মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
প্রতীক লাভের পর প্রার্থীরা নির্বাচনী মাঠে নেমে পড়েছেন। মোট ১ হাজার ৮৯৬ জন প্রার্থী ৩০০ আসনের জন্য এখন নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় নেমে পড়েছেন। ২৭টি দলের প্রার্থী থাকলেও আওয়ামী লীগ, আওয়ামী লীগ স্বতন্ত্র, জাতীয় পার্টি, তৃণমূল বিএনপি এবং বিএনএমের প্রার্থীর সংখ্যাই বেশি।
বিএনপি এবং আন্দোলনরত দলগুলো নির্বাচন বর্জন ও প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়ে এত দিন হরতাল-অবরোধের ডাক দিয়ে জনগণের মধ্যে তেমন কোনো সাড়া ফেলতে পারেনি। নির্বাচনে যদি বিএনপি ও তাদের জোট অংশ নিত, তাহলে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাঠ সম্পূর্ণ ভিন্ন হতো, নির্বাচনী আবহ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রূপ লাভ করত, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে না, তা আগে থেকেই স্পষ্ট ছিল। কারণ তাদের দাবি মেনে নেওয়ার অবস্থানে আওয়ামী লীগ নেই, থাকার কথাও নয়। দেশি-বিদেশি সব পক্ষই বিএনপিকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার অনুরোধ করেছিল, কিন্তু তারা বর্তমান সরকারের অধীনে বা সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্তে অটল। তাদের ধারণা সরকার পতনের ‘বন্দোবস্ত’ করতে সক্ষম হবে। সে ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের ওপরেই তাদের বেশি ভরসা ছিল। ২৮ অক্টোবর অনুষ্ঠিত মহাসমাবেশে তাদের নেতা-কর্মীরা রাজধানী ঢাকা শহরে কয়েক দিন অবস্থান নেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েই এসেছিল, কিন্তু হঠকারী কিছু ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার কারণে ওই মহাসমাবেশ তারা শুরুই করতে পারেনি। ফলে সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল, বিএনপির অনেক নেতাই কারাগারে কিংবা আত্মগোপনে চলে গেলেন। হরতাল-অবরোধের ডাক দিয়ে প্রায় ৫০ দিন কাটিয়ে দিল দলটি।
নির্বাচনী তফসিল যথাসময়ে ঘোষিত হলো। তাদের ধারণা ছিল, হরতাল-অবরোধের আন্দোলন চাঙা হলেই তফসিল বাতিল হবে, কিন্তু সেটিও হলো না। নির্বাচনী ট্রেন এখন ৭ জানুয়ারি অভিমুখে যাত্রা শুরু করেছে। বিএনপি যানবাহনে অগ্নিসংযোগ, রেললাইনে নাশকতা সৃষ্টি, অগ্নিসংযোগ বাড়িয়ে দিয়ে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করার কৌশল নিয়েছে। শোনা যাচ্ছে, বিএনপি লন্ডনের ওহি মোতাবেক আগামী কয়েক দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। জনগণকে ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার আবেদন জানিয়ে লিফলেট বিতরণ, উঠান বৈঠক এবং সবশেষে অসহযোগ আন্দোলনের ডাকও দেওয়া হয়েছে। বিএনপির এসব ডাক সাধারণ ভোটাররা কতটা শুনবেন, তা ৭ জানুয়ারি বোঝা যাবে। দেখা গেছে বিএনপির সমর্থকেরাও ঘোষিত কর্মসূচির সঙ্গে একাত্ম হতে পারেন না।
নাশকতার মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে আগামী কয়েক দিন মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টির কার্যক্রম বাড়ানোর লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। বেশ কয়েকটি রেলে অগ্নিসংযোগ ও ফিশপ্লেট তুলে নেওয়া, ট্রেন লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়া, অগ্নিসংযোগে এ পর্যন্ত পাঁচ যাত্রীর মৃত্যু হওয়ায় ধারণা করা হচ্ছে, রেল চলাচলের ওপর বিঘ্ন সৃষ্টি করার দিকে তারা অধিকতর মনোযোগী। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এসব নাশকতার সঙ্গে জড়িত কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করতে পেরেছে। এর পরও রেলব্যবস্থা বিপর্যস্ত করার জন্য বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীদের একটি অংশ মরিয়া হয়ে উঠেছে। প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও রেল দুর্ঘটনা ঘটানোর গোপন তৎপরতা তারা চালিয়ে যাচ্ছে। নির্বাচন পর্যন্ত তাদের কর্মকাণ্ড কমে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। সে ক্ষেত্রে ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত বিএনপি, জামায়াত এবং যুগপৎ আন্দোলনকারী দলগুলো নির্বাচন ভন্ডুল করতে না পারলেও ভোটার উপস্থিতি হ্রাসের ব্যাপারে যা যা তাদের পক্ষে করণীয়, তার সবই করবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
আগামী কিছুদিনের মধ্যে তাদের কর্মকাণ্ডে আরও হিংস্রতা, নৃশংসতা এমনকি ২০১৩ ও ২০১৫-এর মতো অগ্নিসংযোগ এবং মানুষ হত্যার ঘটনা বাড়িয়ে দিয়ে হলেও তারা তা করতে পারে। গেরিলা কায়দায় সরকারি-বেসরকারি স্থাপনার ওপর তাদের আক্রমণ কিংবা ভয়ভীতি প্রদর্শনের মতো ঘটনা নানা মাত্রিকতায় বাড়তেও পারে। তারা বিষয়টিকে নিজেদের জীবন-মরণ সমস্যা হিসেবে দেখছে। দেশ তাতে জ্বলে-পুড়ে ছারখার হলেও এসব কাজে তারা বিরত থাকবে বলে মনে হয় না। তাদের রাজনীতির আদর্শ ও মানসিকতায় নৃশংসতা, যুক্তিহীনতা ইত্যাদি নিয়ে অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করতে পারেন, কিন্তু নিজেদের অবস্থানে তারা অনড়। তাদের নেতা-কর্মীরা যে বিশ্বাস নিয়ে বড় হয়েছেন, সেই বিশ্বাসের সঙ্গে গণতন্ত্র কতটা যায় কি যায় না; নীতি-নৈতিকতা, মানবতা ইত্যাদি থাকবে কি থাকবে না—তা আশা করেও কোনো লাভ নেই। এই মুহূর্তে জিঘাংসা, প্রতিহিংসা এবং যেকোনো ধরনের নাশকতা ঘটাতে তারা দ্বিধা করবে না।
মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে অগ্নিসংযোগ করে যারা চারজন নিরীহ মানুষকে পুড়িয়ে মেরে ফেলেছে, তারা এর চেয়েও বড় কিছু করতে এখন আর দ্বিধা করবে না। কারণ তারা নিজেদের মতো করে রাষ্ট্রকে চায়, নির্বাচনও চায়। ২৮ অক্টোবর একজন পুলিশকে যে হিংস্রতার সঙ্গে হত্যা করা হয়েছিল, সেই দৃশ্য যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা ভাবতে পারেন না কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মীরা এমন নির্দয়-নিষ্ঠুর আচরণ করতে পারে।
তারা এখন আরও বেশি নৃশংসতা দেখাতে প্রতিদিনই কিছু না কিছু ঘটাতে চেষ্টা করতে পারে। তাদের এসব অপচেষ্টা অন্তত ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত যে চলবে তা বোঝা যাচ্ছে। পরে বন্ধ হয়ে যাবে কি না, সেটা পরের ব্যাপার। সুতরাং বুঝে নিতে হবে, নির্বাচনের আগপর্যন্ত যুগপৎ আন্দোলনকারীরা কী ধরনের জিঘাংসায় পুড়ে পুড়ে মরছে। সেই জিঘাংসার প্রতিক্রিয়ায় কোথায় কী হবে, আমরা কেউই তা বলতে পারব না।
অন্যদিকে যারা প্রার্থী হিসেবে এখন প্রচার-প্রচারণায় নেমে পড়েছেন, তাঁরা প্রত্যেকে নিজের বিজয় ঘরে তোলার দিকেই অধিকতর মনোযোগী। দেশে কী ঘটছে বা ঘটছে না, বিএনপির এবং যুগপৎ আন্দোলনকারীরা নির্বাচন পণ্ড করার জন্য কী করছে, সেদিকে মনোযোগ দেওয়ার তাঁদের সময় নেই। আগামী কয়েক দিন তাঁদের প্রচার-প্রচারণায় ব্যস্ততা কেবলই বাড়তে থাকবে। তবে পক্ষে-বিপক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বিতার তীব্রতা অতীতের নির্বাচনগুলোর মতো না হলেও সহিংসতার ঘটনা একেবারে যে ঘটবে না, তা বলা যাচ্ছে না। প্রার্থীরা সবাই জয়লাভের জন্য মরিয়া চেষ্টা চালাবেন—এটাই স্বাভাবিক। এরই মধ্যে কোথাও কোথাও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে ছোটখাটো সংঘর্ষ ও বিরোধের খবর মিডিয়ায় আসছে। ক্যাম্প নিয়ে দ্বন্দ্বে একজনের মৃত্যুর খবরও পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা আগামী দিনগুলোতে জয়ের নেশায় আরও বেশি মত্ত হলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে, সেটাই দেখার বিষয়।
এরই মধ্যে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরেই বিরোধ ও দ্বন্দ্বের প্রকাশ ঘটতে শুরু করেছে। আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণায় দলীয় নেতা-কর্মীদের অংশ নেওয়ার বিষয়টি মনোনয়ন লাভকারী প্রার্থী ও তাঁর সমর্থকেরা মোটেও ভালোভাবে নিচ্ছেন না। মাঠপর্যায়ে এ নিয়ে দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের আশঙ্কা রয়েছে। এখনই যদি কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিষয়টি নিয়ে সুস্পষ্ট নিয়মনীতি জারি করা না হয়, তাহলে অবস্থা সংঘাতপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। দল যেহেতু স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করার অনুমতি দিয়েছে, সেহেতু দলকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা স্থানীয় পর্যায়ে দলীয় নেতা-কর্মীদের সহায়তায় নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা চালাতে পারবেন কি না। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সমর্থকেরা নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিলে দলের মনোনীত প্রার্থীর সমর্থকেরা আক্রমণ কিংবা নির্বাচনী অফিস ভাঙচুর করলে নির্বাচনের পরিবেশ ও আচরণবিধি লঙ্ঘিত হবে। আচরণবিধির লঙ্ঘন বাড়তে দেওয়া হলে মাঠপর্যায়ের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
সে ক্ষেত্রে তৃণমূল পর্যায়ে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক অবস্থা বিভক্ত হয়ে পড়তে পারে। এর সুযোগ নিতে পারে নির্বাচন পণ্ডকারী শক্তি।
দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করার জন্যই দলের মনোনীত প্রার্থীর পাশাপাশি স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার অনুমতি দিয়েছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা যদি প্রচার-প্রচারণায় ঠিকমতো কাজ করতে না পারেন, বাধাগ্রস্ত হন, তাহলে নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকবে। তেমনটা ঘটলে কার বেশি লাভ হবে? নিঃসন্দেহে নির্বাচন বর্জনকারীরাই এতে লাভবান হবে। বর্জনকারীদের লাভবান করার জন্য আওয়ামী লীগের মনোনীত কিংবা স্বতন্ত্র প্রার্থীরা যদি অবদান রাখেন, তাহলে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা যে উদ্দেশ্যে নির্বাচনটি করতে চাইছেন, সেটিই তো ব্যর্থ হবে।
একই অবস্থা যদি অন্য দলের প্রার্থীদের সঙ্গেও ঘটে, তাহলেও ভোটার উপস্থিতি কমে যেতে পারে। নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু তখনই বলা হবে, যখন কোনো প্রার্থী কিংবা তার সমর্থকেরা অন্য কোনো প্রার্থী বা তার সমর্থকদের বাধা না দেবে, ভোটারদেরও ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হওয়ার জন্য কোনো ধরনের বাধা সৃষ্টি না করবে। কোনো প্রার্থী যদি নিজের জয়ের জন্য মরিয়া হয়ে আচরণবিধি ভঙ্গ করে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী কিংবা তার কর্মী-সমর্থক ও ভোটারদের উপস্থিতি কমানোর চেষ্টা করেন, তাহলে তিনি ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হতে পারেন, কিন্তু তাতে গোটা নির্বাচন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এর দায়ভার দলের ওপরই পড়বে। এখনই যদি আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায় থেকে নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গ না করার ব্যাপারে সতর্ক করে দেওয়া না হয়, তাহলে আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ঘটনা বেড়ে যেতে পারে। স্থানীয় প্রশাসন নির্বাচন কমিশনের বিধি কঠোরভাবে প্রতিপালনে ভূমিকা না নিলে কোনো কোনো আসনে সংঘাত, বিরোধ বেড়ে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ওপর নানা ধরনের প্রশ্ন ও নেতিবাচক প্রভাব পড়ার বিষয়টি উপেক্ষা করা যাবে না।
প্রার্থীরা নির্বাচনে যখন অংশগ্রহণ করেন, তখন তাঁদের অনেক কিছুই কাণ্ডজ্ঞানে থাকে না। সে কারণে আচরণবিধি প্রতিপালনে প্রার্থীদের কঠোরভাবে বাধ্য করতে হবে নির্বাচন কমিশনকেই। তবে যেহেতু এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর সংখ্যা অনেক বেশি, তাই দল হিসেবে আওয়ামী লীগকেই নির্বাচনের ট্রেনটি শান্তিপূর্ণভাবে ৭ জানুয়ারি অতিক্রম করানোর ব্যাপারে ভূমিকা নিতে হবে।
মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী, অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট
প্রতীক লাভের পর প্রার্থীরা নির্বাচনী মাঠে নেমে পড়েছেন। মোট ১ হাজার ৮৯৬ জন প্রার্থী ৩০০ আসনের জন্য এখন নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় নেমে পড়েছেন। ২৭টি দলের প্রার্থী থাকলেও আওয়ামী লীগ, আওয়ামী লীগ স্বতন্ত্র, জাতীয় পার্টি, তৃণমূল বিএনপি এবং বিএনএমের প্রার্থীর সংখ্যাই বেশি।
বিএনপি এবং আন্দোলনরত দলগুলো নির্বাচন বর্জন ও প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়ে এত দিন হরতাল-অবরোধের ডাক দিয়ে জনগণের মধ্যে তেমন কোনো সাড়া ফেলতে পারেনি। নির্বাচনে যদি বিএনপি ও তাদের জোট অংশ নিত, তাহলে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাঠ সম্পূর্ণ ভিন্ন হতো, নির্বাচনী আবহ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রূপ লাভ করত, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে না, তা আগে থেকেই স্পষ্ট ছিল। কারণ তাদের দাবি মেনে নেওয়ার অবস্থানে আওয়ামী লীগ নেই, থাকার কথাও নয়। দেশি-বিদেশি সব পক্ষই বিএনপিকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার অনুরোধ করেছিল, কিন্তু তারা বর্তমান সরকারের অধীনে বা সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্তে অটল। তাদের ধারণা সরকার পতনের ‘বন্দোবস্ত’ করতে সক্ষম হবে। সে ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের ওপরেই তাদের বেশি ভরসা ছিল। ২৮ অক্টোবর অনুষ্ঠিত মহাসমাবেশে তাদের নেতা-কর্মীরা রাজধানী ঢাকা শহরে কয়েক দিন অবস্থান নেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েই এসেছিল, কিন্তু হঠকারী কিছু ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার কারণে ওই মহাসমাবেশ তারা শুরুই করতে পারেনি। ফলে সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল, বিএনপির অনেক নেতাই কারাগারে কিংবা আত্মগোপনে চলে গেলেন। হরতাল-অবরোধের ডাক দিয়ে প্রায় ৫০ দিন কাটিয়ে দিল দলটি।
নির্বাচনী তফসিল যথাসময়ে ঘোষিত হলো। তাদের ধারণা ছিল, হরতাল-অবরোধের আন্দোলন চাঙা হলেই তফসিল বাতিল হবে, কিন্তু সেটিও হলো না। নির্বাচনী ট্রেন এখন ৭ জানুয়ারি অভিমুখে যাত্রা শুরু করেছে। বিএনপি যানবাহনে অগ্নিসংযোগ, রেললাইনে নাশকতা সৃষ্টি, অগ্নিসংযোগ বাড়িয়ে দিয়ে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করার কৌশল নিয়েছে। শোনা যাচ্ছে, বিএনপি লন্ডনের ওহি মোতাবেক আগামী কয়েক দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। জনগণকে ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার আবেদন জানিয়ে লিফলেট বিতরণ, উঠান বৈঠক এবং সবশেষে অসহযোগ আন্দোলনের ডাকও দেওয়া হয়েছে। বিএনপির এসব ডাক সাধারণ ভোটাররা কতটা শুনবেন, তা ৭ জানুয়ারি বোঝা যাবে। দেখা গেছে বিএনপির সমর্থকেরাও ঘোষিত কর্মসূচির সঙ্গে একাত্ম হতে পারেন না।
নাশকতার মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে আগামী কয়েক দিন মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টির কার্যক্রম বাড়ানোর লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। বেশ কয়েকটি রেলে অগ্নিসংযোগ ও ফিশপ্লেট তুলে নেওয়া, ট্রেন লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়া, অগ্নিসংযোগে এ পর্যন্ত পাঁচ যাত্রীর মৃত্যু হওয়ায় ধারণা করা হচ্ছে, রেল চলাচলের ওপর বিঘ্ন সৃষ্টি করার দিকে তারা অধিকতর মনোযোগী। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এসব নাশকতার সঙ্গে জড়িত কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করতে পেরেছে। এর পরও রেলব্যবস্থা বিপর্যস্ত করার জন্য বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীদের একটি অংশ মরিয়া হয়ে উঠেছে। প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও রেল দুর্ঘটনা ঘটানোর গোপন তৎপরতা তারা চালিয়ে যাচ্ছে। নির্বাচন পর্যন্ত তাদের কর্মকাণ্ড কমে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। সে ক্ষেত্রে ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত বিএনপি, জামায়াত এবং যুগপৎ আন্দোলনকারী দলগুলো নির্বাচন ভন্ডুল করতে না পারলেও ভোটার উপস্থিতি হ্রাসের ব্যাপারে যা যা তাদের পক্ষে করণীয়, তার সবই করবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
আগামী কিছুদিনের মধ্যে তাদের কর্মকাণ্ডে আরও হিংস্রতা, নৃশংসতা এমনকি ২০১৩ ও ২০১৫-এর মতো অগ্নিসংযোগ এবং মানুষ হত্যার ঘটনা বাড়িয়ে দিয়ে হলেও তারা তা করতে পারে। গেরিলা কায়দায় সরকারি-বেসরকারি স্থাপনার ওপর তাদের আক্রমণ কিংবা ভয়ভীতি প্রদর্শনের মতো ঘটনা নানা মাত্রিকতায় বাড়তেও পারে। তারা বিষয়টিকে নিজেদের জীবন-মরণ সমস্যা হিসেবে দেখছে। দেশ তাতে জ্বলে-পুড়ে ছারখার হলেও এসব কাজে তারা বিরত থাকবে বলে মনে হয় না। তাদের রাজনীতির আদর্শ ও মানসিকতায় নৃশংসতা, যুক্তিহীনতা ইত্যাদি নিয়ে অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করতে পারেন, কিন্তু নিজেদের অবস্থানে তারা অনড়। তাদের নেতা-কর্মীরা যে বিশ্বাস নিয়ে বড় হয়েছেন, সেই বিশ্বাসের সঙ্গে গণতন্ত্র কতটা যায় কি যায় না; নীতি-নৈতিকতা, মানবতা ইত্যাদি থাকবে কি থাকবে না—তা আশা করেও কোনো লাভ নেই। এই মুহূর্তে জিঘাংসা, প্রতিহিংসা এবং যেকোনো ধরনের নাশকতা ঘটাতে তারা দ্বিধা করবে না।
মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে অগ্নিসংযোগ করে যারা চারজন নিরীহ মানুষকে পুড়িয়ে মেরে ফেলেছে, তারা এর চেয়েও বড় কিছু করতে এখন আর দ্বিধা করবে না। কারণ তারা নিজেদের মতো করে রাষ্ট্রকে চায়, নির্বাচনও চায়। ২৮ অক্টোবর একজন পুলিশকে যে হিংস্রতার সঙ্গে হত্যা করা হয়েছিল, সেই দৃশ্য যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা ভাবতে পারেন না কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মীরা এমন নির্দয়-নিষ্ঠুর আচরণ করতে পারে।
তারা এখন আরও বেশি নৃশংসতা দেখাতে প্রতিদিনই কিছু না কিছু ঘটাতে চেষ্টা করতে পারে। তাদের এসব অপচেষ্টা অন্তত ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত যে চলবে তা বোঝা যাচ্ছে। পরে বন্ধ হয়ে যাবে কি না, সেটা পরের ব্যাপার। সুতরাং বুঝে নিতে হবে, নির্বাচনের আগপর্যন্ত যুগপৎ আন্দোলনকারীরা কী ধরনের জিঘাংসায় পুড়ে পুড়ে মরছে। সেই জিঘাংসার প্রতিক্রিয়ায় কোথায় কী হবে, আমরা কেউই তা বলতে পারব না।
অন্যদিকে যারা প্রার্থী হিসেবে এখন প্রচার-প্রচারণায় নেমে পড়েছেন, তাঁরা প্রত্যেকে নিজের বিজয় ঘরে তোলার দিকেই অধিকতর মনোযোগী। দেশে কী ঘটছে বা ঘটছে না, বিএনপির এবং যুগপৎ আন্দোলনকারীরা নির্বাচন পণ্ড করার জন্য কী করছে, সেদিকে মনোযোগ দেওয়ার তাঁদের সময় নেই। আগামী কয়েক দিন তাঁদের প্রচার-প্রচারণায় ব্যস্ততা কেবলই বাড়তে থাকবে। তবে পক্ষে-বিপক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বিতার তীব্রতা অতীতের নির্বাচনগুলোর মতো না হলেও সহিংসতার ঘটনা একেবারে যে ঘটবে না, তা বলা যাচ্ছে না। প্রার্থীরা সবাই জয়লাভের জন্য মরিয়া চেষ্টা চালাবেন—এটাই স্বাভাবিক। এরই মধ্যে কোথাও কোথাও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে ছোটখাটো সংঘর্ষ ও বিরোধের খবর মিডিয়ায় আসছে। ক্যাম্প নিয়ে দ্বন্দ্বে একজনের মৃত্যুর খবরও পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা আগামী দিনগুলোতে জয়ের নেশায় আরও বেশি মত্ত হলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে, সেটাই দেখার বিষয়।
এরই মধ্যে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরেই বিরোধ ও দ্বন্দ্বের প্রকাশ ঘটতে শুরু করেছে। আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণায় দলীয় নেতা-কর্মীদের অংশ নেওয়ার বিষয়টি মনোনয়ন লাভকারী প্রার্থী ও তাঁর সমর্থকেরা মোটেও ভালোভাবে নিচ্ছেন না। মাঠপর্যায়ে এ নিয়ে দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের আশঙ্কা রয়েছে। এখনই যদি কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিষয়টি নিয়ে সুস্পষ্ট নিয়মনীতি জারি করা না হয়, তাহলে অবস্থা সংঘাতপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। দল যেহেতু স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করার অনুমতি দিয়েছে, সেহেতু দলকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা স্থানীয় পর্যায়ে দলীয় নেতা-কর্মীদের সহায়তায় নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা চালাতে পারবেন কি না। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সমর্থকেরা নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিলে দলের মনোনীত প্রার্থীর সমর্থকেরা আক্রমণ কিংবা নির্বাচনী অফিস ভাঙচুর করলে নির্বাচনের পরিবেশ ও আচরণবিধি লঙ্ঘিত হবে। আচরণবিধির লঙ্ঘন বাড়তে দেওয়া হলে মাঠপর্যায়ের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
সে ক্ষেত্রে তৃণমূল পর্যায়ে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক অবস্থা বিভক্ত হয়ে পড়তে পারে। এর সুযোগ নিতে পারে নির্বাচন পণ্ডকারী শক্তি।
দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করার জন্যই দলের মনোনীত প্রার্থীর পাশাপাশি স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার অনুমতি দিয়েছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা যদি প্রচার-প্রচারণায় ঠিকমতো কাজ করতে না পারেন, বাধাগ্রস্ত হন, তাহলে নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকবে। তেমনটা ঘটলে কার বেশি লাভ হবে? নিঃসন্দেহে নির্বাচন বর্জনকারীরাই এতে লাভবান হবে। বর্জনকারীদের লাভবান করার জন্য আওয়ামী লীগের মনোনীত কিংবা স্বতন্ত্র প্রার্থীরা যদি অবদান রাখেন, তাহলে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা যে উদ্দেশ্যে নির্বাচনটি করতে চাইছেন, সেটিই তো ব্যর্থ হবে।
একই অবস্থা যদি অন্য দলের প্রার্থীদের সঙ্গেও ঘটে, তাহলেও ভোটার উপস্থিতি কমে যেতে পারে। নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু তখনই বলা হবে, যখন কোনো প্রার্থী কিংবা তার সমর্থকেরা অন্য কোনো প্রার্থী বা তার সমর্থকদের বাধা না দেবে, ভোটারদেরও ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হওয়ার জন্য কোনো ধরনের বাধা সৃষ্টি না করবে। কোনো প্রার্থী যদি নিজের জয়ের জন্য মরিয়া হয়ে আচরণবিধি ভঙ্গ করে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী কিংবা তার কর্মী-সমর্থক ও ভোটারদের উপস্থিতি কমানোর চেষ্টা করেন, তাহলে তিনি ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হতে পারেন, কিন্তু তাতে গোটা নির্বাচন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এর দায়ভার দলের ওপরই পড়বে। এখনই যদি আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায় থেকে নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গ না করার ব্যাপারে সতর্ক করে দেওয়া না হয়, তাহলে আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ঘটনা বেড়ে যেতে পারে। স্থানীয় প্রশাসন নির্বাচন কমিশনের বিধি কঠোরভাবে প্রতিপালনে ভূমিকা না নিলে কোনো কোনো আসনে সংঘাত, বিরোধ বেড়ে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ওপর নানা ধরনের প্রশ্ন ও নেতিবাচক প্রভাব পড়ার বিষয়টি উপেক্ষা করা যাবে না।
প্রার্থীরা নির্বাচনে যখন অংশগ্রহণ করেন, তখন তাঁদের অনেক কিছুই কাণ্ডজ্ঞানে থাকে না। সে কারণে আচরণবিধি প্রতিপালনে প্রার্থীদের কঠোরভাবে বাধ্য করতে হবে নির্বাচন কমিশনকেই। তবে যেহেতু এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর সংখ্যা অনেক বেশি, তাই দল হিসেবে আওয়ামী লীগকেই নির্বাচনের ট্রেনটি শান্তিপূর্ণভাবে ৭ জানুয়ারি অতিক্রম করানোর ব্যাপারে ভূমিকা নিতে হবে।
মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী, অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট
প্রবৃদ্ধির শীর্ষে থেকেও বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের দৌড়ে পিছিয়ে রয়েছে। ২০১৪ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি ৫০ দশমিক ৭৯ শতাংশ বেড়েছে
২ দিন আগেদুর্নীতি, মূল্যস্ফীতি, উচ্চ করহারসহ ১৭ ধরনের বাধায় বিপর্যস্ত দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য। রয়েছে সামাজিক সমস্যাও।
২ দিন আগেজমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
৬ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৯ দিন আগে