মামুনুর রশীদ, নাট্যব্যক্তিত্ব
এক অদ্ভুত আলো-আঁধারির মধ্যে চলছে স্বদেশ। খুব দ্রুতই একটি রাষ্ট্রে এক বড় ধরনের পরিবর্তন হয়ে গেল। ছাত্র আন্দোলন এক অভ্যুত্থানে রূপ নিল। এটি আমাদের কাছে নতুন কিছু নয়। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে ছাত্রদের আন্দোলন থেকে এক বিরাট গণ-অভ্যুত্থানের জন্ম নিয়ে রক্তের বিনিময়ে রাষ্ট্রভাষা রক্ষা করা সম্ভব হয়েছিল। সেখানে যাঁরা রক্ত দিয়েছিলেন, তাঁরা আজও আমাদের কাছে এক মহৎ প্রেরণা। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে পাকিস্তানি বাহিনী মিছিলের সম্মুখে থাকা অবস্থায় আসাদকে গুলি করে, আসাদের শার্ট লাল হয়ে ওঠে। আসাদ আমাদের চেতনায়, আমাদের কাব্যে স্থান করে নিয়েছেন।
শামসুর রাহমান লিখেছিলেন ‘আসাদের শার্ট’। স্বৈরাচারবিরোধী গণ-অভ্যুত্থানে নূর হোসেন তাঁর বুক ও পিঠে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ লিখে স্বেচ্ছায় প্রাণ দিয়ে আন্দোলনের চেহারাটা খুব দ্রুতই পাল্টে দিয়েছিলেন।
সম্প্রতি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বুক চিতিয়ে আবু সাঈদের আত্মদান এই অভ্যুত্থানে প্রেরণা এবং প্রতীক হয়ে রইল। ইতিহাসে দেখা গেছে, এই সব আত্মত্যাগী মানুষ একেকটা লড়াইয়ের ঘটনাপ্রবাহকে দ্রুত এগিয়ে দেন। কিউবার মুক্তি আন্দোলনে এক কিশোরের কথা আমরা জানি। সান্তাক্লারা প্রদেশের রেডিও স্টেশনটি দখল করতে গিয়ে সে প্রাণ বিসর্জন দেয়। সেই কিশোরের আত্মত্যাগ লড়াইয়ের গতিকে অগ্নিগর্ভ করে তোলে।
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি এত দ্রুত গতি পেয়ে গেল যে শাসক দল অভ্যুত্থানের সামনে থেকে সরে গেল। মানুষের ক্রোধ ও সেই সঙ্গে একধরনের লোভ-লালসা নানা ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনল। গণভবন, সংসদ ভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অবাধ লুটতরাজ করা হলো। একের পর এক ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হলো। ২২টি শিল্পকলা একাডেমি, সেই সঙ্গে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা এবং জাদুঘরগুলো পুড়িয়ে দেওয়া হলো। টেলিভিশন ভবন, সেতু ভবন, শিশু একাডেমিসহ বিভিন্ন স্থাপনা, মেট্রোরেলের দুটি স্টেশন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে—এসব আক্রান্ত হলো।
আমাদের বিশ্বাস, ছাত্ররা এসব করেনি। রাজধানীতে ক্ষমতার পালাবদলে লুটতরাজ হয়, এটা আমাদের ইতিহাসেই আছে। দিল্লিতে নাদির শাহের লুণ্ঠন, পলাশীর যুদ্ধে সিরাজের পতনের পর মুর্শিদাবাদ লুণ্ঠন। এসব আমাদের জানা ইতিহাস। একটা সময়ে পার হওয়ার পর ছাত্র-জনতার প্রচেষ্টায় এই লুণ্ঠনকাজ কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসে।
সাম্প্রতিক আন্দোলনে স্বল্প সময়ের মধ্যে এত মানুষের মৃত্যু আমাদের ইতিহাসে আগে দেখা যায়নি। সেই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একদিকে নিষ্ঠুরতা এবং অন্যদিকে তাদের প্রাণহানিও লক্ষ করার মতো। তাই দেখা গেল, পুলিশ বাহিনী সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত হয়ে যায়। এ সময়ে শিক্ষার্থীরা এগিয়ে আসে এবং স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা রাজপথে নেমে আসে। অভিজ্ঞতা না থাকলেও কয়েক দিনের মধ্যে দক্ষতার সঙ্গে ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব পালন শুরু করে। অরক্ষিত জনপদে ডাকাতের হামলার খবর পাওয়া যায়। এ সময়ে আবারও ছাত্র-জনতা ও এলাকাবাসী রাত জেগে নিজ নিজ এলাকা পাহারা দিতে থাকে। একটা সময় মনে হলো, আমাদের দেশ আছে, মানুষ আছে কিন্তু রাষ্ট্রটা নেই। রাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষা প্রতিটি মানুষ রেডিও-টেলিভিশনের সংবাদের দিকে নজর রাখতে থাকে এবং আশা করতে থাকে কখন সেনাপ্রধান ভাষণ দেবেন, কখন একটি সরকার গঠন হবে, কে সরকারের প্রধান হয়ে আসবেন।
ছাত্রদের দাবি অনুযায়ী, ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। তিনি রাজি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশের মানুষ অপেক্ষা করত থাকে কখন তিনি দায়িত্ব নেবেন, কখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হবে। সময় যেন কাটতে চায় না। একসময় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পূর্ণাঙ্গ চেহারাটা আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মানুষ আশ্বস্ত হয়। তখনো পুলিশ বাহিনী আসেনি। এখন মানুষের আকাঙ্ক্ষা কখন থানা ও সড়কে পুলিশ আসবে। এ দেশের মানুষের মধ্যে পুলিশ সম্পর্কে খুব একটা উচ্চ ধারণা কখনোই জন্মায়নি। তবু দেখা গেল মানুষ পুলিশ চাইছে।
যখন ট্রাফিক পুলিশ রাস্তায় নামল, তখন সবাই স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল। টিভিতে যখন দেখা গেল থানায় থানায়, এমনকি পুড়ে যাওয়া থানার বাইরের দিকে চেয়ার-টেবিল নিয়ে পুলিশ কাজে বসেছে, খুব কার্যকর না হলেও মানুষ একটা স্বস্তির আশ্বাস পেয়েছে। এই সময়ে একটি মিলিটারি ভ্যান সামনে দিয়ে গেলেও মানুষের কাছে সেটাও একটা স্বস্তির প্রতীক।
কেন এমন হয়? পৃথিবীর দেশে দেশে সরকারের পালাবদল হয়, কিন্তু মানুষ নির্বিঘ্নে থাকে। এখানে সবচেয়ে বিঘ্ন ঘটে একটি জায়গায় তা হলো, সংখ্যালঘুদের নিয়ে। অথচ এই উপমহাদেশে সবচেয়ে অসাম্প্রদায়িক চেতনার দেশ বাংলাদেশ। ৩৩ হাজার মণ্ডপে দুর্গাপূজা হয়ে থাকে প্রতিবছর। দুর্গাপূজায় এক আনন্দের বন্যা ছড়িয়ে পড়ে। দু-চারটে জায়গায় একেবারেই লুণ্ঠন বা দখলের উদ্দেশ্যে দু-একটি ঘটনা ঘটে। কিন্তু সরকারের পালাবদলের সময় এই ঘটনাগুলো মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। গত ক্ষমতাসীন দলের সদস্যরা গা ঢাকা দেন এবং তাঁদের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়, নানা ধরনের ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এই ক্রান্তিকালটা জনগণকে সহ্য করতে হবে।
এবারে বিচার বিভাগ প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, সেখানে বড় ধরনের রদবদল শুরু হয়েছে। পুলিশ প্রশাসনেও তাই, সেখানেও রদবদলের সূচনা হয়েছে। ব্যাপক দুর্নীতি, ন্যায্যতা, মানবিক আচরণ—এসব ক্ষেত্রে একটা গুণগত পরিবর্তন সবারই প্রত্যাশা। সেই প্রত্যাশা পূরণ করা কতটা সম্ভব হবে আগামী দিনগুলোতে, তা স্পষ্ট নয়। মানুষ আঁধারে থাকতে চায় না, আলো দেখতে চায়। একজন আশাবাদী মানুষ হিসেবে আমরাও দেখতে চাই সমাজ গণতান্ত্রিক পরিবেশে নিরাপদ। কিন্তু দুঃখ হয় যে খুব স্থূল কিছু সম্পদ লুণ্ঠিত হলে, সেগুলো ফিরিয়ে আনা কঠিন নয় কিন্তু সেসব সংগ্রহ বা যেসব দলিল, পাঠাগারের দুর্লভ বই, শিল্প স্থাপনা, ভাস্কর্য যেগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে, সেগুলোর কী হবে? ইরাক যুদ্ধের সময় বাগদাদে পৃথিবীর বৃহত্তম লাইব্রেরিটি পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া হয়েছিল। অনেক ধরনের শতাব্দীপ্রাচীন দুর্লভ সব হাতে লেখা ক্যালিগ্রাফি কোরআন শরিফ নিঃশেষ হয়ে গেছে। ইচ্ছে করলেও মানুষ আর তা দেখতে পারবে না। গায়ক এবং চিত্রশিল্পী রাহুলের গৃহস্থালির জিনিসপাতি পুড়ে গেলেও সেগুলো ফিরিয়ে আনা যাবে। কিন্তু সংগৃহীত এবং তাঁর নিজের হাতে তৈরি করা নানা রকমের বাদ্যযন্ত্র সব গুঁড়িয়ে ফেলা হলো, তা কি আর ফিরে পাওয়া যাবে? এই সব গুরুতরভাবে আমাদের মনে রাখা দরকার।
আজ ১৫ আগস্ট আমাদের জাতির ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় আঁধারের দিন। সেই দিন ভোরে আমার তখনো ঘুম ভাঙেনি। আমার স্ত্রী চিৎকার করে বলতে লাগল, ‘ওঠো ওঠো। শেখ সাহেবের পরিবারসহ সবাইকে হত্যা করে ফেলেছে।’ আমি ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম। আমার স্ত্রীর হাতে রেডিও। রেডিওতে সেনাবাহিনীর মেজর ঘোষণা করে যাচ্ছেন যে আমরা শেখ মুজিবকে হত্যা করেছি। সেই সঙ্গে আরও অনেক কথা। কিছুক্ষণ পরেই দেখতে পেলাম পুরান ঢাকায় আমার বাসার সামনেই ছোট ছোট ট্রাকে করে সেনাসদস্যরা একই কথার পুনরাবৃত্তি করছেন। বেশ কিছুদিন ধরেই আমি একটা বিষণ্নতায় ভুগছিলাম, রাষ্ট্র পরিচালনায় কিছু বিষয় আমাকে খুবই পীড়া দিচ্ছিল। মুক্তিযুদ্ধ প্রত্যাগত আমি হয়তো অনেক বড় স্বপ্ন দেখছিলাম, কিন্তু মুহূর্তেই আমি ক্ষুব্ধ হলাম, একি! সে জন্য একজন নেতাকে, যিনি দেশের রাষ্ট্রপতি, তাঁকে সপরিবারে হত্যা করতে হবে? যেকোনো সরকারকে উৎখাত করতে হলে তার পেছনে বিরাট গণ-আন্দোলনের প্রয়োজন।
মনে পড়ে যায় সত্তরের নির্বাচনে জয় হয়েছে আওয়ামী লীগের। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও পাকিস্তানি নেতা ভুট্টোর ষড়যন্ত্রে ক্ষমতা আমরা পেলাম না এবং একাত্তরের মার্চ মাসে এই বিক্ষোভ বিশাল রূপ পেল। আমরা তখন ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকতাম। লুঙ্গি ও পাঞ্জাবি পরা হ্যান্ড মাইক দিয়ে বঙ্গবন্ধু নির্দেশনা দিচ্ছেন গোটা জাতিকে। কোনো টেলিভিশন বা বেতারে তাঁর ভাষণ প্রচার হচ্ছে না। শুধু হ্যান্ড মাইকটাই শক্তি। এরপর সাতই মার্চের রেসকোর্স মাঠের সেই বক্তব্য শুনতে গিয়েছিলাম। সেই বক্তব্য শোনার অভিজ্ঞতাও অবিস্মরণীয়। তিনি যখন পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডন হয়ে দেশে ফিরলেন, তখন আবেগে আমরা অশ্রুসিক্ত হয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের সময় নামাজ আদায় করে দুহাত তুলে বাংলাদেশের বহু মানুষ তাঁর কারামুক্তি
চেয়েছেন, তিনি যেন মুক্তি পান এবং ফিরে আসেন। তত দিনে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর আমাদের স্বাধীনতার প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়।
পরবর্তীকালে তাঁর দল ক্ষমতায় এসেছে। তাঁদের যদি কোনো ব্যর্থতা থেকে থাকে তার দায়ভার কে নেবে? কিন্তু দেখা গেল সরকার পতনের পর তাঁর বাড়িটি ভস্মীভূত করা হলো। মানুষের ক্ষোভ সরকারের প্রতি হতে পারে, কিন্তু যে মানুষটি পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সপরিবারে নিহত হলেন, তাঁর বাড়িটি এতগুলো বছর যখন অন্যরা ক্ষমতায় থেকেছে তখনো অক্ষত থেকেছে। আমরা যারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে স্বচক্ষে দেখেছি, তাঁর রাষ্ট্রক্ষমতায় ভুলভ্রান্তি থাকতে পারে, অনেক প্রত্যাশা করেছি তাঁর কাছ থেকে, প্রত্যাশা পূরণ না হলে বিষণ্ন হয়েছি। এত দ্রুত সময়ের মধ্যে এত বড় একজন রাষ্ট্রনায়ক যিনি পৃথিবীর অনেক বড় বড় বিপ্লবী ও রাষ্ট্রনায়কের বন্ধু হয়েছিলেন, মওলানা ভাসানীর পুত্রতুল্য স্নেহ পেয়েছেন, তাজউদ্দীন আহমদের মতো বিরল নেতা তাঁর কাছাকাছি থেকেছেন, তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী দলের নেতারাও তাঁকে শ্রদ্ধা করেছেন; জেলে যখন থেকেছেন, তখন ছাত্রনেতা থেকে শুরু করে বর্ষীয়ান নেতারা তাঁকে ভালোবাসতেন, সবার কষ্ট-যন্ত্রণা স্বচক্ষে দেখতেন, তিনি জেলময় ঘুরে বেড়াতেন। আজকের দিনে আমার মতো অনেকেই তাঁকে জানাবেন অন্তরের শ্রদ্ধা-ভালোবাসা এবং অসাম্প্রদায়িকতার একজন প্রবক্তা হিসেবে সব বাঙালি তাঁর প্রতি সশ্রদ্ধ চিত্তে সম্মান জানাবেন এবং সবার মর্মবাণীতেই একই সুর বেজে উঠবে।
এক অদ্ভুত আলো-আঁধারির মধ্যে চলছে স্বদেশ। খুব দ্রুতই একটি রাষ্ট্রে এক বড় ধরনের পরিবর্তন হয়ে গেল। ছাত্র আন্দোলন এক অভ্যুত্থানে রূপ নিল। এটি আমাদের কাছে নতুন কিছু নয়। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে ছাত্রদের আন্দোলন থেকে এক বিরাট গণ-অভ্যুত্থানের জন্ম নিয়ে রক্তের বিনিময়ে রাষ্ট্রভাষা রক্ষা করা সম্ভব হয়েছিল। সেখানে যাঁরা রক্ত দিয়েছিলেন, তাঁরা আজও আমাদের কাছে এক মহৎ প্রেরণা। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে পাকিস্তানি বাহিনী মিছিলের সম্মুখে থাকা অবস্থায় আসাদকে গুলি করে, আসাদের শার্ট লাল হয়ে ওঠে। আসাদ আমাদের চেতনায়, আমাদের কাব্যে স্থান করে নিয়েছেন।
শামসুর রাহমান লিখেছিলেন ‘আসাদের শার্ট’। স্বৈরাচারবিরোধী গণ-অভ্যুত্থানে নূর হোসেন তাঁর বুক ও পিঠে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ লিখে স্বেচ্ছায় প্রাণ দিয়ে আন্দোলনের চেহারাটা খুব দ্রুতই পাল্টে দিয়েছিলেন।
সম্প্রতি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বুক চিতিয়ে আবু সাঈদের আত্মদান এই অভ্যুত্থানে প্রেরণা এবং প্রতীক হয়ে রইল। ইতিহাসে দেখা গেছে, এই সব আত্মত্যাগী মানুষ একেকটা লড়াইয়ের ঘটনাপ্রবাহকে দ্রুত এগিয়ে দেন। কিউবার মুক্তি আন্দোলনে এক কিশোরের কথা আমরা জানি। সান্তাক্লারা প্রদেশের রেডিও স্টেশনটি দখল করতে গিয়ে সে প্রাণ বিসর্জন দেয়। সেই কিশোরের আত্মত্যাগ লড়াইয়ের গতিকে অগ্নিগর্ভ করে তোলে।
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি এত দ্রুত গতি পেয়ে গেল যে শাসক দল অভ্যুত্থানের সামনে থেকে সরে গেল। মানুষের ক্রোধ ও সেই সঙ্গে একধরনের লোভ-লালসা নানা ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনল। গণভবন, সংসদ ভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অবাধ লুটতরাজ করা হলো। একের পর এক ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হলো। ২২টি শিল্পকলা একাডেমি, সেই সঙ্গে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা এবং জাদুঘরগুলো পুড়িয়ে দেওয়া হলো। টেলিভিশন ভবন, সেতু ভবন, শিশু একাডেমিসহ বিভিন্ন স্থাপনা, মেট্রোরেলের দুটি স্টেশন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে—এসব আক্রান্ত হলো।
আমাদের বিশ্বাস, ছাত্ররা এসব করেনি। রাজধানীতে ক্ষমতার পালাবদলে লুটতরাজ হয়, এটা আমাদের ইতিহাসেই আছে। দিল্লিতে নাদির শাহের লুণ্ঠন, পলাশীর যুদ্ধে সিরাজের পতনের পর মুর্শিদাবাদ লুণ্ঠন। এসব আমাদের জানা ইতিহাস। একটা সময়ে পার হওয়ার পর ছাত্র-জনতার প্রচেষ্টায় এই লুণ্ঠনকাজ কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসে।
সাম্প্রতিক আন্দোলনে স্বল্প সময়ের মধ্যে এত মানুষের মৃত্যু আমাদের ইতিহাসে আগে দেখা যায়নি। সেই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একদিকে নিষ্ঠুরতা এবং অন্যদিকে তাদের প্রাণহানিও লক্ষ করার মতো। তাই দেখা গেল, পুলিশ বাহিনী সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত হয়ে যায়। এ সময়ে শিক্ষার্থীরা এগিয়ে আসে এবং স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা রাজপথে নেমে আসে। অভিজ্ঞতা না থাকলেও কয়েক দিনের মধ্যে দক্ষতার সঙ্গে ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব পালন শুরু করে। অরক্ষিত জনপদে ডাকাতের হামলার খবর পাওয়া যায়। এ সময়ে আবারও ছাত্র-জনতা ও এলাকাবাসী রাত জেগে নিজ নিজ এলাকা পাহারা দিতে থাকে। একটা সময় মনে হলো, আমাদের দেশ আছে, মানুষ আছে কিন্তু রাষ্ট্রটা নেই। রাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষা প্রতিটি মানুষ রেডিও-টেলিভিশনের সংবাদের দিকে নজর রাখতে থাকে এবং আশা করতে থাকে কখন সেনাপ্রধান ভাষণ দেবেন, কখন একটি সরকার গঠন হবে, কে সরকারের প্রধান হয়ে আসবেন।
ছাত্রদের দাবি অনুযায়ী, ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। তিনি রাজি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশের মানুষ অপেক্ষা করত থাকে কখন তিনি দায়িত্ব নেবেন, কখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হবে। সময় যেন কাটতে চায় না। একসময় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পূর্ণাঙ্গ চেহারাটা আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মানুষ আশ্বস্ত হয়। তখনো পুলিশ বাহিনী আসেনি। এখন মানুষের আকাঙ্ক্ষা কখন থানা ও সড়কে পুলিশ আসবে। এ দেশের মানুষের মধ্যে পুলিশ সম্পর্কে খুব একটা উচ্চ ধারণা কখনোই জন্মায়নি। তবু দেখা গেল মানুষ পুলিশ চাইছে।
যখন ট্রাফিক পুলিশ রাস্তায় নামল, তখন সবাই স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল। টিভিতে যখন দেখা গেল থানায় থানায়, এমনকি পুড়ে যাওয়া থানার বাইরের দিকে চেয়ার-টেবিল নিয়ে পুলিশ কাজে বসেছে, খুব কার্যকর না হলেও মানুষ একটা স্বস্তির আশ্বাস পেয়েছে। এই সময়ে একটি মিলিটারি ভ্যান সামনে দিয়ে গেলেও মানুষের কাছে সেটাও একটা স্বস্তির প্রতীক।
কেন এমন হয়? পৃথিবীর দেশে দেশে সরকারের পালাবদল হয়, কিন্তু মানুষ নির্বিঘ্নে থাকে। এখানে সবচেয়ে বিঘ্ন ঘটে একটি জায়গায় তা হলো, সংখ্যালঘুদের নিয়ে। অথচ এই উপমহাদেশে সবচেয়ে অসাম্প্রদায়িক চেতনার দেশ বাংলাদেশ। ৩৩ হাজার মণ্ডপে দুর্গাপূজা হয়ে থাকে প্রতিবছর। দুর্গাপূজায় এক আনন্দের বন্যা ছড়িয়ে পড়ে। দু-চারটে জায়গায় একেবারেই লুণ্ঠন বা দখলের উদ্দেশ্যে দু-একটি ঘটনা ঘটে। কিন্তু সরকারের পালাবদলের সময় এই ঘটনাগুলো মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। গত ক্ষমতাসীন দলের সদস্যরা গা ঢাকা দেন এবং তাঁদের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়, নানা ধরনের ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এই ক্রান্তিকালটা জনগণকে সহ্য করতে হবে।
এবারে বিচার বিভাগ প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, সেখানে বড় ধরনের রদবদল শুরু হয়েছে। পুলিশ প্রশাসনেও তাই, সেখানেও রদবদলের সূচনা হয়েছে। ব্যাপক দুর্নীতি, ন্যায্যতা, মানবিক আচরণ—এসব ক্ষেত্রে একটা গুণগত পরিবর্তন সবারই প্রত্যাশা। সেই প্রত্যাশা পূরণ করা কতটা সম্ভব হবে আগামী দিনগুলোতে, তা স্পষ্ট নয়। মানুষ আঁধারে থাকতে চায় না, আলো দেখতে চায়। একজন আশাবাদী মানুষ হিসেবে আমরাও দেখতে চাই সমাজ গণতান্ত্রিক পরিবেশে নিরাপদ। কিন্তু দুঃখ হয় যে খুব স্থূল কিছু সম্পদ লুণ্ঠিত হলে, সেগুলো ফিরিয়ে আনা কঠিন নয় কিন্তু সেসব সংগ্রহ বা যেসব দলিল, পাঠাগারের দুর্লভ বই, শিল্প স্থাপনা, ভাস্কর্য যেগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে, সেগুলোর কী হবে? ইরাক যুদ্ধের সময় বাগদাদে পৃথিবীর বৃহত্তম লাইব্রেরিটি পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া হয়েছিল। অনেক ধরনের শতাব্দীপ্রাচীন দুর্লভ সব হাতে লেখা ক্যালিগ্রাফি কোরআন শরিফ নিঃশেষ হয়ে গেছে। ইচ্ছে করলেও মানুষ আর তা দেখতে পারবে না। গায়ক এবং চিত্রশিল্পী রাহুলের গৃহস্থালির জিনিসপাতি পুড়ে গেলেও সেগুলো ফিরিয়ে আনা যাবে। কিন্তু সংগৃহীত এবং তাঁর নিজের হাতে তৈরি করা নানা রকমের বাদ্যযন্ত্র সব গুঁড়িয়ে ফেলা হলো, তা কি আর ফিরে পাওয়া যাবে? এই সব গুরুতরভাবে আমাদের মনে রাখা দরকার।
আজ ১৫ আগস্ট আমাদের জাতির ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় আঁধারের দিন। সেই দিন ভোরে আমার তখনো ঘুম ভাঙেনি। আমার স্ত্রী চিৎকার করে বলতে লাগল, ‘ওঠো ওঠো। শেখ সাহেবের পরিবারসহ সবাইকে হত্যা করে ফেলেছে।’ আমি ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম। আমার স্ত্রীর হাতে রেডিও। রেডিওতে সেনাবাহিনীর মেজর ঘোষণা করে যাচ্ছেন যে আমরা শেখ মুজিবকে হত্যা করেছি। সেই সঙ্গে আরও অনেক কথা। কিছুক্ষণ পরেই দেখতে পেলাম পুরান ঢাকায় আমার বাসার সামনেই ছোট ছোট ট্রাকে করে সেনাসদস্যরা একই কথার পুনরাবৃত্তি করছেন। বেশ কিছুদিন ধরেই আমি একটা বিষণ্নতায় ভুগছিলাম, রাষ্ট্র পরিচালনায় কিছু বিষয় আমাকে খুবই পীড়া দিচ্ছিল। মুক্তিযুদ্ধ প্রত্যাগত আমি হয়তো অনেক বড় স্বপ্ন দেখছিলাম, কিন্তু মুহূর্তেই আমি ক্ষুব্ধ হলাম, একি! সে জন্য একজন নেতাকে, যিনি দেশের রাষ্ট্রপতি, তাঁকে সপরিবারে হত্যা করতে হবে? যেকোনো সরকারকে উৎখাত করতে হলে তার পেছনে বিরাট গণ-আন্দোলনের প্রয়োজন।
মনে পড়ে যায় সত্তরের নির্বাচনে জয় হয়েছে আওয়ামী লীগের। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও পাকিস্তানি নেতা ভুট্টোর ষড়যন্ত্রে ক্ষমতা আমরা পেলাম না এবং একাত্তরের মার্চ মাসে এই বিক্ষোভ বিশাল রূপ পেল। আমরা তখন ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকতাম। লুঙ্গি ও পাঞ্জাবি পরা হ্যান্ড মাইক দিয়ে বঙ্গবন্ধু নির্দেশনা দিচ্ছেন গোটা জাতিকে। কোনো টেলিভিশন বা বেতারে তাঁর ভাষণ প্রচার হচ্ছে না। শুধু হ্যান্ড মাইকটাই শক্তি। এরপর সাতই মার্চের রেসকোর্স মাঠের সেই বক্তব্য শুনতে গিয়েছিলাম। সেই বক্তব্য শোনার অভিজ্ঞতাও অবিস্মরণীয়। তিনি যখন পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডন হয়ে দেশে ফিরলেন, তখন আবেগে আমরা অশ্রুসিক্ত হয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের সময় নামাজ আদায় করে দুহাত তুলে বাংলাদেশের বহু মানুষ তাঁর কারামুক্তি
চেয়েছেন, তিনি যেন মুক্তি পান এবং ফিরে আসেন। তত দিনে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর আমাদের স্বাধীনতার প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়।
পরবর্তীকালে তাঁর দল ক্ষমতায় এসেছে। তাঁদের যদি কোনো ব্যর্থতা থেকে থাকে তার দায়ভার কে নেবে? কিন্তু দেখা গেল সরকার পতনের পর তাঁর বাড়িটি ভস্মীভূত করা হলো। মানুষের ক্ষোভ সরকারের প্রতি হতে পারে, কিন্তু যে মানুষটি পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সপরিবারে নিহত হলেন, তাঁর বাড়িটি এতগুলো বছর যখন অন্যরা ক্ষমতায় থেকেছে তখনো অক্ষত থেকেছে। আমরা যারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে স্বচক্ষে দেখেছি, তাঁর রাষ্ট্রক্ষমতায় ভুলভ্রান্তি থাকতে পারে, অনেক প্রত্যাশা করেছি তাঁর কাছ থেকে, প্রত্যাশা পূরণ না হলে বিষণ্ন হয়েছি। এত দ্রুত সময়ের মধ্যে এত বড় একজন রাষ্ট্রনায়ক যিনি পৃথিবীর অনেক বড় বড় বিপ্লবী ও রাষ্ট্রনায়কের বন্ধু হয়েছিলেন, মওলানা ভাসানীর পুত্রতুল্য স্নেহ পেয়েছেন, তাজউদ্দীন আহমদের মতো বিরল নেতা তাঁর কাছাকাছি থেকেছেন, তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী দলের নেতারাও তাঁকে শ্রদ্ধা করেছেন; জেলে যখন থেকেছেন, তখন ছাত্রনেতা থেকে শুরু করে বর্ষীয়ান নেতারা তাঁকে ভালোবাসতেন, সবার কষ্ট-যন্ত্রণা স্বচক্ষে দেখতেন, তিনি জেলময় ঘুরে বেড়াতেন। আজকের দিনে আমার মতো অনেকেই তাঁকে জানাবেন অন্তরের শ্রদ্ধা-ভালোবাসা এবং অসাম্প্রদায়িকতার একজন প্রবক্তা হিসেবে সব বাঙালি তাঁর প্রতি সশ্রদ্ধ চিত্তে সম্মান জানাবেন এবং সবার মর্মবাণীতেই একই সুর বেজে উঠবে।
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
২ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৬ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৬ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৯ দিন আগে