রুমা মোদক
‘বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি
শুষ্ক হৃদয় লয়ে আছে দাঁড়াইয়ে
ঊর্ধ্বমুখে নরনারী।।’
আমি যে শহরটিতে বাস করি, বছর দশেক আগেও বৈশাখজুড়ে এখানে চলত কালবৈশাখীর তাণ্ডব। জ্যৈষ্ঠের মধুফল পাকার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হতো আগাম বর্ষা। প্রায় প্রতিদিন বৃষ্টি। কখনো কখনো এই বৃষ্টি চলত সপ্তাহজুড়ে। স্থানীয় ভাষায় একে বলত, ‘গাদলা’। গাদলা নামলে উঠোন-বাড়ি সব কাদায় একাকার। দিনের পর দিন জমত ভেজা কাপড়চোপড়ের স্তূপ। ভেজা, স্যাঁতসেঁতে মাটিতে কেঁচো, জোঁক, ব্যাঙ এমনকি সাপের আনাগোনা বেড়ে যেত লোকালয়ে।
আমার সহকর্মী যাঁরা অন্য শহর থেকে চাকরিসূত্রে এখানে এসেছেন, দেখতাম খুব বিরক্ত হতেন। এ কী অবস্থা, খালি বৃষ্টি আর বৃষ্টি। আমার সব সময় বৃষ্টি খুব প্রিয়। মনে হতো সারা বছর বর্ষাকাল হলেও ক্ষতি নেই। দেখতে দেখতে চোখের সামনে পুরো ঋতুর প্রেক্ষাপট পাল্টে গেল। পাল্টে গেল আবহাওয়ার খোলনলচে।
এর আগে পাল্টাল শহরের চেহারা। শহরতলির মানচিত্র। এই শহর ছিল পুকুর, জলাশয় আর শতবর্ষী গাছের শহর। শহরে প্রবেশের একটিমাত্র রাস্তা ঢাকা-সিলেট হাইওয়ের দুই পাশে সবুজে সবুজ চা-বাগান, গভীর অরণ্য আর বিস্তীর্ণ ধানখেত। লেখাপড়া করার সময় যখন কার্বন মনো-অক্সাইডের শহর ঢাকা ছেড়ে ক্রমেই নিজ শহরের দিকে ঢুকতাম, মনে হতো যেন ‘দাও ফিরে সে অরণ্য লও এ নগর’-এর মোহময়তায় প্রবেশ করছি।
এই শহরে এখন একটাও ডালপালা, শিকড় মেলে দেওয়া শিরীষগাছ নেই। সব কাটা পড়েছে উন্নয়নের করাতকলে। মাইলের পর মাইল ধানি জমিতে এখন ইন্ডাস্ট্রির পর ইন্ডাস্ট্রি। বাংলাদেশের বড় বড় শিল্প কারখানার সব কটি সাম্রাজ্য বিস্তার করেছে এখানে। সবুজের পর সবুজ ছেয়ে গেছে ইটভাটার কালো ধোঁয়ায়। শ্যামল-সবুজ গ্রামগুলো এখন ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়া।
হারিয়ে গেছে আমার শহরের শীতল বাতাস, অঝোর বৃষ্টি আর গাদলার দিন। এই শহর এখন উত্তপ্ত কড়াইয়ের মতো এক অসহনীয় আবাসস্থল। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ছোট এক টুকরো উদাহরণ। এই সময়ে এসে কেউ সেই সময়ের শহরটার ছবি কল্পনাও করতে পারবে না।
আমি আমার শহরকে দেখে টের পাই কী করে উন্নয়নের নামে, বাণিজ্যের খাতিরে, মানুষের বাড়তি টাকার ফুটানিতে আমরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছি প্রাকৃতিক পরিবেশের। যার ফল ভোগ করছি প্রচণ্ড গরমে, তীব্র শীতে।
মানুষ সভ্যতার পথ ধরে এগিয়েছে প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে করেই। হিংস্র শ্বাপদ, বিষাক্ত কীটপতঙ্গের সঙ্গে লড়াই করে, চাষাবাদের অযোগ্য জমিকে চাষযোগ্য করে, ঘন জঙ্গল কেটে বসবাসযোগ্য করে, পাহাড় থেকে নেমে আসা জলধারা খাওয়ার উপযোগী পরিশুদ্ধ করে, গাছ কেটে আরামে কাটানোর আসবাব বানিয়ে মানুষ সভ্য হয়েছে।কিন্তু সভ্যতার শিখর স্পর্শ করতে গিয়ে মানুষ ভুলে গেছে সে প্রকৃতির সন্তান। প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে করতে সে প্রকৃতিকে ধ্বংসই করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। মূলত পুঁজির ক্রমাগত উত্থান আর পার্থিব বিলাসের জাঁতাকলে তছনছ হচ্ছে প্রকৃতির স্বাভাবিক ধারা। এ যেন যন্ত্র দিয়ে মুক্তধারার জলকে বাঁধার মহোৎসব, যেমনটি রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন মুক্তধারা নাটকে—শিবতরাইয়ের লোকজন ভাবতেই পারে না, দেবতা তাদের যে জল দিয়েছেন, মানুষ তা বন্ধ করতে পারে!
মানুষ তা বন্ধই তো করছে না কেবল, ধ্বংস করতে করতে ডেকে এনেছে নিজের ধ্বংস, ধ্বংসের প্রান্তসীমায় আজ এই অসহনীয় যাপন। গরমে হাঁসফাঁস, বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা আর শীতে জবুথবু। নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ার সংজ্ঞা পর্যুদস্ত করে চরম ভাবাপন্ন হয়ে উঠেছে।
আবহাওয়া বা বছরের পর বছর ধরে এর যে গড়, জলবায়ুর ক্ষতি—মূলত সবচেয়ে বেশি করে ধনী রাষ্ট্রগুলো; কিন্তু ফল ভোগ করে গরিব দেশ। বিপদ মোকাবিলার সক্ষমতা কম বলে গরিব দেশগুলোর এ ভোগান্তি, এই যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমজুড়ে গাছ লাগানোর ক্যাম্পেইন, তাতে কতটা ফল পাওয়া যাবে, কে জানে। আবহাওয়া কিংবা জলবায়ু পারস্পরিক সম্পর্কে যুক্ত। যারা ঘটা করে ধরিত্রী রক্ষার সম্মেলন করে, তাদের সদিচ্ছা না থাকলে এসব সম্মেলন আদতে লোকদেখানো পত্রিকার খবর হয়েই থাকবে। আর সাধারণ মানুষ দিনে দিনে আরও কঠিন পরিস্থিতিতে পতিত হবে।
লেখক: সাহিত্যিক
‘বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি
শুষ্ক হৃদয় লয়ে আছে দাঁড়াইয়ে
ঊর্ধ্বমুখে নরনারী।।’
আমি যে শহরটিতে বাস করি, বছর দশেক আগেও বৈশাখজুড়ে এখানে চলত কালবৈশাখীর তাণ্ডব। জ্যৈষ্ঠের মধুফল পাকার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হতো আগাম বর্ষা। প্রায় প্রতিদিন বৃষ্টি। কখনো কখনো এই বৃষ্টি চলত সপ্তাহজুড়ে। স্থানীয় ভাষায় একে বলত, ‘গাদলা’। গাদলা নামলে উঠোন-বাড়ি সব কাদায় একাকার। দিনের পর দিন জমত ভেজা কাপড়চোপড়ের স্তূপ। ভেজা, স্যাঁতসেঁতে মাটিতে কেঁচো, জোঁক, ব্যাঙ এমনকি সাপের আনাগোনা বেড়ে যেত লোকালয়ে।
আমার সহকর্মী যাঁরা অন্য শহর থেকে চাকরিসূত্রে এখানে এসেছেন, দেখতাম খুব বিরক্ত হতেন। এ কী অবস্থা, খালি বৃষ্টি আর বৃষ্টি। আমার সব সময় বৃষ্টি খুব প্রিয়। মনে হতো সারা বছর বর্ষাকাল হলেও ক্ষতি নেই। দেখতে দেখতে চোখের সামনে পুরো ঋতুর প্রেক্ষাপট পাল্টে গেল। পাল্টে গেল আবহাওয়ার খোলনলচে।
এর আগে পাল্টাল শহরের চেহারা। শহরতলির মানচিত্র। এই শহর ছিল পুকুর, জলাশয় আর শতবর্ষী গাছের শহর। শহরে প্রবেশের একটিমাত্র রাস্তা ঢাকা-সিলেট হাইওয়ের দুই পাশে সবুজে সবুজ চা-বাগান, গভীর অরণ্য আর বিস্তীর্ণ ধানখেত। লেখাপড়া করার সময় যখন কার্বন মনো-অক্সাইডের শহর ঢাকা ছেড়ে ক্রমেই নিজ শহরের দিকে ঢুকতাম, মনে হতো যেন ‘দাও ফিরে সে অরণ্য লও এ নগর’-এর মোহময়তায় প্রবেশ করছি।
এই শহরে এখন একটাও ডালপালা, শিকড় মেলে দেওয়া শিরীষগাছ নেই। সব কাটা পড়েছে উন্নয়নের করাতকলে। মাইলের পর মাইল ধানি জমিতে এখন ইন্ডাস্ট্রির পর ইন্ডাস্ট্রি। বাংলাদেশের বড় বড় শিল্প কারখানার সব কটি সাম্রাজ্য বিস্তার করেছে এখানে। সবুজের পর সবুজ ছেয়ে গেছে ইটভাটার কালো ধোঁয়ায়। শ্যামল-সবুজ গ্রামগুলো এখন ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়া।
হারিয়ে গেছে আমার শহরের শীতল বাতাস, অঝোর বৃষ্টি আর গাদলার দিন। এই শহর এখন উত্তপ্ত কড়াইয়ের মতো এক অসহনীয় আবাসস্থল। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ছোট এক টুকরো উদাহরণ। এই সময়ে এসে কেউ সেই সময়ের শহরটার ছবি কল্পনাও করতে পারবে না।
আমি আমার শহরকে দেখে টের পাই কী করে উন্নয়নের নামে, বাণিজ্যের খাতিরে, মানুষের বাড়তি টাকার ফুটানিতে আমরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছি প্রাকৃতিক পরিবেশের। যার ফল ভোগ করছি প্রচণ্ড গরমে, তীব্র শীতে।
মানুষ সভ্যতার পথ ধরে এগিয়েছে প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে করেই। হিংস্র শ্বাপদ, বিষাক্ত কীটপতঙ্গের সঙ্গে লড়াই করে, চাষাবাদের অযোগ্য জমিকে চাষযোগ্য করে, ঘন জঙ্গল কেটে বসবাসযোগ্য করে, পাহাড় থেকে নেমে আসা জলধারা খাওয়ার উপযোগী পরিশুদ্ধ করে, গাছ কেটে আরামে কাটানোর আসবাব বানিয়ে মানুষ সভ্য হয়েছে।কিন্তু সভ্যতার শিখর স্পর্শ করতে গিয়ে মানুষ ভুলে গেছে সে প্রকৃতির সন্তান। প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে করতে সে প্রকৃতিকে ধ্বংসই করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। মূলত পুঁজির ক্রমাগত উত্থান আর পার্থিব বিলাসের জাঁতাকলে তছনছ হচ্ছে প্রকৃতির স্বাভাবিক ধারা। এ যেন যন্ত্র দিয়ে মুক্তধারার জলকে বাঁধার মহোৎসব, যেমনটি রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন মুক্তধারা নাটকে—শিবতরাইয়ের লোকজন ভাবতেই পারে না, দেবতা তাদের যে জল দিয়েছেন, মানুষ তা বন্ধ করতে পারে!
মানুষ তা বন্ধই তো করছে না কেবল, ধ্বংস করতে করতে ডেকে এনেছে নিজের ধ্বংস, ধ্বংসের প্রান্তসীমায় আজ এই অসহনীয় যাপন। গরমে হাঁসফাঁস, বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা আর শীতে জবুথবু। নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ার সংজ্ঞা পর্যুদস্ত করে চরম ভাবাপন্ন হয়ে উঠেছে।
আবহাওয়া বা বছরের পর বছর ধরে এর যে গড়, জলবায়ুর ক্ষতি—মূলত সবচেয়ে বেশি করে ধনী রাষ্ট্রগুলো; কিন্তু ফল ভোগ করে গরিব দেশ। বিপদ মোকাবিলার সক্ষমতা কম বলে গরিব দেশগুলোর এ ভোগান্তি, এই যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমজুড়ে গাছ লাগানোর ক্যাম্পেইন, তাতে কতটা ফল পাওয়া যাবে, কে জানে। আবহাওয়া কিংবা জলবায়ু পারস্পরিক সম্পর্কে যুক্ত। যারা ঘটা করে ধরিত্রী রক্ষার সম্মেলন করে, তাদের সদিচ্ছা না থাকলে এসব সম্মেলন আদতে লোকদেখানো পত্রিকার খবর হয়েই থাকবে। আর সাধারণ মানুষ দিনে দিনে আরও কঠিন পরিস্থিতিতে পতিত হবে।
লেখক: সাহিত্যিক
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
৪ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৭ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৭ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
১১ দিন আগে