শাহরিয়ার হাসান, বকশীগঞ্জ, জামালপুর থেকে
হত্যা মামলার প্রধান আসামি, দল থেকে বহিষ্কৃত নেতা, আত্মগোপনে গিয়ে হয়েছেন গ্রেপ্তারও। তবু তাঁর বিরুদ্ধে কারও প্রকাশ্যে মুখ খোলার যেন সাহস নেই। কারণ সবার আশঙ্কা, সুযোগ পেয়ে একবার বের হতে পারলে সেই শোধ নিতে ভুল করবেন না জামালপুরের বকশীগঞ্জের সাধুরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম বাবু।
স্থানীয় লোকজন বলছেন, পুলিশ-প্রশাসন, আইনকানুন—কোনো কিছুরই ধার ধারতেন না সাংবাদিক খুনের মামলার প্রধান আসামি এই বাবু। চেয়ারম্যান হওয়ায় অভিযোগ থানায় না পাঠিয়ে নিজের আদালতেই করতেন বিচার। বিচারে মানুষ বাধ্য হয় গ্রাম ছাড়তে। ১৩ বছর ধরে পালিত ক্যাডার বাহিনী দিয়ে এভাবেই ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন দাপুটে এই চেয়ারম্যান।
ভুক্তভোগীদের কেউ কেউ বলেছেন, বেপরোয়া বাবুর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারতেন না কেউ। কথা বললেই দিতেন মিথ্যা মামলা। এ কাজে নাম ভাঙাতেন আপন চাচাতো ভাই পুলিশের সাবেক পদস্থ এক কর্মকর্তার। তাঁদের ভয়ে তটস্থ থাকত এলাকাবাসী। বকশীগঞ্জ বাজারের পাটহাটি এলাকায় গত বুধবার রাতে হামলার শিকার হন বাংলানিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জামালপুর জেলা প্রতিনিধি ও একাত্তর টিভির বকশীগঞ্জ উপজেলা প্রতিনিধি গোলাম রব্বানি নাদিম।
পরদিন বৃহস্পতিবার দুপুরে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। তাঁর পরিবারের অভিযোগ, প্রকাশিত সংবাদের জের ধরে নাদিমকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে
হত্যাকাণ্ডের পর আত্মগোপনে যাওয়া চেয়ারম্যান বাবুকে গত শনিবার পঞ্চগড় থেকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। পরে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে বাহিনীটি জানিয়েছে, চেয়ারম্যান বাবুর পরিকল্পনা ও উপস্থিতিতেই সাংবাদিক নাদিমকে হত্যা করা হয়।
এলাকার মানুষ যা বলছেন
সরেজমিনে গতকাল এলাকায় ঘুরে পুলিশ সূত্র, ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ পাওয়া যায়। এলাকাবাসী বলছেন, চেয়ারম্যান বাবুর দুই গ্রুপে ৩০-৩৫ জনের সন্ত্রাসী ও ক্যাডার বাহিনী রয়েছে। যার একটি গ্রুপ তিনি সরাসরি দেখভাল করেন। এলাকা ও ইউনিয়ন পরিষদকেন্দ্রিক অপকর্মে তাদের কাজে লাগান। এদের ভেতর থেকে দুই-তিনজনকে ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যও বানিয়েছেন। ১০-১৫ জনের আরেক গ্রুপ রয়েছে উপজেলা শহর বকশীগঞ্জে। বাবু কয়েক বছর ধরে এখানেই থাকেন।
উপজেলা আওয়ামী লীগের উপপ্রচার সম্পাদক বন্ধু রাকিববিল্লাহ রাকিব তাদের নেতৃত্ব দেন। ভবিষ্যতে উপজেলা আওয়ামী লীগে বড় পদ বাগানো ও প্রতিপক্ষদের শাসাতে এদের ব্যবহার করেন বাবু। সাংবাদিক নাদিম হত্যার মিশনেও রাকিব গ্রুপের ক্যাডাররা অংশ নেয়। মামলায়ও আসামি হিসেবে আসে তাঁর নাম। গ্রেপ্তারও হয়েছেন।
সাধুরপাড়া চার, পাঁচ ও ছয় নম্বর ওয়ার্ডের নির্বাচিত মহিলা সদস্য আমেনা বেগম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘চার ইউপি সদস্য দিয়ে ইউনিয়ন পরিষদ চালায় চেয়ারম্যান বাবু। গরিব মানুষের জন্য ১০ কেজি বরাদ্দের চালে কখনোই ৬ কেজির বেশি কেউ পায় না। এটা বলাতেই পরিষদ থেকে বের করে দিয়েছে আমাকে। নির্বাচিত সদস্য হওয়া সত্ত্বেও এক বছর ধরে পরিষদে যেতে পারি না।’
সাধুরপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি আক্কাস আলী বলেন, ‘সে (বাবু) তো ভয়াবহ সন্ত্রাসী। নাদিম না মরলে কেউ তাঁর অত্যাচার সম্পর্কে জানত না। এভাবে প্রতি সপ্তাহেই কাউকে না কাউকে মারধর করে।’প্রবীণ এই আওয়ামী লীগ নেতার দাবি, পাঁচ বছর ধরে ইউনিয়নের পার্টি অফিসে ঢুকতে পারেন না তিনি। তাঁর মতো অন্যদেরও একই অবস্থা।
এক রুমে অফিস অন্য রুমে টর্চার সেল
জামালপুর জেলার বকশীগঞ্জ থানা শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে সাধুরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদ। পরপর দুইবারের চেয়ারম্যান হলেও মাসে এক দিনও ইউনিয়ন পরিষদে বসেন না বাবু। পরিষদ থেকে এক কিলোমিটার দূরে কামালবর্ত্তী বাজার। বাজারের সঙ্গেই লাগানো বাবুর গ্রামের বাড়ি। বাজারে তিনতলা একটি ভবন তুলেছেন তিনি। সেটার তৃতীয় তলায় পাশাপাশি দুটি রুম। দিনরাত এক রুমে ক্যাডার বাহিনী নিয়ে বসে মজমাস্তি করেন বাবু। কাউকে শাসাতে হলে লোক দিয়ে তুলে এনে আদালত বসান। করেন শারীরিক নির্যাতন।
গতকাল সরেজমিনে দেখা যায়, ওই মার্কেটের শুধু নিচের তলায় দুটো দোকান। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে দেখা যায় এক রুমে কয়েকটি চেয়ার পাতানো। মুখোমুখি অন্য রুমের পাশে এক-দেড় হাত করে লাঠি ও ভাঙা কাঠের টুকরো। এই গ্রামের মিল্লাত নামের এক যুবক অভিযোগ করেন, এক বছর আগে চেয়ারম্যান বাবুর অনুসারীদের সঙ্গে মতবিরোধের জেরে তাঁকে ডেকে ব্যাপক নির্যাতন করা হয় তিনতলার ওই কক্ষে। পরে গ্রাম ছাড়তে বাধ্য করেন। গ্রাম ছেড়েও মিথ্যা মামলা থেকে রেহাই পাননি তিনি।
ভাইয়ের প্যারালাইসিসে কপাল খোলে বাবুর
চেয়ারম্যান বাবুর বাবারা ছয় ভাই। বাবুর এক চাচাতো ভাইয়ের নাম হারুন। তাঁর ঠিকাদারি লাইসেন্স ছিল। আরেক চাচাতো ভাই পুলিশের সাবেক একজন পদস্থ কর্মকর্তা। তাঁর সহযোগিতায় নিয়মিতই কাজ পেতেন হারুন। বেশি কাজ থাকত বিভিন্ন মোবাইল কোম্পানির টাওয়ার নির্মাণের। এইচএসসি ফেল বাবু হারুনকে টাওয়ার নির্মাণের কাজে সহযোগিতা করতেন। রাজমিস্ত্রিদের প্রধান হয়ে সেগুলো দেখভাল করতেন। এভাবে কিছুদিন চলার পর হঠাৎ করে হারুন প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হন। এরপর তাঁর লাইসেন্স নিয়েই কাজ করতে শুরু করেন বাবু। বাবুর দ্বিতীয় স্ত্রী সাবিনা আক্তারের দাবি, তখনো পর্যন্ত রাজনীতিতে আসেননি বাবু। কিছুদিন পর হারুন মারা যাওয়ায় বাবু নিজে একটি ঠিকদারি লাইসেন্স করেন। এরপর সেখান থেকে ভালো টাকা উপার্জন করেন।
রাতারাতি দল করেও বাবুর শক্ত অবস্থান
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, স্কুলমাস্টারের ছেলে বাবু ১৯৯৪-৯৫ সালের দিকে কলেজজীবনে জাতীয় পার্টির ছাত্রসংগঠনের প্রথম সারির কর্মী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ঠিকাদারি করে টাকাপয়সা কামিয়ে ২০১১ সালে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ভেড়েন। ২০১১ সালে আওয়ামী লীগে ভিড়েই ইউপি নির্বাচনে অংশ নেন বাবু। তবে সেবার জয়ী হতে না পারলেও ২০১৪ সালে সাধুরপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ বাগিয়ে নিতে সক্ষম হন। দলের এই পদে থাকায় খুব সহজেই ২০১৬ সালের ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকিট পান। পরে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে দ্রুত নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে সক্ষম হন বাবু। ২০১৪ সালে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সম্মেলনের পর আর কোনো সম্মেলন হয়নি। তাই পদে থেকে ২০২১ সালে ফের নৌকার মাঝি হয়ে ফিরে আসেন মাহমুদুল আলম বাবু। নির্বাচিত হন এবারও।
সাংবাদিক নাদিম হত্যার প্রেক্ষাপট
স্থানীয় লোকজন ও বকশীগঞ্জের সাংবাদিকদের ভাষ্যমতে, চেয়ারম্যান বাবুর সঙ্গে কিছুদিন আগেও সাংবাদিক নাদিমের সম্পর্ক ভালো ছিল। কিন্তু বাবুর দ্বিতীয় স্ত্রী সাবিনা আক্তারের অনুরোধে তাঁর পক্ষে প্রতিবেদন করাই দূরত্ব তৈরি হয় বাবুর সঙ্গে। শুরুর দিকে বাবু নিহত নাদিমকে তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীর পক্ষ না নেওয়ার অনুরোধ করেন।
সাবিনা আক্তার বলেন, প্রায় ১০ বছর আগে গোপনে তাঁকে বিয়ে করেন বাবু। ২০১৮ সালে তাঁকে তালাক দেন। আদালতে মামলা করলে সেবার ফিরিয়ে নেন। তবে আগের মতোই একা বাসায় রাখেন। এখন তাঁর কোলে ছয় মাসের মেয়েসন্তান। আবারও নতুন করে অস্বীকার করেছিলেন সাবিনাকে। সাবিনা যখন তাঁর অধিকার ফিরে পেতে চান, তখন এ নিয়ে সাংবাদিক গোলাম রব্বানি নাদিম একের পর এক সংবাদ প্রকাশ করতে থাকেন। এরপরই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন চেয়ারম্যান বাবু।
স্থানীয় সাংবাদিক ও নাদিমের পরিবারের সদস্যরা জানান, নাদিম গত মে মাসে স্থানীয় অনলাইন পোর্টালে কয়েকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। এর মধ্যে ১০ মে ‘দুইবার বিয়ের পরও সন্তান-স্ত্রীকে অস্বীকার করছেন ইউপি চেয়ারম্যান!’, ১৪ মে ‘আমি আমার স্বামী চাই, একসঙ্গে সংসার করতে চাই’ এবং ২০ মে ‘আ.লীগ থেকে স্বামীর বহিষ্কার চেয়ে স্ত্রীর আবেদন’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়। এতে ক্ষিপ্ত হন বাবু চেয়ারম্যান। একের পর এক সংবাদ প্রকাশ করায় নাদিমসহ কয়েকজনের নামে সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন বাবু। কিন্তু তা খারিজ করে দেন ময়মনসিংহের সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক। আর এই মামলা খারিজের চার ঘণ্টার মধ্যেই হামলার শিকার হন সাংবাদিক নাদিম।
নাদিমের মাথায় আঘাত করেন চেয়ারম্যানের ছেলে
প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঘটনার দিন গত বুধবার সন্ধ্যায় নাদিম ও স্থানীয় সাংবাদিক আল মুজাহিদ কাজ শেষে আলাদা মোটরসাইকেলে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেন। তাঁরা পাশাপাশি মোটরসাইকেলে করে যাচ্ছিলেন। পাটহাটি মোড়েই নাদিমকে মোটরসাইকেল থেকে টেনেহিঁচড়ে নামায় বাবুর ক্যাডাররা।
আল মুজাহিদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, চলন্ত মোটরসাইকেল থেকে টেনেহিঁচড়ে নাদিমকে নামায়। তাঁকে উপর্যুপরি কিল-ঘুষি দিতে দিতে অন্ধকার টিঅ্যান্ডটি সড়কে নিয়ে যায়। সেখানে আগে থেকেই অবস্থান করছিল আরও ১৫-২০ জন সন্ত্রাসী। সবাই মিলে যে যেভাবে পারছিল, নাদিমকে পেটাচ্ছিল। আর দূর থেকে নির্দেশনা দিচ্ছিলেন মূল অভিযুক্ত বাবু। একপর্যায়ে বাবুর ছেলে রিফাত লাথি মেরে পাশে থাকা একটি দেয়ালের ইট ভাঙে। চেয়ারম্যানের ছেলে সেই ইট হাতে নিয়ে নাদিমের মাথায় আঘাত করে।
নাদিমের স্ত্রী-সন্তানদের দেখবে কে
সাংবাদিক নাদিমের তিন সন্তান। দুইটা ছেলে একজন মেয়ে। বড় ছেলে ডিগ্রিতে পড়ে। মেয়ে এবার স্নাতকে ভর্তি হবে। সবার ছোট ছেলেটার বয়স সাত। নাদিমের স্ত্রী মনিরা আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমাদের আর দেখার কেউ থাকল না। সাংবাদিকতা করতে গিয়ে আমার স্বামী জীবন দিয়ে চলে গেল।’
বাবু পাঁচ দিনের রিমান্ড, অন্যদের চার দিন-তিন দিন
মনিরা বেগম স্বামী হত্যার অভিযোগে চেয়ারম্যান বাবুকে প্রধান আসামি করে ২২ জনের নাম উল্লেখসহ আরও ২৫ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে বকশীগঞ্জ থানায় মামলা করেছেন। এই মামলায় এ পর্যন্ত বাবুসহ ১৩ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। চেয়ারম্যান বাবুকে গতকাল পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। এই মামলায় আসামি রেজাউল করিম ও মনিরুল ইসলাম মনিরের চার দিন ও জাকিরুল ইসলামের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন জামালপুরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত।
হত্যা মামলার প্রধান আসামি, দল থেকে বহিষ্কৃত নেতা, আত্মগোপনে গিয়ে হয়েছেন গ্রেপ্তারও। তবু তাঁর বিরুদ্ধে কারও প্রকাশ্যে মুখ খোলার যেন সাহস নেই। কারণ সবার আশঙ্কা, সুযোগ পেয়ে একবার বের হতে পারলে সেই শোধ নিতে ভুল করবেন না জামালপুরের বকশীগঞ্জের সাধুরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম বাবু।
স্থানীয় লোকজন বলছেন, পুলিশ-প্রশাসন, আইনকানুন—কোনো কিছুরই ধার ধারতেন না সাংবাদিক খুনের মামলার প্রধান আসামি এই বাবু। চেয়ারম্যান হওয়ায় অভিযোগ থানায় না পাঠিয়ে নিজের আদালতেই করতেন বিচার। বিচারে মানুষ বাধ্য হয় গ্রাম ছাড়তে। ১৩ বছর ধরে পালিত ক্যাডার বাহিনী দিয়ে এভাবেই ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন দাপুটে এই চেয়ারম্যান।
ভুক্তভোগীদের কেউ কেউ বলেছেন, বেপরোয়া বাবুর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারতেন না কেউ। কথা বললেই দিতেন মিথ্যা মামলা। এ কাজে নাম ভাঙাতেন আপন চাচাতো ভাই পুলিশের সাবেক পদস্থ এক কর্মকর্তার। তাঁদের ভয়ে তটস্থ থাকত এলাকাবাসী। বকশীগঞ্জ বাজারের পাটহাটি এলাকায় গত বুধবার রাতে হামলার শিকার হন বাংলানিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জামালপুর জেলা প্রতিনিধি ও একাত্তর টিভির বকশীগঞ্জ উপজেলা প্রতিনিধি গোলাম রব্বানি নাদিম।
পরদিন বৃহস্পতিবার দুপুরে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। তাঁর পরিবারের অভিযোগ, প্রকাশিত সংবাদের জের ধরে নাদিমকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে
হত্যাকাণ্ডের পর আত্মগোপনে যাওয়া চেয়ারম্যান বাবুকে গত শনিবার পঞ্চগড় থেকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। পরে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে বাহিনীটি জানিয়েছে, চেয়ারম্যান বাবুর পরিকল্পনা ও উপস্থিতিতেই সাংবাদিক নাদিমকে হত্যা করা হয়।
এলাকার মানুষ যা বলছেন
সরেজমিনে গতকাল এলাকায় ঘুরে পুলিশ সূত্র, ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ পাওয়া যায়। এলাকাবাসী বলছেন, চেয়ারম্যান বাবুর দুই গ্রুপে ৩০-৩৫ জনের সন্ত্রাসী ও ক্যাডার বাহিনী রয়েছে। যার একটি গ্রুপ তিনি সরাসরি দেখভাল করেন। এলাকা ও ইউনিয়ন পরিষদকেন্দ্রিক অপকর্মে তাদের কাজে লাগান। এদের ভেতর থেকে দুই-তিনজনকে ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যও বানিয়েছেন। ১০-১৫ জনের আরেক গ্রুপ রয়েছে উপজেলা শহর বকশীগঞ্জে। বাবু কয়েক বছর ধরে এখানেই থাকেন।
উপজেলা আওয়ামী লীগের উপপ্রচার সম্পাদক বন্ধু রাকিববিল্লাহ রাকিব তাদের নেতৃত্ব দেন। ভবিষ্যতে উপজেলা আওয়ামী লীগে বড় পদ বাগানো ও প্রতিপক্ষদের শাসাতে এদের ব্যবহার করেন বাবু। সাংবাদিক নাদিম হত্যার মিশনেও রাকিব গ্রুপের ক্যাডাররা অংশ নেয়। মামলায়ও আসামি হিসেবে আসে তাঁর নাম। গ্রেপ্তারও হয়েছেন।
সাধুরপাড়া চার, পাঁচ ও ছয় নম্বর ওয়ার্ডের নির্বাচিত মহিলা সদস্য আমেনা বেগম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘চার ইউপি সদস্য দিয়ে ইউনিয়ন পরিষদ চালায় চেয়ারম্যান বাবু। গরিব মানুষের জন্য ১০ কেজি বরাদ্দের চালে কখনোই ৬ কেজির বেশি কেউ পায় না। এটা বলাতেই পরিষদ থেকে বের করে দিয়েছে আমাকে। নির্বাচিত সদস্য হওয়া সত্ত্বেও এক বছর ধরে পরিষদে যেতে পারি না।’
সাধুরপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি আক্কাস আলী বলেন, ‘সে (বাবু) তো ভয়াবহ সন্ত্রাসী। নাদিম না মরলে কেউ তাঁর অত্যাচার সম্পর্কে জানত না। এভাবে প্রতি সপ্তাহেই কাউকে না কাউকে মারধর করে।’প্রবীণ এই আওয়ামী লীগ নেতার দাবি, পাঁচ বছর ধরে ইউনিয়নের পার্টি অফিসে ঢুকতে পারেন না তিনি। তাঁর মতো অন্যদেরও একই অবস্থা।
এক রুমে অফিস অন্য রুমে টর্চার সেল
জামালপুর জেলার বকশীগঞ্জ থানা শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে সাধুরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদ। পরপর দুইবারের চেয়ারম্যান হলেও মাসে এক দিনও ইউনিয়ন পরিষদে বসেন না বাবু। পরিষদ থেকে এক কিলোমিটার দূরে কামালবর্ত্তী বাজার। বাজারের সঙ্গেই লাগানো বাবুর গ্রামের বাড়ি। বাজারে তিনতলা একটি ভবন তুলেছেন তিনি। সেটার তৃতীয় তলায় পাশাপাশি দুটি রুম। দিনরাত এক রুমে ক্যাডার বাহিনী নিয়ে বসে মজমাস্তি করেন বাবু। কাউকে শাসাতে হলে লোক দিয়ে তুলে এনে আদালত বসান। করেন শারীরিক নির্যাতন।
গতকাল সরেজমিনে দেখা যায়, ওই মার্কেটের শুধু নিচের তলায় দুটো দোকান। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে দেখা যায় এক রুমে কয়েকটি চেয়ার পাতানো। মুখোমুখি অন্য রুমের পাশে এক-দেড় হাত করে লাঠি ও ভাঙা কাঠের টুকরো। এই গ্রামের মিল্লাত নামের এক যুবক অভিযোগ করেন, এক বছর আগে চেয়ারম্যান বাবুর অনুসারীদের সঙ্গে মতবিরোধের জেরে তাঁকে ডেকে ব্যাপক নির্যাতন করা হয় তিনতলার ওই কক্ষে। পরে গ্রাম ছাড়তে বাধ্য করেন। গ্রাম ছেড়েও মিথ্যা মামলা থেকে রেহাই পাননি তিনি।
ভাইয়ের প্যারালাইসিসে কপাল খোলে বাবুর
চেয়ারম্যান বাবুর বাবারা ছয় ভাই। বাবুর এক চাচাতো ভাইয়ের নাম হারুন। তাঁর ঠিকাদারি লাইসেন্স ছিল। আরেক চাচাতো ভাই পুলিশের সাবেক একজন পদস্থ কর্মকর্তা। তাঁর সহযোগিতায় নিয়মিতই কাজ পেতেন হারুন। বেশি কাজ থাকত বিভিন্ন মোবাইল কোম্পানির টাওয়ার নির্মাণের। এইচএসসি ফেল বাবু হারুনকে টাওয়ার নির্মাণের কাজে সহযোগিতা করতেন। রাজমিস্ত্রিদের প্রধান হয়ে সেগুলো দেখভাল করতেন। এভাবে কিছুদিন চলার পর হঠাৎ করে হারুন প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হন। এরপর তাঁর লাইসেন্স নিয়েই কাজ করতে শুরু করেন বাবু। বাবুর দ্বিতীয় স্ত্রী সাবিনা আক্তারের দাবি, তখনো পর্যন্ত রাজনীতিতে আসেননি বাবু। কিছুদিন পর হারুন মারা যাওয়ায় বাবু নিজে একটি ঠিকদারি লাইসেন্স করেন। এরপর সেখান থেকে ভালো টাকা উপার্জন করেন।
রাতারাতি দল করেও বাবুর শক্ত অবস্থান
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, স্কুলমাস্টারের ছেলে বাবু ১৯৯৪-৯৫ সালের দিকে কলেজজীবনে জাতীয় পার্টির ছাত্রসংগঠনের প্রথম সারির কর্মী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ঠিকাদারি করে টাকাপয়সা কামিয়ে ২০১১ সালে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ভেড়েন। ২০১১ সালে আওয়ামী লীগে ভিড়েই ইউপি নির্বাচনে অংশ নেন বাবু। তবে সেবার জয়ী হতে না পারলেও ২০১৪ সালে সাধুরপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ বাগিয়ে নিতে সক্ষম হন। দলের এই পদে থাকায় খুব সহজেই ২০১৬ সালের ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকিট পান। পরে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে দ্রুত নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে সক্ষম হন বাবু। ২০১৪ সালে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সম্মেলনের পর আর কোনো সম্মেলন হয়নি। তাই পদে থেকে ২০২১ সালে ফের নৌকার মাঝি হয়ে ফিরে আসেন মাহমুদুল আলম বাবু। নির্বাচিত হন এবারও।
সাংবাদিক নাদিম হত্যার প্রেক্ষাপট
স্থানীয় লোকজন ও বকশীগঞ্জের সাংবাদিকদের ভাষ্যমতে, চেয়ারম্যান বাবুর সঙ্গে কিছুদিন আগেও সাংবাদিক নাদিমের সম্পর্ক ভালো ছিল। কিন্তু বাবুর দ্বিতীয় স্ত্রী সাবিনা আক্তারের অনুরোধে তাঁর পক্ষে প্রতিবেদন করাই দূরত্ব তৈরি হয় বাবুর সঙ্গে। শুরুর দিকে বাবু নিহত নাদিমকে তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীর পক্ষ না নেওয়ার অনুরোধ করেন।
সাবিনা আক্তার বলেন, প্রায় ১০ বছর আগে গোপনে তাঁকে বিয়ে করেন বাবু। ২০১৮ সালে তাঁকে তালাক দেন। আদালতে মামলা করলে সেবার ফিরিয়ে নেন। তবে আগের মতোই একা বাসায় রাখেন। এখন তাঁর কোলে ছয় মাসের মেয়েসন্তান। আবারও নতুন করে অস্বীকার করেছিলেন সাবিনাকে। সাবিনা যখন তাঁর অধিকার ফিরে পেতে চান, তখন এ নিয়ে সাংবাদিক গোলাম রব্বানি নাদিম একের পর এক সংবাদ প্রকাশ করতে থাকেন। এরপরই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন চেয়ারম্যান বাবু।
স্থানীয় সাংবাদিক ও নাদিমের পরিবারের সদস্যরা জানান, নাদিম গত মে মাসে স্থানীয় অনলাইন পোর্টালে কয়েকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। এর মধ্যে ১০ মে ‘দুইবার বিয়ের পরও সন্তান-স্ত্রীকে অস্বীকার করছেন ইউপি চেয়ারম্যান!’, ১৪ মে ‘আমি আমার স্বামী চাই, একসঙ্গে সংসার করতে চাই’ এবং ২০ মে ‘আ.লীগ থেকে স্বামীর বহিষ্কার চেয়ে স্ত্রীর আবেদন’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়। এতে ক্ষিপ্ত হন বাবু চেয়ারম্যান। একের পর এক সংবাদ প্রকাশ করায় নাদিমসহ কয়েকজনের নামে সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন বাবু। কিন্তু তা খারিজ করে দেন ময়মনসিংহের সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক। আর এই মামলা খারিজের চার ঘণ্টার মধ্যেই হামলার শিকার হন সাংবাদিক নাদিম।
নাদিমের মাথায় আঘাত করেন চেয়ারম্যানের ছেলে
প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঘটনার দিন গত বুধবার সন্ধ্যায় নাদিম ও স্থানীয় সাংবাদিক আল মুজাহিদ কাজ শেষে আলাদা মোটরসাইকেলে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেন। তাঁরা পাশাপাশি মোটরসাইকেলে করে যাচ্ছিলেন। পাটহাটি মোড়েই নাদিমকে মোটরসাইকেল থেকে টেনেহিঁচড়ে নামায় বাবুর ক্যাডাররা।
আল মুজাহিদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, চলন্ত মোটরসাইকেল থেকে টেনেহিঁচড়ে নাদিমকে নামায়। তাঁকে উপর্যুপরি কিল-ঘুষি দিতে দিতে অন্ধকার টিঅ্যান্ডটি সড়কে নিয়ে যায়। সেখানে আগে থেকেই অবস্থান করছিল আরও ১৫-২০ জন সন্ত্রাসী। সবাই মিলে যে যেভাবে পারছিল, নাদিমকে পেটাচ্ছিল। আর দূর থেকে নির্দেশনা দিচ্ছিলেন মূল অভিযুক্ত বাবু। একপর্যায়ে বাবুর ছেলে রিফাত লাথি মেরে পাশে থাকা একটি দেয়ালের ইট ভাঙে। চেয়ারম্যানের ছেলে সেই ইট হাতে নিয়ে নাদিমের মাথায় আঘাত করে।
নাদিমের স্ত্রী-সন্তানদের দেখবে কে
সাংবাদিক নাদিমের তিন সন্তান। দুইটা ছেলে একজন মেয়ে। বড় ছেলে ডিগ্রিতে পড়ে। মেয়ে এবার স্নাতকে ভর্তি হবে। সবার ছোট ছেলেটার বয়স সাত। নাদিমের স্ত্রী মনিরা আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমাদের আর দেখার কেউ থাকল না। সাংবাদিকতা করতে গিয়ে আমার স্বামী জীবন দিয়ে চলে গেল।’
বাবু পাঁচ দিনের রিমান্ড, অন্যদের চার দিন-তিন দিন
মনিরা বেগম স্বামী হত্যার অভিযোগে চেয়ারম্যান বাবুকে প্রধান আসামি করে ২২ জনের নাম উল্লেখসহ আরও ২৫ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে বকশীগঞ্জ থানায় মামলা করেছেন। এই মামলায় এ পর্যন্ত বাবুসহ ১৩ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। চেয়ারম্যান বাবুকে গতকাল পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। এই মামলায় আসামি রেজাউল করিম ও মনিরুল ইসলাম মনিরের চার দিন ও জাকিরুল ইসলামের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন জামালপুরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত।
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
৩ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৬ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৬ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
১০ দিন আগে