সানজিদা সামরিন
মনে প্রায়ই একটা প্রশ্ন জাগে—অভিভাবকেরা যা করেন, যা সিদ্ধান্ত নেন, তার সবটাতেই কি সন্তানের মঙ্গল হয়? অভিভাবকেরাও তো মানুষ, তাঁদেরও তো ভুল হয়। কী, হয় না? কিন্তু তাঁদের সিদ্ধান্তও যে ভুল হতে পারে, এ কথা বলার মতো বুকের পাটা আসলে নেই অধিকাংশেরই। যেমন আমি এখন এ কথা লিখছি এবং আমার প্রতিটি শব্দেই লুকিয়ে আছে প্রবল অপরাধবোধ। নিজের মনই বলছে, ‘লিখো না, লিখো না ওসব!’
পরিবার, সমাজ ও আশপাশের পরিস্থিতি প্রতিক্ষণেই আমাদের শোনায়, বোঝায় ও বলে, ‘ভুল তোমার, অভিভাবকের কোনো ভুল নেই। হয় না। তাঁরা নির্ভুল।’ আমার প্রায়ই মনে হয়, আমাদের দেশের অধিকাংশ অভিভাবকই কোনটা দায়িত্ব ও কোনটা সঠিক সিদ্ধান্ত, তা গুলিয়ে ফেলেন। বেশির ভাগ সময়ই দায়িত্বের কোটা পূরণ করে নির্বাণ লাভ করেন অভিভাবকেরা। কিন্তু দেখা যায় তাঁদের ভুল সিদ্ধান্তের ফল গোটা জীবন ধরে ভোগ করছে সন্তানেরা।
যদি নিজের সিদ্ধান্তকে পরে ভুল বলে বুঝতে পারেন, তখন দেওয়ার মতো উত্তরও তাঁদের তৈরি থাকে। কখনো ভাগ্য়কে দোষ দিয়ে আবার কখনো সন্তানকে পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে হয়তো তাঁরা একধরনের মুক্তি পান। কিন্তু ভুক্তভোগী সন্তান তো জীবনকে এড়িয়ে বাঁচতে পারে না। আবার অভিভাবকদের দোষও দেওয়া যায় না। কারণ এমন নিয়ম নেই।
জন্মের পর থেকেই আমাদের শেখানো হয়—সব ভুল সন্তানের, মা-বাবার কোনো ভুল নেই। মা-বাবা কখনো ভুল সিদ্ধান্ত নেন না। এই যে এত কথা লিখছি, যাঁরা পড়বেন, তাঁরা নিশ্চয়ই ভাবছেন লেখক কতটা উদ্ধত চরিত্রের যে অভিভাবকদের দুষছেন! অথবা লেখক বুঝি অবাধ্য সন্তান, তাই এমনটা লিখছেন। কিন্তু কখনো না কখনো আমার বয়সও বেড়ে ৬০ কি ৭০ হবে। আমি জানি, তখন আর কেউই আমাকে দোষারোপ করবেন না। কারণ আমাদের পরিবার, বেড়ে ওঠা সংস্কার ও সমাজ আপনাদের শিখিয়েছে, ‘বয়োজ্যেষ্ঠদের ভুল নেই;’ অর্থাৎ আমি ব্যক্তিমানুষ যতই ভুলে জর্জরিত হই না কেন, ওই বয়সে পৌঁছে আমি ঠিকই পাপমুক্ত, ভুলমুক্ত হয়ে শুদ্ধ মানুষ হয়ে যাব! তখন আমি যা বলব, তাই হবে ঠিক। তখন দোষ হবে হয়তো আমার কনিষ্ঠদের। কনিষ্ঠ বা সন্তান হওয়ার অপরাধে সব ভুল হবে ওদের। আর বয়োজ্যেষ্ঠ হওয়ার গুণে আমার সাত খুন মাফ হয়ে যাবে।
১. যে বিষয়টি নিয়ে এখন বলব, আমি জানি এ বিষয়ে এখনো অনেকেই কথা বলতে রাজি নন। তবে সত্য অপ্রিয় হলেও তা সত্য়। একটি মেয়ে যখন আত্মীয়স্বজনের মধ্য়ে কারও দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হয়, তখন তা মা-বাবা বা পরিবারের বড় কাউকে জানালেও কোনো লাভ হয় না। প্রথমত, কিছু ক্ষেত্রে পরিবার মেয়েটির কথা বিশ্বাস করতে চায় না। দ্বিতীয়ত, পরিবার যখন জানতে পারে নিকটাত্মীয় দ্বারা মেয়েটি কোনো না কোনোভাবে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে, তখন তাঁরাই মেয়েটিকে বলেন যেন সে ব্যাপারটা চেপে যায়। কারণ প্রথমত, জানাজানি হলে মানসম্মান যাবে আর পরে ওই আত্মীয়ের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হবে। কথা হচ্ছে, পাড়ার মোড়ে কোনো ছেলে যদি মেয়ের দিকে তাকায় তাহলে পরিবার সেই ছেলেকে শাস্তি দেওয়ার জন্য উদ্গ্রীব হলেও, আত্মীয়ের মধ্য়ে কেউ নিজের মেয়েকে যৌন হয়রানি করলে পরিবার নিশ্চুপ থাকে। কন্যার সম্মান নষ্ট করে আত্মীয়তার সম্পর্ক রাখা পরিবারের মান বা সম্মান ঠিক কোথায়—বোঝা কঠিন হয়ে যায় অনেক সময়। ব্যাপারটা অনেকটা যেন এমন, আত্মীয় যদি নিজের মেয়েকে যৌন নির্যাতন করে তাহলে সমস্যা নেই, কিন্তু বাইরের কোনো ছেলে মেয়ের দিকে তাকালে ওই ছেলে খারাপ, কারণ সে আত্মীয় নয়! এখানে স্পষ্ট বলতে পারি, পরিবারের এই অদ্ভুত সিদ্ধান্তে সন্তানের মঙ্গল হয় না। আশপাশে এমন ঘটনা দেখলে মনে হয়, কাহলিল জিবরান যেমন লিখেছিলেন, ‘ইয়োর চিলড্রেন আর নট ইয়োর চিলড্রেন।’ তেমনি যদি লিখতে পারতাম, ‘সামটাইমস ইয়োর প্যারেন্টস আর নট ইয়োর গার্ডিয়ান।’
২. পরিবারের মেয়েটির যখন বিয়ের বয়স হয়, তখন অনেক পরিবারেই তাঁর বিয়ের তোড়জোড় চলে। কিন্তু ঠিক ওই সময়টায় মেয়েটি বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হতে চাইছে কি না, সেটা তখন গৌণ হয়ে পড়ে। মুখ্য হয়ে পড়ে ‘অভিভাবকেরা কখনো সন্তানের খারাপ চান না’। কিন্তু বিয়ে যে ওই মানুষটার জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় এবং সেই অধ্যায়ে পা রাখতে গেলে কিছু মানসিক প্রস্তুতি রয়েছে, সেটা ভাবার অনেকেই নেই। এখনো। অনিচ্ছা সত্ত্বে অসময়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসে কেবল ‘মানিয়ে নাও’-এর চাকার ওপরই কি ওই মেয়েটির জীবন চলবে? এভাবে ভাবার মতো এখনো অনেকেই নেই। যাঁরা ভাবেন, তাঁদের কথা হচ্ছে না।
যদি অন্যভাবে বলি তাহলে, আপনার পছন্দ করা পাত্রকে আপনার মেয়ে বিয়ে করতে চাইছেন না বলে হয়তো তার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিচ্ছেন বা যে তরিকায় কথা বলছেন তা ছুরির আঘাতের চেয়েও ভয়ানক। এটা কি আদৌ সংগত বা তাঁর মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ভালো হচ্ছে বলে ধরে নেওয়া যায়? দ্বিতীয়ত, আপনার সন্তান যদি আত্মনির্ভরশীল হয় এবং আপনার ওপর সেই অর্থে তাঁর ভরণপোষণের দায়িত্ব পালন করার চাপ না থাকে, তাহলে সে কি তার ইচ্ছায় আর কিছুদিন বাবা-মায়ের বাড়িতে থাকতে পারে না? এ কথা বলার কারণ, একটা সময় ছিল যখন বিয়ের আগে নারীর সব ধরনের খরচ বাবাকে ও বিয়ের পর স্বামীকে বহন করতে হতো। অভাবী পরিবারগুলোয় মেয়ে দ্রুত বিয়ে দেওয়ার অন্যতম কারণ ছিল যেন মেয়েটি অন্য কোথাও হলেও ভাত-কাপড়ে বেঁচে থাকে। আর নিজের পরিবারে একটা মুখ কমে। মুখ কমলে ভাতের জোগানও স্বাভাবিকভাবে কমবে। কিন্তু এখন?
৩. অনেক পরিবারেই দেখা যায়, মেয়ের প্রেমের সম্পর্ক আছে জানার পর বিয়ের চাপ আরও দ্রুত এসে পড়ে মেয়েটির কাঁধে। কারণ ‘মেয়েটির ভালোর জন্য!’ নিজের সন্তান যেন কোনো ভুল না করে বসে তাই দ্রুত সাত পাকে বেঁধে দিতে পারলেই দায় সারা! কিন্তু মেয়েটির বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতে আরও কিছু সময় চায় কি না, তা দেখার কেউ নেই। কারণ সম্পর্ক থাকলেও সেই সম্পর্ক সারা জীবন কতটা সুন্দরভাবে টেনে নেওয়া যাবে, তা বোঝার জন্যও সময় দরকার। কিন্তু সেই সময় অনেক ক্ষেত্রেই পাওয়া যায় না। ফলে পরে ভোগান্তি হলে অভিভাবকেরাই বলে ওঠেন, ‘তোমাদের সম্পর্ক ছিল বলেই বিয়ে দিয়েছি। এখন সামলাতে পারছ না!’ এতেও অভিভাবকের মুক্তি লাভ হয়। কিন্তু সেই সন্তান কখনোই বলতে পারে না, ‘আমি তো সময় চেয়েছিলাম বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতে! তোমরা দাওনি!’ কারণ এসব বলতে নেই। কিন্তু একটা প্রশ্ন, অভিভাবকেরা যেমন কিছু হলেই বলতে পারেন, ‘আমার মানসম্মান রেখো’, যদি সন্তানও সেটা বলতে পারত ‘এমন কিছু কোরো না, যাতে আমার সম্মানহানি হয় বা জীবনটা জলে যায়...!’ প্রকৃতির দিকে তাকালে অন্তত এটুকু তো আমরা বলতে পারি, অভিভাবক ও সন্তান দুজনই মানুষ, দুইয়েরই ব্যক্তিগত সামাজিক জীবন ও মানসম্মান নিয়ে বাঁচার অধিকার আছে।
৪. অভিভাবক বলতে আমি যেটুকু বুঝি—জীবনবোধ যিনি শেখান, আগলে রাখেন, যিনি পথ দেখান। আমাদের এখানে নারীর অভিভাবক দুই প্রকার। বিয়ের আগে মা-বাবা আর বিয়ের পরে স্বামী। কিন্তু স্ত্রী হিসেবে আমাদের দেশের নারীরা তাঁদের স্বামীকে একপ্রকার মায়ের মতোই আগলে রাখেন। উল্টো করে বললে, অভিভাবক যদি হতেই হয় তাহলে খুব কম স্বামীর মধ্য়েই নিজের বাবার ছায়া খুঁজে পাওয়া যায়। বর্তমানে কর্মজীবী নারীদের বেলায় তাঁদের ভরণপোষণের চাপও অনেক স্বামীকে নিতে হচ্ছে না। এটা ইতিবাচক। একজন মানুষের অবশ্যই সক্ষমতা থাকতে হবে। কিন্তু সমাজ তো সুবিধা নেবেই। মেয়েটি যতই মাতৃসুলভ হয়ে স্বামী আগলে রাখুক বা নিজের দায়িত্ব নিজে নিক, তাতে কিছুই আসে-যায় না। ফলে মেয়েটির জীবনের সব সিদ্ধান্ত বিয়ের পর স্বামীই নেবেন। বলা ভালো, স্বামী ও মেয়েটির পরিবার যখন যেভাবে সুবিধা তাদের সিদ্ধান্ত আরোপ করবে মেয়েটির ওপর।
এমন তো এখনো হয়—স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া হয়েছে; স্বামী চড়াও হয়ে মেয়েটির বাপের বাড়িতে নালিশ জানিয়েছে। আমাদের দেশে ছেলের পরিবার ছেলের অপরাধ, দোষ ঢেকে তাকে সমর্থন জানালেও খুব কম মেয়ের পরিবারই মেয়ের সঙ্গে হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ জানায়।কারণ যুক্তি তো এখানেও আছে। নারীকে তো একটু ধৈর্যশীল হতেই হবে, মানিয়েও নেওয়া চাই সর্বদা। ফলে মেয়ের পক্ষে কথা বলাটা খুব জরুরি কিছু না। শঙ্কা এখানেই শেষ নয়, ছেলেপক্ষের বিরুদ্ধে বললে যদি মেয়েটি তালাকপ্রাপ্ত হয়, সেটা আরও বড় ঝুঁকির। কারণ কেন যেন নারী চাইলেই নিজের ইচ্ছেমতো সময় অবধি বাবার বাড়ি থাকতে পারে না, ইচ্ছেমতো বয়সে বিয়ে করতে পারে না, তালাক হওয়ার পর যদি মেয়েকে বাবার বাড়ি ফেরত যেতে হয়, তখন অধিকাংশ অভিভাবকই তাঁকে হৃদয় থেকে স্বাগত জানান না। গুটিকয়েক যাঁদের এমন হয় না, লেখাটি তাঁদের জন্য নয়। অভিভাবকের সব সিদ্ধান্তই মন্দ নয়। কিন্তু সবই কি মঙ্গল ডেকে আনে?
লেখক: সহসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
মনে প্রায়ই একটা প্রশ্ন জাগে—অভিভাবকেরা যা করেন, যা সিদ্ধান্ত নেন, তার সবটাতেই কি সন্তানের মঙ্গল হয়? অভিভাবকেরাও তো মানুষ, তাঁদেরও তো ভুল হয়। কী, হয় না? কিন্তু তাঁদের সিদ্ধান্তও যে ভুল হতে পারে, এ কথা বলার মতো বুকের পাটা আসলে নেই অধিকাংশেরই। যেমন আমি এখন এ কথা লিখছি এবং আমার প্রতিটি শব্দেই লুকিয়ে আছে প্রবল অপরাধবোধ। নিজের মনই বলছে, ‘লিখো না, লিখো না ওসব!’
পরিবার, সমাজ ও আশপাশের পরিস্থিতি প্রতিক্ষণেই আমাদের শোনায়, বোঝায় ও বলে, ‘ভুল তোমার, অভিভাবকের কোনো ভুল নেই। হয় না। তাঁরা নির্ভুল।’ আমার প্রায়ই মনে হয়, আমাদের দেশের অধিকাংশ অভিভাবকই কোনটা দায়িত্ব ও কোনটা সঠিক সিদ্ধান্ত, তা গুলিয়ে ফেলেন। বেশির ভাগ সময়ই দায়িত্বের কোটা পূরণ করে নির্বাণ লাভ করেন অভিভাবকেরা। কিন্তু দেখা যায় তাঁদের ভুল সিদ্ধান্তের ফল গোটা জীবন ধরে ভোগ করছে সন্তানেরা।
যদি নিজের সিদ্ধান্তকে পরে ভুল বলে বুঝতে পারেন, তখন দেওয়ার মতো উত্তরও তাঁদের তৈরি থাকে। কখনো ভাগ্য়কে দোষ দিয়ে আবার কখনো সন্তানকে পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে হয়তো তাঁরা একধরনের মুক্তি পান। কিন্তু ভুক্তভোগী সন্তান তো জীবনকে এড়িয়ে বাঁচতে পারে না। আবার অভিভাবকদের দোষও দেওয়া যায় না। কারণ এমন নিয়ম নেই।
জন্মের পর থেকেই আমাদের শেখানো হয়—সব ভুল সন্তানের, মা-বাবার কোনো ভুল নেই। মা-বাবা কখনো ভুল সিদ্ধান্ত নেন না। এই যে এত কথা লিখছি, যাঁরা পড়বেন, তাঁরা নিশ্চয়ই ভাবছেন লেখক কতটা উদ্ধত চরিত্রের যে অভিভাবকদের দুষছেন! অথবা লেখক বুঝি অবাধ্য সন্তান, তাই এমনটা লিখছেন। কিন্তু কখনো না কখনো আমার বয়সও বেড়ে ৬০ কি ৭০ হবে। আমি জানি, তখন আর কেউই আমাকে দোষারোপ করবেন না। কারণ আমাদের পরিবার, বেড়ে ওঠা সংস্কার ও সমাজ আপনাদের শিখিয়েছে, ‘বয়োজ্যেষ্ঠদের ভুল নেই;’ অর্থাৎ আমি ব্যক্তিমানুষ যতই ভুলে জর্জরিত হই না কেন, ওই বয়সে পৌঁছে আমি ঠিকই পাপমুক্ত, ভুলমুক্ত হয়ে শুদ্ধ মানুষ হয়ে যাব! তখন আমি যা বলব, তাই হবে ঠিক। তখন দোষ হবে হয়তো আমার কনিষ্ঠদের। কনিষ্ঠ বা সন্তান হওয়ার অপরাধে সব ভুল হবে ওদের। আর বয়োজ্যেষ্ঠ হওয়ার গুণে আমার সাত খুন মাফ হয়ে যাবে।
১. যে বিষয়টি নিয়ে এখন বলব, আমি জানি এ বিষয়ে এখনো অনেকেই কথা বলতে রাজি নন। তবে সত্য অপ্রিয় হলেও তা সত্য়। একটি মেয়ে যখন আত্মীয়স্বজনের মধ্য়ে কারও দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হয়, তখন তা মা-বাবা বা পরিবারের বড় কাউকে জানালেও কোনো লাভ হয় না। প্রথমত, কিছু ক্ষেত্রে পরিবার মেয়েটির কথা বিশ্বাস করতে চায় না। দ্বিতীয়ত, পরিবার যখন জানতে পারে নিকটাত্মীয় দ্বারা মেয়েটি কোনো না কোনোভাবে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে, তখন তাঁরাই মেয়েটিকে বলেন যেন সে ব্যাপারটা চেপে যায়। কারণ প্রথমত, জানাজানি হলে মানসম্মান যাবে আর পরে ওই আত্মীয়ের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হবে। কথা হচ্ছে, পাড়ার মোড়ে কোনো ছেলে যদি মেয়ের দিকে তাকায় তাহলে পরিবার সেই ছেলেকে শাস্তি দেওয়ার জন্য উদ্গ্রীব হলেও, আত্মীয়ের মধ্য়ে কেউ নিজের মেয়েকে যৌন হয়রানি করলে পরিবার নিশ্চুপ থাকে। কন্যার সম্মান নষ্ট করে আত্মীয়তার সম্পর্ক রাখা পরিবারের মান বা সম্মান ঠিক কোথায়—বোঝা কঠিন হয়ে যায় অনেক সময়। ব্যাপারটা অনেকটা যেন এমন, আত্মীয় যদি নিজের মেয়েকে যৌন নির্যাতন করে তাহলে সমস্যা নেই, কিন্তু বাইরের কোনো ছেলে মেয়ের দিকে তাকালে ওই ছেলে খারাপ, কারণ সে আত্মীয় নয়! এখানে স্পষ্ট বলতে পারি, পরিবারের এই অদ্ভুত সিদ্ধান্তে সন্তানের মঙ্গল হয় না। আশপাশে এমন ঘটনা দেখলে মনে হয়, কাহলিল জিবরান যেমন লিখেছিলেন, ‘ইয়োর চিলড্রেন আর নট ইয়োর চিলড্রেন।’ তেমনি যদি লিখতে পারতাম, ‘সামটাইমস ইয়োর প্যারেন্টস আর নট ইয়োর গার্ডিয়ান।’
২. পরিবারের মেয়েটির যখন বিয়ের বয়স হয়, তখন অনেক পরিবারেই তাঁর বিয়ের তোড়জোড় চলে। কিন্তু ঠিক ওই সময়টায় মেয়েটি বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হতে চাইছে কি না, সেটা তখন গৌণ হয়ে পড়ে। মুখ্য হয়ে পড়ে ‘অভিভাবকেরা কখনো সন্তানের খারাপ চান না’। কিন্তু বিয়ে যে ওই মানুষটার জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় এবং সেই অধ্যায়ে পা রাখতে গেলে কিছু মানসিক প্রস্তুতি রয়েছে, সেটা ভাবার অনেকেই নেই। এখনো। অনিচ্ছা সত্ত্বে অসময়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসে কেবল ‘মানিয়ে নাও’-এর চাকার ওপরই কি ওই মেয়েটির জীবন চলবে? এভাবে ভাবার মতো এখনো অনেকেই নেই। যাঁরা ভাবেন, তাঁদের কথা হচ্ছে না।
যদি অন্যভাবে বলি তাহলে, আপনার পছন্দ করা পাত্রকে আপনার মেয়ে বিয়ে করতে চাইছেন না বলে হয়তো তার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিচ্ছেন বা যে তরিকায় কথা বলছেন তা ছুরির আঘাতের চেয়েও ভয়ানক। এটা কি আদৌ সংগত বা তাঁর মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ভালো হচ্ছে বলে ধরে নেওয়া যায়? দ্বিতীয়ত, আপনার সন্তান যদি আত্মনির্ভরশীল হয় এবং আপনার ওপর সেই অর্থে তাঁর ভরণপোষণের দায়িত্ব পালন করার চাপ না থাকে, তাহলে সে কি তার ইচ্ছায় আর কিছুদিন বাবা-মায়ের বাড়িতে থাকতে পারে না? এ কথা বলার কারণ, একটা সময় ছিল যখন বিয়ের আগে নারীর সব ধরনের খরচ বাবাকে ও বিয়ের পর স্বামীকে বহন করতে হতো। অভাবী পরিবারগুলোয় মেয়ে দ্রুত বিয়ে দেওয়ার অন্যতম কারণ ছিল যেন মেয়েটি অন্য কোথাও হলেও ভাত-কাপড়ে বেঁচে থাকে। আর নিজের পরিবারে একটা মুখ কমে। মুখ কমলে ভাতের জোগানও স্বাভাবিকভাবে কমবে। কিন্তু এখন?
৩. অনেক পরিবারেই দেখা যায়, মেয়ের প্রেমের সম্পর্ক আছে জানার পর বিয়ের চাপ আরও দ্রুত এসে পড়ে মেয়েটির কাঁধে। কারণ ‘মেয়েটির ভালোর জন্য!’ নিজের সন্তান যেন কোনো ভুল না করে বসে তাই দ্রুত সাত পাকে বেঁধে দিতে পারলেই দায় সারা! কিন্তু মেয়েটির বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতে আরও কিছু সময় চায় কি না, তা দেখার কেউ নেই। কারণ সম্পর্ক থাকলেও সেই সম্পর্ক সারা জীবন কতটা সুন্দরভাবে টেনে নেওয়া যাবে, তা বোঝার জন্যও সময় দরকার। কিন্তু সেই সময় অনেক ক্ষেত্রেই পাওয়া যায় না। ফলে পরে ভোগান্তি হলে অভিভাবকেরাই বলে ওঠেন, ‘তোমাদের সম্পর্ক ছিল বলেই বিয়ে দিয়েছি। এখন সামলাতে পারছ না!’ এতেও অভিভাবকের মুক্তি লাভ হয়। কিন্তু সেই সন্তান কখনোই বলতে পারে না, ‘আমি তো সময় চেয়েছিলাম বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতে! তোমরা দাওনি!’ কারণ এসব বলতে নেই। কিন্তু একটা প্রশ্ন, অভিভাবকেরা যেমন কিছু হলেই বলতে পারেন, ‘আমার মানসম্মান রেখো’, যদি সন্তানও সেটা বলতে পারত ‘এমন কিছু কোরো না, যাতে আমার সম্মানহানি হয় বা জীবনটা জলে যায়...!’ প্রকৃতির দিকে তাকালে অন্তত এটুকু তো আমরা বলতে পারি, অভিভাবক ও সন্তান দুজনই মানুষ, দুইয়েরই ব্যক্তিগত সামাজিক জীবন ও মানসম্মান নিয়ে বাঁচার অধিকার আছে।
৪. অভিভাবক বলতে আমি যেটুকু বুঝি—জীবনবোধ যিনি শেখান, আগলে রাখেন, যিনি পথ দেখান। আমাদের এখানে নারীর অভিভাবক দুই প্রকার। বিয়ের আগে মা-বাবা আর বিয়ের পরে স্বামী। কিন্তু স্ত্রী হিসেবে আমাদের দেশের নারীরা তাঁদের স্বামীকে একপ্রকার মায়ের মতোই আগলে রাখেন। উল্টো করে বললে, অভিভাবক যদি হতেই হয় তাহলে খুব কম স্বামীর মধ্য়েই নিজের বাবার ছায়া খুঁজে পাওয়া যায়। বর্তমানে কর্মজীবী নারীদের বেলায় তাঁদের ভরণপোষণের চাপও অনেক স্বামীকে নিতে হচ্ছে না। এটা ইতিবাচক। একজন মানুষের অবশ্যই সক্ষমতা থাকতে হবে। কিন্তু সমাজ তো সুবিধা নেবেই। মেয়েটি যতই মাতৃসুলভ হয়ে স্বামী আগলে রাখুক বা নিজের দায়িত্ব নিজে নিক, তাতে কিছুই আসে-যায় না। ফলে মেয়েটির জীবনের সব সিদ্ধান্ত বিয়ের পর স্বামীই নেবেন। বলা ভালো, স্বামী ও মেয়েটির পরিবার যখন যেভাবে সুবিধা তাদের সিদ্ধান্ত আরোপ করবে মেয়েটির ওপর।
এমন তো এখনো হয়—স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া হয়েছে; স্বামী চড়াও হয়ে মেয়েটির বাপের বাড়িতে নালিশ জানিয়েছে। আমাদের দেশে ছেলের পরিবার ছেলের অপরাধ, দোষ ঢেকে তাকে সমর্থন জানালেও খুব কম মেয়ের পরিবারই মেয়ের সঙ্গে হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ জানায়।কারণ যুক্তি তো এখানেও আছে। নারীকে তো একটু ধৈর্যশীল হতেই হবে, মানিয়েও নেওয়া চাই সর্বদা। ফলে মেয়ের পক্ষে কথা বলাটা খুব জরুরি কিছু না। শঙ্কা এখানেই শেষ নয়, ছেলেপক্ষের বিরুদ্ধে বললে যদি মেয়েটি তালাকপ্রাপ্ত হয়, সেটা আরও বড় ঝুঁকির। কারণ কেন যেন নারী চাইলেই নিজের ইচ্ছেমতো সময় অবধি বাবার বাড়ি থাকতে পারে না, ইচ্ছেমতো বয়সে বিয়ে করতে পারে না, তালাক হওয়ার পর যদি মেয়েকে বাবার বাড়ি ফেরত যেতে হয়, তখন অধিকাংশ অভিভাবকই তাঁকে হৃদয় থেকে স্বাগত জানান না। গুটিকয়েক যাঁদের এমন হয় না, লেখাটি তাঁদের জন্য নয়। অভিভাবকের সব সিদ্ধান্তই মন্দ নয়। কিন্তু সবই কি মঙ্গল ডেকে আনে?
লেখক: সহসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
প্রবৃদ্ধির শীর্ষে থেকেও বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের দৌড়ে পিছিয়ে রয়েছে। ২০১৪ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি ৫০ দশমিক ৭৯ শতাংশ বেড়েছে
১ দিন আগেদুর্নীতি, মূল্যস্ফীতি, উচ্চ করহারসহ ১৭ ধরনের বাধায় বিপর্যস্ত দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য। রয়েছে সামাজিক সমস্যাও।
১ দিন আগেজমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
৫ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৯ দিন আগে