জাহীদ রেজা নূর
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে পৃথিবীর মানুষ শান্তিতে নেই। দেশ চালায় যারা, তারাই যুদ্ধ বাধায়। কোনো দেশের মানুষ যুদ্ধ চায় না। তারপরও দেশের দণ্ডমুণ্ডের কর্তাদের কৌশলের শিকার হতে হয় তাদের। যুগে যুগে এভাবেই সাধারণ মানুষকে বহন করতে হয়েছে রাষ্ট্রনেতাদের একনায়কতন্ত্রের ভার।
রাশিয়া আর ইউক্রেন আমাদের দেশের থেকে অনেক অনেক দূরের দেশ। ওই দেশ দুটোর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক রয়েছে ভাষাভিত্তিক পরিচয়ের মধ্যে। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর সদস্য আমরা। যদিও রুশ ও ইউক্রেনীয় ভাষার উৎপত্তি হয়েছে আদি স্লাভিয়ান ভাষা থেকে, কিন্তু তারও বহু আগে যখন ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা নানাভাবে নানা দেশে ছড়িয়ে গেছে, তখনই তার একটি অংশ ইন্দো-ইরানীয় হয়ে ঢুকে গেছে আমাদের ভূখণ্ডে। ফলে কিছু কিছু শব্দ আছে, যা রুশ আর বাংলা ভাষায় একই রকম। উদাহরণ? এই নিন: বাংলা আগুন রুশ ভাষায় আগোন, বাংলা দুয়ার রুশ ভাষায় দুয়ের (dver), বাংলায় ‘আমি কোপাই’ রুশ ভাষায় ‘ইয়া কাপায়ু’।
ভাষা নিয়ে আলোচনা খুবই আকর্ষণীয় বিষয়। কিন্তু এ মুহূর্তে সে আলোচনা খুব দরকারি নয়। যুদ্ধে জড়িয়ে যাওয়া ভাই-রাষ্ট্র দুটোর হানাহানির প্রভাব আমাদের দেশে কতটা পড়বে, সেটা নিয়েই কথা হতে পারে।
দুই.
আমি মোটেও বলার চেষ্টা করছি না, এই কিছুদিন আগে ভোজ্যতেলের দাম যেভাবে বাড়ানো হলো, তাতে আমার সায় আছে। সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে ব্যবসায়ীরাই যখন তেলের দাম নির্ধারণ করে দেন এবং দেশের কোনো কোনো মন্ত্রী যখন এর সঙ্গে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রসঙ্গকে জুড়ে দেন, তখন তা নিয়ে কারও মনে প্রশ্ন উঠলে তা অগ্রাহ্য করা ঠিক হবে না। কথাটা সত্য, এই যুদ্ধের ফলে পৃথিবীব্যাপী প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম অনেক বেড়ে যাচ্ছে, যাবে। তার আলামত পাওয়া যাচ্ছে সর্বত্রই। কিন্তু মিলমালিকেরা কিংবা তাঁদের ডিলাররা কিংবা বড় বড় প্রতিষ্ঠান তেলের দাম বাড়ানোর আগে আগে বাজার থেকে তেল উধাও করে দিয়েছিল কেন, সে প্রশ্নের উত্তর কি তারা দিতে পারবে? যদি তারা বলে, ‘না, আমরা ধোয়া তুলসীপাতা, এ ধরনের অন্যায় কাজ আমরা করিনি’, তাহলে উল্টো প্রশ্ন করতে হবে, অভিযান চালিয়ে এই যে বিভিন্ন জায়গা থেকে টনকে টন লুকিয়ে রাখা তেল উদ্ধার হচ্ছে, এগুলো কি হাওয়া থেকে ভেসে এসেছে?
বাজার থেকে পণ্য উধাও করে দেন যাঁরা, তাঁরা কখনোই সৎ ব্যবসায়ী হতে পারেন না। যে গণতান্ত্রিক দেশের স্বপ্ন আমরা দেখি, সেই গণতান্ত্রিক দেশে তাঁদের নাম হওয়া উচিত ‘মজুতদার, ডাকাত, মুনাফাখোর’। কিন্তু যে কারণেই হোক, তাঁদের আমরা ব্যবসায়ী বলেই সার্টিফিকেট দিয়েছি। তাঁরা যেভাবে চাইছেন, সেভাবেই তেলের মূল্য নির্ধারণ করছেন, এমনকি দাম বাড়ার আগে যে তেল বাজারে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল, সেই তেলেরও ভাগ্য খুলেছে। সে তেল নতুন দামে বিক্রি হওয়ায় মুনাফাখোরেরা তাঁদের ব্যাংক ব্যালান্স বাড়িয়ে নিতে পেরেছেন।
পেঁয়াজের ক্ষেত্রেও কি একই কথা বলা যায় না? বলা হলো কৃষকদের কথা ভেবে ভারতীয় পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ রাখা হয়েছে। তাতে ফল কী হলো? পেঁয়াজের পাইকারি মূল্য বেড়ে গেল কেজিতে ৫ টাকা, আর ক্রেতার কাছে পৌঁছাতে সে মূল্য বাড়ল ১৫ টাকা। এই টাকা কি কৃষকের হাতে গেল নাকি ওই মজুতদার, মুনাফাখোরদের হাতে গেল? অর্থনীতির সবচেয়ে গবেট ছাত্রটিও এইপ্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে। যুদ্ধ যে মজুতদারদের এভারেস্ট শৃঙ্গে ওঠার সুযোগ করে দেয়, তা ইতিহাসের সব ক্ষেত্রেই দেখা গেছে। সরকার যদি শক্ত হাতে তাঁদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে, তাহলে যুদ্ধের কারণে সাধারণ নাগরিক জীবনের যতটা ক্লেশের সম্মুখীন হওয়ার কথা, তার চেয়ে অনেক বেশি ক্লেশের মুখোমুখি হতে হবে। আর তাতে যে নৈরাজ্যের সৃষ্টি হবে, তা থেকে রক্ষা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।
তিন.
চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী যে সংকটের সৃষ্টি করতে পারে, তা নিয়ে এবার কিছু কথা বলা যাক।
এ কথা সত্য, রাশিয়া আর ইউক্রেনের মধ্যে যে যুদ্ধ চলছে, তা শুধু দেশ দুটিতে ধ্বংস আর মৃত্যুই ডেকে আনছে না, সারা বিশ্বকেই তা প্রভাবিত করছে; বিশেষ করে তা সারা বিশ্বকেই প্রবল খাদ্যসংকটের মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। রাশিয়া আর ইউক্রেন থেকে খাদ্য আমদানি করে যে দেশগুলো নিজ দেশের খাদ্যসংকটের মোকাবিলা করে, তারা পড়বে মহা সংকটে। ইতিমধ্যে সেই সংকট শুরু হয়ে গেছে। ধনী দেশগুলো সংকটে পড়লেও নানাভাবে তারা সেই সংকট সামাল দিতে পারবে, কিন্তু দরিদ্র দেশগুলোর কী হবে? দরিদ্র দেশগুলোর বেশির ভাগেরই অবস্থান এশিয়া আর আফ্রিকায়।
আমরা জ্বালানি তেল ও গ্যাসের আলোচনা পাশে রেখে দিই। আগে কথা বলি খাদ্য ও ভোজ্যতেল নিয়ে। রাশিয়া আর ইউক্রেন থেকে সারা বিশ্বে খাদ্য ও ভোজ্যতেল রপ্তানি হতো। যুদ্ধ সেই রপ্তানি প্রক্রিয়াকে থামিয়ে দিয়েছে। ইউরোপের শস্যভান্ডার নামে খ্যাত ইউক্রেনে এখন ফসল রোপণ করার চেয়ে মাইন বোনা ফরজ হয়ে উঠেছে।
ফসলের মাঠ যখন মাইনের মাঠে পরিণত হয়, তখন তার প্রভাব শুধু সেই মাটিতেই পড়ে না। যে দেশগুলো এই ফসলের দিকে চেয়ে থাকে বাঁচার দাবিতে, সেই দেশের জনগণের অবস্থাও হয় ত্রাহি মধুসূদন। যে পরিবারের আয়ের সিংহভাগ খরচ হয় খাদ্যদ্রব্য কিনতে, দাম বেড়ে গেলে তাদের অবস্থা কী হতে পারে, সেটা নিশ্চয়ই বুঝিয়ে বলতে হবে না।
রাশিয়া আর ইউক্রেন থেকে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি গম আমদানি করে। যুদ্ধের কারণে গম আমদানি বিঘ্নিত হতে পারে। সয়াবিন তেলের পরিবর্তে সরিষার তেল, পাম অয়েল, সূর্যমুখী তেল ব্যবহারের কথাও ভাবছেন অনেকে। সূর্যমুখী তেলের আশি শতাংশও তো আসে ওই দুটি দেশ থেকে! গমের দাম বাড়লে বেকারি পণ্য, ফাস্ট ফুডের দাম বাড়বে। তার চেয়ে বড় কথা, সাধারণ মানুষের রুটি-ভাজির জীবনেও এসে লাগবে বড় ধাক্কা!
চার.
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, সে ব্যাপারে সবারই ধারণা আছে। এই মূল্যবৃদ্ধি মূলত শাণিত ছুরির মতো আঘাত করে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষের শরীরে। এরই মধ্যে আমরা শিখে নিয়েছি, জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে তার প্রভাবে বেড়ে যায় পরিবহনের ভাড়া। পণ্য পরিবহনের জন্য বেশি অর্থ খরচ করা হলে সেই পণ্যের দাম বাড়বে, যাত্রী পরিবহনেও আসবে পরিবর্তন। দাম বাড়িয়ে দেবে পরিবহন মালিকেরা।
আমাদের দেশে এসব ক্ষেত্রে সততা এতটাই ভঙ্গুর অবস্থানে আছে যে জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে তার ভয়াবহ প্রভাবের শিকার হবে সাধারণ যাত্রীরা। আমরা তো এ-ও দেখেছি, জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে গ্যাসে চলা পরিবহনের ভাড়াও বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে! এই অসততার বিরুদ্ধে কি কোনো পদক্ষেপ নেওয়া গেছে? নেওয়ার উদাহরণ আছে?
আর কৃষি খাত? কৃষি উৎপাদনেও যে এর প্রভাব পড়বে, তা বলা বাহুল্য। বিদ্যুৎ? তেল ও গ্যাসের দাম বাড়লে বিদ্যুতের দাম এক জায়গায় স্থির থাকবে, এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। এখন পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এই দুটি জ্বালানিই ব্যবহার করা হয়।
ইচ্ছে করেই আলোচনায় পর্যটনশিল্পের কথা আনা হলো না। বিভিন্ন দেশের পর্যটন খাত বিপর্যস্ত হওয়ায় সেসব দেশের অর্থনীতিতে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এই খাত থেকে আয় কমে যাওয়ায় বিপদেও আছে দেশগুলো। আশপাশের দেশ থেকে রাশিয়ায় কাজ করতে যাওয়া শ্রমিকেরাও পড়েছেন বিপদে।
পাঁচ.
আরেকটু বিস্তার ঘটানো যাক ভাবনাটার। দুর্ভিক্ষ কি সমাসন্ন?
প্রাচ্যের আর উত্তর আফ্রিকার গরিব দেশগুলোকে নিয়ে আশঙ্কা আছে। এই দেশগুলো প্রায় ৯০ শতাংশ খাদ্যই আমদানি করে থাকে, আর দুশ্চিন্তার ব্যাপার হলো, এই খাদ্য আসে মূলত রাশিয়া আর ইউক্রেন থেকে।
অনেকেরই মনে পড়ে যাবে, বছর দশেক আগে লিবিয়া, তিউনিসিয়া, মিসর, ইয়েমেন, সিরিয়ায় যখন ক্ষমতার পালাবদল শুরু হয়েছিল, যার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘আরব বসন্ত’, তারই অভিঘাতে তর তর করে বেড়ে গিয়েছিল খাদ্যদ্রব্যের দাম। এবার রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে তুরস্ক, মিসর, ভারত, থাইল্যান্ড, জর্জিয়া, আর্মেনিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, লেবানন, এমনকি শ্রীলঙ্কাও ভুগতে পারে। এই তালিকায় বাংলাদেশের নামটিও থাকবে অনিবার্যভাবে। কীভাবে সে সংকট মোকাবিলা করা হবে, সেটাই হতে হবে এখনকার আলোচনা। তা না করে, একদল মানুষ রোবটের মতো বলে যাবে, ‘আমাদের দেশ শ্রীলঙ্কার মতো হবে না,’ আরেক দল বলবে, ‘সবুর করো, কটা বছর যেতে দাও, এ দেশটাও হবে শ্রীলঙ্কার মতো’—এটা কোনো সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি হতে পারে না। গলাবাজি করা আর বাস্তব সংকট দেখে ব্যবস্থা নেওয়া এক কথা নয়।
সামনে আসছে কঠিন সময়। এ সময়টার মোকাবিলা করতে হবে বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত নিয়ে। জনগণ কোন ধরনের সংকটে পড়তে পারে, তার আগাম বার্তা যেমন দেওয়া দরকার, তেমনি সেই সংকট থেকে জনগণকে বাঁচানোর জন্য কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, সেটাও ঘোষণা করা দরকার। নইলে আঘাত যখন আসবে, তখন
তা সামাল দেওয়ার প্রস্তুতি থাকবে না। আর সেটা যে ভয়াবহ পরিণতি নিয়ে আসবে, তা ভাবতেও ভয় লাগে।
লেখক: জাহীদ রেজা নূর, উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে পৃথিবীর মানুষ শান্তিতে নেই। দেশ চালায় যারা, তারাই যুদ্ধ বাধায়। কোনো দেশের মানুষ যুদ্ধ চায় না। তারপরও দেশের দণ্ডমুণ্ডের কর্তাদের কৌশলের শিকার হতে হয় তাদের। যুগে যুগে এভাবেই সাধারণ মানুষকে বহন করতে হয়েছে রাষ্ট্রনেতাদের একনায়কতন্ত্রের ভার।
রাশিয়া আর ইউক্রেন আমাদের দেশের থেকে অনেক অনেক দূরের দেশ। ওই দেশ দুটোর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক রয়েছে ভাষাভিত্তিক পরিচয়ের মধ্যে। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর সদস্য আমরা। যদিও রুশ ও ইউক্রেনীয় ভাষার উৎপত্তি হয়েছে আদি স্লাভিয়ান ভাষা থেকে, কিন্তু তারও বহু আগে যখন ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা নানাভাবে নানা দেশে ছড়িয়ে গেছে, তখনই তার একটি অংশ ইন্দো-ইরানীয় হয়ে ঢুকে গেছে আমাদের ভূখণ্ডে। ফলে কিছু কিছু শব্দ আছে, যা রুশ আর বাংলা ভাষায় একই রকম। উদাহরণ? এই নিন: বাংলা আগুন রুশ ভাষায় আগোন, বাংলা দুয়ার রুশ ভাষায় দুয়ের (dver), বাংলায় ‘আমি কোপাই’ রুশ ভাষায় ‘ইয়া কাপায়ু’।
ভাষা নিয়ে আলোচনা খুবই আকর্ষণীয় বিষয়। কিন্তু এ মুহূর্তে সে আলোচনা খুব দরকারি নয়। যুদ্ধে জড়িয়ে যাওয়া ভাই-রাষ্ট্র দুটোর হানাহানির প্রভাব আমাদের দেশে কতটা পড়বে, সেটা নিয়েই কথা হতে পারে।
দুই.
আমি মোটেও বলার চেষ্টা করছি না, এই কিছুদিন আগে ভোজ্যতেলের দাম যেভাবে বাড়ানো হলো, তাতে আমার সায় আছে। সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে ব্যবসায়ীরাই যখন তেলের দাম নির্ধারণ করে দেন এবং দেশের কোনো কোনো মন্ত্রী যখন এর সঙ্গে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রসঙ্গকে জুড়ে দেন, তখন তা নিয়ে কারও মনে প্রশ্ন উঠলে তা অগ্রাহ্য করা ঠিক হবে না। কথাটা সত্য, এই যুদ্ধের ফলে পৃথিবীব্যাপী প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম অনেক বেড়ে যাচ্ছে, যাবে। তার আলামত পাওয়া যাচ্ছে সর্বত্রই। কিন্তু মিলমালিকেরা কিংবা তাঁদের ডিলাররা কিংবা বড় বড় প্রতিষ্ঠান তেলের দাম বাড়ানোর আগে আগে বাজার থেকে তেল উধাও করে দিয়েছিল কেন, সে প্রশ্নের উত্তর কি তারা দিতে পারবে? যদি তারা বলে, ‘না, আমরা ধোয়া তুলসীপাতা, এ ধরনের অন্যায় কাজ আমরা করিনি’, তাহলে উল্টো প্রশ্ন করতে হবে, অভিযান চালিয়ে এই যে বিভিন্ন জায়গা থেকে টনকে টন লুকিয়ে রাখা তেল উদ্ধার হচ্ছে, এগুলো কি হাওয়া থেকে ভেসে এসেছে?
বাজার থেকে পণ্য উধাও করে দেন যাঁরা, তাঁরা কখনোই সৎ ব্যবসায়ী হতে পারেন না। যে গণতান্ত্রিক দেশের স্বপ্ন আমরা দেখি, সেই গণতান্ত্রিক দেশে তাঁদের নাম হওয়া উচিত ‘মজুতদার, ডাকাত, মুনাফাখোর’। কিন্তু যে কারণেই হোক, তাঁদের আমরা ব্যবসায়ী বলেই সার্টিফিকেট দিয়েছি। তাঁরা যেভাবে চাইছেন, সেভাবেই তেলের মূল্য নির্ধারণ করছেন, এমনকি দাম বাড়ার আগে যে তেল বাজারে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল, সেই তেলেরও ভাগ্য খুলেছে। সে তেল নতুন দামে বিক্রি হওয়ায় মুনাফাখোরেরা তাঁদের ব্যাংক ব্যালান্স বাড়িয়ে নিতে পেরেছেন।
পেঁয়াজের ক্ষেত্রেও কি একই কথা বলা যায় না? বলা হলো কৃষকদের কথা ভেবে ভারতীয় পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ রাখা হয়েছে। তাতে ফল কী হলো? পেঁয়াজের পাইকারি মূল্য বেড়ে গেল কেজিতে ৫ টাকা, আর ক্রেতার কাছে পৌঁছাতে সে মূল্য বাড়ল ১৫ টাকা। এই টাকা কি কৃষকের হাতে গেল নাকি ওই মজুতদার, মুনাফাখোরদের হাতে গেল? অর্থনীতির সবচেয়ে গবেট ছাত্রটিও এইপ্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে। যুদ্ধ যে মজুতদারদের এভারেস্ট শৃঙ্গে ওঠার সুযোগ করে দেয়, তা ইতিহাসের সব ক্ষেত্রেই দেখা গেছে। সরকার যদি শক্ত হাতে তাঁদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে, তাহলে যুদ্ধের কারণে সাধারণ নাগরিক জীবনের যতটা ক্লেশের সম্মুখীন হওয়ার কথা, তার চেয়ে অনেক বেশি ক্লেশের মুখোমুখি হতে হবে। আর তাতে যে নৈরাজ্যের সৃষ্টি হবে, তা থেকে রক্ষা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।
তিন.
চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী যে সংকটের সৃষ্টি করতে পারে, তা নিয়ে এবার কিছু কথা বলা যাক।
এ কথা সত্য, রাশিয়া আর ইউক্রেনের মধ্যে যে যুদ্ধ চলছে, তা শুধু দেশ দুটিতে ধ্বংস আর মৃত্যুই ডেকে আনছে না, সারা বিশ্বকেই তা প্রভাবিত করছে; বিশেষ করে তা সারা বিশ্বকেই প্রবল খাদ্যসংকটের মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। রাশিয়া আর ইউক্রেন থেকে খাদ্য আমদানি করে যে দেশগুলো নিজ দেশের খাদ্যসংকটের মোকাবিলা করে, তারা পড়বে মহা সংকটে। ইতিমধ্যে সেই সংকট শুরু হয়ে গেছে। ধনী দেশগুলো সংকটে পড়লেও নানাভাবে তারা সেই সংকট সামাল দিতে পারবে, কিন্তু দরিদ্র দেশগুলোর কী হবে? দরিদ্র দেশগুলোর বেশির ভাগেরই অবস্থান এশিয়া আর আফ্রিকায়।
আমরা জ্বালানি তেল ও গ্যাসের আলোচনা পাশে রেখে দিই। আগে কথা বলি খাদ্য ও ভোজ্যতেল নিয়ে। রাশিয়া আর ইউক্রেন থেকে সারা বিশ্বে খাদ্য ও ভোজ্যতেল রপ্তানি হতো। যুদ্ধ সেই রপ্তানি প্রক্রিয়াকে থামিয়ে দিয়েছে। ইউরোপের শস্যভান্ডার নামে খ্যাত ইউক্রেনে এখন ফসল রোপণ করার চেয়ে মাইন বোনা ফরজ হয়ে উঠেছে।
ফসলের মাঠ যখন মাইনের মাঠে পরিণত হয়, তখন তার প্রভাব শুধু সেই মাটিতেই পড়ে না। যে দেশগুলো এই ফসলের দিকে চেয়ে থাকে বাঁচার দাবিতে, সেই দেশের জনগণের অবস্থাও হয় ত্রাহি মধুসূদন। যে পরিবারের আয়ের সিংহভাগ খরচ হয় খাদ্যদ্রব্য কিনতে, দাম বেড়ে গেলে তাদের অবস্থা কী হতে পারে, সেটা নিশ্চয়ই বুঝিয়ে বলতে হবে না।
রাশিয়া আর ইউক্রেন থেকে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি গম আমদানি করে। যুদ্ধের কারণে গম আমদানি বিঘ্নিত হতে পারে। সয়াবিন তেলের পরিবর্তে সরিষার তেল, পাম অয়েল, সূর্যমুখী তেল ব্যবহারের কথাও ভাবছেন অনেকে। সূর্যমুখী তেলের আশি শতাংশও তো আসে ওই দুটি দেশ থেকে! গমের দাম বাড়লে বেকারি পণ্য, ফাস্ট ফুডের দাম বাড়বে। তার চেয়ে বড় কথা, সাধারণ মানুষের রুটি-ভাজির জীবনেও এসে লাগবে বড় ধাক্কা!
চার.
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, সে ব্যাপারে সবারই ধারণা আছে। এই মূল্যবৃদ্ধি মূলত শাণিত ছুরির মতো আঘাত করে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষের শরীরে। এরই মধ্যে আমরা শিখে নিয়েছি, জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে তার প্রভাবে বেড়ে যায় পরিবহনের ভাড়া। পণ্য পরিবহনের জন্য বেশি অর্থ খরচ করা হলে সেই পণ্যের দাম বাড়বে, যাত্রী পরিবহনেও আসবে পরিবর্তন। দাম বাড়িয়ে দেবে পরিবহন মালিকেরা।
আমাদের দেশে এসব ক্ষেত্রে সততা এতটাই ভঙ্গুর অবস্থানে আছে যে জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে তার ভয়াবহ প্রভাবের শিকার হবে সাধারণ যাত্রীরা। আমরা তো এ-ও দেখেছি, জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে গ্যাসে চলা পরিবহনের ভাড়াও বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে! এই অসততার বিরুদ্ধে কি কোনো পদক্ষেপ নেওয়া গেছে? নেওয়ার উদাহরণ আছে?
আর কৃষি খাত? কৃষি উৎপাদনেও যে এর প্রভাব পড়বে, তা বলা বাহুল্য। বিদ্যুৎ? তেল ও গ্যাসের দাম বাড়লে বিদ্যুতের দাম এক জায়গায় স্থির থাকবে, এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। এখন পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এই দুটি জ্বালানিই ব্যবহার করা হয়।
ইচ্ছে করেই আলোচনায় পর্যটনশিল্পের কথা আনা হলো না। বিভিন্ন দেশের পর্যটন খাত বিপর্যস্ত হওয়ায় সেসব দেশের অর্থনীতিতে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এই খাত থেকে আয় কমে যাওয়ায় বিপদেও আছে দেশগুলো। আশপাশের দেশ থেকে রাশিয়ায় কাজ করতে যাওয়া শ্রমিকেরাও পড়েছেন বিপদে।
পাঁচ.
আরেকটু বিস্তার ঘটানো যাক ভাবনাটার। দুর্ভিক্ষ কি সমাসন্ন?
প্রাচ্যের আর উত্তর আফ্রিকার গরিব দেশগুলোকে নিয়ে আশঙ্কা আছে। এই দেশগুলো প্রায় ৯০ শতাংশ খাদ্যই আমদানি করে থাকে, আর দুশ্চিন্তার ব্যাপার হলো, এই খাদ্য আসে মূলত রাশিয়া আর ইউক্রেন থেকে।
অনেকেরই মনে পড়ে যাবে, বছর দশেক আগে লিবিয়া, তিউনিসিয়া, মিসর, ইয়েমেন, সিরিয়ায় যখন ক্ষমতার পালাবদল শুরু হয়েছিল, যার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘আরব বসন্ত’, তারই অভিঘাতে তর তর করে বেড়ে গিয়েছিল খাদ্যদ্রব্যের দাম। এবার রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে তুরস্ক, মিসর, ভারত, থাইল্যান্ড, জর্জিয়া, আর্মেনিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, লেবানন, এমনকি শ্রীলঙ্কাও ভুগতে পারে। এই তালিকায় বাংলাদেশের নামটিও থাকবে অনিবার্যভাবে। কীভাবে সে সংকট মোকাবিলা করা হবে, সেটাই হতে হবে এখনকার আলোচনা। তা না করে, একদল মানুষ রোবটের মতো বলে যাবে, ‘আমাদের দেশ শ্রীলঙ্কার মতো হবে না,’ আরেক দল বলবে, ‘সবুর করো, কটা বছর যেতে দাও, এ দেশটাও হবে শ্রীলঙ্কার মতো’—এটা কোনো সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি হতে পারে না। গলাবাজি করা আর বাস্তব সংকট দেখে ব্যবস্থা নেওয়া এক কথা নয়।
সামনে আসছে কঠিন সময়। এ সময়টার মোকাবিলা করতে হবে বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত নিয়ে। জনগণ কোন ধরনের সংকটে পড়তে পারে, তার আগাম বার্তা যেমন দেওয়া দরকার, তেমনি সেই সংকট থেকে জনগণকে বাঁচানোর জন্য কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, সেটাও ঘোষণা করা দরকার। নইলে আঘাত যখন আসবে, তখন
তা সামাল দেওয়ার প্রস্তুতি থাকবে না। আর সেটা যে ভয়াবহ পরিণতি নিয়ে আসবে, তা ভাবতেও ভয় লাগে।
লেখক: জাহীদ রেজা নূর, উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
প্রবৃদ্ধির শীর্ষে থেকেও বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের দৌড়ে পিছিয়ে রয়েছে। ২০১৪ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি ৫০ দশমিক ৭৯ শতাংশ বেড়েছে
১ দিন আগেদুর্নীতি, মূল্যস্ফীতি, উচ্চ করহারসহ ১৭ ধরনের বাধায় বিপর্যস্ত দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য। রয়েছে সামাজিক সমস্যাও।
১ দিন আগেজমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
৫ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৮ দিন আগে