জাহীদ রেজা নূর
প্রথম পর্ব
আজকের লেখাটি একটু বড় হবে। ১৫ দিন পর এই লেখার দ্বিতীয় পর্বটিও পড়তে অনুরোধ করব পাঠককে। সামগ্রিকভাবে যেকোনো ভাষার বাঁচা-মরা, বাঁচার লড়াই নিয়ে আলোকপাত থাকবে দ্বিতীয় পর্বে। আর সেই পর্বে প্রবেশের জন্যই আজকের এ পর্বটি।
ভাষা আন্দোলনের কথা বলতে গেলেই আমরা নির্দিষ্ট কিছু মুখস্থ শব্দ উচ্চারণ করি। ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে বাঙালি, এ কথারই পুনরাবৃত্তি করতে থাকি। ভাষার মর্যাদা রক্ষার কথা বলি। কিন্তু মূলত ভাষা ও ভাষার রাজনীতি নিয়ে আলোচনা কমই হয়। সে কারণে একটু ভিন্নভাবে ভাষা নিয়ে ভাবার চেষ্টা থাকবে এই লেখায়।
আমি তখন সোভিয়েত ইউনিয়নে গিয়েছি পড়াশোনার জন্য। মস্কো থেকে ট্রেনে চব্বিশ ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছেছি ক্রাসনাদার শহরে। এই শহরের কৃষি ইনস্টিটিউটটি বিশ্বের সেরা কৃষি ইনস্টিটিউটের একটি (এখন তা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে গেছে)। সেই শহরেই প্রস্তুতিপর্বে শুরু হলো রুশ ভাষা শিক্ষা।
পৃথিবীর বিভিন্ন অলিগলি থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নে তখন শিক্ষার্থীরা আসত। উচ্চশিক্ষার জন্য কোনো শিক্ষার্থীকেই অর্থ খরচ করতে হতো না, প্রতিজন শিক্ষার্থীই সেখানে স্টাইপেন্ড বা স্কলারশিপ পেত। তাতে নির্বিঘ্নে মাস চালানোর খরচ মিটে যেত। বিশ্বের প্রতিটি দেশের মানুষের মনে সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে শ্রদ্ধা জাগবে, এই শিক্ষার্থীরাই দেশে ফিরে নিজ দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে যুক্ত হবে, এ রকম একটা সুদূরপ্রসারী ইচ্ছে ছিল সোভিয়েত ভাবনায়, তবে পড়াশোনার নামে ফাঁকিবাজি করেনি তারা। সেরা শিক্ষকদের নিয়ে তৈরি সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেরা পাঠদানের চেষ্টায় ত্রুটি ছিল না।
বিদেশি ছাত্রদের জন্য এক বছর রুশ ভাষা শেখার জন্য ছিল প্রিপারেটরি ফ্যাকাল্টি। বিভিন্ন ভাষাভাষীর শিক্ষার্থীরা সেখানেই পড়ত। ক্লাস শুরু হওয়ার পর আড্ডা হতো কখনো কখনো। নানা দেশের ছেলেমেয়েরা সেই আড্ডায় অংশ নিত। আমি একসময় লক্ষ করলাম, আফ্রিকার ছেলেরা কি দ্রুত ইংরেজি বলে যাচ্ছে! তখনো রুশ ভাষা ঠিকভাবে শেখা হয়নি বলে কথার আদান-প্রদান হতো ইংরেজিতে।
যারা ফরাসি বা স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলত, তারা আলাদাভাবে আড্ডা দিত। এই আপাতবিচ্ছিন্নতা কেটে গিয়েছিল রুশ ভাষায় একটু একটু করে কথা বলা শুরু হলে। শিক্ষার্থীরা তখন রুশ ভাষাতেই ভাবের আদান-প্রদান করতে পারত।
২. আফ্রিকান ছেলেমেয়েরা কীভাবে এত সুন্দর ইংরেজি বলে, সেটা আমার জন্য ছিল বিস্ময়ের ব্যাপার। এ বিষয়টি নিয়ে আমি রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞ ওয়াহিদুল হককে একটি চিঠি লিখেছিলাম। প্রশ্ন রেখেছিলাম, ‘কীভাবে আফ্রিকার ছেলেরা এত দ্রুত ইংরেজি বলতে পারে, আমি পারি না। আমিই কি ভাষা আয়ত্ত করিনি বলে পিছিয়ে পড়েছি?’
এর উত্তরে একটি অসাধারণ চিঠি লিখেছিলেন ওয়াহিদুল হক। তিনি জানিয়েছিলেন উপনিবেশীয় শোষণের কথা। বলেছিলেন, ইউরোপীয় দেশগুলো যখন এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় উপনিবেশ বানিয়েছে, তখন সেই সব দেশ থেকে তাদের সংস্কৃতি, ভাষা, জীবনব্যবস্থা সমূলে উৎপাটন করার চেষ্টা করেছে। কোথাও কোথাও সফল হয়েছে, কোথাও কোথাও হয়নি।
আফ্রিকা আর লাতিন আমেরিকার বেশির ভাগ দেশ থেকে আচরিত ভাষা হটিয়ে দিয়েছে, সংস্কৃতির মূল উপড়ে ফেলেছে। ভারতবর্ষে এ কাজটি করতে তারা এক শ ভাগ সফল হয়নি। চাপিয়ে দেওয়া ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে আপস করতে হয়েছে ঠিকই, কিন্তু নিজ ভাষা, নিজ সংস্কৃতি ধরে রাখতে পেরেছে ভারতবর্ষের লোকেরা। আফ্রিকার বহু দেশের মানুষ এখন মাতৃভাষায় কথা বলতে পারে না। তারা কথা বলে ইংরেজি অথবা ফরাসি ভাষায়। লাতিন আমেরিকার বিশাল অংশে তো স্প্যানিশই হয়ে উঠেছে রাষ্ট্রভাষা।
ওয়াহিদুল হকের চিঠিখানা আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, ভাষা ও সংস্কৃতি-প্রশ্নে আমাদের যে উত্তরাধিকার, তা খুবই ঋদ্ধ। আমরা নিজের ভাষায় নিজেকে প্রকাশ করতে পারি, এ-ও টিকে থাকার সংগ্রামে একটি বড় অর্জন। ভাষা শিক্ষার প্রতি আমার আগ্রহ এতটাই বেড়েছিল যে আমি তখন আমার পড়ালেখার বিষয় পরিবর্তন করে কুবান রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ভাষা ও সাহিত্য’ বিভাগে ভর্তি হয়েছিলাম।
ভাষার আগ্রাসনকে তখন থেকেই গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখার চেষ্টা করি।
৩. ফেব্রুয়ারি মাস এলেই আমরা ভাষা নিয়ে অতিমাত্রায় সচেতন হয়ে উঠি। ভাষা নিয়ে এমন সব কথা বলি, যা অর্থহীন। যেমন ভাষা আন্দোলনটি কেন হয়েছিল, সে কথা অনেকের কাছেই পরিষ্কার নয়। কেউ কেউ বলেন, মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার লড়াই ছিল ভাষা আন্দোলন। কেউ কেউ বলেন, জনসংখ্যার বিচারে বাংলায় কথা বলত পাকিস্তানের অধিকাংশ মানুষ। তাই উর্দুকে হটিয়ে দিয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার লড়াই ছিল ভাষা আন্দোলন।
দুটো ভাবনাই ভুল। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করার বিষয়টি খুবই ধোঁয়াটে। যে বাঙালি মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করবে, তারা ইতিহাসের একটা বড় সময় ধরেই বাংলায় নিজেকে প্রকাশ করতে চায়নি। বাংলাকে ভেবেছে নিম্নশ্রেণির মানুষের ভাষা। হিন্দু অভিজাত বাঙালি ভেবেছে, ধর্ম ও উচ্চ সাহিত্যের জন্য সংস্কৃত ভাষাই তাদের ভাবপ্রকাশের একমাত্র ভাষা। বাংলায় তা রচনা করা সম্ভব নয়। মুসলমান তো ভেবে এসেছে আরবি বা ফারসির উত্তরাধিকার তারা। বাংলা হচ্ছে হিন্দুয়ানি ভাষা। এই ভাষায় কেন করা হবে সাহিত্য রচনা? বাংলা সম্পর্কে বাঙালি হিন্দু-মুসলমানের এই দ্বিধা ছিল। কিন্তু একটা সময়ে এসে হিন্দু সম্প্রদায় বাংলাকে নিজ ভাষা হিসেবে মেনে নেয়। বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায়ের মনের দ্বিধা কাটতে আরও সময় লেগেছিল।
বাঙালি মুসলমানের সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল, ধর্ম ও সংস্কৃতির ফারাক। বাস করছে এই মাটিতে, কিন্তু মনে লালন করছে আরব দেশকে—এই দ্বিধা বরাবর বাঙালি অভিজাত মুসলমানকে বাংলা সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ করে রেখেছে। অনভিজাত বাঙালিরাই কিন্তু মধ্যযুগে দ্বিধাগ্রস্ত মন নিয়ে বাংলার চর্চা শুরু করেছিল। এই ঐতিহাসিক সত্যকে মনে রাখলে বাংলা ভাষার সংগ্রামের বিষয়টি বোঝা সহজ হবে।
হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের গরিব মানুষের কাছে বাংলাই ছিল মাতৃভাষা। ফলে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করার জন্য তখন কোনো আন্দোলন ছিল না। বাংলাতেই তো তাদের জীবনযাপন, তাই নতুন করে তা আদায় করার কিছু নেই। আন্দোলন হলো রাষ্ট্রভাষা নিয়ে, মাতৃভাষা নিয়ে নয়। পাকিস্তান সৃষ্টির আগে যখন এই বিচিত্র রাষ্ট্রটির সরকারি বা প্রশাসনিক ভাষা কী হবে, তা নিয়ে বিতর্ক উঠল, তখনই উর্দুকে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হলো রাষ্ট্রভাষা হিসেবে। পূর্ব বাংলার মানুষ প্রতিবাদ করেছিল। তারা আন্দোলনের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছিল, রাষ্ট্রভাষা হওয়ার যোগ্যতা রয়েছে বাংলার।
দ্বিতীয় প্রশ্নটির উত্তরও রয়েছে প্রথম প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই। পূর্ব বাংলা বলেনি, শুধু বাংলাকেই রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। উর্দুর পাশাপাশি বাংলাও হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা, সেটাই ছিল এই আন্দোলনের সারমর্ম। এই আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি, ভাষা আন্দোলন ছিল মূলত পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়ার আন্দোলন। মাতৃভাষার অধিকার নয়, রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা অর্জনই ছিল মুখ্য। বাংলা রাষ্ট্রভাষা হলে আমাদের মাতৃভাষা অনায়াসে তার মর্যাদা পাবে।
এরই সূত্র ধরে আমরা বলতে পারি, আমাদের ভাষা আন্দোলন আমাদের স্বাধিকার ও স্বাধীনতার দিকে নিয়ে গিয়েছে সত্য, কিন্তু ভাষা প্রসঙ্গটির যে ব্যাপ্তি, তার কাছাকাছি হওয়ার চেষ্টা খুব কমই হয়েছে। আমরা আমাদের অঙ্গীকারগুলো কতটা রক্ষা করেছি, সে প্রশ্ন উঠলে লজ্জায় মাথা কাটা যাওয়ার উপক্রম হবে।
৪. ওপরের আলোচনাটিকে বিচ্ছিন্ন আলোচনা বলে মনে হতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সঙ্গে বর্তমান পরিপ্রেক্ষিত যোগ করলে আমরা বুঝতে পারব, বাংলা ভাষা নিয়ে আমাদের চিন্তা-ভাবনায় রয়েছে গলদ। ওয়াহিদুল হক উপনিবেশীকরণের সময় দখলকৃত কোনো দেশের জাতীয় ভাষাগুলোকে যেভাবে হটিয়ে দেওয়ার কথা শুনিয়েছিলেন, সেভাবে হয়তো এখন আর ভাষা তার জায়গা হারাচ্ছে না, কিন্তু ভাষার ওপর ভাষার আগ্রাসন এখনো চলছে।
দুটো প্রসঙ্গ আনব ভেবে দেখার জন্য। বাংলা ছাড়াও আমাদের এ দেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর আরও কিছু ভাষা রয়েছে। সেই ভাষাব্যবহারকারীদের সংখ্যা কমছে। বাংলা ভাষা ছাড়া উচ্চশিক্ষার উপায় নেই বলে সেই ভাষাগুলোর বেশির ভাগেরই উন্নতি হচ্ছে না।
একটা ভাষার লিখিত রূপ ও তার সাহিত্য না থাকলে, সেই ভাষা ধীরে ধীরে অবসিত হতে থাকে। ভাষা আন্দোলন রাষ্ট্রভাষার আন্দোলন ছিল বটে, কিন্তু প্রশ্নটিকে আরও প্রসারিত করলে দেখা যাবে, মাতৃভাষাকে মর্যাদা দেওয়ার বিষয়টিও আন্দোলনের মধ্যে প্রচ্ছন্ন ছিল এবং তা শুধু বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে নয়। দেশে প্রচলিত সব ভাষার মর্যাদা রক্ষার দায় রয়েছে ভাষা আন্দোলনের। সেটা কীভাবে রক্ষা হচ্ছে, তা দেখা দরকার।
দ্বিতীয় প্রসঙ্গটি বাংলা ভাষা নিয়েই। উচ্চশিক্ষায় ইংরেজির দাপট এখনো এমন পর্যায়ে রয়েছে যে, ওই ভাষাটা না জানলে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকেই বেশির ভাগ বিষয়ে ডিগ্রি নেওয়া যাবে না, এমনকি উচ্চশিক্ষিত হওয়া যাবে না। বাংলা ভাষার প্রতি আমাদের যে মমত্ব নেই, সেটা বোঝার জন্য রকেট সায়েন্টিস্ট হতে হয় না। এ বিষয়টি নিয়েই আমরা পরবর্তী পর্বে আলোচনা করব।
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
প্রথম পর্ব
আজকের লেখাটি একটু বড় হবে। ১৫ দিন পর এই লেখার দ্বিতীয় পর্বটিও পড়তে অনুরোধ করব পাঠককে। সামগ্রিকভাবে যেকোনো ভাষার বাঁচা-মরা, বাঁচার লড়াই নিয়ে আলোকপাত থাকবে দ্বিতীয় পর্বে। আর সেই পর্বে প্রবেশের জন্যই আজকের এ পর্বটি।
ভাষা আন্দোলনের কথা বলতে গেলেই আমরা নির্দিষ্ট কিছু মুখস্থ শব্দ উচ্চারণ করি। ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে বাঙালি, এ কথারই পুনরাবৃত্তি করতে থাকি। ভাষার মর্যাদা রক্ষার কথা বলি। কিন্তু মূলত ভাষা ও ভাষার রাজনীতি নিয়ে আলোচনা কমই হয়। সে কারণে একটু ভিন্নভাবে ভাষা নিয়ে ভাবার চেষ্টা থাকবে এই লেখায়।
আমি তখন সোভিয়েত ইউনিয়নে গিয়েছি পড়াশোনার জন্য। মস্কো থেকে ট্রেনে চব্বিশ ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছেছি ক্রাসনাদার শহরে। এই শহরের কৃষি ইনস্টিটিউটটি বিশ্বের সেরা কৃষি ইনস্টিটিউটের একটি (এখন তা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে গেছে)। সেই শহরেই প্রস্তুতিপর্বে শুরু হলো রুশ ভাষা শিক্ষা।
পৃথিবীর বিভিন্ন অলিগলি থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নে তখন শিক্ষার্থীরা আসত। উচ্চশিক্ষার জন্য কোনো শিক্ষার্থীকেই অর্থ খরচ করতে হতো না, প্রতিজন শিক্ষার্থীই সেখানে স্টাইপেন্ড বা স্কলারশিপ পেত। তাতে নির্বিঘ্নে মাস চালানোর খরচ মিটে যেত। বিশ্বের প্রতিটি দেশের মানুষের মনে সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে শ্রদ্ধা জাগবে, এই শিক্ষার্থীরাই দেশে ফিরে নিজ দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে যুক্ত হবে, এ রকম একটা সুদূরপ্রসারী ইচ্ছে ছিল সোভিয়েত ভাবনায়, তবে পড়াশোনার নামে ফাঁকিবাজি করেনি তারা। সেরা শিক্ষকদের নিয়ে তৈরি সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেরা পাঠদানের চেষ্টায় ত্রুটি ছিল না।
বিদেশি ছাত্রদের জন্য এক বছর রুশ ভাষা শেখার জন্য ছিল প্রিপারেটরি ফ্যাকাল্টি। বিভিন্ন ভাষাভাষীর শিক্ষার্থীরা সেখানেই পড়ত। ক্লাস শুরু হওয়ার পর আড্ডা হতো কখনো কখনো। নানা দেশের ছেলেমেয়েরা সেই আড্ডায় অংশ নিত। আমি একসময় লক্ষ করলাম, আফ্রিকার ছেলেরা কি দ্রুত ইংরেজি বলে যাচ্ছে! তখনো রুশ ভাষা ঠিকভাবে শেখা হয়নি বলে কথার আদান-প্রদান হতো ইংরেজিতে।
যারা ফরাসি বা স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলত, তারা আলাদাভাবে আড্ডা দিত। এই আপাতবিচ্ছিন্নতা কেটে গিয়েছিল রুশ ভাষায় একটু একটু করে কথা বলা শুরু হলে। শিক্ষার্থীরা তখন রুশ ভাষাতেই ভাবের আদান-প্রদান করতে পারত।
২. আফ্রিকান ছেলেমেয়েরা কীভাবে এত সুন্দর ইংরেজি বলে, সেটা আমার জন্য ছিল বিস্ময়ের ব্যাপার। এ বিষয়টি নিয়ে আমি রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞ ওয়াহিদুল হককে একটি চিঠি লিখেছিলাম। প্রশ্ন রেখেছিলাম, ‘কীভাবে আফ্রিকার ছেলেরা এত দ্রুত ইংরেজি বলতে পারে, আমি পারি না। আমিই কি ভাষা আয়ত্ত করিনি বলে পিছিয়ে পড়েছি?’
এর উত্তরে একটি অসাধারণ চিঠি লিখেছিলেন ওয়াহিদুল হক। তিনি জানিয়েছিলেন উপনিবেশীয় শোষণের কথা। বলেছিলেন, ইউরোপীয় দেশগুলো যখন এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় উপনিবেশ বানিয়েছে, তখন সেই সব দেশ থেকে তাদের সংস্কৃতি, ভাষা, জীবনব্যবস্থা সমূলে উৎপাটন করার চেষ্টা করেছে। কোথাও কোথাও সফল হয়েছে, কোথাও কোথাও হয়নি।
আফ্রিকা আর লাতিন আমেরিকার বেশির ভাগ দেশ থেকে আচরিত ভাষা হটিয়ে দিয়েছে, সংস্কৃতির মূল উপড়ে ফেলেছে। ভারতবর্ষে এ কাজটি করতে তারা এক শ ভাগ সফল হয়নি। চাপিয়ে দেওয়া ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে আপস করতে হয়েছে ঠিকই, কিন্তু নিজ ভাষা, নিজ সংস্কৃতি ধরে রাখতে পেরেছে ভারতবর্ষের লোকেরা। আফ্রিকার বহু দেশের মানুষ এখন মাতৃভাষায় কথা বলতে পারে না। তারা কথা বলে ইংরেজি অথবা ফরাসি ভাষায়। লাতিন আমেরিকার বিশাল অংশে তো স্প্যানিশই হয়ে উঠেছে রাষ্ট্রভাষা।
ওয়াহিদুল হকের চিঠিখানা আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, ভাষা ও সংস্কৃতি-প্রশ্নে আমাদের যে উত্তরাধিকার, তা খুবই ঋদ্ধ। আমরা নিজের ভাষায় নিজেকে প্রকাশ করতে পারি, এ-ও টিকে থাকার সংগ্রামে একটি বড় অর্জন। ভাষা শিক্ষার প্রতি আমার আগ্রহ এতটাই বেড়েছিল যে আমি তখন আমার পড়ালেখার বিষয় পরিবর্তন করে কুবান রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ভাষা ও সাহিত্য’ বিভাগে ভর্তি হয়েছিলাম।
ভাষার আগ্রাসনকে তখন থেকেই গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখার চেষ্টা করি।
৩. ফেব্রুয়ারি মাস এলেই আমরা ভাষা নিয়ে অতিমাত্রায় সচেতন হয়ে উঠি। ভাষা নিয়ে এমন সব কথা বলি, যা অর্থহীন। যেমন ভাষা আন্দোলনটি কেন হয়েছিল, সে কথা অনেকের কাছেই পরিষ্কার নয়। কেউ কেউ বলেন, মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার লড়াই ছিল ভাষা আন্দোলন। কেউ কেউ বলেন, জনসংখ্যার বিচারে বাংলায় কথা বলত পাকিস্তানের অধিকাংশ মানুষ। তাই উর্দুকে হটিয়ে দিয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার লড়াই ছিল ভাষা আন্দোলন।
দুটো ভাবনাই ভুল। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করার বিষয়টি খুবই ধোঁয়াটে। যে বাঙালি মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করবে, তারা ইতিহাসের একটা বড় সময় ধরেই বাংলায় নিজেকে প্রকাশ করতে চায়নি। বাংলাকে ভেবেছে নিম্নশ্রেণির মানুষের ভাষা। হিন্দু অভিজাত বাঙালি ভেবেছে, ধর্ম ও উচ্চ সাহিত্যের জন্য সংস্কৃত ভাষাই তাদের ভাবপ্রকাশের একমাত্র ভাষা। বাংলায় তা রচনা করা সম্ভব নয়। মুসলমান তো ভেবে এসেছে আরবি বা ফারসির উত্তরাধিকার তারা। বাংলা হচ্ছে হিন্দুয়ানি ভাষা। এই ভাষায় কেন করা হবে সাহিত্য রচনা? বাংলা সম্পর্কে বাঙালি হিন্দু-মুসলমানের এই দ্বিধা ছিল। কিন্তু একটা সময়ে এসে হিন্দু সম্প্রদায় বাংলাকে নিজ ভাষা হিসেবে মেনে নেয়। বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায়ের মনের দ্বিধা কাটতে আরও সময় লেগেছিল।
বাঙালি মুসলমানের সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল, ধর্ম ও সংস্কৃতির ফারাক। বাস করছে এই মাটিতে, কিন্তু মনে লালন করছে আরব দেশকে—এই দ্বিধা বরাবর বাঙালি অভিজাত মুসলমানকে বাংলা সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ করে রেখেছে। অনভিজাত বাঙালিরাই কিন্তু মধ্যযুগে দ্বিধাগ্রস্ত মন নিয়ে বাংলার চর্চা শুরু করেছিল। এই ঐতিহাসিক সত্যকে মনে রাখলে বাংলা ভাষার সংগ্রামের বিষয়টি বোঝা সহজ হবে।
হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের গরিব মানুষের কাছে বাংলাই ছিল মাতৃভাষা। ফলে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করার জন্য তখন কোনো আন্দোলন ছিল না। বাংলাতেই তো তাদের জীবনযাপন, তাই নতুন করে তা আদায় করার কিছু নেই। আন্দোলন হলো রাষ্ট্রভাষা নিয়ে, মাতৃভাষা নিয়ে নয়। পাকিস্তান সৃষ্টির আগে যখন এই বিচিত্র রাষ্ট্রটির সরকারি বা প্রশাসনিক ভাষা কী হবে, তা নিয়ে বিতর্ক উঠল, তখনই উর্দুকে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হলো রাষ্ট্রভাষা হিসেবে। পূর্ব বাংলার মানুষ প্রতিবাদ করেছিল। তারা আন্দোলনের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছিল, রাষ্ট্রভাষা হওয়ার যোগ্যতা রয়েছে বাংলার।
দ্বিতীয় প্রশ্নটির উত্তরও রয়েছে প্রথম প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই। পূর্ব বাংলা বলেনি, শুধু বাংলাকেই রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। উর্দুর পাশাপাশি বাংলাও হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা, সেটাই ছিল এই আন্দোলনের সারমর্ম। এই আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি, ভাষা আন্দোলন ছিল মূলত পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়ার আন্দোলন। মাতৃভাষার অধিকার নয়, রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা অর্জনই ছিল মুখ্য। বাংলা রাষ্ট্রভাষা হলে আমাদের মাতৃভাষা অনায়াসে তার মর্যাদা পাবে।
এরই সূত্র ধরে আমরা বলতে পারি, আমাদের ভাষা আন্দোলন আমাদের স্বাধিকার ও স্বাধীনতার দিকে নিয়ে গিয়েছে সত্য, কিন্তু ভাষা প্রসঙ্গটির যে ব্যাপ্তি, তার কাছাকাছি হওয়ার চেষ্টা খুব কমই হয়েছে। আমরা আমাদের অঙ্গীকারগুলো কতটা রক্ষা করেছি, সে প্রশ্ন উঠলে লজ্জায় মাথা কাটা যাওয়ার উপক্রম হবে।
৪. ওপরের আলোচনাটিকে বিচ্ছিন্ন আলোচনা বলে মনে হতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সঙ্গে বর্তমান পরিপ্রেক্ষিত যোগ করলে আমরা বুঝতে পারব, বাংলা ভাষা নিয়ে আমাদের চিন্তা-ভাবনায় রয়েছে গলদ। ওয়াহিদুল হক উপনিবেশীকরণের সময় দখলকৃত কোনো দেশের জাতীয় ভাষাগুলোকে যেভাবে হটিয়ে দেওয়ার কথা শুনিয়েছিলেন, সেভাবে হয়তো এখন আর ভাষা তার জায়গা হারাচ্ছে না, কিন্তু ভাষার ওপর ভাষার আগ্রাসন এখনো চলছে।
দুটো প্রসঙ্গ আনব ভেবে দেখার জন্য। বাংলা ছাড়াও আমাদের এ দেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর আরও কিছু ভাষা রয়েছে। সেই ভাষাব্যবহারকারীদের সংখ্যা কমছে। বাংলা ভাষা ছাড়া উচ্চশিক্ষার উপায় নেই বলে সেই ভাষাগুলোর বেশির ভাগেরই উন্নতি হচ্ছে না।
একটা ভাষার লিখিত রূপ ও তার সাহিত্য না থাকলে, সেই ভাষা ধীরে ধীরে অবসিত হতে থাকে। ভাষা আন্দোলন রাষ্ট্রভাষার আন্দোলন ছিল বটে, কিন্তু প্রশ্নটিকে আরও প্রসারিত করলে দেখা যাবে, মাতৃভাষাকে মর্যাদা দেওয়ার বিষয়টিও আন্দোলনের মধ্যে প্রচ্ছন্ন ছিল এবং তা শুধু বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে নয়। দেশে প্রচলিত সব ভাষার মর্যাদা রক্ষার দায় রয়েছে ভাষা আন্দোলনের। সেটা কীভাবে রক্ষা হচ্ছে, তা দেখা দরকার।
দ্বিতীয় প্রসঙ্গটি বাংলা ভাষা নিয়েই। উচ্চশিক্ষায় ইংরেজির দাপট এখনো এমন পর্যায়ে রয়েছে যে, ওই ভাষাটা না জানলে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকেই বেশির ভাগ বিষয়ে ডিগ্রি নেওয়া যাবে না, এমনকি উচ্চশিক্ষিত হওয়া যাবে না। বাংলা ভাষার প্রতি আমাদের যে মমত্ব নেই, সেটা বোঝার জন্য রকেট সায়েন্টিস্ট হতে হয় না। এ বিষয়টি নিয়েই আমরা পরবর্তী পর্বে আলোচনা করব।
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
প্রবৃদ্ধির শীর্ষে থেকেও বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের দৌড়ে পিছিয়ে রয়েছে। ২০১৪ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি ৫০ দশমিক ৭৯ শতাংশ বেড়েছে
১ দিন আগেদুর্নীতি, মূল্যস্ফীতি, উচ্চ করহারসহ ১৭ ধরনের বাধায় বিপর্যস্ত দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য। রয়েছে সামাজিক সমস্যাও।
১ দিন আগেজমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
৫ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৮ দিন আগে