ড. এম আবদুল আলীম
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘জুলিও কুরি’ পদক প্রাপ্তির ৫০ বছর পূর্তি হচ্ছে এমন একসময়, যখন রাশিয়া-আমেরিকার কর্তৃত্বের লড়াইয়ে ইউক্রেন পুড়ছে ক্ষেপণাস্ত্রসহ অত্যাধুনিক সব অস্ত্রের আগুনে। শুধু কি তা-ই? পরাশক্তিগুলোর প্রভাব বিস্তার এবং অস্ত্র ব্যবসায়ের প্রতিযোগিতায় চলছে শান্তি বিনাশী নানা তৎপরতা, যাতে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার তাগিদে গড়ে ওঠা প্রধান আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান জাতিসংঘ পরিণত হয়েছে ঠুঁটো জগন্নাথে। এ ছাড়া বিশ্বশান্তি তথা বিশ্বমানবের কল্যাণে গড়ে ওঠা অন্য প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাগুলোও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। শান্তি ও মানবতার ধুয়া তুলে আন্তর্জাতিক নানা আইন তৈরি ও চুক্তি সম্পন্ন হলেও সেগুলো লঙ্ঘন করে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার দ্বন্দ্বে প্রায়ই মানুষের রক্তে হোলি খেলা হচ্ছে পৃথিবীর দেশে দেশে। কিন্তু এমনটি তো হওয়ার কথা ছিল না।
এবার আসি বঙ্গবন্ধুর জুলিও কুরি শান্তিপদক প্রাপ্তি প্রসঙ্গে। ১৯৭৩ সালের ২৩ মে তিনি এই আন্তর্জাতিক পদক লাভ করেন। সংগত কারণেই প্রশ্ন আসে, কেন তিনি এই পদক লাভ করেছিলেন? এই উত্তরের সন্ধানে আমাদের ফিরে তাকাতে হয় অন্তত ৭০-৭৫ বছর পেছনে; বঙ্গবন্ধুর জীবন, সংগ্রাম ও চিন্তাদর্শের দিকে। তাঁর আবির্ভাব প্রথম বিশ্বযুদ্ধের রণরক্ত অধ্যায় শেষে, ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ। কিন্তু ক্ষত তখনো শুকায়নি, যুদ্ধের অভিঘাতে বিশ্বমানবের জীবন তখনো ছিল বিপন্ন। সেই ধাক্কা সামলে না উঠতেই কিশোর মুজিব দেখলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠতে। দেখলেন তাতে দেশে দেশে মারণাস্ত্রের আঘাতে নারী, শিশু কেউই রেহাই পাচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত হিরোশিমা-নাগাসাকির ভয়াবহ ট্র্যাজেডির পরিণামে এ যুদ্ধের অবসান ঘটলেও বিশ্ববাসীকে এর মূল্য দিতে হয়েছে বহু বছর। সেই বিশ্বযুদ্ধকবলিত বাংলায় আর্তমানবতার সেবায় যুবক বয়সেই শেখ মুজিব স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে মাঠে নেমেছিলেন। পরবর্তীকালে নবগঠিত রাষ্ট্র পাকিস্তানের একজন উদীয়মান রাজনীতিবিদ হিসেবে ১৯৫২ সালের অক্টোবর মাসে যোগ দিয়েছিলেন চীন শান্তি সম্মেলনে। ওই সম্মেলনে তিনি বিশ্বের ৩৭টি দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন এবং বাংলা ভাষায় বক্তব্য তুলে ধরেন। সে প্রসঙ্গে তিনি বিস্তারিত লিখেছেন ‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থে। এর চার বছর পর তিনি আরেকটি আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলনে যোগ দেন, যেটি অনুষ্ঠিত হয় স্টকহোমে। ১৯৫৬ সালের ৫ থেকে ৯ এপ্রিল অনুষ্ঠিত বিশ্বশান্তি পরিষদের ওই সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, ‘বিশ্বশান্তি আমার মূলনীতি। নিপীড়িত, নির্যাতিত, শোষিত ও স্বাধীনতাকামী সংগ্রামী মানুষ, যেকোনো স্থানেই হোক না কেন, তাদের সঙ্গে আমি রয়েছি। আমরা চাই বিশ্বের সর্বত্র শান্তি বজায় থাকুক, তাকে সুসংহত করা হোক।’
এই শান্তিকামী নেতা পূর্ববঙ্গের শোষিত-বঞ্চিত মানুষের মুক্তির সংগ্রামে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে বছরের পর বছর জেল-জুলুম সহ্য করেছেন। অবশেষে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে এই অঞ্চলের মানুষের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। স্বাধীন দেশের কর্ণধার হিসেবে তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শান্তির বার্তা নিয়ে হাজির হন। বিশ্বরাজনীতি তখন মার্কিন-সোভিয়েত পরস্পরবিরোধী দুই পরাশক্তির কবজায়। উভয়ের নেতৃত্বেই গড়ে উঠেছিল সামরিক জোট। বঙ্গবন্ধু কোনো জোটেরই অন্তর্ভুক্ত হননি। তিনি জোটনিরপেক্ষ নীতির ঝান্ডা হাতে বিশ্ববাসীর কাছে তাঁর পররাষ্ট্রনীতি তুলে ধরেছিলেন এবং দ্ব্যর্থহীন ভাষায় উচ্চারণ করেছিলেন, ‘আমরা সর্বপ্রকার অস্ত্র প্রতিযোগিতার পরিবর্তে দুনিয়ার সকল শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের কল্যাণে বিশ্বাসী বলেই বিশ্বের সব দেশ ও জাতির বন্ধুত্ব কামনা করি। সকলের প্রতি বন্ধুত্ব, কারও প্রতি বিদ্বেষ নয়, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের এই নীতিতে আমরা আস্থাশীল।’
জোটনিরপেক্ষতা এবং সকলের প্রতি বন্ধুত্ব, কারও প্রতি বিদ্বেষ নয়—এই পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করলেও সব সময় তাঁর অবস্থান ছিল শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের পক্ষে। তাই পৃথিবীর যেখানেই মানবতা বিপন্ন হয়েছে, যুদ্ধবাজ রাষ্ট্রগুলোর অস্ত্রের ঝনঝনানিতে মানুষের জীবন বিপন্ন হয়েছে, তার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু স্বীয় অবস্থানের কথা দৃঢ়ভাবে উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘...ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাওস, অ্যাঙ্গোলা, মোজাম্বিক, গিনি বিসাউসহ দুনিয়ার সকল উপনিবেশবিরোধী সংগ্রামের প্রতি আমরা জানিয়েছি অকুণ্ঠ সমর্থন। আমরা ক্ষোভ প্রকাশ করি অন্যায়ভাবে আরব এলাকা ইসরায়েল কর্তৃক জোরপূর্বক দখলে রাখার বিরুদ্ধে। আমরা দ্বিধাহীন চিত্তে নিন্দা করি, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বিশ্বের সকল স্থানের বর্ণভেদবাদী নীতির। আমরা সমর্থন জানাই বিশ্বশান্তি, নিরস্ত্রীকরণ ও মানবকল্যাণের যেকোনো মহৎ প্রচেষ্টাকে।’ বিশ্বমোড়লদের অস্ত্র প্রতিযোগিতায় অর্থ ব্যয় করা দেখে তিনি মর্মাহত হয়েছিলেন। তাই বলেছিলেন, ‘পৃথিবীর বৃহত্তম শক্তি যে অর্থ ব্যয় করে মানুষ মারার অস্ত্র তৈরি করছে, সেই অর্থ গরিব দেশগুলোকে সাহায্য দিলে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা হতে পারে।’
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যেমন, তেমনি আঞ্চলিক শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারেও তিনি দৃঢ় প্রত্যয়ী ছিলেন। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বাধীন দেশের মাটিতে পা রেখেই তিনি আঞ্চলিক শান্তির ডাক দিয়েছিলেন। এমনকি বাঙালির ওপর নির্মম গণহত্যা চালানো পাকিস্তানকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন, ‘আমি তোমাদের বিরুদ্ধে কোনো বৈরী ভাব পোষণ করি না। তোমাদের স্বাধীনতা তোমাদেরই রইল। আমাদেরও স্বাধীনতায় থাকতে দাও।’ আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি সম্পন্ন করেছিলেন ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চুক্তি। ১৯৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতা সফরের সময় রাজভবনে বঙ্গবন্ধুর সম্মানে ইন্দিরা গান্ধী যে নৈশভোজসভার আয়োজন করেছিলেন, তাতে তিনি উচ্চারণ করেছিলেন শান্তি প্রতিষ্ঠার এক অনন্য উক্তি। তিনি বলেছিলেন, ‘আমার একান্ত কামনা, উপমহাদেশে অবশেষে শান্তি ও সুস্থিরতা আসবে।...দক্ষিণ এশিয়াকে একটি শান্তিপূর্ণ অঞ্চলে পরিণত করায় আমরা সচেষ্ট রইব। যেখানে আমরা সুপ্রতিবেশী হিসেবে পাশাপাশি বাস করতে পারি। যদি আমরা সেই দায়িত্বে ব্যর্থ হই, ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।’ ১৯৭৪ সালের ৪ মার্চ দাউদকান্দির এক জনসভায় প্রায় একই চিন্তার প্রতিফলন ঘটিয়ে তিনি বলেন, ‘এই উপমহাদেশে আমরা বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল আর শ্রীলঙ্কা মিলে শান্তিতে বসবাস করতে চাই। আমরা কারও সঙ্গে বিবাদ চাই না।’ এসব উক্তি কেবল বক্তৃতার মঞ্চ কাঁপানোর জন্য ছিল না, এসব ছিল তাঁর হৃদয়ের গভীর থেকে উৎসারিত বিশ্বাসের মর্মবাণী।
বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর আকাঙ্ক্ষা এবং বিশ্বমানবের কল্যাণে তাঁর চিন্তাকর্ম আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাড়া ফেলে। তার পরিপ্রেক্ষিতেই স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় এবং বন্ধুত্বের হাত বাড়ায়। শুধু তা-ই নয়, বিশ্বশান্তি পরিষদ ১৯৭২ সালের ১০ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুকে জুলিও কুরি পদক দেওয়ার ঘোষণা দেয়। এ জন্য বিশ্বশান্তি পরিষদের প্রেসিডেনশিয়াল কমিটির সভায় ১৪০টি রাষ্ট্রের প্রায় ২০০ সদস্য সর্বসম্মতভাবে তাঁকে এ পদক দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। বঙ্গবন্ধুর জীবনব্যাপী সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদান এবং বিশ্বব্যাপী শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ের কথা বিবেচনায় এনেই এ পদক দেওয়া হয়। ১৯৭৩ সালের ২৩ মে এশীয় শান্তি সম্মেলনের এক জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুকে জুলিও করি পদক পরিয়ে দেন বিশ্বশান্তি পরিষদের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল রমেশ চন্দ্র। একই সঙ্গে ওই পদক প্রদান অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলার নন, তিনি বিশ্বের এবং তিনি বিশ্ববন্ধু।’ জুলিও কুরি প্রাপ্তির প্রতিক্রিয়ায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এ সম্মান কোনো ব্যক্তিবিশেষের জন্য নয়। এ সম্মান বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে আত্মদানকারী শহীদদের, স্বাধীনতার বীর সেনানীদের। জুলিও কুরি শান্তি পদক সমগ্র বাঙালি জাতির।’ এই পদক আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বঙ্গবন্ধুর ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল করে।
বিশ্বশান্তি পরিষদ ১৯৫০ সাল থেকে এ পদক প্রবর্তন করে। নোবেল বিজয়ী বিশ্ববিখ্যাত ফরাসি বিজ্ঞানী জঁ ফ্রেডরিক জুলিও কুরি ও তাঁর স্ত্রী পিয়েরে কুরি বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে যে অবদান রেখেছেন, তা স্মরণীয় করে রাখতে পদকটির নামকরণ করা হয় ‘জুলিও কুরি’। ফ্যাসিবাদ-সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রাম, মানবতার কল্যাণ এবং বিশ্বশান্তির পক্ষে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনকে এই পদকে ভূষিত করা হয়। বঙ্গবন্ধু ছাড়াও ফিদেল কাস্ত্রো, সালভাদর আলেন্দে, হো চি মিন, ইয়াসির আরাফাত, নেলসন ম্যান্ডেলা, পণ্ডিত জওহর লাল নেহরু, পাবলো নেরুদা, মার্টিন লুথার কিং, নিওনিদ ব্রেজনেভ, ইন্দিরা গান্ধী, মাদার তেরেসা প্রমুখ এই পদক লাভ করেন।
বঙ্গবন্ধুর ‘জুলিও কুরি’ পদক প্রাপ্তির ৫০ বছর পূর্তির এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে দাঁড়িয়ে বলতে হয়, বিশ্বশান্তি ও মানবকল্যাণে তিনি আজীবন যে সংগ্রাম করেছেন, সেই চেতনা সর্বত্র সঞ্চারিত হোক। দেশে দেশে বন্ধ হোক যুদ্ধ। মানবকল্যাণ ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় বিশ্বমোড়লদের বিবেক জাগ্রত হোক।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘জুলিও কুরি’ পদক প্রাপ্তির ৫০ বছর পূর্তি হচ্ছে এমন একসময়, যখন রাশিয়া-আমেরিকার কর্তৃত্বের লড়াইয়ে ইউক্রেন পুড়ছে ক্ষেপণাস্ত্রসহ অত্যাধুনিক সব অস্ত্রের আগুনে। শুধু কি তা-ই? পরাশক্তিগুলোর প্রভাব বিস্তার এবং অস্ত্র ব্যবসায়ের প্রতিযোগিতায় চলছে শান্তি বিনাশী নানা তৎপরতা, যাতে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার তাগিদে গড়ে ওঠা প্রধান আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান জাতিসংঘ পরিণত হয়েছে ঠুঁটো জগন্নাথে। এ ছাড়া বিশ্বশান্তি তথা বিশ্বমানবের কল্যাণে গড়ে ওঠা অন্য প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাগুলোও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। শান্তি ও মানবতার ধুয়া তুলে আন্তর্জাতিক নানা আইন তৈরি ও চুক্তি সম্পন্ন হলেও সেগুলো লঙ্ঘন করে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার দ্বন্দ্বে প্রায়ই মানুষের রক্তে হোলি খেলা হচ্ছে পৃথিবীর দেশে দেশে। কিন্তু এমনটি তো হওয়ার কথা ছিল না।
এবার আসি বঙ্গবন্ধুর জুলিও কুরি শান্তিপদক প্রাপ্তি প্রসঙ্গে। ১৯৭৩ সালের ২৩ মে তিনি এই আন্তর্জাতিক পদক লাভ করেন। সংগত কারণেই প্রশ্ন আসে, কেন তিনি এই পদক লাভ করেছিলেন? এই উত্তরের সন্ধানে আমাদের ফিরে তাকাতে হয় অন্তত ৭০-৭৫ বছর পেছনে; বঙ্গবন্ধুর জীবন, সংগ্রাম ও চিন্তাদর্শের দিকে। তাঁর আবির্ভাব প্রথম বিশ্বযুদ্ধের রণরক্ত অধ্যায় শেষে, ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ। কিন্তু ক্ষত তখনো শুকায়নি, যুদ্ধের অভিঘাতে বিশ্বমানবের জীবন তখনো ছিল বিপন্ন। সেই ধাক্কা সামলে না উঠতেই কিশোর মুজিব দেখলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠতে। দেখলেন তাতে দেশে দেশে মারণাস্ত্রের আঘাতে নারী, শিশু কেউই রেহাই পাচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত হিরোশিমা-নাগাসাকির ভয়াবহ ট্র্যাজেডির পরিণামে এ যুদ্ধের অবসান ঘটলেও বিশ্ববাসীকে এর মূল্য দিতে হয়েছে বহু বছর। সেই বিশ্বযুদ্ধকবলিত বাংলায় আর্তমানবতার সেবায় যুবক বয়সেই শেখ মুজিব স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে মাঠে নেমেছিলেন। পরবর্তীকালে নবগঠিত রাষ্ট্র পাকিস্তানের একজন উদীয়মান রাজনীতিবিদ হিসেবে ১৯৫২ সালের অক্টোবর মাসে যোগ দিয়েছিলেন চীন শান্তি সম্মেলনে। ওই সম্মেলনে তিনি বিশ্বের ৩৭টি দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন এবং বাংলা ভাষায় বক্তব্য তুলে ধরেন। সে প্রসঙ্গে তিনি বিস্তারিত লিখেছেন ‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থে। এর চার বছর পর তিনি আরেকটি আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলনে যোগ দেন, যেটি অনুষ্ঠিত হয় স্টকহোমে। ১৯৫৬ সালের ৫ থেকে ৯ এপ্রিল অনুষ্ঠিত বিশ্বশান্তি পরিষদের ওই সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, ‘বিশ্বশান্তি আমার মূলনীতি। নিপীড়িত, নির্যাতিত, শোষিত ও স্বাধীনতাকামী সংগ্রামী মানুষ, যেকোনো স্থানেই হোক না কেন, তাদের সঙ্গে আমি রয়েছি। আমরা চাই বিশ্বের সর্বত্র শান্তি বজায় থাকুক, তাকে সুসংহত করা হোক।’
এই শান্তিকামী নেতা পূর্ববঙ্গের শোষিত-বঞ্চিত মানুষের মুক্তির সংগ্রামে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে বছরের পর বছর জেল-জুলুম সহ্য করেছেন। অবশেষে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে এই অঞ্চলের মানুষের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। স্বাধীন দেশের কর্ণধার হিসেবে তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শান্তির বার্তা নিয়ে হাজির হন। বিশ্বরাজনীতি তখন মার্কিন-সোভিয়েত পরস্পরবিরোধী দুই পরাশক্তির কবজায়। উভয়ের নেতৃত্বেই গড়ে উঠেছিল সামরিক জোট। বঙ্গবন্ধু কোনো জোটেরই অন্তর্ভুক্ত হননি। তিনি জোটনিরপেক্ষ নীতির ঝান্ডা হাতে বিশ্ববাসীর কাছে তাঁর পররাষ্ট্রনীতি তুলে ধরেছিলেন এবং দ্ব্যর্থহীন ভাষায় উচ্চারণ করেছিলেন, ‘আমরা সর্বপ্রকার অস্ত্র প্রতিযোগিতার পরিবর্তে দুনিয়ার সকল শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের কল্যাণে বিশ্বাসী বলেই বিশ্বের সব দেশ ও জাতির বন্ধুত্ব কামনা করি। সকলের প্রতি বন্ধুত্ব, কারও প্রতি বিদ্বেষ নয়, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের এই নীতিতে আমরা আস্থাশীল।’
জোটনিরপেক্ষতা এবং সকলের প্রতি বন্ধুত্ব, কারও প্রতি বিদ্বেষ নয়—এই পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করলেও সব সময় তাঁর অবস্থান ছিল শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের পক্ষে। তাই পৃথিবীর যেখানেই মানবতা বিপন্ন হয়েছে, যুদ্ধবাজ রাষ্ট্রগুলোর অস্ত্রের ঝনঝনানিতে মানুষের জীবন বিপন্ন হয়েছে, তার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু স্বীয় অবস্থানের কথা দৃঢ়ভাবে উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘...ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাওস, অ্যাঙ্গোলা, মোজাম্বিক, গিনি বিসাউসহ দুনিয়ার সকল উপনিবেশবিরোধী সংগ্রামের প্রতি আমরা জানিয়েছি অকুণ্ঠ সমর্থন। আমরা ক্ষোভ প্রকাশ করি অন্যায়ভাবে আরব এলাকা ইসরায়েল কর্তৃক জোরপূর্বক দখলে রাখার বিরুদ্ধে। আমরা দ্বিধাহীন চিত্তে নিন্দা করি, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বিশ্বের সকল স্থানের বর্ণভেদবাদী নীতির। আমরা সমর্থন জানাই বিশ্বশান্তি, নিরস্ত্রীকরণ ও মানবকল্যাণের যেকোনো মহৎ প্রচেষ্টাকে।’ বিশ্বমোড়লদের অস্ত্র প্রতিযোগিতায় অর্থ ব্যয় করা দেখে তিনি মর্মাহত হয়েছিলেন। তাই বলেছিলেন, ‘পৃথিবীর বৃহত্তম শক্তি যে অর্থ ব্যয় করে মানুষ মারার অস্ত্র তৈরি করছে, সেই অর্থ গরিব দেশগুলোকে সাহায্য দিলে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা হতে পারে।’
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যেমন, তেমনি আঞ্চলিক শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারেও তিনি দৃঢ় প্রত্যয়ী ছিলেন। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বাধীন দেশের মাটিতে পা রেখেই তিনি আঞ্চলিক শান্তির ডাক দিয়েছিলেন। এমনকি বাঙালির ওপর নির্মম গণহত্যা চালানো পাকিস্তানকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন, ‘আমি তোমাদের বিরুদ্ধে কোনো বৈরী ভাব পোষণ করি না। তোমাদের স্বাধীনতা তোমাদেরই রইল। আমাদেরও স্বাধীনতায় থাকতে দাও।’ আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি সম্পন্ন করেছিলেন ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চুক্তি। ১৯৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতা সফরের সময় রাজভবনে বঙ্গবন্ধুর সম্মানে ইন্দিরা গান্ধী যে নৈশভোজসভার আয়োজন করেছিলেন, তাতে তিনি উচ্চারণ করেছিলেন শান্তি প্রতিষ্ঠার এক অনন্য উক্তি। তিনি বলেছিলেন, ‘আমার একান্ত কামনা, উপমহাদেশে অবশেষে শান্তি ও সুস্থিরতা আসবে।...দক্ষিণ এশিয়াকে একটি শান্তিপূর্ণ অঞ্চলে পরিণত করায় আমরা সচেষ্ট রইব। যেখানে আমরা সুপ্রতিবেশী হিসেবে পাশাপাশি বাস করতে পারি। যদি আমরা সেই দায়িত্বে ব্যর্থ হই, ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।’ ১৯৭৪ সালের ৪ মার্চ দাউদকান্দির এক জনসভায় প্রায় একই চিন্তার প্রতিফলন ঘটিয়ে তিনি বলেন, ‘এই উপমহাদেশে আমরা বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল আর শ্রীলঙ্কা মিলে শান্তিতে বসবাস করতে চাই। আমরা কারও সঙ্গে বিবাদ চাই না।’ এসব উক্তি কেবল বক্তৃতার মঞ্চ কাঁপানোর জন্য ছিল না, এসব ছিল তাঁর হৃদয়ের গভীর থেকে উৎসারিত বিশ্বাসের মর্মবাণী।
বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর আকাঙ্ক্ষা এবং বিশ্বমানবের কল্যাণে তাঁর চিন্তাকর্ম আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাড়া ফেলে। তার পরিপ্রেক্ষিতেই স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় এবং বন্ধুত্বের হাত বাড়ায়। শুধু তা-ই নয়, বিশ্বশান্তি পরিষদ ১৯৭২ সালের ১০ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুকে জুলিও কুরি পদক দেওয়ার ঘোষণা দেয়। এ জন্য বিশ্বশান্তি পরিষদের প্রেসিডেনশিয়াল কমিটির সভায় ১৪০টি রাষ্ট্রের প্রায় ২০০ সদস্য সর্বসম্মতভাবে তাঁকে এ পদক দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। বঙ্গবন্ধুর জীবনব্যাপী সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদান এবং বিশ্বব্যাপী শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ের কথা বিবেচনায় এনেই এ পদক দেওয়া হয়। ১৯৭৩ সালের ২৩ মে এশীয় শান্তি সম্মেলনের এক জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুকে জুলিও করি পদক পরিয়ে দেন বিশ্বশান্তি পরিষদের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল রমেশ চন্দ্র। একই সঙ্গে ওই পদক প্রদান অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলার নন, তিনি বিশ্বের এবং তিনি বিশ্ববন্ধু।’ জুলিও কুরি প্রাপ্তির প্রতিক্রিয়ায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এ সম্মান কোনো ব্যক্তিবিশেষের জন্য নয়। এ সম্মান বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে আত্মদানকারী শহীদদের, স্বাধীনতার বীর সেনানীদের। জুলিও কুরি শান্তি পদক সমগ্র বাঙালি জাতির।’ এই পদক আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বঙ্গবন্ধুর ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল করে।
বিশ্বশান্তি পরিষদ ১৯৫০ সাল থেকে এ পদক প্রবর্তন করে। নোবেল বিজয়ী বিশ্ববিখ্যাত ফরাসি বিজ্ঞানী জঁ ফ্রেডরিক জুলিও কুরি ও তাঁর স্ত্রী পিয়েরে কুরি বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে যে অবদান রেখেছেন, তা স্মরণীয় করে রাখতে পদকটির নামকরণ করা হয় ‘জুলিও কুরি’। ফ্যাসিবাদ-সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রাম, মানবতার কল্যাণ এবং বিশ্বশান্তির পক্ষে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনকে এই পদকে ভূষিত করা হয়। বঙ্গবন্ধু ছাড়াও ফিদেল কাস্ত্রো, সালভাদর আলেন্দে, হো চি মিন, ইয়াসির আরাফাত, নেলসন ম্যান্ডেলা, পণ্ডিত জওহর লাল নেহরু, পাবলো নেরুদা, মার্টিন লুথার কিং, নিওনিদ ব্রেজনেভ, ইন্দিরা গান্ধী, মাদার তেরেসা প্রমুখ এই পদক লাভ করেন।
বঙ্গবন্ধুর ‘জুলিও কুরি’ পদক প্রাপ্তির ৫০ বছর পূর্তির এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে দাঁড়িয়ে বলতে হয়, বিশ্বশান্তি ও মানবকল্যাণে তিনি আজীবন যে সংগ্রাম করেছেন, সেই চেতনা সর্বত্র সঞ্চারিত হোক। দেশে দেশে বন্ধ হোক যুদ্ধ। মানবকল্যাণ ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় বিশ্বমোড়লদের বিবেক জাগ্রত হোক।
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
২ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৬ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৬ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৯ দিন আগে