রজত কান্তি রায়, গঙ্গাচড়া (রংপুর)
অটোরিকশাওয়ালা আমাকে ঠকিয়েছেন –বিষয়টি যখন বুঝলাম, তখন হাসি পেল। চালক ভেবেছিলেন, একটু ঘুরিয়ে কিছু বেশি টাকা নেবেন। কিন্তু তিনি বুঝতে পারেননি লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের একাংশ ঘোরা হয়ে গেছে আমার। রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার লক্ষ্মীটারী একটি ইউনিয়নের নাম। তিস্তা নদীর তীরে গড়ে ওঠা সে জনপদের কথা সবিস্তারে বলে গেছেন চারণ সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিন, আজ থেকে প্রায় ২৬ বছর আগে।
মোনাজাত উদ্দিন যখন ‘লক্ষ্মীটারী’ নামে তাঁর শেষ বইটি লেখেন তখন তাঁর বয়স ৪৯ বছর এবং আমার ১৪ বছর। লক্ষ্মীটারীতে গিয়েছি মোনাজাত উদ্দিন সেখানে যাওয়ার প্রায় ২৮ বছর পরের শীতকালে, এ বছরের জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি।
গঙ্গাচড়া থেকে সোজা যাওয়া যায় মহীপুর। কিন্তু ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার চালক আমাকে নিয়ে চললেন ঘুরপথে। বারবার তাঁকে জিজ্ঞেস করছিলাম, এটাই কি লক্ষ্মীটারী? তিনি, না মানে এটা ইউনিয়ন; লক্ষ্মীটারী নামে কোনো গ্রাম নেই, বলেই চলছিলেন। আমিও রিকশায় বসে আরামে দুদিক দেখতে দেখতে চলেছি। আর আমার স্মৃতিতে দোলা দিয়ে যাচ্ছে গত শতকের আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে দেখা উত্তরবঙ্গের পরিবেশ ও রাস্তাঘাট। সে সময়ের বড় মাটির রাস্তাগুলো এখন পিচ ঢালা পথ। কোথাও চওড়া, কোথাও সরু। বাঁশের চাটাইয়ে ঘেরা বাড়ি। ওপরে টিনের অথবা খড়ের চালা। এখন টিনের চালাই বেশি। বাড়ির পাশে বাঁশঝাড়। সামনে দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তার ধারে বাঁশের গায়ে শুকাতে দেওয়া গোবর নড়ি (পাটখড়িতে লাগানো গোবর)। গঙ্গাচড়ার এই অঞ্চল এখনো কিছুটা আশি-নব্বইয়ের দশকের মতো আছে। এখনো নিস্তরঙ্গ। তবে সমৃদ্ধির ছোঁয়া যে লেগেছে সেটা বোঝা যায় বিদ্যুতের খুঁটি, মোটর বাইক আর মাঝেমধ্যে ছাদপেটানো পাকা বাড়ি দেখে। শিহরণ জাগে, আজ থেকে প্রায় ২৮ বছর আগে কাঁধে ব্যাগ আর ক্যামেরা ঝুলিয়ে মোনাজাত উদ্দিন এই সব রাস্তায় ঘুরেছেন।
পুরোটাই যে এককালে তিস্তার চর ছিল, সেটা বোঝা যায় ভূমিরূপ দেখলেই। লক্ষ্মীটারী ইউনিয়ন পরিষদে যাওয়ার আগে পড়বে খানাটারী নামে একটি গ্রাম। রংপুর অঞ্চলে টারী শব্দটির অর্থ গ্রাম। যেমন দীঘলটারী, দর্জীটারী, শ্যাওড়াটারী...। খানাটারী পার হওয়ার সময় চোখে পড়ল আলুর খেত। যত দূর চোখ যায় শুধুই আলু। বিকেল বলে কোনো মানুষ নেই খেতে। আলুর গাছের পাতায় সকালের শিশির জমে আছে। শীত-বিকেলের কুয়াশামাখা আলোয় সেগুলো গাঢ় সবুজ। মাটির কাঁচা রাস্তা ধরে চলছে আমাদের অটোরিকশা। বাড়িগুলোর সামনের ছোট ছোট জমিতে চাষ করা হয়েছে রসুন, লাফা শাক। বাবর শাক—এতে হলুদ ফুল ফুটেছে। এগুলো বিক্রির জন্য নয়। বাড়িতে খাবারের জন্য। খানাটারীর একটি পাড়ার একটি দোকানের সামনে দাঁড়ালাম। উৎসুক মানুষ তাকিয়ে দেখছে। বয়স্ক একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, এটাই কি লক্ষ্মীটারী? তিনি বললেন, হয় হয় বাওয়া। এইটা লক্ষ্মীটারী ইউনিয়ন। যাইমেন কোনটে? বললাম, লক্ষ্মীটারী দেখতে এসেছি। তিনি হাসলেন। বললেন, দেইখবার কী আছে বাহে? আর কিছু না বলে ধন্যবাদ জানিয়ে এগিয়ে চললাম। পাশেই মহীপুর জামে মসজিদের সাইনবোর্ড চোখে পড়ল। মানে মহীপুর নামের একটি গ্রাম আমরা পার হচ্ছি।
এ রাস্তা ধরে সোজা গিয়ে উঠলাম আনুর বাজারে। বিখ্যাত কারও নামে রাখা হয়েছে বাজারের নাম। যে রাস্তাটা খানাটারী থেকে আনুর বাজারের পাকা রাস্তায় লেগেছে, সেটা বেশ বড় তিন রাস্তার মোড়। বাজারটিও বেশ জমজমাট। সেই মোড়ের ওপরেই দেখা হলো নুরুল ইসলাম মেম্বারের সঙ্গে। তিনি লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের তিনবারের নির্বাচিত মেম্বার ছিলেন। বয়স্ক বলে জিজ্ঞেস করলাম, বয়স কত চাচা? মেম্বার সাব জানালেন, বয়সবা কত হইল্ বাহে! ১৯৩২ সালে জন্ম হামার। হিসেব করে দেখলাম, নুরুল ইসলাম নামের যে মানুষটির সঙ্গে কথা বলছি তাঁর বয়স কমবেশি ৯০ বছর! কিন্তু তিনি দিব্যি বাজার করতে এসেছেন। অনেকক্ষণ কথা হলো তাঁর সঙ্গে। জানালেন, তিস্তার বানে একসময় কিছুই হতো না এলাকায়। এত দিনে লক্ষ্মীটারী এলাকার মানুষের কিছুটা সুখ হয়েছে। এখন এই এলাকায় আলু হয় প্রচুর। কিন্তু দাম পাঁচ টাকা কেজি।
এই আনুর বাজার থেকে মহীপুর প্রায় দুই কিলোমিটার। দুই হাটের মাঝখানে লক্ষ্মীটারী ইউনিয়ন পরিষদ। রাস্তাটা পাকা। এটা কাকিনা রোড। রংপুর শহর থেকে এই রোড ধরে সোজা চলে যাওয়া যায় কাকিনা, তুষভাণ্ডার। তার পরে আরও দূরে লালমনিরহাট। সেগুলো তিস্তার ওপারের জায়গা। আনুর বাজার থেকে মহীপুর হাটের দিকে রওনা দিলাম পাকা রাস্তা ধরে। মাঝখানে থামলাম ইউনিয়ন পরিষদে।
মহীপুর একেবারে তিস্তা নদীর তীরে পুরোনো হাট। এই সেই মহীপুর হাট, হাকিমুদ্দিন নামের এক চাষি আজ থেকে ২৮ বছর আগে তামাকের ন্যায্য দাম না পাওয়ার জন্য শতশত মানুষের সামনে, প্রকাশ্য দিবালোকে বিক্রি করতে আনা তামাকের ওপর প্রস্রাব করে দিয়েছিলেন। সেই খবর মানুষ জেনেছিল মোনাজাত উদ্দিনের কল্যাণে। আজ এত দিন পর মহীপুর কিংবা লক্ষ্মীটারীর মানুষ হাকিমুদ্দিন বা মোনাজাত উদ্দিন কারও নামই আর মনে রাখেনি। হয়তো সেসব কথা মনে রেখে কোনো কাজ নেই। আটাশ বছর পরের সে হাট এখন গমগমে। যোগাযোগ ব্যবস্থার শনৈঃশনৈ উন্নতি হয়েছে। কেন্দ্রের সঙ্গে ২৪ ঘণ্টা যোগাযোগের জন্য মহীপুরেই তৈরি হয়েছে মহীপুর ব্রিজ। ৮৫০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ৯ দশমিক ৬০ মিটার প্রস্থের মহীপুর ব্রিজ এখন এ অঞ্চলের দর্শনীয় বস্তু। প্রতিদিন বিকেলে এখানে ঘুরতে আসেন সুখী মানুষেরা। ২৮ বছর আগে সেখানে ছিল খেয়াঘাট। তাকিয়ে দেখলাম, মহীপুর হাটের প্রায় মাঝখানে আর পাকা রাস্তাটার শ খানিক গজ দূরে একটি ক্লিনিক। সেখানেই কি রাতের বেলা ঘুমিয়েছিলেন মোনাজাত উদ্দিন? সম্ভবত। সে রকমই লিখেছেন তিনি।
মহীপুর হাটের বাঁ দিক দিয়ে তিস্তার বাঁধ ধরে চলতে শুরু করল রিকশা। প্রচুর মানুষ যাতায়াত করছে। কিন্তু এদের মধ্যে প্যানকাটু বর্মণের মতো কাউকে দেখা গেল না। এ এলাকায় সবাই এখন বেশ সুখী। হাড্ডিচর্মসার, কোটর থেকে বেরিয়ে আসা চোখের কোনো মানুষ নেই। শিক্ষার হার বেড়েছে, সরকারি পরিসংখ্যান তা-ই বলে। অনেক স্কুল হয়েছে, চোখেও পড়ে সেটা। নদীর পারের লোকজন হাঁসের খামার তৈরি করেছে—মাংস আর ডিম দুটোই মিলছে। চরে চাষ হচ্ছে ভুট্টা আর ধান। তামাকের চাষ একটু কম হলেও আছে। মাঝখান থেকে তিস্তাই ক্ষয়ে গেছে। চরে-চরে জীর্ণ এ নদীকে কেউ এখন আর মহানদী বলে না। বয়স্করা মাঝেমধ্যে দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্মৃতির জাবর কাটেন। সম্ভবত নদীর এ মৃত্যু তাঁরা চাননি। ভাঙলেও নদী তাঁদের অস্তিত্বের অংশ ছিল।
একটা জনপদ বার্গার বা স্যান্ডুইচের মতো। ওপর আর নিচ থেকে দেখলে এক রকম। কামড় বসালে আর এক রকম। জনপদ আর মানুষের গল্প সরকারি পরিসংখ্যানের চোখে দেখলে এক রকম, রসিকের চোখে আরেক রকম, আর মোনাজাত উদ্দিনের চোখে অন্য রকম। বাম বা ডান চোখে দেখলে আলাদা আলাদা । এনজিও আর উন্নয়নের চোখে দেখলে অন্য রকম। কোন চোখে দেখবেন সে বিবেচনা আপনার। মোনাজাত উদ্দিন এক জটিল রাষ্ট্রীয় কাঠামো আর তার চেয়েও জটিল ভিলেজ পলিটিক্স দেখেছিলেন লক্ষ্মীটারীতে। কিন্তু লিংক-ফার্লঙের হিসেবে ভাঙতে থাকা পারিবারিক গল্পটা দেখেননি। হয়তো সেটা দেখা তাঁর উদ্দেশ্যও ছিল না। কিন্তু ২৮ বছর পরের লক্ষ্মীটারী ভাঙতে ভাঙতে এজমালি শব্দটি এ-তে এসে ঠেকেছে। ইংরেজি এ-র অর্থ একটি। একক। সিঙ্গেল। বহুত্বের ঠাঁই নেই সেখানে। শরিকি পুকুর, শরিকি উঠোন, শরিকি মাটি, শরিকি ছায়া, এজমালি রোদ...শব্দগুলো লক্ষ্মীটারীতে এখন ‘তিস্তার ভাঙন’ শব্দের মতোই ঐতিহাসিক। নুরুল ইসলাম মেম্বার কিংবা মহীপুর হাটের চায়ের দোকানদার আহমদের সময়টাই এখন লিংক-ফার্লঙের হিসেব করে কাটে। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মঙ্গা কিংবা তিস্তার উন্মত্ত ঢেউ সামলাবার গল্প এখন নিখোঁজ। উন্মুক্ত অর্থনীতির যুগে সবাই এখন একক। নিঃসঙ্গ।
এজমালি রোদ গোধূলিতে। সূর্য তখন তিস্তার ওপারে কমলা আভা ছড়িয়ে ডুবতে চলেছে। আমরা চলেছি গঙ্গাচড়া শহরে। সন্ধ্যার শীত জেঁকে বসার আগেই পৌঁছাতে হবে সেখানে।
অটোরিকশাওয়ালা আমাকে ঠকিয়েছেন –বিষয়টি যখন বুঝলাম, তখন হাসি পেল। চালক ভেবেছিলেন, একটু ঘুরিয়ে কিছু বেশি টাকা নেবেন। কিন্তু তিনি বুঝতে পারেননি লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের একাংশ ঘোরা হয়ে গেছে আমার। রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার লক্ষ্মীটারী একটি ইউনিয়নের নাম। তিস্তা নদীর তীরে গড়ে ওঠা সে জনপদের কথা সবিস্তারে বলে গেছেন চারণ সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিন, আজ থেকে প্রায় ২৬ বছর আগে।
মোনাজাত উদ্দিন যখন ‘লক্ষ্মীটারী’ নামে তাঁর শেষ বইটি লেখেন তখন তাঁর বয়স ৪৯ বছর এবং আমার ১৪ বছর। লক্ষ্মীটারীতে গিয়েছি মোনাজাত উদ্দিন সেখানে যাওয়ার প্রায় ২৮ বছর পরের শীতকালে, এ বছরের জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি।
গঙ্গাচড়া থেকে সোজা যাওয়া যায় মহীপুর। কিন্তু ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার চালক আমাকে নিয়ে চললেন ঘুরপথে। বারবার তাঁকে জিজ্ঞেস করছিলাম, এটাই কি লক্ষ্মীটারী? তিনি, না মানে এটা ইউনিয়ন; লক্ষ্মীটারী নামে কোনো গ্রাম নেই, বলেই চলছিলেন। আমিও রিকশায় বসে আরামে দুদিক দেখতে দেখতে চলেছি। আর আমার স্মৃতিতে দোলা দিয়ে যাচ্ছে গত শতকের আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে দেখা উত্তরবঙ্গের পরিবেশ ও রাস্তাঘাট। সে সময়ের বড় মাটির রাস্তাগুলো এখন পিচ ঢালা পথ। কোথাও চওড়া, কোথাও সরু। বাঁশের চাটাইয়ে ঘেরা বাড়ি। ওপরে টিনের অথবা খড়ের চালা। এখন টিনের চালাই বেশি। বাড়ির পাশে বাঁশঝাড়। সামনে দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তার ধারে বাঁশের গায়ে শুকাতে দেওয়া গোবর নড়ি (পাটখড়িতে লাগানো গোবর)। গঙ্গাচড়ার এই অঞ্চল এখনো কিছুটা আশি-নব্বইয়ের দশকের মতো আছে। এখনো নিস্তরঙ্গ। তবে সমৃদ্ধির ছোঁয়া যে লেগেছে সেটা বোঝা যায় বিদ্যুতের খুঁটি, মোটর বাইক আর মাঝেমধ্যে ছাদপেটানো পাকা বাড়ি দেখে। শিহরণ জাগে, আজ থেকে প্রায় ২৮ বছর আগে কাঁধে ব্যাগ আর ক্যামেরা ঝুলিয়ে মোনাজাত উদ্দিন এই সব রাস্তায় ঘুরেছেন।
পুরোটাই যে এককালে তিস্তার চর ছিল, সেটা বোঝা যায় ভূমিরূপ দেখলেই। লক্ষ্মীটারী ইউনিয়ন পরিষদে যাওয়ার আগে পড়বে খানাটারী নামে একটি গ্রাম। রংপুর অঞ্চলে টারী শব্দটির অর্থ গ্রাম। যেমন দীঘলটারী, দর্জীটারী, শ্যাওড়াটারী...। খানাটারী পার হওয়ার সময় চোখে পড়ল আলুর খেত। যত দূর চোখ যায় শুধুই আলু। বিকেল বলে কোনো মানুষ নেই খেতে। আলুর গাছের পাতায় সকালের শিশির জমে আছে। শীত-বিকেলের কুয়াশামাখা আলোয় সেগুলো গাঢ় সবুজ। মাটির কাঁচা রাস্তা ধরে চলছে আমাদের অটোরিকশা। বাড়িগুলোর সামনের ছোট ছোট জমিতে চাষ করা হয়েছে রসুন, লাফা শাক। বাবর শাক—এতে হলুদ ফুল ফুটেছে। এগুলো বিক্রির জন্য নয়। বাড়িতে খাবারের জন্য। খানাটারীর একটি পাড়ার একটি দোকানের সামনে দাঁড়ালাম। উৎসুক মানুষ তাকিয়ে দেখছে। বয়স্ক একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, এটাই কি লক্ষ্মীটারী? তিনি বললেন, হয় হয় বাওয়া। এইটা লক্ষ্মীটারী ইউনিয়ন। যাইমেন কোনটে? বললাম, লক্ষ্মীটারী দেখতে এসেছি। তিনি হাসলেন। বললেন, দেইখবার কী আছে বাহে? আর কিছু না বলে ধন্যবাদ জানিয়ে এগিয়ে চললাম। পাশেই মহীপুর জামে মসজিদের সাইনবোর্ড চোখে পড়ল। মানে মহীপুর নামের একটি গ্রাম আমরা পার হচ্ছি।
এ রাস্তা ধরে সোজা গিয়ে উঠলাম আনুর বাজারে। বিখ্যাত কারও নামে রাখা হয়েছে বাজারের নাম। যে রাস্তাটা খানাটারী থেকে আনুর বাজারের পাকা রাস্তায় লেগেছে, সেটা বেশ বড় তিন রাস্তার মোড়। বাজারটিও বেশ জমজমাট। সেই মোড়ের ওপরেই দেখা হলো নুরুল ইসলাম মেম্বারের সঙ্গে। তিনি লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের তিনবারের নির্বাচিত মেম্বার ছিলেন। বয়স্ক বলে জিজ্ঞেস করলাম, বয়স কত চাচা? মেম্বার সাব জানালেন, বয়সবা কত হইল্ বাহে! ১৯৩২ সালে জন্ম হামার। হিসেব করে দেখলাম, নুরুল ইসলাম নামের যে মানুষটির সঙ্গে কথা বলছি তাঁর বয়স কমবেশি ৯০ বছর! কিন্তু তিনি দিব্যি বাজার করতে এসেছেন। অনেকক্ষণ কথা হলো তাঁর সঙ্গে। জানালেন, তিস্তার বানে একসময় কিছুই হতো না এলাকায়। এত দিনে লক্ষ্মীটারী এলাকার মানুষের কিছুটা সুখ হয়েছে। এখন এই এলাকায় আলু হয় প্রচুর। কিন্তু দাম পাঁচ টাকা কেজি।
এই আনুর বাজার থেকে মহীপুর প্রায় দুই কিলোমিটার। দুই হাটের মাঝখানে লক্ষ্মীটারী ইউনিয়ন পরিষদ। রাস্তাটা পাকা। এটা কাকিনা রোড। রংপুর শহর থেকে এই রোড ধরে সোজা চলে যাওয়া যায় কাকিনা, তুষভাণ্ডার। তার পরে আরও দূরে লালমনিরহাট। সেগুলো তিস্তার ওপারের জায়গা। আনুর বাজার থেকে মহীপুর হাটের দিকে রওনা দিলাম পাকা রাস্তা ধরে। মাঝখানে থামলাম ইউনিয়ন পরিষদে।
মহীপুর একেবারে তিস্তা নদীর তীরে পুরোনো হাট। এই সেই মহীপুর হাট, হাকিমুদ্দিন নামের এক চাষি আজ থেকে ২৮ বছর আগে তামাকের ন্যায্য দাম না পাওয়ার জন্য শতশত মানুষের সামনে, প্রকাশ্য দিবালোকে বিক্রি করতে আনা তামাকের ওপর প্রস্রাব করে দিয়েছিলেন। সেই খবর মানুষ জেনেছিল মোনাজাত উদ্দিনের কল্যাণে। আজ এত দিন পর মহীপুর কিংবা লক্ষ্মীটারীর মানুষ হাকিমুদ্দিন বা মোনাজাত উদ্দিন কারও নামই আর মনে রাখেনি। হয়তো সেসব কথা মনে রেখে কোনো কাজ নেই। আটাশ বছর পরের সে হাট এখন গমগমে। যোগাযোগ ব্যবস্থার শনৈঃশনৈ উন্নতি হয়েছে। কেন্দ্রের সঙ্গে ২৪ ঘণ্টা যোগাযোগের জন্য মহীপুরেই তৈরি হয়েছে মহীপুর ব্রিজ। ৮৫০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ৯ দশমিক ৬০ মিটার প্রস্থের মহীপুর ব্রিজ এখন এ অঞ্চলের দর্শনীয় বস্তু। প্রতিদিন বিকেলে এখানে ঘুরতে আসেন সুখী মানুষেরা। ২৮ বছর আগে সেখানে ছিল খেয়াঘাট। তাকিয়ে দেখলাম, মহীপুর হাটের প্রায় মাঝখানে আর পাকা রাস্তাটার শ খানিক গজ দূরে একটি ক্লিনিক। সেখানেই কি রাতের বেলা ঘুমিয়েছিলেন মোনাজাত উদ্দিন? সম্ভবত। সে রকমই লিখেছেন তিনি।
মহীপুর হাটের বাঁ দিক দিয়ে তিস্তার বাঁধ ধরে চলতে শুরু করল রিকশা। প্রচুর মানুষ যাতায়াত করছে। কিন্তু এদের মধ্যে প্যানকাটু বর্মণের মতো কাউকে দেখা গেল না। এ এলাকায় সবাই এখন বেশ সুখী। হাড্ডিচর্মসার, কোটর থেকে বেরিয়ে আসা চোখের কোনো মানুষ নেই। শিক্ষার হার বেড়েছে, সরকারি পরিসংখ্যান তা-ই বলে। অনেক স্কুল হয়েছে, চোখেও পড়ে সেটা। নদীর পারের লোকজন হাঁসের খামার তৈরি করেছে—মাংস আর ডিম দুটোই মিলছে। চরে চাষ হচ্ছে ভুট্টা আর ধান। তামাকের চাষ একটু কম হলেও আছে। মাঝখান থেকে তিস্তাই ক্ষয়ে গেছে। চরে-চরে জীর্ণ এ নদীকে কেউ এখন আর মহানদী বলে না। বয়স্করা মাঝেমধ্যে দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্মৃতির জাবর কাটেন। সম্ভবত নদীর এ মৃত্যু তাঁরা চাননি। ভাঙলেও নদী তাঁদের অস্তিত্বের অংশ ছিল।
একটা জনপদ বার্গার বা স্যান্ডুইচের মতো। ওপর আর নিচ থেকে দেখলে এক রকম। কামড় বসালে আর এক রকম। জনপদ আর মানুষের গল্প সরকারি পরিসংখ্যানের চোখে দেখলে এক রকম, রসিকের চোখে আরেক রকম, আর মোনাজাত উদ্দিনের চোখে অন্য রকম। বাম বা ডান চোখে দেখলে আলাদা আলাদা । এনজিও আর উন্নয়নের চোখে দেখলে অন্য রকম। কোন চোখে দেখবেন সে বিবেচনা আপনার। মোনাজাত উদ্দিন এক জটিল রাষ্ট্রীয় কাঠামো আর তার চেয়েও জটিল ভিলেজ পলিটিক্স দেখেছিলেন লক্ষ্মীটারীতে। কিন্তু লিংক-ফার্লঙের হিসেবে ভাঙতে থাকা পারিবারিক গল্পটা দেখেননি। হয়তো সেটা দেখা তাঁর উদ্দেশ্যও ছিল না। কিন্তু ২৮ বছর পরের লক্ষ্মীটারী ভাঙতে ভাঙতে এজমালি শব্দটি এ-তে এসে ঠেকেছে। ইংরেজি এ-র অর্থ একটি। একক। সিঙ্গেল। বহুত্বের ঠাঁই নেই সেখানে। শরিকি পুকুর, শরিকি উঠোন, শরিকি মাটি, শরিকি ছায়া, এজমালি রোদ...শব্দগুলো লক্ষ্মীটারীতে এখন ‘তিস্তার ভাঙন’ শব্দের মতোই ঐতিহাসিক। নুরুল ইসলাম মেম্বার কিংবা মহীপুর হাটের চায়ের দোকানদার আহমদের সময়টাই এখন লিংক-ফার্লঙের হিসেব করে কাটে। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মঙ্গা কিংবা তিস্তার উন্মত্ত ঢেউ সামলাবার গল্প এখন নিখোঁজ। উন্মুক্ত অর্থনীতির যুগে সবাই এখন একক। নিঃসঙ্গ।
এজমালি রোদ গোধূলিতে। সূর্য তখন তিস্তার ওপারে কমলা আভা ছড়িয়ে ডুবতে চলেছে। আমরা চলেছি গঙ্গাচড়া শহরে। সন্ধ্যার শীত জেঁকে বসার আগেই পৌঁছাতে হবে সেখানে।
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
২ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৯ দিন আগে