চিররঞ্জন সরকার
‘সেলফি’—যার অর্থ নিজেই নিজের ছবি তোলা। নানা অঙ্গ-ভঙ্গিমায় নিজের ছবি তুলে মুহূর্তেই তা দেখতে পারার স্বাধীনতা এনে দিয়েছে সেলফি। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোর বদৌলতে সেলফি শব্দ ও সংস্কৃতি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। হাটে, মাঠে, ঘাটে, পথে-প্রান্তরে—সর্বত্রই আজ ‘সেলফি’র জয়জয়কার। দুঃখ, শোকে ম্রিয়মাণ মানুষও কান্নার মাঝে চট করে ধরে রাখছে তার ওই মুহূর্তের স্মৃতি।আর আনন্দের সময় ‘সেলফি’ তো এক অনিবার্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
এ কথা তো অস্বীকার করা যাবে না যে মানুষ নিজেকে দেখতে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। তাই হয়তো আয়না, কিংবা ক্যামেরার প্রতি আকর্ষণ কখনোই গোপন করতে পারে না। নিজের খুঁটিনাটি বিষয় কিংবা ভঙ্গিমা দেখতে সবার আড়ালে হলেও দাঁড়িয়ে যাই আয়না বা ক্যামেরার সামনে। তবু খুঁতখুঁতানির শেষ নেই। অন্যের সামনে নানা অঙ্গ-ভঙ্গিমায় দাঁড়াতে দ্বিধা কাজ করে অনেকের। এই সমস্যার সমাধান করল একটি নতুন প্রযুক্তি, একটি নতুন শব্দ ‘সেলফি’!
এই অভিনব পদ্ধতি নিজের ছবি তোলার ক্ষেত্রে মানুষকে স্বাবলম্বী করেছে। এটা এক অর্থে বেশ ভালো এবং আনন্দের কথা। ব্যস্ত দুনিয়ায় পরনির্ভরশীলতা যত কম হয়, ততই মঙ্গলজনক। কিন্তু সবকিছুতে স্বনির্ভরতা মানুষকে ক্রমে বিচ্ছিন্ন ও একা করে তোলে—এ কথাও সত্যি। বিচ্ছিন্নতা মানুষকে করে তোলে স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক। যূথবদ্ধ হয়ে কাজ করার মানসিকতা অনেক ক্ষেত্রেই নষ্ট করে দেয় এ ধরনের আত্মকেন্দ্রিকতা। বর্তমান বিশ্বের ‘বাজ ওয়ার্ড’ সেলফি ‘সেলফিশ’, অর্থাৎ স্বার্থপরের ইংরেজি শব্দের সঙ্গে কোথায় যেন মিলে যায়!
এই আত্মকেন্দ্রিকতা মানুষকে তার পারিপার্শ্বিক জগৎ থেকে আলাদা করে দেয়। প্রতিটি মানুষের চিন্তা-চেতনায় তীব্রভাবে ফুটে ওঠে শুধু ব্যক্তি ‘আমি’র প্রতি আকাঙ্ক্ষা। এই আকাঙ্ক্ষার জগতে সামগ্রিক বা সামষ্টিকতার যেন কোনো ঠাঁই নেই।
নিজেকে নিয়ে, নিজেকে দিয়ে, নিজেকে দেখার ও দেখানোর এই আবিশ্ব প্রবণতা উসকে দিয়েছে মোবাইল ফোনের সেলফি ক্যামেরা। এই দৃশ্যকেন্দ্রিকতা ইন্টারনেট-নির্ভর, যার দ্বারা নিমেষে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে দৃশ্য-তথ্য বণ্টন সম্ভব। তাই আমরা স্বেচ্ছায় আমাদের প্রতিনিধিত্বের দায়ভার সঁপেছি সেলফিতে, প্রযুক্তি আমাদের অংশবিশেষ নিয়ে অনায়াসে পাড়ি দিচ্ছে অন্যের ফোনের-পর্দায়।
আমাদের অস্তিত্ব হয়ে উঠেছে অস্থির, মুহূর্তগামী, সদা মন্তব্যপিপাসু। এই অস্থিরতা বাধ্য করে আমাদের চালচলন, পাশের মানুষজন ও পটভূমি পাল্টে-পাল্টে নিজেকে সচেতনভাবে সাজাতে। গোটা পরিকল্পনাই নিজের দ্বারা, যদিও অধিকাংশ সময় তা অপরমুখী। সে কারণেই মুহূর্তে তার বিতরণ না হলে সব প্রয়াসই বৃথা।
নিজস্বী-স্পৃহায় উৎসাহ দিতে বাজারে আসছে নিত্যনতুন ‘সেলফি-এক্সপার্ট’ ক্যামেরা। উন্নততর মেগাপিক্সেল-মহিমায় উদ্ভাসিত হচ্ছে নিজ-দৃশ্য-আরতি, পরবর্তী সেলফির তরঙ্গে বিলীন হচ্ছে খানিক আগে তোলা নিজের ছবিটি। এই অস্থায়িত্বই সেলফির স্বভাব।
সাময়িকতার দৈনন্দিন উৎসবে আমরা এতই মগ্ন যে নিজের কোনো ছবিই আলাদা করে দাগ কাটে না, দীর্ঘমেয়াদি হয় না। স্থিরচিত্রের নান্দনিক দর্শনে স্থান-কালের স্থিতির যে অনড়-ভাবনা ছিল, ডিজিটাল অঢেলপনা সেই স্থায়িত্বকে বাতিল করেছে। সেলফির আধিক্যের সামনে অ্যালবামে সুরক্ষিত গুটিকয় ছবি এখন মূল্যবান হলেও ‘অচল’। অফুরন্ত, ওজনহীন ডিজিটাল সঞ্চয়-ভান্ডারের সামনে অ্যালবাম কোথায়! নিমেষে ও নির্বিঘ্নে কমকে বেশিতে, এক-কে একাধিকে পরিণত করাই উত্তরাধুনিক প্রযুক্তির দর্শন। পারদর্শিতাও।
এই স্ব-মুদ্রণের মাধ্যমে জ্ঞানত বা অজান্তে আমরা হয়ে উঠেছি একাধারে দৃশ্য এবং দর্শক। সেলফি-দর্শনের ধারক-বাহক-প্রচারকও আমরাই। আমরাই অংশগ্রহণকারী, আমরাই মূল্যায়নকারী। সেলফিগ্রস্ত এই সভ্যতা নিজেকে দৃশ্য-পণ্যে পরিণত করে ও তাকে বিতরণ করে অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সদা উন্মুখ। সেলফি-ক্যামেরাটি এখন এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠছে, প্রতিটি সেলফিই জরুরি এক ‘স্ট্যাটাস আপডেট’। ছবি তুলে বা তোলার মুহূর্তেই না জানালে যেন জীবন বৃথা। প্রতিটি ব্যক্তিগত মুহূর্তই এখন প্রচারযোগ্য ও মন্তব্যকামী; নিজের অস্তিত্ব, সঙ্গ ও একাকিত্বকে সেলফির মাধ্যমে সম্প্রচার করাটা দাঁড়িয়েছে অভ্যাসে।
এমনিতেই বর্তমানে আমরা এক অনুদার সংকীর্ণ প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিমণ্ডলে বসবাস করছি। ছোট ছোট ঘর। আকাশ নেই। মাঠ নেই। খোলা জায়গা নেই। মানুষ, বাড়িঘর, আর স্থাপনায় ঠাসাঠাসি এক প্রায়ন্ধকার পরিবেশে আমরা বড় হচ্ছি। বেড়ে উঠছি। আমাদের দৃষ্টিসীমা সংকীর্ণ আর আবদ্ধ নানা স্থাপনায়। অথচ আমরা জানি, মন বড় হওয়ার জন্য বড় পরিসর চাই। উদার আকাশ, দিগন্তবিস্তৃত মাঠ। বড় বড় বাড়িঘর, উঠোন চাই। চাই বড় মানুষের সান্নিধ্য।
কিন্তু এখন সবকিছু ছোট। সারাক্ষণ মোবাইল-ট্যাব-ল্যাপটপ আর কম্পিউটারের স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকা। দৃষ্টিসীমা একটি নির্দিষ্ট বৃত্তে আবদ্ধ হওয়ায় মনের দিগন্ত কখনো বিস্তৃত হতে পারছে না। ফলে আমরা বড় বেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছি। জাতি হিসেবে আমরা রিক্ত-নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছি। শুধু নিজের সুবিধা আদায় করতে গিয়ে যদি অন্য কারও অসুবিধা হয়, আমরা তার পরোয়া করছি না।
সর্বত্র যখন সেলফির জয়জয়কার, তখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তাঁর কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের সঙ্গে একটি সেলফি তুলেছেন। এই সেলফি নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠেছে। গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট শেখ হাসিনা এবং তাঁর কন্যার সঙ্গে হাস্যোজ্জ্বল ভঙ্গিতে সেলফি তুলছেন। জো বাইডেন ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে জি২০ সম্মেলন চলাকালে এই সেলফি তোলেন। প্রধানমন্ত্রীর কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল মনের আনন্দে এ ছবি সামাজিক মাধ্যম এক্স-এ (সাবেক টুইটারে) প্রকাশ করেন। তারপর ছবিটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
ছবি নিয়ে শুরু হয় নানা ধরনের মত-মন্তব্য, ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ। সরকার-সমর্থকদের কেউ কেউ নির্বাচন সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শেখ হাসিনা সরকারের সম্পর্ক ভালো হয়ে যাওয়ার প্রমাণ হিসেবে এই সেলফিকে বর্ণনা করছেন। আবার সরকারবিরোধীদের কেউ কেউ এটাকে সংকীর্ণতা হিসেবে বিবেচনা করছেন। তাঁদের মতে, ‘সেলফি দিয়ে বিভ্রান্তির চেষ্টা হচ্ছে এবং সেলফিতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের কোনো নড়চড় হবে না।’ কয়েক মাস যাবৎ দুই দেশের সম্পর্কের টানাপোড়েনের পটভূমিতে মার্কিন প্রেসিডেন্টের হাসিমুখে শেখ হাসিনা এবং তাঁর কন্যার সঙ্গে সেলফি তোলার ঘটনাকে কার্যত ‘আগের দূরত্ব ঘুচে গেছে’ বলে প্রচারের চেষ্টা করছে আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা।
এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের এক সেলফিতে বিএনপির নেতাদের রাতের ঘুম হারাম।’ বিএনপিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘এত দিন বিএনপি আটলান্টিকের ওপারে হোয়াইট হাউসের দিকে তাকিয়ে ছিল—বাইডেন সাহেব নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আওয়ামী লীগকে হটিয়ে তাদের ক্ষমতায় বসাবে। কী দেখলেন আজকে? বাইডেন সাহেব নিজেই সেলফি তুললেন শেখ হাসিনার সঙ্গে।’
এর জবাবে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘সেলফির জন্য কিন্তু র্যাবের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা কিংবা ভিসা নীতি উঠে যায়নি। দেউলিয়া হয়ে গেছে বলেই বাইডেনের সঙ্গে সেলফি তুলে ঢোল পেটাচ্ছেন। ভোটটা ঠিকমতো না করলে কোনো সেলফিই রক্ষা করতে পারবে না।’
কেবল রাজনৈতিক দলের নেতারাই নন, সরকার এবং বিরোধী উভয় দলের কর্মী-সমর্থকেরাও বিষয়টি নিয়ে নেমে পড়েছেন ‘প্রচার যুদ্ধে’।পক্ষে-বিপক্ষে নানা বক্তব্য, আক্রমণ এবং পাল্টা আক্রমণ চলছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
কিন্তু সত্যিই কি এই সেলফি জো বাইডেনের সঙ্গে শেখ হাসিনার সব ল্যাঠা চুকেবুকে যাওয়ার বিজ্ঞাপন? না শুধুই সৌজন্য? আসলে একই অনুষ্ঠানে উপস্থিত রাষ্ট্রের দুই কর্তাব্যক্তির সেলফি খুবই সাধারণ ও মামুলি একটা ঘটনা। এর দ্বারা দুই দেশের সরকারের সম্পর্কের ভালো-মন্দ কিছুই প্রকাশ পায় না।
আমেরিকা তার নিজের স্বার্থ ও সুবিধাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েই অন্য দেশের সঙ্গে সম্পর্ক ও কূটনীতি পরিচালিত করে। রাষ্ট্রপতি কার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করলেন, কার সঙ্গে সেলফি তুললেন, সেটা মোটেও কোনো তাৎপর্য বহন করে না। রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক আলাদা জিনিস। এর পেছনে লাভ-লোকসানের হিসাব জড়িত থাকে। থাকে আরও অনেক জটিল অঙ্ক ও কৌশল। সেলফি এসব তাৎপর্য ধারণ করে না।
সেলফি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা আসলে আমাদের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বেরই বহিঃপ্রকাশ। আগামী দিনে আমরা কীভাবে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেব, কীভাবে একটি অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য সুষ্ঠু নির্বাচন করব, সেই সিদ্ধান্ত আমাদেরই নিতে হবে।অন্য কোনো রাষ্ট্রপ্রধান বা অন্য কোনো দেশের সমর্থনের ওপর নির্ভর করে কখনো স্বদেশের গণতন্ত্র মেরামত করা যায় না।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
‘সেলফি’—যার অর্থ নিজেই নিজের ছবি তোলা। নানা অঙ্গ-ভঙ্গিমায় নিজের ছবি তুলে মুহূর্তেই তা দেখতে পারার স্বাধীনতা এনে দিয়েছে সেলফি। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোর বদৌলতে সেলফি শব্দ ও সংস্কৃতি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। হাটে, মাঠে, ঘাটে, পথে-প্রান্তরে—সর্বত্রই আজ ‘সেলফি’র জয়জয়কার। দুঃখ, শোকে ম্রিয়মাণ মানুষও কান্নার মাঝে চট করে ধরে রাখছে তার ওই মুহূর্তের স্মৃতি।আর আনন্দের সময় ‘সেলফি’ তো এক অনিবার্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
এ কথা তো অস্বীকার করা যাবে না যে মানুষ নিজেকে দেখতে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। তাই হয়তো আয়না, কিংবা ক্যামেরার প্রতি আকর্ষণ কখনোই গোপন করতে পারে না। নিজের খুঁটিনাটি বিষয় কিংবা ভঙ্গিমা দেখতে সবার আড়ালে হলেও দাঁড়িয়ে যাই আয়না বা ক্যামেরার সামনে। তবু খুঁতখুঁতানির শেষ নেই। অন্যের সামনে নানা অঙ্গ-ভঙ্গিমায় দাঁড়াতে দ্বিধা কাজ করে অনেকের। এই সমস্যার সমাধান করল একটি নতুন প্রযুক্তি, একটি নতুন শব্দ ‘সেলফি’!
এই অভিনব পদ্ধতি নিজের ছবি তোলার ক্ষেত্রে মানুষকে স্বাবলম্বী করেছে। এটা এক অর্থে বেশ ভালো এবং আনন্দের কথা। ব্যস্ত দুনিয়ায় পরনির্ভরশীলতা যত কম হয়, ততই মঙ্গলজনক। কিন্তু সবকিছুতে স্বনির্ভরতা মানুষকে ক্রমে বিচ্ছিন্ন ও একা করে তোলে—এ কথাও সত্যি। বিচ্ছিন্নতা মানুষকে করে তোলে স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক। যূথবদ্ধ হয়ে কাজ করার মানসিকতা অনেক ক্ষেত্রেই নষ্ট করে দেয় এ ধরনের আত্মকেন্দ্রিকতা। বর্তমান বিশ্বের ‘বাজ ওয়ার্ড’ সেলফি ‘সেলফিশ’, অর্থাৎ স্বার্থপরের ইংরেজি শব্দের সঙ্গে কোথায় যেন মিলে যায়!
এই আত্মকেন্দ্রিকতা মানুষকে তার পারিপার্শ্বিক জগৎ থেকে আলাদা করে দেয়। প্রতিটি মানুষের চিন্তা-চেতনায় তীব্রভাবে ফুটে ওঠে শুধু ব্যক্তি ‘আমি’র প্রতি আকাঙ্ক্ষা। এই আকাঙ্ক্ষার জগতে সামগ্রিক বা সামষ্টিকতার যেন কোনো ঠাঁই নেই।
নিজেকে নিয়ে, নিজেকে দিয়ে, নিজেকে দেখার ও দেখানোর এই আবিশ্ব প্রবণতা উসকে দিয়েছে মোবাইল ফোনের সেলফি ক্যামেরা। এই দৃশ্যকেন্দ্রিকতা ইন্টারনেট-নির্ভর, যার দ্বারা নিমেষে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে দৃশ্য-তথ্য বণ্টন সম্ভব। তাই আমরা স্বেচ্ছায় আমাদের প্রতিনিধিত্বের দায়ভার সঁপেছি সেলফিতে, প্রযুক্তি আমাদের অংশবিশেষ নিয়ে অনায়াসে পাড়ি দিচ্ছে অন্যের ফোনের-পর্দায়।
আমাদের অস্তিত্ব হয়ে উঠেছে অস্থির, মুহূর্তগামী, সদা মন্তব্যপিপাসু। এই অস্থিরতা বাধ্য করে আমাদের চালচলন, পাশের মানুষজন ও পটভূমি পাল্টে-পাল্টে নিজেকে সচেতনভাবে সাজাতে। গোটা পরিকল্পনাই নিজের দ্বারা, যদিও অধিকাংশ সময় তা অপরমুখী। সে কারণেই মুহূর্তে তার বিতরণ না হলে সব প্রয়াসই বৃথা।
নিজস্বী-স্পৃহায় উৎসাহ দিতে বাজারে আসছে নিত্যনতুন ‘সেলফি-এক্সপার্ট’ ক্যামেরা। উন্নততর মেগাপিক্সেল-মহিমায় উদ্ভাসিত হচ্ছে নিজ-দৃশ্য-আরতি, পরবর্তী সেলফির তরঙ্গে বিলীন হচ্ছে খানিক আগে তোলা নিজের ছবিটি। এই অস্থায়িত্বই সেলফির স্বভাব।
সাময়িকতার দৈনন্দিন উৎসবে আমরা এতই মগ্ন যে নিজের কোনো ছবিই আলাদা করে দাগ কাটে না, দীর্ঘমেয়াদি হয় না। স্থিরচিত্রের নান্দনিক দর্শনে স্থান-কালের স্থিতির যে অনড়-ভাবনা ছিল, ডিজিটাল অঢেলপনা সেই স্থায়িত্বকে বাতিল করেছে। সেলফির আধিক্যের সামনে অ্যালবামে সুরক্ষিত গুটিকয় ছবি এখন মূল্যবান হলেও ‘অচল’। অফুরন্ত, ওজনহীন ডিজিটাল সঞ্চয়-ভান্ডারের সামনে অ্যালবাম কোথায়! নিমেষে ও নির্বিঘ্নে কমকে বেশিতে, এক-কে একাধিকে পরিণত করাই উত্তরাধুনিক প্রযুক্তির দর্শন। পারদর্শিতাও।
এই স্ব-মুদ্রণের মাধ্যমে জ্ঞানত বা অজান্তে আমরা হয়ে উঠেছি একাধারে দৃশ্য এবং দর্শক। সেলফি-দর্শনের ধারক-বাহক-প্রচারকও আমরাই। আমরাই অংশগ্রহণকারী, আমরাই মূল্যায়নকারী। সেলফিগ্রস্ত এই সভ্যতা নিজেকে দৃশ্য-পণ্যে পরিণত করে ও তাকে বিতরণ করে অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সদা উন্মুখ। সেলফি-ক্যামেরাটি এখন এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠছে, প্রতিটি সেলফিই জরুরি এক ‘স্ট্যাটাস আপডেট’। ছবি তুলে বা তোলার মুহূর্তেই না জানালে যেন জীবন বৃথা। প্রতিটি ব্যক্তিগত মুহূর্তই এখন প্রচারযোগ্য ও মন্তব্যকামী; নিজের অস্তিত্ব, সঙ্গ ও একাকিত্বকে সেলফির মাধ্যমে সম্প্রচার করাটা দাঁড়িয়েছে অভ্যাসে।
এমনিতেই বর্তমানে আমরা এক অনুদার সংকীর্ণ প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিমণ্ডলে বসবাস করছি। ছোট ছোট ঘর। আকাশ নেই। মাঠ নেই। খোলা জায়গা নেই। মানুষ, বাড়িঘর, আর স্থাপনায় ঠাসাঠাসি এক প্রায়ন্ধকার পরিবেশে আমরা বড় হচ্ছি। বেড়ে উঠছি। আমাদের দৃষ্টিসীমা সংকীর্ণ আর আবদ্ধ নানা স্থাপনায়। অথচ আমরা জানি, মন বড় হওয়ার জন্য বড় পরিসর চাই। উদার আকাশ, দিগন্তবিস্তৃত মাঠ। বড় বড় বাড়িঘর, উঠোন চাই। চাই বড় মানুষের সান্নিধ্য।
কিন্তু এখন সবকিছু ছোট। সারাক্ষণ মোবাইল-ট্যাব-ল্যাপটপ আর কম্পিউটারের স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকা। দৃষ্টিসীমা একটি নির্দিষ্ট বৃত্তে আবদ্ধ হওয়ায় মনের দিগন্ত কখনো বিস্তৃত হতে পারছে না। ফলে আমরা বড় বেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছি। জাতি হিসেবে আমরা রিক্ত-নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছি। শুধু নিজের সুবিধা আদায় করতে গিয়ে যদি অন্য কারও অসুবিধা হয়, আমরা তার পরোয়া করছি না।
সর্বত্র যখন সেলফির জয়জয়কার, তখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তাঁর কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের সঙ্গে একটি সেলফি তুলেছেন। এই সেলফি নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠেছে। গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট শেখ হাসিনা এবং তাঁর কন্যার সঙ্গে হাস্যোজ্জ্বল ভঙ্গিতে সেলফি তুলছেন। জো বাইডেন ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে জি২০ সম্মেলন চলাকালে এই সেলফি তোলেন। প্রধানমন্ত্রীর কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল মনের আনন্দে এ ছবি সামাজিক মাধ্যম এক্স-এ (সাবেক টুইটারে) প্রকাশ করেন। তারপর ছবিটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
ছবি নিয়ে শুরু হয় নানা ধরনের মত-মন্তব্য, ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ। সরকার-সমর্থকদের কেউ কেউ নির্বাচন সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শেখ হাসিনা সরকারের সম্পর্ক ভালো হয়ে যাওয়ার প্রমাণ হিসেবে এই সেলফিকে বর্ণনা করছেন। আবার সরকারবিরোধীদের কেউ কেউ এটাকে সংকীর্ণতা হিসেবে বিবেচনা করছেন। তাঁদের মতে, ‘সেলফি দিয়ে বিভ্রান্তির চেষ্টা হচ্ছে এবং সেলফিতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের কোনো নড়চড় হবে না।’ কয়েক মাস যাবৎ দুই দেশের সম্পর্কের টানাপোড়েনের পটভূমিতে মার্কিন প্রেসিডেন্টের হাসিমুখে শেখ হাসিনা এবং তাঁর কন্যার সঙ্গে সেলফি তোলার ঘটনাকে কার্যত ‘আগের দূরত্ব ঘুচে গেছে’ বলে প্রচারের চেষ্টা করছে আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা।
এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের এক সেলফিতে বিএনপির নেতাদের রাতের ঘুম হারাম।’ বিএনপিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘এত দিন বিএনপি আটলান্টিকের ওপারে হোয়াইট হাউসের দিকে তাকিয়ে ছিল—বাইডেন সাহেব নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আওয়ামী লীগকে হটিয়ে তাদের ক্ষমতায় বসাবে। কী দেখলেন আজকে? বাইডেন সাহেব নিজেই সেলফি তুললেন শেখ হাসিনার সঙ্গে।’
এর জবাবে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘সেলফির জন্য কিন্তু র্যাবের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা কিংবা ভিসা নীতি উঠে যায়নি। দেউলিয়া হয়ে গেছে বলেই বাইডেনের সঙ্গে সেলফি তুলে ঢোল পেটাচ্ছেন। ভোটটা ঠিকমতো না করলে কোনো সেলফিই রক্ষা করতে পারবে না।’
কেবল রাজনৈতিক দলের নেতারাই নন, সরকার এবং বিরোধী উভয় দলের কর্মী-সমর্থকেরাও বিষয়টি নিয়ে নেমে পড়েছেন ‘প্রচার যুদ্ধে’।পক্ষে-বিপক্ষে নানা বক্তব্য, আক্রমণ এবং পাল্টা আক্রমণ চলছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
কিন্তু সত্যিই কি এই সেলফি জো বাইডেনের সঙ্গে শেখ হাসিনার সব ল্যাঠা চুকেবুকে যাওয়ার বিজ্ঞাপন? না শুধুই সৌজন্য? আসলে একই অনুষ্ঠানে উপস্থিত রাষ্ট্রের দুই কর্তাব্যক্তির সেলফি খুবই সাধারণ ও মামুলি একটা ঘটনা। এর দ্বারা দুই দেশের সরকারের সম্পর্কের ভালো-মন্দ কিছুই প্রকাশ পায় না।
আমেরিকা তার নিজের স্বার্থ ও সুবিধাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েই অন্য দেশের সঙ্গে সম্পর্ক ও কূটনীতি পরিচালিত করে। রাষ্ট্রপতি কার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করলেন, কার সঙ্গে সেলফি তুললেন, সেটা মোটেও কোনো তাৎপর্য বহন করে না। রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক আলাদা জিনিস। এর পেছনে লাভ-লোকসানের হিসাব জড়িত থাকে। থাকে আরও অনেক জটিল অঙ্ক ও কৌশল। সেলফি এসব তাৎপর্য ধারণ করে না।
সেলফি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা আসলে আমাদের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বেরই বহিঃপ্রকাশ। আগামী দিনে আমরা কীভাবে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেব, কীভাবে একটি অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য সুষ্ঠু নির্বাচন করব, সেই সিদ্ধান্ত আমাদেরই নিতে হবে।অন্য কোনো রাষ্ট্রপ্রধান বা অন্য কোনো দেশের সমর্থনের ওপর নির্ভর করে কখনো স্বদেশের গণতন্ত্র মেরামত করা যায় না।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
৪ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৭ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৭ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
১১ দিন আগে