বিভুরঞ্জন সরকার
দুই পক্ষের মিছিল, পাল্টা মিছিল, স্লোগান, ধাক্কাধাক্কি, ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, আইনজীবী ও সাংবাদিকদের ওপর পুলিশের হামলা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে সভাপতি ও সম্পাদকসহ ১৪টি পদের সব কটিতে জয় পেয়েছেন আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্যানেল থেকে মনোনীত প্রার্থীরা। বিএনপি এই নির্বাচনকে একতরফা বলেছে। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ফলাফল বাতিল ও নতুন নির্বাচনের দাবি করেছেন। এই দাবি মানা হবে কি না, বলা মুশকিল। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, বিএনপি ঝামেলা তৈরি করতে পারে, দাবিও জানাতে পারে; তবে দাবি আদায় করতে পারে না। তা ছাড়া, বিএনপির সমর্থক আইনজীবীরা আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচন বর্জন করেননি।
তাঁদের সমর্থকেরা ভোটদানে বিরতও ছিলেন না। তাঁদের আপত্তি সত্ত্বেও ভোট যে চলেছে, সেটা অস্বীকার করা যাবে না। কেউ যদি বলেন, আওয়ামী লীগ চেয়েছে বিএনপিকে ভোট থেকে দূরে রেখে বিপুল বিজয় পেতে এবং বিএনপি এ ক্ষেত্রে তাদের সহযোগিতা করেছে, তাহলে তার সন্তোষজনক জবাব বিএনপির কাছে আছে কি?
আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি মুখোমুখি অবস্থান এখন নিত্যদিনের ঘটনা। কিন্তু বিএনপির চাপের কারণে আওয়ামী লীগ পিছু হটেছে, এমনটা কি একবারও হয়েছে? সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনও বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা নিজেদের সুবিধামতো পরিবেশে করতে চেয়েছেন, কিন্তু নির্বাচন হয়েছে আওয়ামী লীগের পছন্দমতো। এই অবস্থার জন্য কোন দলের দায় বেশি, তা নিয়ে বিতর্ক করা যাবে, ফয়সালায় পৌঁছা যাবে না। কারণ, দেশের মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এখানে একমত হওয়ার আশা করা দুরাশা ছাড়া কিছু নয়।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরাও রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ছাড়া অন্য রাজনৈতিক বিশ্বাসের আইনজীবীও আছেন। তবে আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে বরাবরই মূলত প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়ে থাকে দুটি প্যানেলের মধ্যে। একটি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন আইনজীবীদের সংগঠন বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ (সাদা দল হিসেবে পরিচিত) মনোনীত প্যানেল। অন্যটি বিএনপির নেতৃত্বাধীন জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ঐক্য প্যানেল (নীল দল হিসেবে পরিচিত)।
১৫ ও ১৬ মার্চ অনুষ্ঠিত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যা যা হয়েছে, তা অনভিপ্রেত ও অনাকাঙ্ক্ষিত। সুপ্রিম কোর্ট দেশের সর্বোচ্চ আদালত। বলা হয়ে থাকে ন্যায়বিচার পাওয়ার শেষ আশ্রয় সুপ্রিম কোর্ট। বিচারপতি এবং আইনজীবী মিলেই ন্যায়বিচার প্রাপ্তির প্রত্যাশা পূরণ হয়। আইনজীবীদের বলা হয় ‘অফিসার্স অব দ্য কোর্ট’। সেই আইনজীবীরা যদি নিজেদের মধ্যকার কোনো সমস্যা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে না পারেন, তাঁদের যদি লাঠি হাতে শারীরিক শক্তি পরীক্ষায় নামতে হয়, তাহলে সাধারণ মানুষের আশা-ভরসার কোনো জায়গা থাকে?
ঘোষিত ফলাফল অনুসারে সাদা প্যানেলের প্রার্থী মোমতাজ উদ্দিন ফকির ৩ হাজার ৭২৫ ভোট পেয়ে সভাপতি হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন। সভাপতি পদে নীল প্যানেলের প্রার্থী মাহবুব উদ্দিন খোকন ২৯৩ ভোট পেয়েছেন।সাদা প্যানেলের প্রার্থী মো. আবদুন নূর ৩ হাজার ৭৪১ ভোট পেয়ে সম্পাদক পদে পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন। এই পদে নীল প্যানেলের প্রার্থী মো. রুহুল কুদ্দুস ৩০৯ ভোট পেয়েছেন। ভোট স্বাভাবিকভাবে হলে দুই পক্ষের এমন ভোটের ব্যবধান হওয়ার কথা নয়। বিএনপির আইনজীবীরা ভোটে আন্তরিকভাবে অংশ নিলে ফলাফল কী হতো, তা নিয়ে এখন জল্পনা করা অর্থহীন। আইনজীবীদের মধ্যে বিএনপির সমর্থক বেশি না আওয়ামী লীগের—এটাও নিশ্চিত করে বলা কঠিন। তবে বিএনপি শক্তিশালী অবস্থানেই আছে। গত নির্বাচনে (২০২২-২৩) সভাপতি ও সম্পাদকসহ সাতটি পদে জয় পেয়েছিলেন আওয়ামী লীগ-সমর্থিত আইনজীবীরা। অপর সাতটি পদে জয় পেয়েছিলেন বিএনপি-সমর্থিত আইনজীবীরা। এবার বিএনপির প্রার্থীরা একটি পদেও জয় পাননি। এটা কি শুধু আওয়ামী লীগের জবরদস্তির কারণে, নাকি বিএনপির কৌশলেও কিছু ত্রুটি ছিল?
এবার নির্বাচনের নির্ধারিত তারিখ ছিল ১৫ ও ১৬ মার্চ। জটিলতা শুরু হয় ১৩ মার্চ থেকে। সেদিন নির্বাচন পরিচালনাসংক্রান্ত উপকমিটির আহ্বায়ক সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মো. মনসুরুল হক চৌধুরী ‘ব্যক্তিগত’ কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করেন। দুই পক্ষই ঐকমত্যের ভিত্তিতে তাঁকে আহ্বায়ক হিসেবে মেনে নিয়েছিল। প্রশ্ন হলো, তাঁকে পদত্যাগ করতে হলো কেন? তিনি আওয়ামী লীগ করেন, তবে একজন সৎ, দায়িত্ববান ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ হিসেবে তাঁর সুনাম আছে। তিনি পদত্যাগ করার পর মঙ্গলবার সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগ-সমর্থিত আইনজীবীরা নির্বাচন পরিচালনাসংক্রান্ত উপকমিটির আহ্বায়ক হিসেবে মো. মনিরুজ্জামানকে মনোনীত করেন। এরপর বিএনপি-সমর্থিত আইনজীবীরা এ এস এম মোকতার কবির খানকে আহ্বায়ক মনোনীত করেন। কেন ঐকমত্যের ভিত্তিতে একজনকে মনোনীত করা হলো না? দুই পক্ষই পরিস্থিতি নিজেদের অনুকূলে রাখতে চেয়েছে। সম্ভবত তাই কেউ যার যার পছন্দের বাইরে যেতে চায়নি। আওয়ামী লীগ জয়ের নিশ্চয়তা চেয়েছে। আর বিএনপি সম্ভবত চেয়েছে আওয়ামী লীগের সময়ে ভালো নির্বাচন করা সম্ভব নয়, এটা প্রমাণ করতে। এদিক থেকে দেখলে দুই পক্ষই সফল হয়েছে। আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা বিপুল জয় পেয়েছেন। বিএনপি নির্বাচনটিকে হাস্যকর, বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির একতরফা নির্বাচনের ফলাফল বাতিল ও নতুন নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেছেন, ভোট ডাকাতিতে সিদ্ধহস্ত আওয়ামী লীগের মুখোশ আরেকবার উন্মোচিত হলো। দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থার কফিনে শেষ পেরেকটি ঠোকানো হয়েছে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতিতে।
আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে না যাওয়া হলো বিএনপির রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। সে জন্য ভোটে জেতা নয়, ভোটকে বিতর্কিত করার জন্য মরিয়া এখন বিএনপি।আওয়ামী লীগও বিএনপিকে সুযোগ করে দিচ্ছে। না হলে সুপ্রিম কোর্টে পুলিশ এমন উন্মত্ত আচরণ করবে কেন? সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনের সময় পুলিশের উপস্থিতি নতুন না হলেও এবারের মতো পুলিশের এমন অতি তৎপরতা এর আগে দেখা যায়নি।
সামরিক শাসনের সময়েও পুলিশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ভবনে এ রকম কাজ করার সাহস পায়নি উল্লেখ করে একাধিক আইনজীবী তাঁদের অসন্তোষের কথা জানিয়ে বলেছেন, আইনজীবীদের নির্বাচন নিয়ে যে জটিলতা তৈরি হয়েছে, সেটা নিয়ে তাঁরা নিজেরা আলাপ-আলোচনা করতে পারতেন। কিন্তু এভাবে পুলিশ ডেকে নিয়ে আসাটা ঠিক হয়নি। এটা সুপ্রিম কোর্টের সব আইনজীবী এবং বিচার বিভাগের জন্য অমর্যাদাকর হয়েছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় কী? একজন আইনজীবী বলেছেন, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির গঠনতন্ত্রে প্যানেলভিত্তিক নির্বাচনের কোনো বিধি বা নিয়ম নেই। তারপরও দীর্ঘদিন ধরে প্যানেলভিত্তিক নির্বাচন হয়ে আসছে। আইনজীবী সমিতির একাধিক সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুধু আইনজীবী নেতারা নন, এই দুই প্যানেলে কারা থাকবেন, সেটা নির্ধারণে সরাসরি ভূমিকা রাখেন দল দুটির শীর্ষ নেতারা। এর ফলে আইনজীবী সমিতির নির্বাচনগুলো রাজনৈতিক নির্বাচনের মতো হয়ে গেছে এবং আইনজীবীদের একটি বড় অংশ দলীয় আনুগত্য প্রকাশে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। একটি পেশাজীবী সংগঠনের নির্বাচনে অতি রাজনীতিকীকরণ বা দলবাজির পরিণতি যা হওয়ার তা-ই হয়েছে।
বিরাজনীতিকরণ যেমন একটি সমস্যা, তেমনি অতি রাজনীতিকরণও যে সমস্যা, তা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যাচ্ছে। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি একটি পেশাজীবী সংগঠন। দেশে এ রকম আরও অসংখ্য পেশাজীবী সংগঠন থাকলেও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির আলাদা একটা গুরুত্ব আছে। আর এ কারণেই এই সংগঠনের নির্বাচনটি ‘দৃষ্টান্তমূলক’ হবে, এমন প্রত্যাশা ছিল অনেকের। কিন্তু দলাদলি এবং যেকোনোভাবে নির্বাচনে জেতার যে সংস্কৃতি কয়েক বছর ধরে সারা দেশে চালু হয়েছে, সেটা থেকে সর্বোচ্চ আদালতের আইনজীবীদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠনটিও রেহাই পেল না।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেছেন, জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পর এবার সুপ্রিম কোর্টে আইনজীবীদের নির্বাচনেও ভোট চুরি হচ্ছে। অপর দিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপি ভোট চুরির মহারাজা। সুপ্রিম কোর্টের নির্বাচনে জিততে তারা ব্যালট পেপার ছিনতাই করতে গেছে। নির্বাচন পণ্ড করতে হামলা করেছে। সুপ্রিম কোর্টে ভোট পণ্ড করার জন্য বিএনপি ৪০০ সন্ত্রাসী পাঠিয়ে জঙ্গি কায়দায় হামলা করেছে।
শুধু অভিযোগ উত্থাপন করার মধ্য দিয়ে নেতারা দায়িত্ব শেষ করতে পারেন না। মির্জা ফখরুলের উচিত ভোট চুরির প্রমাণ হাজির করা। ঢালাও অভিযোগ শুধু তিক্ততা বাড়ায়। তাঁর সমর্থকেরা কেন ভোট থেকে বিরত থাকলেন, তার যৌক্তিক কারণ মানুষের কাছে ব্যাখ্যা করতে হবে। আবার ওবায়দুল কাদের যেসব অভিযোগ করেছেন, সেগুলোর তথ্য-প্রমাণ নিশ্চয়ই তাঁর কাছে আছে। বিএনপি যে ৪০০ সন্ত্রাসী পাঠিয়েছিল, তাদের কেন ধরা হয়নি? পুলিশ এই সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার না করে সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হলো কেন?
ধৈর্যের অভাব, আত্মবিশ্বাসের অভাবে অনেকের মধ্যেই পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কায় সহনশীলতার অভাব দেখা যাচ্ছে। একে অপরকে দোষ না দিয়ে এখন বোধ হয় বলার সময় এসেছে, ‘ওরে ভাই, কার নিন্দা করো তুমি, মাথা করো নত, এ আমার এ তোমার পাপ’।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
দুই পক্ষের মিছিল, পাল্টা মিছিল, স্লোগান, ধাক্কাধাক্কি, ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, আইনজীবী ও সাংবাদিকদের ওপর পুলিশের হামলা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে সভাপতি ও সম্পাদকসহ ১৪টি পদের সব কটিতে জয় পেয়েছেন আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্যানেল থেকে মনোনীত প্রার্থীরা। বিএনপি এই নির্বাচনকে একতরফা বলেছে। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ফলাফল বাতিল ও নতুন নির্বাচনের দাবি করেছেন। এই দাবি মানা হবে কি না, বলা মুশকিল। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, বিএনপি ঝামেলা তৈরি করতে পারে, দাবিও জানাতে পারে; তবে দাবি আদায় করতে পারে না। তা ছাড়া, বিএনপির সমর্থক আইনজীবীরা আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচন বর্জন করেননি।
তাঁদের সমর্থকেরা ভোটদানে বিরতও ছিলেন না। তাঁদের আপত্তি সত্ত্বেও ভোট যে চলেছে, সেটা অস্বীকার করা যাবে না। কেউ যদি বলেন, আওয়ামী লীগ চেয়েছে বিএনপিকে ভোট থেকে দূরে রেখে বিপুল বিজয় পেতে এবং বিএনপি এ ক্ষেত্রে তাদের সহযোগিতা করেছে, তাহলে তার সন্তোষজনক জবাব বিএনপির কাছে আছে কি?
আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি মুখোমুখি অবস্থান এখন নিত্যদিনের ঘটনা। কিন্তু বিএনপির চাপের কারণে আওয়ামী লীগ পিছু হটেছে, এমনটা কি একবারও হয়েছে? সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনও বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা নিজেদের সুবিধামতো পরিবেশে করতে চেয়েছেন, কিন্তু নির্বাচন হয়েছে আওয়ামী লীগের পছন্দমতো। এই অবস্থার জন্য কোন দলের দায় বেশি, তা নিয়ে বিতর্ক করা যাবে, ফয়সালায় পৌঁছা যাবে না। কারণ, দেশের মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এখানে একমত হওয়ার আশা করা দুরাশা ছাড়া কিছু নয়।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরাও রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ছাড়া অন্য রাজনৈতিক বিশ্বাসের আইনজীবীও আছেন। তবে আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে বরাবরই মূলত প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়ে থাকে দুটি প্যানেলের মধ্যে। একটি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন আইনজীবীদের সংগঠন বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ (সাদা দল হিসেবে পরিচিত) মনোনীত প্যানেল। অন্যটি বিএনপির নেতৃত্বাধীন জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ঐক্য প্যানেল (নীল দল হিসেবে পরিচিত)।
১৫ ও ১৬ মার্চ অনুষ্ঠিত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যা যা হয়েছে, তা অনভিপ্রেত ও অনাকাঙ্ক্ষিত। সুপ্রিম কোর্ট দেশের সর্বোচ্চ আদালত। বলা হয়ে থাকে ন্যায়বিচার পাওয়ার শেষ আশ্রয় সুপ্রিম কোর্ট। বিচারপতি এবং আইনজীবী মিলেই ন্যায়বিচার প্রাপ্তির প্রত্যাশা পূরণ হয়। আইনজীবীদের বলা হয় ‘অফিসার্স অব দ্য কোর্ট’। সেই আইনজীবীরা যদি নিজেদের মধ্যকার কোনো সমস্যা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে না পারেন, তাঁদের যদি লাঠি হাতে শারীরিক শক্তি পরীক্ষায় নামতে হয়, তাহলে সাধারণ মানুষের আশা-ভরসার কোনো জায়গা থাকে?
ঘোষিত ফলাফল অনুসারে সাদা প্যানেলের প্রার্থী মোমতাজ উদ্দিন ফকির ৩ হাজার ৭২৫ ভোট পেয়ে সভাপতি হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন। সভাপতি পদে নীল প্যানেলের প্রার্থী মাহবুব উদ্দিন খোকন ২৯৩ ভোট পেয়েছেন।সাদা প্যানেলের প্রার্থী মো. আবদুন নূর ৩ হাজার ৭৪১ ভোট পেয়ে সম্পাদক পদে পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন। এই পদে নীল প্যানেলের প্রার্থী মো. রুহুল কুদ্দুস ৩০৯ ভোট পেয়েছেন। ভোট স্বাভাবিকভাবে হলে দুই পক্ষের এমন ভোটের ব্যবধান হওয়ার কথা নয়। বিএনপির আইনজীবীরা ভোটে আন্তরিকভাবে অংশ নিলে ফলাফল কী হতো, তা নিয়ে এখন জল্পনা করা অর্থহীন। আইনজীবীদের মধ্যে বিএনপির সমর্থক বেশি না আওয়ামী লীগের—এটাও নিশ্চিত করে বলা কঠিন। তবে বিএনপি শক্তিশালী অবস্থানেই আছে। গত নির্বাচনে (২০২২-২৩) সভাপতি ও সম্পাদকসহ সাতটি পদে জয় পেয়েছিলেন আওয়ামী লীগ-সমর্থিত আইনজীবীরা। অপর সাতটি পদে জয় পেয়েছিলেন বিএনপি-সমর্থিত আইনজীবীরা। এবার বিএনপির প্রার্থীরা একটি পদেও জয় পাননি। এটা কি শুধু আওয়ামী লীগের জবরদস্তির কারণে, নাকি বিএনপির কৌশলেও কিছু ত্রুটি ছিল?
এবার নির্বাচনের নির্ধারিত তারিখ ছিল ১৫ ও ১৬ মার্চ। জটিলতা শুরু হয় ১৩ মার্চ থেকে। সেদিন নির্বাচন পরিচালনাসংক্রান্ত উপকমিটির আহ্বায়ক সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মো. মনসুরুল হক চৌধুরী ‘ব্যক্তিগত’ কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করেন। দুই পক্ষই ঐকমত্যের ভিত্তিতে তাঁকে আহ্বায়ক হিসেবে মেনে নিয়েছিল। প্রশ্ন হলো, তাঁকে পদত্যাগ করতে হলো কেন? তিনি আওয়ামী লীগ করেন, তবে একজন সৎ, দায়িত্ববান ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ হিসেবে তাঁর সুনাম আছে। তিনি পদত্যাগ করার পর মঙ্গলবার সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগ-সমর্থিত আইনজীবীরা নির্বাচন পরিচালনাসংক্রান্ত উপকমিটির আহ্বায়ক হিসেবে মো. মনিরুজ্জামানকে মনোনীত করেন। এরপর বিএনপি-সমর্থিত আইনজীবীরা এ এস এম মোকতার কবির খানকে আহ্বায়ক মনোনীত করেন। কেন ঐকমত্যের ভিত্তিতে একজনকে মনোনীত করা হলো না? দুই পক্ষই পরিস্থিতি নিজেদের অনুকূলে রাখতে চেয়েছে। সম্ভবত তাই কেউ যার যার পছন্দের বাইরে যেতে চায়নি। আওয়ামী লীগ জয়ের নিশ্চয়তা চেয়েছে। আর বিএনপি সম্ভবত চেয়েছে আওয়ামী লীগের সময়ে ভালো নির্বাচন করা সম্ভব নয়, এটা প্রমাণ করতে। এদিক থেকে দেখলে দুই পক্ষই সফল হয়েছে। আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা বিপুল জয় পেয়েছেন। বিএনপি নির্বাচনটিকে হাস্যকর, বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির একতরফা নির্বাচনের ফলাফল বাতিল ও নতুন নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেছেন, ভোট ডাকাতিতে সিদ্ধহস্ত আওয়ামী লীগের মুখোশ আরেকবার উন্মোচিত হলো। দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থার কফিনে শেষ পেরেকটি ঠোকানো হয়েছে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতিতে।
আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে না যাওয়া হলো বিএনপির রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। সে জন্য ভোটে জেতা নয়, ভোটকে বিতর্কিত করার জন্য মরিয়া এখন বিএনপি।আওয়ামী লীগও বিএনপিকে সুযোগ করে দিচ্ছে। না হলে সুপ্রিম কোর্টে পুলিশ এমন উন্মত্ত আচরণ করবে কেন? সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনের সময় পুলিশের উপস্থিতি নতুন না হলেও এবারের মতো পুলিশের এমন অতি তৎপরতা এর আগে দেখা যায়নি।
সামরিক শাসনের সময়েও পুলিশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ভবনে এ রকম কাজ করার সাহস পায়নি উল্লেখ করে একাধিক আইনজীবী তাঁদের অসন্তোষের কথা জানিয়ে বলেছেন, আইনজীবীদের নির্বাচন নিয়ে যে জটিলতা তৈরি হয়েছে, সেটা নিয়ে তাঁরা নিজেরা আলাপ-আলোচনা করতে পারতেন। কিন্তু এভাবে পুলিশ ডেকে নিয়ে আসাটা ঠিক হয়নি। এটা সুপ্রিম কোর্টের সব আইনজীবী এবং বিচার বিভাগের জন্য অমর্যাদাকর হয়েছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় কী? একজন আইনজীবী বলেছেন, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির গঠনতন্ত্রে প্যানেলভিত্তিক নির্বাচনের কোনো বিধি বা নিয়ম নেই। তারপরও দীর্ঘদিন ধরে প্যানেলভিত্তিক নির্বাচন হয়ে আসছে। আইনজীবী সমিতির একাধিক সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুধু আইনজীবী নেতারা নন, এই দুই প্যানেলে কারা থাকবেন, সেটা নির্ধারণে সরাসরি ভূমিকা রাখেন দল দুটির শীর্ষ নেতারা। এর ফলে আইনজীবী সমিতির নির্বাচনগুলো রাজনৈতিক নির্বাচনের মতো হয়ে গেছে এবং আইনজীবীদের একটি বড় অংশ দলীয় আনুগত্য প্রকাশে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। একটি পেশাজীবী সংগঠনের নির্বাচনে অতি রাজনীতিকীকরণ বা দলবাজির পরিণতি যা হওয়ার তা-ই হয়েছে।
বিরাজনীতিকরণ যেমন একটি সমস্যা, তেমনি অতি রাজনীতিকরণও যে সমস্যা, তা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যাচ্ছে। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি একটি পেশাজীবী সংগঠন। দেশে এ রকম আরও অসংখ্য পেশাজীবী সংগঠন থাকলেও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির আলাদা একটা গুরুত্ব আছে। আর এ কারণেই এই সংগঠনের নির্বাচনটি ‘দৃষ্টান্তমূলক’ হবে, এমন প্রত্যাশা ছিল অনেকের। কিন্তু দলাদলি এবং যেকোনোভাবে নির্বাচনে জেতার যে সংস্কৃতি কয়েক বছর ধরে সারা দেশে চালু হয়েছে, সেটা থেকে সর্বোচ্চ আদালতের আইনজীবীদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠনটিও রেহাই পেল না।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেছেন, জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পর এবার সুপ্রিম কোর্টে আইনজীবীদের নির্বাচনেও ভোট চুরি হচ্ছে। অপর দিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপি ভোট চুরির মহারাজা। সুপ্রিম কোর্টের নির্বাচনে জিততে তারা ব্যালট পেপার ছিনতাই করতে গেছে। নির্বাচন পণ্ড করতে হামলা করেছে। সুপ্রিম কোর্টে ভোট পণ্ড করার জন্য বিএনপি ৪০০ সন্ত্রাসী পাঠিয়ে জঙ্গি কায়দায় হামলা করেছে।
শুধু অভিযোগ উত্থাপন করার মধ্য দিয়ে নেতারা দায়িত্ব শেষ করতে পারেন না। মির্জা ফখরুলের উচিত ভোট চুরির প্রমাণ হাজির করা। ঢালাও অভিযোগ শুধু তিক্ততা বাড়ায়। তাঁর সমর্থকেরা কেন ভোট থেকে বিরত থাকলেন, তার যৌক্তিক কারণ মানুষের কাছে ব্যাখ্যা করতে হবে। আবার ওবায়দুল কাদের যেসব অভিযোগ করেছেন, সেগুলোর তথ্য-প্রমাণ নিশ্চয়ই তাঁর কাছে আছে। বিএনপি যে ৪০০ সন্ত্রাসী পাঠিয়েছিল, তাদের কেন ধরা হয়নি? পুলিশ এই সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার না করে সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হলো কেন?
ধৈর্যের অভাব, আত্মবিশ্বাসের অভাবে অনেকের মধ্যেই পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কায় সহনশীলতার অভাব দেখা যাচ্ছে। একে অপরকে দোষ না দিয়ে এখন বোধ হয় বলার সময় এসেছে, ‘ওরে ভাই, কার নিন্দা করো তুমি, মাথা করো নত, এ আমার এ তোমার পাপ’।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
৩ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৭ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৭ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
১০ দিন আগে