চিররঞ্জন সরকার
চলমান আন্দোলন ঘিরে সারা দেশে হিংসাত্মক ঘটনা বাড়ছে। মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। ভীতি বাড়ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম। দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতির প্রভাবে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ যতটা না ভুগছে, তার চেয়েও খারাপ পরিস্থিতি স্বল্প আয়ের মানুষগুলোর। শুধু টিয়ার গ্যাসের ঝাঁজেই নয়, মানুষ বাজার করতে গিয়েও এখন কাঁদছে।
শহরগুলোতে বেড়েছে সব ধরনের সবজির দাম। বিক্রেতারা বলছেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যে পাইকারি বাজারে পণ্যের সরবরাহ নেমেছে অর্ধেকে। এতে প্রতি কেজি সবজিতে দাম বেড়েছে ১০ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত। অবশ্য শিক্ষার্থীদের আন্দোলন অজুহাত মাত্র। এমনিতেই জিনিসপত্রের দাম ক্রমবর্ধমান। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক জরিপ থেকে জানা যায়, খাদ্য মূল্যস্ফীতি চলতি বছর রেকর্ড ১৫ শতাংশে পৌঁছেছে। অন্যদিকে, বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) তথ্যমতে, দেশে গত পাঁচ বছরে শুধু ভোগ্যপণ্যের দাম ৩১০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। চাল, চিনি, সয়াবিন তেল, গরুর মাংসের দাম বিশ্ববাজারের তুলনায় বাংলাদেশে বেশি।
অবশ্য আমাদের দেশে জীবনের দাম বাড়ে না, সৃজনশীলতা বা স্বপ্নের দাম বাড়ে না, এমনকি মানুষের দামও বাড়ে না। চারদিকে যে হারে মানুষ মারার ‘উৎসব’ চলছে, তাতে মনে হচ্ছে জীবন কত সস্তা! জীবনের দাম কমলেও বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম শুধুই বাড়ে। কারণে বাড়ে, অকারণে বাড়ে। বাড়তেই থাকে। দাম বাড়ার জন্য কোনো কারণও লাগে না। জিনিসপত্রের দাম বাজেটের আগে বাড়ে, পরেও বাড়ে। ঝড়, বৃষ্টি হলে বাড়ে, না হলেও বাড়ে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দাম বাড়লেও বাড়ে। নির্বাচিত ‘ঢিলেঢালা’ সরকারের শাসনামলে বাড়ে, এমনকি অনির্বাচিত ‘শক্ত’ সরকারের আমলেও বাড়ে। রমজানের আগে বাড়ে, পরেও বাড়ে। আন্দোলনের আগে বাড়ে, আন্দোলনের মধ্যে বাড়ে, পরেও বাড়ে। দাম একবার বাড়লে তা আর কমে না। আরও বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দাম কমলেও আমাদের দেশে দাম কমে না। এমনকি দেশে বাম্পার ফলন হলেও খাদ্যশস্যের দাম কমে না। মানুষের বয়সের মতো, আমাদের জীবনের সামগ্রিক হতাশার মতো জিনিসপত্রের দাম কেবল বাড়ে, বাড়তেই থাকে।
দাম আপনা-আপনি বাড়ে না, বাড়ানো হয়। বলা বাহুল্য, এ দাম বাড়ার ক্ষেত্রে আমদানিকারক, ব্যবসায়ী, আড়তদার, চাঁদাবাজ, আন্তর্জাতিক বাজার ইত্যাদির ভূমিকা থাকলেও সরকারি নীতির ভূমিকাও উপেক্ষণীয় নয়। তবে আশার কথা হচ্ছে, এসব নিয়ে মানুষের মধ্যে অসন্তোষ থাকলেও বড় বেশি ক্ষোভ নেই। এরও অবশ্য কারণ আছে। আমাদের দেশের শাসকেরা নানা কৌশলে মানুষের সহ্যশক্তি বাড়িয়ে দিয়েছে। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ধরে যদি একটু একটু করে নির্যাতন করা হয়, আঘাত করা হয়, তাহলে একসময় তা সয়ে যায়। এরপর আঘাতের মাত্রা বাড়ালেও খুব একটা ভাবান্তর হয় না। আমাদের দেশের মানুষকেও একটু একটু করে আঘাত ও নির্যাতন চালিয়ে সর্বংসহা বানিয়ে ফেলা হয়েছে।
তারপরও অবশ্য আমরা মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে মাথা ঘামাই। এটা নিয়ে আমাদের মাথা ঘামাতেই হয়। কারণ, বাঁচার জন্য আমাদের খেতে হয়, জিনিসপত্র কিনতে হয়; কাজেই দাম যত বেশিই হোক প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি আমাদের সংগ্রহ করতেই হবে। কম হোক, বেশি হোক, ভাত
হোক আলু হোক, আমিষ হোক আর নিরামিষ হোক, সাপ-ব্যাঙ-কুকুরই হোক, আর মরা মুরগি, রাসায়নিকমিশ্রিত সবজিই হোক, খেতে হবেই। না খেয়ে মানুষ বাঁচে না। বাঁচতে পারে না।
জিনিসপত্রের দাম ক্রমাগত কেন বাড়ছে, কী পরিমাণ বাড়ছে, এতে সরকারের ভূমিকা কতটুকু, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার প্রভাব কতটুকু আর ব্যবসায়ী বা মধ্যস্বত্বভোগীদের কারসাজি কতটুকু, এই দাম বাড়ার ফলে কারা ক্ষতিগ্রস্ত হলো, এর পরিণামই বা কী, এসব বিষয় নিয়ে অনেক আলোচনা ও গবেষণা হয়েছে, এখনো হচ্ছে, আশা করা যায় ভবিষ্যতে আরও অনেক হবে। কিন্তু তাতে পরিস্থিতি বদলায়নি; হয়তো বদলাবেও না। বাজারদর এখনো চড়া। চাল-ডাল, তরিতরকারি, চিনি-তেল, মাছ-মাংস, ডিম, দুধসহ প্রায় সব জিনিসপত্রের দামই বেশি।
এই দাম বেড়ে যাওয়া নিয়েও আছে পরস্পরবিরোধী মন্তব্য। সরকার দোষ দেয় ব্যবসায়ীদের। তাদের অতিমুনাফার লোভ আর মজুতদারি মানসিকতার কারণে দাম বাড়ে বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়। পক্ষান্তরে ব্যবসায়ীরা বলেন নানা কথা। তাঁদের মতে, উৎপাদন কম হওয়া, পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি, চাঁদাবাজি, আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি কারণেই মূল্যবৃদ্ধি ঘটে। দাম বাড়ার জন্য ব্যবসায়ীরা ইদানীং ক্রেতাদের দোষ দেন। ক্রেতারা এক কেজি লাগলে পাঁচ কেজি কেনেন, তাতে দাম বাড়ে বলে মন্তব্য করেন কোনো কোনো ব্যবসায়ী! পক্ষান্তরে ক্রেতাদের অভিযোগ, ব্যবসায়ীরা সুযোগ পেলেই দাম বাড়িয়ে দেন। ডাকাতি করেন। দাম বাড়ার জন্য ব্যবসায়ী-সরকার-ক্রেতা একে অপরকে দায়ী করছেন। তাতে অবশ্য জিনিসের দাম কমছে না!
আসলে ব্যবসায়ীদের দোষ দিয়েও লাভ নেই। কারণ তাঁরা যেকোনো উপায়ে কীভাবে মুনাফা বাড়ানো যায়, সেই চেষ্টা সততার সঙ্গেই করেন। তাঁদের ধর্মের দোহাই দিয়ে, ভয় দেখিয়ে লাভ বা মুনাফার আকাঙ্ক্ষা থেকে সরিয়ে আনা যাবে না। আর তাই আন্দোলনে-বন্যা-খরা ও রমজানে দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিও ‘নিয়তি’ হিসেবেই মেনে নিতে হবে!
আমাদের সমাজে ব্যবসায়ীদের ইমেজ খুব একটা ইতিবাচক নয়। সৎপথে থেকে সৎভাবে ব্যবসা করে বড় লাভের মুখ দেখা সম্ভব নয়, এমন একটা বদ্ধমূল ধারণা আমরা লালন করি। যাঁরা ব্যবসা করেন, তাঁরা চোরাপথে মাল কিনে, শ্রমিক-কর্মচারীদের ঠকিয়ে, ভেজাল বা নিম্নমানের জিনিস মিশিয়ে, ওজনে কম দিয়ে, মজুতদারি করে, দাম বাড়িয়ে, ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে বড়লোক হন বলে অনেকের বিশ্বাস।
তবে ব্যবসা-বাণিজ্যের মূল কথাই হচ্ছে লাভ। যেকোনো উপায়ে লাভ করাই একজন ব্যবসায়ীর প্রধান লক্ষ্য। শুধু লাভ নয়, মহা লাভ খোঁজেন তাঁরা। লাভ করতে গিয়ে কোনো ঝুটঝামেলা, ইনকাম ট্যাক্স, সেলস ট্যাক্স, কাস্টমস, পুলিশ, মামলা, অসন্তোষ, হরতাল, ধর্মঘটে জড়িয়ে না পড়েন, ব্যবসায়ীদের মনে এই আকাঙ্ক্ষাও প্রবলভাবে কাজ করে। ব্যবসা করা অবশ্য সহজ কাজ নয়। অনেক ঝানু ব্যক্তি ব্যবসা করতে গিয়ে ফতুর হয়েছেন, আবার অনেক হাঁদারামও ব্যবসায় সফল হয়ে কোটিপতি বনেছেন। উভয় প্রকার উদাহরণই আমাদের সমাজে ভূরি ভূরি আছে। প্রখর বুদ্ধি, কূট-কৌশল, কঠোর পরিশ্রম, অমিত আত্মবিশ্বাস, সেই সঙ্গে ভাগ্যদেবীর সুনজর—এসব না হলে ব্যবসায় সফল হওয়া যায় না।
হ্যাঁ, সেই সঙ্গে সততাও প্রয়োজন। আমরা ছোটবেলায় দেখতাম দোকানে কাচের ফ্রেমে বাঁধানো রয়েছে, ‘সততাই আমাদের একমাত্র মূলধন’। আজকাল অবশ্য এ রকম কোনো ঘোষণাপত্র কোনো দোকানে বা শোরুমের দেয়ালে দেখা যায় না। পুরো সমাজ থেকেই যেখানে সততা বিদায় হয়েছে, সেখানে দোকানে তা আর টিকে থাকবে কীভাবে? ব্যবসায় সততা বলতে যে কিছুই আর অবশিষ্ট নেই তেমন নয়, সততা এখনো আছে। তবে তা ভিন্ন সংজ্ঞায়, আলাদা মানে নিয়ে। এ প্রসঙ্গে একটি গল্প বলা যাক।
এক বৃদ্ধ ব্যবসায়ী তাঁর শিশু নাতিকে নিয়ে নিজের দোকানে এসেছেন। তিনি নাতিকে নিয়ে ক্যাশবাক্সের পেছনে গদিতে বসেছেন, পাশের দেয়ালেই ‘সততাই আমাদের মূলধন’ বিজ্ঞপ্তি ঝুলছে। নাতি পড়তে শিখেছে। সে ওটা দেখে পিতামহকে প্রশ্ন করল, ‘দাদু, সততা কী?’ দাদু বললেন, ‘সততা একটা খুব খাঁটি জিনিস। চট করে বোঝানো কঠিন। মনে করো আমি আর তুমি এ ব্যবসার অংশীদার। এখন একজন গ্রাহক এসে একটা জিনিস কিনে ১০ টাকা দিতে গিয়ে ভুল করে ২০ টাকার নোট তোমাকে দিয়ে চলে গেল। তুমিই ক্যাশবাক্সে বসেছ, তোমার অংশীদার আমি দোকানের অন্যদিকে রয়েছি। আমি দেখতে পাইনি গ্রাহক ভুল করে ১০ টাকা বেশি দিয়েছে। এখন তুমি যদি ওই ১০ টাকা থেকে আমাকে ৫ টাকা দাও, তাহলে সেটাই হলো তোমার সততা।’
নাতি বলল, ‘কিন্তু দাদু গ্রাহক...!’
দাদু বললেন, ‘গ্রাহকের কথা ভেব না, ওটা বাদ দাও।’
আগে মোটা অঙ্কের চাঁদার বিনিময়ে ব্যবসায়ীরা সরকারকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করতেন। তাঁদের স্বার্থের পক্ষে নীতি ও আইন প্রণয়নের জন্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হতো। বর্তমানে ব্যবসায়ীরাই রাজনীতিবিদ, রাজনীতিবিদরাই ব্যবসায়ী। এখন আর তোয়াজ-তোষামোদের বালাই নেই। এখন তাঁরাই সর্বেসর্বা। তাঁরা নিজেদের স্বার্থে আইন প্রণয়ন যেমন করছেন, নিজেদের প্রয়োজনে সেই আইনকে বুড়ো আঙুলও দেখান। দেখারও কেউ নেই আর বলারও কিছু নেই। তাঁরাই এখন নীতিনির্ধারক। দণ্ডমুণ্ডের কর্তা।
প্রশ্ন হলো, এই অচলায়তন কবে ভাঙবে কবে? কবে?
লেখক: চিররঞ্জন সরকার, গবেষক ও কলামিস্ট
চলমান আন্দোলন ঘিরে সারা দেশে হিংসাত্মক ঘটনা বাড়ছে। মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। ভীতি বাড়ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম। দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতির প্রভাবে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ যতটা না ভুগছে, তার চেয়েও খারাপ পরিস্থিতি স্বল্প আয়ের মানুষগুলোর। শুধু টিয়ার গ্যাসের ঝাঁজেই নয়, মানুষ বাজার করতে গিয়েও এখন কাঁদছে।
শহরগুলোতে বেড়েছে সব ধরনের সবজির দাম। বিক্রেতারা বলছেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যে পাইকারি বাজারে পণ্যের সরবরাহ নেমেছে অর্ধেকে। এতে প্রতি কেজি সবজিতে দাম বেড়েছে ১০ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত। অবশ্য শিক্ষার্থীদের আন্দোলন অজুহাত মাত্র। এমনিতেই জিনিসপত্রের দাম ক্রমবর্ধমান। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক জরিপ থেকে জানা যায়, খাদ্য মূল্যস্ফীতি চলতি বছর রেকর্ড ১৫ শতাংশে পৌঁছেছে। অন্যদিকে, বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) তথ্যমতে, দেশে গত পাঁচ বছরে শুধু ভোগ্যপণ্যের দাম ৩১০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। চাল, চিনি, সয়াবিন তেল, গরুর মাংসের দাম বিশ্ববাজারের তুলনায় বাংলাদেশে বেশি।
অবশ্য আমাদের দেশে জীবনের দাম বাড়ে না, সৃজনশীলতা বা স্বপ্নের দাম বাড়ে না, এমনকি মানুষের দামও বাড়ে না। চারদিকে যে হারে মানুষ মারার ‘উৎসব’ চলছে, তাতে মনে হচ্ছে জীবন কত সস্তা! জীবনের দাম কমলেও বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম শুধুই বাড়ে। কারণে বাড়ে, অকারণে বাড়ে। বাড়তেই থাকে। দাম বাড়ার জন্য কোনো কারণও লাগে না। জিনিসপত্রের দাম বাজেটের আগে বাড়ে, পরেও বাড়ে। ঝড়, বৃষ্টি হলে বাড়ে, না হলেও বাড়ে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দাম বাড়লেও বাড়ে। নির্বাচিত ‘ঢিলেঢালা’ সরকারের শাসনামলে বাড়ে, এমনকি অনির্বাচিত ‘শক্ত’ সরকারের আমলেও বাড়ে। রমজানের আগে বাড়ে, পরেও বাড়ে। আন্দোলনের আগে বাড়ে, আন্দোলনের মধ্যে বাড়ে, পরেও বাড়ে। দাম একবার বাড়লে তা আর কমে না। আরও বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দাম কমলেও আমাদের দেশে দাম কমে না। এমনকি দেশে বাম্পার ফলন হলেও খাদ্যশস্যের দাম কমে না। মানুষের বয়সের মতো, আমাদের জীবনের সামগ্রিক হতাশার মতো জিনিসপত্রের দাম কেবল বাড়ে, বাড়তেই থাকে।
দাম আপনা-আপনি বাড়ে না, বাড়ানো হয়। বলা বাহুল্য, এ দাম বাড়ার ক্ষেত্রে আমদানিকারক, ব্যবসায়ী, আড়তদার, চাঁদাবাজ, আন্তর্জাতিক বাজার ইত্যাদির ভূমিকা থাকলেও সরকারি নীতির ভূমিকাও উপেক্ষণীয় নয়। তবে আশার কথা হচ্ছে, এসব নিয়ে মানুষের মধ্যে অসন্তোষ থাকলেও বড় বেশি ক্ষোভ নেই। এরও অবশ্য কারণ আছে। আমাদের দেশের শাসকেরা নানা কৌশলে মানুষের সহ্যশক্তি বাড়িয়ে দিয়েছে। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ধরে যদি একটু একটু করে নির্যাতন করা হয়, আঘাত করা হয়, তাহলে একসময় তা সয়ে যায়। এরপর আঘাতের মাত্রা বাড়ালেও খুব একটা ভাবান্তর হয় না। আমাদের দেশের মানুষকেও একটু একটু করে আঘাত ও নির্যাতন চালিয়ে সর্বংসহা বানিয়ে ফেলা হয়েছে।
তারপরও অবশ্য আমরা মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে মাথা ঘামাই। এটা নিয়ে আমাদের মাথা ঘামাতেই হয়। কারণ, বাঁচার জন্য আমাদের খেতে হয়, জিনিসপত্র কিনতে হয়; কাজেই দাম যত বেশিই হোক প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি আমাদের সংগ্রহ করতেই হবে। কম হোক, বেশি হোক, ভাত
হোক আলু হোক, আমিষ হোক আর নিরামিষ হোক, সাপ-ব্যাঙ-কুকুরই হোক, আর মরা মুরগি, রাসায়নিকমিশ্রিত সবজিই হোক, খেতে হবেই। না খেয়ে মানুষ বাঁচে না। বাঁচতে পারে না।
জিনিসপত্রের দাম ক্রমাগত কেন বাড়ছে, কী পরিমাণ বাড়ছে, এতে সরকারের ভূমিকা কতটুকু, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার প্রভাব কতটুকু আর ব্যবসায়ী বা মধ্যস্বত্বভোগীদের কারসাজি কতটুকু, এই দাম বাড়ার ফলে কারা ক্ষতিগ্রস্ত হলো, এর পরিণামই বা কী, এসব বিষয় নিয়ে অনেক আলোচনা ও গবেষণা হয়েছে, এখনো হচ্ছে, আশা করা যায় ভবিষ্যতে আরও অনেক হবে। কিন্তু তাতে পরিস্থিতি বদলায়নি; হয়তো বদলাবেও না। বাজারদর এখনো চড়া। চাল-ডাল, তরিতরকারি, চিনি-তেল, মাছ-মাংস, ডিম, দুধসহ প্রায় সব জিনিসপত্রের দামই বেশি।
এই দাম বেড়ে যাওয়া নিয়েও আছে পরস্পরবিরোধী মন্তব্য। সরকার দোষ দেয় ব্যবসায়ীদের। তাদের অতিমুনাফার লোভ আর মজুতদারি মানসিকতার কারণে দাম বাড়ে বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়। পক্ষান্তরে ব্যবসায়ীরা বলেন নানা কথা। তাঁদের মতে, উৎপাদন কম হওয়া, পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি, চাঁদাবাজি, আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি কারণেই মূল্যবৃদ্ধি ঘটে। দাম বাড়ার জন্য ব্যবসায়ীরা ইদানীং ক্রেতাদের দোষ দেন। ক্রেতারা এক কেজি লাগলে পাঁচ কেজি কেনেন, তাতে দাম বাড়ে বলে মন্তব্য করেন কোনো কোনো ব্যবসায়ী! পক্ষান্তরে ক্রেতাদের অভিযোগ, ব্যবসায়ীরা সুযোগ পেলেই দাম বাড়িয়ে দেন। ডাকাতি করেন। দাম বাড়ার জন্য ব্যবসায়ী-সরকার-ক্রেতা একে অপরকে দায়ী করছেন। তাতে অবশ্য জিনিসের দাম কমছে না!
আসলে ব্যবসায়ীদের দোষ দিয়েও লাভ নেই। কারণ তাঁরা যেকোনো উপায়ে কীভাবে মুনাফা বাড়ানো যায়, সেই চেষ্টা সততার সঙ্গেই করেন। তাঁদের ধর্মের দোহাই দিয়ে, ভয় দেখিয়ে লাভ বা মুনাফার আকাঙ্ক্ষা থেকে সরিয়ে আনা যাবে না। আর তাই আন্দোলনে-বন্যা-খরা ও রমজানে দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিও ‘নিয়তি’ হিসেবেই মেনে নিতে হবে!
আমাদের সমাজে ব্যবসায়ীদের ইমেজ খুব একটা ইতিবাচক নয়। সৎপথে থেকে সৎভাবে ব্যবসা করে বড় লাভের মুখ দেখা সম্ভব নয়, এমন একটা বদ্ধমূল ধারণা আমরা লালন করি। যাঁরা ব্যবসা করেন, তাঁরা চোরাপথে মাল কিনে, শ্রমিক-কর্মচারীদের ঠকিয়ে, ভেজাল বা নিম্নমানের জিনিস মিশিয়ে, ওজনে কম দিয়ে, মজুতদারি করে, দাম বাড়িয়ে, ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে বড়লোক হন বলে অনেকের বিশ্বাস।
তবে ব্যবসা-বাণিজ্যের মূল কথাই হচ্ছে লাভ। যেকোনো উপায়ে লাভ করাই একজন ব্যবসায়ীর প্রধান লক্ষ্য। শুধু লাভ নয়, মহা লাভ খোঁজেন তাঁরা। লাভ করতে গিয়ে কোনো ঝুটঝামেলা, ইনকাম ট্যাক্স, সেলস ট্যাক্স, কাস্টমস, পুলিশ, মামলা, অসন্তোষ, হরতাল, ধর্মঘটে জড়িয়ে না পড়েন, ব্যবসায়ীদের মনে এই আকাঙ্ক্ষাও প্রবলভাবে কাজ করে। ব্যবসা করা অবশ্য সহজ কাজ নয়। অনেক ঝানু ব্যক্তি ব্যবসা করতে গিয়ে ফতুর হয়েছেন, আবার অনেক হাঁদারামও ব্যবসায় সফল হয়ে কোটিপতি বনেছেন। উভয় প্রকার উদাহরণই আমাদের সমাজে ভূরি ভূরি আছে। প্রখর বুদ্ধি, কূট-কৌশল, কঠোর পরিশ্রম, অমিত আত্মবিশ্বাস, সেই সঙ্গে ভাগ্যদেবীর সুনজর—এসব না হলে ব্যবসায় সফল হওয়া যায় না।
হ্যাঁ, সেই সঙ্গে সততাও প্রয়োজন। আমরা ছোটবেলায় দেখতাম দোকানে কাচের ফ্রেমে বাঁধানো রয়েছে, ‘সততাই আমাদের একমাত্র মূলধন’। আজকাল অবশ্য এ রকম কোনো ঘোষণাপত্র কোনো দোকানে বা শোরুমের দেয়ালে দেখা যায় না। পুরো সমাজ থেকেই যেখানে সততা বিদায় হয়েছে, সেখানে দোকানে তা আর টিকে থাকবে কীভাবে? ব্যবসায় সততা বলতে যে কিছুই আর অবশিষ্ট নেই তেমন নয়, সততা এখনো আছে। তবে তা ভিন্ন সংজ্ঞায়, আলাদা মানে নিয়ে। এ প্রসঙ্গে একটি গল্প বলা যাক।
এক বৃদ্ধ ব্যবসায়ী তাঁর শিশু নাতিকে নিয়ে নিজের দোকানে এসেছেন। তিনি নাতিকে নিয়ে ক্যাশবাক্সের পেছনে গদিতে বসেছেন, পাশের দেয়ালেই ‘সততাই আমাদের মূলধন’ বিজ্ঞপ্তি ঝুলছে। নাতি পড়তে শিখেছে। সে ওটা দেখে পিতামহকে প্রশ্ন করল, ‘দাদু, সততা কী?’ দাদু বললেন, ‘সততা একটা খুব খাঁটি জিনিস। চট করে বোঝানো কঠিন। মনে করো আমি আর তুমি এ ব্যবসার অংশীদার। এখন একজন গ্রাহক এসে একটা জিনিস কিনে ১০ টাকা দিতে গিয়ে ভুল করে ২০ টাকার নোট তোমাকে দিয়ে চলে গেল। তুমিই ক্যাশবাক্সে বসেছ, তোমার অংশীদার আমি দোকানের অন্যদিকে রয়েছি। আমি দেখতে পাইনি গ্রাহক ভুল করে ১০ টাকা বেশি দিয়েছে। এখন তুমি যদি ওই ১০ টাকা থেকে আমাকে ৫ টাকা দাও, তাহলে সেটাই হলো তোমার সততা।’
নাতি বলল, ‘কিন্তু দাদু গ্রাহক...!’
দাদু বললেন, ‘গ্রাহকের কথা ভেব না, ওটা বাদ দাও।’
আগে মোটা অঙ্কের চাঁদার বিনিময়ে ব্যবসায়ীরা সরকারকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করতেন। তাঁদের স্বার্থের পক্ষে নীতি ও আইন প্রণয়নের জন্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হতো। বর্তমানে ব্যবসায়ীরাই রাজনীতিবিদ, রাজনীতিবিদরাই ব্যবসায়ী। এখন আর তোয়াজ-তোষামোদের বালাই নেই। এখন তাঁরাই সর্বেসর্বা। তাঁরা নিজেদের স্বার্থে আইন প্রণয়ন যেমন করছেন, নিজেদের প্রয়োজনে সেই আইনকে বুড়ো আঙুলও দেখান। দেখারও কেউ নেই আর বলারও কিছু নেই। তাঁরাই এখন নীতিনির্ধারক। দণ্ডমুণ্ডের কর্তা।
প্রশ্ন হলো, এই অচলায়তন কবে ভাঙবে কবে? কবে?
লেখক: চিররঞ্জন সরকার, গবেষক ও কলামিস্ট
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
২ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৬ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৬ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
১০ দিন আগে