চিররঞ্জন সরকার
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ২৪ দিন পর পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরেছিলেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাই বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বাংলাদেশের স্বাধীনতার মতোই তাৎপর্যপূর্ণ একটি ঘটনা। তিনি যদি ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে না আসতেন আর পাকিস্তানি সামরিক জান্তারা তাঁকে হত্যা করত, তাহলে আমরা আজকের এই বাংলাদেশ পেতাম কি না, সন্দেহ আছে। বঙ্গবন্ধুর সমালোচকদের কেউ কেউ এখনো বলেন, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি শাসকদের গ্রেপ্তারের সুযোগ না দিয়ে আত্মগোপন করতে পারতেন। আত্মগোপনে থেকে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে পারতেন। যাঁরা এ ধরনের কথা বলেন, তাঁরা আসলে সেই সময়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা সম্পর্কে জানেন না। প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো, বঙ্গবন্ধু রাজনীতি করেছেন সিংহ ও বীরের মতো। তিনি লুকোচুরি পছন্দ করতেন না। তিনি তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘আমি পালিয়ে থাকার রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না। কারণ আমি গোপন রাজনীতি পছন্দ করি না, আর বিশ্বাসও করি না (পৃ. ১৩৪)।’ ব্রিটিশ ধাঁচের সংসদীয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ছিল বঙ্গবন্ধুর পছন্দ।
আত্মগোপন না করে গ্রেপ্তার হওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল বঙ্গবন্ধুর জীবনের সবচেয়ে সঠিক সিদ্ধান্তের একটি। তিনি সাংবিধানিক ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথে ছিলেন বলেই সেদিন আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন মিলেছিল। আর মুক্তিসংগ্রামে বিশ্বজনমত বাংলাদেশের পক্ষে ছিল।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার হাতে গ্রেপ্তার হওয়া, পাকিস্তানের কারাগারে বন্দিত্ব, বন্দিদশা থেকে মুক্তি, মুক্তির পর লন্ডনে যাওয়া, সেখান থেকে দিল্লি হয়ে বাহাত্তরের ১০ জানুয়ারি স্বদেশে প্রত্যাবর্তন সম্পর্কে সবার পর্যবেক্ষণ এক রকম নয়। তবে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় একাত্তরের ১ মার্চ থেকে বাহাত্তরের ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তার প্রতিটিই যথার্থ ছিল।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গ্রেপ্তার হওয়া সম্পর্কে ১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারি ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘সেদিন সন্ধ্যায় আমার বাড়ি পাকিস্তান সামরিক জান্তার কমান্ডো বাহিনী ঘেরাও করেছিল। ওরা আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। প্রথমে ওরা ভেবেছিল, আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলে ওরা আমায় হত্যা করবে এবং প্রচার করে দেবে যে, ‘‘তারা যখন আমার সঙ্গে রাজনৈতিক আপসের আলোচনা করছিল, তখন দেশের চরমপন্থীরাই আমাকে হত্যা করেছে।’’ আমি বাড়ি থেকে বের হওয়া নিয়ে চিন্তা করলাম। আমি স্থির করলাম, আমি মরি, তবু আমার প্রিয় দেশবাসী রক্ষা পাক।...আমি ইচ্ছা করলে যেকোনো জায়গায় যেতে পারতাম। কিন্তু আমার দেশবাসীকে ছেড়ে আমি কেমন করে যাব? আমি তাদের নেতা। আমি সংগ্রাম করব। মৃত্যুবরণ করব। পালিয়ে যাব কেন? দেশবাসীর কাছে আমার আহ্বান ছিল তোমরা প্রতিরোধ গড়ে তোলো।...আমার মনের কথা ছিল, আজ আমি যদি আমার দেশের নেতা হিসেবে মাথা উঁচু রেখে মরতে পারি, তাহলে আমার দেশের মানুষের অন্তত লজ্জার কোনো কারণ থাকবে না। কিন্তু আমি ওদের কাছে আত্মসমর্পণ করলে, আমার দেশবাসী পৃথিবীর সামনে আর মুখ তুলে দাঁড়াতে পারবে না। আমি মরি, তাও ভালো। তবু আমার দেশবাসীর যেন মর্যাদার কোনো হানি না ঘটে।’
রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর আত্মমর্যাদাবোধ এবং দেশবাসীর সম্মানকে তিনি যেভাবে দেখেছেন, তার তুলনা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।
১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও মানুষের মনে ছিল শঙ্কা ও বিষাদের ছাপ। এ ছাড়া যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের পুনর্গঠন ও প্রশাসনিক কাঠামো পুনর্নির্মাণের মাধ্যমে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শারীরিক উপস্থিতি ছিল অনিবার্য। সেদিন বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতি যে কতটা প্রয়োজন ছিল, তা বর্তমান সময়ে বসে অনুভব করা যাবে না। তখন আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের অনেকেই মনে করেছিলেন, ‘আমরা সবাই রাজা’। কেউ কাউকে মানছিলেন না। তরুণ নেতারা অস্থায়ী সরকারের কোনো কথা শুনছিলেন না। একটি নৈরাজ্যের মতো অবস্থা ছিল ২৫টি দিন। তিনি না এলে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র জমা দিতেন কি না, সন্দেহ ছিল। ভারতীয় সৈন্যরাও হয়তো অত তাড়াতাড়ি ফিরে যেত না। অনেক দেশের স্বীকৃতি পেতেও বেগ পেতে হতো। তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিন থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব আরও সংহত হয়। ১০ জানুয়ারি আসলে বাঙালি জাতির স্বাধীনতাসংগ্রামের পরিপূর্ণতা লাভের দিন। এ দিন দেশবাসী তাদের প্রাণপ্রিয় নেতাকে ফিরে পেয়ে প্রাণভরে বিজয়ের পূর্ণ স্বাদ উপভোগ করেন। এ দিন থেকে বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রবেশ করে গণতন্ত্রের এক আলোকিত অভিযাত্রায়।
ইতিহাসকে বিচার করতে হয় সময়ের নিরিখে। আজ বসে বসে হয়তো অনেক কথাই বলা যায়। কিন্তু সেদিনের ঘটনাগুলোকে মূল্যায়ন করতে হবে সেই সময়ের আলোকে। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য রেহমান সোবহান সেই সময়ের মূল্যায়ন করে বলেছেন, ‘সাধারণ লোকজন তো শুধু মনে করেছে একটা যুদ্ধের মধ্যে আমরা স্বাধীন হয়ে গেছি। আমাদের আর ভাবনা-চিন্তা কী? আমাদের নাগালে সবকিছুই চলে আসবে। দেশের ওই সব সাধারণ লোকের মধ্যে এ ভাবনাটাই স্বাভাবিক ছিল। কারণ, বঙ্গবন্ধুর প্রতি জনগণের ভালোবাসা ছিল তীব্র। মানুষ মনে করত তিনি সবকিছু করে ফেলতে পারবেন। সত্যিকার অর্থে ১৯৭২ সালে আমাদের অর্থনীতি পুরোপুরি ধ্বংস বা বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। আমাদের ইনফ্রাস্ট্রাকচার, রাস্তাঘাট ধ্বংস করে, দুটো বড় ব্রিজ পাকিস্তানিরা সাবোট্যাজ করে চলে যায়। হাইওয়েতে কোনো গাড়ি চলে না। যোগাযোগব্যবস্থা বলতে কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। ...প্ল্যানিং কমিশনের সদস্য হিসেবে বঙ্গবন্ধু আমাকে বললেন, “তুমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে দাঁড় করাও, অর্থাৎ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে অ্যালোকেট করে রিভাইভ করো।’’ সব তো তখন আমার হাতেই ছিল। এসব কঠিন কাজ তিন বছরের মধ্যে যে কিছু একটা হয়েছে, এটা তো কল্পনার বাইরে, এত শিগগিরই আমরা কিছু একটা দাঁড় করাতে পেরেছিলাম, এটাই তো অনেক। তারপর তিন বছরের মধ্যে সবকিছু কি গোলাপবাগান হয়ে যাবে, এটা তো সম্ভব নয়। যত কিছু হয়েছে, সবই চ্যালেঞ্জিং সময়ের মধ্যে হয়েছে। তবে হয়েছে অনেক কিছুই, ওটা তো সম্ভব হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য, তিনি দিন-রাত পরিশ্রম করেছেন প্ল্যানিং কমিশন নিয়ে। তাঁর নজরে ছিল কীভাবে দেশের মজবুত অর্থনীতির ভিত রচনা করা যায়। তবে তাঁর আরও চাপ ছিল ডোনারের সঙ্গে, আমেরিকা তো ফুড শিপমেন্ট বন্ধ করে দিয়েছে বাংলাদেশে। ওই সময় ফুডের একটা সংকট বাইরে থেকে চলে আসে। ফলে সবকিছু তো তাঁকেই সামলাতে হচ্ছে। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে তখন আমরা এগোচ্ছিলাম। দেশ ও দেশের বাইরের নানা বৈরী পরিস্থিতি শেখ মুজিবুর রহমানকে সামাল দিতে হচ্ছিল। তবে এর মধ্য থেকেও সবার সঙ্গে তিনি পারসোনাল সম্পর্ক বজায় রাখতেন। ...যদি বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকতেন, তবে সাড়ে তিন বছরের কষ্টের ফসলের ওপর দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির মজবুত ভিত তৈরি হতো। সব তো ইতিহাস। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দেশ যে পথে গেল, হয়তো সে পথে যেত না। তিনি দেশকে একটা পূর্ণতা দিতে পারতেন, এটা আমার স্পেকুলেশন। আমার মনে হয়, আরেকটা ইতিহাস হতো। এত সংকটের দিন থাকত না। এত মারামারি, এত কষ্ট, এত রক্তপাত হয়তো হতো না (বণিক বার্তা, ১০ জানুয়ারি ২০২০)।’
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেশের রাজনীতি ক্রমেই অবক্ষয়গ্রস্ত হয়েছে। সুবিধাবাদিতা রাজনীতির মূল আদর্শ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দল, দেশ বা দেশের মানুষ নয়, সবার ওপরে স্থান পাচ্ছে ব্যক্তিগত স্বার্থ ও সুবিধা। এ জন্য এখন সবাই নেতা হতে মরিয়া। কর্মীর চেয়ে দলে এখন নেতা বেশি। অধিক নেতার সমারোহে মঞ্চও ভেঙে পড়ছে। গণমানুষের রাজনীতি, মানুষের জন্য আত্মত্যাগ ও স্বার্থত্যাগ, যা ছিল বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের আদর্শ, সেই রাজনীতি থেকে খোদ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের কেউ কেউ যেন সচেতনভাবে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে নিজেদের বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক দাবি করছেন।
বঙ্গবন্ধু তাঁর আত্মজীবনীতে স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘তিনি সব সময় শোষকের বিরুদ্ধে, শোষিতের পক্ষে।’ এখনকার নেতাদের অনেকেই যেন উল্টো পথের যাত্রী। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশে এখন একদিকে যেমন অনেক উন্নয়ন ঘটছে, অন্যদিকে বাড়ছে ধনবৈষম্য। বঙ্গবন্ধু শোষিতের পক্ষে যেভাবে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেছিলেন, আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতৃত্ব কি সেটা সেভাবে করছেন? মঞ্চের শোভা ও ভিড় বাড়ানো স্বার্থপর নেতা দিয়ে আদৌ দলের বা দেশের কোনো উপকার হবে কি? বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিন এই প্রশ্ন নিয়ে সবারই ভাবা দরকার।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ২৪ দিন পর পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরেছিলেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাই বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বাংলাদেশের স্বাধীনতার মতোই তাৎপর্যপূর্ণ একটি ঘটনা। তিনি যদি ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে না আসতেন আর পাকিস্তানি সামরিক জান্তারা তাঁকে হত্যা করত, তাহলে আমরা আজকের এই বাংলাদেশ পেতাম কি না, সন্দেহ আছে। বঙ্গবন্ধুর সমালোচকদের কেউ কেউ এখনো বলেন, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি শাসকদের গ্রেপ্তারের সুযোগ না দিয়ে আত্মগোপন করতে পারতেন। আত্মগোপনে থেকে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে পারতেন। যাঁরা এ ধরনের কথা বলেন, তাঁরা আসলে সেই সময়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা সম্পর্কে জানেন না। প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো, বঙ্গবন্ধু রাজনীতি করেছেন সিংহ ও বীরের মতো। তিনি লুকোচুরি পছন্দ করতেন না। তিনি তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘আমি পালিয়ে থাকার রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না। কারণ আমি গোপন রাজনীতি পছন্দ করি না, আর বিশ্বাসও করি না (পৃ. ১৩৪)।’ ব্রিটিশ ধাঁচের সংসদীয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ছিল বঙ্গবন্ধুর পছন্দ।
আত্মগোপন না করে গ্রেপ্তার হওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল বঙ্গবন্ধুর জীবনের সবচেয়ে সঠিক সিদ্ধান্তের একটি। তিনি সাংবিধানিক ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথে ছিলেন বলেই সেদিন আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন মিলেছিল। আর মুক্তিসংগ্রামে বিশ্বজনমত বাংলাদেশের পক্ষে ছিল।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার হাতে গ্রেপ্তার হওয়া, পাকিস্তানের কারাগারে বন্দিত্ব, বন্দিদশা থেকে মুক্তি, মুক্তির পর লন্ডনে যাওয়া, সেখান থেকে দিল্লি হয়ে বাহাত্তরের ১০ জানুয়ারি স্বদেশে প্রত্যাবর্তন সম্পর্কে সবার পর্যবেক্ষণ এক রকম নয়। তবে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় একাত্তরের ১ মার্চ থেকে বাহাত্তরের ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তার প্রতিটিই যথার্থ ছিল।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গ্রেপ্তার হওয়া সম্পর্কে ১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারি ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘সেদিন সন্ধ্যায় আমার বাড়ি পাকিস্তান সামরিক জান্তার কমান্ডো বাহিনী ঘেরাও করেছিল। ওরা আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। প্রথমে ওরা ভেবেছিল, আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলে ওরা আমায় হত্যা করবে এবং প্রচার করে দেবে যে, ‘‘তারা যখন আমার সঙ্গে রাজনৈতিক আপসের আলোচনা করছিল, তখন দেশের চরমপন্থীরাই আমাকে হত্যা করেছে।’’ আমি বাড়ি থেকে বের হওয়া নিয়ে চিন্তা করলাম। আমি স্থির করলাম, আমি মরি, তবু আমার প্রিয় দেশবাসী রক্ষা পাক।...আমি ইচ্ছা করলে যেকোনো জায়গায় যেতে পারতাম। কিন্তু আমার দেশবাসীকে ছেড়ে আমি কেমন করে যাব? আমি তাদের নেতা। আমি সংগ্রাম করব। মৃত্যুবরণ করব। পালিয়ে যাব কেন? দেশবাসীর কাছে আমার আহ্বান ছিল তোমরা প্রতিরোধ গড়ে তোলো।...আমার মনের কথা ছিল, আজ আমি যদি আমার দেশের নেতা হিসেবে মাথা উঁচু রেখে মরতে পারি, তাহলে আমার দেশের মানুষের অন্তত লজ্জার কোনো কারণ থাকবে না। কিন্তু আমি ওদের কাছে আত্মসমর্পণ করলে, আমার দেশবাসী পৃথিবীর সামনে আর মুখ তুলে দাঁড়াতে পারবে না। আমি মরি, তাও ভালো। তবু আমার দেশবাসীর যেন মর্যাদার কোনো হানি না ঘটে।’
রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর আত্মমর্যাদাবোধ এবং দেশবাসীর সম্মানকে তিনি যেভাবে দেখেছেন, তার তুলনা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।
১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও মানুষের মনে ছিল শঙ্কা ও বিষাদের ছাপ। এ ছাড়া যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের পুনর্গঠন ও প্রশাসনিক কাঠামো পুনর্নির্মাণের মাধ্যমে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শারীরিক উপস্থিতি ছিল অনিবার্য। সেদিন বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতি যে কতটা প্রয়োজন ছিল, তা বর্তমান সময়ে বসে অনুভব করা যাবে না। তখন আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের অনেকেই মনে করেছিলেন, ‘আমরা সবাই রাজা’। কেউ কাউকে মানছিলেন না। তরুণ নেতারা অস্থায়ী সরকারের কোনো কথা শুনছিলেন না। একটি নৈরাজ্যের মতো অবস্থা ছিল ২৫টি দিন। তিনি না এলে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র জমা দিতেন কি না, সন্দেহ ছিল। ভারতীয় সৈন্যরাও হয়তো অত তাড়াতাড়ি ফিরে যেত না। অনেক দেশের স্বীকৃতি পেতেও বেগ পেতে হতো। তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিন থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব আরও সংহত হয়। ১০ জানুয়ারি আসলে বাঙালি জাতির স্বাধীনতাসংগ্রামের পরিপূর্ণতা লাভের দিন। এ দিন দেশবাসী তাদের প্রাণপ্রিয় নেতাকে ফিরে পেয়ে প্রাণভরে বিজয়ের পূর্ণ স্বাদ উপভোগ করেন। এ দিন থেকে বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রবেশ করে গণতন্ত্রের এক আলোকিত অভিযাত্রায়।
ইতিহাসকে বিচার করতে হয় সময়ের নিরিখে। আজ বসে বসে হয়তো অনেক কথাই বলা যায়। কিন্তু সেদিনের ঘটনাগুলোকে মূল্যায়ন করতে হবে সেই সময়ের আলোকে। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য রেহমান সোবহান সেই সময়ের মূল্যায়ন করে বলেছেন, ‘সাধারণ লোকজন তো শুধু মনে করেছে একটা যুদ্ধের মধ্যে আমরা স্বাধীন হয়ে গেছি। আমাদের আর ভাবনা-চিন্তা কী? আমাদের নাগালে সবকিছুই চলে আসবে। দেশের ওই সব সাধারণ লোকের মধ্যে এ ভাবনাটাই স্বাভাবিক ছিল। কারণ, বঙ্গবন্ধুর প্রতি জনগণের ভালোবাসা ছিল তীব্র। মানুষ মনে করত তিনি সবকিছু করে ফেলতে পারবেন। সত্যিকার অর্থে ১৯৭২ সালে আমাদের অর্থনীতি পুরোপুরি ধ্বংস বা বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। আমাদের ইনফ্রাস্ট্রাকচার, রাস্তাঘাট ধ্বংস করে, দুটো বড় ব্রিজ পাকিস্তানিরা সাবোট্যাজ করে চলে যায়। হাইওয়েতে কোনো গাড়ি চলে না। যোগাযোগব্যবস্থা বলতে কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। ...প্ল্যানিং কমিশনের সদস্য হিসেবে বঙ্গবন্ধু আমাকে বললেন, “তুমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে দাঁড় করাও, অর্থাৎ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে অ্যালোকেট করে রিভাইভ করো।’’ সব তো তখন আমার হাতেই ছিল। এসব কঠিন কাজ তিন বছরের মধ্যে যে কিছু একটা হয়েছে, এটা তো কল্পনার বাইরে, এত শিগগিরই আমরা কিছু একটা দাঁড় করাতে পেরেছিলাম, এটাই তো অনেক। তারপর তিন বছরের মধ্যে সবকিছু কি গোলাপবাগান হয়ে যাবে, এটা তো সম্ভব নয়। যত কিছু হয়েছে, সবই চ্যালেঞ্জিং সময়ের মধ্যে হয়েছে। তবে হয়েছে অনেক কিছুই, ওটা তো সম্ভব হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য, তিনি দিন-রাত পরিশ্রম করেছেন প্ল্যানিং কমিশন নিয়ে। তাঁর নজরে ছিল কীভাবে দেশের মজবুত অর্থনীতির ভিত রচনা করা যায়। তবে তাঁর আরও চাপ ছিল ডোনারের সঙ্গে, আমেরিকা তো ফুড শিপমেন্ট বন্ধ করে দিয়েছে বাংলাদেশে। ওই সময় ফুডের একটা সংকট বাইরে থেকে চলে আসে। ফলে সবকিছু তো তাঁকেই সামলাতে হচ্ছে। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে তখন আমরা এগোচ্ছিলাম। দেশ ও দেশের বাইরের নানা বৈরী পরিস্থিতি শেখ মুজিবুর রহমানকে সামাল দিতে হচ্ছিল। তবে এর মধ্য থেকেও সবার সঙ্গে তিনি পারসোনাল সম্পর্ক বজায় রাখতেন। ...যদি বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকতেন, তবে সাড়ে তিন বছরের কষ্টের ফসলের ওপর দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির মজবুত ভিত তৈরি হতো। সব তো ইতিহাস। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দেশ যে পথে গেল, হয়তো সে পথে যেত না। তিনি দেশকে একটা পূর্ণতা দিতে পারতেন, এটা আমার স্পেকুলেশন। আমার মনে হয়, আরেকটা ইতিহাস হতো। এত সংকটের দিন থাকত না। এত মারামারি, এত কষ্ট, এত রক্তপাত হয়তো হতো না (বণিক বার্তা, ১০ জানুয়ারি ২০২০)।’
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেশের রাজনীতি ক্রমেই অবক্ষয়গ্রস্ত হয়েছে। সুবিধাবাদিতা রাজনীতির মূল আদর্শ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দল, দেশ বা দেশের মানুষ নয়, সবার ওপরে স্থান পাচ্ছে ব্যক্তিগত স্বার্থ ও সুবিধা। এ জন্য এখন সবাই নেতা হতে মরিয়া। কর্মীর চেয়ে দলে এখন নেতা বেশি। অধিক নেতার সমারোহে মঞ্চও ভেঙে পড়ছে। গণমানুষের রাজনীতি, মানুষের জন্য আত্মত্যাগ ও স্বার্থত্যাগ, যা ছিল বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের আদর্শ, সেই রাজনীতি থেকে খোদ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের কেউ কেউ যেন সচেতনভাবে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে নিজেদের বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক দাবি করছেন।
বঙ্গবন্ধু তাঁর আত্মজীবনীতে স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘তিনি সব সময় শোষকের বিরুদ্ধে, শোষিতের পক্ষে।’ এখনকার নেতাদের অনেকেই যেন উল্টো পথের যাত্রী। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশে এখন একদিকে যেমন অনেক উন্নয়ন ঘটছে, অন্যদিকে বাড়ছে ধনবৈষম্য। বঙ্গবন্ধু শোষিতের পক্ষে যেভাবে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেছিলেন, আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতৃত্ব কি সেটা সেভাবে করছেন? মঞ্চের শোভা ও ভিড় বাড়ানো স্বার্থপর নেতা দিয়ে আদৌ দলের বা দেশের কোনো উপকার হবে কি? বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিন এই প্রশ্ন নিয়ে সবারই ভাবা দরকার।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
২ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৬ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৬ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
১০ দিন আগে