আজকের পত্রিকা: গত ৭৬ বছরের মধ্যে এবার দীর্ঘ সময় ধরে তাপপ্রবাহ চলছে, এর কারণ কী?
অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার: দেখুন, আমরা দেখছি যে বিগত ৭৬ বছরের মধ্যে এবার দীর্ঘ সময় ধরে তাপপ্রবাহ চলছে। বর্তমান দাবদাহ পরিস্থিতি হচ্ছে দীর্ঘদিনের পরিবেশ ধ্বংসের একটি ফলাফল। দ্রুত নগরায়ণ করতে গিয়ে আমরা পরিবেশের কথা মাথায় না রেখেই বহুতলবিশিষ্ট ভবন নির্মাণ করছি, ছোট ছোট বনাঞ্চল কেটে ফেলছি, জলাভূমি ভরাট করে ফেলছি, জনসংখ্যা বাড়ার ফলে গৃহস্থালি উষ্ণতা ও নিষ্কাশন নির্গমন বেড়েছে, নির্বিচারে গাছপালা কেটে ফেলার কারণে বৃষ্টিপাতের পরিমাণও কমে গেছে ইত্যাদি কারণের সবগুলোই বিভিন্ন উপায়ে শহরের তাপীয় অবস্থার পরিবর্তন করছে। আবার এ দেশের নদনদীগুলো বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে মেরে ফেলা হয়েছে। ফলে নদীগুলোর সংখ্যার সঙ্গে সঙ্গে দৈর্ঘ্য-প্রস্থ কমে গেছে। যেসব জায়গায় নদী কমেছে, তার কয়েকটিতে বালু ভরাট করা হয়েছে, আবার কোথাও কোথাও স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে। ফলে সেখান থেকে প্রচুর পরিমাণ তাপ ছড়িয়ে পড়ছে। অন্যদিকে বালু থাকার কারণে মরুময় একটি অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে এবং এসব কারণে আশপাশের অঞ্চলের তাপমাত্রা বাড়ছে। দাবদাহের এই বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ঢাকাসহ অন্যান্য জেলা শহরে দিন ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য বা তারতম্য কমে আসবে, যার কারণে সব সময়ই গরম অনুভূত হবে।
আজকের পত্রিকা: এই তাপপ্রবাহ কতটা মানবসৃষ্ট এবং কতটা প্রাকৃতিক?
অধ্যাপক কামরুজ্জমান: এটি একটি স্বাভাবিক ঘটনা বলে মনে হলেও অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ণ ও শিল্প কর্মকাণ্ডই এর পেছনে প্রধান কারণ। পরিবেশের এই অস্বাভাবিকতার জন্য আমাদের কৃতকর্মই অধিকাংশে দায়ী।
আজকের পত্রিকা: ঢাকা কেন ক্রমেই উত্তপ্ত হচ্ছে?
অধ্যাপক কামরুজ্জমান: ঢাকা শহর বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলোর একটি। এই মেগাসিটির জনসংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। তাপমাত্রা বাড়ার জন্য জলবায়ু পরিবর্তন যতটা দায়ী, তার চেয়ে অনেক বেশি দায়ী অপরিকল্পিত নগরায়ণ, নগরে বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব ও পরিবেশ ব্যবস্থাপনা। প্রধানত বৈশ্বিক, আঞ্চলিক ও স্থানীয়—এই তিন কারণে ঢাকা শহরের তাপমাত্রা বাড়ছে। তবে তাপমাত্রা বাড়াতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে স্থানীয় কারণগুলো। স্থানীয় কারণগুলোর মধ্যে প্রধান কারণ হলো ঢাকা শহরের সবুজায়ন কমে যাওয়া। একসময় বাংলাদেশে ২৫ ভাগের বেশি সবুজায়ন থাকলেও বর্তমানে এর পরিমাণ মাত্র ১৭ ভাগে এসে দাঁড়িয়েছে। এখন শহরের সৌন্দর্যবর্ধনের নামে রাস্তা বিভাজনের বড় বড় গাছগুলো কেটে ফেলা হচ্ছে। ফলে বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেন ও জলীয়বাষ্প কমে গিয়ে তাপমাত্রা বাড়ছে এবং বৃষ্টিপাত কমে যাচ্ছে।
তাপমাত্রা বাড়ার দ্বিতীয় অন্যতম কারণ হলো জলাধার কমে যাওয়া। গবেষণা থেকে দেখা যায়, ঢাকা শহরের জলাধার বা পুকুরের পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে কমছে এবং জলাধারগুলো মাটির পরিবর্তে বালু দিয়ে ভরাট করা হচ্ছে। ঢাকা শহরের ৩৬টি স্থান নিয়ে বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব এলাকায় সবুজের উপস্থিতি রয়েছে, সেসব এলাকায় তাপমাত্রা তুলনামূলক কম। এর মধ্যে ৯টি স্থানে ছিল তাপমাত্রা বেশি। কারণ এগুলোতে গাছপালা কম ছিল। আর বাকি ৯টি স্থানে গাছপালা বেশি থাকায় তাপমাত্রাও কম ছিল। এতেই প্রমাণিত, সবুজ জলাভূমি তাপমাত্রার তারতম্যের অন্যতম উৎস।
তৃতীয়ত, ঢাকার অত্যধিক জনসংখ্যাও তাপমাত্রা বাড়াতে ভূমিকা রাখছে। ইউএস-ইপিএর মতে, সাধারণত প্রতি ১০ লাখ লোকের জন্য যেকোনো এলাকার তাপমাত্রা ১.৮-৫.৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট বাড়তে পারে। আবার মানুষের শরীরের একটি নিজস্ব তাপমাত্রা রয়েছে, যাকে বলা হয় মেটাবোলিক হিটিং এবং প্রত্যেক ব্যক্তির ক্ষেত্রেই এই তাপমাত্রার পরিমাণ ১০০ ওয়াট। অর্থাৎ, একই স্থানে যত বেশিসংখ্যক মানুষ থাকবে, সেই স্থানের তাপমাত্রা ততই বেশি হবে। ঢাকা শহরের বর্তমান জনসংখ্যা ২ কোটির বেশি, যেটি প্রত্যক্ষভাবে তাপমাত্রা বাড়াচ্ছে। এ ছাড়া নগরের একটি বিশাল অংশের মানুষ রান্নার কাজে কাঠ পুড়িয়ে থাকে। এর বাইরে নগরীতে প্রায় ২০ লাখ পরিবার রয়েছে, যাদের ২০ লাখ চুলায় গড়ে প্রতিদিন কমপক্ষে তিন ঘণ্টা করে রান্নার কাজ চলে।
ঢাকায় তাপমাত্রা বৃদ্ধির চতুর্থ কারণ হলো যত্রতত্র বর্জ্য পোড়ানো। বর্জ্যের ভেতরে থাকা প্লাস্টিক পোড়ানোর ফলে বিভিন্ন রকম দূষিত গ্যাস ও মাইক্রো প্লাস্টিক বস্তুকণা বাতাসের সঙ্গে মিশে বাতাসকে দূষিত করছে। বাতাসে ভাসমান এই প্লাস্টিক কণাগুলো তাপ ধরে রেখে বায়ুমণ্ডলকে উত্তপ্ত করে তুলছে।
পঞ্চমত, রাজধানীর অধিক যানবাহন, যানজট সমস্যাও তাপমাত্রা বাড়াতে ভূমিকা রাখছে। যানজটের কারণে গাড়িগুলোকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ইঞ্জিন চালু রেখে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এতে করে ইঞ্জিন থেকে নির্গত তাপ বাতাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে শহরের পরিবেশকে উত্তপ্ত করে তোলে।
ষষ্ঠ কারণের মধ্যে রয়েছে ঢাকা শহরের পিচঢালা রাস্তা ও ফুটপাতে ঘাসের পরিবর্তে পাকাকরণ। দিনের বেলায় এই রাস্তা ও ফুটপাত উত্তপ্ত হয় এবং রাতের প্রথম ভাগ পর্যন্ত তাপ ধারণ করে এবং গভীর রাতে তাপ নির্গমনের মাধ্যমে নগরে তাপ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে।
ফুটপাতে ঘাসের পরিবর্তে এখন পাকাকরণ হচ্ছে, যার কারণে পানি মাটিতে প্রবেশ করতে পারে না। ফলে পাকার নিচের মাটিও উত্তপ্ত হয়ে যায়, যা তাপমাত্রা বাড়াতে ভূমিকা রাখে। সপ্তম কারণ হলো, নতুন করে তৈরিকৃত বহুতল ভবনগুলোতে অতিরিক্ত গ্লাসের ও এসির ব্যবহার এবং ভবনের ভেতরের সরু রাস্তা। এতে করে গ্লাসে ধারণ করা তাপ ও এসি থেকে নিঃসৃত তাপ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে তাপমাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়। আবার ভবনের ভেতরকার সরু রাস্তা বায়ুর স্বাভাবিক চলাচলকে বাধাগ্রস্ত করে, যার ফলে দুপুরের চরম
তাপ ভবনগুলোর মাঝে ট্র্যাপ হয়ে যায় এবং হঠাৎ করেই সন্ধ্যার পর ওই এলাকার তাপমাত্রা বেশি পরিলক্ষিত হয়।
আজকের পত্রিকা: উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর কার্বন নিঃসরণ বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে তাপপ্রবাহ বাড়ার কারণ নয় কি?
অধ্যাপক কামরুজ্জমান: জার্মানভিত্তিক গবেষণা সংস্থা জার্মান ওয়াচের ‘ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স-২০১৫’ শীর্ষক প্রতিবেদন বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর বেশির ভাগই দরিদ্র, যার শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। উন্নত বিশ্বের দেশসমূহের কার্বন নিঃসরণ বাংলাদেশের মতো দেশসমূহে তাপপ্রবাহ বাড়ার অন্যতম কারণ। কার্বন নিঃসরণে খুব একটা দায়ী না হয়েও এর ফল ভোগ করছে বাংলাদেশ।
আজকের পত্রিকা: ঢাকাকে পরিবেশবান্ধব করতে রাজউক, সিটি করপোরেশনের ব্যর্থতা কতটুকু?
অধ্যাপক কামরুজ্জমান: আমার মতে, ঢাকাকে পরিবেশবান্ধব করতে রাজউক ও সিটি করপোরেশনগুলো তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে, কিন্তু তারাই একমাত্র দায়ী কর্তৃপক্ষ নয়। এই দায়ভার সবার। সবাইকে নিজ নিজ জায়গা থেকে দায়িত্ব পালন করতে হবে। সমন্বিতভাবে সবাইকে একযোগে কাজ করে যেতে হবে।
আজকের পত্রিকা: তাপপ্রবাহ মোকাবিলায় করণীয় কী?
অধ্যাপক কামরুজ্জমান: ঢাকা শহরের এই ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য প্রথমে যে পদক্ষেপ নিতে হবে, তা হলো শহরের প্রতিটি ফাঁকা স্থানে গাছ লাগাতে হবে। রাস্তার বিভাজনে শোভাবর্ধনকারী গাছ ছাড়াও ভূমির ধরনের ভিত্তিতে বিভিন্ন রকম উপকারী বৃক্ষ যেমন—বিভিন্ন ফলের গাছ, ঔষধি গাছ, কাষ্ঠল গাছও রোপণ করতে হবে। ছাদবাগান বাড়াতে হবে। গাছ কাটা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে হবে। একটি বনাঞ্চল সরাসরি তাপ ও কার্বন নির্গমন হ্রাস করে। ঢাকার সব জলাভূমি সংরক্ষণ করতে হবে।দখলকৃত জলাভূমি উদ্ধার ও নতুন জলাধারের পরিমাণও বাড়াতে হবে। জলাভূমি ভরাট করে কোনো স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না।
প্রয়োজনে আইন প্রয়োগের মাধ্যমে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অবকাঠামো নির্মাণের সময়ও সচেতন হতে হবে এবং একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে ভবন নির্মাণ করতে হবে। ভবন তৈরির সময় ভবনের মাঝে প্রাকৃতিক বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা রাখতে হবে। রাস্তায় সাদা রং (এসআরআই) ব্যবহার করা যেতে পারে। পর্যাপ্ত যাত্রীছাউনি ও জরুরি নিরুত্তাপ কেন্দ্রের ব্যবস্থা করতে হবে। জরুরি মুহূর্তে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা উচিত। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং শহরাঞ্চল থেকে মানুষের আধিক্য কমাতে হবে। যত্রতত্র প্লাস্টিক ও অন্যান্য বর্জ্য পোড়ানো থেকে বিরত থাকতে হবে এবং প্লাস্টিক বর্জ্যকে যথাযথ ব্যবস্থাপনার আওতায় আনতে হবে। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ করতে হবে এবং এর পরিবর্তে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। শহরের স্থানীয়, ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জননীতি মাথায় রেখে পরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরি। সর্বোপরি সবাইকে এই তাপপ্রবাহ কমানোর লক্ষ্যে একযোগে কাজ করে যেতে হবে।
আজকের পত্রিকা: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
অধ্যাপক কামরুজ্জমান: আপনাকেও ধন্যবাদ।
আজকের পত্রিকা: গত ৭৬ বছরের মধ্যে এবার দীর্ঘ সময় ধরে তাপপ্রবাহ চলছে, এর কারণ কী?
অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার: দেখুন, আমরা দেখছি যে বিগত ৭৬ বছরের মধ্যে এবার দীর্ঘ সময় ধরে তাপপ্রবাহ চলছে। বর্তমান দাবদাহ পরিস্থিতি হচ্ছে দীর্ঘদিনের পরিবেশ ধ্বংসের একটি ফলাফল। দ্রুত নগরায়ণ করতে গিয়ে আমরা পরিবেশের কথা মাথায় না রেখেই বহুতলবিশিষ্ট ভবন নির্মাণ করছি, ছোট ছোট বনাঞ্চল কেটে ফেলছি, জলাভূমি ভরাট করে ফেলছি, জনসংখ্যা বাড়ার ফলে গৃহস্থালি উষ্ণতা ও নিষ্কাশন নির্গমন বেড়েছে, নির্বিচারে গাছপালা কেটে ফেলার কারণে বৃষ্টিপাতের পরিমাণও কমে গেছে ইত্যাদি কারণের সবগুলোই বিভিন্ন উপায়ে শহরের তাপীয় অবস্থার পরিবর্তন করছে। আবার এ দেশের নদনদীগুলো বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে মেরে ফেলা হয়েছে। ফলে নদীগুলোর সংখ্যার সঙ্গে সঙ্গে দৈর্ঘ্য-প্রস্থ কমে গেছে। যেসব জায়গায় নদী কমেছে, তার কয়েকটিতে বালু ভরাট করা হয়েছে, আবার কোথাও কোথাও স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে। ফলে সেখান থেকে প্রচুর পরিমাণ তাপ ছড়িয়ে পড়ছে। অন্যদিকে বালু থাকার কারণে মরুময় একটি অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে এবং এসব কারণে আশপাশের অঞ্চলের তাপমাত্রা বাড়ছে। দাবদাহের এই বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ঢাকাসহ অন্যান্য জেলা শহরে দিন ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য বা তারতম্য কমে আসবে, যার কারণে সব সময়ই গরম অনুভূত হবে।
আজকের পত্রিকা: এই তাপপ্রবাহ কতটা মানবসৃষ্ট এবং কতটা প্রাকৃতিক?
অধ্যাপক কামরুজ্জমান: এটি একটি স্বাভাবিক ঘটনা বলে মনে হলেও অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ণ ও শিল্প কর্মকাণ্ডই এর পেছনে প্রধান কারণ। পরিবেশের এই অস্বাভাবিকতার জন্য আমাদের কৃতকর্মই অধিকাংশে দায়ী।
আজকের পত্রিকা: ঢাকা কেন ক্রমেই উত্তপ্ত হচ্ছে?
অধ্যাপক কামরুজ্জমান: ঢাকা শহর বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলোর একটি। এই মেগাসিটির জনসংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। তাপমাত্রা বাড়ার জন্য জলবায়ু পরিবর্তন যতটা দায়ী, তার চেয়ে অনেক বেশি দায়ী অপরিকল্পিত নগরায়ণ, নগরে বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব ও পরিবেশ ব্যবস্থাপনা। প্রধানত বৈশ্বিক, আঞ্চলিক ও স্থানীয়—এই তিন কারণে ঢাকা শহরের তাপমাত্রা বাড়ছে। তবে তাপমাত্রা বাড়াতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে স্থানীয় কারণগুলো। স্থানীয় কারণগুলোর মধ্যে প্রধান কারণ হলো ঢাকা শহরের সবুজায়ন কমে যাওয়া। একসময় বাংলাদেশে ২৫ ভাগের বেশি সবুজায়ন থাকলেও বর্তমানে এর পরিমাণ মাত্র ১৭ ভাগে এসে দাঁড়িয়েছে। এখন শহরের সৌন্দর্যবর্ধনের নামে রাস্তা বিভাজনের বড় বড় গাছগুলো কেটে ফেলা হচ্ছে। ফলে বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেন ও জলীয়বাষ্প কমে গিয়ে তাপমাত্রা বাড়ছে এবং বৃষ্টিপাত কমে যাচ্ছে।
তাপমাত্রা বাড়ার দ্বিতীয় অন্যতম কারণ হলো জলাধার কমে যাওয়া। গবেষণা থেকে দেখা যায়, ঢাকা শহরের জলাধার বা পুকুরের পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে কমছে এবং জলাধারগুলো মাটির পরিবর্তে বালু দিয়ে ভরাট করা হচ্ছে। ঢাকা শহরের ৩৬টি স্থান নিয়ে বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব এলাকায় সবুজের উপস্থিতি রয়েছে, সেসব এলাকায় তাপমাত্রা তুলনামূলক কম। এর মধ্যে ৯টি স্থানে ছিল তাপমাত্রা বেশি। কারণ এগুলোতে গাছপালা কম ছিল। আর বাকি ৯টি স্থানে গাছপালা বেশি থাকায় তাপমাত্রাও কম ছিল। এতেই প্রমাণিত, সবুজ জলাভূমি তাপমাত্রার তারতম্যের অন্যতম উৎস।
তৃতীয়ত, ঢাকার অত্যধিক জনসংখ্যাও তাপমাত্রা বাড়াতে ভূমিকা রাখছে। ইউএস-ইপিএর মতে, সাধারণত প্রতি ১০ লাখ লোকের জন্য যেকোনো এলাকার তাপমাত্রা ১.৮-৫.৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট বাড়তে পারে। আবার মানুষের শরীরের একটি নিজস্ব তাপমাত্রা রয়েছে, যাকে বলা হয় মেটাবোলিক হিটিং এবং প্রত্যেক ব্যক্তির ক্ষেত্রেই এই তাপমাত্রার পরিমাণ ১০০ ওয়াট। অর্থাৎ, একই স্থানে যত বেশিসংখ্যক মানুষ থাকবে, সেই স্থানের তাপমাত্রা ততই বেশি হবে। ঢাকা শহরের বর্তমান জনসংখ্যা ২ কোটির বেশি, যেটি প্রত্যক্ষভাবে তাপমাত্রা বাড়াচ্ছে। এ ছাড়া নগরের একটি বিশাল অংশের মানুষ রান্নার কাজে কাঠ পুড়িয়ে থাকে। এর বাইরে নগরীতে প্রায় ২০ লাখ পরিবার রয়েছে, যাদের ২০ লাখ চুলায় গড়ে প্রতিদিন কমপক্ষে তিন ঘণ্টা করে রান্নার কাজ চলে।
ঢাকায় তাপমাত্রা বৃদ্ধির চতুর্থ কারণ হলো যত্রতত্র বর্জ্য পোড়ানো। বর্জ্যের ভেতরে থাকা প্লাস্টিক পোড়ানোর ফলে বিভিন্ন রকম দূষিত গ্যাস ও মাইক্রো প্লাস্টিক বস্তুকণা বাতাসের সঙ্গে মিশে বাতাসকে দূষিত করছে। বাতাসে ভাসমান এই প্লাস্টিক কণাগুলো তাপ ধরে রেখে বায়ুমণ্ডলকে উত্তপ্ত করে তুলছে।
পঞ্চমত, রাজধানীর অধিক যানবাহন, যানজট সমস্যাও তাপমাত্রা বাড়াতে ভূমিকা রাখছে। যানজটের কারণে গাড়িগুলোকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ইঞ্জিন চালু রেখে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এতে করে ইঞ্জিন থেকে নির্গত তাপ বাতাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে শহরের পরিবেশকে উত্তপ্ত করে তোলে।
ষষ্ঠ কারণের মধ্যে রয়েছে ঢাকা শহরের পিচঢালা রাস্তা ও ফুটপাতে ঘাসের পরিবর্তে পাকাকরণ। দিনের বেলায় এই রাস্তা ও ফুটপাত উত্তপ্ত হয় এবং রাতের প্রথম ভাগ পর্যন্ত তাপ ধারণ করে এবং গভীর রাতে তাপ নির্গমনের মাধ্যমে নগরে তাপ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে।
ফুটপাতে ঘাসের পরিবর্তে এখন পাকাকরণ হচ্ছে, যার কারণে পানি মাটিতে প্রবেশ করতে পারে না। ফলে পাকার নিচের মাটিও উত্তপ্ত হয়ে যায়, যা তাপমাত্রা বাড়াতে ভূমিকা রাখে। সপ্তম কারণ হলো, নতুন করে তৈরিকৃত বহুতল ভবনগুলোতে অতিরিক্ত গ্লাসের ও এসির ব্যবহার এবং ভবনের ভেতরের সরু রাস্তা। এতে করে গ্লাসে ধারণ করা তাপ ও এসি থেকে নিঃসৃত তাপ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে তাপমাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়। আবার ভবনের ভেতরকার সরু রাস্তা বায়ুর স্বাভাবিক চলাচলকে বাধাগ্রস্ত করে, যার ফলে দুপুরের চরম
তাপ ভবনগুলোর মাঝে ট্র্যাপ হয়ে যায় এবং হঠাৎ করেই সন্ধ্যার পর ওই এলাকার তাপমাত্রা বেশি পরিলক্ষিত হয়।
আজকের পত্রিকা: উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর কার্বন নিঃসরণ বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে তাপপ্রবাহ বাড়ার কারণ নয় কি?
অধ্যাপক কামরুজ্জমান: জার্মানভিত্তিক গবেষণা সংস্থা জার্মান ওয়াচের ‘ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স-২০১৫’ শীর্ষক প্রতিবেদন বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর বেশির ভাগই দরিদ্র, যার শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। উন্নত বিশ্বের দেশসমূহের কার্বন নিঃসরণ বাংলাদেশের মতো দেশসমূহে তাপপ্রবাহ বাড়ার অন্যতম কারণ। কার্বন নিঃসরণে খুব একটা দায়ী না হয়েও এর ফল ভোগ করছে বাংলাদেশ।
আজকের পত্রিকা: ঢাকাকে পরিবেশবান্ধব করতে রাজউক, সিটি করপোরেশনের ব্যর্থতা কতটুকু?
অধ্যাপক কামরুজ্জমান: আমার মতে, ঢাকাকে পরিবেশবান্ধব করতে রাজউক ও সিটি করপোরেশনগুলো তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে, কিন্তু তারাই একমাত্র দায়ী কর্তৃপক্ষ নয়। এই দায়ভার সবার। সবাইকে নিজ নিজ জায়গা থেকে দায়িত্ব পালন করতে হবে। সমন্বিতভাবে সবাইকে একযোগে কাজ করে যেতে হবে।
আজকের পত্রিকা: তাপপ্রবাহ মোকাবিলায় করণীয় কী?
অধ্যাপক কামরুজ্জমান: ঢাকা শহরের এই ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য প্রথমে যে পদক্ষেপ নিতে হবে, তা হলো শহরের প্রতিটি ফাঁকা স্থানে গাছ লাগাতে হবে। রাস্তার বিভাজনে শোভাবর্ধনকারী গাছ ছাড়াও ভূমির ধরনের ভিত্তিতে বিভিন্ন রকম উপকারী বৃক্ষ যেমন—বিভিন্ন ফলের গাছ, ঔষধি গাছ, কাষ্ঠল গাছও রোপণ করতে হবে। ছাদবাগান বাড়াতে হবে। গাছ কাটা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে হবে। একটি বনাঞ্চল সরাসরি তাপ ও কার্বন নির্গমন হ্রাস করে। ঢাকার সব জলাভূমি সংরক্ষণ করতে হবে।দখলকৃত জলাভূমি উদ্ধার ও নতুন জলাধারের পরিমাণও বাড়াতে হবে। জলাভূমি ভরাট করে কোনো স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না।
প্রয়োজনে আইন প্রয়োগের মাধ্যমে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অবকাঠামো নির্মাণের সময়ও সচেতন হতে হবে এবং একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে ভবন নির্মাণ করতে হবে। ভবন তৈরির সময় ভবনের মাঝে প্রাকৃতিক বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা রাখতে হবে। রাস্তায় সাদা রং (এসআরআই) ব্যবহার করা যেতে পারে। পর্যাপ্ত যাত্রীছাউনি ও জরুরি নিরুত্তাপ কেন্দ্রের ব্যবস্থা করতে হবে। জরুরি মুহূর্তে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা উচিত। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং শহরাঞ্চল থেকে মানুষের আধিক্য কমাতে হবে। যত্রতত্র প্লাস্টিক ও অন্যান্য বর্জ্য পোড়ানো থেকে বিরত থাকতে হবে এবং প্লাস্টিক বর্জ্যকে যথাযথ ব্যবস্থাপনার আওতায় আনতে হবে। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ করতে হবে এবং এর পরিবর্তে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। শহরের স্থানীয়, ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জননীতি মাথায় রেখে পরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরি। সর্বোপরি সবাইকে এই তাপপ্রবাহ কমানোর লক্ষ্যে একযোগে কাজ করে যেতে হবে।
আজকের পত্রিকা: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
অধ্যাপক কামরুজ্জমান: আপনাকেও ধন্যবাদ।
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
৪ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৭ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৭ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
১১ দিন আগে