক্ষের ওকালতি করে সরকারের বিরুদ্ধে তারা যা খুশি বলে। এককথায় সরকারবিরোধী।’
অপরদিকে টিআইবির রিপোর্টকে জনমতের প্রতিফলন বলে মনে করে বিএনপি। ১৯ জানুয়ারি স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেছেন, ‘সবাই তো বলেছে যে নির্বাচন সুষ্ঠু হয় নাই। কাজেই টিআইবি যা বলেছে, এটা জনমতের প্রতিফলন। আমরা (বিএনপি) যা বলেছি, সেটাও জনমতের প্রতিফলন। ফলে যদি আমাদের কথা মিলে যায়, সেটা একজন আরেকজনকে পছন্দ করার জন্য না, এটা সত্য বলার জন্য।’
(আজকের পত্রিকা, ২০ জানুয়ারি) যেকোনো বিষয়ে আওয়ামী লীগ-বিএনপির অবস্থান-প্রতিক্রিয়া পপগুরু আযম খানের গান ‘আলাল যদি ডাইনে যায়, দুলাল যায় বাঁয়ের’ কথা মনে করিয়ে দেয়। এই দুই দল কোনো বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করবে—এটা আশা করাও দুরাশা।
টিআইবি একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার বাংলাদেশ চ্যাপটার। তারা তাদের নীতিমালা অনুসারে বিভিন্ন সময়ে জাতীয় বিভিন্ন ইস্যু সম্পর্কে অভিমত বা পর্যবেক্ষণ রিপোর্ট দিয়ে থাকে। সরকার কিংবা কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের পক্ষাবলম্বন, দালালি কিংবা তল্পীবহনের আবশ্যকতা তাদের আছে বলে মনে হয় না। সমস্যা হলো, শুধু টিআইবি নয়, যেকোনো দেশীয় কিংবা আন্তর্জাতিক সংস্থার রিপোর্ট যখন যে দলের বিরুদ্ধে যায়, তখন তারা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। মনে পড়ে, বিএনপির ২০০১-২০০৬ শাসনামলের কথা। এই টিআইবি তখন দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশ শীর্ষে বলে পর্যবেক্ষণ দিয়েছিল।
সে সময়ের বিরোধী দল ও আজকের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সেটা সমর্থন করেছিল। এখনো আওয়ামী লীগের নেতারা বিএনপিকে ঘায়েল করতে প্রসঙ্গক্রমে টিআইবির সেই প্রতিবেদনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে থাকেন। আর তখন ক্ষমতাসীন বিএনপি ওই সব রিপোর্টকে ‘পক্ষপাতদুষ্ট ও বস্তুনিষ্ঠ নয়’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছিল। এ যেন একই রেকর্ডের এপিঠ-ওপিঠ বাজে, শুধু কণ্ঠশিল্পীর পরিবর্তন।
একই ব্যাপার ঘটছে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনকে কোন রাষ্ট্র ‘স্বীকৃতি’ দিল বা না দিল, তা নিয়ে বিএনপি বলে চলেছে, প্রহসনের (তাদের ভাষায়) ওই ডামি নির্বাচনকে বিশ্বের কোনো দেশ স্বীকৃতি দেয়নি। এখানে বলে নেওয়া দরকার, কোনো একটি দেশের নির্বাচনকে অপর কোনো দেশের স্বীকৃতি দেওয়ার কিছু নেই, এখতিয়ারও নেই। সাধারণত বিজয়ী দলের নেতাকে অন্য দেশের সরকারপ্রধানেরা অভিনন্দন জানিয়ে থাকেন। স্বীকৃতি দরকার হয় নতুন কোনো দেশ স্বাধীন হলে। এবারে নির্বাচনের পর যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য, ভারত, চীন, রাশিয়া, ফ্রান্স, কানাডাসহ বহসংখ্যক দেশের সরকারপ্রধান বা তাঁদের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানানো হয়েছে।
এমনকি নির্বাচনের পর নতুন সরকারে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্রসহ ঢাকার সব দেশের কূটনীতিকেরা উপস্থিত ছিলেন। নির্বাচন যদি তাঁদের কাছে গ্রহণযোগ্য না-ই হয়ে থাকবে, তাহলে যে আমেরিকা এই নির্বাচন নিয়ে এত দৌড়ঝাঁপ করল, হুঁশিয়ারি দিল, সেই আমেরিকার রাষ্ট্রদূত পিটার হাস কেন ওই অনুষ্ঠানে হাজির থাকলেন? তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশের কূটনীতিক মন্ত্রীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে, তাঁদের সরকার বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী বলে জানিয়েছেন।
এটা ঠিক, যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যসহ কয়েকটি প্রভাবশালী রাষ্ট্র নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হয়নি বলে মন্তব্য করেছে। তাদের এ মন্তব্যকে বেঠিক বলা যাবে না। ৭ জানুয়ারি নির্বাচন যে ব্যাপক অর্থে অংশগ্রহণমূলক হয়নি, তা কি অস্বীকার করা যাবে? কেননা, বিএনপি কিংবা আওয়ামী লীগ এই দুই দলের যেকোনো একটিকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশে অর্থবহ নির্বাচন হতে পারে না। তাই বলে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনকে বিশ্বের কোনো দেশ কি প্রত্যাখ্যান করেছে? সবচেয়ে বড় কথা, ভোটকেন্দ্রে যাক বা না যাক, বাংলাদেশের জনগণ এ নির্বাচনকে প্রত্যাখ্যান করেছে—এ কথাও বলা যাবে না; বরং নির্বাচন-পরবর্তী তাদের নীরবতাকে ‘মৌনতা সম্মতির লক্ষণ’ বলেই ধরে নেওয়া যায়।
এদিকে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস অভিনন্দন জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। নিজের স্বাক্ষরিত বার্তায় তিনি বাংলাদেশের মানুষের কল্যাণে শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গে কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছেন। কমনওয়েলথ মহাসচিব প্যাট্রিসিয়া স্কটল্যান্ডও এক বার্তায় এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের ঢাকার রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সংস্থাটির পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস ১৭ জানুয়ারি নবনিযুক্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আগামী দিনে পারস্পরিক স্বার্থকে এগিয়ে নিতে বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে যুক্তরাষ্ট্র উন্মুখ বলে জানিয়েছেন।
কোনো একটি দেশে নতুন নির্বাচন এবং সরকার গঠিত হলে বিশ্ব নেতাদের এ ধরনের অভিনন্দন জানানো একটি প্রথাগত রীতি ও রাষ্ট্রাচারের অংশ। দুঃখজনক হলো, এই ট্র্যাডিশনাল বিষয়টি নিয়ে আমাদের দেশে চলছে কাদা ছোড়াছুড়ি। ২২ জানুয়ারি আজকের পত্রিকার শেষ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত দুটি সংবাদ অনেকেরই মনোযোগ আকর্ষণ করে থাকবে।
একটি খবরের শিরোনাম, ‘কারও অভিনন্দনের জন্য চাতক পাখির মতো তাকিয়ে নেই,’ বললেন ওবায়দুল কাদের। অপরটির শিরোনাম, ‘সমর্থন জোগাড়ে দেশে দেশে ধরনা দিচ্ছে সরকার’, রিজভীর মন্তব্য। সংবাদ দুটির বিষয়বস্তু ব্যাখ্যা করার দরকার আছে বলে মনে হয় না। শুধু বলা দরকার মনে করছি, কত তুচ্ছ বিষয় নিয়ে আমাদের নেতারা বাহাসে লিপ্ত হতে পারেন! প্রশ্ন হলো, বিদেশিদের অভিনন্দন কেন এত জরুরি মনে হচ্ছে?
একটি দেশের নির্বাচনকে সে দেশের জনগণ স্বীকৃতি দিল কি না, সেটা হলো বিবেচ্য। বিদেশিদের স্বীকৃতি-অভিনন্দন এ ক্ষেত্রে জরুরি নয়, সৌজন্যের বিষয় মাত্র। এটা নিয়ে অতি আনন্দিত কিংবা উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। দেশবাসী গ্রহণ না করলে গোটা বিশ্বের সব রাষ্ট্র অভিনন্দন জানালেও যেমন লাভ নেই, তেমনি জনসাধারণ একটি নির্বাচনকে মেনে নিলে বিশ্ব মোড়লেরা কে কী বলল, তাতে কিছু আসে-যায় না।
কিন্তু আমাদের রাজনীতিকেরা বিদেশিদের সার্টিফিকেটকে অতীব মূল্যবান মনে করেন। যেন তাঁদের প্রদত্ত সনদই রক্ষাকবচ। আর তা নিয়ে তাঁরা শুরু করেন বাগ্যুদ্ধ। এটা যে জাতি হিসেবে আমাদের কতটা হেয়প্রতিপন্ন করে, সেটা তাঁরা বুঝতেই চান না।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজননীতি বিশ্লেষক
প্রবৃদ্ধির শীর্ষে থেকেও বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের দৌড়ে পিছিয়ে রয়েছে। ২০১৪ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি ৫০ দশমিক ৭৯ শতাংশ বেড়েছে
১ দিন আগেদুর্নীতি, মূল্যস্ফীতি, উচ্চ করহারসহ ১৭ ধরনের বাধায় বিপর্যস্ত দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য। রয়েছে সামাজিক সমস্যাও।
১ দিন আগেজমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
৫ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৯ দিন আগে