এ কে এম শামসুদ্দিন
অনেক জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে শেষ পর্যন্ত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন হলো। এর আগে এই নির্বাচন কীভাবে হবে, তা নিয়ে অনেক কথাই হয়েছে। বিএনপিবিহীন নির্বাচনে জাতীয় পার্টিও যদি অংশ না নেয় তাহলে কী পরিস্থিতি দাঁড়ায়, তা নিয়েও মানুষের ভেতর কৌতূহল ছিল। কারণ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি অংশগ্রহণ করবে কি না, তা নিয়ে শেষ মুহূর্তে কিছুটা নাটকীয়তার সৃষ্টি হয়েছিল। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন দুপুরে জাতীয় পার্টির নীতিনির্ধারকেরা যখন মিটিং করছিলেন, তখন দলীয় কার্যালয়ের বাইরে অনেক নেতা-কর্মীই নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন।
এবারের নির্বাচনে ২৬টি আসন আওয়ামী লীগ ছেড়ে দিলেও জাতীয় পার্টি সন্তুষ্ট ছিল না। ছেড়ে দেওয়া আসনগুলোতে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে যাতে সরে দাঁড়ান, এর ব্যবস্থা করার জন্য আওয়ামী লীগের কাছে তাঁরা দাবি করেছিলেন। তা ছাড়া আরও কিছু আসন ছেড়ে দেওয়ার আবদার তো ছিলই। আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টির কোনো দাবি বা আবদার না রাখলেও দলটি নির্বাচনে যে অংশগ্রহণ করবে, সে ব্যাপারে আওয়ামী লীগ নিশ্চিত ছিল। শেষ পর্যন্ত তা-ই হয়েছে। আওয়ামী লীগ যেভাবে চেয়েছে তা মেনে নিয়েই জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে।
এবারের নির্বাচন কেমন হয়েছে, তা নিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার দুটো বক্তব্য সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তিনি বলেছেন, নির্বাচন নিয়ে কে কী বলছে, তা নিয়ে তিনি মাথা ঘামান না। তিনি বরং জোর দিয়ে বলেছেন, ‘আমরা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছি। এ নির্বাচন দেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।’ জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের বক্তব্য ছিল শেখ হাসিনার বক্তব্যের সম্পূর্ণ উল্টো। তিনি বলেছেন, ‘সরকারের নিয়ন্ত্রণে এ নির্বাচন হয়েছে। সরকার যেখানে নিরপেক্ষ করতে চেয়েছে, সেখানে নিরপেক্ষ হয়েছে। সরকার যেখানে যাকে জেতাতে চেয়েছে, সেটিই করেছে।’ আওয়ামী লীগের শরিক দল জাসদ নেতা হাসানুল হক ইনুও ভোট জালিয়াতির কথা বলেছেন। জনগণের ভোটে নয়, কারচুপির ভোটে তাঁকে পরাজিত করা হয়েছে বলে তিনি অভিযোগও করেন। নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি নিয়ে নৌকার অনেক প্রার্থীরও বিস্তর অভিযোগ আছে।
এই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করার জন্য আওয়ামী লীগ যে পরিকল্পনা করেছিল বাস্তবে তা ঘটেনি। তারা চেয়েছিল, ৫০ শতাংশ ভোটারও যদি ভোট দেন, তাহলে নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক হয়েছে বলে প্রচার করা যাবে। এ জন্য ব্যাপক প্রস্তুতিও নিয়েছিল। এমনকি ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আনার জন্য ভয়ভীতি দেখানোসহ নানা কৌশল গ্রহণ করেও ফল হয়নি। বিভিন্ন গণমাধ্যম এবং পর্যবেক্ষকদের হিসাব অনুযায়ী, ২০ শতাংশের নিচে ভোট কাস্ট হলেও নির্বাচন কমিশন দাবি করেছে ৪১ দশমিক ৯৯ শতাংশ। কমিশনের দেওয়া এ তথ্য নিয়েও বিতর্ক আছে। এই বিতর্কের জন্য অবশ্য নির্বাচন কমিশনকেই দায়ী করা চলে। বেলা ৩টায় নির্বাচন কমিশনের প্রশাসনিক বিভাগ থেকে ভোট গ্রহণের যে হিসাব পাওয়া গিয়েছিল তাতে দেখা গেছে, ভোট পড়েছে মাত্র ২৮ শতাংশ।
সেখানে বিকেল ৪টার মধ্যে আরও ১৪ শতাংশ ভোট পড়ল কী করে, সেই হিসাব মিলিয়ে নির্বাচন কমিশন জনগণকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। এমনকি বিদেশি পর্যবেক্ষকেরা পর্যন্ত এ ব্যাপারে বিভ্রান্ত। জানা গেছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিশেষজ্ঞসহ যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট ও ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউটের প্রতিনিধিরাও নির্বাচন কমিশনের কাছে ভোটের সঠিক হার জানতে চেয়েছেন।
প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন আয়োজনের উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগ সভাপতি মনোনয়নবঞ্চিতদের নৌকার বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার নির্দেশ দিয়ে, দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলকে উসকে দিয়েছেন বলেও মনে করা হচ্ছে। নির্বাচনের সময় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর নেতা-কর্মীদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষের যে ঘটনা ঘটেছে তার রেশ এখনো রয়ে গেছে। প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর নেতা-কর্মীদের রেষারেষির খবর পাওয়া যায়। নির্বাচনের পর পরাজিত প্রার্থীর সমর্থকদের ওপর বিজয়ী প্রার্থীর লোকজনের হামলার অভিযোগ যেমন আছে, তেমনি আছে একে অপরকে দোষারোপের চেষ্টা। এসব কোন্দলকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন সংসদীয় আসনে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে বিভাজন দেখা দিয়েছে। নির্বাচনের আগে থেকেই বিভিন্ন এলাকায় ক্ষমতার ভাগাভাগি ও নেতৃত্ব নিয়ে নিজেদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। নির্বাচনে একাধিক প্রার্থীর পক্ষে কাজ করতে গিয়ে কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে সেই দূরত্ব আরও বেড়েছে। এই বিভেদ সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে উঠতে পারে। দলের ভেতর এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব থেকে যেতে পারে। এ নিয়ে দলের অভ্যন্তরে বিরাজ করছে চরম অস্বস্তি। সম্ভবত এ কারণেই আওয়ামী লীগের সভাপতি নৌকা ও স্বতন্ত্র বিভেদ ভুলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি ১৫ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলের যৌথ সভায় নিজেদের মধ্যে একে অপরের দোষ ধরা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেন।
গত সংসদে সংসদ সদস্যদের মধ্যে ব্যবসায়ীদের আধিক্য থাকায় প্রচুর সমালোচনা হয়েছিল। এবার সেই সংখ্যা আরও বেড়েছে। স্বাধীনতার পর জাতীয় সংসদে ব্যবসায়ীদের এই সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। ১৯৭৩ সালে প্রথম সংসদে ব্যবসায়ী যেখানে ছিল মাত্র ১৮ শতাংশ, সেখানে গত সংসদে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬২ শতাংশে। একাদশ জাতীয় সংসদে ৩০০ আসনের মধ্যে ব্যবসায়ীর সংখ্যা ছিল ১৮২। বর্তমান সংসদে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯৯ জন, যা সরাসরি ভোটে নির্বাচিত মোট সংসদ সদস্যের দুই-তৃতীয়াংশ। শতাংশের হিসাবে ৬৭। এবারের নির্বাচনে মোট ১ হাজার ৯৪৫ প্রার্থীর মধ্যে ১ হাজার ১৪২ জনই ছিলেন ব্যবসায়ী। জাতীয় সংসদে ব্যবসায়ীদের সংখ্যা এ হারে বেড়ে যাওয়ায় প্রকৃত রাজনীতিবিদেরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, আমাদের দেশে ব্যবসায়ীরা রাজনীতিতে যে বিনিয়োগ করেন, তা নিজেদের স্বার্থের জন্য। তাঁরা ধীরে ধীরে রাষ্ট্রীয়ব্যবস্থার নীতিকাঠামো দখল করে নিজেদের অর্থসম্পদ ও ব্যবসা বৃদ্ধি করে নিচ্ছেন। অতীতে দেখা গেছে, ব্যাংকিং, পোশাকশিল্প ও বিদ্যুতের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে ব্যবসায়ীরাই ঠিক করছেন নীতিকাঠামো কী হবে। এমনকি ঋণখেলাপির মতো বিষয়ের নীতিমালাও এই ব্যবসায়ী মহলই ঠিক করে দিচ্ছে।
এবারের নতুন মন্ত্রিসভার ৩৭ সদস্যের মধ্যে ১৬ জনই ব্যবসায়ী। জাতীয় সংসদে প্রকৃত রাজনীতিবিদেরা সংখ্যালঘু হয়ে পড়ায়, অনেক আইন তৈরি করার ক্ষেত্রে তাঁরা ব্যবসায়ীদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন। সংসদে প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা, নিজেদের সুবিধার জন্য ব্যবসায়ীবান্ধব নীতি তৈরি করছেন। ফলে জনগণের কল্যাণের চেয়ে ব্যবসায়ীদের স্বার্থই রক্ষা হয় বেশি। তাঁদের অনেকেই সিন্ডিকেট ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন। সে জন্য সরকারকে তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। গত মেয়াদে সরকারকে এই সিন্ডিকেট ব্যবসায়ী মহলের কাছেই একাধিকবার অসহায় হয়ে পড়তে দেখা গেছে। সংসদে এসব ব্যবসায়ীর সংখ্যা স্বাভাবিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় বেড়েছে বলা ঠিক হবে না। তাঁরা বিপুল সম্পদের মালিক হওয়ায় অর্থের জোরে রাজনৈতিক শক্তিমত্তা অর্জন করেছেন। তাঁরা ক্ষমতাসীনদের সন্তুষ্ট করেই দলে পদ ও পদবি দখল করে নিয়েছেন। ফলে প্রকৃত রাজনৈতিক নেতারা পিছিয়ে পড়ছেন।
ভোটাধিকার গণতন্ত্রচর্চার অন্যতম স্তম্ভ। এবার নিয়ে গত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে সাধারণ মানুষ তাঁদের সেই অধিকার যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে পারেননি। গণতন্ত্রের স্বাভাবিক ধারা এভাবেই বারবার বিঘ্নিত হয়েছে। প্রতিপক্ষকে রাজনৈতিক ময়দান থেকে বিতাড়িত করে যেভাবে নির্বাচনটি সম্পন্ন করা হলো, তাতে সবার মনে প্রশ্ন জেগেছে, এ দেশে আর কখনো কি সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না? নিজ দল থেকে ডামি প্রার্থী দিয়ে, শরিক ও জোটের দল নিয়ে মিলেমিশে যে নির্বাচন করা হয়েছে, তা যেকোনো বিচারে দেশের নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের সঙ্গেই তুলনা চলে। ২০১৪ সালে বিনা ভোটের নির্বাচন, ২০১৮ সালে রাতের ভোটের নির্বাচনের পর এ বছরের এই অভিনব কায়দার নির্বাচন দেশের মানুষকে সত্যিই হতাশ করেছে। এই নির্বাচন সরকারি দলের সমর্থকদের মুখে বিজয়ের হাসি ফোটালেও, প্রকৃত গণতন্ত্রকামীদের হাসি কেড়ে নিয়েছে। এমন বিজয়ে খুশি হওয়া যায়, কিন্তু গর্ব করা যায় না।
এ ধরনের একতরফা এই নির্বাচন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গণতন্ত্রের জন্য শুভ নয় বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মত পোষণ করেছেন। এবার যে অভিনব কায়দায় নির্বাচন হলো, তাতে দেশের সাধারণ মানুষ সন্তুষ্ট হতে পারেনি। আন্তর্জাতিক মহলেও এ নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক আছে। আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, ‘বিরোধী দল নির্বাচনে অংশ নেয়নি বলে দেশে গণতন্ত্র নেই, সে কথা ঠিক নয়; বরং জনগণ নির্বাচনে অংশ নিয়েছে সেটিই বড় কথা।’ তাঁর এই বক্তব্য দেশে একদলীয় শাসনের ভীতি বাড়িয়ে তুলেছে। বৃহত্তর বিরোধী দলের প্রায় সব শীর্ষ নেতাসহ শত শত নেতা-কর্মীকে জেলহাজতে আটক রেখে ক্ষমতাসীন দল যে শক্তিমত্তার পরিচয় দিয়েছে, তা দেশের গণতন্ত্রচর্চা এবং ভবিষ্যতে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের জন্য অশনিসংকেত। তা ছাড়া, সংসদে বিরোধী নেতা বা দল কে বা কারা হবে, তা-ও যদি সরকারদলীয় নেতা ঠিক করেন, তাহলে কি বলা যায় যে বাংলাদেশ বহুদলীয় উদার গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পথে এগিয়ে যাচ্ছে?
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ও কলাম লেখক
অনেক জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে শেষ পর্যন্ত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন হলো। এর আগে এই নির্বাচন কীভাবে হবে, তা নিয়ে অনেক কথাই হয়েছে। বিএনপিবিহীন নির্বাচনে জাতীয় পার্টিও যদি অংশ না নেয় তাহলে কী পরিস্থিতি দাঁড়ায়, তা নিয়েও মানুষের ভেতর কৌতূহল ছিল। কারণ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি অংশগ্রহণ করবে কি না, তা নিয়ে শেষ মুহূর্তে কিছুটা নাটকীয়তার সৃষ্টি হয়েছিল। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন দুপুরে জাতীয় পার্টির নীতিনির্ধারকেরা যখন মিটিং করছিলেন, তখন দলীয় কার্যালয়ের বাইরে অনেক নেতা-কর্মীই নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন।
এবারের নির্বাচনে ২৬টি আসন আওয়ামী লীগ ছেড়ে দিলেও জাতীয় পার্টি সন্তুষ্ট ছিল না। ছেড়ে দেওয়া আসনগুলোতে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে যাতে সরে দাঁড়ান, এর ব্যবস্থা করার জন্য আওয়ামী লীগের কাছে তাঁরা দাবি করেছিলেন। তা ছাড়া আরও কিছু আসন ছেড়ে দেওয়ার আবদার তো ছিলই। আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টির কোনো দাবি বা আবদার না রাখলেও দলটি নির্বাচনে যে অংশগ্রহণ করবে, সে ব্যাপারে আওয়ামী লীগ নিশ্চিত ছিল। শেষ পর্যন্ত তা-ই হয়েছে। আওয়ামী লীগ যেভাবে চেয়েছে তা মেনে নিয়েই জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে।
এবারের নির্বাচন কেমন হয়েছে, তা নিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার দুটো বক্তব্য সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তিনি বলেছেন, নির্বাচন নিয়ে কে কী বলছে, তা নিয়ে তিনি মাথা ঘামান না। তিনি বরং জোর দিয়ে বলেছেন, ‘আমরা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছি। এ নির্বাচন দেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।’ জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের বক্তব্য ছিল শেখ হাসিনার বক্তব্যের সম্পূর্ণ উল্টো। তিনি বলেছেন, ‘সরকারের নিয়ন্ত্রণে এ নির্বাচন হয়েছে। সরকার যেখানে নিরপেক্ষ করতে চেয়েছে, সেখানে নিরপেক্ষ হয়েছে। সরকার যেখানে যাকে জেতাতে চেয়েছে, সেটিই করেছে।’ আওয়ামী লীগের শরিক দল জাসদ নেতা হাসানুল হক ইনুও ভোট জালিয়াতির কথা বলেছেন। জনগণের ভোটে নয়, কারচুপির ভোটে তাঁকে পরাজিত করা হয়েছে বলে তিনি অভিযোগও করেন। নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি নিয়ে নৌকার অনেক প্রার্থীরও বিস্তর অভিযোগ আছে।
এই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করার জন্য আওয়ামী লীগ যে পরিকল্পনা করেছিল বাস্তবে তা ঘটেনি। তারা চেয়েছিল, ৫০ শতাংশ ভোটারও যদি ভোট দেন, তাহলে নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক হয়েছে বলে প্রচার করা যাবে। এ জন্য ব্যাপক প্রস্তুতিও নিয়েছিল। এমনকি ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আনার জন্য ভয়ভীতি দেখানোসহ নানা কৌশল গ্রহণ করেও ফল হয়নি। বিভিন্ন গণমাধ্যম এবং পর্যবেক্ষকদের হিসাব অনুযায়ী, ২০ শতাংশের নিচে ভোট কাস্ট হলেও নির্বাচন কমিশন দাবি করেছে ৪১ দশমিক ৯৯ শতাংশ। কমিশনের দেওয়া এ তথ্য নিয়েও বিতর্ক আছে। এই বিতর্কের জন্য অবশ্য নির্বাচন কমিশনকেই দায়ী করা চলে। বেলা ৩টায় নির্বাচন কমিশনের প্রশাসনিক বিভাগ থেকে ভোট গ্রহণের যে হিসাব পাওয়া গিয়েছিল তাতে দেখা গেছে, ভোট পড়েছে মাত্র ২৮ শতাংশ।
সেখানে বিকেল ৪টার মধ্যে আরও ১৪ শতাংশ ভোট পড়ল কী করে, সেই হিসাব মিলিয়ে নির্বাচন কমিশন জনগণকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। এমনকি বিদেশি পর্যবেক্ষকেরা পর্যন্ত এ ব্যাপারে বিভ্রান্ত। জানা গেছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিশেষজ্ঞসহ যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট ও ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউটের প্রতিনিধিরাও নির্বাচন কমিশনের কাছে ভোটের সঠিক হার জানতে চেয়েছেন।
প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন আয়োজনের উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগ সভাপতি মনোনয়নবঞ্চিতদের নৌকার বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার নির্দেশ দিয়ে, দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলকে উসকে দিয়েছেন বলেও মনে করা হচ্ছে। নির্বাচনের সময় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর নেতা-কর্মীদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষের যে ঘটনা ঘটেছে তার রেশ এখনো রয়ে গেছে। প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর নেতা-কর্মীদের রেষারেষির খবর পাওয়া যায়। নির্বাচনের পর পরাজিত প্রার্থীর সমর্থকদের ওপর বিজয়ী প্রার্থীর লোকজনের হামলার অভিযোগ যেমন আছে, তেমনি আছে একে অপরকে দোষারোপের চেষ্টা। এসব কোন্দলকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন সংসদীয় আসনে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে বিভাজন দেখা দিয়েছে। নির্বাচনের আগে থেকেই বিভিন্ন এলাকায় ক্ষমতার ভাগাভাগি ও নেতৃত্ব নিয়ে নিজেদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। নির্বাচনে একাধিক প্রার্থীর পক্ষে কাজ করতে গিয়ে কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে সেই দূরত্ব আরও বেড়েছে। এই বিভেদ সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে উঠতে পারে। দলের ভেতর এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব থেকে যেতে পারে। এ নিয়ে দলের অভ্যন্তরে বিরাজ করছে চরম অস্বস্তি। সম্ভবত এ কারণেই আওয়ামী লীগের সভাপতি নৌকা ও স্বতন্ত্র বিভেদ ভুলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি ১৫ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলের যৌথ সভায় নিজেদের মধ্যে একে অপরের দোষ ধরা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেন।
গত সংসদে সংসদ সদস্যদের মধ্যে ব্যবসায়ীদের আধিক্য থাকায় প্রচুর সমালোচনা হয়েছিল। এবার সেই সংখ্যা আরও বেড়েছে। স্বাধীনতার পর জাতীয় সংসদে ব্যবসায়ীদের এই সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। ১৯৭৩ সালে প্রথম সংসদে ব্যবসায়ী যেখানে ছিল মাত্র ১৮ শতাংশ, সেখানে গত সংসদে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬২ শতাংশে। একাদশ জাতীয় সংসদে ৩০০ আসনের মধ্যে ব্যবসায়ীর সংখ্যা ছিল ১৮২। বর্তমান সংসদে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯৯ জন, যা সরাসরি ভোটে নির্বাচিত মোট সংসদ সদস্যের দুই-তৃতীয়াংশ। শতাংশের হিসাবে ৬৭। এবারের নির্বাচনে মোট ১ হাজার ৯৪৫ প্রার্থীর মধ্যে ১ হাজার ১৪২ জনই ছিলেন ব্যবসায়ী। জাতীয় সংসদে ব্যবসায়ীদের সংখ্যা এ হারে বেড়ে যাওয়ায় প্রকৃত রাজনীতিবিদেরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, আমাদের দেশে ব্যবসায়ীরা রাজনীতিতে যে বিনিয়োগ করেন, তা নিজেদের স্বার্থের জন্য। তাঁরা ধীরে ধীরে রাষ্ট্রীয়ব্যবস্থার নীতিকাঠামো দখল করে নিজেদের অর্থসম্পদ ও ব্যবসা বৃদ্ধি করে নিচ্ছেন। অতীতে দেখা গেছে, ব্যাংকিং, পোশাকশিল্প ও বিদ্যুতের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে ব্যবসায়ীরাই ঠিক করছেন নীতিকাঠামো কী হবে। এমনকি ঋণখেলাপির মতো বিষয়ের নীতিমালাও এই ব্যবসায়ী মহলই ঠিক করে দিচ্ছে।
এবারের নতুন মন্ত্রিসভার ৩৭ সদস্যের মধ্যে ১৬ জনই ব্যবসায়ী। জাতীয় সংসদে প্রকৃত রাজনীতিবিদেরা সংখ্যালঘু হয়ে পড়ায়, অনেক আইন তৈরি করার ক্ষেত্রে তাঁরা ব্যবসায়ীদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন। সংসদে প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা, নিজেদের সুবিধার জন্য ব্যবসায়ীবান্ধব নীতি তৈরি করছেন। ফলে জনগণের কল্যাণের চেয়ে ব্যবসায়ীদের স্বার্থই রক্ষা হয় বেশি। তাঁদের অনেকেই সিন্ডিকেট ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন। সে জন্য সরকারকে তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। গত মেয়াদে সরকারকে এই সিন্ডিকেট ব্যবসায়ী মহলের কাছেই একাধিকবার অসহায় হয়ে পড়তে দেখা গেছে। সংসদে এসব ব্যবসায়ীর সংখ্যা স্বাভাবিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় বেড়েছে বলা ঠিক হবে না। তাঁরা বিপুল সম্পদের মালিক হওয়ায় অর্থের জোরে রাজনৈতিক শক্তিমত্তা অর্জন করেছেন। তাঁরা ক্ষমতাসীনদের সন্তুষ্ট করেই দলে পদ ও পদবি দখল করে নিয়েছেন। ফলে প্রকৃত রাজনৈতিক নেতারা পিছিয়ে পড়ছেন।
ভোটাধিকার গণতন্ত্রচর্চার অন্যতম স্তম্ভ। এবার নিয়ে গত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে সাধারণ মানুষ তাঁদের সেই অধিকার যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে পারেননি। গণতন্ত্রের স্বাভাবিক ধারা এভাবেই বারবার বিঘ্নিত হয়েছে। প্রতিপক্ষকে রাজনৈতিক ময়দান থেকে বিতাড়িত করে যেভাবে নির্বাচনটি সম্পন্ন করা হলো, তাতে সবার মনে প্রশ্ন জেগেছে, এ দেশে আর কখনো কি সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না? নিজ দল থেকে ডামি প্রার্থী দিয়ে, শরিক ও জোটের দল নিয়ে মিলেমিশে যে নির্বাচন করা হয়েছে, তা যেকোনো বিচারে দেশের নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের সঙ্গেই তুলনা চলে। ২০১৪ সালে বিনা ভোটের নির্বাচন, ২০১৮ সালে রাতের ভোটের নির্বাচনের পর এ বছরের এই অভিনব কায়দার নির্বাচন দেশের মানুষকে সত্যিই হতাশ করেছে। এই নির্বাচন সরকারি দলের সমর্থকদের মুখে বিজয়ের হাসি ফোটালেও, প্রকৃত গণতন্ত্রকামীদের হাসি কেড়ে নিয়েছে। এমন বিজয়ে খুশি হওয়া যায়, কিন্তু গর্ব করা যায় না।
এ ধরনের একতরফা এই নির্বাচন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গণতন্ত্রের জন্য শুভ নয় বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মত পোষণ করেছেন। এবার যে অভিনব কায়দায় নির্বাচন হলো, তাতে দেশের সাধারণ মানুষ সন্তুষ্ট হতে পারেনি। আন্তর্জাতিক মহলেও এ নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক আছে। আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, ‘বিরোধী দল নির্বাচনে অংশ নেয়নি বলে দেশে গণতন্ত্র নেই, সে কথা ঠিক নয়; বরং জনগণ নির্বাচনে অংশ নিয়েছে সেটিই বড় কথা।’ তাঁর এই বক্তব্য দেশে একদলীয় শাসনের ভীতি বাড়িয়ে তুলেছে। বৃহত্তর বিরোধী দলের প্রায় সব শীর্ষ নেতাসহ শত শত নেতা-কর্মীকে জেলহাজতে আটক রেখে ক্ষমতাসীন দল যে শক্তিমত্তার পরিচয় দিয়েছে, তা দেশের গণতন্ত্রচর্চা এবং ভবিষ্যতে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের জন্য অশনিসংকেত। তা ছাড়া, সংসদে বিরোধী নেতা বা দল কে বা কারা হবে, তা-ও যদি সরকারদলীয় নেতা ঠিক করেন, তাহলে কি বলা যায় যে বাংলাদেশ বহুদলীয় উদার গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পথে এগিয়ে যাচ্ছে?
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ও কলাম লেখক
প্রবৃদ্ধির শীর্ষে থেকেও বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের দৌড়ে পিছিয়ে রয়েছে। ২০১৪ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি ৫০ দশমিক ৭৯ শতাংশ বেড়েছে
১ দিন আগেদুর্নীতি, মূল্যস্ফীতি, উচ্চ করহারসহ ১৭ ধরনের বাধায় বিপর্যস্ত দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য। রয়েছে সামাজিক সমস্যাও।
১ দিন আগেজমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
৫ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৯ দিন আগে